চরিত-কথা (বিপিনচন্দ্র পাল)/শ্রীযুক্ত স্যার তারকনাথ পালিত

শ্রীযুক্ত স্যার তারকনাথ পালিত

(বঙ্গদর্শন- ১৩১৯)

 বাংলাদেশের বাহিরে শ্রীযুক্ত তারকনাথ পালিতের নাম এতাবৎকাল যে খুব সুপরিচিত ছিল তাহা নহে। আপনার দীর্ঘ জীবনের সমুদায় সঞ্চিত সম্পত্তি জড়বিজ্ঞানশিক্ষার সুব্যবস্থার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করিয়া পালিত মহাশয় আজ একটা ভারতব্যাপী খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। দেশবিদেশের সংবাদপত্র সকল তার গুণগানে মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে। রাজপুরুষেরা তাঁর এই অনন্যসাধারণ বদান্যতার পুরস্কারস্বরূপ তাঁহাকে “নাইট” শ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন। আজি পর্যন্ত বাংলাদেশে এক হাইকোর্টের জজেরা ব্যতীত অপর কেহ এরূপ সম্মান প্রাপ্ত হন নাই। বোম্বাইএ পারশী ধনকুবেরদের মধ্যে কেহ কেহ আপনাদের বদন্যতার জন্য এইরূপ ভাবে সম্মানিত হইয়াছেন বটে, কিন্তু বাংলায় পালিত মহাশয়ই সব্বপ্রথমে এই প্রতিপত্তি লাভ করিলেন।

 বহুদিন হইতেই বাংলার লোকে পালিত মহাশয়ের নাম শুনিয়া আসিয়াছে। অল্প বয়সে বিলাত যাইয়া তিনি বারিষ্টার হইয়া আসেন। সেকালে বিলাত যাওসা এতটা সহজ ছিল না। আর বাঙালী বারিষ্টারের সংখ্যাও দেশে অতি অল্প ছিল। স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বোধ হয় পালিত মহাশয়ের পূর্ব্বেই বারিষ্টার হইয়া আসেন। স্বর্গীয় মনোমোহন ঘোষ পালিত মহাশয়ের সমকালীয় লোক। কিন্তু মনোমোহন ঘোষ বা উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আপন আপন ব্যবসায়ে যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পালিত মহাশয় তাহা করেন নাই। অথচ পালিত মহাশয়ের শক্তিসাধ্য যে ইহাদের অপেক্ষা বড় বেশি হীন ছিল, এমন কথা কিছুতেই বলা যায় না। ববং বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় পালিত মহাশয় ইঁহাদের অপেক্ষা কতকটা শ্রেষ্ঠ ছিলেন বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু এ জগতে সর্ব্বত্রই একটা অদ্ভুত ক্ষতিপূরণের নিয়ম প্রতিষ্ঠিত আছে। বিধাতা যাহাকে একদিকে কিছু বেশি দান করেন, অন্যদিকে সেই আতিশয্যের “পাষাণ ভাঙ্গিবার” জন্যই বা বুঝি, তাহাকে কিছু খাট করিয়াও রাখেন। একটু তলাইয়া দেখিলে অনেক বুঝিতে পারা যায়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি যার থাকে, ধীরতা তার তেমন থাকে না। সহজে যে জটিল বিষয় ধরিতে বা বুঝিতে পারে, গভীর বিষয়ে দীর্ঘকাল ধরিয়া মনোনিবেশ করিবার প্রবৃত্তি ও অভ্যাস তার প্রায় দেখা যায় না। মেধা ও শ্রমশীলতা কচিৎ একসঙ্গে বসবাস করে। পালিত মহাশয়ের তীক্ষ্ণ মেধাই বোধ হয় কিয়ৎ পরিমাণে তাঁর ব্যবসায়ে অনন্যসাধারণ কৃতিত্বলাভের অন্তরায় হইয়াছিল। আর এইজন্যই তিনি অধিকাংশ সময় ফৌজদারী মামলাতেই নিযুক্ত