চরিত-কথা/পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী ও ব্রাহ্মসমাজ
পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী
ও
ব্রাহ্মসমাজ
আধুনিক ভারতবর্ষের শিক্ষা ও সাধনা ব্রাহ্মসমাজের নিকটে অশেষপ্রকারে ঋণী। আমরা এ ঋণ অস্বীকার করিলেও, ইতিহাস কখনও তাহা ভুলিয়া থাকিবে না।
আমরা আজ যাহাকে ব্রাহ্মধর্ম্ম বলিয়া জানি, দেশের লোকে তাহা এপর্য্যন্ত গ্রহণ করে নাই; কখনও যে করিবে, ইহা কল্পনা করাও অসম্ভব। কিন্তু এই ধর্ম্মের হাওয়াটা দেশের সকল সম্প্রদায়ের উপরেই স্বল্পবিস্তর পড়িয়াছে এবং ইহার সাধারণ ভাবগুলি যে অনেকেই অজ্ঞাতসারে আত্মসাৎ করিয়াছেন ও করিতেছেন, এ কথাই কি অঙ্গীকার করা সম্ভব? ব্রাহ্মসমাজ এ পর্য্যন্ত যে তত্ত্বসিদ্ধান্তের উপরে আপনার ধর্ম্মবিশ্বাসকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছেন, সে সিদ্ধান্ত দেশের ধর্ম্মচিন্তায় এখনও কোনও স্থান পায় নাই; কখনও যে পাইবে, তারও কোনও সম্ভাবনা নাই। এ দেশে এবং অন্য দেশে এক সময়ে যারা এই যুক্তিবাদী সিদ্ধান্ত অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাঁহারাই ক্রমে সে সিদ্ধান্তের অপূর্ণতা ও অসঙ্গতি দেখিয়া, তাহাকে বর্জ্জন করিতেছেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিতে যাইয়া ব্রাহ্মসমাজ যে যুক্তিমার্গ আশ্রয় করেন, তাহার প্রভাবে দেশের প্রাচীন ও প্রচলিত ধর্ম্মবিশ্বাস ও ধর্ম্মসাধন যে বহুল পরিমাণে যুক্তিপ্রতিষ্ঠ ও অর্থসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছে, ইহাও সত্য। ব্রাহ্মসমাজ যে আদর্শে ও যে ভাবে আমাদের প্রাচীন সমাজের সংস্কারসাধনে প্রবৃত্ত হন, দেশের লোকে সর্ব্বতোভাবে তাহা অঙ্গীকার করা দূরে থাকুক, বরং প্রত্যক্ষভাবে তাহাকে প্রত্যাখ্যানই করিয়াছেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের সমাজ-সংস্কারচেষ্টার পরোক্ষ প্রভাবেই যে আজ ভারতের, বিশেষতঃ বাঙ্গলা দেশের, হিন্দুসমাজ নানা দিকে উদার ও উন্নতিমুখী হইয়া উঠিতেছে, ইহাই বা অস্বীকার করা যায় কি?
আর ব্রাহ্মসমাজ আমাদের বর্ত্তমান সমাজবিবর্ত্তনে একটা শূন্যতাকে পূর্ণ করিয়াই, আপাততঃ এরূপ নিষ্ফলতা লাভ করিয়াও ফলতঃ দেশের ধর্ম্মকর্ম্মের উপরে এতটা প্রভাব বিস্তার করিতে পারিয়াছেন। ব্রাহ্মধর্ম্ম যতই কেন বিদেশীয় ভাবাপন্ন হউক না, ইহা যে ভারতবর্ষের বিশাল হিন্দুসমাজের উপরে উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসে নাই, কিন্তু তাহার বর্ত্তমান সামাজিক বিবর্ত্তনের ধারাটীকে আশ্রয় করিয়া ভিতর হইতেই ফুটিয়া উঠিয়াছে, ইহা মানিতেই হইবে।
সমাজ বিবর্ত্তনের ক্রম
এই সামাজিক বিবর্ত্তনের গতিটা সোজা নয়, কিন্তু বাঁকা। সে বাঁকাও একটু অদ্ভুত রকমের। ইংরেজিতে ইহাকে স্পাইর্যাল (spiral) বলে। আমাদের ভাষায় ইহার কোনও প্রতিশব্দ আছে বলিয়া মনে পড়ে না। কোনও সোজা খুঁটির গায়ে গোড়া হইতে আগা পর্য্যন্ত, খানিকটা করিয়া ব্যবধান রাখিয়া, যদি একখানা কাপড় বা একটা রজ্জু জড়াইয়া দেওয়া হয়, তবে এই কাপড়ের বা রজ্জুর গতি যেরূপ হইবে, সমাজ-বিবর্ত্তনের গতিও সেইরূপ। এইরূপ বক্রগতিকেই ইংরেজিতে স্পাইর্যাল-গতি বলে। এ গতি একটানা কেবল উপরের দিকে চলে না। একটু উপরে উঠিয়া আবার একটু নীচে নামিয়া আইসে। কিন্তু এইরূপে নিম্নাভিমুখী হইয়াও, আগে যতটা নীচে ছিল, কদাপি ততটা নীচে আর যায় না। বরং নীচে নামিতে যাইয়াও সর্ব্বদাই আগে যতটা উচ্চে ছিল, প্রত্যেক স্থানেই তার চাইতে উপরে থাকে। আর এরই জন্য মোটের উপরে এই গতি সর্ব্বদাই ঊর্দ্ধমুখী হইয়া পরিণামে চরম উন্নতি লাভ করে। সমাজবিবর্ত্তনের ধারাও ঠিক এইরূপ।
সমাজ এই বক্রগতিতে চলিয়া, এক একবার নামিয়া আসিয়া আবার উপরে উঠিতে তিনটী অবস্থার ভিতর দিয়া যায়। আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা ইহার প্রথম অবস্থাকে ইংরেজিতে homogeneityর বা নির্ব্বিশেষ-একাকারত্বের অবস্থা বলেন। দ্বিতীয় অবস্থাকে differen tiationএর বা বিশিষ্ট বহুত্বের ও পার্থক্যের অবস্থা বলেন। তৃতীয় অবস্থাকে integrationএর বা মিলনের, সামঞ্জস্যের, একত্বের অবস্থা বলিয়া থাকেন। এই কথা তিনটী জীবজগতের বিবর্ত্তনের ইতিহাস হইতেই মূলে গৃহীত হইয়াছে। সামাজিক বিবর্ত্তনে এই অবস্থাগুলির অন্যরূপ নাম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আমাদের শাস্ত্রীয় পরিভাষা ব্যবহার করিলে, বিবর্ত্তনের প্রথম পাদ বা প্রথম অবস্থাকে তামসিক, মধ্যমপাদ বা মধ্যের অবস্থাকে রাজসিক এবং শেষের পাদকে বা অবস্থাকে সাত্ত্বিক বলাই সঙ্গত হইবে। আমাদের পৌরাণিকী কাহিনীর সৃষ্টিপ্রকরণে এই বিবর্ত্তন-ক্রমটীই ব্যক্ত হইয়াছে।
সৃষ্টির আদি অবস্থা নির্ব্বিশেষ একাকারত্বেরই অবস্থা। ইংরেজিতে ইহাকে স্বচ্ছন্দেই hoinogeneityর অবস্থা বলা যাইতে পারে। আমাদের পৌরাণিকী কাহিনী নিখিল বিশ্বের বীজরূপী, অপঞ্চীকৃত-পঞ্চমহাভূতাত্মক অণ্ডমধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্ত্তনশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। অণ্ড-বস্তুর লক্ষণ নির্ব্বিশেষত্ব ও একাকারত্ব। কারণাদ্ধিমধ্যে, এই অপঞ্চীকৃত-পঞ্চমহাভূতাত্মক অণ্ডের ভিতরে, সৃষ্টির পূর্ব্বে, হিরণ্যগর্ভ বা মহাবিষ্ণু যোগনিদ্রাভিভূত হইয়া থাকেন। সাংখ্যদর্শন এই তত্ত্বকেই অব্যক্ত বা প্রকৃতি বলিয়াছেন। এই তত্ত্বে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই গুণত্রয় সাম্যাবস্থায় বিরাজ করে। ত্রিগুণের এই সাম্যাবস্থাই বিশ্ববিবর্ত্তনে, সৃষ্টিপ্রকরণে, homogeneityর অবস্থা। এই সাম্য ভাঙ্গিবা মাত্রই মহাবিষ্ণুর যোগনিদ্রাও ভাঙ্গিয়া যায় এবং নির্ব্বিশেষ-একাকারত্ব হইতে ক্রমে, রজঃপ্রাধান্যহেতু, সবিশেষ ও বহু-আকারসম্পন্ন বিশাল ও বিচিত্র ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ আরম্ভ হয়। ইহাই differentiationএর বা ভেদ-প্রতিষ্ঠার অবস্থা। ভেদমাত্রেই বিরোধাত্মক, আর বিরোধমাত্রেই উপায়পর্য্যায়ভুক্ত; তাহার নিজস্ব কোনও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নাই। বিরোধ আপনাকে বিনাশ কবিয়াই আপনার সার্থকতা লাভ করে। সুতরাং এই বিরোধের বা differentiationএর অবস্থা কদাপি স্থায়ী হইতে পারে না। ভেদের ভিতর দিয়া অভেদের প্রতিষ্ঠা হইলেই তবে সে ভেদ আপনার সার্থকতা লাভ করে। এইজন্য differentiationএর পরে integration হইবেই হইবে। এই integration একত্বের, অভেদের, কিম্বা অচিন্ত্যভেদাভেদাত্মক মহান্ একের প্রতিষ্ঠা করে; এবং এই একত্বে বা integrationএ বিবর্ত্তনপ্রণালী পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। Homogeneity, differentiation, integration—বিবর্ত্তনক্রিয়ার এই তিন পাদের প্রথম পাদে তমোগুণের, দ্বিতীয় পাদে রজোগুণের, তৃতীয় পাদে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য হইয়া থাকে।
এই ত্রিপাদকে আশ্রয় করিয়াই জনসমাজ নিয়ত বিবর্ত্তিত হইতেছে। কিন্তু সমাজবিবর্ত্তনের এই ত্রিপাদচক্রে যে সমাজ-জীবনের আদি হইতে শেষ পর্য্যন্ত, কেবল একবার মাত্র ঘুরিয়া আইসে, তাহা নয়। সমাজবিবর্ত্তনের গতি কখনও কোথাও থামিয়া যায় না। সমাজ নিয়তই বিবর্ত্তিত হইতেছে। সুতরাং এই ত্রিপাদচক্রও নিয়ত ঘুরিতেছে। তমঃ রজঃ সত্ত্ব এই তিনগুণ, প্রত্যেক সমাজের জীবনে, একের পর অন্যে, বারম্বার প্রবল হইয়া, এই ত্রিপাদ চক্রের গতিবেগ রক্ষা করিতেছে। যুগে যুগে একবার করিয়া এই গুণত্রয়কে আশ্রয় করিয়া এই ত্রিপাদচক্র ঘুরিয়া আসিতেছে। প্রত্যেক যুগের আদিতে সমাজ ঘোরতর তামসিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। পূর্ব্বতন যুগের শ্রেষ্ঠতম সাত্ত্বিকতা, কালবশে, শাস্ত্রে ও সংস্কারে, আচারে ও অনুষ্ঠানে আবদ্ধ হইয়া ক্রমে গতানুগতিকতা প্রাপ্ত হয়। সমাজের ধর্ম্মকর্ম্ম সকলই তখন প্রতিষ্ঠানবদ্ধ হইয়া প্রাণহীন ও অর্থশূন্য হইয়া পড়ে। সমাজ তখন জড়ত্ব প্রাপ্ত হইয়া, জড়গতিমাত্র লাভ করে। এই জড়ত্ব—তমেরই ধর্ম্ম। এ অবস্থা তামসিক homogeneityরই অবস্থা। ক্রমে তখন আবার সমাজমধ্যে রজোগুণ জাগিয়া উঠিতে আরম্ভ করে। এই রজঃপ্রাবল্য নিবন্ধন অসার সমাজদেহে ভেদবিরোধের সৃষ্টি হইয়া, নুতন শক্তির সঞ্চার হয়। ইহাই রাজসিক differentiationএর অবস্থা। সর্ব্বশেষে সত্ত্বগুণ প্রবল হইয়া এই ভেদবিরোধের উপশম ও শান্তি হইতে আরম্ভ করে। সমাজ তখন অভিনব সামঞ্জস্যের ও সঙ্গতির সাহায্যে পূর্ব্বতন যুগের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ ও অবস্থাকে ছাড়াইয়া আরো উপরে উঠিয়া যায়। এইরূপে বক্রভাবে, স্পাইর্যাল (spiral) গতিতে সমাজ ক্রমে উন্নতির অভিমুখে অগ্রসর হয়।
আধুনিক ভারতের সামাজিক বিবর্ত্তনে ব্রাহ্মসমাজের স্থান
বর্ত্তমান যুগের প্রারম্ভে, সমগ্র ভারতসমাজ অগাধ অবসাদে নিমগ্ন ছিল। ধর্ম্ম প্রাণহীন, অনুষ্ঠান অর্থহীন, প্রকৃতিপুঞ্জ জ্ঞানহীন, সমাজ আত্মচৈতন্যহীন হইয়া পড়িয়াছিল। ঘোরতর তামসিকতা শ্রেষ্ঠতম সাত্ত্বিকতার ভাণ করিয়া, ভীতিকে শম, নির্ব্বীর্য্যতাকে দম, নিদ্রালস্যসম্ভূত নিশ্চেষ্টতাকে নির্ভর বলিয়া আলিঙ্গন করিতেছিল। ভারতসমাজের এই ঘোরতর তামসিকতাচ্ছন্ন অবস্থায় ইংরেজের শাসন, খৃষ্টীয়ানের ধর্ম্ম, য়ুরোপের সাধনা এক অভিনব আদর্শের প্রেরণা লইয়া আমাদের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হয়। এই নূতন শক্তি-সংঘর্ষে এই তামসিকতা অল্পে অল্পে নষ্ট হইয়া অভিনব রাজসিকতা জাগিয়া উঠিতে আরম্ভ করে। এই বিচিত্র যুগসন্ধিকালে ব্রাহ্মসমাজের জন্ম হয়। য়ুরোপীয় সাধনার এই প্রবল রাজসিকতাকে আশ্রয় করিয়াই ব্রাহ্মসমাজ, ধর্ম্মে ও কর্ম্মে, সর্ব্ববিষয়ে স্বদেশী সমাজ যে ঘোরতর তামসিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, প্রতিবাদী ধর্ম্মের প্রবল আঘাতে তাহাকে ভাঙ্গিতে আরম্ভ করিয়া, আধুনিক ভারতের বিবর্ত্তনগতিকে homageneity বা thesisএর অবস্থা হইতে differentiation বা antethesisএর অবস্থায় লইয়া যান। আর তিন জন প্রতিভাশালী পুরুষকে আশ্রয় করিয়া ব্রাহ্মসমাজ আধুনিক ভারতবর্ষের ধর্ম্ম ও কর্ম্মকে ঘোরতর তামসিকতা হইতে মুক্ত করিয়া, তাহার মধ্যে অভিনব রাজসিকতার সঞ্চার করিয়াছেন। প্রথম—মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর; দ্বিতীয়—ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন; তৃতীয়—পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী।
রাজর্ষি রামমোহন ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
রাজা রামমোহন রায়কেই লোকে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া গ্রহণ করে সত্য; কিন্তু তিনি যে ভাবে ব্রাহ্মসমাজকে গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছিলেন, আর ব্রাহ্মসমাজে তাঁর পরবর্ত্তী নেতৃবর্গ যে ভাবে ইহাকে গড়িয়া তুলিয়াছেন, তাহার মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ দাঁড়াইয়া গিয়াছে। রাজা একান্তভাবে শাস্ত্র প্রামাণ্য বর্জ্জন করেন নাই। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বেদকে প্রামাণ্যমর্য্যাদাভ্রষ্ট করিয়া শুদ্ধ ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির উপরেই ঐকান্তিকভাবে সত্যাসত্য ও ধর্ম্মাধর্ম্ম-মীমাংসার ভার অর্পণ করেন। রাজা ধর্ম্মসাধনে যে গুরুরও একটা বিশেষ স্থান আছে, ইহা কখনও অস্বীকার করেন নাই। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, যেমন শাস্ত্র সেইরূপ গুরুকেও বর্জ্জন করিয়া, প্রত্যক্ষ আত্মশক্তি ও অপ্রত্যক্ষ ব্রহ্মকৃপার উপরেই সাধনে যথাযোগ্য সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজা কি তত্ত্বাঙ্গে, কি সাধনাঙ্গে, ধর্ম্মের কোনও অঙ্গেই, স্বদেশের সনাতন সাধনার সঙ্গে আপনার ধর্ম্মসংস্কারের প্রাণগত যোগ নষ্ট করেন নাই। মহর্ষি একপ্রকারের স্বাদেশিকতার একান্ত অনুরাগী হইয়াও প্রকৃতপক্ষে এই যোগ রক্ষা করেন নাই এবং করিতে চেষ্টাও করেন নাই। রাজা বেদান্তের উপরেই আপনার তত্ত্বসিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করেন। মহর্ষি প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশখৃষ্টশতাব্দীর য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের উপরেই তাঁহার ব্রাহ্মধর্ম্মকে গড়িয়া তুলেন। রাজা বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ধর্ম্মকেই ব্রাহ্মধর্ম্ম বলিয়া প্রচার করেন। মহর্ষি তাঁহার আপনার আত্মপ্রত্যয় বা স্বানুভূতি প্রতিপাদ্য ধর্ম্মকেই ব্রাহ্মধর্ম্ম বলিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজা বৈদান্তিক হইলেও তাঁর পূর্ব্বতন কোনও বৈদান্তিক সিদ্ধান্তকেই একান্তভাবে সত্য বলিয়া গ্রহণ করেন নাই। কিন্তু শাস্ত্রাবলম্বনে যে সকল যুক্তিপ্রমাণাদিকে আশ্রয় করিয়া, পূর্ব্বতন ঋষি ও মনীষিগণ আপন আপন সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, রাজা রামমোহন সেই প্রাচীন ঋষিপন্থার অনুসরণ করিয়াই, আধুনিক সময়ের উপযোগী এক সমীচিন বেদান্তসিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করেন। ইহাতে স্বদেশের ধর্ম্মের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকিয়া যায়, অথচ পুরাতনের উপরেই, পুরাতনের সঙ্গে যুক্ত হইয়া, পুরাতনের শিক্ষা ও সাধনাকে সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিয়াই—দেশকালের উপযোগী নূতন সিদ্ধান্তেরও প্রতিষ্ঠা হয়। মহর্ষিও পুরাতনকে কতকটা রক্ষা করিতে চাহিয়াছেন বটে, কিন্তু সে কেবল তাঁর অভিজাত প্রকৃতির বলবতী রক্ষণশীলতার অনুরোধে। তিনি যে সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করেন, তাহার সঙ্গে তাঁর এই চেষ্টার কোনই অপরিহার্য্য সম্বন্ধ ছিল না। মহর্ষির ব্রাহ্মধর্ম্মগ্রন্থে কেবল উপনিষদের উপদেশই উদ্ধৃত ও ব্যাখ্যাত হইয়াছে সত্য; কিন্তু এ সকল উদ্ধৃত উপদেশের প্রামাণ্যমর্য্যাদা শ্রুতি-প্রতিষ্ঠিত নহে, মহর্ষির আপনার স্বানুভূতি-প্রতিষ্ঠিত মাত্র। উপনিষদের যে সকল শ্রুতি মহর্ষির নিকটে সত্য বলিয়া বোধ হইয়াছে, তিনি সেগুলিকেই বাছিয়া বাছিয়া আপনার ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রন্থে নিবদ্ধ করেন;—ঋষিরা কি সত্য বলিয়া দেখিয়াছিলেন বা জানিয়াছিলেন, তাহার সন্ধান তিনি করেন নাই। কোনও শ্রুতির বা উত্তরার্দ্ধ, কোনওটীর বা অপরার্দ্ধ, যার যতটুকু তাঁর নিজের মনোমত পাইয়াছেন, তাহাই কাটিয়া ছাঁটিয়া আপনার ব্রাহ্মধর্ম্ম, গ্রন্থে গাঁথিয়া দিয়াছেন। অতএব মহর্ষির ব্রাহ্মধর্ম্মগ্রন্থে বিস্তর শ্রুতি উদ্ধৃত হইলেও, এ গ্রন্থ তাঁর নিজের। ইহার মতামত তাঁর, প্রাচীন ঋষিদিগের নহে। সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধার না করিয়া কেবল বাঙ্গলা ভাষায় এ সকল মতামত লিপিবদ্ধ করিলেও, তার যতটুকু মর্য্যাদা থাকিত, উপনিষদের বুক্নী দেওয়াতে ইহা তদপেক্ষা বেশী মর্য্যাদা লাভ করে নাই। য়ুরোপীয় যুক্তিবাদিগণের অন্যতম উপদেষ্টা মন্কিওর ডি কন্ওয়ের (Moncure D. Conway) সঙ্কলিত শাস্ত্রসংগ্রহের বা Sacred Anthology’র যে পরিমাণ ও যে জাতীয় শাস্ত্রপ্রামাণ্য ও শাস্ত্রমর্য্যাদা থাকা সম্ভব, মহর্ষির সঙ্কলিত ব্রাহ্মধর্ম্মগ্রন্থের সে পরিমাণ ও সেই জাতীয় শাস্ত্রপ্রামাণ্য এবং শাস্ত্রমর্য্যাদাই আছে বা থাকিতে পারে। তার বেশী নাই।
