চরিত-কথা (বিপিনচন্দ্র পাল)/টাইট্যানিকের তিরোধান
টাইট্যানিকের তিরোধান
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের ব্যবধানটা যে কত সূক্ষ্ম ও সামান্য, সংসারমোহবিভ্রান্ত মানুষ সকল সময়ে ইহা বুঝিয়া উঠিতে পারে না। তাই বুঝি বিধাতাপুরুষ মাঝে মাঝে টাইট্যানিকের তিরোধানের মত লোমহর্ষণ বিধানের ব্যবস্থা করিয়া, আত্মবিস্তৃত জনগণের আত্মচৈতন্যকে জাগাইয়া দেন। সভ্যতা বলিতে আমরা আজি কালি যে বস্তুকে বুঝিয়া থাকি, তাহা একান্তই ইহ-সব্বস্ব। এই সভ্যতার শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানবের চিন্তা ও কল্পনার উপরে প্রত্যক্ষ পূরুষকারের প্রভাব অত্যন্ত বাড়িয়া গিয়া, অপেক্ষাকৃত “অসভ্য” প্রাচীন সমাজে দৈবের উপরে যে একটা ঐকান্তিক নির্ভর ছিল, তাহা ক্রমেই ক্ষীণ হইয়া, একেবারেই নষ্ট হইবার উপক্রম হইয়াছে। মানুষের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তার অদ্ভুত উদ্ভাবনীশক্তি, তার আশ্চর্য্য কর্ম্মকুশলতা, যতই তাহাকে বাহিরের শক্তিপুঞ্জের প্রভু ও নিয়ন্তা করিয়া তুলিতেছে, যতই মানুষ আপনার বুদ্ধি-বলে দেশ-কালের নৈসর্গিক ব্যবধান, জল-স্থলের অনুল্লঙ্ঘনীয় অন্তরায়, বহিঃপ্রকৃতির অনুকূলতা-প্রতিকূলতা, এ সকলকে তুচ্ছ করিয়া, আপনার অভীষ্টসাধনে সমর্থ হইতেছে, ততই তার আপনার উপরে নির্ভরটা অতিমাত্রায় বাড়িয়া উঠিতেছে। এই নির্ভরটাই আধুনিক সভ্যতার একটা অতি প্রধান লক্ষণ। সুতরাং এরূপ সভ্যতা যে “আত্মসম্ভাবিতাস্তব্ধা ধনমানমদান্বিতা” হইবে, ইহা আর বিচিত্র কি? এ সভ্যতাকে মাঝে মাঝে এরূপ ভাবে নাড়া না দিলে, তার চৈতন্যোদয় হইবে কেন?
য়ুরোপ ভাবিতেছিল যে সে আপনার অলৌকিক অধ্যবসায় ও অসাধারণ বুদ্ধির জোরে নিসর্গের প্রতিকূল শক্তিপুঞ্জকে করায়ত্ত করিয়া ক্রমে মানুষকে মৃত্যুঞ্জয় করিয়া তুলিবে। টাইট্যানিকের তিরোধানে, ক্ষণিকের জন্য তার সে সুখস্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। আমরা এ পথে মৃত্যুকে জয় করিতে যাই নাই। আমরা যাঁহাকে মৃত্যুঞ্জয় বলিয়া জানি, তিনি যোগেশ্বর, তিনি মহাবৈরাগী, তিনি দ্বন্দ্বাতীত, মৃত্যু ও অমৃতে তাঁর সমান-জ্ঞান, তপঃপ্রভাবে জীব-শিব তাঁর ভিতরে এক হইয়া গিয়াছে। আমাদের মৃত্যুকে জয় করিবার পথ ছিল—যোগের পথ, ভোগের পথ নহে; ত্যাগের পথ, লোভের পথ নহে।
য়দা সর্ব্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেহস্য হৃদি শ্রিতাঃ।
অথ মর্ত্ত্যোহমৃত ভবত্যত্র ব্রহ্ম সমশ্নতে॥