হইতেন। ফৌজদারী মামলায় এক সময়ে বাঙালী বারিষ্টারদিগের মধ্যে শ্রীযুক্ত তারকনাথ পালিত মহাশয়ের মতন এমন সুদক্ষ লোক আর কেহ ছিলেন না, বলিলেও হয়। মনোমোহন ঘোষ মহাশয়ের প্রতিপত্তি কতকটা বেশি ছিল সত্য, কিন্তু ঘোষ মহাশয় কেবল আপনার ব্যবহারকুশলতাগুণে এই প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন কি না, বলা যায় না। ঘোষ মহাশয়ের যে কর্ম্মকুশলতা, যে লোকরঞ্জনশক্তি, যে ধৈর্য্য ও স্থৈর্য্য ছিল, সে সকলগুণ সে মাত্রায় পালিত মহাশরের থাকিলে, তিনি কোনও অংশে যে ঘোষ মহাশয় অপেক্ষা অল্প খ্যাত্যাপন্ন হইতেন, এমন মনে হয় না। কিন্তু বিধাতার রাজ্যে এ সকল ‘যদি’র স্থান নাই। তাঁর নিরপেক্ষ বিচারে আমাদের প্রত্যেককে আমাদের উপযোগী শক্তিসাধ্য দান করিয়া থাকে। একদিকে কাহাকে একটু কিছু বেশি দিলে আর একদিকে একটু কাটিয়া ছাটিয়া সমান করিয়া দেয়। ঘোষ মহাশয়ের যাহা ছিল পালিত মহাশয়ের তাহা ছিল না, আর পালিত মহাশয়ের যাহা আছে, ঘোষ মহাশয় তাহা পান নাই, এইরূপ গড়ে মানুষ একটা বিচিত্র ক্ষমতা লাভ করিয়া থাকে।

 শ্রীযুক্ত তারকনাথ পালিতের অনেক শক্তিসাধ্য আছে ——- যে সকল শক্তিসাধ্য থাকিলে লোকে ব্যবহারজীবীর ব্যবসায়ে কৃতিত্বলাভ করে, পালিত মহাশরের তাহা বিলক্ষণ ছিল। আর যে সুযোগ পাইলে এ সকল শক্তিসাধ্য সফলতা লাভ করিয়া থাকে, পালিত মহাশয়ের ভাগ্যে সে সুযোগও যে জুটে নাই, এমন বলা যায় না। কিন্তু তাঁর প্রকৃতির মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যাহাতে এ সকল শক্তি এবং সুযোগ সত্ত্বেও তিনি আপনার ব্যবসারে সর্ব্বোচ্চ স্থান অধিকার করিতে পারেন নাই। লোকে সচরাচর ব্যবহার-ব্যবসায়কে স্বাধীন ব্যবসায় বলিয়া থাকে বটে; কিন্তু এখানেও যে স্বাধীনতার খুব আদর থাকে বা প্রতিষ্ঠা সম্ভব এমন বলা যায় না। উকিল বারিষ্টারকেও আদালতের মুখ চাহিয়া এবং হাকিমের মর্জ্জি বুঝিয়া চলিতে হয়। না পারিলে ব্যবসার চলা ভার হইয়া উঠে। আর অনন্যসাধারণ আইনজ্ঞতা বা কর্ম্মকুশলতা গুণে ব্যবসায় চালাইতে পারিলেও সকল সময়ে সমব্যবসায়ীদের মধ্যে সর্বোচ্চস্থান অধিকার করা সম্ভব হয় না। পালিত মহাশয় চিরদিনই অতিশয় স্বাধীনচেতা লোক বলিয়া পরিচিত ছিলেন। লোকের মুখ চাহিয়া চলিবার কৌশলটা তিনি কখনও শিক্ষা করেন নাই। যে নম্রতা থাকিলে এ শিক্ষা সহজ হয়, পালিত মহাশরের প্রকৃতিতে তাহা ছিল না এবং নাই। খাতির কাহাকে বলে তিনি তাহা জানেন না। চক্ষুলজ্জা-বস্তুটাও তাঁর আছে বলিয়া মনে হয় না। আর এসকল যে উকীল বারিষ্টারের নাই, তাঁর পক্ষে আপনার ব্যবসায়ে উচ্চতম সোপানে আরোহণ করা আদৌ সম্ভবে না। পালিত মহাশয়ের প্রকৃতি একটু রুক্ষ। মনে হয় যেন সহজেই তিনি উত্তেজিত হইয়া পড়েন। সতাং ব্রুয়াৎ প্রিয়ং ব্রুয়াৎ, মা ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ং—মহাভারতের এই সমীচীন নীতি অনুসরণ করিয়া চলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব বলিয়া বোধ হয়। মোলায়েম করিয়া কথা বলার অভ্যাসটা তিনি কখনও লাভ করেন নাই। আর এই জন্যই এত শক্তি সাধ্য থাকিতেও তিনি আপনার ব্যবসায়ে যথাযোগ্য উন্নতি লাভ করিতে সক্ষম হন নাই।