কিন্তু রাজা রামমোহন যে সমীচিন মীমাংসার সাহায্যে স্বদেশের পুরাতন সাধনার উপরেই নূতন যুগের নূতন সাধনাকে গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছিলেন, সে মীমাংসা-প্রতিষ্ঠার অনুকূল কাল তখনও উপস্থিত হয় নাই। লোকের মন তখনও তাহা গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হয় নাই। ফলতঃ যে বিবেক জাগ্রত হইলে লোকের মনে পুরাতন ও প্রচলিতের প্রাণহীনতার জ্ঞান জন্মিয়া থাকে, এদেশে তখনও সে বিবেক জাগে নাই। শাস্ত্র, সন্দেহ, বিচার, সমন্বয়, সঙ্গতি—ইহাই মীমাংসার ক্রম। যতক্ষণ না শাস্ত্রে সন্দেহ জন্মে, ততক্ষণ বিচারের অবসর ও মীমাংসার প্রয়োজনই উপস্থিত হয় না। রামমোহনের অলোকসামান্য প্রতিভা প্রাচীন ও প্রচলিতের অসারতা ও ভ্রান্তি দেখিয়া তাহার প্রতি সন্দিহান হইয়াছিল। তাই সেই সন্দেহ হইতে বিচার, সেই বিচারের ফলে তিনি নূতন মীমাংসায় উপনীত হন। কিন্তু দেশের লোকের মনে তখনও এরূপ গভীর সন্দেহের উদয় হয় নাই; তাঁহাদের বিবেকও জাগে নাই। প্রাচীনকে লইয়াই তাঁরা তখনও সন্তুষ্ট ছিলেন। শাস্ত্র ও স্বাভিমতের মধ্যে তখনও কোনও প্রবল বিরোধ উৎপন্ন হয় নাই। দেশের লোকে শাস্ত্র কি, তাহা জানিতেন না। জানিবার প্রয়োজন-বোধ পর্য্যন্ত তাঁহাদের জন্মায় নাই। সুতরাং রাজা যে মীমাংসার প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করেন, তাহা বুঝিবার ও ধরিবার বাসনা এবং শক্তি দু’য়েরই তখন একান্ত অভাব ছিল।
রাজার সময়ে যে সন্দেহ জাগে নাই, মহর্ষির সময়ে তাহা জাগিয়া উঠিয়াছিল। রাজার জীবদ্দশায় অষ্টাদশখৃষ্টশতাব্দীর য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চিত্তকে অভিভূত করিতে আরম্ভ করে নাই। প্রাচীন ও প্রচলিতের প্রতি রাজার মনে যে সন্দেহের উদয় হইয়াছিল, তাহা মোহম্মদীয় যুক্তিবাদেরই ফল, খৃষ্টীয় যুক্তিবাদের ফল নহে। ফরাসী বিপ্লবের চিন্তানায়কগণের সঙ্গে রাজার তখনও কোনই পরিচয় হয় নাই। পাটনায় যাইয়া, পারসী ও আরবী পড়িয়া, মোহম্মদীয় তন্ত্রের মোতাজোলা সম্প্রদায়ের যুক্তিবাদের শিক্ষাদীক্ষা লাভ করিয়াই, রাজা সর্ব্বপ্রথমে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম্মের তথাকথিত পৌত্তলিকতার প্রতিবাদ করিতে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু মহর্ষি যে এই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন, তাহা ইংরেজি শিক্ষারই ফল। তাঁহার সময়ে য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের প্রভাবেই, আমাদের নব্য-শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও দেশের প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারাদি সম্বন্ধে প্রবল সন্দেহের উদয় হইয়াছিল।
আর যে বিচার বা criticismকে অবলম্বন করিয়া দেশের ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রাণে এই সন্দেহের উৎপত্তি হয়, সেই বিচার বা criticismকে আশ্রয় করিয়াই মহর্ষির ধর্ম্মমীমাংসার এবং তত্ত্ব-সিদ্ধান্তেরও প্রতিষ্ঠা হয়! এই বিচার বা criticismএর উপরেই অষ্টাদশ ও উনবিংশ খৃষ্ট-শতাব্দীর য়ুরোপীয় যুক্তিবাদেরও প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। এই যুক্তিবাদ আগমের বা আপ্তবাক্যের প্রামাণ্য স্বীকার করে না। এই যুক্তিবাদের বিচারপদ্ধতি প্রাকৃত বুদ্ধির আশ্রয়ে, লৌকিক ন্যায়ের বা formal logic এর উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং এই য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের প্রভাবে, আমাদের তদানীন্তন ইংরেজি-শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিচার বা criticism ও শাস্ত্রাশ্রয় বর্জ্জন এবং সদ্গুরুর শিক্ষা ও সাহায্যকে উপেক্ষা করিয়া, লৌকিক ন্যায়ের প্রত্যক্ষ ও অনুমানাদি প্রমাণকেই অবলম্বন করিয়া চলিতে আরম্ভ করে। এই বিচার একান্তই প্রত্যক্ষবাদী। আর প্রত্যক্ষ বলিতে ইহা কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষই বুঝিয়া থাকে। এই যুক্তিবাদের বা Rationalism এর সঙ্গে জড়বাদের বা Materialismএর সম্বন্ধ অতিশয় ঘনিষ্ঠ। এইজন্য য়ুরোপে যখনই যেখানে যুক্তিবাদ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে, তখনই সেখানে তার সঙ্গে সঙ্গে, এই জড়বাদ বা Materialisne প্রবল হইয়াছে। য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ ও জড়বাদ উভয়ই “নান্যদস্তীতিবাদী।” এই যুক্তিবাদের উপরে ধর্ম্মবস্তুকে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে, মানুষের প্রত্যক্ষ চক্ষু কর্ণাদির ন্যায়, অপ্রত্যক্ষ অথচ বুদ্ধিগম্য, একটা অতীন্দ্রিয় বৃত্তির অস্তিত্ব মানিয়া লইতে হয়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ খৃষ্টশতাব্দীর য়ুরোপীয় আস্তিক-মতাবলম্বী ধর্ম্মসংস্কারকেরা তাহাই করিয়াছেন। তাঁরা মানুষের মধ্যে ধর্ম্মবুদ্ধি বা religious sense বলিয়া একটা অতীন্দ্রিয় বৃত্তির প্রতিষ্ঠা করিয়া, তাহারই উপরে ধর্ম্মের প্রামাণ্যকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। এই ধর্ম্মবুদ্ধি বা religious sense সভ্য অসভ্য সকল মানুষেরই মধ্যে আছে। ইহা সার্ব্বজনীন ও সার্ব্বভৌমিক। সুতরাং কোনও বাহ্য কারণের বা অবস্থার যোগাযোগে ইহার উৎপত্তি হয় না বলিয়া, এই ধর্ম্মবুদ্ধিটা সত্য। আর ইহার একটা স্বতঃপ্রামাণ্যও আছে। এই ভাবেই য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ ধর্ম্মকে বাঁচাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিয়াছে। মহর্ষিও ব্রাহ্মধর্ম্মকে রক্ষা করিতে যাইয়া কতকটা এই পথ ধরিয়াই চলিয়াছিলেন। য়ুরোপীয় যুক্তিবাদী আস্তিকসম্প্রদায় যাহাকে ধর্ম্মবুদ্ধি বা religious sense বলিয়াছেন, মহর্ষি আপনার ধর্ম্মমীমাংসায় তাহাকেই আত্মপ্রত্যয় নামে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই আত্মপ্রত্যয় বস্তুতঃ আমাদের শাস্ত্রোক্ত স্বানুভূতিরই নামান্তর মাত্র। বেদান্ত যাহাকে আত্মপ্রত্যয় বলিয়াছেন, মহর্ষির আত্মপ্রতায় ঠিক সেই বস্তু নয়। অন্ততঃ তাঁহার প্রথম জীবনের ধর্ম্মমীমাংসা যাহাকে আত্মপ্রত্যয় বলিয়া ধরিয়াছিল, তাহা যে বেদান্তোক্ত আত্মপ্রত্যয়, এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না। আর শাস্ত্র-গুরু বর্জ্জন করিয়া শুদ্ধ যুক্তিমার্গ অবলম্বন করিলে এই তথাকথিত আত্মপ্রত্যয় বা স্বানুভূতিই সত্যের ও প্রামাণ্যের একমাত্র আশ্রয় হইয়া দাঁড়ায়। মহর্ষিও এই স্বানুভূতিকে অবলম্বন করিয়াই, ব্রাহ্মধর্ম্মকে পুনরায় জাগাইয়া তুলেন।
এদেশে তখন এরূপভাবে লোকের স্বানুভূতিকে জাগাইয়া তোলা অত্যন্ত আবশ্যক ছিল। কেবল শাস্ত্রাবলম্বনে ধর্ম্মসাধন করিবে না, শাস্ত্রযুক্তি মিলাইয়া ধর্ম্মপ্রতিষ্ঠা করিবে,—লোকে এই প্রাচীন ও সমীচিন উপদেশ তখন একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিল। শাস্ত্রজ্ঞানও একরূপ লোপ পাইয়াছিল। তাহা না হইলে মহর্ষি যেভাবে চারিজন ব্রাহ্মণকে কাশীতে বেদ পড়িবার জন্য পাঠাইয়া, তাঁহাদের সাক্ষ্যে বেদের প্রামাণ্য-মর্য্যাদা নষ্ট করেন, তাহা আদৌ সম্ভব হইত না। ইঁহারা কেবল ব্যাকরণের সাহায্যে বেদার্থ নির্ণয় করিতে গিয়াছিলেন, প্রাচীন মীমাংসার পথ অবলম্বন করেন নাই। রাজা এই মীমাংসার পথ ধরিয়া শাস্ত্রার্থ নির্দ্ধারণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন বলিয়া, মহর্ষির ন্যায় তাঁহাকে ভ্রান্ত বলিয়া প্রাচীন শ্রুতি প্রামাণ্য পরিত্যাগ করিতে হয় নাই। প্রাকৃত জনে যে চক্ষে বেদকে দেখে, লোকসংগ্রহার্থে পণ্ডিতেরাও যে ভাবে বেদের অতিপ্রাকৃত মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন,—ভারতের প্রাচীন মীমাংসকগণ সেরূপ করেন নাই। রাজা এ সকল কথা জানিতেন। সুতরাং তাঁহাকে মহর্ষির ন্যায় শাস্ত্রপ্রামাণ্য বর্জ্জন করিতে হয় নাই। কিন্তু তখনও এ সকল প্রাচীন সিদ্ধান্তের পুনরুদ্ধারের ও পুনঃ প্রতিষ্ঠার সময় হয় নাই। দেশের লোক তখনও এ সমীচীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার অধিকারী হয় নাই। সে সময়ে এ সকল সিদ্ধান্তের কথা বলিলেও, লোকে ভাল করিয়া তাহা বুঝিত না, অথচ না বুঝিয়াও তাহারই মধ্যে নিজেদের নিশ্চেষ্টতা ও তামসিকতার সমর্থন করিবার যুক্ত্যাভাস পাইয়া, সেই নির্জীব অবস্থাতেই পড়িয়া থাকিত। তখনকার প্রধান কর্ম্ম ছিল, সত্য প্রতিষ্ঠা করা নয়, কিন্তু সংস্কার নাশ করা। সাধুমীমাংসা মাত্রেই সম্যগ্দর্শী। আর সম্যগ্দর্শন নিম্নাধিকারী লোকের পক্ষে কর্ম্ম-চেষ্টার ও আত্ম প্রতিষ্ঠার একান্ত অন্তরায় হইয়া থাকে। যে ‘গোঁ’এর ভিতর দিয়া রজোগুণ বর্ণিত হইয়া প্রবল তমোগুণকে অভিভূত করিয়া থাকে, অসময়ে সম্যগ্দৃষ্টি লাভ করিলে সে ‘গোঁ’ জন্মাইতে পারে না; সুতরাং তামসিকতাও নষ্ট হয় না। আধুনিক ভারতের নূতন সাধনার প্রয়োজনেই রাজার তত্ত্ব-সিদ্ধান্তে যে সম্যগ্দর্শনের পরিচয় পাই, মহর্ষির প্রথম জীবনের ধর্ম্মর্মীমাংসায় সে সম্যগ্দৃষ্টি ফুটিয়া উঠে নাই; উঠিলে তাঁহার দ্বারা বিধাতা যে কাজ করাইয়াছেন, তাহার গুরুতর ব্যাঘাত উৎপন্ন হইত।
দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র
রাজা রামমোহন প্রচলিত ক্রিয়াকাণ্ডের প্রতিবাদ করিয়াও, প্রকৃতপক্ষে একটা নুতন ধর্ম্মের বা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করিতে যান নাই। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথই “ব্রহ্মসভার” ভজন-সাধনকে একটা স্বতন্ত্র ধর্ম্মরূপে গড়িতে আরম্ভ করেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজে এই নূতন ধর্ম্মের স্বাতন্ত্র্য ও সাম্প্রদায়িক লক্ষণ যতটা পরিস্ফুট হয় নাই, কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে তদপেক্ষা অনেক বেশী ফুটিয়া উঠে।
দেবেন্দ্রনাথ শাস্ত্র-গুরু বর্জ্জন করিয়া, কেবলমাত্র স্বানুভূতিকে আশ্রয় করিয়াই আপনার ধর্ম্ম সিদ্ধান্ত ও ধর্ম্মসাধনের প্রতিষ্ঠা করেন বটে, কিন্তু এই স্বানুভূতি-প্রতিষ্ঠিত ধর্ম্মকেই তিনি উপনিষদের শ্রুতির আশ্রয়ে স্থাপন করিতে যাইয়া, এক প্রকারের শাস্ত্র প্রামাণ্যও প্রদান করেন। এইজন্য তাঁর ব্রাহ্মধর্ম্মবস্তুটা যে একান্তই অভিনব ও স্বরচিত, ইহার যে কোনই প্রাচীন ভিত্তি বা প্রামাণ্যমর্য্যাদা নাই, লোকে ইহা সহজে ধরিতে পারে নাই। সে সময়ে দেশে শাস্ত্রজ্ঞান একরূপ লোপ পাইয়াছিল। সাধারণ লোকের তো কথাই নাই, দেশের ব্রাহ্মণপণ্ডিতেরাও বেদবেদান্তাদির কোনই ধার ধারিতেন না। সুতরাং আপনার ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধিসম্ভূত সিদ্ধান্তকে মহর্ষি যে অদ্ভুত শ্রুতিমর্য্যাদা প্রদান করিতে চেষ্টা করেন, তাহার কৃত্রিমতা ও অশাস্ত্রীয়তা, দেশের লোকে একেবারেই বুঝিতে ও ধরিতে পারেন নাই। ফলতঃ প্রচলিত কর্ম্মকাণ্ড পরিহার করিয়াই, দেবেন্দ্রনাথ সমাজচ্যুত হইয়াছিলেন; নতুবা তাঁর ব্রাহ্মধর্ম্ম একান্তই অশাস্ত্রীয় ও অপ্রামাণ্য বলিয়া তাহার উপরে কোনই নির্য্যাতন হয় নাই। বরঞ্চ তাঁর সিদ্ধাস্ত ও সাধনকে উচ্চতর অধিকারের হিন্দুধর্ম্ম বলিয়াই অনেকে মনে করিতেন।