“যে সকল কামনা এই মর্ত্তা জীবের হৃদয়কে আশ্রয় করিয়া আছে, সেই সমুদায় যখন একান্তভাবে পরিত্যক্ত হয়, তখনই মর্ত্য অমর হয়, এবং এইখানেই ব্রহ্মকে ভোগ করিয়া থাকে।"
আমরা অতি প্রাচীনকাল হইতে ইহাকেই অমৃতত্ব লাভের একমাত্র পথ বলিয়া জানিয়া আসিয়াছি। “ত্যাগেনৈবমৃতত্বমনাশু” কেবল ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব পাওয়া যায়, তার আর অন্যপথ নাই, ভারতের আর্য্যসভ্যতা ও সাধনার ইহাই সার কথা ও শেষ কথা। জগতের সকল সাধু ও সিদ্ধপুরুষেরাই এ কথার সত্যতার ও সারবত্ত্বার সাক্ষ্য দিয়া আসিতেছেন! খ্রীষ্টীয় সাধনায়ও এ কথাটা নূতন নহে। যিশু ও এই ত্যাগের পথই দেখাইয়া গিয়াছেন, ভোগের পথ দেখান নাই। “তোমার যা’ কিছু তৎসমুদায় বিকাইয়া দিয়া, আমার অনুগামী হও,”—“যদি সে’ জীবন পাইতে চাও, তবে এ’জীবন বিসর্জ্জন দাও”, —কল্যকার জন্য চিন্তা করিও না, আজিকার দুর্ভাবনাই আজিকার জন্য যথেষ্ট”;—খৃষ্টের এ সকল প্রসিদ্ধ উপদেশ,—এবং পরিণামে যে ভাবে তিনি এই মহাত্যাগযজ্ঞে আপনার পবিত্র দেহ উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন, আর এইরূপ ভারে দেহ রাখিয়া আপনার “পুনরুত্থান” বা রিসরেক্সণের (Resurrection) ভিতর দিয়া, খৃষ্টীয়ান্মণ্ডলীকে তিনি স্বয়ং অমৃতত্বের যে পথ দেখাইয়া গিয়াছেন, তাহাও আমাদেরই এই প্রাচীন ও সার্ব্বজনীন ঋষিপন্থা। ইহাই মুক্তির একমাত্র পথ— “নান্যঃ পন্থাঃ বিদ্যতেহয়নায়”।
টাইট্যানিকের তিরোধান সংসার মোহ-বিভ্রান্ত বুরোপীয় সমাজকে, অপূর্ব্ব কলাকুশলতা সহকারে, এই সনাতন ঋষি-পথ ও পুরাতন যিশুপথই দেখাইয়া দিয়া গেল। যারা আজন্মকাল নিরবচ্ছিন্নভাবে কেবল ভোগের পথ ধরিয়াই চলিয়াছিল, যাহাদিগকে দুনিয়ার লোকে ইহ-সর্বস্ব বলিয়াই ভাবিয়া আসিয়াছিল, আমাদের শাস্ত্রে যাহাকে আসুরী-সম্পদ বলিয়াছেন, গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে আসুবীভাবের বর্ণনা করিয়াছেন, তাহার আহবণ করিতে যাহারা আপনাদের সর্ব্বস্ব পণ করিয়াছিল রলিয়া মনে হইত, সেই সকল লোককে বুকে লইয়াই টাইট্যানিক তার এই মহা— প্রয়াণে যাত্রা করিয়াছিল। আধুনিক সমাজের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যা ও বুদ্ধি, অধ্যবসায় ও কর্ম্মকুশলতা মিলিয়া এই বিপুল অণবযানখানি নির্ম্মাণ করিয়াছিল। একদিন যুরোপ হইতে আটল্যাণ্টিক মহাসাগর পার হইয়া আমেরিকায় যাইতে এক পক্ষ কাল লাগিত। ক্রমে তাহা এক