চরিত-কথা (বিপিনচন্দ্র পাল)/স্বর্গীয় উইলিয়েম টি, ষ্টেড্
স্বর্গীয় উইলিয়েম টি, ষ্টেড্
বাল্যকাল হইতে ইংরেজি গ্রন্থে অনেক প্রসিদ্ধ ইংরেজের চরিতাখ্যান পড়িয়াছি। ইংরেজসমাজের মাঝখানে বসিয়াও ছোট বড় অনেক ইংরেজের সঙ্গে নানা কর্ম্মে, নানা ভাবে, মেশামিশি করিয়াছি। কিন্তু উইলিয়েম, টি, ষ্টেডের মত এমন খাঁটি ইংরেজ অতি অল্পই দেখিয়াছি।
“খাঁটি” ও “ভাল”
যে বস্তু ঠিক আপনার স্বরূপেতে থাকে তাহাকেই আমরা খাঁটি বস্তু বলি। কিন্তু খাঁটি হইলেই যে সে বস্তু সকলের চক্ষে ভাল হইবে এমন বলা যায় না। দ্রব্যগুণসম্বন্ধে, বোধ হয়, যা খাঁটি তাই ভাল, আর যা ভাল তাই খাঁটি হয়। কিন্তু মানুষ সম্বন্ধে ঠিক এ কথা বলা যায় কি? আমরা কোনো দ্রব্যের নিজের প্রকৃতির দ্বারাই তার সত্যিকার ভালমন্দ বিচার করিয়া থাকি। কিন্তু মানুষের বেলা আমরা তার ভিতরকার প্রকৃতির সত্যাসত্য ও ধর্ম্মাধর্ম্মের সন্ধান করি না; আমাদের নিজের প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি রুচি ও অভ্যাসের দ্বারাই তার ভালমন্দের বিচার করিয়া থাকি। সকল মানুষ যদি সমান হইত, তবে এরূপ বিচার অসঙ্গত হইত না। কিন্তু মানুষ যে সকল সমান নয়। সকল জলই যেমন সমান, জলে জলে যে বেশ কম দেখি, তাহা জলের ভিতরকার প্রকৃতিগত নহে, জল ছাড়া অন্য কোনো ধাতুকণা বা লবণাদি তার সঙ্গে মিশিয়া গিয়া জলের গুণের তারতম্য উৎপাদন করে; সকল সোণাই যেমন সমান; সকল পারদ গন্ধকই যেমন সমান; সকল মানুষ তো আর সেরূপ সমান নয়। মানুষে মানুষে যে বিভিন্নতা তা’ তার প্রকৃতিগত। সে প্রকৃতির বাহিরের কোন বস্তু তার সঙ্গে মিশিয়া গিয়া এ সকল ভেদাভেদের সৃষ্টি করে নাই। আর মানুষে মানুষে এই প্রকৃতিগত বৈষম্য আছে বলিয়াই প্রকৃতপক্ষে একের যা’ ধর্ম্ম অপরের তাই ধর্ম্ম হয় না, একের ভাল মন্দের দ্বারা অপরের ভালমন্দের বিচার সঙ্গত হইতেই পারে না; সুতরাং কোনো মানুষ খাঁটি হইলেই যে সকলের বিচারে সে ভালও হইবে, আর সকলে কাহাকেও ভাল বলিলেই যে সে খাঁটি হইবে, এমন কোনো কথা নাই। বরং এ সংসারে দশজনে যা’কে ভাল বলে অনেক সময় সে খাঁটি হয় না; নিজের স্বরূপেতে থাকা তার পক্ষে একান্তই কঠিন হইয়া পড়ে।
ভাল ইংরেজ ও খাঁটি ইংরেজ
এমন ইংরেজ তো দেখিয়াছি যাঁহাদিগকে আমাদের চক্ষে বড়ই ভাল লাগিয়াছে। এমন বিস্তর ইংরেজ সর্ব্বদাই তো দেখিতে পাই, যাঁহাদিগকে আমাদের চক্ষে নিতান্তই মন্দ ঠেকে। কিন্তু আমরা যাঁহাকে ভাল বলি তিনিই যে খাঁটি ইংরেজ আর আমরা যাঁহাকে মন্দ দেখি তিনিই যে খাঁটি ইংরেজ নহেন, এমন কথা বলা যায় কি? বরং আমরা যে ইংরেজকে বড় ভাল বলি তার পক্ষে খাঁটি ইংরেজ না হওয়ারই সম্ভাবনা কি বেশী নাই? লাট রিপণ্ আমাদের চক্ষে বড় ভাল ইংরেজ ছিলেন। তাঁর মত এমন ভাল লাট বহুদিন ভারত শাসন করিতে আসেন নাই। কিন্তু রিপণচরিত্রে যে বস্তু দেখিয়া আমরা এত মুগ্ধ হইয়াছিলাম সে বস্তু ইংরেজচরিত্রের বিশেষত্ব নহে। রিপণের শান্তমূর্ত্তি, সদাপ্রসন্ন ভাব, সমাহিত চেষ্টা-চরিত্র, ধর্ম্মভয় ও ভগবদ্ভক্তি দেখিয়া আমরা ইংরেজ আভিজাত্যের পরিচয় পাই নাই, বরং আমাদের সনাতন ব্রাহ্মণ্য আদর্শেরই কথঞ্চিৎ আভাস পাইতাম। আর তারই জন্য রিপণকে আমাদের এতটা ভাল লাগিয়াছিল। রিপণ লোক অতি মহৎ ছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু খাঁটি ইংরেজ ছিলেন, এমন কথা বলিতে পারি না। রিপণের মত, ভারত-বন্ধু স্যার হেন্রি কটনও লোক অতি ভাল। রিপণকে দেখিয়া যেমন হিন্দু ব্রাহ্মণপণ্ডিতের ভাব মনে আসিত, কটনকে দেখিয়া, তাঁর কথাবার্ত্তায় ভাবস্বভাবে, কতকটা সেইরূপ আধুনিকশিক্ষাপ্রাপ্ত, বিশ্বমানবভক্ত, বাঙ্গালী আন্দোলনকারী বা এজিটেটরদের স্মৃতি জাগিয়া উঠে। ফলতঃ কটন যখন আসামের চিফ্কমিশনার ছিলেন, তখন শিলঙ্গের সিভিলিয়ান্ সমাজ, পরিহাসচ্ছলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্ত্তায় তাঁহাকে “বাবু চিফ্” বলিয়াই ডাকিতেন। আর তারই জন্যই বস্তুতঃ কটনকেও আমাদের এত ভাল লাগে। কিন্তু রিপণ, কটন, এঁরা কেউ যে খাঁটি ইংরেজ, এ কথা বলিতে পারি না।
ব্যক্তিত্ব ও জাতিত্ব
ইংরেজের ইংরেজত্ব বলিয়া যে একটা বস্তু আছে, সে বস্তু যার ভিতরে ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, কেবল তাঁহাকেই খাঁটি ইংরেজ বলা যাইতে পারে, অন্যকে নহে। দুধ যখন সম্পূর্ণরূপে আপনার স্বরূপে থাকে, তখনই কেবল তাহাকে খাঁটি দুধ বলা যায়। খাঁটি দুধের চাইতে কারো কারো নিকটে রাবড়ী ঢের বেশি মিষ্টি লাগে। ডাক্তার কবিরাজের ব্যবস্থায় ঘোল কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢের বেশি উপকারী হয়। কিন্তু তাই বলিয়া রাবড়ী বা ঘোল খাঁটি দুধ হয় না। যেমন দুধের দুগ্ধত্ব বলিয়া একটা বস্তু আছে, যে বস্তুরূপে দুধ যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই তাহাকে খাঁটি দুধ বলা যায়; সেইরূপ ইংরেজেরও ইরেজত্ব বলিয়া একটা বিশেষ বস্তু আছে, এ বস্তুরূপে থাকিলেই ইংরেজ খাঁটি ইংরেজ হয়। দুধের দুগ্ধত্ব যেমন দুধকে দুনিয়ার আর সকল বস্তু হইতে পৃথক্ করিয়া রাখিয়াছে, তেমনি ইংরেজের এই ইংরেজত্ব বস্তুও তাহাকে দুনিয়ার আর সকল জা’ত হইতে পৃথক করিয়া রাখিয়াছে। সকল মানুষই এক হিসাবে সমান বটে; কিন্তু আর এক হিসাবে কোনো মানুষই আর কোনো মানুষের মত নহে। সকল মানুষেরই দেহ গঠন মোটের উপরে এক; সকলেরই মোটের উপরে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয় আছে; সকলেরই মধ্যে একাদশ ইন্দ্রিয়রূপে মন বিরাজ করিতেছেন, মনের উপরে বুদ্ধি; বুদ্ধির উপরে আত্মা;—সভ্য ও অসভ্য, আর্য্য অনার্য্য, মানুষমাত্রেই এ সকল সাধারণ মানবধর্ম্ম রহিয়াছে। কিন্তু তথাপি সকল মানুষ তো সমান নয়। কারণ এই সাধারণ ও সার্ব্বজনীন মানবধর্ম্মের মধ্যেই আবার ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মধ্যে তার নিজত্ব বা ব্যক্তিত্ব বলিয়া একটা কিছু আছে, যাহাতে প্রত্যেক মানুষকে অপর সকল মানুষ হইতে আলাহিদা করিয়া রাখিতেছে। এই ব্যক্তিত্ব-বস্তুটী তার চেহারায়, তার চাহনিতে, তার গলার স্বরে, তার পায়ের শব্দে, তার চালচলনে, তার ভাবস্বভাবে, যে ভাবে সে চিন্তা করে, যে রূপে সে ভাবে-চিন্তে,—এ সকলের ভিতর দিয়া প্রকাশ হইয়া পড়ে। এই যে বিশেষত্বটুকু যাহাতে এক মানুষকে আর এক মানুষ হইতে পৃথক্ করিয়া রাখে, ইহাকে সাধারণ মানবধর্ম্মের অন্তর্গত ব্যক্তিধর্ম্ম বলা যাইতে পারে। যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির, সেইরূপ প্রত্যেক মনুষ্যসমাজের বা মনুজ গোষ্ঠির কতকগুলি নিজ ধর্ম্ম আছে। আর এই যে নিজস্ব সমাজ ধর্ম্ম বা গোষ্ঠি-ধর্ম্ম বা জাতি-ধর্ম্ম, ইহারই জন্য এক জাতি অপর জাতি হইতে পৃথক্ হইয়া রহিয়াছে। বিশাল মনুষ্যত্বের সাধারণ ভূমিতেই কতকগুলি বিশেষ বিশেষ লক্ষণ প্রকাশিত হইয়া, হিন্দুর হিন্দুত্বকে, ইহুদীর ইহুদীত্বকে, জর্ম্মাণের জর্ম্মাণত্বকে, ইংরেজের ইংরেজত্বকে,—এ সকল ভিন্ন ভিন্ন জা’তের জাতিত্ব বা জাতীয়তাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। মানুষের হিসাবে ইহুদী ও হিন্দু, জাপ ও জর্ম্মাণ, রুশ ও চীন, ইতালীয় ও ইংরেজ, এঁরা সকলেই সমান। সকলেরই