প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিত্বাভিমানী য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের উপরেই দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ব্রাহ্মধর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু তাঁর সাধনা ও চরিত্রগুণে, তাঁর উপদিষ্ট ব্রাহ্মধর্ম্মে এই ব্যক্তিত্বাভিমানী যুক্তিবাদের প্রভাব ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠে নাই। দেবেন্দ্রনাথের প্রকৃতির মধ্যেই একটা অতি প্রবল প্রভুত্বাভিমান বিদ্যমান ছিল। তিনি যে সমাজে, যে পরিবারে, যেরূপ বিভবগৌরবের মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেন ও যে সৌভাগ্যের অঙ্কে লালিত পালিত হ’ন, তাহাতে এরূপ প্রবল প্রভুত্বাভিমান যে তাঁর মধ্যে জন্মিবে, ইহা কিছুই বিচিত্র নহে। তার পর তিনি যে ভাবে ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিয়া, তার মুমুর্ষু দেহে নবজীবনের সঞ্চার করেন এবং এক দিকে আপনার সাধনের ও অন্যদিকে আপনার অর্থের দ্বারা যেরূপে ইহাকে লোকসমাজে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন, তাহাতে এই ব্রাহ্মসমাজে যে তাঁর একটা একতন্ত্র প্রভুত্বের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল, ইহাও কিছুই আশ্চর্য্য নহে। আর এই কারণে মহর্ষি আদিব্রাহ্মসমাজে যে ধর্ম্মের ও সাধনের প্রতিষ্ঠা করিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা যে একান্তই শাস্ত্র-গুরু-বর্জ্জিত, এ ভাবটা বহুদিন পর্য্যন্ত ধরা পড়ে নাই। প্রাচীন শাস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া দেবেন্দ্রনাথ আপনার সঙ্কলিত “ব্রাহ্মধর্ম্ম” গ্রন্থকেই প্রামাণ্য শাস্ত্রের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রাচীন গুরু-আনুগত্য বর্জ্জন করিয়া, দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম শিষ্যমণ্ডলী, তাঁহাকেই নূতন ধর্ম্মের গুরুরূপে বরণ করেন। সুতরাং প্রকৃত পক্ষে শাস্ত্র-গুরু-বর্জ্জিত, শুদ্ধ স্বানুভূতি-প্রতিষ্ঠিত হইয়াও, দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম্মে বাহ্যতঃ ও লোকতঃ গুরু ও শাস্ত্র উভয়েরই প্রতিষ্ঠা হয়। আর এই জন্য স্বদেশেব ধর্ম্মের সঙ্গে সাধন ও সংস্কারাদি বিষয়ে ইহার বিস্তর পার্থক্য দাঁড়াইলেও, ভাবগত কোনও প্রবল বিরোধ উৎপন্ন হয় নাই। কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ সর্ব্বদা আপনার তত্ত্বসিদ্ধান্ত ও ধর্ম্মসাধনকে উচ্চতর ও বিশুদ্ধতর হিন্দুধর্ম্ম বলিয়াই প্রচার করিয়াছেন। দেশের লোকেও তাঁহাদের এই দাবীর একান্ত প্রতিবাদ করেন নাই।
কিন্তু এইরূপে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ যে পথ ধরিয়া আপনাদের ধর্ম্মসাধনে গুরু ও শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠা করিতে গেলেন, সে পথে, এদেশে, কখনও এ বস্তু মিলে নাই। আমাদের সাধনায় শাস্ত্র-গুরু-আনুগত্যের একটা নিগূঢ় সঙ্কেত আছে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ সে সঙ্কেতটী লাভ করেন নাই। গুরু স্বয়ং গুরু-আনুগত্য স্বীকার ও শাস্ত্র আপনি পুরাতন শাস্ত্রে আবদ্ধ আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াই আপনাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমাদের গুরু ও শাস্ত্র কিম্বা গুরূপদেশ, দু’এর কেহই স্বয়ং-বৃত ও স্বপ্রতিষ্ঠ নহেন। পূর্ব্বতন গুরুপরম্পরা ও সনাতন শাস্ত্র-ধারার সঙ্গে ইহাদের একটা গভীর ও অঙ্গাঙ্গী যোগ সর্ব্বদাই রক্ষিত হয়। মহর্ষির ব্রাহ্মসমাজে এ যোগ থাকে নাই। আর এইরূপ স্বয়ংবৃত গুরুর বা মনগড়া শাস্ত্রের মর্য্যাদা কদাপি কোথাও স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে না। যেখানেই এরূপ গুরু-শাস্ত্রের সৃষ্টি হইয়াছে, সেই খানেই ক্রমে বিদ্রোহীদলের উৎপত্তি হইয়া, সম্প্রদায়কে শতধা বিচ্ছিন্ন করিয়াছে। রোমক খৃষ্টীয় সঙ্ঘের প্রামাণ্য একদিকে পুরাতন শাস্ত্রধারার ও অন্যদিকে পুরাগত গুরুপারম্পর্য্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত বলিয়া, সেখানে ধর্ম্মমত লইয়া দলাদলির প্রকোপও অত্যন্ত কম। প্রোটেষ্ট্যাণ্ট্ খৃষ্টীয় সঙ্ঘে শাস্ত্র আছে, কিন্তু গুরুপরম্পরার ব্যাখ্যাকে অবলম্বন করিয়া শাস্ত্রধারার সৃষ্টি হয় নাই; এখানে প্রত্যেকে আপনার বিচার ও বুদ্ধি, খুসি ও খেয়াল মত শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করিতে পারেন। অন্যদিকে প্রোটেষ্ট্যাণ্ট্ খৃষ্টীয়মণ্ডলী মধ্যে গুরুপরম্পরারও প্রতিষ্ঠা হয় নাই। আর এই দুই কারণে প্রোটেস্ট্যাণ্ট্ সঙ্ঘ এই পাঁচশত বৎসরের মধ্যে অসংখ্য বিরোধী দলে বিভক্ত হইয়াছে, আর প্রতিদিনই নূতন নূতন প্রতিবাদী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়া, ইহাকে আরো ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া তুলিতেছে। আমাদের ব্রাহ্মসমাজেও, মূলতঃ এই একই কারণে, মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই, পঞ্চাশৎ বৎসর যাইতে না যাইতে তিনটী দলের সৃষ্টি হইয়াছে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যে পথ ধরিয়া প্রাচীন শাস্ত্র-গুরু বর্জ্জন করিয়া, আপনার ব্রাহ্মসমাজে নূতন গুরু ও শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠা করিতে গেলেন, সে পথে এ বস্তু পাওয়া যায় না। তিনি আপনার বিচারবুদ্ধি বা তথাকথিত আত্মপ্রত্যয়কে যতটা প্রামাণ্যমর্য্যাদা প্রদান করিতে লাগিলেন, অপর ব্রাহ্মদিগের বিচারবুদ্ধির প্রতি সেইরূপ মর্য্যাদা প্রদর্শন করিতে পারিলেন না। পারিলে, তাঁর নিজের গুরুপদ-গৌরব ও তাঁর সঙ্কলিত “ব্রাহ্মধর্ম্ম” গ্রন্থের শাস্ত্র প্রামাণ্য, তিনি দু’এর কিছুরই দাবী করিতে পারিতেন না। কিন্তু মহর্ষি যে ব্যক্তিত্বাভিমানী যুক্তিবাদের (Individualistic Rationalism) উপরে আপনার ব্রাহ্মধর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত করেন, তার অপরিহার্য্য পরিণামকে অকুতোভয়ে গ্রহণ করিতে পারেন নাই বলিয়াই, কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজে তিনি আপনার অসঙ্গত একতন্ত্রপ্রভুত্ব রক্ষা করিতে যাইয়া আপনার শিষ্যগণের মধ্যে একটা প্রবল প্রতিবাদ জাগাইয়া তুলিলেন। যে ব্যক্তিত্বাভিমানী সংজ্ঞান বা Conscienceকে আশ্রয় করিয়া, দেবেন্দ্রনাথ প্রাচীন ও পুরাগত শাস্ত্রগুরু বর্জ্জন করিলেন, সেই ব্যক্তিত্বাভিমানী সংজ্ঞানের মর্য্যাদা রক্ষা করিবার জন্যই, কেশবচন্দ্র প্রভৃতি ব্রাহ্মসমাজের যুবকদল, তাঁহার একতন্ত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়া, ব্রাহ্মসমাজে এক নূতন বিদ্রোহীদলের সৃষ্টি করেন। এ জগতে প্রত্যেক বস্তু তার অনুরূপ বস্তুকেই উৎপাদন করিয়া থাকে। স্বদেশের শাস্ত্রগুরুর বিরুদ্ধে দেবেন্দ্রনাথের দ্রোহিতা, আপনার কর্ম্মবশেই, তাঁহার নিজের সমাজে, আপনার শিষ্যগণের ভিতরে, এই নূতন দ্রোহিদলের সৃষ্টি করিল। এই নূতন ব্রাহ্মসমাজ, কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে, এমন পথ ধরিয়া চলিতে লাগিল, যাহাতে স্বদেশের শাস্ত্র ও সাধনার সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ যে বিরোধ জাগাইয়াছিলেন, সেই বিরোধই আরো বেশী বিশদ ও তীব্র হইয়া উঠিল।
মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র উভয়েই য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের দ্বারা অত্যন্ত অভিভূত হইয়াছিলেন। উভয়েই প্রকৃতপক্ষে সারসংগ্রহবাদী ছিলেন। এই শ্রেণীর দার্শনিকদিগকে ইংরেজিতে Eclectic বলে। কিন্তু মহর্ষির যুক্তিবাদ যতটা সংযত ও সারসংগ্রহবাদ যে পরিমাণ স্বাদেশিক ছিল, কেশবচন্দ্রের যুক্তিবাদ ততটা সংযত ও তাঁর সারসংগ্রহবাদ বা Eclecticism সে পরিমাণ স্বাদেশিক রহে নাই। মহর্ষি আপনার বিচারবুদ্ধিকে সত্যের একমাত্র ও অনন্য প্রতিযোগী প্রামাণ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, সেই বিচারবুদ্ধির সাহায্যে স্বদেশের প্রাচীন শ্রুতি হইতে আপনার মনোমত সিদ্ধান্ত ও উপদেশাদি উদ্ধার করিয়া, তাহাকেই ব্রাহ্মধর্ম্মের শাস্ত্র বলিয়া প্রচার করেন। কেশবচন্দ্র এই পথে যাইয়াই, জগতের সমুদায় ধর্ম্মসাহিত্য হইতে সার সংগ্রহ করিয়া, এই শ্লোকসংগ্রহকেই ব্রাহ্মধর্ম্মের উদার ঐতিহাসিক ভিত্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের মধ্যে একটা উদার বিশ্বজনীন ভাব আছে। মহর্ষির ব্রাহ্মসিদ্ধান্তে বা ব্রহ্মসাধনে এই বিশ্বজনীনতা রক্ষিত হয় নাই। কেশবচন্দ্রের সিদ্ধান্তে ও সাধনায় ইহা খুবই ফুটিয়া উঠে। এইজন্য যুক্তিবাদের নিক্তিতে ওজন করিলে, কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মত, সিদ্ধান্ত, সাধনাদি, সকলই মহর্ষির মত, সিদ্ধাত্ত ও সাধন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হইয়া উঠে। কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজে মহর্ষির একতন্ত্র প্রভুত্বের প্রতিবাদ করিতে যাইয়াই ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের জন্ম হয়। এইজন্য এই নূতন সমাজকে প্রথমে গণতন্ত্রতার আদর্শে গড়িয়া তুলিবার কতকটা চেষ্টাও হইয়াছিল। ইহার ফলে মহর্ষির সমাজে ব্রাহ্মসাধারণের ব্যক্তিত্বাভিমানী ‘সহজবুদ্ধি’র বা Intuitionএর যতটা প্রভাব ফুটিয়া উঠিবার অবসর পায় নাই, কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে, প্রথম প্রথম তাহা তদপেক্ষা অনেক বেশি পরিস্ফুট হইয়া উঠে। মহর্ষির উপদেশে ও সাধনে একটা হিন্দুভাব সর্ব্বদাই জাগিয়া ছিল। এই কারণে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের ব্রাহ্মগণমধ্যে একটা বিনয়, একটা শ্রদ্ধা ও একটা সংযমের প্রভাবও সর্ব্বদাই দৃষ্ট হইত। এই বিনয়, শ্রদ্ধা ও সংযম হিন্দুর প্রকৃতিগত বস্তু। কিন্তু প্রোটেষ্ট্যাণ্ট্ খৃষ্টীয় সাধনা ব্যক্তিগত সংজ্ঞান বা Conscienceকে বাড়াইতে যাইয়া, ধর্ম্মের এই প্রাণগত বস্তুগুলিকে অনেকটা নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। কেশবচন্দ্র প্রথম যৌবনে এই খৃষ্টীয় ভাবের দ্বারা অত্যন্ত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁর শিক্ষাদীক্ষাতে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজেও ব্যক্তিগত সংজ্ঞান বা Conscienceএব ভাবটা নিরতিশয় প্রবল হইয়া, এই বিনয়, সংযম ও শ্রদ্ধা বস্তুকে এক প্রকার নষ্ট করিয়া ফেলে। এই ব্যক্তিত্বাভিমানী সংজ্ঞানের প্রাধান্য আধুনিক য়ুরোপীয় যুক্তিবাদী ধর্ম্মসকলের প্রধান লক্ষণ। এই লক্ষণাক্রান্ত হইয়া, আমাদের ব্রাহ্মসমাজেও, কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে যুক্তিবাদী ধর্ম্মের স্বরূপটা যতটা ফুটিয়া উঠে, মহর্ষির অধীনে, তাঁর কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজে, ততটা ফুটিয়া উঠিতে পারে নাই। কেশবচন্দ্রের শিষ্যগণ জীবনের সকল বিভাগে, তত্ত্বসিদ্ধান্তে, ধর্ম্মসাধনে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে, সর্ব্বত্র, এই ব্যক্তিত্বাভিমানী সংজ্ঞানের অনন্যপ্রতিযোগী প্রাধান্য প্রতিফলিত করিতে যাইয়া, আধুনিক ভারত সমাজে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ধর্ম্মমীমাংসায় ও ধর্ম্মসাধনে যে রাজসিক ভাব জাগাইয়াছিলেন, তাহাকে আরো প্রবল করিয়া তুলিতে লাগিলেন। দেবেন্দ্রনাথ আমাদের বর্ত্তমান সামাজিক বিবর্ত্তনে যে anti-thesisএর প্রতিষ্ঠা করেন, কেশবচন্দ্র তাহাকেই আরো বিশদ ও তীব্র করিয়া তুলিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র ও শিবনাথ
কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের যে স্থান ছিল; তার পরে, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে কেশবচন্দ্র যে স্থান অধিকার করেন; তৎপরবর্ত্তী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী সেই স্থানই প্রাপ্ত হ’ন। ইঁহারা তিন জনেই, একের পর অন্যে, ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম্ম ও কর্ম্মকে এবং ব্রাহ্মসমাজের ভিতর দিয়া দেশের ইংরেজিশিক্ষাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের চিন্তা ও ভাবকে স্বল্প বিস্তর ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। কেশবচন্দ্রের অলৌকিক বাগ্মিপ্রতিভা-গুণে তাঁহার প্রথম জীবনের উদার শিক্ষা দীক্ষার ভিতর দিয়াই, ব্রাহ্মসমাজের এ ভাব দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষভাবে ছড়াইয়া পড়ে। আধুনিক ভারতবর্ষের জ্ঞান ও কর্ম্মের বিকাশ সাধনে কেশবচন্দ্র যে পরিমাণে সাহায্য করিয়াছেন, দেবেন্দ্রনাথ বা শিবনাথ ইঁহাদের কেহই সে পরিমাণে সাহায্য করেন নাই। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসে যেমন মহর্ষির এবং কেশবচন্দ্রের, সেইরূপ পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর নামও স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। শিবনাথ শাস্ত্রী কিছুতেই মহর্ষির সাধননিষ্ঠা এবং কেশবচন্দ্রের দৈবীপ্রতিভার দাবী করিতে পারেন না, সত্য। কিন্তু অন্য দিকে যে সকল বাহিরের অবস্থার ও ঘটনার শুভযোগাযোগ ব্যতীত কি মহর্ষি কি কেশবচন্দ্র ইঁহাদের কেহই ব্রাহ্মসমাজে এবং ব্রাহ্মসমাজের ভিতর দিয়া স্বদেশের বৃহত্তর কর্ম্মজীবনে ও ধর্ম্মজীবনে কখনই কোনও প্রভাব এবং প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিতেন না, শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবনে সে সকল যোগাযোগও ঘটে নাই।
দেবেন্দ্রনাথ প্রিন্স্ দ্বারকানাথের পুত্র। পিতৃবিয়োগের পরে কিছুকাল দেবেন্দ্রনাথ অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যের ভিতরে পড়িয়াছিলেন সত্য; কিন্তু তাঁহার সংযম ও সততাগুণে কালক্রমে পৈতৃক জমিদারী ঋণমুক্ত হইলে তিনি পুনরায় কলিকাতার ধনিসমাজের অগ্রণীদলভুক্ত হইয়া উঠেন এবং তখন হইতে তাঁহার অর্থেই ব্রাহ্মসমাজের যাবতীয় ব্যয় নির্ব্বাহ হইতে আরম্ভ করে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাই সে সময়ে ব্রাহ্মসমাজের একমাত্র মুখপত্র ছিল। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সাহায্যেই ব্রাহ্মসমাজের তদানীন্তন মত ও আদর্শ এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচারিত হয়। বাঙ্গলা সাহিত্যের এবং আধুনিক বাঙ্গালী সমাজের সাধনার ইতিহাসে তত্ত্ববোধিনী অক্ষয়কীর্ত্তি অর্জ্জন করিয়াছেন। এই তত্ত্ববোধিনী মহর্ষির অর্থেই স্থাপিত ও পরিপুষ্ট হয়। তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদকগণ, ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্য্য ও কর্ম্মচারিগণ সকলেই তখন মহর্ষির অর্থানুকূল্যে ব্রাহ্মসমাজের বেতনভোগী বা বৃত্তিভোগী হইয়াছিলেন। আর এই ধনবল না থাকিলে, শুদ্ধ আপনার চরিত্রের বা সাধনার বলে সে সময়ে মহর্ষি কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজকে এতটা বাড়াইয়া ভুলিতে পারিতেন না। আর ব্রাহ্মসমাজে কালক্রমে মহর্ষির যে একতন্ত্রপ্রভুত্বের প্রতিষ্ঠা হয়, তাঁহার অর্থবলই ইহারও একটা প্রধান কারণ ছিল সন্দেহ নাই।