সপ্তাহে আসিয়া দাড়ায়; বৎসর দুই কাল হইল, এ ব্যবধান আরও কমিয়া গিয়াছিল। দুইটি প্রসিদ্ধ ইংরেজ কোম্পানীর জাহাজ ইংলণ্ড ও আমেরিকার মধ্যে যাতায়াত করে; একের নাম “কিউন্যার্ড” (Cunard), অপরের নাম “হোয়াইট ষ্টার” (White Star)। কিউন্যার্ড কোম্পানীর মরিট্যানিয়া (Mauritania) নামক নূতন জাহাজ প্রথমে, পাঁচ দিন কয়েক ঘণ্টায়, ইংলণ্ড ও আমেরিকার মধ্যে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করে। সপত্নী কোম্পানীর এই অদ্ভুত কৃতিত্ব দেখিয়া, হোয়াইটষ্টার (White Star) কোম্পানীর পক্ষে নিশ্চেষ্ট থাকা অসম্ভব হইয়া উঠিল। এই প্রতিযোগিতার প্রেরণাতেই “টাইট্যানিকের” জন্ম হয়। পাশ্চাত্য জগতে প্রতিদিনই নূতন নূতন তথ্য আবিষ্কৃত ও নূতন নূতন যন্ত্র উদ্ভাবিত হইতেছে। “মরিট্যানিয়া” যখন নিম্মিত হয় তার পরে, এই দুই বৎসর কি তিন বৎসর কালের মধ্যে, বৈজ্ঞানিক তথ্যের বা যন্ত্রের যাহা কিছু আবিষ্কার ও উদ্ভাবনা হইয়াছে, “টাইট্যানিক” সে সকলের সাহায্যে নির্ম্মিত হইয়াছিল। আয়তনে ও গতি-শক্তিতে, সাজসজ্জার বিচিত্রতায় ও ভোগবিলাসের আয়োজনে, সকল বিষয়েই “হোয়াই্ট ষ্টার” কোম্পানীর কম্মকর্ত্তাগণ “টাইট্যানিক”কে অর্ণবপোতের সেরা করিয়া নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। আরোহীগণের সুখেব ও সখের ব্যবস্থা করিয়াই ইহাঁরা ক্ষান্ত হন নাই। জাহাজখানিকে এমনভাবে গড়িয়াছিলেন, তার ভিতরে এমন সকল কলকৌশল রচনা করিয়াছিলেন যাহাতে ইহার ডুবিবার কোনও আশঙ্কাই ছিল না। আপনাদের আসাধারণ কৃতিত্বের উপরে অটল বিশ্বাস স্থাপন করিয়া, নিরতিশয় স্পর্দ্ধা সহকারে যাত্রিগণকে সব্বপ্রকারের সুখসৌখিনতার ও ভোগবিলাসের লোভ দেখাইয়া, এবং সমুদ্র— যাত্রার সর্ব্ববিধ বিপদাশঙ্কা সম্বন্ধে একান্ত অভয়দান করিয়া, আপনাদের নিয়ন্তৃসমিতির বা Board of Directors’ এর সভাপতি মহাশয়কে সঙ্গে দিয়া, যাত্রী, কম্মচারী ও নাবিক সকলে মিলিয়া প্রায় তিন হাজার স্ত্রীপুরুষ লইয়া, হোয়াইটৃষ্টার কোম্পানী টাইট্যানিককে আটল্যাণ্টিকের বুকে ভাসাইয়া দিলেন। প্রহরে প্রহরে অদৃশ্য ঈথর-স্পন্দনকে আশ্রয় করিয়া, তারহীন তড়িৎ-বার্ত্তা সাগর-বক্ষঃস্থ টাইটানিকের গতিবিধির সংবাদ চারিদিকে প্রচার করিতে লাগিল। বিপুলকায় জাহাজখানি নির্ভয়ে ও সদর্পে সমুদ্র-তরঙ্গ ভেদ করিয়া যেমন হেলিয়া দুলিয়া নাচিয়া খেলিয়া চলিতেছিল, তার বুকের উপরে সহস্রাধিক নরনারীও সেইরূপ ভয়ভাবনা-বিরহিত হইয়া, হাস্যপরিহাসে, নাচে গানে, দিন কাটাইতেছিলেন। এইরূপেই এই বিশাল প্রাণের পসরা সাজাইয়া “টাইট্যানিক” আনন্দে আপনার গন্তব্যের দিকে, দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইতেছিল।