মানুষের দেহ, মানুষের মন, মানুষের ভাবস্বভাব রহিয়াছে। অথচ জাতির হিসাবে, ইহাদের সকলেরই অপর সকল হইতে ভিন্ন। হিন্দুর চেহারায়, কথাবার্ত্তায়, চালচলনে, ভাবস্বভাবে, এমন একটা বিশেষত্ব আছে যাহা জগতের আর কোনো জা’তের ভিতরে নাই। এই বিশেষত্বটুকুই হিন্দুর হিন্দুত্ব। যে সকল চিহ্ন দ্বারা দুনিয়ার অসংখ্য জা’তের মাঝখানে আমরা হিন্দুকে বাছাই করিয়া আলাহিদা করিতে পারি, তাই তার হিন্দুত্ব। সেইরূপ যে সকল চিহ্নের দ্বারা জর্ম্মাণকে জগতের আর দশটা জা’তের ভিতরে চিনিয়া লইতে পারা যায়, তাহাই তার জর্ম্মাণত্ব। আর যে সকল লক্ষণার দ্বারা ইংরেজকে এইভাবে বিশ্বের মানবসমাজের মাঝখানে চিহ্নিত করিয়া বাহির করিতে পারা যায়, তাহাই তার ইংরেজত্ব। এই ইংরেজত্ব-বস্তু ইংরেজের চেহারায়, তার গঠনে, তার বর্ণে, তার সর্ব্ববিধ সূক্ষ্ম শারীর ধর্ম্মে, তার চালচলনে, তার ভাবস্বভাবে, জীবনের সকল বিভাগে ফুটিয়া রহিয়াছে। যাঁর ভিতরে এই ইংরেজত্ববস্তু বেশি লক্ষ্য করিতে পারি, যে ইংরেজ আপনার জা’তের এই সকল স্বরূপলক্ষণেতে অবস্থান করিতেছে, কেবল তাঁহাকেই খাঁটি ইংরেজ বলা যায়। আর এই অর্থেই ষ্টেড্কে আমি অত্যন্ত খাঁটি ইংরেজ বলিতেছি।
ইংরেজত্বের শারীর লক্ষণ
আমাদের দেশের নানা জাতের নানা লোকের ভিতরে কে যে হিন্দু আর কে যে অহিন্দু ইহা যেমন তাহার চেহারাতেই অনেক সময় ধরা পড়ে, সেইরূপ বিলাতের নানা জাতের লোকের মধ্যে কে যে ইংরেজ ইহা তার চেহারা দেখিয়াই চিনিতে পারা যায়। বিলাতে ইংরেজ আছে, স্কচ্ বা স্কট্ আছে, আইরিশ আছে, ওয়েল্শ্ আছে; তাহা ছাড়া জর্ম্মাণ, রুশ, ইতালীয়, ফরাসীস্, এ সকল শ্বেতাঙ্গও বিস্তর আছে। আর কিছুদিন সে দেশে বাস করিলেই কে কোন্ জা’তের লোক ইহা তাহাদের চেহারা দেখিয়াই ঠিক করিতে পারা যায়। যেখানে পুরুষানুক্রমে অসজাতীয় বিবাহ নিবন্ধন নানা জাতের রক্তের বেশি মেশামিশি হইয়া গিয়াছে, সেখানে কে ইংরেজ, কে জর্ম্মাণ, কে আইরিশ, ইহা একেবারে ঠিক করা যায় না বটে, কিন্তু যেখানে এরূপ শোণিত-মিশ্রণ হয় নাই, সেখানে খাঁটি ইংরেজ যে কে ইহা তার চেহারাতেই ধরা পড়ে। খাঁটি ইংরেজের চেহারা ভারি ভারি ঠেকে। আইরিশের বা ইতালীয়ের চেহারা যেমন কাটা ছাঁটা, ইংরেজের চেহারা সেরূপ নয়। আইরিশ বা ইতালীয়ের প্রত্যেকটী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেরূপভাবে আপন আপন উৎকর্ষলাভের চেষ্টা করে, ইংরেজের যেন সেরূপ করে না। নাক, চোখ, ভ্রূ, কপোল, ললাট, কর্ণ, গ্রীবা, আইরিশ বা ইতালীয়ের চেহারায় এরা সকলে আপন আপন অধিকারে স্বপ্রতিষ্ঠ হইয়া, সকলে মিলিয়া, তারই ভিতর দিয়া যেন একটা সুন্দর সঙ্গত্ মিলাইবার চেষ্টা করিতেছে, এরূপই মনে হয়, ইংরেজের চেহারাতে এ ভাবটা লক্ষ্য করা যায় না। আইরিশের বা ইতালীয়ের, প্রাচীন গ্রীশীয়ের বা রোমকের চেহারা দেখিলে মনে হয় যে বিধাতাপুরুষ বুঝি আপনার কারখানায় নিবিষ্টমনে বসিয়া ভাস্কর্য্যের চর্চ্চা করিতে করিতে, অপূর্ব্ব বাটুলি দিয়া, এ চেহারাগুলি খুদিয়া বাহির করিয়াছেন। কিন্তু ইংরেজকে গড়িতে যাইয়া কোনো সূক্ষ্ম যন্ত্র ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। ইংরেজের চেহারার উপকরণগুলি বেশ বাছিয়া গুছিয়াই যে সংগৃহীত হইয়াছিল, ইহা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু শেষটা যেন, কোনো দৈব কারণবশতঃ বিধাতাপুরুষ আঙ্গুল দিয়াই সেগুলিকেই ঠাসিয়া, টিপিয়া, ইংরেজের মূর্ত্তি গড়িয়াছেন, এমনই মনে হয়। তারই জন্য ইংরেজের গঠনটা কেমন মোটা, ভারি, স্থূল। চীন-জাপের মতন ইংরেজের নাক খাঁদা নয়, আবার আইরিশ বা ইতালীয়ের মত চাঁছাছোলাও নয়, কিন্তু মোটা। ইংরেজের চক্ষু আকর্ণায়তও নহে, অথচ খুব ছোটও নহে; কিন্তু রংএ ও আকারে কতকটা মার্জ্জার চক্ষুরই মত; তার মোহিনীশক্তি অত্যন্ত কম। ইংরেজের কেশ কটা; চিবুক চওড়া; গ্রীবা বঙ্কিমও নয়, খাটও নয়, কিন্তু কতকটা মোটা। তার সমুদয় দেহগঠনই অনেকটা স্থূল। কিন্তু এই স্থূলত্বে কোনো বিশেষ কমনীয়তা ফুটিয়া উঠে না, কেবল সতেজ রক্তমাংসের একটা জীবন্ত প্রভাবই যেন অনুভূত হইয়া থাকে। এই রক্তমাংসের প্রভাবের একটা বিশেষ শব্দ ইংরেজিতে আছে, আমাদের ভাষায় আছে বলিয়া জানি না। ইংরেজিতে এ বস্তুকে এনিম্যালিজম্ (Animalism) বলে। আর খাঁটি ইংরেজ যত কেন উন্নত চরিত্রের হউন না, এই এনিম্যালিজ্ম্ বস্তুটী তাঁর চেহারাতে সর্ব্বদাই স্বল্প বিস্তর ফুটিয়া রহে। বুলডগ (Bulldog) নামে যে এক জাতীয় বিলাতী কুকুর আছে, সারমেয়-সমাজে তার চেহারা যে ছাঁচের, কুকুরজাতির ভিতরে সে চেহারার যে বিশেষত্ব আছে, মনুষ্যসমাজে ইংরেজের চেহারাও কতকটা সেই ছাঁচের।
ইংরেজত্বের মানস-লক্ষণ
ইংরেজের চেহারা স্থূল কিন্তু শক্ত, মোটা কিন্তু অনমনীয়, কোন অঙ্গই তার অপরিস্ফুট নাই, অথচ কোন অঙ্গই যেন জড়ত্বের ও ইতরজীবত্বের প্রভাবকে অতিক্রম করিয়া উঠিতে পারে নাই। যেমন ইংরেজের চেহারায় বুল ডগ্কে মনে করাইয়া দেয়, তেমনি তার প্রকৃতি ও অনেকটা এই বুল্ডগেরই মত। বুল্ডগ্ একবার কোনো শীকারের পশ্চাতে ছুটিলে সে শীকারকে কখনো ছাড়িয়া আসে না। একবার কোনো শীকারকে ধরিলে, প্রাণ যায় যাক্ তবুও তার দাঁতের কবাট আর খোলে না। ইংরেজও সেইরূপ যে লক্ষ্যকে একবার সন্ধান করে, তাহাকে কখনো লাভ না করিয়া ছাড়ে না। যাহা একবার ধরে, প্রাণান্ত হইলেও তাহাকে আর পরিত্যাগ করে না। সহজে সে কোনো বিষয়ে কাণ দেয় না। হুজুগে পড়িয়া সে আত্মহারা হয় না। কোনো বস্তুকে বুঝিতে তার সময় লাগে। কোনো লক্ষ্যকে সন্ধান করিবার পূর্ব্বে সে অনেক ভাবে-চিন্তে। তার বৈশ্যপ্রকৃতি ক্ষতি-লাভের খতিয়ান না করিয়া কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু একবার যদি কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারে, একবার যদি কোন লক্ষ্যকে সন্ধান করে, একবার যদি কোনো ব্যাপারে হাত দেয়, তবে তার শেষ পর্য্যন্ত দেখিবার চেষ্টায় ইংরেজ আর অগ্রপশ্চাৎ বা ভালমন্দ, বা ক্ষতিলাভ, কোন কিছুরই গণনা করে না। ইংরেজকে দেখিলেই, তার চেহারার ভিতরেই, একটা পশুভাবের প্রভাব লক্ষ্য হয়। তার শারীর প্রকৃতিকে অনেকটা তামসিক বলিয়াই মনে হয়, সত্য; কিন্তু তথাপি তাহার মধ্যে নিদ্রালস্য প্রভৃতি তমোধর্ম্মের লেশ মাত্র আছে বলিয়াও বোধ হয় না। ইংরেজ ব্যবসাদার, দোকান-পশারীর জাত, অথচ দোকানীপশারীর স্বভাবসুলভ কৃপণতা তাহাতে নাই। ইংরেজের বুদ্ধি অনেকটা স্থূল সন্দেহ নাই। সূক্ষ্মতত্ত্ব ধরিবার শক্তি তার কম, ইহা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। অথচ স্থূলবুদ্ধি লোকের মধ্যে যে এক প্রকারের মানসিক জড়তা প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়, ইংরেজের মধ্যে তাহা দেখা যায় না। কথাটা আপাতত স্ববিরোধী হইলেও নিরতিশয় সত্য যে জগতের অপর জাতির মধ্যে সচরাচর যাহা নিতান্ত দোষের বলিয়া গণ্য হয়, তাহাই ইংরেজের মধ্যে, ইংরেজপ্রকৃতির বিশেষত্বনিবন্ধন, তার অশেষ গুণগরিমার মূল কারণ হইয়া উঠিয়াছে।
ষ্টেডের শারীর লক্ষণ ও মনের প্রকৃতি
