চরিত-কথা/উপাধ্যায়ের স্বাদেশিকতা
উপাধ্যায়ের স্বাদেশিকতা
আমাদের বর্ত্তমান স্বাদেশিকতার আদর্শ কতটা পরিমাণে যে আমরা ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট হইতে পাইয়াছি, দেশের লোকে যেন সে কথা ক্রমে ভুলিয়া যাইতেছে। নতুবা এত লোকের স্মৃতিকে জাগাইয়া রাখিবার জন্য কত চেষ্টা হইতেছে, কিন্তু উপাধ্যায় মহাশয়ের নামে একটা বাৎসরিক স্মৃতি-সভার আয়োজন পর্য্যন্ত হয় না কেন?
উপাধ্যায় সন্ন্যাসী ছিলেন। কিন্তু আমাদের বড় বড় সন্ন্যাসীদের যেমন শিষ্যসেবক থাকে, উপাধ্যায়ের সেরূপ শিষ্য-সেবক কেহ ছিল না। সে আকাঙ্ক্ষাও উপাধ্যায়ের ছিল বলিয়া মনে হয় না। তাঁর সন্ন্যাস অন্য ধরণের ছিল। গীতা যাহাকে সর্ব্বকর্ম্মন্যাস বলিয়াছেন, উপাধ্যায়ের সন্ন্যাস সে জাতীয় ছিল। আপনার বলিতে সংসারে তিনি কিছুই রাখেন নাই। আজন্ম ব্রহ্মচর্য্য সাধন করিয়া, তিনি এমন একটা অবস্থা লাভ করিয়াছিলেন, যাহাতে তাঁর অহং-জ্ঞানটা ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণতর সম্বন্ধ সকলকে একান্তভাবে অতিক্রম করিয়া সমগ্র বিশ্বে ছাইয়া পড়িয়াছিল। আমাদের আধুনিক কর্ম্মনায়কগণের মধ্যে উপাধ্যায়ের মতন আর কেহ এতটা পরিমাণে সর্ব্বভূতে আত্মদৃষ্টি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া জানি না।
সন্ন্যাসের অন্তরালে অনেক সময় একটা বুজুরগী লুকাইয়া থাকে। উপাধ্যায়ের অসাধারণ আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল। কিন্তু তাঁর প্রাণটা অতি বড় হইলেও, কোনও মতেই তাঁহাকে প্রচলিত অর্থে “বুজুর্গ্” বলা যাইত না। অতিলৌকিক কোনও কিছুর দাবী তিনি কখনও করেন নাই। এমন কি আপনি সংসার করেন নাই বলিয়া, সংসারী লোকের প্রতি তাঁহাকে কখনও কটাক্ষপাত করিতেও দেখি নাই!
সন্ন্যাসের সঙ্গে সচরাচর সমাজ-জীবনের একটা বিরোধ জাগিয়া উঠে। সন্ন্যাস লইয়া লোকে প্রায়ই সংসার ছাড়িয়া চলিয়া যায়। উপাধ্যায় সন্ন্যাসী হইয়াও সংসারত্যাগী হন নাই। ফলতঃ তাঁর মধ্যে চিরদিনই এমন একটা প্রবল ও সজীব সমাজানুগত্যের ভাব দেখিয়াছি, যার সঙ্গে আমাদের মধ্যযুগের হিন্দুয়ানীর সন্ন্যাসের আদর্শের কোনও প্রকারের আন্তরিক সঙ্গতিসাধন কখনও সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় নাই। আমাদের সন্ন্যাসীরাও কোনও কোনও বিষয়ে একান্তভাবেই লৌকিকাচারের বশ্যতা স্বীকার করিয়া চলেন, সত্য। কিন্তু উপাধ্যায়ের সমাজানুগত্যের সঙ্গে ইহাঁদের সমাজানুগত্যের একটা জাতিগত প্রভেদ ছিল বলিয়াই মনে হয়। আমাদের প্রাচীন মতের সন্ন্যাসিগণ লোকসংগ্রহার্থে, কর্ম্মাসক্ত জনগণের বুদ্ধিভেদ যাহাতে না জন্মায়, তারই জন্য, লৌকিকাচারের অনুবর্ত্তিতা করিয়া চলেন। উপাধ্যায়ের সমাজানুগত্যের অন্তরালে কোনও শোকসংগ্রহেচ্ছা কখনই দেখিতে পাই নাই। তাঁর অকৈতব স্বদেশভক্তির উপরেই এই অদ্ভুত সমাজানুগত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল।
আর ইহাই উপাধ্যায়ের স্বাদেশিকতার বিশেষত্ব ছিল। উপাধ্যায় তাঁর নিজের দেশকে ও সমাজকে যে চক্ষে দেখিতেন, আমরা আজি পর্য্যন্ত সে চক্ষু লাভ করিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। আমাদের স্বদেশপ্রেম অতি হাল্কা বস্তু। আমরা এ পর্য্যন্ত গোটা দেশটাকে ভাল বাসিতে শিখি নাই। আমরা দেশটাকে টুক্রা টুক্রা করিয়া দেখি। কিয়দংশ বা তার ভাল, আর কিয়দংশ বা তার মন্দ, এরূপ ভাবে স্বদেশের সভ্যতা ও সাধনার ভাল-মন্দের মধ্যে আমরা একটা ভাগ-বাটোয়ারা করিয়া, যেটুকু আমাদের চক্ষে বা বিচারে ভাল লাগে, তাহাকেই ভালবাসি; আর যেটুকু ভাল লাগে না, তাহাকে ঘৃণা করিয়া, তাহা হইতে নিজেদেরে যথাসাধ্য দূরে রাখিতে চেষ্টা করি।
কিন্তু প্রকৃত প্রেমের ধর্ম্ম এ নহে। ভাল-ও-মন্দ জড়িত যে প্রেমের পাত্র প্রেমিকের চিত্তকে আকর্ষণ করে, প্রেমিক তাহাকে গোটাভাবেই দেখে এবং গোটাভাবেই তাহাকে প্রীতি করে। যার এ প্রেম নাই, সে এ ভালমন্দ-মিশ্রিত বস্তুর বা ব্যক্তির ভালকেও ভাল করিয়া বোঝে না; মন্দকেও ভাল করিয়া ধরে না। প্রেমকে লোকে অন্ধ বলে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে প্রেমের মতন এমন চক্ষুষ্মান আর কিছুই নাই। প্রেম অপরের চাইতে কম দেখে না; বেশী দেখে। আর বেশী দেখে বলিয়াই প্রেমপাত্রের মন্দের মধ্যেও যে ভালটুকু লুকাইয়া আছে, সে তাহাকেও দেখে, শুধু মন্দটুকুকে দেখিয়াই তাহা হইতে ফিরিয়া আইসে না।