কেশবচন্দ্র মহর্ষির মত ধনী ছিলেন না বটে; কিন্তু রামকমল সেনের পৌত্র বলিয়া কলিকাতা-সমাজে তাঁহারও একটা বিশেষ আভিজাত্য মর্য্যাদা ছিল। ফলতঃ সামাজিক হিসাবে, কলুটোলার সেনেরা, বৈদ্য হইয়াও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদিগের অপেক্ষা কোন অংশে হীন ছিলেন না। অন্য দিকে ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিতে না করিতেই, কেশবচন্দ্রের দৈবীশক্তিশালিনী বাগ্মীপ্রতিভা দেশের উর্দ্ধতন ইংরেজ রাজপুরুষদিগের শুভদৃষ্টি লাভ করে। এখন যেমন, সেকালেও সেইরূপই, ইংরেজ রাজপুরুষগণ যাঁহাদিগকে বাড়াইয়া তুলিতেন, স্বদেশী সমাজেও, আপনা হইতেই, তাঁহাদের প্রভাব বাড়িয়া যাইত। এই সকল বাহ্য যোগাযোগ ব্যতীত কেশবচন্দ্রের অলোকসামান্য প্রতিভাও এত সহজে ও এত অল্পকাল মধ্যে দেশের শিক্ষিত সমাজে এমন অনন্য-প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিত না।
পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর কেবল যে মহর্ষির সাধননিষ্ঠা বা কেশবচন্দ্রের দৈবীপ্রতিভাই নাই তাহা নহে। যে সকল বাহ্যঘটনা ও অবস্থার যোগাযোগের সাহায্যে মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র আপনাদিগের কর্ম্মজীবনকে গড়িয়া তুলেন, শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাগ্যে সেইরূপ কোনো যোগাযোগও ঘটে নাই। শিবনাথ দরিদ্রের সন্তান। একরূপ পরান্নে প্রতিপালিত হইয়াই বিশ্বব্যিালয়ের শিক্ষালাভ করেন। মহর্ষির ধন, কেশবচন্দ্রের বংশমর্য্যাদা—এ সকলের কিছুই তাঁর ছিল না। আর এ সকল ছিল না বলিয়াই ব্রাহ্মসমাজের বিকাশ সাধনে মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র যে কাজটা করিতে পারেন নাই, শিবনাথ শাস্ত্রী তাহা করিয়াছেন।
ইংরেজি শিক্ষা, ইংরেজের শাসন, আধুনিক য়ুরোপীয় সাধনার প্রেরণা,—এ সকলে মিলিয়া আমাদের নব্যশিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রাণে যে অভিনব অনধীনতা বা Independence এর ভাব জাগাইয়া তুলে, তাহার ক্রমবিকাশের ইতিহাস আর ব্রাহ্মসমাজের বিগত পঞ্চাশ বৎসরের ইতিহাস দুই এক বস্তু। এই অভিনব অনধীনতার আদর্শ ব্রাহ্মসমাজকে যতটা অধিকার করে, দেশের অপর কোন সম্প্রদায়কে ততটা অধিকার করিতে পারে নাই। অপরে আংশিকভাবে এই আদর্শের অনুসরণ করিয়াছেন। কেবল ব্রাহ্মসমাজই ইহাকেই সম্পূর্ণভাবে জীবনের সকল বিভাগে গড়িয়া তুলিতে গিয়াছে। আর ব্রাহ্মসমাজও যে প্রথমাবধিই এই আদর্শকে একান্তভাবে আশ্রয় করিয়াছিল, এমনও নহে। মহর্ষি ইহাকে যতটা অবলম্বন করেন, কেশবচন্দ্র তদপেক্ষা বেশী করিয়াছিলেন। আর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে এই অনধীনতার আদর্শ যতটা ফুটিয়া উঠে, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে তদপেক্ষা অধিক ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই অনধীনতা-মন্ত্রের সাধক এবং এই অনধীনতা-ধর্মের—বা ‘Religion of Freedomএর পুরোহিতরূপেই, ব্রাহ্মসমাজের ভিতর দিয়া, এ দেশের আধুনিক ধর্ম্মজীবনে ও কর্ম্মজীবনে, প্রথমে মহর্ষির, তার পরে কেশবচন্দ্রের এবং সর্ব্বশেষে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর শিক্ষার ও চরিত্রের যাহা কিছু প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজে প্রধানতঃ তত্ত্বমীমাংসায় ও ধর্ম্মসাধনেই এই অনধীনতার আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করেন। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে কেশবচন্দ্র ইহাকে আরও একটু বিস্তৃততর ক্ষেত্রে,—পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে, প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু দেশের আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের প্রাণে এই অনধীনতাপ্রবৃত্তি ক্রমে যতটা বলবতী ও বহুমুখী হইয়া উঠে, কেশবচন্দ্র বেশিদিন তাহার সঙ্গে আপনার আধ্যাত্মিক জীবনের যোগ রক্ষা করিতে পারেন নাই এবং তাহারই জন্য দেশের নবশিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপরে তাঁহার পূর্ব্বপ্রভাব ক্রমশঃ নষ্ট হইতে আরম্ভ করে। এরূপ অবস্থায়ই বস্তুতঃ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের জন্ম হয় এবং পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এই অনধীনতা আদর্শের সাধক ও প্রচারকরূপে নূতন সমাজের নেতৃত্বপদে প্রতিষ্ঠিত হ’ন।
মহর্ষির প্রকৃতিগত রক্ষণশীলতাই তাঁহাকে সর্ব্বান্তঃকরণে এই নূতন অনধীনতার আদর্শের অনুসরণ করিতে দেয় নাই। মহর্ষির এই রক্ষণশীলতার অন্তরালে, তাঁহার অজ্ঞাতসারে, একটা সমাজানুগত্যের ভাব বিদ্যমান ছিল। আপনার তত্ত্বসিদ্ধান্তে মহর্ষি কতকটা য়ুরোপীয় আদর্শের যুক্তিবাদী ছিলেন, হয় ত এমনও বলা যাইতে পারে। কিন্তু সাধারণ সামাজিক ব্যাপারে মহর্ষি সর্ব্বদাই স্বদেশের সমাজের সঙ্গে যথাসম্ভব যোগ রাখিয়া চলিতে চাহিয়াছিলেন। এইজন্য মহর্ষি অনেক সময় মর্য্যাদাহানির ভয়েই অনেক অযৌক্তিক সমাজবিধানও মানিয়া চলিতেন। মহর্ষির এই রক্ষণশীলতা কিয়ৎপরিমাণে তাঁহার আভিজাত্যের আর কিয়ৎপরিমাণে তাঁহার প্রকৃতিগত স্বাদেশিকতার ফল ছিল।
কেশবচন্দ্রের রক্ষণশীলতার মূলে হিন্দুর সমাজানুগত্য নহে, কিন্তু খৃষ্টীয় Non-conformist Conscience এর নৈতিক প্রভাবই বিদ্যমান ছিল। এই Non-conformist Conscience একটা অদ্ভুত বস্তু। আপনার ব্যক্তিগত স্বত্বস্বার্থের প্রতিষ্ঠায় ইহা সর্ব্বদাই অত্যুদার হইয়া উঠে। কিন্তু অপরের ব্যক্তিগত স্বত্বস্বার্থের সঙ্গে বিরোধ উপস্থিত হইলে, এই বস্তুই অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ও অনুদার হইয়া পড়ে। ইহা ধর্ম্মের ও সত্যের দোহাই দিয়া একদিকে আপনাকে অপরের আনুগত্য হইতে মুক্ত করিতে চাহে। অন্যদিকে আপনার মতামতকে অপরের উপরে চাপাইয়া তাহাদের মুক্তিবিধানের জন্যই তাহাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে হরণও করে। এই জন্য এই Non-conformist Conscience যুগপৎ উদার ও রক্ষণশীল হয়। কেশবচন্দ্রের রক্ষণশীলতা এই ধাতেরই ছিল। মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র উভয়েই অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ খৃষ্ট-শতাব্দীর য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের প্রভাবে ধর্ম্মসংস্কারকার্য্যে ব্রতী হন। কিন্তু মহর্ষির ভিতরকার ভাব ও আদর্শ সর্ব্বদাই হিন্দু ছিল। কেশবচন্দ্রের ভিতরকার ভাব, বিশেষতঃ প্রথমজীবনে, বহুল পরিমাণে পিউরিট্যান খৃষ্টীয়ান (Puritan Christian) আদর্শের দ্বারা অভিভূত হইয়াছিল। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজকেও তিনি এইভাবেই গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।
পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর মধ্যে এক সময়ে মহর্ষির হিন্দুভাবাপন্ন কিংবা কেশবচন্দ্রের পিউরিট্যানভাবাপন্ন রক্ষণশীলতা একেবারেই ছিল না বলিলেও চলে। খৃষ্টীয় জগতে পিউরিট্যান্গণ সংসারের সর্ব্ববিধ সম্বন্ধে একটা তীব্র পবিত্রতার আদর্শের অনুসরণ করেন। কেশবচন্দ্রও যৌবনাবধিই এই আদর্শের অনুসরণ করিয়া চলিয়াছিলেন। আমাদের প্রাচীন ধর্ম্মে ও সাধনায় যাহাকে শুদ্ধতা বলে, এই খৃষ্টীয়ানী পবিত্রতা ঠিক সে বস্তু নয়। আমাদের দেহশুদ্ধি বা ভূতশুদ্ধি এবং চিত্তশুদ্ধির কথা আধুনিক খৃষ্টীয় সাধনায় পাওয়া যায় না। কেশবচন্দ্র যে পবিত্রতা প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য ব্যস্ত ছিলেন, তাহা ইংরেজি পিউরিটি, সংস্কৃত শুদ্ধতা নহে। এই পিউরিটি রক্ষা করিবার আত্যন্তিক আগ্রহ হইতেই কেশবচন্দ্রের রক্ষণশীলতার উৎপত্তি হয়। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবনে ও চরিত্রে অতি কঠোর সংযমের পরিচয় পাওয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু তাঁর অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে মহর্ষির স্বাভাবিক সমাজানুগত্য কিংবা কেশবচন্দ্রের পিউরিটি প্রবণতা কখনই ছিল না।
দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র উভয়ের মধ্যেই একটা অতি প্রবল প্রকৃতিগত আস্তিক্য-বুদ্ধিও ছিল। আর নিজেদের প্রকৃতির এই আভ্যন্তরীণ ধর্ম্ম-প্রবণতার বা বিশ্বাস-প্রবণতার গুণেই য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ আশ্রয় করিয়াও ইঁহারা সংশয়বাদী হইয়া উঠেন নাই। ইঁহাদিগের অটল ঈশ্বরবিশ্বাস আপন আপন প্রকৃতির অন্তঃস্থল হইতেই ফুটিয়া উঠিয়াছিল, যুক্তিতর্কের দ্বারা স্থাপিত হয় নাই। ফলতঃ এই প্রকৃতিগত ঈশ্বর-বিশ্বাসকেই মহর্ষি আত্মপ্রত্যয় বলিয়াছেন। আপনার ধর্ম্মসিদ্ধান্তে কেশবচন্দ্র এই প্রকৃতিগত আস্তিক্য-বুদ্ধিকেই অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ খৃষ্ট-শতাব্দীর খৃষ্টীয়ান দর্শনের পরিভাষায় ইন্টুইসন্ (intuition) নামে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। মহর্ষির আত্মপ্রত্যয়ই কেশবচন্দ্রের প্রথম জীবনের ধর্ম্মসিদ্ধান্তের ইন্টুইসন্। আর এ দু’ই মূলতঃ ও বস্তুতঃ তাঁহাদের নিজেদের প্রকৃতিগত ব্যবসায়াত্মিকা আস্তিক্য-বুদ্ধির নামান্তর মাত্র। এই প্রকৃতিগত আস্তিক্য-বুদ্ধি ছিল বলিয়াই মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র আত্মপ্রত্যয় বা ইন্টুইসন্রূপ চঞ্চল ভিত্তির উপরেও আপনাদিগের এমন অটল ধর্ম্ম-বিশ্বাসকে গড়িয়া তুলিতে পারিয়াছিলেন।
কিন্তু সংশয়-প্রবণ য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের প্রভাবে যে সকল লোক ব্রাহ্মসমাজে আসিয়া পড়েন, তাঁহাদের অনেকেরই এই পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সাধনসম্পদ ছিল না। বিজয়কৃষ্ণ এবং অঘোরনাথ প্রভৃতি দুই চারিজন ধর্ম্মপ্রাণ সাধুপুরুষ ভিন্ন ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক এবং উপাসকগণের মধ্যে প্রায় কাহারই প্রকৃতির ভিতরে মহর্ষির বা কেশবচন্দ্রের ন্যায় কোনও বলবতী আস্তিক্য-বুদ্ধি ছিল না। সুতরাং ইঁহারা অতক-প্রতিষ্ঠ পরমতত্ত্বকে লৌকিক তর্কযুক্তির উপরেই গড়িয়া তুলিবার চেষ্টায় নিযুক্ত হন। ইঁহাদের প্রায় সকলেই কেশবচন্দ্রের বাগ্মী প্রতিভায় আকৃষ্ট হইয়া ব্রাহ্মসমাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই সকল যুক্তিবাদী ব্রাহ্মগণের মধ্যে কেহ কেহ কেশবচন্দ্রের অলোকসামান্য মনীষীত্বের প্রভাবে অভিভূত হইয়া তাঁহার প্রতি অত্যন্ত ভক্তিমান হইয়া উঠেন এবং তাঁহাকেই একমাত্র প্রত্যক্ষ গুরুরূপে বরণ করিয়া একান্তভাবে তাঁহার আনুগত্য গ্রহণ করেন। অতি সংশয়বাদ সর্ব্বত্রই এই ভাবে অনেক সময় অতি-বিশ্বাসে যাইয়া পড়ে। এই অতিসংশয়বাদেরই ইংরেজি নাম Scepticism এবং ইংরেজিতে যাহাকে Credulity বলে বাঙ্গলায় তাহাকেই অতি-বিশ্বাস বলা যাইতে পারে। কোনও প্রকারের অতীন্দ্রিয় ও অপ্রত্যক্ষতত্ত্বে যাঁহারা কোন মতেই বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারেন না, তাঁহারাই Sceptic বা অতি-সংশয়বাদী। আর এই অতিসংশয়বাদের তাড়নাতেই এই সকল লোকে অনেক সময় এমন সকল বিষয়েও আগ্রহাতিশয় সহকারে বিশ্বাস স্থাপন করেন, যাহা কখনও কোন যুক্তিতর্কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না ও হইতে পারে না। মানব প্রকৃতির অদ্ভুত জটিলতা নিবন্ধন অনেক সময় এইরূপে অতিসংশয়বাদ বা Scepticism হইতেই অতি-বিশ্বাসের বা credulity’র উৎপত্তি হয়। কেবশচন্দ্রের অনুচরগণের মধ্যে মূলে যাঁহারা অতিসংশয়বাদী ছিলেন তাঁহাদেরই একদল কেশবচন্দ্রের দৈবী প্রতিভার দ্বারা মুগ্ধ হইয়া অতি-বিশ্বাসভরে তাঁহাকে ঈশ্বর-প্রেরিত মহাপুরুষ রূপে বরণ করেন এবং তাঁহার ঐকান্তিক আনুগত্য অবলম্বন করিয়া তাঁহার মত ও উপদেশানুসারে আপনাদিগের ধর্ম্ম-জীবন ও কর্ম্ম-জীবনকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। আর একদল লোক এই অতি-বিশ্বাসকে বর্জ্জন এবং কেশবচন্দ্রের মহাপুরুষত্বের দাবীকে উপেক্ষা করিয়া, আপনাদিগের স্বানুভূতিকে আশ্রয় করিয়া শুদ্ধ তর্কযুক্তির সাহায্যে পরমতত্ত্বকে ও ধর্ম্মসাধনাকে নিজ নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টায় নিযুক্ত হন। এইরূপে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠার অল্পদিন পর হইতেই তাহার ভিতরে দুইটি পরস্পরবিরোধী ভাব ও আদর্শ ফুটিয়া উঠিতে আরম্ভ করে।