ইংরেজপ্রকৃতির এই সহজ ও বিশেষ ধর্ম্মগুলি ষ্টেডের মধ্যে অতি আশ্চর্য্যরূপে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। আমরা যে সকল প্রসিদ্ধ ইংরেজের চেহারা দেখিয়াছি, তার কোথাও ইংরেজের ইংরেজত্বটী এমনভাবে প্রকাশিত হইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না। গ্ল্যাডষ্টোন্ কি মর্লে, টেনিসন্ কি মরিস্, হ্যারিসন্ কি স্পেন্সার, এঁদের সকলের চেহারাতেই এমন কিছু না কিছু চাঁছা-ছোলার, কাটাকুঁদার ভাব ছিল, যে ভাব খাঁটি ইংরেজের চেহারায় নাই। খাঁটি ইংরেজের চেহারা ঢালাই জিনিষ, খোদাই জিনিষ নহে। এ চেহারা অনেকটা সাদাসিধে, অনেকটা মোটাশোটা, অনেকটা স্থূল। ষ্টেডের চেহারাও ঢালাই ছিল, খোদাই ছিল না। তাহাও অনেকটা সাদাসিধে, অনেকটা মোটাশোটা, অনেকটা স্থূল ছিল। ষ্টেড্কে দেখিয়া মনে হইত, বিধাতাপুরুষ যে বিশেষ ছাঁচে প্রথমে ইংরেজকে গড়িয়াছিলেন বহুদিন পরে বুঝি সেই ছাঁচটাকে ধুইয়া মুছিয়া, ঘষিয়া মাজিয়া, আবার যেন তাহাতেই আমাদের এ কালে স্টেড্কে ঢালাই করিয়া পাঠাইয়াছেন। ষ্টেডের মাথাটা বড় ছিল। আর সেই বড় ও সুগোল মস্তকের ঘননিবিড় কেশরাশি তাঁর ভিতরকার ভাবপ্রবণতার পরিচয় প্রদান করিত। অতিশয় ভাবপ্রবণ লোকে একটু লঘুচিত্ত, একটু চঞ্চল, একটু নিষ্ঠাহীন হইয়াই থাকে। কি আইরিশ্, কি স্পেনীয়, কি ফরাসীস্, কি ইতালীয়,—য়ুরোপের ভাবপ্রবণ লোকেরা সকলেই স্বল্পবিস্তর লঘুচিত্ত ও চঞ্চল ও নিষ্ঠাহীন বলিয়া প্রসিদ্ধ। ইংরেজের চরিত্রে এ লঘুচিত্ততা, এ চাঞ্চল্য, এ নিষ্ঠাহীনতা নাই বলিলেই হয়। স্টেডের আন্তরিক ভাবপ্রবণতার মধ্যেও এরূপ লঘুচিত্ততা বা চাঞ্চল্য বা নিষ্ঠাহীনতা ছিল না। তাঁর সুগঠিত মস্তকের নিবিড় কেশরাশি যেমন তাঁর ভাবপ্রবণতার পরিচয় দান করিত, তেমনি আবার তাঁর প্রশস্ত ললাট, উন্নত কপোল, অপেক্ষাকৃত স্থূল অধরোষ্ঠ ও আয়ত চিবুকের ভিতর দিয়া তাঁর চরিত্রের স্থৈর্য্য ও গাম্ভীর্য্য, কর্ত্তব্যনিষ্ঠা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞতার আভাই ফুটিয়া বাহির হইত। তাঁর চোখ দু’টা ছোট ছিল। কিন্তু সেই ছোট গোলকের তীব্র দৃষ্টির ভিতর দিয়া লোকচরিত্র বুঝিবার একটা অসাধারণ শক্তি এবং আপনার স্বত্বস্বার্থ রক্ষা করিবার উপযোগী একটা বণিকস্বভাবসুলভ চতুরতাও প্রকাশিত হইয়া পড়িত। ষ্টেডের মুখের দিকে চাহিলেই মনে হইত, এ লোককে ক্ষেপান যায়, কিন্তু ঠকান যায় না। এ ব্যক্তি ফলাফল প্রত্যক্ষ করিয়া, কোন অভীষ্ট-সিদ্ধির জন্য সর্ব্বনাশকে অকুতোভয়ে আলিঙ্গন করিতে পারে কিন্তু ভাল করিয়া না বুঝিয়া, আপনি কোন বিষয়ের সত্যাসত্য প্রত্যক্ষ ও প্রমাণিত না করিয়া, অন্ধ বিশ্বাসের প্রেরণায় বা কোন হুজুগের টানে, গোলে হরিবোল দিয়া, অন্ধকারে এক পা-ও চলিতে পাবে না। ষ্টেডের চেহারার ভিতর দিয়াই এ সকল যেন ফুটিয়া বাহির হইত।
ষ্টেডের বাল্যশিক্ষা
ষ্টেড্ অতি সামান্য গৃহস্থের ঘরে জন্মিয়া অতি সামান্য ভাবেই জীবন যাত্রা আরম্ভ করেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে আমরা আজিকালি উচ্চশিক্ষা বলিরা জানি, সে শিক্ষালাভের সুযোগ তাঁহার ঘটে নাই। ষ্টেড্ কোন বড় স্কুলে যান নাই। বিলাতে আমাদের দেশের মত বর্ণভেদ নাই, কিন্তু শ্রেণীভেদ আছে। বর্ণভেদে সামাজিক পদমর্য্যাদাকে একান্ত ভাবে ব্যক্তিবিশেষের জন্ম ও কুলের উপরেই প্রতিষ্ঠিত করে। শ্রেণীভেদে সামাজিক পদ-মর্য্যাদাকে অনেক পরিমাণে ধনের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকে। বর্ণভেদের উপরে যে সমাজ গঠিত, সেখানে ধনের মূল্য কখনই অতিমাত্রায় বাড়িয়া যাইতে পারে না। সেখানে ধনী ও নির্ধনের মধ্যে কোনো প্রকারের আত্যন্তিক ব্যবধানের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। অন্যদিকে শ্রেণীভেদের উপরে যে সমাজ গড়িয়া উঠে, সেখানে ধনের মূল্যটা আপনা হইতেই চড়িয়া যায়। সেখানে ধনী ও নির্ধনের মধ্যে জীবনের সকল পথেই একটা দুরতিক্রমণীয় ব্যবধানের প্রতিষ্ঠা হয়। বর্ণভেদপ্রতিষ্ঠিত সমাজে, যে বড় কুলে জন্মাইল, তার ধন থাক্ বা না থাক্, আপনার কুলোচিত বিদ্যা ও জ্ঞান তাহাকে উপার্জ্জন করিতেই হয়। সমাজও সেখানে আত্মরক্ষার জন্য আপনা হইতেই এই বিদ্যা ও জ্ঞান উপার্জ্জনের ব্যবস্থা করিয়া দেয়। কিন্তু শ্রেণীভেদপ্রতিষ্ঠিত সমাজে টাকা দিয়া বিদ্যা কিনিতে হয়। এই জন্য শ্রেণীভেদের উপরে যে সমাজের প্রতিষ্ঠা, সেখানে বিদ্যালাভ ধনীদেরই সাধ্যায়ত্ত, দরিদ্রের পক্ষে সহজ নহে। বিলাতে ইটন্ ((Eton), হ্যারো (Harrow), উইন্চেষ্টার (Winchester), রাগ্বী (Rugby) প্রভৃতি কতকগুলি প্রসিদ্ধ স্কুল আছে। দেশের বড়লোকের বালকেরাই এই সকল স্কুলে যাইতে পারে। আভিজাত্যের দাবী যাহাদের নাই, তাহাদের পক্ষে এ সকল স্কুলে যাওয়া অসম্ভব। এ সকল স্কুলের বালকেরাই অক্সফোর্ড (Oxford) ও ক্যাম্ব্রিজ্ (Cambridge) এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইয়া থাকে। অক্সফোর্ড (Oxford) ও ক্যাম্ব্রিজ্ (Cambridge) এই দুই পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার সকলেরই প্রতি উন্মুক্ত রহিয়াছে সত্য, কিন্তু এখানে বিদ্যালাভ করা এতই ব্যয়সাধ্য যে দেশের সাধারণ গরিব লোকে সে ব্যয়ভার বহন করিতে পারে না। তার উপরে এই দুইটী বিলাতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক জীবনের মধ্যে এমন একটা আভিজাত্যের অভিমান জাগিয়া আছে যে, সমাজের নিম্নশ্রেণীর বালকেরা সেখানে যাইয়া অনেক সময় “হংসমধ্যে বকো যথা”র ন্যায় বিড়ম্বিত হইয়া থাকে। ষ্টেড্ গরিব গৃহস্থের সন্তান। বিলাতী সমাজের আভিজাতশ্রেণীর সঙ্গে তাঁর পরিবারের কোন প্রকারের সম্বন্ধের গন্ধ মাত্রও ছিল না। সুতরাং কোন প্রসিদ্ধ স্কুলে বা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইয়া কোন প্রকারের উচ্চশিক্ষা লাভ করিবার সুযোগ তাঁহার ঘটে নাই। সামান্য লেখাপড়া শিখিয়া অতি অল্প বয়সেই এক আফিসের ছোক্রার বা এরেণ্ড বয়ের (Errand Boy) কর্ম্মগ্রহণ করিয়া ষ্টেড্কে জীবনযাত্রা আরম্ভ করিতে হয়।
কালেজের শিক্ষা ও কাজকর্ম্মের শিক্ষা
বিধাতার বিশ্বের যেখানেই কোন বিশেষ মন্দ জাগিয়া উঠে, সেখানে সেই মন্দেরই সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবিধায়ক ভালটাও আপনা হইতেই গড়িয়া উঠে। মানুষের প্রকৃতি কখনই চিরকাল বা দীর্ঘকাল কোন মন্দকে আশ্রয় করিয়া তিষ্ঠিতে পারে না। ব্যক্তির পক্ষে ইহা অসম্ভব, সমাজের পক্ষে ইহা অসাধ্য। যাহা অপূর্ণ তাহাই মন্দ। আর মানবপ্রকৃতি পূর্ণতার বীজ বুকে ধরিয়া ঋজুকুটিলভাবে সেই পূর্ণতার দিকেই ক্রমে ফুটিয়া উঠে। ব্যক্তিও ইহাই করিতেছে, সমাজ এই পথেই চলিতেছে। আর তারই জন্য কি ব্যক্তিগত, কি সামাজিক, মানুষের সকল প্রকারের প্রয়াস ও প্রতিষ্ঠার ভিতরেই ভালোর মধ্যেই মন্দ ও মন্দের মধ্যেই ভালো মিশিয়া রহে। এই জন্য রজতপ্রধান বিলাতীসমাজে গরিব লোকের পক্ষে উচ্চশ্রেণীর বিদ্যালয়ে কিম্বা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইয়া বিদ্যালাভ করা যেমন কঠিন, অন্যদিকে সেইরূপ এ সকল সুযোগ না পাইয়াও যত লোক সেখানে কেবল আপনার অনুশীলন ও অধ্যবসায়বলে অতি উচ্চ অঙ্গের শিক্ষালাভ করিয়া সমাজে অসাধারণ সম্ভ্রম ও