উপাধ্যায় ভারতবর্ষকে এবং ভারতবর্ষের পুরাগত সভ্যতা ও সাধনাকে এইরূপ প্রেমের চক্ষে দেখিতেন বলিয়াই তাঁর নিকটে স্বদেশ-বস্তু যেরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, আমাদের মধ্যে অতি অল্পলোকের নিকটেই সেরূপ করিয়াছে। অনেক সময় এ বিষয়ে উপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার গুরুতর মতবিরোধ উপস্থিত হইয়াছে। তিনি যে চক্ষে স্বদেশকে ও স্বদেশী সমাজকে দেখিতেন, আমি সে চক্ষে ঠিক দেখিতাম না। অথচ উপাধ্যায় যে নিরতিশয় রক্ষণশীল ছিলেন, বা যেটা যেমন আছে, সেটা ঠিক তেমনি থাকুক, ইহা যে তিনি চাহিতেন, এমন কথাও বলিতে পারি না। তিনি সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন। যে সমাজ যুগে যুগে রিবর্ত্তিত হয় না, তাহা মৃত, জড়; তার ভূতগৌরব যাহাই থাকুক না কেন, ভবিষ্যৎ-আশা যে কিছুই নাই, আমরা যেমন ইহা বুঝি, উপাধ্যায়ও ঠিক সেইরূপই বুঝিতেন। তাঁহাকে প্রকৃত অর্থে কিছুতেই “রি-অ্যাকষণারী” (Re-actionary) বলা সঙ্গত হইত না। অথচ, অন্যপক্ষে তিনি যে প্রচলিত অর্থে সংস্কারক বা Reformer ছিলেন, তাহাও নহে।
কারণ তিনি স্বদেশকে যে ভাবে, যতটা ভাল বাসিতেন ও ভক্তি করিতেন, কোনও সংস্কারকের পক্ষে তাহা আদৌ সম্ভব বলিয়াই বোধ হয় না। সংস্কারকের অন্তঃপ্রকৃতিটা যে কি, তাহা নিজের জীবনে, আর যৌবন-কালের চারিপাশের বন্ধুবান্ধবদিগের জীবনে সর্ব্বদাই প্রত্যক্ষ করিয়াছি। সংস্কারক সমাজের দোষভাগের প্রতি যতটা সজাগ থাকেন, তার গুণভাগের প্রতি ততটা সজাগ থাকিতেই পারেন না। থাকিলে তাঁর সংস্কার-বাসনার বেগটা কমিয়া যায়। আর যে প্রতিনিয়ত কেবল কোনও ব্যক্তির বা সমাজের হীনতারই আলোচনা করে, এবং এইরূপ আলোচনা করা কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়াই ভাবিয়া থাকে তার পক্ষে সে ব্যক্তির বা সে সমাজের প্রতি সতা ভালবাসা লাভ করা কখনই সম্ভব হইতে পারে না। ভালবাসা সুন্দরের সাক্ষাৎকারেই জন্মে, সুন্দরকেই চায়, সুন্দরের সন্ধানেই ফিরে। কুৎসিতের ধ্যানে বা দর্শনে বা চিন্তনে, ভালবাসা জন্মিতেই পারে না, বাড়িয়া ওঠা বা বাঁচিয়া থাকা তো বহু দূরের কথা। অথচ সমাজসংস্কারক প্রায়ই মক্ষিকাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সমাজ-দেহের ক্ষতস্থানগুলির চারিদিকেই সর্ব্বদা ভন ভন করিয়া বেড়ান; এরূপ না করিলে তাঁর ব্যবসায় টিকিয়া থাকিতে পারে না। এই কারণে এই জাতীয় সমাজ-সংস্কারক অনেক সময়ই আত্ম-সম্ভাবিত, ও মদান্বিত হইয়া উঠেন। আর এ অবস্থায় ইঁহাদের পক্ষে স্বদেশকে বা স্বদেশের সমাজকে সত্যভাবে বা গভীররূপে ভালবাসা যে অসম্ভব হইয়া উঠে, ইহা আর বিচিত্র কি? উপাধ্যায় প্রথম যৌবনে কিয়ৎপরিমাণে এ জাতীয় সমাজসংস্কারক যে ছিলেন না, এমন বলা কঠিন। কিন্তু ক্রমে তিনি সে ভাবটাকে ছাড়াইয়া উঠেন। বাংলা দেশে তিনি যে অভিনব দেশভক্তি প্রচার করিয়া গিয়াছেন, তাহা তাঁর পরিণত বয়সের দীর্ঘসাধনলব্ধ বস্তু; যৌবনের পরকীয়া প্রীতির মোহের মরীচিকা মাত্র নহে। তাঁরই জন্য এ বস্তু এতটা সাচ্চা ও সজীব হইয়াছিল।
উপাধ্যায় স্বদেশের ভালটুকুকে, স্বদেশী সমাজের শ্রেয়টুকুকে, স্বাদেশিক রীতিনীতির শোভনতাটুকুকেই ভাল করিয়া ধরিয়াছিলেন। ইহাতেই তাঁর উদার কোমল প্রাণ মজিয়া গিয়াছিল। তাই তিনি অমন করিয়া স্বদেশকে ও স্বদেশী সমাজকে, স্বদেশী সভ্যতা ও স্বদেশী সাধনাকে এতটা পরিমাণে প্রেম দিতে পারিয়াছিলেন। তাঁর চক্ষে আমাদের ভাল, আমাদের মন্দকে ছাপাইয়া উঠিত। আমাদের সৌন্দর্য্য, আমাদের কদর্য্যতাকে ঢাকিয়া ফেলিত। আমাদের অব্যক্ত শক্তি প্রকাশ্য দুর্ব্বলতার মায়িকতা মাত্র প্রমাণ করিত। তিনি আমাদের সিদ্ধিকে উপেক্ষা করিয়া সাধ্যের ধ্যান করিতেন। আমরা কি করিতেছি বা করিয়াছি তার বিচার না করিয়া আমরা কি করিতে পারি তারই সন্ধান করিতেন। আর এই জন্যই আমাদের ত্রুটি দুর্ব্বলতা প্রভৃতি কিছুতেই তাঁর প্রেমকে ব্যাহত করিতে পারিত না। এ বিষয়ে তিনি ভারতে সন্ত-সমাজ-সুলভ প্রখর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করিয়াছিলেন।