প্রথমে মহর্ষি এবং তারপরে কেশবচন্দ্রও আপনার প্রথম যৌবনে ব্রাহ্মধর্ম্ম ও ব্রাহ্মসমাজকে যে পথে পরিচালিত করেন, তাহাতে এরূপ বিরোধ একরূপ অনিবার্য্য হইয়া উঠে। মহর্ষির সময় হইতে ব্রাহ্মসমাজ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ খৃষ্ট-শতাব্দীর য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের উপরেই গড়িয়া উঠে। আর বস্তুতঃ সেই জন্যই কেশবচন্দ্রকে শেষজীবনে “নববিধানের” প্রতিষ্ঠা করিতে হয়। কারণ এই যুক্তিবাদ বা Rationalism, প্রাকৃত বুদ্ধির প্রেরণায়, লৌকিক ন্যায়ের প্রত্যক্ষ ও অনুমান এই প্রমাণদ্বয়কে আশ্রয় করিয়া যে পরমতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করে, তাহাকে স্বচ্ছন্দে ইংরেজিতে Deism বলা যাইতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে Theism বলা যায় কি না সন্দেহ। Deism আর Theismএ পার্থক্য এই যে, একেতে ঈশ্বরতত্ত্বকে বিশ্ব-শক্তি বা বিশ্ববিধানরূপে এবং অপরে শক্তিমান পরমপুরুষ বা বিশ্ববিধাতা ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। শিবনাথ বাবুর কথায়, Deism এর ঈশ্বর শক্তি, Theism এর ঈশ্বর ব্যক্তি। আর প্রকৃতপক্ষে য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ ঈশ্বরকে শক্তিরূপেই প্রতিষ্ঠিত করে, ব্যক্তি বা বিধাতারূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না। মহর্ষির ঈশ্বর কেবল শক্তি মাত্র ছিলেন না, সত্য। কিন্তু মহর্ষির ঈশ্বরানুভূতি প্রকৃতপক্ষে তাঁর ব্রহ্মতত্ত্বের উপরে গড়িয়া উঠে নাই। ইহা তাঁর ভাবাঙ্গ-সাধনেরই ফল। এই ভাবাঙ্গসাধনে মহর্ষি হাফেজ প্রভৃতি মোহম্মদীয় ভক্তগণেরই পন্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন, লৌকিক ন্যায় ও য়ুরোপীয়-যুক্তিবাদ-প্রতিষ্ঠিত মামুলী ব্রাহ্মধর্ম্মের পন্থার অনুসরণ করেন নাই। এই গভীর ভাবাঙ্গসাধনের গুণেই মহর্ষির ব্রাহ্মধর্ম্ম Deism হয় নাই, কিন্তু অতি উচ্চদরের Theism রূপেই তাঁর জীবনে ও চরিত্রে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। কেশবচন্দ্রের ঈশ্বরও শক্তিমাত্র ছিলেন না। কারণ কেশবচন্দ্রের প্রখর সংজ্ঞানের বা conscience এর প্রেরণায় প্রথম হইতেই তাঁর ঈশ্বরতত্ত্বে একটা উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা হয়। মহর্ষি ভাবাঙ্গ-সাধনের ভিতর দিয়া, মোহম্মদীয় ভক্তগণের দৃষ্টান্ত ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে, তাঁহার নিজের জীবনের প্রতাক্ষ ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। কেশবচন্দ্র প্রথম যৌবনে, তাঁর গভীর পাপ-বোধের বা Ethical Consciousness এর ভিতর দিয়া, খৃষ্টীয়ান সাধকগণের দৃষ্টান্তে, ও শিক্ষায় আপনার প্রত্যক্ষ ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্মসমাজে ইঁহারা উভয়েই যে তত্ত্ব-সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করেন, তাহার উপরে Deism এরই প্রতিষ্ঠা হয়; Theismএর প্রতিষ্ঠা হয় না। কিন্তু এ সত্ত্বেও মহর্ষির এবং কেশবচন্দ্রের নিজেদের প্রত্যক্ষ ঈশ্বরতত্ত্ব যে Theism হইয়া উঠে, ইহাদের প্রকৃতির ও সাধনার বিশেষত্বই ইহার প্রধান ও একমাত্র কারণ।
ফলতঃ শুদ্ধ যুক্তিবাদের উপরে কোনও প্রকারের গভীর ধর্ম্মতত্ত্ব ও ধর্ম্মসাধনকে গড়িয়া তুলা যে অসম্ভব, মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র উভয়েই ইহা ক্রমে অনুভব করিয়াছিলেন। এইজন্য ইঁহারা জীবনের শেষ পর্য্যন্ত এই যুক্তিবাদকে ধরিয়া থাকিতে পারেন নাই। ঈশ্বরানুপ্রাণিত হইয়া সাধক অনুকূল অবস্থাধীনে সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া থাকেন এবং ধর্ম্মবস্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রাকৃত-বিচার-বুদ্ধির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় না, কিন্তু এই সকল ঈশ্বরানুপ্রাণিত সাধু মহাজনের সাক্ষ্যের উপরেই প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া থাকে,—মহর্ষি ও কেশবচন্দ্র উভয়েই জীবনের শেষভাগে এই মত প্রচার করেন। কিন্তু যে ঈশ্বরানুপ্রাণনের উপরে মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র দুজনেই পরে আপনাদিগের উপদিষ্ট ব্রাহ্মধর্ম্মের প্রামাণ্যমর্য্যাদা স্থাপন করিতে চেষ্টা করেন, তাঁহাদের ধর্ম্মসিদ্ধান্তের মূলগত যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিত্বাভিমান কিছুতেই সে ঈশ্বরানুপ্রাণনের মতকে সমর্থন করে না।
ফলতঃ যে আধুনিক য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের উপরে ব্রাহ্মসাধারণের তত্ত্বসিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে, তাহাতে কোনও প্রকারের অনন্যসাধারণত্বের বা অপ্রাকৃতত্ত্বের দাবী কখনই গ্রাহ্য হয় না। এই যুক্তিবাদ ধর্ম্মসাধনে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে; কিন্তু সদ্গুরুর প্রতিষ্ঠা সহ্য করিতে পারে না। সমাজগঠনে ও রাষ্ট্রীয়জীবনে এই যুক্তিবাদ কেবল গণতন্ত্রব্যবস্থাকেই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত ও ধর্ম্মসঙ্গত বলিয়া ব্যবস্থা গ্রহণ করে; কিন্তু সমাজ-পতি বা রাজা বা রাষ্ট্রনায়কের আধিপত্য গ্রাহ্য করে না। ফরাসীবিপ্লবের সাম্যমৈত্রীস্বাধীনতার আদর্শ এই যুক্তিবাদের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। কেশবচন্দ্রের ধর্ম্ম সিদ্ধান্ত প্রথমে এই যুক্তিবাদকেই আশ্রয় করিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়, সত্য; কিন্তু ইহা সত্ত্বেও তাঁর ধর্ম্ম প্রবণ বুদ্ধি প্রথমাবধিই এই সাম্য-মৈত্রীস্বাধীনতার আদর্শকে স্বল্পবিস্তর ভীতির চক্ষেই দেখিতে আরম্ভ করে। এই সাম্য মৈত্রীস্বাধীনতার নামে য়ুরোপের ইতিহাসে যে পাশবলীলার অভিনয় হইয়াছে, তাহা স্মরণ করিয়া, যাহাতে এই আদর্শ ব্রাহ্মসমাজে একান্ত প্রতিষ্ঠালাভ না করে, কেশবচন্দ্র সর্ব্বদাই প্রাণপণে তার চেষ্টা করিয়াছিলেন।
ঊনবিংশ খৃষ্ট-শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধ অতীত হইতে না হইতেই য়ুরোপীয় মনীষিগণের মধ্যেও কেহ কেহ ফরাসী বিপ্লবের সামাজিক সিদ্ধান্তের অসঙ্গতি ও অপূর্ণতা প্রত্যক্ষ করিতে আরম্ভ করেন। ফরাসীবিপ্লব যে সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করিতে গিয়াছিল, তাহাতে সমাজে ব্যক্তিগত স্বত্বস্বার্থের একটা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাই জাগাইয়া তুলে, কিন্তু এ সকলের চিরন্তন বিবোধ নিষ্পত্তির কোনও উপায় উদ্ভাবন করিতে পারে নাই। ফরাসীবিপ্লব স্বাধীনতার নামে একটা ঐকান্তিক অনধীনতার ভাবকে জাগাইয়া জনসমাজকে বিশৃঙ্খল ও বিচ্ছিন্নই করিতে থাকে, কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে তার সমাজের ও সেই সমাজান্তর্গত অপরাপর ব্যক্তির যে নিগূঢ় অঙ্গাঙ্গী যোগ রহিয়াছে, তাহাকে ফুটাইয়া তুলিয়া সমাজের ঘননিবিষ্টতা সাধনের কোনও পন্থার প্রতিষ্ঠা করিতে পারে নাই। আধুনিক যুগে প্রাচীনকে ভাঙ্গাই ফরাসীবিপ্লবের বিধিনির্দ্দিষ্ট কর্ম্ম ছিল, এই বিপ্লব সেই কর্ম্মই সাধন করিয়া যায়; কিন্তু নবযুগের নব আদর্শের উপযোগী করিয়া জনসমাজকে নূতন প্রেমের ও বিশ্বজনীনতার উপরে গড়িয়া তোলা তার কাজও ছিল না, সে কাজ ফরাসী বিপ্লব করিতেও পারে নাই। ফরাসী-বিপ্লবের নিকটে আধুনিক সভ্যতা ও সাধনা যে অশোধনীয় ঋণজালে আবদ্ধ, তাহা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াও, এইজন্য ইতালীয় মনীষী ম্যাজিনী (১৮৩৫) ফবাসীবিপ্লবের অধিনায়কগণের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার সিদ্ধান্তকে যথাযোগ্যভাবে সংশোধন করিয়া লইয়া, বিশুদ্ধতর আস্তিক্যবুদ্ধি-প্রতিষ্ঠিত হিউম্যানিটীর (Humanity) উপরে, আপনার স্বদেশচর্য্যা বা Nationalismকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। এই উন্নত আদর্শের উপরেই ম্যাজিনী মাতৃভূমির উদ্ধারকল্পে যূন ইতালীয় সমাজের বা Young Italy Associationএর প্রতিষ্ঠা করেন। ইহার কিছুকাল পরে ইংরেজ মনীষী কার্লাইল (Carlyle) Hero Worship নামক প্রবন্ধে এক নূতন মহাপুরুষবাদের প্রতিষ্ঠা করিয়া ফরাসী বিপ্লবের সাম্যবাদের মূল ভিত্তিকে একেবারে ভাঙ্গিয়া দিতে চেষ্টা করেন।
ব্রাহ্মসমাজকে এই বিপ্লবাত্মক যুক্তিবাদ ও সাম্যবাদের প্রভাব হইতে রক্ষা করিবার জন্য কেশবচন্দ্র আগ্রহাতিশয় সহকারে কার্লাইলের মহাপুরুষবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু কার্লাইলের মহাপুরুষবাদেও প্রকৃতপক্ষে ধর্ম্মের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠিত হয় না দেখিয়া, তিনি ইহার সঙ্গে ইহুদীয় সাধনার ঈশ্বরতন্ত্রের বা Theocracyর মতকে যুক্ত করিয়া দিয়া, এক নূতন প্রেরিত-মহাপুরুষবাদের প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হ’ন। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের জন্মের কিছুকাল পরেই কেশবচন্দ্র মহাপুরুষ বা Great Men সম্বন্ধে এক সুদীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন। এই বক্তৃতাতেই তিনি সর্ব্বপ্রথমে এই নূতন সিদ্ধান্ত অভিব্যক্ত করেন। এইখানেই, প্রকৃতপক্ষে, ব্রাহ্মসমাজের কৃতবিদ্য যুক্তিবাদী যুবকদলের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের ও তাঁর অনুগত প্রচারকগণের বিরোধ আরম্ভ হয়।
শিবনাথের চরিত্র
এই বিরোধের সূত্রপাত অবধিই শিবনাথ কেশবচন্দ্রের প্রতিপক্ষীয় দলের মুখপাত্র ও অগ্রণী হইয়া উঠিতে আরম্ভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ না করিয়া, শিক্ষার্থী অবস্থাতেই, তিনি ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক কৃতবিদ্য যুবকগণ যেরূপভাবে কেশবচন্দ্রের অলৌকিক প্রতিভার দ্বারা মুগ্ধ হইয়া আত্যন্তিক শ্রদ্ধাসহকারে তাঁহার শিক্ষা দীক্ষা গ্রহণ করিতেছিলেন, শিবনাথ সেরূপভাবে ব্রাহ্মসমাজে আসিয়াছিলেন কি না, সন্দেহ। ফলতঃ যৌবনাবধিই শিবনাথের মধ্যে এই আত্যন্তিক শ্রদ্ধার ভাব অত্যন্তই অল্প ছিল। শিবনাথের পিতা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত হইয়াও, অতিশয় বুদ্ধিমান্ লোক ছিলেন। আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির সঙ্গে গভীর শ্রদ্ধার যোগ এ জগতে অত্যন্ত বিরল। বিশেষতঃ যেখানে এই তীক্ষ্ণবুদ্ধির সঙ্গে সুরসিকতাও বিদ্যমান থাকে, সেখানে শ্রদ্ধা ফুটিয়া উঠিবার অবসর মাত্রই প্রায় পায় না। যেমন তাঁর পিতৃচরিত্রে, সেইরূপ শিবনাথের নিজের প্রকৃতিতেও একদিকে প্রখর ধীশক্তি ও অন্যদিকে উচ্ছসিত রসিকতা এই দুইই পাওয়া যায়। সুতরাং প্রথম যৌবনে তাঁর বিচারশক্তি ও বিদ্রূপ-প্রবৃত্তি যতটা ফুটিয়াছিল, শ্রদ্ধাশীলতা যে ততটা ফুটিয়া উঠে নাই, ইহা কিছুই বিচিত্র নহে। তাঁর সে কালের প্রবন্ধাদি ইহারই সাক্ষ্য দান করে। সোমপ্রকাশ-সম্পাদক স্বর্গীয় দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয় শিবনাথের মাতুল ছিলেন। এই সূত্রে ছাত্রাবস্থা হইতেই সোমপ্রকাশের সঙ্গে তাঁরও কতকটা সম্বন্ধ গড়িয়া উঠে। আর সে সময়ে সোমপ্রকাশে শিবনাথের যে সকল রচনা প্রকাশিত হয়, তাহার মধ্যে তাঁর এই যুক্তিপ্রবণতার ও বিদ্রূপাসক্তির বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের “বঙ্গদর্শনে”—
“হইতাম যদি আমি যমুনার জল,
হে প্রাণবল্লভ,”
প্রকাশিত হইলে, সোমপ্রকাশে শিবনাথ তাহার অনুকরণে যে বিদ্রূপাত্মক কবিতা লেখেন, তাহাতেই তাঁহার উজ্জ্বল কবিপ্রতিভা ও অসাধারণ বিদ্রূপাসক্তির প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল এবং বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র প্রভৃতি সাহিত্যরথিগণও তাহা পড়িয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। ফলতঃ তাঁর আপনার স্বরূপে শিবনাথ তত্ত্বজ্ঞানীও নহেন, ভগবদ্ভক্তও নহেন, চিন্তাশীল দার্শনিকও নহেন, মুমুক্ষু সাধকও নহেন, কিন্তু অসাধারণ শব্দসম্পত্তিশালী সাহিত্যিক ও সুরসিক কবি। এক সময়ে শব্দযোজনার কুশলতায় শিবনাথ বাঙ্গালী সাহিত্যিকদিগের মধ্যে অতি উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। কোনও কোনও দিক্ দিয়া বিচার করিলে, এ বিষয়ে তাঁর সমকক্ষ আর কেহ ছিলেন কি না, সন্দেহ। প্রথমে শক্তিশালী লেখক ও সুরসিক কবিরূপেই বাঙ্গলা সাহিত্যে ও বাঙ্গালী সমাজে শিবনাথের প্রভাব ও প্রতিপত্তি হয়। এমন কি, পরে ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃপদ পাইয়া স্বদেশের ধর্ম্মচিন্তায় ও কর্ম্মজীবনে তিনি যা কিছু প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছেন, আপনার স্বাভাবিকী সাহিত্যশক্তি ও কবিপ্রতিভার সেবায় একান্তভাবে আত্মোৎসর্গ করিলে, বাঙ্গালার আধুনিক সাহিত্যের ও সমাজজীবনের ইতিহাসে তদপেক্ষা অনেক উচ্চতর স্থান পাইতেন, সন্দেহ নাই। আর ব্রাহ্মসমাজেও তিনি যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, তাহাও প্রকৃতপক্ষে তাঁর বাগ্মিতাশক্তি ও সাহিত্য-সম্পদের উপরেই গড়িয়া উঠিয়াছে, কোনও প্রকারের অনন্যসাধারণ সাধনসম্পত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।
আর ইহার প্রধান কারণ এই যে, কুচবিহার বিবাহোপলক্ষে যাঁহারা কেশবচন্দ্রের অধিনেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করিয়া ব্রাহ্মসমাজে আবার একটা নূতন দল গড়িয়া তুলিতে প্রবৃত্ত হ’ন, তাঁহাদের অনেকে তখনও পর্য্যন্ত জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে য়ুরোপীর যুক্তিবাদের উপরেই বিশেষভাবে আপনাদিগের নূতন ধর্ম্মজীবনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বিজয়কৃষ্ণও এই দলের সঙ্গে যোগদান করেন সত্য; কিন্তু একদিকে কেশবচন্দ্রের আপনার শিক্ষার সঙ্গে তাঁহার এই কার্য্যের একান্ত অসঙ্গতি এবং অন্যদিকে এই বিবাহ সম্বন্ধে ব্রাহ্মসমাজের অপর প্রচারকগণ কেশবচন্দ্রের পক্ষসমর্থনের জন্য যে সকল উপায় অবলম্বন করেন, তাহার অন্তর্নিহিত ওকালতী-বুদ্ধি-সুলভ সত্যগোপনের এবং অসত্য-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, এই দুই মিলিয়া বিজয়কৃষ্ণের ঐকান্তিক সত্যনিষ্ঠা ও ধর্ম্মনিষ্ঠাতে গুরুতর আঘাত করিয়াছিল বলিয়াই, তিনি কেশবচন্দ্রকে পরিত্যাগ করেন। আর ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম্মনিষ্ঠ, ভক্তিমান্ ও রক্ষণশীল সভ্যদিগকে আকৃষ্ট করিবার জন্য নূতন সমাজের প্রতিষ্ঠাতাগণ বিজয়কৃষ্ণকে আচার্য্যপদে বরণ করেন, নতুবা প্রকৃতপক্ষে তিনি কখনই ইঁহাদিগের ধর্ম্মজীবনের বা কর্ম্মজীবনের অধিনেতৃত্বলাভ করেন নাই। ফলতঃ নূতন সমাজের কর্ত্তৃপক্ষেরা বিজয় কৃষ্ণের ভক্তযশের সাহায্যে আপনাদিগের বিদ্রোহিদলের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করিতে যতটা উৎসুক ছিলেন তাঁহার সাধু চরিত্রের এবং অলোকসামান্য আধ্যাত্মিক সম্পদের আশ্রয়ে নিজেদের ধর্ম্মজীবনকে গড়িয়া তুলিবার জন্য ততটা উৎসুক ছিলেন না। এই কারণেই বিজয়কৃষ্ণের সাধু চরিত্রের প্রভাব সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে বদ্ধমূল হইবার অবসর পায় নাই এবং তাহারই জন্য সমাজের নেতৃবর্গ কিছুদিন পরে অত্যন্ত সরাসরিভাবে বিজয়কৃষ্ণের সঙ্গে নিজেদের সমাজের সর্ব্বপ্রকারের যোগ ছেদন করিতে পারিয়াছিলেন। আর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল ছিল বলিয়াই বিশেষ সাধনসম্পদের অধিকারী না হইয়াও কেবল আপনার বিদ্যাবুদ্ধি ও বাগ্মিতা গুণে শিবনাথ শাস্ত্রী তাহার অধিনায়কত্ব লাভ করেন।