প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারেন, অন্য কোন সমাজে তাহা সম্ভব হয় না। কি ব্যবসা-বাণিজ্যে কি রাষ্ট্রীয় কার্য্যে কিম্বা নূতন তত্ত্বের আবিষ্কারে বিলাতে যাঁহারা সমাজে অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেন, তাঁহাদের সকলে বা অনেকেই যে অক্সফোর্ড, বা ক্যাম্ব্রিজের লোক, এমন নহে। ইংরেজের বিশাল বাণিজ্য যাঁহারা গড়িয়া তুলিয়াছেন, বোধ হয় তাঁহাদের একজনেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। ইংরেজজাতির ক্ষাত্ত্রবীর্য্য যে সকল মহাবীরকে আশ্রয় করিয়া ব্রিটিশসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, তাঁহাদের মধ্যে ক’জনের সঙ্গেই বা অক্সফোর্ড, বা ক্যাম্ব্রিজের কোন সম্পর্ক ছিল? বারুণীর অঙ্কে বর্দ্ধিত ইংরেজের নৌ-বিলাস হইতেই ইংলণ্ডের বিশ্ববিজয়িনী নৌশক্তির অভ্যুদয় হইয়াছে, অক্সফোর্ড বা ক্যাম্ব্রিজের শিক্ষা হইতে হয় নাই। ফলতঃ সকলে অক্সফোর্ড বা ক্যাম্ব্রিজে যাইতে পারে না বলিয়াই ইংরেজসমাজের এত লোক বাল্যে কোন শিক্ষা না পাইয়াও শুদ্ধ আপনাদের অদম্য অধ্যবসায়বলে পরজীবনে সমাজের শ্রেষ্ঠজনের সমকক্ষ হইয়া উঠিতে পারে। এই অদম্য অধ্যবসায় ইংরেজচরিত্রের একটা বিশেষ লক্ষণ।
ষ্টেডের অধ্যবসায় ও কৃতিত্ব
এই অধ্যবসায় গুণেই ষ্টেড্ও অতি সামান্য গৃহস্থের ঘরে জন্মিয়া, শৈশবে উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষালাভের কোনো সুযোগ না পাইয়াও, পরজীবনে কেবল আপনার দেশে নহে, কিন্তু সমগ্র সভ্যসমাজে এতটা প্রসিদ্ধি লাভ করিতে পারিয়াছিলেন। একদিন যে সামান্য হরকরার কাজে নিযুক্ত হইয়া লণ্ডনের রাজপথে চিঠি হাতে করিয়া ছুটোছুটি করিত, পরে এমন এক দিন আসিল, যখন রুসিয়ার জার (Czar) ও জর্ম্মণীর ক্যায়সার (Kaiser), তুরস্কের সুলতান ও ইংলণ্ডের সম্রাট, নিয়ম-তন্ত্রাধীন রাজমন্ত্রী ও প্রজাতন্ত্রাধীন প্রেসিডেণ্ট, সমাজসংস্কারক ও ধর্ম্মপ্রচারক, তাঁহারই পরামর্শপ্রার্থী হইয়াছিলেন। অথচ ষ্টেড্ কখনো সাক্ষাৎভাবে কোন রাষ্ট্রীয় কর্ম্মভার গ্রহণ করেন নাই। ব্রিটিশ পার্লেমেণ্টে প্রবেশ করা তাঁহার পক্ষে অসাধ্য ছিল না। তাঁহার অপেক্ষা অনেক নীচুদবের ইংরেজও পার্লেমেণ্টে যাইয়া ক্রমে মন্ত্রীদলে পর্য্যন্ত ঢুকিয়াছেন। ইচ্ছা করিলে ষ্টেড্ও তাহা পারিতেন। কিন্তু এ চেষ্টা তিনি কখনো করেন নাই। একবার কেবল তিনদিনের জন্য পার্লেমেণ্টে যাইবার তাঁর সাধ হইয়াছিল,— আমাকে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন। তখন আইরিস্ লোকনায়ক পার্ণেল জীবিত ছিলেন। সে সময়ে কি একটা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অহিতাচারের তীব্র প্রতিবাদ করা আবশ্যক হয়। ষ্টেড্ পার্ণেলকে তখন একটা আইরিস কনষ্টিটুয়েন্সী (Constituency) জোগাড় করিয়া তিন-চা’র দিনের জন্য তাঁহাকে পার্লেমেণ্টের সভা করিয়া দিতে বলেন। পার্লেমেণ্টে দাঁড়াইয়া এই অহিতাচারের প্রতিবাদ করিয়া একটী মাত্র বক্তৃতা দিয়াই তিনি তাঁর পদ প্রত্যাখ্যান করিয়া যার স্থান তাহাকে দিতে রাজি হন। যাহা হউক ষ্টেডের এই ক্ষণিক সাধও পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু পার্লেমেণ্টের সভ্য না হইয়াও ব্রিটিশসাম্রাজ্যনীতির বিকাশসাধনে ষ্টেড্ যতটা সাহায্য করিয়াছেন, গ্ল্যাডস্টোন প্রভৃতি অতি অল্পসংখ্যক ব্রিটিশ ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যতীত আর কেহ ততটা সাহায্য করিয়াছেন কি না, সন্দেহের কথা।
আর ষ্টেডের এই অসাধারণ কৃতিত্বের পশ্চাতে তাঁর সাচ্চা ইংরেজপ্রকৃতিটীই দেখিতে পাওয়া যায়। ষ্টেডের বুদ্ধি যে নিরতিশর সূক্ষ্ম ছিল, তাহা নহে। ইংরেজের স্বাভাবিকী বুদ্ধি একটু মোটা। তাহা ভারে কাটে কিন্তু ধারে কাটে না। কোনো সূক্ষ্ম তত্ত্বে বা জটিল বিষয়ে ইংরেজের বুদ্ধি সহজে প্রবেশ করিতে পারে না। কোনো জটিল সমস্যার জটিলতা প্রত্যক্ষ করিতে পারিলে, একটা সম্যক্দর্শন ফুটিয়া উঠে। ইংরেজবুদ্ধির এ সম্যক্ দৃষ্টি নাই। যে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ব্যবসায়ীর লাভালাভ জানিবার জন্য অত্যাবশ্যক, ততটুকু দূরদর্শিতা ইংরেজের বুদ্ধিরও আছে। কিন্তু যে সম্যক্দৃষ্টি তত্ত্বদর্শীর লক্ষণ, ইংরেজের সে সম্যক্দৃষ্টি নাই। আর সেরূপ সম্যক্দৃষ্টি নাই বলিয়াই ইংরেজের একটা অসাধারণ ‘গোঁ’ আছে। এই গোঁয়ের জোরেই ইংরেজ দুনিয়া জয় করিয়াছে। আর এই গোঁয়ের জোরেই ষ্টেডও অসাধারণ বিদ্যার বল, অথবা বিপুল ধনের বল, কিম্বা উচ্চ আভিজাত্যের বল ব্যতীতও আজীবন ইংরেজসমাজে রাজা প্রজা, ইতর ও ভদ্র, সকলের উপরে এতটা আধিপত্য ভোগ করিয়া গিয়াছেন।
Maiden Tribute
ষ্টেডের প্রথম প্রতিষ্ঠা “পেল্ মেল গেজেট” (Pall Mall Gazette) নামক পত্রিকার। সে আজ প্রায় আটাশ বৎসরের কথা। ইংলণ্ডের সংবাদপত্রের পাঠকদিগের নিকটে ষ্টেড্ তার পূর্ব্ব হইতেই সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু যে দিন “Maiden Tribute of Modern Babylon” নামক প্রবন্ধাবলী পেল্ মেল্ গেজেটে প্রকাশিত হইতে আরম্ভ করিল, সে দিন সমগ্র সভ্যজগতের চক্ষু ষ্টেডের উপরে যাইয়া পড়িল। সেদিন ইংরেজ বুঝিল যে বহুদিন পরে একজন মানুষের মত মানুষ দেশে জন্মিয়াছে। সে দিন দুনিয়া দেখিল যে ইংরেজের বিপুল ধনরাশি, তাহার প্রচণ্ড ভোগবিলাস, তাহার সখ ও সৌখিনতা এ সকলের পশ্চাতেও একটা সাচ্চা মনুষ্যত্ব বস্তু জাগিয়া আছে। সে দিন ইংরেজ সমাজের সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র য়ুরোপীয় সমাজেও একটা সাড়া পড়িয়া গেল। লণ্ডন সহরে সে সময়ে একদল বড়লোক গরিব পিতামাতাকে টাকা দিয়া বশ করিয়া তাহাদের উদ্ভিন্নযৌবনা অপ্রাপ্তবয়স্কা বালিকাগণের সর্ব্বনাশ করিতেছিল। এই পাপে ইংরেজ আভিজাতসমাজ নীরয়গামী হইতেছিল। প্রাচীন বেবিলনে, আমাদের দেশের কোনো কোনো তান্ত্রিক সাধনের ন্যায়, ধর্ম্মের নামে, অক্ষতযোনী কুমারীগণের সতীত্ব নাশ করা হইত, এরূপ কিম্বদন্তী আছে। এই কিম্বদন্তী স্মরণ করিয়াই ষ্টেড্ লণ্ডন সহরকে মডার্ণ বেবিলন (Modern Babylon) নামে অভিহিত করেন। আর বেবিলনের পুরাতন গর্হিতাচার মনে করিয়াই কুমারী বলি বা Maiden Tribute বলিয়া লণ্ডনের ধনীলোকদিগের এই আধুনিক পশুবৃত্তির ব্যাখ্যান করেন। বিলাতের অতিবড় সম্ভ্রান্ত লোকেরাও এই পাপে লিপ্ত ছিলেন। মাতৃরূপিণী রমণীর শ্রেষ্ঠতম বস্তু যে এরূপভাবে বেচা কেনা হয়, ষ্টেড্ ইহা সহ্য করিতে পারিলেন না। এ দুরাচারের প্রতিরোধ ও প্রতিবিধান করিবার জন্য আপনার সর্ব্বস্ব পণ করিয়া দাঁড়াইলেন। কেবল লোকের মুখের কথার উপরে নির্ভর করিয়া সমাজের সম্ভ্রান্ত লোকের বিরুদ্ধে অত বড় অভিযোগ আনা সঙ্গত নহে ভাবিয়া, তিনি স্বয়ং ইহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সংগ্রহে নিযুক্ত হইলেন। আপনি একজন লম্পট সাজিয়া, যাহারা এই গর্হিত ব্যবসারে নিযুক্ত ছিল, তেমন লোকের দ্বারা একটী উদ্ভিন্নযৌবনা বালিকার মাতাকে উপযুক্ত অর্থ দিয়া, তার কন্যাকে সংগ্রহ করিলেন। বিলাতী আইনে সে সময়ে ষোড়শ বর্ষই বালিকাগণের নিম্নতম “সম্মতির” বয়স বলিয়া নির্দ্ধারিত ছিল। এই বালিকার বয়স যে ষোড়শ বর্ষের