আমাদের সাধুসন্তেরা মানুষ কি আছে তাহা তত দেখেন না, সে সত্য বস্তুটা যে কি, ইহা জানেন বলিয়া, তাহার বর্ত্তমান দুর্গতি বা পাপকলুষ দর্শনে বিন্দু পরিমাণেও বিচলিত হন না। এ দু’দিনের কর্ম্মভোগ দু’দিনে ফুরাইয়া যাইবে। পথের ধূলামাটী চিরদিন গায়ে লাগিয়া থাকিবে না। একদিন না একদিন এগুলি আপনা হইতেই ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার হইয়া যাইবে। এ বিশ্বাস তাঁহাদের আছে বলিয়া কাহারও প্রতি তাঁহাদের প্রেমের বা আস্থার বা শ্রদ্ধার কোনও অল্পতা হয় না। উপাধ্যায়ও সেইরূপ এই ভারতবর্ষ আজি কি ভাবে পড়িয়া আছে, তাহার প্রতি দৃকৃপাত করিতেন না। ভারতবর্ষ সত্য বস্তুটী কি, ইহাই জানিয়াছিলেন ও ধরিয়াছিলেন বলিয়া তার বর্ত্তমান দুর্গতিতে বা হীনতায় বিন্দু পরিমাণেও তাঁর চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিত না। এ মোহ যে দুদিনের, এ মায়া যে ক্ষণস্থায়ী, এ দুর্দ্দশা যে শারদ প্রভাতের মেঘাড়ম্বরের ন্যায় আপনা হইতে কালক্রমে কাটিয়া যাইবেই যাইবে;—এ বিশ্বাস উপাধ্যায়ের মধ্যে যেমন দেখিয়াছি, এমন আর কাহারও মধ্যে দেখি নাই। আর উপাধ্যায়ের মধ্যে যে রক্ষণশীলতা দেখা যাইত, তাহা এই অটল বিশ্বাসেরই ফল। স্বদেশের সভ্যতার ও সাধনার, স্বদেশের সমাজ-প্রকৃতির ও লোক-প্রকৃতির উপরে উপাধ্যায়ের যেরূপ আস্থা ছিল, এমন আস্থা আমাদের মধ্যে আর কাহারও ছিল বলিয়া বিশ্বাস হয় না।
আর এই খানেই আমাদের বর্ত্তমান স্বাদেশিকতার আদর্শ পূর্ব্বযুগের স্বাদেশিকতার আদর্শ হইতে পৃথক্ হইয়া পড়ে। চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে আমাদের ইংরেজিশিক্ষিত সমাজে যে প্যাট্রিয়টিজ্ম্ জাগিয়া উঠিয়াছিল, তার মধ্যে স্বদেশের সভ্যতা ও সাধনার প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধা ও স্বদেশের শক্তিসাধ্যের উপরে এই অবিচলিত আস্থা কখনও দেখিতে পাওয়া যায় নাই। এ বস্তু আমাদের সে’কালের সমাজ-সংস্কারকদিগের মধ্যেও ছিল না, রাষ্ট্রসংস্কারক দলেও পাওয়া যাইত না। আর এই জন্মই প্রথম যুগের সমাজসংস্কার প্রয়াস ও রাষ্ট্রীয়-কর্ম্মচেষ্টা, উভয়ই একান্ত বহির্ম্মুখীন ও বিদেশাভিমুখীন ছিল। সুতরাং সে সময়ে আমরা আমাদের সমাজ জীবন, ধর্ম্মসাধন, কর্ম্মচেষ্টা, রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ,—স্বাদেশিকতার সকল উপকরণ গুলিকেই বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনার দাঁড়িপাল্লায় তুলিয়া তৌল করিতে যাইতাম।
আর পরের মাপে যে ব্যক্তি সর্ব্বদা এরূপভাবে আপনাকে ওজন করিতে যাইবে, তার আত্মজ্ঞানের স্ফূর্ত্তি কদাপি সম্ভবে না। এই কারণে আমাদের প্রথমযুগের সমাজসংস্কার ও রাষ্ট্রসংস্কার সকল প্রকারের স্বাদেশিক কর্ম্মচেষ্টাই আমাদিগের মধ্যে একটা গুরুতর আত্মবিস্মৃতি জন্মাইয়া দেয়। এবং এই সাংঘাতিক আত্মবিস্মৃতি হইতে একটা পরমুখাপেক্ষিতার অভ্যাস জন্মিয়া গিয়া, আমাদের সর্ব্ববিধ শক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা ও আস্ফালনকেই আমাদের আভ্যন্তরীণ দুর্ব্বলতা বৃদ্ধির একটা প্রবল ও নূতন কারণ করিয়া তুলে।
প্রচলিত সমাজসংস্কার-চেষ্টা এবং রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের এই বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করিয়া, উপাধ্যায় এই উভয়বিধ কর্ম্ম-চেষ্টারই তীব্র প্রতিবাদ করিতে আরম্ভ করেন। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আন্দোলন সর্ব্ববিষয়ে গবর্ণমেণ্টের মুখাপেক্ষী হইয়া, দেশের রাষ্ট্রশক্তিকে আত্মস্থ ও পরিপুষ্ট হইবার পথে অন্তরায় স্থাপন করিতেছিল। আবেদন-নিবেদনেই দেশের নবজাগ্রত রাষ্ট্রীয় কর্ম্মাকাঙ্ক্ষা আপনাকে নিঃশেষ করিয়া ফেলিতেছিল, জনশক্তিকে প্রবুদ্ধ করিয়াও এই সকল রাষ্ট্রীয় কর্ম্মচেষ্টা, সে শক্তিকে সংহত ও কার্য্যক্ষম করিয়া তুলিতে পারিতেছিল না। বরং প্রজা-সাধারণের নিজের হাতে আত্মচেষ্টাতে কোনও স্বাদেশিক কর্ম্মসাধনের ইচ্ছা ও প্রয়াসকে নষ্ট করিয়াই ফেলিতেছিল। এই জন্য উপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় জীবনে আত্মনির্ভর ও আত্মচেষ্টার আদর্শটীকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করেন। নিজের কোটে থাকিয়া, গবর্ণমেণ্টের দিকে একান্তভাবে মুখ ফিরাইয়া, শান্ত ও সমাহিত ভাবে আমরা জনশক্তির সংহতিতে সর্ব্ববিধ স্বাদেশিক কার্য্য সাধন করিব,—উপাধ্যায় সর্ব্বদা এই কথাই বলিতেন। গবর্ণমেণ্টের সঙ্গে বিরোধ বাঁধানই প্রথমাবধি যে তাঁর রাষ্ট্রীয় কর্ম্মচেষ্টার লক্ষ্য ছিল, এমন কথা বলা যায় না। ক্রমে, ঘটনাচক্রে, এরূপ একটা বিরোধের সূত্রপাত হয় সত্য; কিন্তু এই বিরোধকে উপাধ্যায় নিজে ইচ্ছা করিয়া জাগাইয়াছিলেন, এমন কথাও বলা যায় না। ফলতঃ দেশের তদানীন্তন অবস্থাধীনে গবর্ণমেণ্টের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া স্বাদেশিক কর্ম্ম করা নীতিসম্মত না হইলেও, চিরদিনই যে