 আর ঠিক এই কারণেই দেশের তথাকথিত জনহিতকর কর্ম্মেও পালিত মহাশয় এ পর্য্যন্ত নেতৃ-পদ প্রাপ্ত হন নাই। এ আকাঙ্ক্ষাও যে তাঁর কখনও ছিল এরূপত মনে হয় না। স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের শেষ ভাগে, আর মনোমোহন ঘোষ মহাশয় আযৌবনই দেশহিতকর অনুষ্ঠানে লিপ্ত ছিলেন। মনোমোহন ঘোষ বাল্যাবধিই লোকমত-গঠন করিয়া আসিয়াছিলেন। বিলাত যাইবার পূর্ব্বে, যখন তিনি অজাতশ্মশ্রু যুবকমাত্র, তখনই “ইণ্ডিয়ান মিরার” (Indian Mirror) পত্রের সম্পাদকীয় ভার বহন করিয়াছিলেন। “ইণ্ডিয়ান মিরার” তখন সাপ্তাহিক ছিল; তার বহুকাল পরে দৈনিক আকারে পরিণত হয়। কিন্তু সে কালে একখানা ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্র পরিচালনাও সামান্য ব্যাপার ছিল না। বিশেষতঃ “ইণ্ডিয়ান মিরার” তখন নবোদিত ব্রহ্ম-সমাজের মুখপত্র ছিল। কেশবচন্দ্র বক্তৃতামঞ্চে যে সুর জাগাইতেছিলেন, ইণ্ডিয়ানমিরারের স্তম্ভে সেই সুরই ভাঁজিতে হইত। ইহাতেই একদিকে মনোমোহনের শক্তিসাধ্যের ও অন্যদিকে লোক-হিতব্রতে তাঁর কি যে গভীর অনুরাগ ছিল তার বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। মনোমোহন এইরূপে প্রথম যৌবনাবধিই লোকনায়কের পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই উচ্চাভিলাষ আমরণ পর্যন্ত তাঁহার অন্তরে জাগরুক ছিল। কিন্তু পালিত মহাশয়ের মধ্যে এ বস্তুটা কখনও দেখা গিয়াছে কি না সন্দেহ, যে সকল সরঞ্জাম থাকিলে লোকে জননায়কের পদলাভ করিতে পারে, পালিত মহাশয়ের সে সকল সরঞ্জামও কখনও ছিল বলিয়া বোধ হয় না। যেমন ব্যবহারব্যবসায়ে হাকিমের মুখ চাহিয়া কথা বলিতে হয়, সেইরূপ জননেতৃলাভ করিতে হইলে অনেক সময় জনগণের মন যোগাইয়া চলা আবশ্যক হয়। যাঁহারা অনন্য-সাধারণ বাগ্মীতাশক্তি বা সাহিত্য-প্রতিভার গুণে প্রথমে অগঠিত লোকমতকে প্রবুদ্ধ ও গঠিত করিয়া সেই সংহত জনশক্তির অগ্রণীরূপে লোকনায়কের পদলাভ করেন, তাঁহাদের পক্ষে এরূপভাবে লোকমতানুবর্ত্তিতা না করিয়াও সেই পদ রক্ষা করা সম্ভব হইতে পারে। কিন্তু যাঁহাদের এ শক্তি নাই, তাঁহাদের পক্ষে লোকমণ্ডলীর মুখাপেক্ষী হইয়া না চলিতে পারিলে, আধুনিক দেশহিতকর অনুষ্ঠানাদিতে অগ্রণীদলভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত অল্প। আমাদের দেশে এ পর্য্যন্ত যাঁহারা লোকনেতৃত্ব লাভ করিয়াছেন, একদিকে স্বর্গীয় কেশবচন্দ্র সেন ও অন্যদিকে কিয়ৎপরিমাণে শ্রীযুক্ত সুবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভিন্ন আর প্রায় সকলকেই স্বল্পবিস্তর লোকের মন যোগাইয়া চলিতে হইয়াছে। আর সুরেন্দ্রনাথও এক সমরে যতটা স্বাধীন