য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়াও অনেকে ক্রমে এই যুক্তিবাদের অপূর্ণতা ও অসঙ্গতি উপলব্ধি করিয়া, আপনাদিগের তত্ত্বসিদ্ধান্তে ও ধর্ম্মসাধনে এই যুক্তিবাদকে স্বল্প বিস্তর অতিক্রম করিয়া গিয়াছেন। কেশবচন্দ্র আপনিও তাহা করেন। তাঁহার অনুগত শিষ্য মণ্ডলীও এই যুক্তিমার্গ বর্জ্জন করিয়া এক প্রকারের ভক্তিমার্গ অবলম্বন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু শিবনাথ প্রথম যৌবনে যে সকল সিদ্ধান্তকে আশ্রয় করিয়া ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিয়াছিলেন, আজ পর্য্যন্ত ও তাহার কোন পরিবর্ত্তন বা সংশোধন করিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। ইহার প্রধান কারণ এই যে, তাঁহার অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যেই এমন একটা যুক্তি প্রবণতা আছে, যাহাকে যতই ছাড়াইতে ইচ্ছা করুন না কেন, এ পর্য্যন্ত কিছুতেই ছাড়াইয়া উঠিতে পারেন নাই। এই যুক্তি প্রবণতা মূলতঃ ইংরেজিতে যাহাকে Scepticism বা অতিসন্দেহবাদ বলে, তাহারই রূপাস্তর মাত্র। আর শিবনাথ বাবুর বক্তৃতা ও উপদেশাদিতে সর্ব্বদাই যেন এই বস্তুটী লুকাইয়া থাকে। তিনি অনেক সময় আস্তিক্যবিরোধী সিদ্ধান্ত সকল খণ্ডন করিবার চেষ্টা করেন, আর তখন প্রথমে যথারীতি সে সকল সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যাও করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁর এই সকল বক্তৃতায় ও উপদেশে এ সকল বিরোধী সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা যতটা বিশদ ও যুক্তি প্রতিষ্ঠ হয়, তিনি যে ভাবে এ সকলের খণ্ডন করিতে প্রয়াস পান, তাহা সেরূপ বিশদ এবং সদ্যুক্তি দ্বারা সমর্থিত হইয়া উঠে না। এই কারণে তাঁর ধর্ম্মোপদেশে যুক্তিবাদী শ্রোতা বা পাঠকের প্রাণে ধর্ম্মের মূল ভিত্তিগুলিকে যে পরিমাণে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া দেয়, সে পরিমাণে আবার কিছুতেই তাহাকে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারে না। আর এই সাংঘাতিক অপূর্ণতা সত্ত্বেও তাঁর বক্তৃতা ও উপদেশাদিতে যে কতকটা ধর্ম্মের প্রেরণা জাগাইয়া তুলে, ইহা তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতাশক্তি এবং মায়াময়ী কবিকল্পনারই ফল।
কিন্তু ইহাতে শিবনাথ বাবুর কোনই গৌরবের হানি হয় না। তত্ত্বসিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা কিম্বা ভক্তিপন্থা প্রদর্শন করিবার জন্য বিধাতাপুরুষ তাঁহার সৃষ্টি করেন নাই; করিলে তাঁর অন্তঃপ্রকৃতি অন্য ছাঁচেই গঠিত হইত। প্রকৃত ধর্ম্মজীবনের কতকগুলি পূর্ব্ববৃত্ত সাধন আছে। আর মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্রের প্রথম জীবনের সংস্কার-চেষ্টা কতকটা সঙ্কুচিত হইয়া আসিলে, শিবনাথ বাবুই এই সকল পূর্ব্ববৃত্ত সাধনে ব্রাহ্মসমাজের এবং কিয়ৎপরিমাণে দেশের সাধারণ শিক্ষিত ও শিক্ষার্থী যুবকদলের গুরু হইয়া, তাহাদের ধর্ম্মজীবন ও কর্ম্মজীবনকে ফুটাইয়া তুলিবার যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছেন। সর্ব্বপ্রকারের সংস্কার বর্জ্জন করিয়া, চিত্তশুদ্ধি লাভ করিলে, সেই শুদ্ধচিত্তেই কেবল পরমতত্ত্বের সার্থক অনুশীলন সম্ভব হয়। প্রথমে সন্দেহ, পরে বিচারযুক্তি, তার পরে, সর্ব্বশেষে, এই বিচারযুক্তির ফলে সত্যপ্রতিষ্ঠা হইলে, সন্দেহের একান্ত নিরসন হইয়া, প্রকৃত শ্রদ্ধা বা আস্তিক্যবুদ্ধির সঞ্চার,—এই ভাবেই প্রকৃত ধর্ম্মজীবনের পূর্ব্ববৃত্ত সাধন সমাপ্ত হইয়া থাকে। এই শ্রদ্ধাই, এজন্য, ধর্ম্মজীবনের প্রথম সোপান ও মূল ভিত্তি। আর এ কালের অনেক বাঙ্গালী ও ভারতবাসী শিবনাথ বাবুর শিক্ষাদীক্ষার প্রেরণায় নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সর্ব্ববিধ পূর্ব্বসংস্কারবর্জ্জিত হইয়া, সন্দেহ, বিচার, প্রভৃতির সাহায্যে ক্রমে গভীর আস্তিক্যবুদ্ধি লাভ করিয়াছেন। অনেকে তাঁর নায়কত্বে “না” এর পথ বাহিয়া গিয়া, পরে “হাঁ” এর রাজ্যে যাইয়া পৌঁছিয়াছেন। আর ইঁহারা ব্রাহ্মসমাজে থাকিয়া বা তাহার বাহিরে যাইয়া, নিজ নিজ সাধনশক্তির দ্বারা যে দিকে ও যে পরিমাণে দেশের ধর্ম্মজীবন ও কর্ম্মজীবনকে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন বা তুলিতেছেন, তার জন্য এদেশের বর্ত্তমান সাধনা কিয়ৎপরিমাণে শিবনাথ বাবুব নিকটে ঋণী রহিয়াছে, সন্দেহ নাই।
মহর্ষির সময়াবধি ব্রাহ্মসমাজ যে ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার বা ‘Freedom’এর আদর্শকে বরিয়া, আমাদিগের আধুনিক আধ্যাত্মিক জীবন ও সামাজিক-জীবনকে গড়িয়া তুলিবার সংকল্প করিয়া, দেশের বর্ত্তমান ঐতিহাসিক বিবর্ত্তনস্রোতের মুখে যাইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, মহর্ষি কিংবা তাঁর আদি ব্রাহ্মসমাজ, কেশবচন্দ্র কিংবা তাঁর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ, ইহাঁদের কেহই শেষ পর্য্যন্ত সেই সংকল্পের উপরে দৃঢ়ব্রত হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে পারেন নাই; পারিলে, ব্রাহ্মসমাজের ভিতর দিয়া, দেশের বর্ত্তমান ধর্ম্মমীমাংসায় ও কর্ম্মজীবনে, শিবনাথ শাস্ত্রী কিংবা তাঁহার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কোনই স্থান হইত না। কিন্তু মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র উভয়েই, প্রথমে যে যুক্তি ও বিচার অবলম্বন করিয়া দেশ-প্রচলিত ধর্ম্মকর্ম্মকে বর্জ্জন করেন, সেই যুক্তি ও বিচারের উপরে, সর্ব্ববিধ ফলাফলভাবনা-বিরহিত হইয়া, বিশ্বাস বা সাহস ভরে, শেষ পর্য্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিতে পারেন নাই। ইঁহারা দুইজনেই স্বদেশের ধর্ম্মের ও সমাজের সনাতন ভিত্তিকে ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতেই, তাহার ফলে নিজেদের নূতন সমাজে ধর্ম্মের নামে নাস্তিক্যবুদ্ধি ও স্বাধীনতার অজুহাতে স্বেচ্ছাতন্ত্র অরাজকতার অভ্যুদয় দেখিয়া, একান্ত ভীতিগ্রস্ত হইয়া, নিতান্ত অযৌক্তিক ও অসঙ্গত উপায়ে স্বস্কৃতকর্ম্মের অপরিহার্য্য পরিণামের প্রতিরোধ করিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হন। মহর্ষির ভাঙার ভিতরেও, তাঁর প্রকৃতিতে হিন্দু-আস্তিক্যবুদ্ধি ও রক্ষণশীলতার গুণে, কতকটা সংযম বিদ্যমান ছিল। সুতরাং ইনি যে উপায়ে আপনার কর্ম্মের মন্দফলকে নিরস্ত করিতে চেষ্টা কবেন, তার মধ্যেও কতকটা সংযতভাব ছিল। কেশবচন্দ্রের ভাঙার অন্তরালে হিন্দুর আস্তিক্যবুদ্ধি বা রক্ষণশীলতা ছিল না, কিন্তু খৃষ্টীয়ান্ কনফর্ম্মিষ্ট-স্বভাব-সুলভ উদ্ধত অহংবুদ্ধি ও উদ্দাম সংস্কার চেষ্টাই বিদ্যমান ছিল। সুতরাং তাঁর ধর্ম্ম ও সমাজ-সংস্কার-চেষ্টার অন্তরালে সেরূপ কোনও সংযত ও সশ্রদ্ধ ভাব আদৌ ছিল না বলিয়া, তিনি যে উপায়ে স্বকৃতকর্ম্মের অপরিহার্য্য পরিণামের প্রতিরোধ করিতে প্রবৃত্ত হন, তাহাও অত্যন্ত উদ্দাম ও অসংযত হইয়া উঠে। মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র উভয়েই ক্রমে বিশেষ ঈশ্বরানুপ্রাণতার দাবী করিয়া, আপনাদিগের উপদিষ্ট ব্রাহ্মধর্ম্মকে একটা বিশেষ ও অতিপ্রাকৃত প্রামাণ্য-মর্য্যাদা দান করিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু মহর্ষির এই দাবীর অন্তরালে একটা সংযত ও সশ্রদ্ধ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়, নিতান্ত অন্তরঙ্গ ও অনুগত শিষ্যগণের নিকটেই প্রসঙ্গক্রমে তিনি এই দাবীর উল্লেখ করিয়াছেন, জনসাধারণের মধ্যে কখনও প্রকাশ্যভাবে ইহার প্রতিষ্ঠা করিতে যান নাই। কেশবচন্দ্র, অন্যদিকে, কেবল এদেশে নয়, সমগ্র জগতের সমক্ষে তাঁর অনন্যসাধারণ, ঈশ্বরানুপ্রাণতার দাবী জাহির করিয়াছেন এবং মানবেতিহাসের প্রথমাবধি যুগে যুগে ঈশ্বরপ্রেরিত মহাজনেরা এই ঈশ্বরানুপ্রাণতার সাহায্যে যেমন যুগধর্ম্ম প্রবর্ত্তিত করিয়াছেন, তিনি ও তাঁহার “প্রেরিত-মণ্ডলী” সেইরূপই বর্ত্তমান যুগের “নববিধানকে” প্রতিষ্ঠিত করিতে আসিয়াছেন, নানাদিকে ও নানাভাবে, এই মত প্রচার করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্র ও পুরাগত গুরুপরম্পরাশ্রিত সাধনমার্গ সকলকে অভ্রান্ত নয় বলিয়া সর্ব্বপ্রকারের প্রামাণ্য-মর্য্যাদা ভ্রষ্ট করিয়া, নিজেদের উপদেশ ও সিদ্ধান্তের জন্য সেই মর্য্যাদার দাবী করিলে, লোকে তাহা শুনিবে কেন? মহর্ষির এবং কেশরচন্দ্রের এই অনন্যসাধারণ ঈশ্বরানুপ্রাণতার দাবী ব্রাহ্মসমাজের কোনও কোনও সভ্য স্বীকার করিলেও আধুনিক ভারতসমাজে এ পর্য্যন্ত স্বীকৃত হয় নাই; কখনও যে হইবে, তারও কোনই সম্ভাবনা নাই। সুতরাং দেশের ধর্ম্মজীবনে ও কর্ম্মজীবনে ব্রাহ্মসমাজ যে জটিল সমস্যাকে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন, এ পর্য্যন্ত ব্রাহ্ম আচার্য্যগণ তার কোনও মীমাংসার পথ দেখাইতে পারেন নাই।
তবে শিবনাথ শাস্ত্রী এবং তাঁর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ যে পরিমাণে এই সমস্যাকে মীমাংসার দিকে লইয়া গিয়াছেন, মহর্ষি কিংবা কেশবচন্দ্র যে তাহাও পারেন নাই—জনসমাজের ঐতিহাসিক বিবর্ত্তনের প্রাচীন অভিজ্ঞতার দিক্ দিয়া বিচার করিলে, একথাও অস্বীকার করা অসম্ভব হইবে। ফল যেমন পরিপূর্ণ পক্বতা প্রাপ্ত হইলে, আপনিই গাছ হইতে পড়িয়া গিয়া, আবার নূতন ফসলের সূত্রপাত করে; সেইরূপ যে সকল চিন্তা, ভাব ও আদর্শের প্রেরণায় সমাজমধ্যে কোনও জটিল যুগসমস্যার উৎপত্তি হয়, সেই সকল চিন্তা, ভাব ও আদর্শ নিঃশেষরূপে ফুটিয়া উঠিয়া আপনারাই নিজেদের ভিতরকার সত্য ও অসত্য, যুক্তি ও যুক্ত্যাভাস, কল্যাণ ও অকল্যাণকে বিশদ করিয়া তুলে এবং তখনই প্রাচীন ও প্রচলিতের সঙ্গে নূতন ও অপ্রচলিতের একটা উচ্চতর সামঞ্জস্যের ভূমি প্রকাশিত হইয়া, সেই যুগ-সমস্যার প্রকৃত মীমাংসার পথটা দেখাইয়া দেয়। এই সকল চিন্তা, ভাব ও আদর্শ আপনাদের যথাযথ পরিণতি লাভ করিয়া পূর্ব্বে, কোনও কোনও দিকে তাহাদের অসঙ্গতি বা অমঙ্গল ফল দেখিয়া, যিনিই অকালে কোনও যুগসমস্যার মীমাংসা করিতে যাইবেন, তাঁহার সে মীমাংসা যে অপূর্ণ ও অযৌক্তিক, উদ্ভ্রান্ত ও উদ্ভট হইবে, ইহা অনিবার্য্য। প্রশ্নটা পরিষ্কাররূপে অভিব্যক্ত হইলেই তো তার সদুত্তর দেওয়া সম্ভব হয়। ইংরেজি শিক্ষা ইংরেজের শাসন, য়ুরোপীয় সাধনার সংস্পর্শ, এই সকলে মিলিয়া আমাদের প্রাচীন ধর্ম্মজীবনে ও সমাজজীবনে যে সকল প্রশ্ন জাগাইয়া তুলে, মহর্ষির কর্ম্মচেষ্টা বা কেশবচন্দ্রের জীবনমাত্রা সাঙ্গ হইবার পূর্ব্বে, তার সম্যক্ ও সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি হয় নাই। সুতরাং মহর্ষি বা কেশবচন্দ্র যে এই জটিল প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন নাই, ইহা কিছুই বিচিত্র নহে। ফলতঃ কেবল ব্রাহ্মসমাজের আচার্য্যগণই যে ইহার সদুত্তর দিবার নিষ্ফল চেষ্টা করেন, তাহাও নহে। একদিকে যেমন কেশবচন্দ্র, অন্যদিকে সেরূপ দয়ানন্দ স্বামীর আর্য্যসমাজ, অল্কট্—ব্লাভ্যাটস্কীর থিওসফী সমাজ এবং পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি-প্রমুখ তথাকথিত হিন্দু পুনরুত্থানকারিগণ, ইঁহারা সকলেই আধুনিক য়ুরোপীয় যুক্তিবাদপ্রতিষ্ঠিত “সাম্যমৈত্রীস্বাধীনতার” আদর্শে আমাদের নব্যশিক্ষিত সমাজে এবং তাঁহাদের শিক্ষাদীক্ষায় ও আচার আচরণে কিয়ৎপরিমাণে সাধারণ জনগণের ভিতরেও যে যথেচ্ছাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতা আনিয়া ফেলিতেছিল, তাহা দেখিয়া আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া পড়েন এবং আপন আপন সিদ্ধান্ত ও শক্তি অনুসারে এই অভিনব বিপ্লবস্রোতের প্রতিরোধ করিতে প্রবৃত্ত হন। আর বিগত পঁয়ত্রিশ বৎসরের ইতিহাস এই সমুদায় চেষ্টারই নিষ্ফলতার সাক্ষ্যদান করিতেছে।