জন-মণ্ডলীর পক্ষে এরূপ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করা আবশ্যক বা বাঞ্ছনীয় বা সম্ভব, উপাধ্যায় এমনটা কখনও ভাবিতেন বলিয়া বোধ হয় না। সে সময়ে দেশ ঘোরতর তামসিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়াছিল বলিয়া তাহাকে একটা রাজসিক প্রেরণা প্রদান করা আবশ্যক হয়। এই জন্যই উপাধ্যায় জীবনের শেষ দশায় এই স্বাতন্ত্র্য-নীতি অবলম্বন করেন। কিন্তু রাজসিকতা ভারতের সভ্যতা ও সাধনার চিরন্তন বা উর্দ্ধতন লক্ষ্য যে নয়, উপাধ্যায় ইহা যেমন জানিতেন, এমন আর কেহ জানিতেন বলিয়াই বোধ হয় না। তবে যে সাত্ত্বিকতা চিরদিনই আমাদের সভ্যতা ও সাধনার চরম লক্ষ্য হইয়া আছে, সেই সাত্ত্বিকতাকে জাগাইতে হইলেই, সে অবস্থায়, প্রথমে দেশব্যাপী তামসিকতাকে রাজসিকতার দ্বারা অভিভূত করা আবশ্যক, উপাধ্যায় এ সত্যটাকে দৃঢ় করিয়া ধরিয়াছিলেন। রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রেই এই রাজসিকতাকে জাগাইয়া তোলা সহজ ও সর্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ। তাহাতে ভবিষ্যতের সাত্ত্বিকতার পথও উন্মুক্ত হইবে, অথচ সমাজে কোনও প্রকারের সাংঘাতিক অরাজকতার প্রতিষ্ঠারও কোন বিশেষ আশঙ্কা থাকে না। এই জন্যই উপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় জীবনে এই অভিনব স্বাতন্ত্র্যনীতি প্রচার করিয়াছিলেন। দেশের লোকের আত্মচৈতন্যকে জাগাইয়া তোলা, তাহাদিগের চক্ষুকে আপনার উপরে নিবদ্ধ করা, নিজের হাতে দেশের কাজ দশে মিলিয়া করিলে যে শিক্ষা, যে সংযম, যে শক্তি লাভ হয়, ইহাতে আপনাদের উপরে যে আস্থা জন্মে, ও এই আস্থার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণে যে উৎসাহ, অন্তরে যে আশা, পেশিতে যে বল সঞ্চারিত হয়, এই সকলের জন্যই উপাধ্যায় এই নীতি প্রচার করিতে প্রবৃত্ত হন, নতুবা গবর্ণমেণ্টের সঙ্গে গায়ে পড়িয়া বিরোধ বাঁধানই যে তাঁর অভিপ্রায় ছিল, এমন কথা কিছুতেই বলিতে পারি না।
কিন্তু উপাধ্যায় মহাশয়ের স্বাদেশিকতার সত্য আদর্শটাকে ধরিতে হইলে, বিশেষভাবে তাঁর সমাজ-নীতির আলোচনা করা আবশ্যক। কারণ এখানেই তাঁর স্বাদেশিকতার নিজস্ব স্বরূপটী ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
উপাধ্যায়ের সমাজ-নীতি
উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব মহাশয় স্বদেশবস্তুকে কতটা যে ভাল বাসিতেন, তাঁর ঐকান্তিক সমাজানুগত্যই ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। হিন্দু সাধনা পরিহার করিয়া, সাধনান্তর গ্রহণ করিয়াও তিনি এই সমাজানুগত্য বর্জ্জন করেন নাই। বরং এই বিদেশীয় ধর্ম্মসাধনকেই, আপনার জীবনে, সম্পূর্ণরূপে, নিজের দেশের সমাজ-বিধানের সঙ্গে মিলাইয়া লইবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন।
কেহ কেহ উপাধ্যায় মহাশয়ের এই সমাজানুগত্যের অন্তরালে কেবল একটা অর্থহীন ও অযৌক্তিক রক্ষণশীলতাই দেখিতেন। প্রথম বয়সে উপাধ্যায় না কি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়া ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কারের পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। এই জন্য তাঁর পরিণত বয়সের এই সমাজানুগত্যকে কেহ কেহ, বিশেষতঃ তাঁর পূর্ব্বকার ধর্ম্মবন্ধুগণ, পুরাতন কুসংস্কারের দিকে পুনরাবর্ত্তন বা রি-অ্যাক্ষণ (re-action) বলিয়া মনে করিতেন। কিন্তু উপাধ্যায়কে এ জাতীয় রক্ষণশীল বা এই শ্রেণীর পুনরাবর্ত্তনকারী বা রি-অ্যাকষণারী (re-actionary) বলা যাইতে পারে কি না সন্দেহ।
উপাধ্যায়ের মধ্যে একটা প্রকৃত শ্রদ্ধার ভাব ছিল, এ কথাটা সকলে জানেন না ও বোঝেন না। “সন্ধ্যা”-পত্রিকার সম্পাদক বলিয়াই বাঙ্গালী সমাজে উপাধ্যায় বিশেষ ভাবে পরিচিত হইয়াছিলেন। আর “সন্ধ্যাতে” প্রায়ই সমাজের, বিশেষ নব্যশিক্ষাভিমানী সম্প্রদায়ের, কোনও কোনও শ্রেষ্ঠজন সম্বন্ধে এরূপ কঠোর, তীব্র, কখনও কখনও বা গভীর বিদ্রুপাত্মক প্রবন্ধ প্রকাশিত হইত যে এগুলি পড়িয়া অপরিচিত লোকে কোনও প্রকারেই সম্পাদককে এক জন শ্রদ্ধাশীল লোক বলিয়া কল্পনা করিতে পারিত না। কিন্তু উপাধ্যায়কে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে জানিতেন, তাঁরা তাঁহার কথাবার্ত্তায় কখনও প্রকৃত শ্রদ্ধাশীলতার অভাব দেখিয়াছেন কি না সন্দেহ। পল্লীর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য, পল্লীবাসীর কাহাকেও না কাহাকেও তার আবর্জ্জনরাশি পরিষ্কৃত