ন্যূন ইহা সত্য সতা ডাক্তার দিয়া পরীক্ষা করিয়া লইলেন। যখন এতটা প্রমাণ স্বয়ং সংগ্রহ করিলেন, ব্যাপারটা যে সত্য সে বিষয়ে যখন আর তিলপরিমাণ সন্দেহের অবসর রহিল না, তখন ইহার কথা সাধারণ্যে প্রচার করিয়া Maiden Tribute শীর্ষক প্রবন্ধগুলি পত্রস্থ করিলেন। এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবা মাত্র, চারিদিকে তুমুল আন্দোলন জাগিয়া উঠিল। ধনীদল আপনাদের কলঙ্ক রটনায়, ক্রোধে, ভয়ে, লোকলজ্জায় অস্থির হইয়া পড়িলেন। ইংরেজ জনসাধারণে দারিদ্র্যের অবমাননার কথা পড়িয়া ক্ষেপিয়া উঠিল। সভ্যজগতের লোকে ইংরেজের নামে ধিক্কার দিতে লাগিল। Maiden Tribute লেখার জন্য ষ্টেড্কে রাজদ্বারে দণ্ডিত করা অসম্ভব দেখিয়া, তাঁর শত্রুগণ ষ্টেড্ আপনি যে একটী অপ্রাপ্তবয়স্কা কুমারীকে ডাক্তার দিয়া পরীক্ষা করাইরা, আপনার প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সেই সূত্রেই, ষ্টেড্ অপ্রাপ্তবয়স্কা কুমারীর সম্ভ্রম নষ্ট করিয়াছেন বলিয়া তাঁহার নামে নালিশ রজু করাইলেন। অপ্রাপ্তবয়স্কা বালিকার সহবাসের চেষ্টা করিয়াছেন বলিয়া ষ্টেড্ রাজদ্বারে অভিযুক্ত হইলেন। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হইয়া তাঁর কারাদণ্ড হইল। কিন্তু এ জন্য ষ্টেডের দুঃখ হইল না। এ দণ্ড তাঁর নিন্দার হেতু না হইয়া শ্লাঘার কারণই হইল। কারাবাস তাঁর অপমানের বিষয় না হইয়া অশেষ গৌরবের বিষয় হইয়া উঠিল। আমরণ পর্য্যন্ত ষ্টেড্ যে তারিখে তাঁর কারাদণ্ড হইয়াছিল, প্রতি বৎসর সেই দিন সেই পুরাতন কয়েদীর পোষাক পরিধান করিয়া, সেই ত্যাগযজ্ঞের সাম্বৎসরিক উৎসব করিতেন। স্টেডের জেল হইল বটে, কিন্তু যে গোপনীয় অত্যাচারের কথা লোকমণ্ডলী মধ্যে প্রচার করিয়া তিনি এ দণ্ডভোগ করেন, সে অহিতাচারেরও প্রতিবিধান হইল। Maiden Tribute শীর্ষক প্রবন্ধাবলীর প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ বিলাতের প্রাচীন দণ্ডবিধিতে অষ্টাদশ বর্ষের ন্যূনবয়স্কা যুবতীগণের সহবাসকে দণ্ডনীয় করিয়া, নূতন বিধান সন্নিবিষ্ট হইল। এই বিধান অনুসারে অবিবাহিতা স্ত্রীলোকের “সম্মতির” বয়স অষ্টাদশবর্ষ নির্দ্ধারিত হইল। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের ক্রিমিন্যাল এমেণ্ডমেণ্ট অ্যাক্ট (Criminal Amendment Act) ইংরেজের সমাজ-জীবনের ইতিহাসে, ষ্টেডের অক্ষয় কীর্ত্তি বলিয়া চিরদিন ঘোষিত হইবে।
বিলাতী সংবাদপত্র সম্পাদনে ষ্টেডের বিশেষত্ব
সাময়িক পত্রের লেখক ও সম্পাদক বলিয়াই ষ্টেড্ আধুনিক সভ্যজগতে এতটা প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। আধুনিক সময়ে সাময়িক সংবাদপত্রের প্রভাব অত্যন্ত বেশী সন্দেহ নাই। কিন্তু সাময়িক পত্রের প্রভাব যত, এই সকল পত্রের লেখকদিগের প্রতিষ্ঠা তার শতাংশের এক অংশও হয় না। ফলতঃ এ সকল পত্রে কে লেখে বা না লেখে, সাধারণ লোকে তার খবরাখবর রাখে না। বিলাতী সাময়িক পত্র সকল দল বিশেষের মুখপত্র হইয়াই থাকে। যে পত্রিকা যে দলের মুখপত্র, তাহাতে সেই দলের মতামত ও রীতিনীতিরই পোষকতা করা হয়। এই সকল রচনার ভিতর দিয়া লেখকগণের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়া উঠিবার অবসর পায় না। লেখকেরা পয়সা খাইয়া লেখেন। যাঁহাদের বেতনভোগী হইয়া ইহাঁরা প্রবন্ধাদি রচনা করেন, তাঁহাদের মতামতই ইহাঁদিগকে ব্যক্ত করিতে হয়। নিজেদের বিচারবুদ্ধির অনুযায়ী কোনো কিছু লিখিবার অধিকার ইহাঁদের প্রায়ই থাকে না। কখনো কখনো নিজেদের যাহা মত নয়, এমন বিষয়ও ইহাঁদিগকে লিখিতে হয়। এরূপ ব্যবসাদারী সাহিত্যচর্চ্চায় ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হইলেও মনোবৃত্তির স্ফূরণ কিম্বা মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভব হয় না। বিলাতের ধনিলোকেরা এবং রাজ-নৈতিক সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ বহুকাল ধরিয়া সংবাদপত্রের সম্পাদক ও লেখকগণের মনুষ্যত্বকে এইরূপভাবে চাপিয়া রাখিয়া ও পিষিয়া মারিতেছিলেন। ষ্টেড্ই সর্ব্বপ্রথমে এই নিষ্ঠুর দাসত্বের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়া সংবাদপত্রের সম্পাদকের ও সাময়িক পত্রের লেখকগণের আত্মসম্মানবোধকে জাগাইয়া তোলেন। পঁচিশ ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে বেনামী লেখাই বিলাতী সংবাদপত্রের সাধারণ রীতি ছিল। ষ্টেড্ই সর্ব্বপ্রথমে নিজের নাম দিয়া সংবাদপত্রে লিখিতে আরম্ভ করেন। আজিকালি তাঁহারই পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া বিলাতের প্রসিদ্ধ সাময়িক পত্রের লেখকগণ নিজের নাম দিয়া প্রবন্ধাদি লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন। পূর্ব্বকার বেনামী লেখাতে সংবাদপত্রবিশেষেরই প্রতিষ্ঠা হইত, দলবিশেষেরই প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বাড়িয়া যাইত; জনগণের চিন্তা ও চরিত্রের কিম্বা রাষ্ট্রের কর্ম্ম ও নীতি সম্বন্ধে লোকমত সংগ্রহকারী সাময়িক পত্রের লেখকগণের ব্যক্তিত্বের ও বিদ্যাবুদ্ধির কোনো প্রকারের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হইত না। ষ্টেড্ এ সকলকে বদ্লাইয়া গিয়াছেন। সাময়িক পত্রের লেখকগণ যে রাষ্ট্রীয় জীবনগঠনে কতটা সহায়তা করেন, প্রতিভাশালী সংবাদপত্রের সম্পাদকের পদগৌরব ও শক্তিসাধ্য যে কোনো রাজমন্ত্রী বা রাষ্ট্রমন্ত্রী অপেক্ষা কম নহে, কিন্তু কোনো কোনো স্থলে অনেক বেশী; লোকে পূর্ব্বে ইহা কখনো অনুভব করে নাই। ষ্টেড্কে দেখিয়া তারা এখন ইহা বুঝিয়াছে। ষ্টেড্ সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাময়িক পত্রের লেখক ছিলেন। কিন্তু কি স্বরাষ্ট্রের কিম্বা পররাষ্ট্রের বিশেষ বিশেষ নীতি নির্দ্ধারণে তিনি যে পরিমাণে সাহায্য করিয়াছেন, অনেক রাষ্ট্রমন্ত্রী তাহা করিতে পারেন নাই। ইংরেজের নৌ-নীতি আজ যে রীতির অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে, তাহা বহুল পরিমাণে স্টেডেরই উদ্ভাবিত। জর্ম্মণী প্রভৃতি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রশক্তির নৌবলের তুলনায় ইংরেজের নৌশক্তিকে কি পরিমাণে বাড়াইতে হইবে, তাহার মূলমন্ত্রটী স্টেডের দ্বারাই উদ্ভাবিত হয়। ষ্টেড্ই প্রথমে এ কথা বলিয়াছিলেন যে, অপরে যখন এক খানা বুদ্ধজাহাজ নির্ম্মাণ করিবে, ইংলণ্ডকে তখন দু’খানা নির্ম্মাণ করিতে হইবে। আজ উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল উভয় দলের রাষ্ট্রনৈতিকেরা এক বাক্যে এই আদর্শ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন। আজিকালি য়ুরোপের সর্ব্বত্র শালিশীর দ্বারা যে রাষ্ট্রীয় বিরোধের নিষ্পত্তির চেষ্টা হইতেছে, ষ্টেড্ তাহারও সূত্রপাত করেন। কতিপয় বৎসর পূর্ব্বে হেগ্ (Hague) নগরীতে সভ্যজগতের ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ মিলিয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের শান্তি হইয়া পরস্পরের বিবাদ যাহাতে আপোষে মিটিতে পারে, তাহার বিচার আলোচনা করিয়াছিলেন। ষ্টেড্ সেই শান্তিসমিতি বা ‘Peace Conference’ এরও