আর এই নিষ্ফলতার প্রধান কারণ এই যে, একদিকে আধুনিক য়ুরোপীয় সাধনার এবং অন্যদিকে আমাদিগের সনাতন ধর্ম্মের ও প্রাচীন সমাজের মূল প্রকৃতি যে কি, এ জ্ঞান ইঁহাদের কাহারই ভাল করিয়া পরিস্ফুট হয় নাই। কি কেশবচন্দ্র, কি অল্কট্ ব্লাভ্যাট্স্কী, কি শশধর তর্কচূড়ামণি প্রভৃতি,—ইঁহাদের কেহই দেশের লোক-প্রকৃতি, সমাজপ্রকৃতি কিংবা পুরাগত সভ্যতা ও সাধনার প্রকৃতির উপরে, অথবা আমাদের প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবর্ত্তন-প্রণালীর সঙ্গে মিলাইয়া, নিজেদের মীমাংসার প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন নাই। ফলতঃ তাঁহারা যে পথে আমাদের বর্ত্তমান যুগসমস্যার মীমাংসা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, তাহাকে মীমাংসা বলা যায় কি না, সন্দেহ। মীমাংসার প্রথমে কতকগুলি প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত মত, সিদ্ধান্ত বা সংস্কার বা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান থাকে। কোনও কারণে এ সকলে সত্য বা কল্যাণকারিতা সম্বন্ধে লোকের মনে সন্দেহের উদয় হয়। কোনও নূতন মত বা সিদ্ধান্ত, ভাব বা আদর্শকে আশ্রয় করিয়া, তারই প্রেরণায় এ সন্দেহের উৎপত্তি হয়। এই সন্দেহ নিরসনের জন্য বিচারের বা যথাযোগ্য-প্রমাণপ্রতিষ্ঠা-সমালোচনার বা criticismএর আবশ্যক হয়। এই বিচার ক্রমে নূতন সিদ্ধান্তের সাহায্যে প্রাচীনের সঙ্গে নূতনের বিরোধ নিষ্পত্তির পথ দেখাইয়া দেয়। এই পথে যাইয়াই পরিণামে চূড়ান্ত মীমাংসার প্রতিষ্ঠা হয়। এরূপ মীমাংসার জন্য বাদী প্রতিবাদী উভয় পক্ষেরই সম্যক জ্ঞানলাভ অত্যাবশ্যক। কিন্তু কি কেশবচন্দ্র, কি থিওসফী সমাজের নেতৃবর্গ, কি তর্কচূড়ামণি প্রভৃতি তথাকথিত হিন্দু পুনরুত্থানকারিগণ, ইঁহাদের কেহই এ জ্ঞানলাভ করেন নাই। কেশবচন্দ্রের স্বদেশের মূল প্রকৃতির এবং বিশেষতঃ স্বজাতির ঐতিহাসিক বিবর্ত্তনের কোনও বিশেষ জ্ঞান ছিল না। থাকিলে তিনি খৃষ্টীয়ানী সিদ্ধান্ত ও খৃষ্টীয়ান্ ইতিহাসের দৃষ্টান্ত আশ্রয় করিয়া, বর্ত্তমান যুগসমস্যার মীমাংসা করিতে যাইতেন না। হিন্দু যুগে যুগে, স্বানুভূতি ও শাস্ত্রের মধ্যে যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করিয়া সমাজের গতিশক্তি ও স্থিতিশক্তির নিত্য বিরোধকে মিটাইয়াছেন এবং এইরূপে বেদের ক্রিয়াকাণ্ড ও দেববাদ হইতে ক্রমে উপনিষদের জ্ঞানকাণ্ড ও ব্রহ্মতত্ত্ব; উপনিষদের জ্ঞানকাণ্ড হইতে আধ্যাত্মিক কল্পনাভূষিত পৌরাণিকী ভক্তিপন্থার ভিতর দিয়া, ধর্ম্মতত্ত্ব ও ধর্ম্মসাধনকে অপূর্ব্বভাবে ফুটাইয়া তুলিয়া, পন্থাবিভাগ ও অধিকারিভেদের সাহায্যে, আপনার ধর্ম্মের অদ্ভুত বৈচিত্র্য ও বিশেষত্বের মধ্যেই সনাতন বিশ্বধর্ম্ম ক্রমে ক্রমে গড়িয়া উঠিতেছেন,—“কেশবচন্দ্র স্বদেশের সাধনার এই অপূর্ব্ব ঐতিহাসিক তত্ত্বটী ভাল করিয়া ধরিতে পারেন নাই। তাঁর অনন্যসাধারণ আধ্যাত্মিক কল্পনাবলে তিনি যে ত্রিবিধ যোগপ্রণালীর বর্ণনা করেন,[১] তাহাতে মানবসমাজের ধর্ম্মের ও সাধনার ইতিহাসের সাধারণ বিবর্ত্তন-তত্ত্বটী অতি পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হইয়াছে, সত্য; কিন্তু স্বদেশের সাধনার ঐতিহাসিক বিবর্ত্তনপ্রণালীর বিচার করিবার সময়, কেশবচন্দ্র সম্যগ্রূপে এই তত্ত্বটা প্রয়োগ করেন নাই বা অকালে দেহত্যাগ কবিয়া, করিবার অবসর প্রাপ্ত হন নাই। ফলতঃ একরূপ অন্তিমদশার আসিয়াই তিনি এই যোগ-তত্ত্বটা লাভ করেন। তাঁর “নববিধান” ইহার অনেক পূর্ব্বেই আমাদের বর্ত্তমান যুগসমস্যার একটা উদ্ভট মীমাংসা করিয়া বসিয়াছিল। আর সে মীমাংসার প্রতিষ্ঠায়, কেশবচন্দ্র স্বদেশের ঐতিহাসিক বিবর্ত্তন-পন্থাকে উপেক্ষা করিয়া, খৃষ্টীয়ানী সিদ্ধান্ত ও খৃষ্টীয়ানী অভিজ্ঞতাকেই আশ্রয় করেন। তাঁর প্রেরিত মহাপুরুষ-বাদ ঈশ্বরানুপ্রাণতা-বাদ ও শ্রীদরবার, এ সকলই ইহুদীয় ও খৃষ্টীয় শাস্ত্র এবং ইতিহাস হইতে সংগৃহীত। স্বদেশের শাস্ত্র ও সাধনার সঙ্গে এ সকলের কোনই সম্পর্ক নাই। আর ইহাই কেশবচন্দ্রের সীমাংসা-চেষ্টার নিষ্ফলতার কারণ। কেশবচন্দ্রের মীমাংসার চেষ্টা যেমন খৃষ্টীয়শাস্ত্রে ও খৃষ্টীয়ান ইতিহাসের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়, ইহাকে যেমন প্রচ্ছন্ন খৃষ্টীয়বাদ বলা যাইতে পারে;[২] সেইরূপ দয়ানন্দের আর্য্যসমাজের, অল্কট্ ব্লাভ্যাট্স্কীর থিওসফীর এবং শশধর তর্কচূড়ামণি প্রভৃতি নব্য হিন্দুগণের মীমাংসাও বস্তুতঃ য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ ও জড়বাদের প্রভাবেই একান্ত অভিভূত হইয়া পড়ে। অল্কট্ ব্লাভ্যাট্স্কীর তো কথাই নাই, দয়ানন্দ স্বামী বা তর্কচূড়ামণি মহাশয় ও স্বদেশের ঋষিপন্থা অবলম্বন করিয়া আধুনিক যুগসমস্যার মীমাংসা করিবার চেষ্টা করেন নাই। এই সকল মীমাংসাই প্রকৃতপক্ষে য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ ও লৌকিক ন্যায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই সকল অকাল-চেষ্টিত মীমাংসার নিষ্ফলতার প্রধান কারণই এই যে, এ সকলে যে সমস্যা ভেদ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তখন পর্য্যন্ত সে সমস্যাটাই নিঃশেষভাবে ফুটিয়া উঠে নাই। শিবনাথ শাস্ত্রী এবং তাঁর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ বিগত পঁচিশ বৎসরের মধ্যে এই সমস্যাটাকে বিশেষভাবে ফুটইয়া তুলিতে সাহায্য করিয়াই, তার মীমাংসার পথই পরিষ্কার করিয়া দিয়াছেন।
মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র শাস্ত্র-গুরু-বর্জ্জিত ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা করিতে যাইযাও, নিজেদের পূর্ব্ববর্জিত সাধন-সম্পৎ-প্রভাবে, আপনাদের ধর্ম্মতত্ত্বে বা ধর্ম্মসাধনে শুদ্ধ স্বানুভূতি ও যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠিত ধর্ম্মের সত্য স্বরূপটী ভাল করিয়া ফুটাইয়া তুলিতে পারেন নাই। মহর্ষি এবং কেশবচন্দ্র উভয়েই যুক্তিবাদের উপরে ধর্ম্মস্থাপন অসম্ভব দেখিয়া, পরে নিজেরাই শাস্ত্র-প্রণেতার ও ঈশ্বরানুপ্রাণিত গুরুর অধিকার গ্রহণ করেন। মহর্ষির জীবদ্দশায় তাঁর আদি ব্রাহ্মসমাজ সকল বিষয়েই তাঁর আনুগত্য স্বীকার করিয়া চলিয়াছেন। কেশবচন্দ্রের লোকান্তর গমনের পরেও নববিধানসমাজ তাঁরই বিধান মানিয়া চলিয়াছেন। এই সমাজে গুরুকরণের প্রয়োজন স্বীকৃত না হইলেও, একটা প্রবল পৌরহিত্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া কিয়ৎপরিমাণে সমাজের ধর্ম্মকে ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার আতিশয্য হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা হইয়াছে, ইহাও অস্বীকার করা যায় না। আর কেশবচন্দ্রের শেষ জীবনের শিক্ষার গুণে এই দলের ব্রাহ্মগণ এক প্রকারের শাস্ত্রানুগত্য এবং সাধুভক্তির অনুশীলন করিয়া তাঁহাদের ব্রাহ্মধর্ম্মকে এমন একটা সংযম ও শ্রদ্ধাশীলতার দ্বারা পরিপুষ্ট করিয়াছেন, যাহা শিবনাথ বাবুর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে ক্বচিৎ কোনও কোনও ব্যক্তির মধ্যে দেখা গেলেও, সাধারণ সভ্যদিগের মধ্যে দেখা যায় না। একদিকে শিবনাথ বাবুর মধ্যে কোনও প্রকৃতিগত বলবতী আস্তিক্যবুদ্ধি নাই। অন্যদিকে নববিধান-সমাজের ‘প্রেরিত মণ্ডলী’র ও ‘শ্রীদরবারে’র মত কোনও পৌরহিত্যের প্রতিষ্ঠাও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে হয় নাই। নববিধানমণ্ডলীর শাস্ত্রানুগত্য ও সাধুভক্তিকে সাধারণ ব্রাহ্ম-সমাজের সভ্যেরা সর্ব্বদাই স্বল্পবিস্তর ভীতির চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছেন। এ সমাজের কোনও কোনও আচার্য্য ও প্রচারক ‘মৃত সাধুদের’ চরিত্রের অনুশীলনের উপদেশ দিয়া, ধর্ম্মজীবনের পক্ষে নিরাপদ নয় বলিয়া, জীবিত সাধুদের সঙ্গ করা নিষেধ করিয়াছেন,—এমনও শোনা যায়। সুতরাং শিবনাথ বাবু তাঁর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যে ধর্ম্মকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করেন, তাহাতে যুক্তিবাদী ধর্ম্মের নিজস্ব স্বরূপটী যতটা ফুটিয়া উঠিয়াছে, মহর্ষির জীবদ্দশায় তাঁর আদি ব্রাহ্মসমাজে, বা কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে আজি পর্য্যন্তও ততটা ফুটিয়া উঠিবার অবসর প্রাপ্ত হয় নাই।
শিবনাথ বাবুর ধর্ম্মানুরাগ
কিন্তু শিবনাথ বাবুর মধ্যে কোনও স্বাভাবিকী ও বলবতী আস্তিক্যবুদ্ধি না থাকিলেও, সর্ব্বদাই একপ্রকারের ধর্ম্মানুরাগ বিদ্যমান ছিল। আমাদের দেশে মুমুক্ষুত্ব হইতেই ধর্ম্মানুরাগের উৎপত্তি হয়। শিবনাথ বাবুর ধর্ম্মানুরাগ এই জাতীয় কি না, সন্দেহ। ইহাকে বিলাতী ছাঁচের ধর্ম্মানুরাগ বলিয়াই মনে হয়। ইংরেজীতে ইহাকে Religious Enthusiasm বলে। এই ধর্ম্মানুরাগ দুই দিক্ দিয়া প্রকাশিত হয়। একদিকে ইহাতে ব্যক্তিগত চরিত্রের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটা গভীর আগ্রহ থাকে, এবং এই কারণে মিথ্যাকথন, প্রবঞ্চনা, পরদ্রব্যহরণ, পরদার গ্রহণ, প্রভৃতি দুষ্কর্ম্ম হইতে নির্ম্মুক্ত থাকিবার বাসনার ও প্রয়াসের ভিতর দিয়া ইহা ফুটিয়া উঠে। অন্যদিকে লোকহিতেচ্ছা এবং লোকসেবার চেষ্টাতেও ইহা প্রকাশিত হয়। এই জাতীয় ধর্ম্মানুরাগের সঙ্গে ঈশ্বর-বিশ্বাসের বা ভগবদ্ভভক্তির কোনও অপরিহার্য্য সম্বন্ধ নাই। শিবনাথ বাবুর ধর্ম্মানুরাগ অনেকটা এই জাতীয়। তাঁর ঈশ্বর-বিশ্বাসের ভিত্তি যে কি, বলা সহজ নয়। প্রকৃতিগত বলবতী আস্তিক্য-বুদ্ধি তাঁর নাই। শিক্ষার প্রভাবে গভীর তত্ত্বালোচনার দ্বারাও যে তিনি তাঁর ঈশ্বর-বিশ্বাস লাভ করিয়াছেন, এমনও বলা যায় না। সদ্গুরুর আশ্রয় পাইয়া, গুরু-শক্তিসঞ্চারেও তাঁর ভগবৎ-স্ফূর্ত্তি হয় নাই। কার্য্য-কারণ-সম্বন্ধের আলোচনায় লৌকিক ন্যায় যে কারণ-ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা করে, কেবল সেই ব্রহ্মের জ্ঞানই কতকটা তাঁর আছে মাত্র। আর কবি-প্রকৃতি-সুলভ ভাবাবেগ হইতে এই লৌকিকন্যায়-প্রতিষ্ঠিত কারণ-ব্রহ্মতে দয়া-দাক্ষিণ্যাদি মহদ্গুণের অধ্যাস হইয়া, শিবনাথ বাবুর ধর্ম্মে একপ্রকারের ঈশ্বর কল্পনাও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। অন্যদিকে স্বদেশের এবং সমগ্র মানবজাতির সুখ ও উন্নতি-কামনা-প্রস্তুত একটা প্রবল কর্ম্মানুরাগও তাঁর জীবনে বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছে। জগতের সর্ব্বত্র, এই সকল উপকরণেই যুক্তিবাদী ধর্ম্ম বা Rational Religion গড়িয়া উঠে।
ফলতঃ যে ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার আদর্শে আমাদের সেকালের ইংরেজি-শিক্ষা-প্রাপ্ত যুবকমণ্ডলীর চিত্ত একেবারে মাতিয়া উঠে, তাহারই উপরে শিবনাথ বাবুর এই ধর্ম্মানুরাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম যৌবনাবধিই, কতকটা বৈজিক-নিয়মাধীনে, আর কতকটা ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে, শিবনাথ বাবুর ভিতরে একটা অদম্য অনধীনতার ভাব জাগিয়াছিল। ইহার সঙ্গে য়ুরোপীয় ঝাঁঝের একটা বলবতী মানবহিতৈষাও মিশিয়াছিল। তাঁর প্রকৃতির ভিতরেই বাল্যাবধি এমন একটা নিঃস্বার্থতা এবং মহাপ্রাণতাও ছিল, যাহাতে এই মানবহিতৈষাকে বাড়াইয়া তুলে। এই অনধীনতার ও মানবহিতৈষার প্রেরণাতেই তিনি ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেন বলিয়া মনে হয়। লোকসেবাই তাঁর ধর্ম্মের মূল মন্ত্র ছিল। অনধীনতার ভাব হইতেই দেশ প্রচলিত হিন্দুধর্ম্মের কর্ম্মবহুল অনুষ্ঠানাদি ও প্রাচীন শাস্ত্রগুরুর শাসনকে তিনি বর্জ্জন করেন। মানবহিতৈষা হইতেই স্বদেশের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেন। য়ুরোপীয় সাম্যভাবের প্রেরণায়ই, স্বদেশের ও মানবসমাজের হিতকল্পে ধর্ম্মের ও সমাজের সর্ব্বপ্রকারের শাসন হইতে মানুষকে মুক্ত করিয়া, তার মনুষ্যত্ব বস্তুকে অবাধে ফুটিয়া উঠিবার সম্পূর্ণ অবসর দিবার জন্য, শিবনাথ বাবুব যে আত্যন্তিক আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা গিয়াছে, মহর্ষির কিম্বা কেশবচন্দ্রের মধ্যে তাহা দেখা যায় নাই। তথাকথিত সাম্যমৈত্রীস্বাধীনতার উপরে পরিবারের ও সমাজের সর্ব্ববিধ সম্বন্ধকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া সমাজের সংস্কার সাধনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রজাস্বত্বের সম্প্রসারণে, এক সময়ে শিবনাথ বাবু ফরাসীবিপ্লবের অধিনায়কগণের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু ফরাসীবিপ্লবের সাম্যমৈত্রীস্বাধীনতার প্রভাব, ভলটেয়ার, রুশো প্রভৃতি ফরাসীয় চিন্তানায়কগণের শিক্ষা-দীক্ষার ভিতর দিয়া সাক্ষাৎভাবে শিবনাথ বাবু বা তাঁর সহযোগী ব্রাহ্মগণের উপরে আসিয়া পড়ে নাই। ইংলণ্ডের ও আমেরিকার যুক্তিবাদী খৃষ্টীয়ান সম্প্রদায়ের আচার্য্যগণের শিক্ষা-দীক্ষা হইতেই আমাদের ব্রাহ্মসমাজ য়ুরোপীয় ‘সাম্যমৈত্রীস্বাধীনতা’র উদ্দীপনা লাভ করেন। আর ইঁহাদের মধ্যে ইংলণ্ডের ফ্রান্সেস নিউম্যান এবং আমেরিকার থিওডোর পার্কারের সঙ্গেই ব্রাহ্মসমাজের সর্ব্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ যোগ স্থাপিত হয়। শিবনাথ বাবুর প্রথম যৌবনকালে পার্কারই ব্রাহ্মসমাজের যুক্তিবাদী যুবকদলের প্রধান শিক্ষা গুরু হইয়াছিলেন। কিন্তু যে দার্শনিক ভিত্তির উপরে পার্কারের ধর্ম্ম-সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা হয়, তাঁর ভারতবাসী শিষ্যগণ সে তত্ত্বকে ভাল করিয়া ধরিয়াছিলেন কি না, সন্দেহের কথা। শিবনাথ বাবু প্রভৃতি পার্কারের দুর্দ্দমনীয় অনধীনতা প্রবৃত্তি এবং উদার ও বিশ্বজনীন মানব-প্রেমের উদ্দীপনাই কতকটা লাভ করেন, কিন্তু পার্কারের তত্ত্বজ্ঞান বা ভক্তিভাব লাভ করিরাছিলেন কি না, বলা সহজ নয়।
ফলতঃ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃপদে বৃত হইবার পূর্ব্বে শিবনাথ বাবুর ধর্ম্মজীবন অপেক্ষা কর্ম্মোৎসাহই বেশী ফুটিয়া উঠিয়াছিল। উপাসনাদি অন্তরঙ্গ ধর্ম্মকর্ম্মে তাঁর যতটা উৎসাহ ও নিষ্ঠা ছিল, সমাজ-সংস্কারে তখন যে তদপেক্ষা অনেক বেশী আগ্রহ ছিল, হহা অস্বীকার করা অসম্ভব। এ সময়ে তিনি উপাসনা-প্রার্থনাদি ব্রাহ্মধর্ম্মের অন্তরঙ্গ সাধনকেও যে লৌকিক ন্যায়ের বিশুদ্ধ তর্কযুক্তির কষ্টিপাথরে কসিতেছিলেন, তাঁর সম্পাদিত “সমদর্শী”ই ইহার সাক্ষী। কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগত প্রচারকগণ যে শিবনাথ বাবুর সে সময়ের ধর্ম্মভাবকে বড় বিশেষ শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন না, ইহাও জানা কথা। কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে বৈরাগ্য-সাধন প্রবর্ত্তিত করিবার প্রয়াসী হইলে, শিবনাথ বাবু তাঁর এ সকল মত ও আদর্শকে লোকচক্ষে কতটা হীন করিবার চেষ্টা করেন, তখনকার “সোমপ্রকাশে” এবং “সমদর্শী”তে তার বিলক্ষণ প্রমাণ পাওয়া যায়। আর তখন পর্য্যন্ত ধর্ম্মের অন্তরঙ্গ ও অতিলৌকিক দিক্টা যে শিবনাথ বাবুর নিকট প্রকাশিত হয় নাই, এ সকলে ইহাই প্রমাণ করে। ক্রমে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আচার্য্যপদে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হইলে, শিবনাথ বাবু ‘বিবেক’ ‘বৈরাগ্যা’দি সম্বন্ধে কিছু কিছু উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন বটে, কিন্তু এ সকল কতটা যে তাঁর ভিতরকার সাধনাভিজ্ঞতা হইতে ফুটিয়া উঠিয়াছে, আর কতটা যে ব্রাহ্মসমাজের বাহিরের অবস্থার পরিবর্ত্তনের ফল, ইহাও বলা সহজ নয়। আর এ সকল সত্ত্বেও শিবনাথ বাবুর জীবনে ধর্ম্মের অন্তরঙ্গ সাধনের প্রয়াস অপেক্ষা, বাহিরের সমাজ-সংস্কারাদি সাধনের প্রয়াস যে সর্ব্বদাই বলবত্তর হইয়া আছে, ইহা অস্বীকার করা অসম্ভব।