করা অত্যাবশ্যক হয়। অত্যাবশ্যকীয় কর্ম্ম যে করিতে যাইবে, তার হাতে ও গায়ে কিছু না কিছু ময়লাও লাগিবেই লাগিবে। কিন্তু দশের হিতের জন্য এ কাজ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে বলিয়া সে বাক্তি যে স্বভাবতঃই আবর্জ্জনা ভালবাসে, এমন কথা যেমন বলা সঙ্গত হয় না, সেইরূপ সময়বিশেষে সমাজের নৈতিক বা রাষ্ট্রীয় আবর্জ্জনা পরিষ্কার করা প্রয়োজন হইলে, সমাজের শ্রেষ্ঠজনকেও সর্ব্বসমক্ষে অপদস্থ করা আবশ্যক হইতে পারে। আর সে অবস্থায়, সে অপ্রীতিকর কর্ম্ম যদি কেহ করে, তাহাতে তাহাকে স্বল্পবিস্তর হীনতাও স্বীকার করিতেই হয়। কিন্তু তাই বলিয়া সে নির্ব্বিকার-চিত্ত দেশসেবককে হীনচরিত্রের লোক বলিয়া মনে করা কখনই সঙ্গত হয় না। উপাধ্যায় সম্বন্ধেও এই কথাই খাটে। “সন্ধ্যা” পত্রিকায় সমাজের কোনও কোনও শ্রেষ্ঠজনকে যখন তখন তীব্রভাবে আক্রমণ করা হইত বলিয়া, সম্পাদকের প্রকৃতিতে যে একটা স্বাভাবিকী শ্রদ্ধাশীলতা ছিল না, একেবারে সরাসরিভাবে এমন সিদ্ধাত্ত করা যায় না।
ফলতঃ উপাধ্যায় “সন্ধ্যা” পরিচালনা করিতে যাইয়া, আপনার অন্তরকে কতটা পরিমাণে যে নিপীড়িত করিতেন, বহুদিন কাছে থাকিয়া, এক সঙ্গে কাজকর্ম্ম করিয়া, তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। এ সকল আক্রমণ যে সর্ব্বদা তিনি নিজে লিপিবদ্ধ করিতেন, তাহাও নহে। তবে অপর লেখকদিগের প্রবন্ধাদির উপরে তিনি প্রায়ই হস্তক্ষেপ করিতেন না। আর সমাজের “মেকি” নেতৃত্ব ও স্বদেশ-সেবার প্রভাব নষ্ট হইলে, সত্য ও সজীব স্বাদেশিকতা কখনই ফুটিয়া উঠিবে না, ইহাও তিনি মনে করিতেন। এই জন্য আর কোনও কিছু বিচার না করিয়া উপাধ্যায় এ সকল লেখা পত্রস্থ করিয়া দিতেন। নতুবা, সত্য সত্যই যে লোকনিন্দায় তাঁর আনন্দ হইত, তাহা নয়। আর এ সকলে তাঁর প্রাণগত শ্রদ্ধাশীলতার অভাবও সূচিত হইত না।
প্রকৃতিগত শ্রদ্ধাশীলতা হইতে, সর্ব্বত্রই এক প্রকারের রক্ষণশীলতাও জন্মিয়া থাকে। এই জাতীয় রক্ষণশীলতা উপাধ্যায়ের মধ্যে বেশই ছিল। তারই জন্য উপাধ্যায়ের হাত প্রাচীনের ও প্রতিষ্ঠিতের উপরে আঘাত করিতে সর্ব্বদাই সঙ্কুচিত হইত। এই জন্যই উপাধ্যায় প্রথম বয়সে আপনার কৌলিক ধর্ম্মে আস্থাহীন হইয়াও, একেবারে উৎকট ধর্ম্মসংস্কারক বা সমাজ-সংস্কারক হইয়া উঠেন নাই। ব্রাহ্মসমাজে আসিয়া, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যোগ না দিয়া, কেশবচন্দ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেন। কেশবচন্দ্রের নিজের চরিত্রে একটা রক্ষণশীলতা এবং তাঁহার শিষ্যবর্গের মধ্যে একটা শ্রদ্ধাশীলতা সর্ব্বদাই বিদ্যমান ছিল। এ বস্তু ব্রাহ্মসমাজের অপর শাখায় ততটা পাওয়া যায় নাই। উপাধ্যায়ের প্রকৃতিগত শ্রদ্ধাশীলতা শাস্ত্রগুরুবর্জ্জিত ব্রাহ্ম ধর্ম্মেতেও বেশি দিন তৃপ্তিলাভ করিতে পারিল না। এই শ্রদ্ধাশীলতার প্রেরণাতেই, আমার মনে হয়, উপাধ্যায় ব্রাহ্মসমাজ ছাড়িয়া প্রথমে প্রোটেষ্ট্যাণ্ট খৃষ্টীয় মণ্ডলীর ও শেষে রোমান ক্যাথলিক খৃষ্টীয় সঙ্ঘের আশ্রয় লইয়াছিলেন। আর এই খানেই, তাঁর— প্রকৃতিগত শ্রদ্ধাশীলতা ও রক্ষণশীলতার প্রভাবে উপাধ্যায়ের শেষ বয়সের সমাজনীতির মূল ভিত্তিটী গড়িয়া উঠিতে আরম্ভ করে।
সর্ব্বত্রই ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার আদর্শের সঙ্গে সমাজানুগত্যের একটা নিত্য বিরোধ জাগিয়া রহে। যেখানেই এই অনধীনতার ভাবটা প্রবল হইয়া উঠে, সেই খানেই সমাজানুগত্যটা ধর্ম্মবিগর্হিত বলিয়া, পরিত্যক্ত হয়। প্রোটেষ্ট্যাণ্ট খৃষ্টীয়ান্ সম্প্রদায়ে এই ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার ভাব খুবই প্রবল। এই জন্য ইহাদের মধ্যে সমাজানুগত্যও ক্রমশই কমিয়া গিয়াছে, এখন নাই বলিলেও চলে। অন্যদিকে রোমান ক্যাথলিক খৃষ্টীয় সঙ্ঘে, শাস্ত্র ও গুরু উভয়ের প্রাধান্য-মর্য্যাদা সমভাবে রক্ষিত হইয়া, ধর্ম্মসাধনে ও সমাজ-জীবনে, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার ভাবকে অনেকটা সংযত করিয়া রাখিয়াছে। এই জন্য এখানে সমাজানুগতা যে ধর্ম্মের একটা শ্রেষ্ঠ অঙ্গ, এ ভাবটা এ পর্য্যন্ত একেবারে নষ্ট হইয়া যায় নাই। এই কারণেই, রোমক-সঙ্ঘের আশ্রয় গ্রহণ করিবার সঙ্গে সঙ্গেই উপাধ্যায়ের সমাজানুগত্যের ভাবটাও পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে আরম্ভ করে।