কিন্তু তার কর্ম্মকর্ত্তাগণ তাহার যে গন্তব্য নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছিলেন, সে গন্তব্য লাভ তাহার ভাগ্যে ছিল না। সভ্যতার দর্পচূর্ণ করিবার জন্য, মানুষের বিদ্যাবুদ্ধির গর্ব্ব হরণ করিবার জন্য, বিষয়বিমূঢ় জনগণের চিত্তে সাড়া আনিবার জন্য, পুরুষকারের উপরে যে দৈব আছেন এই জ্ঞান জন্মাইবার জন্য, সংসারমোহবিভ্রান্ত স্বরূপভ্রষ্ট সভ্য জীবের স্বরূপচৈতন্যের সঞ্চার করিবার জন্য, কামোপভোগপরমা সভ্যতা ও সাধনার ঘুম ভাঙ্গাইবার জন্য, “নান্যদস্তীতিবাদী” ইহ-সব্বস্ব জনগণের প্রাণে অমৃতত্বের সুসমাচার প্রচার করিবার জন্য, ভোগসব্বস্ব সমাজকে ত্যাগের মহত্ত্ব ও মাহাত্ম্য দেখাইবার জন্য—বিধাতাপুরুষ টাইট্যানিকের আর এক গন্তব্য নিদ্ধারণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। টাইট্যানিক্ সে সাংঘাতিক নিয়তি প্রাপ্ত হইয়াই আপনার চরম সার্থকতালাভ করিয়াছে।
সমুদ্রে তরঙ্গ নাই। আকাশে মেঘ নাই। অগণ্য নক্ষত্ররাজি দশদিক্ পূর্ণ কবিয়া হীরার হাট খুলিয়া বসিয়াছে বলিয়া কৃষ্ণপক্ষের নিশির অন্ধকারও নাই। শান্ত সুপ্রসন্ন প্রকৃতিমুখে নির্মমতার আভাস মাত্র নাই। অপূর্ব্ব রচনাকৌশল বিপুলকায় অর্ণবপোতের জলমগ্নের আশঙ্কার লেশমাত্র নাই। তড়িতালোকসমুজ্জ্বল, বিবিধ কলাকুশলপূর্ণ প্রমোদপ্রয়াসমুখরিত ইন্দ্রপুরীর—ন্যায় অণবপোত আশ্রয় করিয়া দ্বিসহস্রাধিক আরোহী নির্ভয়ে ও নিশ্চিত মনে অকূল জলরাশি ভাঙ্গিয়া চলিয়াছে। কেহ বা শুইয়াছে, কেহ বা শয়নের আয়োজন করিতেছে। কেহ বা ক্রীড়াকৌতুক করিতেছে, কেহ বা সঙ্গীতালাপ করিতেছে। কেহ বা আরামচৌকিতে বসিয়া নিবিষ্টমনে অধ্যয়ন করিতেছে, আর কেহ বা ডেকের উপরে পাদচারণ করিতে করিতে প্রণয়ীজনের সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করিতেছে। কেহ বা ধনের কেহ বা দারিদ্যের, কেহ বা প্রেমের কেহ বা প্রতিযোগিতার, কেহ বা জ্ঞানের কেহ বা ললিতকলার, কেহ বা সখ্যের কেহ বা সখের ভাবনা ভাবিতেছে। দুনিয়ার সকল ভাবনার বোঝা লইয়া টাইট্যানিক শান্ত সমুদ্রাম্বুরাশি ভাঙ্গিয়া চলিয়াছে—নাই কেবল সে বিচিত্র পসরায় এক মৃত্যুর ভাবনা। সহসা যখন মরণের ডাক পড়ল, জাহাজের কল যখন বন্ধ হইয়া গেল, আরোহীগণের