প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তাঁহার চেষ্টা ও অধ্যবসায় ব্যতীত এই অনুষ্ঠান যে কখনই সম্ভব হইত না, ইহা সকলেই এখন একবাক্যে স্বীকার করিতেছেন। স্টেডের ধনবল ছিল না। ষ্টেড্ কোনো রাষ্ট্রনৈতিকদলের নেতা ছিলেন না। তাঁর লোকবলও ছিল না। তাঁর অসাধারণ ধীশক্তি কিম্বা অলোকসামান্য প্রতিভাও ছিল না। তাঁর ছিল কেবল অদমনীয় অধ্যবসায়, অকপট সত্যানুরাগ ও ধর্ম্মানুরাগ, অসাধারণ আত্মনির্ভর এবং নিঃস্বার্থ স্বদেশপ্রেম ও লোকহিতৈষা। ষ্টেড্ বালকের ন্যায় সরল ছিলেন, স্ত্রীলোকের ন্যায় কোমলহৃদয় ও স্নেহপ্রবণ ছিলেন, সিংহের ন্যায় সাহসী ছিলেন ও পর্ব্বতের ন্যায় অটল ছিলেন। আর তাঁহার মধ্যে এ সকল গুণের সমাবেশ ছিল বলিয়াই, সামান্য সাময়িক পত্রের সম্পাদক ও লেখক হইয়াও তিনি সাময়িক ইতিহাসে এরূপ অক্ষয় কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন। সংবাদপত্র-পরিচালকগণ দুই পথ ধরিয়া প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন। এক পথে যাইয়া, সর্ব্বদা লোকমতের অনুসরণ করিয়া, জনসাধারণে যখন যে ভাবে ক্ষেপিয়া উঠে সেই ভাবেতে ইন্ধন জোগাইয়া তাঁহারা সহজেই লোকের অনুরাগভাজন হইতে পারেন। আর এক পথে যাইয়া, জনসাধারণের কি ভাল লাগিবে সে দিকে দৃক্পাত না করিয়া, কিসে তাহাদের ভাল হইবে, তারই অনুধ্যান করিয়া তাহাদিগকে প্রেয়ের পথে নয়, কিন্তু শ্রেয়ের পথে পরিচালিত করিবার চেষ্টা করিতে পারেন। প্রথম পথের পথিক লোকমতের অনুসরণ করিয়া অনুগত ভৃত্যের ন্যায় জনসাধারণের সেবা করেন। এ পথ সহজ। এই পথে অনায়াসে বা অতি স্বল্পায়াসেই সংবাদপত্র-পরিচালক আপনার পশার বৃদ্ধি করিতে পারেন। এ পথ ব্যবসাদারের পথ। বিলাতের প্রতিপত্তিশালী সংবাদপত্রের ও সাময়িক পত্রের প্রায় সকলগুলিই এই পথের পথিক। লোকমতের হাওয়া যখন যে বিষয়ে যে দিকে প্রবলবেগে ছুটিতে আরম্ভ করে, তখন ইঁহারা সেই দিকেই আপনাদের লেখনী চালনা করিয়া থাকেন। দেশের প্রবল রাষ্ট্রীয় দলের প্রত্যেকেরই দু’ এক খানা মুখপত্র আছে। এই সকল সংবাদপত্র নিজ নিজ দলের নেতৃবর্গের মুখাপেক্ষী হইয়া চলে। এক সময়ে বিলাতে রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক, লিবারেল ও কন্সারভেটিভ (Liberal ও Conservative) এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কোনোটারই একান্ত অনুগত নয়, এমন সংবাদপত্র ছিল না। তখন যারা সংবাদপত্র কিনিতেন ও পড়িতেন, তাঁরা সকলেই হয় কন্সারভেটিভ না হয় লিবারেল্ এই দুই দলের একদল ভুক্ত হইতেন। আর এই দুই দলের মধ্যে এতটা রেশারেশি ছিল যে একদলের লোকে অপর দলের পৃষ্ঠপোষক সংবাদপত্র স্পর্শ পর্য্যন্ত করিতেন না। সাময়িক পত্রের পাঠক সংখ্যাও তখন অল্প ছিল। ক্রমেই এ সকল অবস্থার ঘোরতর পরিবর্ত্তন ঘটিতেছে। সাময়িক পত্রের পাঠকসংখ্যা পূর্ব্বাপেক্ষা এখন অনেক গুণে বেশী হইরাছে। আগেকার দলাদলির ভাবটাও ক্রমে কমিয়াছে। কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয়দলভুক্ত নহে, সাময়িক পত্রের এরূপ অনেক পাঠক এখন জুটিয়াছে। এ সকল লোকই পার্লেমেণ্টে সভ্যনির্ব্বাচন সময়ে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীদলের ভাগ্যবিধাতা হইয়া থাকে। যখন যে দলের দিকে ইহারা ঝুঁকিয়া পড়ে, তখন সেই দলেরই জিত হয়। আর আজিকালি বিলাতে এই সকল লোকই ব্যবসাদারী সাময়িক পত্র সকলের প্রভু হইয়া বসিয়াছে। সুচতুর ব্যবসায়ী যেমন বাজারের মতি গতি লক্ষ্য করিয়া আপনার পণ্য সংগ্রহ করে ও দোকানপাট সাজায়, গ্রাহকের মন জোগাইয়া পয়সা উপার্জ্জন করা ছাড়া আর কোনো উচ্চতর লক্ষ্য যেমন তার থাকে না, সেইরূপ এই সকল সংবাদপত্র-পরিচালক ও লোকমত কোন্ দিকে চলিতেছে তাহাই লক্ষ্য করিয়া দেখেন এবং সেই মতের পোষকতা করিয়াই আপনাদের মতামত ব্যক্ত করেন। কোনো বিষয়ের সত্যাসত্য, ভালমন্দ বা ধম্মাধর্ম্মের বিচার তাঁহাদের কর্ত্তব্যসীমার বাহিরে পড়িয়া রহে। এই সকল সংবাদপত্র-পরিচালক জনমণ্ডলীর আসন্ন পরিচারক রূপে তাহাদের মর্জ্জি জোগাইয়াই দু’ পয়সা উপার্জ্জন করেন; লোকের ইষ্টানিষ্ট ও দেশের ভালমন্দের প্রতি ইহাদের দৃষ্টি নাই। বিলাতের অধিকাংশ সাময়িক পত্রই এখন এই পথ ধরিয়া চলিতেছে। ডে’লি মে’ল (Daily Mail) জাতীয় সংবাদ পত্র এই পথ ধরিয়া চলিয়াই দেশটা লুটিয়া খাইতেছে। কিন্তু ইহাই সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র পরিচালনার শ্রেষ্ঠতম আদর্শ নহে। ভালমন্দ বিচার না করিয়া লোকমতের অনুসরণ করাই সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের ব্যবসায় বা কর্ত্তব্য নহে। সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের সম্পাদক ও লেখক জনমণ্ডলীর পরিচারক হইবেন না, কিন্তু পরিচালকই হইবেন; অনুগত ভৃত্য হইবেন না, কিন্তু তাহাদের শক্তিশালী গুরু হইয়া, তাহাদিগকে প্রেয়ের পথ হইতে প্রতিনিবৃত্ত করিয়া শ্রেয়ের পথে লইয়া যাইবেন। ইহাই সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের সত্য লক্ষ্য। আর আধুনিক বিলাতী সমাজে যে অত্যল্পসংখ্যক সাময়িক পত্রের সম্পাদক ও লেখক এই লক্ষ্যের অনুসরণ করিয়া চলিতে চেষ্টা করিয়াছেন, ষ্টেড্ তাঁহাদের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান ছিলেন। যে কালে ষ্টেড্ এই আদর্শ ধরিয়া চলিতে আরম্ভ করেন, সে কালে বিলাতী সংবাদপত্র-সম্পাদক ও লেখকবর্গের ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা বলিয়া কোনো বস্তু ছিল না। যে পেল্ মেল্ গেজেটকে আশ্রয় করিয়া ষ্টেড্ বিলাতের সাময়িক সাহিত্যে অসাধারণ প্রসিদ্ধি লাভ করেন, সেই পেল্ মেল্ গেজেটের সঙ্গেও বেশী দিন একসঙ্গে কাজ করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল। ষ্টেড্ “পেল্ মেল্” পরিত্যাগ করিলেন। যে আদর্শের অনুসরণ করিতে যাইয়া তাঁহাকে পেল্ মেল্ ছাড়িয়া দিতে হয়, অন্য কোনো সংবাদপত্রের বেতনভোগী সম্পাদক বা লেখকরূপে সেই আদর্শের অনুসরণ করা সম্ভব ছিল না। আপনার জীবনের লক্ষ্য সাধনের জন্য ষ্টেড্কে তখন আপনার সত্ত্বাধীনে একখানি সাময়িক পত্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন করিতে হয়। এইরূপেই তাঁহার বিশ্ববিশ্রুত রিভিউ অব্ রিভিউজের (Review of Reviews) উৎপত্তি হয়। আপনি এই পত্রের সত্ত্বাধিকারী ও আপনি ইহার সম্পাদক ও পরিচালক হইয়া ষ্টেড্ বিগত বাইশ বৎসর কাল আধুনিক সভ্যসমাজে আপনার পবিত্র লোকশিক্ষাব্রতের উদ্যাপন করিয়া গিয়াছেন।
“রিভিউ অব্-রিভিউজ্”