অতএব এই সমাজানুগত্যটা ভাল হউক মন্দ হউক; যুক্তিসঙ্গত বা অযৌক্তিক আর যাহা কিছুই হউক না কেন, ইহার অন্তরালে যে একটা বিরাট ধর্ম্মতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব বিদ্যমান ছিল, এ কথাটা অস্বীকার করা যায় না। একটা খেয়ালের চাপে উপাধ্যায় প্রাচীন সমাজশাসন পরিত্যাগ করেন নাই; খেয়ালের চাপে তাহার পুনঃ-প্রতিষ্ঠার চেষ্টাতেও প্রবৃত্ত হন নাই। এই জন্য তাঁহাকে পুনরাবর্ত্তনকারী বা রি-অ্যাকষণারীও বলা যায় না।
ফলতঃ আমাদের সমাজের যাহা যেরূপ আছে, তাহা সেইরূপই থাকিবে বা থাকা বাঞ্ছনীয়, উপাধ্যায়কে কোনও দিন এমন কথা বলিতে শুনি নাই। “বন্দে মাতরম্” পত্র প্রতিষ্ঠার সময়ে এই সম্বন্ধে উপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়। নূতন কাগজ সমাজ-সংস্কার সম্বন্ধে কি নীতি অবলম্বন করিবে, ইহাই আমাদের উভয়ের বিচার্য্য বিষয় ছিল। বন্দে মাতরম্ সর্ব্ব বিষয়ে উদার সংস্কারের সমর্থন করিবে, আমি এই কথা বলি। উপাধ্যায় এ বিষয়ে একটু আপত্তি করেন। তাঁর মূল কথাটা আজিও আমার মনের মধ্যে জাগিয়া আছে। তিনি বলেন—“সমাজ-সংস্কারের বিরুদ্ধে আমি নই। কিন্তু বর্ত্তমান অবস্থাধীনে সমাজ-সংস্কার বলিতেই বিদেশীয় সভ্যতাসাধনার প্রভাবে, কতকগুলি বৈদেশিক আদর্শের স্বল্পবিস্তর অনুবর্ত্তনই বুঝাইয়া থাকে। এই জাতীয় সমাজ-সংস্কারে আমাদের সমাজের বিশেষত্বটুকু ক্রমে লোপ পাইতেছে, আমরা ফিরিঙ্গীর একটা নকলের নকলের মতন হইয়া উঠিতেছি। এটা আমি চাই না। ইহাতে সমাজের স্বাদেশিকতা নষ্ট হইয়া, সমাজের ও লোক-চরিত্রের সাংঘাতিক বিপর্য্যয় উপস্থিত হইবে। এই বিদেশীয় শক্তির প্রভাবকে প্রথমে আটকাইতে হইবে। স্বদেশের সমাজকে ও স্বদেশের জনগণকে সর্ব্বাদৌ আত্মস্থ করিতে হইবে। তারা আগে জাগুক। নিজেরা নিজেদের চিনিয়া লউক। তারপর, তারা নিজেরাই নিজেদের প্রকৃতি ও প্রয়োজনানুরূপ নিজেদের সমাজকে গড়িয়া পিটিয়া শুধরাইয়া লইবে।”
এই কথাগুলিতেই উপাধ্যায়ের সমাজনীতির যেমন, তেমনি তাঁর স্বাদেশিকতারও সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায়।
বস্তুতঃ উপাধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন মানব-সমাজকে এক একটা স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট জীবের মতন মনে করিতেন বলিয়া বোধ হয়। Social organism বা সমাজ-জীর আধুনিক বিদেশীয় সমাজ-বিজ্ঞানের এই পরিচিত পরিভাষাটী তাঁর মুখে কখনও শুনিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। কিন্তু তাঁর কথাবার্ত্তায় তিনি যে এই আধুনিক সমাজতত্ত্বটীকে দৃঢ় করিয়া ধরিয়াছিলেন ইহা খুবই বুঝিয়াছিলাম। আর প্রত্যেক সমাজকে এইরূপ বিশিষ্ট জীবধর্ম্মাবলম্বী বলিয়া মনে করিতেন বলিয়াই সকল সমাজেরই ভাল ও মন্দের মধ্যে যে একটা অতি নিগূঢ় অঙ্গাঙ্গী যোগ আছে, এ কথাও তিনি বলিতেন। এইজন্যই বিলাতী সমাজের মন্দটীকে ছাড়িয়া শুদ্ধ ভালটীকে গ্রহণ করা আমাদের পক্ষে যেরূপ নিতান্ত অসাধ্য, সেইরূপ আমাদের নিজেদের সমাজের ভালটুকুকে নিখুঁতভাবে রক্ষা করিয়া, কেবল তার মন্দটুকুকে একান্তভাবে পরিহার করাও একান্ত অসম্ভব। জীবদেহে যখন প্রাণশক্তি দুর্ব্বল হইয়া পড়ে, তখনই কেবল তাহার অন্তরস্থ রোগের বীজাণু সকল প্রবল হইয়া অশেষ উৎপাত ও অমঙ্গল ঘটাইতে আরম্ভ করে, প্রাণীর সুস্থ সবল অবস্থায়, তারা নির্জীব ও অপকার সাধনে অক্ষম হইয়া পড়িয়া থাকে, এ যেমন সত্য, সমাজের ভালমন্দ সম্বন্ধেও ইহা সেইরূপই সত্য। সমাজ মধ্যে যখন প্রাণশক্তি সতেজ ও সবল থাকে তখন সমাজের রীতিনীতি এবং শাসনসংস্কারের ভালটুকুই প্রবল হইয়া রহে ও তাহার মন্দটুকু হতবল ও হীনতেজ হইয়া অপকার সাধনে অক্ষম হইয়া যায়। কিন্তু সমাজের প্রাণশক্তি হ্রাস হইতে আরম্ভ করিলেই এ সকল অন্তর্নিহিত উৎপাত ও অমঙ্গলের বীজ অঙ্কুরিত হইয়া, সমাজকে বিপর্য্যস্ত করিয়া তুলিতে থাকে। সুতরাং সমাজের প্রাণশক্তিকে জাগাইয়া তোলা, সেখানে বল সঞ্চার করা, এ সকলই সমাজসংস্কারসাধনের প্রথম ও মুখ্য কর্ম্ম। এটা করিতে পারিলে, সমাজ একবার সজীব ও আত্মস্থ হইয়া উঠিলে, সামাজিক ব্যাধিসকলের বীজাণুগুলি আপনি মরিয়া যাইবে বা মুমূর্ষু হইয়া পড়িয়া থাকিবে। উপাধ্যায় এই কারণেই সর্ব্বাগ্রে ও সর্ব্ব-প্রযত্নে, স্বদেশী সমাজের প্রাণমধ্যে এই শক্তি সঞ্চার করিবার জন্যই ব্যগ্র ছিলেন; বাহির হইতে উত্তেজক ঔষধ দিয়া, সমাজদেহের ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় উপদ্রবসকলকে প্রশমিত করিবার জন্য হাতুড়ে চিকিৎসার আশ্রয় গ্রহণ করিতে চাহেন নাই। এ কথাটী না বুঝিলে, উপাধ্যায় কেন যে শেষ জীবনে সমাজ-সংস্কারের কথা তেমন বেশী বলিতেন না, ইহার প্রকৃত মর্ম্ম গ্রহণ করা সহজ বা সম্ভব হইবে না।