প্রাণরক্ষার জন্য লাইফ্-বোট (Life-boat, বা জীবনতরণীগুলিকে জলে নামাইবার ব্যবস্থা আরম্ভ হইল, সকলকে ডেকে যাইয়া দাঁড়াইবার জন্য যখন কাপ্তানের হুকুমজারী হইল, তখনও সকলের প্রাণে সাড়া পড়িল না। কালের ভেরী বাজিল, তথাপি অনেকে ক্রীড়াকৌতুক ছাড়িল না, অনেকের গীতবাদ্য থামিল না। বিজ্ঞানের প্রামণ্যকে নষ্ট করিয়া, সভ্যতার অসাধারণ কৃতিত্বাভিমানকে চূর্ণ করিয়া, স্থির সমুদ্রে, নির্ম্মল আকাশ তলে, টাইটানিক যে সহসা অতলে ডুবিবে বা ডুবিতে পারে, অনেকের মনে এ কল্পনার ও উদয় হয় নাই। প্রথমকার এ ভাব সহজেই বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু পরে যখন বিপদ যে সত্য, মৃত্যু যে সন্নিকট এ বিষয়ে তিল পরিমাণ সন্দেহের আর অবসর রহিল না, তখনও যে কেন এই দ্বিসহস্রাধিক আরোহী এবং নাবিকেরা ভয়-বিক্ষিপ্ত হইয়া, শৃঙ্খলমুক্ত পশুর ন্যায় কে কাহাকে মারিয়া আপনকে বাঁচাইবে সে চেষ্টায় জাহাজ খানিকে কলহকোলাহলপূর্ণ করিয়া তুলিল না, এ রহস্য ভেদ করা সহজ নহে। এ সকল দেখিয়া শুনিয়া মনে হয়, যে আধুনিক সভ্যতা হয় মানুষকে সর্ব্বপ্রকারের সাধারণ মানব ধর্ম্ম-বিরহিত করিরা জিহ্বোপান্তসমন্বিত কাষ্ঠলোষ্ট্রে পরিণত করে, না হয় দেবত্বে উন্নীত করিয়া তোলে। এ সকল কি মোহের না মোক্ষের লক্ষণ? টাইট্যানিকে যাহা দেখিলাম তাহা কি জড়ত্ব না বীরত্ব?
আর এরূপ সন্দেহের কারণ এই যে আমরা য়ুরোপকে সচরাচর ইহসর্ব্বস্ব বলিয়াই মনে করি। যুরোপ ভোগের সন্ধানই পাইয়াছে, ত্যাগের নিগূঢ় তত্ত্ব এখনও লাভ করিতে পারে নাই, অনেক সময়ে আমরা এরূপই ভাবিয়া থাকি। সুতরাং টাইট্যানিকের তিরোধানে য়ুরোপ যাহা দেখাইল, তাহার প্রকৃত মর্ম্ম আমরা সহজে ধরিয়া উঠিতে পারি না। কখনো মনে হয়, আমরা যুরোপকে যাহা বুঝিয়া আসিয়াছিলাম তাহা সর্বৈব মিথ্যা। আর কখনো মনে হয়, বুঝি বা টাইট্যানিকের তিরোধানের যে কাহিনী জগতে প্রচারিত হইয়াছে, তাহা বহুল পরিমাণে কল্পিত। ফলতঃ আমাদের পূর্ব্বধারণাও একান্তই মিথ্যা নহে; আর আজ যে ছবি দেখিলাম, তাহাও নিতান্তই কল্পিত নহে। ভারতের সনাতন সভ্যতা ও সাধনা যে ত্যাগের পথ ধরিয়া যুগ যুগান্ত ব্যাপিয়া চলিয়া আসিয়াছে, যুরোপ যে সে পথেরই সন্ধান পাইয়াছে, টাইট্যানিকের তিরোধানে ইহা প্রমাণ হয় না। ভারতের পথ চিরদিনই ত্যাগের পথ। য়ুরোপের পথ চিরদিনই ভোগের পথ। ভারতের যতই কেন আত্মবিস্তৃতি জন্মাক্ না, সে কখনো একান্তভাবে য়ুরোপের ভোগের পথ ধরিতে পারিবে না। আর