যে অকপটে যে আদর্শের অনুসরণ করিতে চেষ্টা করে, বিধাতা পুরুষ স্বয়ং তাহাকে সেই আদর্শ লাভের উপযোগী বিচারবুদ্ধি ও শক্তি সাধ্য দান করিয়া থাকেন। ষ্টেডের যে অসাধারণ বুদ্ধি কিম্বা অলোকসামান্য দূরদৃষ্টি ছিল, এমন বলা যায় না। কতটা পরিমাণে যে রিভিউ অব রিভিউজ্ (Review of Reviews) তাঁহার লোকশিক্ষাব্রত উদ্যাপনে সাহায্য করিবে, প্রথম হইতেই যে তিনি এটা বুঝিয়াছিলেন এমনও বোধ হয় না। আজি কালিকার দিনে লোকে নিজ নিজ বিষয়-কর্ম্ম লইয়া এতই ব্যাপৃত হইয়া পড়ে যে বড় বড় মাসিক পত্রে যে সকল গভীর বিষয়ের আলোচনা হয়, সে সকল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়িবার সময় ও শক্তি তাহাদের থাকে না বলিলেই হয়। অথচ দুনিয়ার চিন্তাস্রোত কোন্ ভাবে কোন্ দিকে চলিতেছে এই সকল মাসিকপত্র না পড়িলে তাহার সন্ধান রাখাও অসম্ভব হইয়া পড়ে। এই সকল প্রবন্ধের সংক্ষিপ্তসার সংগ্রহ করিয়া কর্ম্মব্যস্ত জনগণের হস্তে অর্পণ করিবার জন্যই রিভিউ অব রিভিউজের জন্ম হয়। ইহা অপেক্ষা কোনো উচ্চতর লক্ষ্য যে ষ্টেড্ তখন প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন এমন মনে হয় না। আর প্রত্যক্ষ করেন নাই বলিয়াই তাঁহার এই অনুষ্ঠানের অন্তরালে আমরা এখন বিধাতাপুরুষেরই হস্ত দেখিতেছি। ষ্টেড নিজের একখানা দৈনিক সংবাদপত্র না হউক, অন্ততঃ উচ্চ অঙ্গের সাপ্তাহিক বা মাসিক ইংরেজী পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিতেন। কেন যে তিনি সে পথে যান নাই জানি না। কিন্তু ইহা জানি যে তিনি রিভিউ অব রিভিউজের সাহায্যে সমগ্র সভ্যজগতের চিন্তা ও কর্ম্মের উপরে যতটা প্রভাব লাভ করিয়াছিলেন, কোনো সাপ্তাহিক বা মাসিক ইংরেজী পত্রিকার সাহায্যে তাহা কদাপি লাভ করিতে পারিতেন না। রিভিউ অব্ রিভিউজ ইংরেজীতেই লেখা হয় সত্য, আর লণ্ডনেতেই ছাপা হইত। কিন্তু এ সত্ত্বেও ইহাকে কখনই কেবল ইংরেজের কাগজ বলা যাইতে পারিত না। য়ুরোপের সর্ব্বত্র যে সকল কর্ম্মী ও মনীষিগণের হস্তে আধুনিক জগতের ভাগ্যসূত্র রহিয়াছে, রিভিউ অব রিভিউজ তাহাদের সকলেরই শ্রদ্ধার ও আদরের বস্তু ছিল। রাজপ্রাসাদে রাজা, মন্ত্রভবনে রাজমন্ত্রিগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, সেনাশিবিরে সেনানায়ক, সংবাদপত্রের আপিসে সম্পাদক, ধর্ম্মমন্দিরে ধর্ম্মযাজক, নাট্যশালায় নটনায়ক, আধুনিক সভ্যজগতের সর্ব্বত্র যাঁহারা জনগণের চিন্তাস্রোত ও কর্ম্মস্রোতকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করিতেছেন, তাঁহাদের সকলের সঙ্গেই রিভিউ অব রিভিউজের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। ইহাঁরা সকলেই নিবিষ্ট চিত্তে, শ্রদ্ধাসহকারে রিভিউ অব রিভিউজ পাঠ করিতেন। বিলাতের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রনায়ক ব্যালফোর (Balfour) একবার বলিয়াছিলেন যে তিনি কখনও সংবাদপত্র পাঠ করেন না, কিন্তু তিনিও রিভিউ অব রিভিউজের হস্ত হইতে অব্যাহতি পান নাই। রিভিউ অব রিভিউজ কেবল যে অপর পত্র হইতে প্রবন্ধ সার সংগ্রহ করিয়াই আপনার কলেবর পূর্ণ করিত তাহাও নহে। প্রতি মাসে সভ্যজগতের যেখানেই যে কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটুক না কেন, ষ্টেড্ তাহারই উপরে আপনার মন্তব্য প্রকাশ করিয়া একদিকে জগতের দৈনন্দিন ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিতেন, অন্যদিকে দুনিয়ার লোকমত গঠনের সাহায্য করিবার চেষ্টা করিতেন। রিভিউ অব রিভিউজের চরিত্র-চিত্রগুলি আধুনিক সভ্য জগতের গত ত্রিশ বৎসরের ইতিহাসের প্রাণ বস্তুকে ভবিষ্যতের জন্য মূর্ত্তিমন্ত করিয়া রাখিয়াছে।
ষ্টেডের বিচার প্রণালী
গত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে আধুনিক সভ্য জগতের কোনো দেশে এমন কোনো শক্তিশালী লোকনায়কের অভ্যুদয় হয় নাই, যাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ ভাবে ষ্টেডের স্বল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠ আলাপ পরিচয় ছিল না। তিনি কেবল যে জগতের দৈনন্দিন ঘটনা গুলিই জানিতেন তাহা নহে, কিন্তু এই সকল ঘটনার অন্তরালে যে ব্যক্তিগত চরিত্র লুকাইয়া থাকে, নখদর্পণের ন্যায় সর্ব্বদা তাহাও প্রত্যক্ষ করিতেন। সুতরাং ষ্টেড্ কখনই কেবল বাহিরের কার্য্যাকার্য্যের দ্বারা কোনো বিষয়ের ভালমন্দের বিচার করিতেন না। কিন্তু এই সকল কার্য্যাকার্য্যের ভিতরে যে মানুষের প্রাণ, মানুষের বুদ্ধি, মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষা, মানুষের শক্তি ও সংযম, মানুষের লক্ষ্য ও অভীষ্ট জড়াইয়া থাকে, তাহারই দ্বারা এ সকলের বিচার করিতেন। আর এই জন্য প্রত্যেক দেশের কর্ম্মিগণ একদিকে যেমন তাঁহার মন্তব্যের নিগূঢ় মর্ম্ম বুঝিতে পারিয়া শ্রদ্ধাভরে তাঁহার কথা শুনিতেন, অন্যদিকে সেইরূপ কেবল বাহির হইতে যাহারা সকল বিষয়ের বিচার আলোচনা করেন, তাহারা অনেক সময়ে ষ্টেডের বুদ্ধির স্থিরতা ও তাঁহার মতামতের মধ্যে কোনো প্রকারের সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য নাই বলিয়া প্রায়ই তাঁহার মন্তব্যকে উপেক্ষা করিতেও চেষ্টা করিতেন। যে মানুষ নিজের নিকটে সর্ব্বদা খাঁটী হইতে চাহে, লোকচক্ষে তাঁহার বুদ্ধির স্থিরতা প্রমাণিত করা অসম্ভব। মানুষ সর্ব্বজ্ঞ নহে। সত্যের সকল দিকটা সর্ব্বদা একই সঙ্গে তাহার চক্ষুগোচর হয় না। আমাদের সকল সিদ্ধান্তেই অন্ধের হস্তিদর্শন-ন্যায়টা প্রায় সর্বদাই প্রযুক্ত হইতে পারে। এবং তারই জন্য জ্ঞানের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সর্ব্বপ্রকারের সিদ্ধান্তই উত্তরোত্তর পূর্ণতর হইতে যাইয়াই পরিবর্ত্তিত হয়। লোকে যাহাকে সচরাচর স্থিরমতি বলে তাহা অনেক সময়েই কেবল রুদ্ধগতির লক্ষণ। ইংরেজী বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই রুদ্ধগতিকেই arrested development বলে। কিন্তু ষ্টেডের মনের গতি আমরণ কখনও রুদ্ধ হয় নাই। বয়স তাঁহার বাড়িয়াছিল, কিন্তু শৈশবের সারল্য, যৌবনের উদ্যম, জ্ঞানের পিপাসা, উন্নতির আকাঙ্ক্ষা, কর্ম্মের চেষ্টা, এ সকলের কিছুই বিন্দু পরিমাণ কমে নাই। জগতের অনেক লোক প্রকৃত পক্ষে ত্রিশ চল্লিশ বৎসর হইতে না হইতেই মরিয়া যায়। নূতন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিসাধন করিয়া নূতন শক্তি সংগ্রহ ও নূতন চেষ্টার প্রকাশ, নিত্য নূতন জ্ঞান বা নিত্য নূতন রস আস্বাদন, নিত্য নূতন কর্ম্মের আয়োজন, এ সকলই তো প্রকৃত জীবনের লক্ষণ। কিন্তু জগতের অধিকাংশ লোক জীবিত থাকিয়াও জীবনের এ সকল লক্ষণ প্রকাশ করিতে পারে না। আর এই সকল লোকের বিষয়েই সচরাচর আমরা জীবন্ত-মৃত্যুর স্থবিরতার মধ্যে, তাহাদের রুদ্ধবুদ্ধির স্থিরতাও প্রত্যক্ষ করিয়া থাকি। মৃত্যুর মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত ষ্টেড্ প্রকৃত অর্থে জীবিত ছিলেন বলিয়া তাঁহার বুদ্ধি যে প্রাকৃতজনসুলভ স্থিরত্ব লাভ করে নাই ইহা আশ্চর্য্য নহে। কিন্তু তাঁহার মতামতের মধ্যে যে সঙ্গতির অভাব দৃষ্ট হইত তাহা কেবল বাহিরেরই কথা, ভিতরের কথা নহে।
ষ্টেড্ ও রুশ সম্রাট্