ছিলেন, পরে সে স্বাধীনতা ততটা রক্ষা করিতে পারেন নাই। কিন্তু যে সকল গুণ থাকিলে লোকে এরূপ ভাবে, পদ ও প্রতিপ্রত্তির লোভেও আপনাকে চাপিয়া রাখিতে পারে, শ্রীযুক্ত তারকনাথ পালিত মহাশয়ের প্রকৃতিতে সে গুণ নাই। যে স্বাধীনচিত্ততার জন্য তিনি আপনার ব্যবসায়ের চূড়ার উঠিতে পারেন নাই, সেই স্বাধীনচিত্ততার জন্যই তিনি আমাদের আধুনিক সমাজসংস্কারের বা রাষ্ট্রীয় কর্ম্মীর দলে নেতৃত্বলাভ করিতে পারেন নাই। এরূপ কোনও আকাঙ্ক্ষাও তাঁর মধ্যে কখনও জাগিয়াছে কিনা সন্দেহ। অথচ পালিত মহাশয় নিজের পরিবারে আর দশজন বিলাতপ্রত্যাগত বাঙ্গালী হিন্দুর মতন আধুনিক সমাজসংস্কারের আদর্শের অনুসরণ করিয়াই চলিয়াছেন। কিন্তু কখনও এ সকল লইয়া একটা হুজুগ করেন নাই। রাষ্ট্রীয় আন্দোলনআলোচনাতেও তিনি এইরূপেই যোগ দিয়া আসিয়াছেন। প্রয়োজন মত কংগ্রেসের সাহায্যার্থে যথাসাধ্য অর্থদান করিয়াছেন। তাঁর সমশ্রেণীর আর দশজনে যেমন এ সকল ব্যাপারে অর্থ সাহায্য করিয়াছেন, পালিত মহাশয়ও সেরূপ করিয়াছেন। কিন্তু কখনও এ সকল দানের জন্য কংগ্রেসের রঙ্গমঞ্চে আরোহণ করিবার কোন লিপ্সা তাঁর মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় নাই।

 ফলতঃ এরূপ নেতৃত্বলাভের যোগ্যতাও তাঁর নাই; কিন্তু পালিতমহাশয়ের সর্ব্বাপেক্ষা বেশী প্রশংসার কথা এই যে, তিনি আপনার ঠিক ওজনটা জানেন। তিনি কি করিতে পারেন ও কি করিতে পারেন না, ইহা যেমন পরিষ্কাররূপে জানেন, তাঁর সমশ্রেণীর লোকেরা অনেকেই তাহা জানেন না। এই জন্যই যাঁর যে কার্য্যের কোনও শক্তি ও সরঞ্জাম নাই, সেও আপনার পদের বা ধনের জোরে সে কার্য্যে কেবল হাত দেয় যে তাহা নহে, একেবারে নেতৃত্ব পদে যাইয়া চড়িয়া বসিতে চাহে। বাঙ্গলা ভাষায় ইহাকেই বোধ হয় হাম্‌বা বলে। এই বস্তু হইতেই ইংরেজের হাম্বাগিজমের (Humbugismএর) উৎপত্তি হয়। যার প্রকৃতির ভিতরে এই বাঙ্গলা হাম্‌বাটি নাই, তার পক্ষে ইংরেজি হাস্বাগিজম করিবারও কোন প্রয়োজন উপস্থিত হয় না। যার যে শক্তি নাই, সে সেই কাজ করিতে গেলেই হাম্বাগ (Humbug) হইয়া উঠে। যার প্রকৃতিগত আস্তিক্য বুদ্ধি নাই সে যদি ধাম্মিকের আসনে যাইয়া বসিবার জন্য লালায়িত হয়; যাঁর বাক্শক্তি নাই সে যদি করতালি লাভের লোভে বক্তৃতামঞ্চে যাইয়া দাঁড়াইতে চাহে; যার বিনয় স্বভাবসিদ্ধ নয় সে যদি বিনয়ীর যশলিপ্সায় এই মহৎ গুণের অভিনয় করিতে ব্যস্ত হয়; যার বুদ্ধি ও বিদ্যা নাই, আছে কেবল ধনের উত্তাপ, সে যদি লোকমতপরিচালনার জন্য জননেতৃত্ব দাবী করিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে তার পক্ষে এই হাম্‌বার জন্য হামবাগ্ না সাজা অসম্ভব ও অসাধ্য হইয়া দাঁড়ায়। পালিত মহাশয়ের মধ্যে এরূপ কোন হাম্‌বা নাই বলিয়া, তিনি এই হুজুগের য়ুগেও এ পর্য্যন্ত হাম্বাগ্ হইয়া উঠেন নাই।