য়ুরোপের যতই কেন ক্ষণিক শ্মশানবৈরাগ্যের উদয় হউক না, সেও কখনো ভারতের এই প্রাচীন ত্যাগের পথ ধরিতে পারিবে না। ভারত যদি য়ুরোপের অদ্ভুত অভ্যুদয় দেখিয়া তাহার ভোগের পথ ধরিতে যায়, তাহাতে আত্মচরিতার্থ লাভ করা দূরে থাকুক, সে নিষ্ফল প্রয়াসে তাহার ভাগ্যে কেবল আত্মঘাতী পরধর্ম্ম লাভই ঘটিবে। আর য়ুরোপও যদি ভারতের প্রাচীন পারমার্থিক সম্পদের অতিলৌকিক শক্তিদর্শনে স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া ভারতের পরধর্ম্ম সাধনে নিযুক্ত হয়, সে প্রয়াসও তাহার পক্ষে সাংঘাতিক হইয়াই উঠিবে।
ফলতঃ কি ভারতের কি য়ুরোপের পক্ষে এইরূপ পরধর্ম্মানুশীলনের কোনই প্রয়োজনও নাই। কারণ মানবপ্রকৃতির মৌলিক একত্বনিবন্ধন, মানুষ আপনার প্রকৃতির অনুসরণ করিয়া, নিষ্ঠাসহকারে যে পথেই চলুক না কেন, পরিণামে সেই মূল প্রকৃতিকেই প্রাপ্ত হইবে; ইহাব অন্যথা হওয়া অসম্ভব। সকল নদীই যেমন একই সাগরগর্ভে যাইয়া আপনার চরিতার্থতা লাভ করে, সেইরূপ সকল মানবীয় সাধনাই ঋজুকুটীলভাবে, নানা পথ অতিক্রম করিয়া, পরিণামে যে মনুষ্যত্বে মানবপ্রকৃতিমাত্রেরই সার্থকতা লাভ হয় সেই মনুষ্যত্বকেই প্রাপ্ত হয়। য়ুরোপের প্রবাদে একটা কথা আছে—সকল পথই চরমে রোম নগরে যাইয়া পৌঁছায়। সেইরূপ সার্ব্বজনীন মানব ইতিহাসেরও সিদ্ধান্ত এই যে, সর্ব্ব— প্রকারের মানবীয় সাধনাই চরমে একই পরম মনুষ্যত্ব বস্তুকেই ফুটাইয়া তুলে। ত্যাগে যেমন ত্যাগের পরিসমাপ্তি হয় না, নিষ্কাম ভোগে যাইয়াই ত্যাগ আপনার সার্থকতা লাভ করে; সেইরূপ ভোগও আপনার চরিতার্থতার জন্যই ক্রমে ত্যাগের পথ আশ্রয় করিতে বাধ্য হয় এবং আদিতে যে ভোগ কাম্যবিষয়ের অনুসরণ করিয়া চলে, ক্রমে ত্যাগের পথ ধরিয়া তাহাকেই নিষ্কাম কর্ম্মযোগের মধ্যে আত্মচরিতার্থতা লাভ করিতে হয়।
আধুনিক য়ুরোপীয় সভ্যতার আত্যন্তিক ভোগলালসা আপনার চরিতার্থতার জন্যই যে সকল বর্মনিয়মাদির প্রতিষ্ঠা করিতে বাধ্য হইয়াছে, টাইট্যানিকের তিরোধানকালে তাহারই শ্রেষ্ঠতম ফল আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। আধুনিক ভোগের আয়োজন করিতে হইলে, বহুলোকের সমবেত শ্রম ও সাহচর্য্য প্রয়োজন হয়। টাইট্যানিক আপনি তাহার দৃষ্টান্ত স্থল। এত বড় বিপুলকায় অর্ণবযান পরিচালনার জন্য বহুলোকের আবশ্যক হয়। এই বহুসংখ্যক নৌ-কর্ম্মচারী ও নাবিকদিগের পরিচালনার জন্য প্রত্যেকের কর্ম্মাকম্মের একটা নির্দ্দিষ্ট ব্যবস্থা করা ও অপরিহার্য্য হইয়া উঠে। এই