ফলতঃ শিবনাথ বাবুর প্রকৃতির শ্রেষ্ঠতম বস্তুগুলি তাঁর ব্রাহ্মসমাজের প্রচারকার্য্যের ভিতর দিয়া আজি পর্য্যন্ত ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠিবার অবসর পাইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। শিবনাথ বাবু কবি। রসানুভুতি কবিপ্রকৃতির সাধারণ লক্ষণ। রসগ্রাহিতা ও ভোগলিপ্সা শিবনাথ বাবুর মধ্যেও প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রহিয়াছে। আর এই দুই বস্তুই তাঁর প্রচারক-জীবনের বন্ধনে পড়িয়া বহুল পরিমাণে সঙ্কুচিত ও বিকৃতিপ্রাপ্ত হইয়াছে। কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে শিবনাথের চরিত্রের যে দিক্টা ফুটিয়া উঠিতেছিল, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বভার পাইয়া, তাহা ক্রমে শুকাইয়া যাইতে আরম্ভ করে। সত্য-সন্ধিৎসাই সে সময়ে শিবনাথ বাবুর চরিত্রের বিশিষ্ট গুণ ছিল। এই সত্য-সন্ধিৎসা যুক্তিবাদের সাধারণ লক্ষণ। প্রাচীন কি নূতন কোনও প্রকারের বন্ধন যুক্তিবাদ সহ্য করিতে পারে না। যুক্তিবাদ সত্যের সন্ধানে যাইয়া ভুল ভ্রান্তি যাই করুক না কেন, কখনও লোকানুবর্ত্তিতার আশ্রয় গ্রহণ করে না। গায়র্ডিণো ব্রুণো প্রভৃতি য়ুরোপীয় যুক্তিবাদিগণ সত্যের সন্ধানে বা প্রচারে প্রাচীন শাস্ত্র বা প্রচলিত পৌরোহিত্য কোনও কিছুরই মুখাপেক্ষা করেন নাই বলিয়াই, সেখানে যুক্তিবাদ এতটা প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে। শিবনাথও এক সময় সত্যের সন্ধানে যাইয়া আপনার বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃপ্রকৃতিরই অনুসরণ করিয়া চলিতেন, প্রাচীন সমাজের আনুগত্য পরিহার করিয়া তিনি কিছুতেই তখন নূতন সমাজের প্রচারকমণ্ডলীর বা আচার্য্যের আনুগতা স্বীকার করেন নাই। আর এইজন্য নূতন সমাজের কর্ত্তৃপক্ষীয়দের হাতে শিবনাথকে অশেষপ্রকারের নির্য্যাতন এবং লাঞ্ছনা ও ভোগ করিতে হইয়াছিল। এই সময়ে কেশবচন্দ্রের প্রচারকগণ শিবনাথের যে সকল দুর্নাম রটনা করিয়াছিলেন, কোনও কোনও ব্রাহ্মমণ্ডলীর মধ্যে আজি পর্য্যন্ত তাঁর স্মৃতি জাগিয়া আছে। এই নিগ্রহ-নির্য্যাতনে শিবনাথ বাবুর চরিত্রের শক্তি ও সৌরভ যতটা ফুটিয়াছিল, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃপদে বৃত হইয়া তাহা হয় নাই। বরং এই অভিনব দায়িত্বভাব তাঁহার আপনার অন্তঃপ্রকৃতির প্রেরণাকে নানা দিকে চাপিয়া রাখিয়া, তাঁহার মূল চরিত্রের সম্যগ্রূপে ফুটিয়া উঠিবার বিশেষ ব্যাঘাতই জন্মাইয়াছে।
যোগ, ভক্তি প্রভৃতি ধর্ম্মের অন্তরঙ্গ সাধনের শক্তি ও সরঞ্জাম শিবনাথ বাবুর মধ্যে কখনই বেশী ছিল না। এখনও নাই। ফলাফল-বিচারবিরহিত সত্যসন্ধিৎসা, দুর্দ্দমনীয় অনধীনতা-প্রবৃত্তি, অকৃত্রিম লোকহিতৈষা এবং প্রগাঢ় স্বদেশানুরাগ, এ সকলই শিবনাথ বাবুর প্রকৃতির নিজস্ব সম্পত্তি ছিল। এই সকলের জন্যই তিনি প্রথম জীবনে ব্রাহ্মসমাজের ও দেশের সাধারণ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উদারমতি যুবকদলের উপরে এতটা প্রভাব বিস্তার করিতে পারিয়াছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম্মসিদ্ধান্ত ও ধর্ম্মসাধনাকে সর্ব্বপ্রকারের অতিপ্রাকৃতত্ব ও অতিলৌকিকত্ব হইতে মুক্ত রাখিবার জন্য শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর সম্পাদিত “সমদর্শী” যতটা চেষ্টা করিয়াছিলেন, আর কোথাও সেরূপ চেষ্টা হয় নাই। কেশবচন্দ্র যখন ক্রমে একটা কল্পিত যোগবৈরাগ্যের আদর্শের অনুসরণ করিতে যাইয়া ব্রাহ্মধর্ম্মের সরল ও সোজা ভাবগুলিকে স্বল্পবিস্তর জটিল ও কৃত্রিম করিয়া তুলিতেছেন, তাঁর নূতন শিক্ষাদীক্ষার প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজে যখন সংসারধর্ম্মের সহজ ভাবগুলি একটা কৃত্রিম পারলৌকিকতার উৎপাতে ম্রিয়মাণ হইতে আরম্ভ করে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ব্রাহ্মসমাজ প্রথমে যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রসারবৃদ্ধির চেষ্টা করিতেছিলেন, কেশবচন্দ্র যখন কেবল আপনিই সে আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া পড়িলেন না, কিন্তু প্রকাশ্যভাবে তাহাকে হীন বলিয়া প্রচার করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন শিবনাথই ব্রাহ্মসমাজের সে আদিকার অনধীনতা ধর্ম্মের পুরোহিত ও রক্ষক হইয়া, তাহাকে প্রাণপণে বাঁচাইয়া রাখিতে চেষ্টা করেন। ব্রাহ্ম সমাজে অবরোধ প্রথা তুলিবার চেষ্টায় রক্ষণশীল ও উন্নতিশীল ব্রাহ্মগণের মধ্যে যখন বিরোধ বাধিয়া উঠিল, তখন শিবনাথই এই উন্নতিশীলদলের অগ্রণী হইয়াছিলেন। বাল্যবিবাহ-নিবারণ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, জাতিভেদ-প্রথার উচ্ছেদ সাধন, এ সকল বিষয়ে শিবনাথই তখন বাংলার সমাজ-সংস্কার-প্রয়াসী যুবকদলের নেতা হইয়া উঠিতেছিলেন। আর সর্ব্বোপরি তিনিই, রাজা রামমোহন রায়ের পরে, ব্রাহ্মধর্ম্মেতে একটা উদার ও প্রবল স্বদেশপ্রেমেরও সঞ্চার করিতে চেষ্টা করেন। ব্রাহ্মসমাজ একরূপ প্রথমাবধিই যে সার্ব্বজনীন অনধীনতার আদর্শের অনুসরণ করিয়া চলিতেছিল, শিবনাথ বাবু যে ভাবে ও যে পরিমাণে সেই আদর্শটীকে এক সময়ে ধরিয়াছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ কি কেশবচন্দ্র ইঁহাদের কেহই তাহা করেন নাই বা পারেন নাই।
শিবনাথ বাবুর স্বদেশহিতৈষা
দেবেন্দ্রনাথ ধর্ম্মসাধনে এবং কেশবচন্দ্র পারিবারিক জীবনেই মুখ্যভাবে এই আদর্শকে ফুটাইয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শিবনাথ বাবুই সর্ব্বপ্রথমে ইহাকে রাষ্ট্রীয় জীবনেও প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য লালায়িত হন। এই জন্য শিবনাথ বাবুর ব্রাহ্মধর্ম্মে একটা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রেরণাও জাগিয়া উঠিতে আরম্ভ করে। মহর্ষির বা ব্রহ্মানন্দের মধ্যে এ বস্তু এতটা পরিস্ফুটভাবে কখনও প্রকাশ পায় নাই। এই জন্যই শিবনাথ বাবুর প্রথম জীবনে তাঁর ধর্ম্মজীবন ও কর্ম্মজীবনের মধ্যে একটা সুন্দর সঙ্গতি ও শক্তি ফুটিয়া উঠিয়াছিল। কেশবচন্দ্রের অলৌকিক বাগ্মিপ্রতিভার ফলে, তাঁর ধর্ম্ম-জীবনে ও কর্ম্মজীবনে, এমন কি তাঁর দৈনন্দিন চালচলনেও একটা নটস্বভাবসুলভ কৃত্রিমতা বিদ্যমান ছিল। এই ‘নাটুকে’ ভাবটী শিবনাথ বাবুর মধ্যে এক সময় একেবারেই ছিল না বলিয়া, গভীরতর আধ্যাত্মিক জীবনলাভ না করিয়াও, তিনি অনেক সরল ধর্ম্মপিপাসু লোকেরও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভক্তি লাভ করিয়াছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র উভয়েই অ্যারিষ্টক্রেট (aristocrat) ছিলেন। জীবনব্যাপী ধর্ম্মসাধন এবং ধর্ম্মচর্চ্চাও ইঁহাদের এই আভিজাত্য-অভিমান নষ্ট করিতে পারে নাই। কিন্তু শিবনাথ বাবুর কোনও আভিজাত্যের দাবীও ছিল না; আর তাঁর প্রকৃতির ভিতরেই এক সময়ে একটা ঐকান্তিক নিরহঙ্কারের ভাব বিদ্যমান ছিল বলিয়া, তিনি বাঙ্গলা সমাজে নানাদিকে বিশেষ খ্যাত্যাপন্ন হইয়া উঠিতে আরম্ভ করিলেও, কখনও কোনও রূপ শ্রেষ্ঠত্বাভিমানে স্ফীত হইয়া উঠেন নাই। আযৌবন তাঁহাকে ডিমোক্র্যাট (Democrat) রূপেই আমরা দেখিয়া আসিয়াছি। আর এই ডিমোক্র্যাসীর বা গণতন্ত্রতার আদর্শ তাঁহার ধর্ম্মজীবনের ও কর্ম্মজীবনের সকল বিভাগকেও অধিকার করিয়াছিল বলিয়া, যে স্বদেশপ্রীতি মহর্ষির বা ব্রহ্মানন্দের ধর্ম্মজীবনে প্রকাশিত হয় নাই, শিবনাথ বাবুর মধ্যে তাহা অতি বিশদরূপেই ফুটিয়া উঠিয়াছিল। কেবশচন্দ্র ব্রহ্মোপাসনাকালে সমুদায় জগতের কল্যাণের জন্যই প্রার্থনা করিতেন। আর এই রীতিটী তিনি কিয়ৎ পরিমাণে সম্ভবতঃ ইংলণ্ডের খৃষ্টীয় সঙ্ঘের (Church of England) উপাসনা পদ্ধতি হইতেই গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু শিবনাথ বাবুই সর্ব্বপ্রথমে স্বদেশের কল্যাণের জন্য ভগবানের নিকটে প্রার্থনা করিবার রীতি ব্রহ্মোপাসনাতে প্রবর্ত্তিত করেন। মহর্ষির আদি ব্রাহ্মসমাজের কিম্বা কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতপুস্তকে স্বদেশপ্রেমোদ্দীপক কোন সঙ্গীত কখনও দেখিয়াছিলাম বলিয়া মনে হয় না। শিবনাথ বাবুই প্রথমে—
তব পদে লই শরণ।
আর্য্যদের প্রিয়ভূমি, সাধের ভারতভূমি,
অবসন্ন আছে, অচেতন হে।
একবার দয়া করি, তোল করে ধরি,
দুর্দ্দশা আঁধার তাব কর মোচন।
কোটী কোটী নরনারী, ফেলিছে নয়নবারি,
অন্তর্যামি জানিছ সে সব হে;
তাই প্রাণ কাঁদে, ক্ষম অপরাধে,
অসাড় শরীরে পুন দেও হে চেতন।
কত জাতি ছিল হীন, অচেতন পরাধীন,
কৃপা করি আনিলে সুদিন হে;
সেই কৃপাগুণে, দেখি শুভক্ষণে,
সাধের ভারতে পুনঃ আন হে জীবন।—
—এই স্বদেশ প্রেমোদ্দীপক গান ব্রহ্মসঙ্গীতভুক্ত করিয়া দেন।
কুচবিহার বিবাহের কিছুকাল পূর্ব্বে শিবনাথ বাবু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী যুবককে লইয়া একটা নূতন কর্ম্মিদল গড়িবার চেষ্টা করেন। এই দলটীকে তিনি যে আদর্শে গঠন করিতেছিলেন, তাহার মধ্যে শিবনাথ বাবুর অন্তরের সত্যভাব ও আদর্শ পরিষ্কাররূপে ফুটিয়া উঠিতেছিল। স্বদেশপ্রীতিই এই দলগঠনের মূল প্রেরণা ছিল। এই স্বদেশপ্রীতির ভিতর দিয়াই, শিবনাথ বাবুব সে সময়ের ধর্ম্মভাব ফুটিয়া উঠিতেছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, পারিবারিক স্বাধীনতা—জীবনের সর্ব্ববিভাগে ব্যক্তিত্বাভিমানী যুক্তিবাদিধর্ম্মের অনধীনতার আদর্শটাকে ফুটাইয়া তোলাই, শিবনাথ বাবুর এই কর্ম্মিদল গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল। কি দেবেন্দ্রনাথের আদিব্রাহ্মসমাজে, কি কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে, কোথাও এইরূপ সর্ব্বাঙ্গীণভাবে এই অনধীনতার আদর্শটাকে ফুটাইয়া তুলিবার চেষ্টা হয় নাই। ফলতঃ শিবনাথ বাবু ভিন্ন ব্রাহ্মসমাজের আর কোনও লোক প্রসিদ্ধ চিন্তানায়ক বা কর্ম্মনায়ক ব্রাহ্মধর্ম্মের এই নিজস্ব আদর্শটাকে এমনভাবে ধরিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। অতএব এক দিক্ দিয়া দেখিতে গেলে, শিবনাথ বাবুর মধ্যে এক সময়ে ব্রাহ্মধর্ম্মের মূল ভাব ও আদর্শগুলি যতটা পরিমাণে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, মহর্ষি কিম্বা কেশবচন্দ্রের মধ্যে তাহা করে নাই। মহর্ষি এই ধর্ম্মের বীজমাত্র বপন করেন। কেশবচন্দ্র এই বীজকে কতকটা ফুটাইয়া তুলিয়া, আবার আপনার হাতেই তাহাকে চাপিয়া নষ্ট করেন। শিবনাথ বাবুই এক সময়ে ইহাকে পরিস্ফুট ও পরিপক্কভাবে ফুটাইয়া তুলিবার চেষ্টা করেন। ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসে, ইহাই তাঁর জীবনের ও কর্ম্মের বিশেষত্ব।
কিন্তু আত্যন্তিকভাবে এই আদর্শটীকে লোকচরিত্রে ও সমাজ জীবনে ফুটাইয়া তুলিতে হইলে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে একান্তরূপে তার নিজের প্রকৃতির উপরে ছাড়িয়া দিতে হয়। অনধীনতার আদর্শের চরম পরিণতি দার্শনিক রাজকতায়। য়ুরোপে এই ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার বা Individualistic Freedomএর আদর্শ ক্রমে এইরূপে এই দাশনিক অরাজকতাতে বা Philosphical Anarchismএতে যাইয়া পৌঁছাইয়াছে। আপনার যুক্তির সূত্রটী ধরিয়া চলিলে, শিবনাথ বাবুকে এবং তাঁর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজকেও পরিণামে এইখানেই যাইয়া উপস্থিত হইতে হইত। আর ইঁহারা যে এতটা দূর পর্য্যন্ত যাইতে পারেন নাই, তাহাতে ইঁহাদের কাহারই যে একান্ত কল্যাণ হইয়াছে, এমনও বলা যায় না।
কারণ, এ জগতে মানুষ বিশ্বাসভরে, অন্যচিত্ত হইয়া, ফলাফলবিচার পরিহার পূর্ব্বক, যে কোনও সিদ্ধান্ত বা পন্থাকে ধরিয়াই চলিতে আরম্ভ করুক না কেন, সেই সিদ্ধান্ত বা সেই পন্থাকে আশ্রয় করিয়াই, ক্রমে পরমতত্ত্বে ও চরম গতিতে যাইয়া পৌঁছাইতে পারে। যুক্তিবাদী ধর্ম্মও এইজন্য, আপনার প্রকৃতির অনুসরণ করিয়া চলিতে পারিলে, পরিণামে যাইয়া পরমবস্তু লাভ করিয়া থাকে। আর সাধনের মধ্যপথের আকস্মিক ও মায়িক ভয়বিভীষিকার দ্বারা বিক্ষিপ্ত না হইয়া, ব্রাহ্মসমাজ একান্ত নির্ভর ও নিষ্ঠা সহকারে, নিজের সিদ্ধান্তকে আঁকড়িয়া ধরিতে পারে নাই বলিয়াই, এমন ভাবে নিষ্ফলতা লাভ করিতেছে।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের জন্মের পূর্ব্বে শিবনাথ বাবু যে বিশ্বস্ততা সহকারে আপনার নিজস্ব প্রকৃতির অনুসরণ করিয়া চলিতেছেন, এই নূতন সমাজের নেতৃপদের গুরুতর দায়িত্ব-ভার-গ্রস্ত হইয়া, ক্রমে সে পথ পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। আর এই জন্যই, ভয়াবহ পরধর্ম্মের চাপে, আপনার অন্তঃপ্রকৃতিকে অযথা নিপীড়িত করিবার চেষ্টা করিয়া, শিবনাথ বাবু নিজের জীবনেরও সম্পূর্ণ সার্থকতা লাভ করিতে পারেন নাই, আর তাঁর সমাজকেও আত্মচরিতার্থতা লাভে সাহায্য করিতে পারেন নাই।