 তাঁর রুক্ষ্ম স্বভাবের জন্য পালিত মহাশয় নিজের ব্যবসায়ে যেমন অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব লাভ করিতে পারেন নাই, সেইরূপ আমাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কর্ম্মজীবনেও কোনও প্রকারের নেতৃত্বমর্যাদা প্রাপ্ত হন নাই। আর এই জন্য তাঁর মেধার বা চরিত্রের প্রভাবও আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনোরাজ্যেও কোনও প্রকারের আধিপত্য লাভ করে নাই। ফলতঃ ইংরাজিতে বাহাকে public man বলে, শ্রীয়ুক্ত তারকনাথ পালিত সে জাতীয় জীব নহেন। তাঁর প্রকৃতির মধ্যে এইরূপে লোকনেতৃত্ব লাভ করিবার কোনও উপকরণও নাই। অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবনে, আপনার বন্ধুবান্ধবদিগের মধ্যে, আশৈশবই তিনি অশেষ প্রভুত্বভোগ করিয়া আসিয়াছেন, অকৃত্রিম বন্ধুবাৎসল্য তাঁর চরিত্রের একটা বিশেষ লক্ষণ বলিয়া বহুকালাবধিই জানা গিয়াছে। আর আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবদিগের উপরে তাঁর একটা মোহিনীশক্তিরও পরিচয় অনেক পাওয়া গিয়াছে। ইঁহারা পালিত মহাশয়ের সকল প্রকারের ত্রুটী দুর্ব্বলতা উপেক্ষা করিয়া চিরদিন তাঁর মুখাপেক্ষী হইয়া চলিয়াছেন। একবার যে তাঁর বন্ধুতালাভ করিয়াছে চিরদিন পালিত মহাশয়, প্রাণপণে তাঁহার প্রতি সুহৃদজনোচিত সর্ব্ববিধ কর্ত্তব্য পালন করিয়া আসিয়াছেন। অন্য পক্ষে তাঁর শত্রুতা যে একবার করিয়াছে, বা তাঁর বন্ধুবান্ধবদিগের কোনোও প্রকারের অনিষ্টের চেষ্টাতে যে একবার লিপ্ত হইয়াছে, শ্রীযুক্ত তারকনাথ পালিত জীবনে কখনও তাহাকে ক্ষমা করিতে পারেন নাই। এই কারণে তাঁর বন্ধুর সংখ্যা অল্প, শত্রুর সংখ্যা অনেক বেশী হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাঁর শত্রু বা অসম্পর্কিত লোকের প্রতি পালিত মহাশয় কখনও উদার ও কোমল ব্যবহার করিতে পারেন নাই বলিয়া তাঁর প্রাণটা যে খুব কঠোর এমনও মনে করা সঙ্গত হইবে না। কারণ এই কঠোরতার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কোমলচিত্ততারও অনেক পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। একদিকে যেমন পালিত মহাশয়কে নিরতিশয় কঠোর প্রকৃতির বলিয়া মনে হয়, অন্যদিকে সময়ে সময়ে তাঁর সেইরূপ অসাধারণ কোমলতারও প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। আপনার বন্ধুবান্ধবদিগের সম্বন্ধেই যে তিনি নিরতিশয় কোমলচিত্ততার প্রমাণ দিয়াছেন, তাহা নহে; কখনও কখনও নিতান্ত নিঃসম্পর্কিত লোকদিগের প্রতি গভীর ও উচ্ছ্বসিত সহানুভূতিতে তাঁর বক্ষে দরবিগলিতধারা প্রবাহিত হইতে দেখা গিয়াছে। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের প্রতিষ্ঠার দিনে আমরা স্বচক্ষে ইহাব প্রমাণ পাইয়াছিলাম। সেই দিন একটা যুবকের করুণ প্রার্থনা শুনিয়া পালিত মহাশয় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিলেন, অথচ আমাদের মধ্যে আর কাহারও সে জন্য অশ্রুপাত হয় নাই। পালিত মহাশয়ের আপাতঃ কঠোরতা ও রুক্ষ্ম স্বভাবের সঙ্গে এই ভাবোচ্ছ্বাসের যতটা অসঙ্গতি আছে বলিয়া মনে হইতে পারে, ফলতঃ ততটা অসঙ্গতি এ দু’য়ের মধ্যে একেবারে নাই। দুইই ভাবুকতার লক্ষণ। যাঁরা অতি সহজে ক্রুদ্ধ হইয়া উঠেন, তাঁরা যে বস্তুতঃই অতিশয় নির্ম্মমপ্রকৃতির লোক তাহা নহে। প্রকৃত নিম্মম লোকেরা লোকের সর্ব্বনাশ করিতে পারে, কিন্তু হঠাৎ কাহারো উপরে চটিয়া যায় না। যাঁদের প্রাণ নিরতিশয় কোমল তাঁরাই একদিকে সহজে ক্রোধের বশবর্ত্তী হন, আর অন্যদিকে স্নেহমমতার আবেগেও আত্মহারা হইয়া যান। এ বস্তুটী অনেক লোকহিতব্রত মহাপুরুষের মধ্যেও দেখা গিয়াছে। পুণ্যশ্লোক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চরিত্রে ইহা দেখিয়াছি। বিদ্যাসাগর যেমন সহজে চটিয়া যাইতেন, সেইরূপ অতিসহজেই আবার গলিয়া যাইতেন। ফলতঃ কোনও কোনও বিষয়ে পালিত মহাশয় বিদ্যাসাগর চরিত্রকে স্মরণ করাইয়া থাকেন। অবশ্য দুজনার এক নিক্তিতে তৌলকরা চলে না।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দেবত্ব পালিত মহাশয়ের মধ্যে সব দেখা যায় নাই; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশরের মানুষী ভাবগুলি অনেক সময় পালিত মহাশয়ের মধ্যেও দেখা গিয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় অতিশয় স্বাধীনচেতা মহাপুরুষ ছিলেন; পালিত মহাশয়ের স্বাধীনচিত্ততাও লোকপ্রসিদ্ধ। বিদ্যাসাগর মহাশয় কাহারও মুখ চাহিয়া কথা কহিতে পারিতেন না; পালিত মহাশয়ও তাহা পারেন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোমলচিত্ততাও কিয়ৎপরিমাণে পালিত মহাশয়ের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে ব্রহ্মণ্যপ্রকৃতিসুলভ যে নিতান্ত নির্লোভ ভাব বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এতটা বড় করিয়াছিল, রজত— প্রধান সভ্যতার আদর্শে অভিভূত, ব্যবহারজীবী পালিত মহাশয়ের মধ্যে সে নির্লোভ ও সে ত্যাগের প্রমাণ কেহ কখনও অন্বেষণ করিতে যায়ও নাই, কেহ কখনও পায়ও নাই, আর শেষজীবনে পালিত মহাশয় যে ত্যাগের দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহও বিদ্যাসাগরের জীবনব্যাপী ত্যাগের সমজাতীয় বস্তু নহে। এ ত্যাগেও বিলাতী গন্ধ আছে, বিদ্যাসাগরের ত্যাগে সাত্ত্বিকতাপ্রধান ব্রাহ্মণ্য আভাও দেখা যাইত। কিন্তু এ পার্থক্য সত্ত্বেও, বাংলার আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে উভয়েই অক্ষয় কীর্ত্তি স্থাপন করিয়াছেন। আর পালিত মহাশর জীবনের সন্ধ্যাকালে এইরূপ ভাবে আপনার যথাসর্ব্বস্ব স্বদেশী যুবকগণের শিক্ষার সুব্যবস্থা করিবার জন্য দান করিয়া, প্রথম জীবনে সঞ্চিত সমুদায় কুযশকে একান্তভাবে ক্ষালন করিয়া, বাংলার আধুনিক সমাজের ইতিহাসে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একাসনে নহে, কিন্তু একই মন্দিরে, অক্ষয় কীর্ত্তি অর্জ্জন করিয়াছেন।