উপাধ্যায়ের ভূয়োদর্শন এই ভাবটীকে বিশেষভাবে বাড়াইয়া তুলিয়াছিল। বিলাত যাইবার পূর্ব্বে, করাচীতে যখন বোমক খৃষ্টীয়-ধর্ম্মের অনুশীলন করিতেছিলেন, তখন, উপাধ্যায় যতটুকু পরিমাণে সমাজসংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন, বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া ততটুকুও ছিলেন কি না, সন্দেহ। আমরা সমাজ-সংস্কার করিতে যাইয়া কোন্ পথে চলিতেছি, এই পথ ধরিয়া চলিলে পরিণামে কোন্ স্থানে যাইয়া পৌঁছাইতে হইবে,—বিলাতে যাইয়া ইংরেজ-সমাজের গতিবিধি ও রীতিনীতি, মত ও আদর্শ এবং ভাবস্বভাব সূক্ষ্মভাবে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া, উপাধ্যায় তাহা বেশ করিয়া ধরিতে পারিয়াছিলেন। আর ঐ পথ যে আমাদের পক্ষে ভয়াবহ পরধর্ম্মের পথ,—উপাধ্যায় ইহাও বিশ্বাস করিতেন। এই কারণেই বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি কতকটা পরিমাণে স্বদেশের সামাজিক জীবনের ও সামাজিক আচার-ব্যবহারের পক্ষপাতী হইয়া উঠেন। কামোপভোগপ্রবণ যৌবনকালে যাঁরা বিলাত যান, তাঁদের কথা যাহাই হউক না কেন, বেশী বয়সে, বিশেষতঃ প্রকৃত ধর্ম্মজীবনের কথঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া, যাঁহারা বিলাতী সমাজের ভাবস্বভাব ও মতিগতি পরীক্ষা করিবার প্রত্যক্ষ অবসর প্রাপ্ত হন, তাঁহাদের অনেকেই, বোধ হয়, স্বদেশের রীতিনীতি ও আচারব্যবহারের সমধিক পক্ষপাতী হইয়া বিলাত হইতে স্বদেশে ফিরিয়া আইসেন। অন্ততঃ উপাধ্যায় মহাশয় সম্বন্ধে এরূপই ঘটিয়াছিল। এই জন্যই উপাধ্যায় মহাশয় শেষ জীবনে সমাজ-সংস্কারকার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে এতটা শঙ্কিত হইতেন।
এরূপ শঙ্কা যে একান্তই অস্বাভাবিক বা নিতান্তই অযৌক্তিক, এমনই কি বলিতে পারা যায়? ইংরেজি শিখিয়া, য়ুরোপীয় ঝাঁঝের ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার ও গণতন্ত্রতার আদর্শে মুগ্ধ হইয়া, আমরা এক সময়ে সমাজ-সংস্কারব্যাপারটা যত সহজ মনে করিয়াছিলাম, বাস্তবিক যে তাহা তত সহজ নহে, এ জ্ঞান অনেকেরই অল্পে অল্পে জন্মিতেছে। বিশেষতঃ য়ুরোপীয় সমাজচিত্রের ধ্যানে এই জ্ঞান বাড়িয়া উঠে বৈ হ্রাস হয় না। এক এক করিয়া, আমাদের বর্ত্তমান সমাজ-সংস্কারের মুখ্য প্রয়াসগুলিকে ধীরভাবে তাকাইয়া দেখিলেই, ইহা বুঝিতে পারা যায়। উপাধ্যায় এটা খুব ভাল করিয়া বুঝিয়াছিলেন বলিয়াই, এতটা সরাসরিভাবে সমাজসংস্কারের চেষ্টায় আপনিও প্রবৃত্ত হন নাই, অপরকেও এ কার্য্যে প্রোৎসাহিত করিতেন না।
প্রচলিত সংস্কার-প্রয়াসিগণ আমাদের জাতিভেদ প্রথাটা ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য নিতান্ত ব্যগ্র হইয়াছেন। এ ব্যগ্রতা স্বাভাবিক। বর্ত্তমানে এই জাতিভেদ প্রথা যে আকার ধারণ করিয়াছে, তাহাতে সমাজের স্থবিরতা যে অনেকটা বাড়িয়া গিয়াছে, ইহা অস্বীকার করাও যায় না। আর পূর্ব্ব পূর্ব্ব যুগেও মহাজনেরা সময়ে সময়ে, এই বংশগত জাতিভেদপ্রথার সংস্কার সাধন যে করেন নাই, তাহাও নহে। জাতিভেদের কঠোর শাসন সত্ত্বেও বহুকালাবধি হিন্দুসমাজে যে বীজ-মিশ্রণ ঘটিয়া আসিয়াছে, ইহাও বোধ হয় প্রমাণ করা কঠিন নহে। এইরূপ বীজমিশ্রণে কেবল বিবিধ বর্ণসঙ্করেরই উৎপত্তি হয় নাই, যাঁরা সমাজে সঙ্করবর্ণ বলিয়া পরিচিত নহেন, তাঁহাদের মধ্যেও যে এরূপ বীজমিশ্রণ ঘটিয়াছে, ইহারও প্রমাণ-প্রতিষ্ঠা অসাধ্য নহে। এতদ্ব্যতীত বৈষ্ণব ও শাক্ত উভয় মার্গের সাধক ও সম্প্রদায়-প্রবর্ত্তকগণের মধ্যে কেহ কেহ প্রকাশ্যভাবেই এই জাতিভেদ প্রথাকে স্বল্পবিস্তর ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন, ইহাও অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং বর্ত্তমানেও যে এ প্রথার সংস্কার প্রয়োজন নয়, অথবা সংস্কার হইবে না, এমন কথা কে বলিবে? উপাধ্যায় কখনও এমন কথা বলেন নাই, তিনি জীবনের কোনও বিভাগে এরূপ স্থবিরতা ও বদ্ধভাবের পক্ষপাতী ছিলেন না, এ কথা দৃঢ়ভাবে বলিতে পারা যায়। কিন্তু তথাপি যে ভাবে আমাদের বর্ত্তমান সমাজ-সংস্কারকেরা জাতিভেদপ্রথাকে ভাঙ্গিতেছেন বা ভাঙ্গিতে চাহিতেছেন, উপাধ্যায় তাহার সমর্থন করেন নাই। আর করেন নাই এই জন্য যে আমরা এই পথে আমাদের প্রাচীন জাতিভেদ প্রথার উচ্ছেদ সাধন করিয়া, বিদেশের আমদানী আর এক প্রকারের ঘৃণ্যতর ও সহস্র গুণে অধিক অমঙ্গলকর