সকল ব্যবস্থার উপরেই যখন এত আরোহীর সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও জীবনমরণ নির্ভর করে, তখন এসকলের বিন্দুমাত্র বিপর্য্যয় যাহাতে না ঘটে, তাহার জন্য কঠোর শাসনেরও প্রয়োজন হয়। এক এক খানি সমুদ্রগামী জাহাজ এক একটা ক্ষুদ্র রাজ্যের মত। কাপ্তান সেই রাজ্যের রাজা। জাহাজের কর্ম্মচারী এবং আরোহী সকলকেই কাপ্তানের আজ্ঞাধীন হইয়া চলিতে হয়; না চলিলে জাহাজপরিচালনা অসম্ভব এবং এত লোকের প্রাণরক্ষা অসাধা হইয়া পড়ে। সেনাশিবিরে প্রত্যেক সেনাপতির যে প্রভুত্ব ও অধিকার, সমুদ্রগামী জাহাজের কাপ্তানের সেইরূপ অধিকার ও প্রভুত্ব রহিয়াছে। এখানে নাবিক এবং আবোহী সকলেরই দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্তা, —জাহাজের কাপ্তান। যাহারা এই সকল জাহাজে সর্ব্বদা যাতায়াত করিয়া থাকে ও এই সকল জাহাজের পরিচালনার ভার গ্রহণ করে, তাহারা সকলেই জাহাজের বিধিব্যবস্থা মানিয়া চলিতে ও কাপ্তানের আদেশ পালন করিতে অভ্যস্ত হইয়া যায়। আর এই অভ্যাসের ভিতর দিয়া তাহারা এক প্রকাবের সংযম শিক্ষাও করিযা থাকে। এই সংযমের গুণেই আসন্ন মৃত্যুর মুখেও টাইট্যানিকের দ্বিসহস্রাধিক আরোহী ও নাবিক বিন্দুমাত্র ভয়বিক্ষিপ্ত হইয়া উঠে নাই।
এ তো গেল বিশেষ ব্যবহার ও বিশেষ বিধানের কথা। ইহার অন্তরালে আধুনিক যুরোপীয় সভ্যতার কতকগুলি সাধারণ ধর্ম্মও বিদ্যমান ছিল। এই সভ্যতা ও সাধনা, যতই কেন ভোগপ্রধান হউক না, ইহার পারমার্থিক দৃষ্টি অপেক্ষারত ক্ষীণ হইলেও, পরার্থপরতা বস্তুতঃ সামান্য নহে। বিধাতার রাজ্যে অত্যন্ত ভোগী যে সেও কখনও নিতান্ত একাকীত্বের মধ্যে কিছুই ভোগ করিতে পারে না। জনসমাজই একদিকে যেমন ত্যাগের, অন্যদিকে সেইরূপ ভোগেরও একমাত্র উপযুক্ত ক্ষেত্র। একান্ত একাকী হইয়া যে থাকে, সে যেমন ত্যাগের অবসর পায় না, সেইরূপ ভোগের আয়োজনও করিতে পারে না। ভোগের মাত্রা যতই বাড়িয়া যায়, ততই দশজনকে মিলাইয়া, দশজনের শক্তি সাধ্যের সমবায়ে সেই ভোগের আয়োজনও করিতে হয়। আর এইরূপে দশজনে মিলিয়া কোনো কিছু করিতে গেলেই প্রত্যেকের স্বার্থপরতাকে, নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই, কিয়ৎপরিমাণে সঙ্কুচিত করিয়া চলিতে হয়। এই সমবায়ের সূত্র ধরিয়াই য়ুরোপ এতটা অভ্যুদয়সম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছে। আর দশজনে মিলিয়া কাজ করিতে যাইয়াই যুগোপীয় সমাজে এক প্রকারের পরার্থপরতারও বিকাশ হইয়াছে। এইরূপে দেশের জন্য ও দশের জন্য ত্যাগস্বীকার করা য়ুরোপীয় সভ্যতার ও সাধনার একটি সাধারণ ধর্ম্ম হইরা গিয়াছে। এই ধর্ম্মকে আশ্রয় করিরাই য়ুরোপের জাতীয় চরিত্রে একটা অতি উদার বিশ্বপ্রেমের আদর্শ ও ফুটিয়া উঠিয়াছে। টাইট্যানিকের তিরোধান কালে আমরা এই সকলেরই একটা অতি প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইয়াছি। ত্যাগের পথে যাইয়া ভারত মৃত্যুকে জয় করিয়াছিল। ভোগের পথে যাইয়া য়ুরোপ মৃত্যুকে তুচ্ছ করিতে শিখিয়াছে। ভারত বিশ্বের সঙ্গে একাত্মা সাধন করিয়া আপনি সুখদুঃখের অতীত হইয়াও জগতের সুখকেই আপনার সুখ ও জগতের দুঃখকেই আপনার দুঃখ বলিয়া গ্রহণ ও ভোগ করিবার নিগূঢ় সঙ্কেত লাভ করিয়াছিল। এই মহাপরিনির্ব্বাণের সুখদুঃখের তদুষ্পাঠ্যজানে না। এই ত্রিগুণাতীত অবস্থার সংবাদ আধুনিক সভ্যতা রাখে না। কিন্তু আপনি সুখ চাহে বলিরাই, দুষ্পাঠ্য সুখী করিতে চাহে এবং আপনি দুঃখের তীব্র হলাহল পান করিতেছে বলিয়াই সে বিষের যাতনা জানে এবং তাহারই জন্য জগতের দুঃখীতাপীর সঙ্গে সমবেদনা প্রকাশ করিতে পারে এবং সেই দুঃখ ও সেই বেদনা উপশম করিবার জন্য কখনও কোনও শ্রম বা ত্যাগ স্বীকার করিতেও বিমুখ হয় না। টাইট্যানিকের তিরোধানে কি করিয়া মৃত্যুকে তুচ্ছ করিতে হয়, তাহাই দেখিলাম। কেমন করিয়া অপরের সুখে সুখানুভব ও অপরের দুঃখে দুঃখানুভব করিতে হয়, তাহাও দেখিলাম। কাম্য বস্তুর অন্বেষণ করিতে যাইয়াও যে অসাধারণ সংযমের প্রয়োজন হয় এবং এই অপরিহার্য্য সংযমের মধ্য দিয়াই যে অতি উচ্চ অঙ্গের মনুষ্যত্বও ফুটিয়া উঠিতে পারে এবং এই পথে যাইয়া ও যে সুকৃতিসম্পন্ন লোকে ক্রমে নিষ্কাম কর্ম্মযোগ লাভ করিতে পারেন, টাইট্যানিকের তিরোধানে ইহাও দেখিলাম। এ সকল দিকেই আধুনিক য়ুরোপীয় সাধনা অসাধারণ উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে। টাইট্যানিক আধুনিক য়ুরোপের অসাধারণ বিদ্যাবুদ্ধির অন্যতম নিদর্শনরূপে গঠিত হইয়াছিল এবং য়ুরোপীয় কর্ম্মিগণের অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করিবার জন্য সগর্ব্বে সাগরবক্ষে ভাসিয়াছিল। আর য়ুরোপের ইসর্ব্বস্ব ভোগপ্রধান সাধনার মূলেও সে ভাগবতীলীলাশক্তি প্রচ্ছন্ন থাকিয়া, তাহারই ভিতর দিয়া শ্রেষ্ঠতম যোগশক্তি ও মোক্ষসম্পদ ফুটাইয়া তুলিতেছেন, ইহা প্রমাণ করিয়াই টাইট্যানিক অতল সাগরতলে অন্তর্হিত হইয়াছে। টাইট্যানিকের তিরোধানে যুরোপ মহীয়ান্ ও জগৎ লাভবান্ হইয়াছে।