জাতিভেদের প্রতিষ্ঠা করিতে বসিয়াছি। বিদেশীয় সমাজে ইহাকে জাতিভেদ বলে না বটে। তাঁহারা ইহাকে শ্রেণীভেদ বলেন। কিন্তু যে নামেই নির্দ্দিষ্ট হউক না কেন, বস্তু দুটী এক না হইলেও যে নিতান্তই স-জাতীয় ইহা কি অস্বীকার করা যায়? আর এখানে প্রশ্ন এই যে সামাজিক স্থবিরতাপোষক যে বংশগত জাতিভেদ আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, তাহার যতই দোষ থাকুক না কেন, ইহার বদলে আমরা, সংস্কারের নামে, সমাজের বিপ্লবসাধক, পদগত বা ধনগত যে বিলাতী শ্রেণীভেদকে জ্ঞাতসারেই হউক আর অজ্ঞাতসারেই হউক, আমাদের সমাজে বরণ করিয়া লইতেছি, তাহার দোষ তদপেক্ষা বেশি কি না? এই বিষয়ে উপাধ্যায় এই প্রশ্নটাই তুলিতেন। আর এই প্রশ্নের সোজা উত্তর কেবল একটা—বিলাতী শ্রেণীভেদের দোষ আমাদের জাতিভেদের দোষ অপেক্ষা আকারে ভিন্ন হইলেও, ওজনে কম নহে। আমাদের জাতিভেদ মানুষের মনুষ্যত্ব বস্তুকে হয় ত কোনও কোনও স্থলে চাপিয়া রাখে, বিলাতী শ্রেণীভেদ তাহাকে পিষিয়া মারে। সুতরাং যেরূপ করিয়াই হউক, এই পুরাগত জাতিভেদকে ভাঙ্গিয়া দিলেই যে আমাদের সমাজ উন্নতির পথে ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হইবে, উপাধ্যায় এমনটা বিশ্বাস করিতেন না।
জাতিভেদের সংস্কার সম্বন্ধে যে কথা, অন্যান্য সমাজসংস্কার সম্বন্ধেও সেই কথা। যেটাকে ভাঙ্গিয়া যেটাকে গড়িতে যাইতেছি, তাহা কি বেশি ভাল? যেমন প্রচলিত জাতিভেদ, সেইরূপ বর্ত্তমানে যে আকারে বাল্যবিবাহ-প্রথা দেশে প্রবর্ত্তিত আছে, তাহাও সমাজের উন্নতি ও কল্যাণের ঠিক সহায় যে নয়, এ কথা উপাধ্যায় জানিতেন এবং মানিতেন। এ কুপ্রথা এক সময়ে আমাদের সমাজেও ছিল না। কোন্ যুগে, কি কারণে, কোন্ বিশেষ অবস্থাধীনে ইহা প্রচলিত হয়, স্থির করা বহু-বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম গবেষণা-সাপেক্ষ। কিন্তু যখন এবং যে কারণেই ইহা প্রথমে প্রবর্ত্তিত হউক না কেন, হিন্দুসমাজে যখন প্রাণশক্তি প্রবল ছিল, তখন সমাজ আপনা হইতেই ইহার আনুসঙ্গিক অমঙ্গল ফলগুলি, একান্ত ভাবে না হউক, অন্ততঃ বহুল পরিমাণে নিবারণ কবিবাব উপায় উদ্ভাবন করিয়া লইয়াছিল। সমাজের সে প্রাণশক্তির হীনতা নিবন্ধন ক্রমে এ সকলও ব্যর্থ বা নষ্ট হইরা গিয়াছে। সুতরাং আজ বাল্যবিবাহ-প্রধা যতটা অনিষ্টকর হইয়া উঠিয়াছে, কিছুকাল পূর্ব্বেও তত অনিষ্টকর ছিল না। এ সকলই সত্য। সকলে না হউক, অতি নিষ্ঠাবান অথচ চিন্তাশীল হিন্দু যাঁহারা, তাঁহারাও এ সকল স্বীকার করেন। কিন্তু এই প্রথাকে জোর করিয়া বন্ধ করিলে, আর তাহার বদলে বিলাতী ছাঁচের যৌবন-বিবাহ ও যূননির্বাচন-প্রথা প্রবর্ত্তিত হইলে, আমরা কোথায় গিয়া দাঁড়াইব, তাহাতে আমাদের সমাজের বেশি অমঙ্গল আশঙ্কা হইবে কি না, এ সকল ভাবিয়া চিন্তিয়া, তাঁহারা সহসা এ সংস্কার কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে সাহসী হন না।
এইরূপে আমাদের সমাজবিধানে যে সকল মন্দ জাগিয়া উঠিয়াছে, তাহাকে জোর করিয়া উপড়াইয়া দিলে, তার ভাল যাহা আছে, তাহাও নষ্ট হইয়া যাইবে কি না, এই ভয়েই উপাধ্যায় মহাশয় সমাজ-সংস্কার বিষয়ে এতটা শঙ্কিত হইয়া চলিতেন। নতুবা আমাদের সমাজে বর্ত্তমান অনিষ্টকর প্রথা সম্বন্ধে তিনি যে অন্ধ ছিলেন, কিম্বা এ সকলের পরিবর্ত্তন ও সংশোধন ইচ্ছা করিতেন না,—এমন কথা কিছুতেই বলা যায় না।
অন্য প্রসঙ্গে যাহা বলিয়াছিলাম, উপাধ্যায়ের সমাজানুগত্য ও সমাজনীতি সম্বন্ধেও তাহাই বলিতে পারি। উপাধ্যায় স্বদেশী সমাজকে, লোকে দেবতার মন্দিরকে যে চক্ষে দেখে, সেই চক্ষে দেখিতেন। ভক্ত লোকেও প্রয়োজন হইলে আপনার দেবতার মন্দির ভাঙ্গিয়া থাকেন, কিন্তু ভাঙ্গিবার জন্য তাহা ভাঙ্গেন না, অন্য দেবতার প্রতিষ্ঠার জন্যও তাহাকে নষ্ট করেন না। আপনার দেবতার সেবার সৌকর্য্যার্থেই ভাঙ্গিয়া থাকেন এবং ভাঙ্গিবার সময়, শান্ত সমাহিত, শুদ্ধ বুদ্ধ হইয়া, ভক্তির সঙ্গেই ভাঙ্গেন। এরূপভাবে যদি কেহ হিন্দুসমাজের সংস্কারে প্রবৃত্ত হন, উপাধ্যায় তাঁহার সে চেষ্টাকে মাথায় করিয়া লইতেন, ইহা জানি। আর প্রচলিত সমাজ-সংস্কার-চেষ্টার মধ্যে এই সংযম, এই শ্রদ্ধা ও এই ভক্তির প্রতিষ্ঠা দেখিতে পান নাই বলিয়াই তিনি ইহার সমর্থন করিতে পারেন নাই। তিনি স্বদেশ-বস্তুকে কেবল ভালবাসিতেন যে তাহা নয়, আন্তরিক ভক্তিও করিতেন। তাঁর সমাজানুগত্যের মধ্যে ও সমাজনীতির মূলে এই অপূর্ব্ব স্বদেশভক্তিটী সর্ব্বদা জাগিয়া থাকিয়া, তাঁহার চরিত্রের এই বিশিষ্টতাকে ফুটাইয়া তুলিয়াছিল।