ষ্টেড আজীবন প্রজাতন্ত্রের পক্ষপাতী ছিলেন। যখন যেখানে প্রজামণ্ডলী আপনাদের স্বত্বস্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করিয়াছে, ষ্টেড্ তখনই তাঁহাদের পক্ষ সমর্থন করিয়াছেন। এই জন্যই তিনি বুয়র যুদ্ধের সময় নিজেদের গভর্ণমেণ্টের সমর্থন না করিয়া বুয়র-নেতৃবর্গের পক্ষই সমর্থন করিয়াছিলেন। আর এই কারণে সেই সময়ে তিনি অতিমাত্রায় সাধারণ ইংরেজমণ্ডলীর বিরাগভাজনও হইয়াছিলেন। অথচ যে সিসিল রোড্স্ (Cecil Rhodes) প্রকৃত পক্ষে চক্রান্ত করিয়া ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টকে এই সংগ্রামে প্রবৃত্ত করেন, স্টেড্ সর্ব্বদাই সেই সিসিল রোডসের স্তুতিবাদে নিযুক্ত হইয়া তাঁহার পক্ষ সমর্থন করিতেন। সাধারণ লোকে ষ্টেডের এই দুই কার্য্যের মধ্যে কোনো প্রকারের সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করিতে পারে নাই। ষ্টেড্ একদিকে যেমন জগতের সর্ব্বত্র প্রজামণ্ডলীব স্বত্ব-স্বাধীনতা সম্প্রসারণের ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন, অন্যদিকে সেইরূপ য়ুরোপের স্বেচ্চাতন্ত্রের একমাত্র অধিনায়ক, রুশিয়ার জারেরও (Czar) পক্ষ সমর্থন করিতেন। লোকে এ অসঙ্গতির অর্থও বুঝিতে পারে নাই। এই জন্য তাহারা অনেক সময়ে ষ্টেডের সাধুতা সম্বন্ধেও সন্দিহান হইয়াছে। কেবল বাহির হইতে ষ্টেডের কার্য্যাকার্য্যের বিচার করিলে এ অসঙ্গতির রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয় না। সিসিল রোড্সকে এবং “জারকে” সাধারণ লোকে দূর হইতে এবং বাহির হইতেই সর্ব্বদা দেখিয়াছে। তাঁহাদের নিকটে যাইয়া তাঁহাদের প্রাণের অন্তঃপুরে কখনো প্রবেশাধিকার পায় নাই। ষ্টেড্ এই দুই জনকেই অতি ঘনিষ্ঠভাবে জানিবার ও বুঝিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। বন্ধুর নিকট বন্ধু যেমন প্রাণের সকল পর্দ্দা খুলিয়া দিয়া নিঃসঙ্কোচে দাঁড়ায়, রোডস্ এবং “জার” দু’জনেই সেইরূপ একদিন ষ্টেডের নিকটে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিলেন। ষ্টেডের প্রকৃতিগত অকপটতার সংস্পর্শে জারের জারত্বের বহিরাবরণ আপনা হইতেই সরিয়া গিয়াছিল। ষ্টেডের অনাবৃত মনুষ্যত্বের সম্মুখে “জার” জাররূপে নহে, কিন্তু শুদ্ধ মানুষরূপে একদিন দাঁড়াইয়াছিলেন। “জারের” ভিতরে যে মনুষ্যত্ববস্তু আছে, তাহারই দ্বারা ষ্টেড্ সর্ব্বদা জারের বাহিরের কার্য্যাকার্য্যের বিচার করিতেন। এই জন্য রুশীয় গভর্ণমেণ্টের অত্যাচার-অবিচারে জারের প্রতি ষ্টেডের স্বাভাবিক শ্রদ্ধা ও প্রীতির কোনো ব্যাঘাত উৎপাদন করিতে পারে নাই। রুশীয় গভর্ণমেণ্ট কেবল জারকে লইয়া নহে। সে গভর্ণমেণ্টের কার্য্যাকার্য্যের জন্য জার কতটা দায়ী এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোনো দায়িত্ব আছে কি না এ কথা বলা কঠিন। রুশের বিশাল ও জটিল শাসনযন্ত্রে জার একটা সামান্য অঙ্গ মাত্র। রুশিয়ার রাজশক্তি ও প্রজা-প্রকৃতির অনাদিকৃত কর্ম্মবশে রুশের স্বেচ্ছাতন্ত্র গড়িয়া উঠিয়াছে, কেবল রাজার ইচ্ছার বা আভিজাতবর্গের চেষ্টায় ইহা গড়িয়া উঠে নাই। এখন সে স্বেচ্ছাতন্ত্র কেবল রুশরাজের উদার অভিপ্রায়ের বলে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া আবার নূতন করিয়া গড়িয়া উঠিতে পারে না। রাজা ও প্রজা উভয়ের কর্ম্মক্ষয় না হইলে, কখনই রাজ্যের এ সংস্কার সাধিত হইবার নহে। গুপ্তহত্যায় কর্ম্মবোঝা বাড়িয়াই যায়, ক্ষয় হয় না। এ পথ স্বাধীনতার পথ নহে। সাধারণ প্রকৃতিপুঞ্জ যে দিন আপনার কর্ম্মক্ষয় করিতে পারিবে, তাহাদের পুরুষ পরম্পরাগত তমঃ নষ্ট হইয়া যে দিন তাহাদের আত্মচৈতন্যের উদয় হইবে, সে দিন গুপ্তহত্যারও প্রয়োজন থাকিবে না, বিদ্রোহেরও প্রয়োজন অনাবশ্যক হইবে; কিন্তু আপনা হইতেই রাজাপ্রজার পরস্পরের অধিকারের মধ্যে সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া সকল সমস্যার মীমাংসা হইয়া যাইবে। এই মীমাংসার পথে রুশের বর্ত্তমান জার প্রকৃতপক্ষে কোনই অন্তরায় নহেন। ইহার প্রধান অন্তরায় বিপ্লবপন্থিগণ। বিপ্লবপন্থিগণ যতদিন গুপ্তহত্যা প্রভৃতি অহিতাচার হইতে প্রতিনিবৃত্ত না হইতেছেন, ততদিন পর্য্যন্ত জারের পক্ষে রাজপুরুষদিগের অত্যাচার নিবারণ করাও অসম্ভব। সাধারণ লোকে ইহা বোঝে না। সাধারণ লোকে জারের মনুষ্যত্ব যে কতটা ইহা জানে না। আর তারই জন্য তাহারা সরাসরিভাবে বিচার করিয়া রুশগভর্ণমেণ্টের কার্য্যাকার্য্যের জন্য অন্যায়রূপে জারকে দায়ী করিয়া থাকে। ষ্টেড্ জারকে চিনিতেন। জারের রাজৈশ্বর্য নয় কিন্তু নিরাভরণ মানুষী মুর্ত্তি তিনি প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। রুশশাসনযন্ত্রের জটিলতাও তাঁর চক্ষুগোচর হইয়াছিল। এই যন্ত্রচালনায় জারের শক্তিসাধ্য যে কি এবং অধিকার ও অবসরই বা কতটুকু ইহাও তিনি জানিতেন। আর এ সকল জানিতেন বলিয়াই রুশের রাষ্ট্রীয় শক্তির ও বিপ্লবশক্তির মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়া ক্ষণে ক্ষণে যে সকল অমানুষী কাণ্ড ঘটিত, সে সকলের জন্য জারকে তিনি কখনো দায়ী মনে করিতেন না। রুশের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে জার যেমন অবস্থার দাস এবং ঘটনাচক্রের ক্রীড়াপুত্তলী হইয়া আছেন, সিসিল রোডস্ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সেইরূপই অবস্থার দাস ও ঘটনাচক্রের ক্রীড়নক হইয়াছিলেন। আর এই জন্যই ষ্টেড্ বুয়রব্রিটিশসংগ্রামঘটিত কার্য্যাকার্য্যের জন্য সিসিল রোডস্কেও কখনো সাক্ষাৎভাবে দায়ী করেন নাই।
ষ্টেডের চরিত্রের জটিলতা সকলে বুঝিতে পারুক বা না পারুক, তাঁর চরিত্রের স্বচ্ছতায় ও তাঁর অকৃত্রিম সত্যানুরাগে, তাঁহার সরল স্বদেশবাৎসল্যে ও গভীর মানব-প্রেমে সকলেই মুগ্ধ ছিল। এক প্রকারের সত্যানুরাগ ইংরেজের জাতীয় চরিত্রের সাধারণ লক্ষণ। যেখানে ব্যবসাবাণিজ্যের তীব্র প্রতিযোগিতা থাকে, সেখানে দোকানদারীর ভিতর দিয়াই একপ্রকারের সত্যবাদিতা ফুটিয়া উঠে। এইরূপ সত্যবাদিতা ব্যতীত সে ক্ষেত্রে কেহ আপনার ব্যবসায় রক্ষা করিতে পারে না। এই জাতীয় সততাকে লক্ষ্য করিয়াই ইংরেজ প্রবাদ-বচনে সততাকে শ্রেষ্ঠতম নীতি—অনেষ্টিকে বেষ্ট পলিসি (Honesty is the best policy)—বলিয়াছে। ষ্টেডের সত্যপরায়ণতা এই শ্রেণীর ছিল না। তাহা অকপট সত্যানুরাগ ও ধর্ম্মানুরাগের উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। এইজন্য তিনি যখন যাহা ভাল বুঝিয়াছেন, সেইভাবে কাজ করিতে যাইয়া, অনেক সময় আপনার বিস্তর ক্ষতিও করিয়াছেন। ব্রিটিশ—বুয়রের যুদ্ধের সময়, তার উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। ফলতঃ এই অকপট সত্যানুরাগের জন্যই, ইদানীং তাঁর নিজের সমাজে এবং কিয়ৎ পরিমাণে, অন্যান্য দেশেও ষ্টেডের প্রতিপত্তি কিছু কমিয়া গিয়াছিল। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রের পরলোকের পর হইতে ষ্টেড পরলোকতত্ত্বের অনুশীলনে প্রবৃত্ত হইয়া, ইংরেজিতে যাহাকে স্পিরিটুয়্যালিজ্ম (Spiritualism) বলে, তার একান্ত অনুরক্ত হইয়া পড়েন। মৃতলোকের আত্মা যে জীবিতদিগের সঙ্গে উপযুক্ত “মিডিয়াম” পাইলে, কথাবার্ত্তা কহেন ও এমন কি কখনো কখনো ভৌতিকরূপ ধারণ করিয়া তাহাদের চক্ষুগোচরও হন, ষ্টেড্ কিছুদিন হইতে ইহাতে একাত্ত বিশ্বাসী হইয়া পড়েন। এই স্পিরিটুয়্যালিজ্মের অনুশীলন করিবার জন্য তিনি লণ্ডনের নিকটবর্ত্তী উইম্বেলডেন্ নামক স্থানে একটা বাড়ী করিয়া, মাহিনা দিয়া লোক রাখিয়াছিলেন। প্রতিদিন প্রাতঃকালে, দৈনন্দিন বিষয়কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে প্রায়ই তিনি কিছুকাল এই বিষয়ের অনুশীলনে নিযুক্ত থাকিতেন। এই সময়ে কখনো কখনো তিনি জগতের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সমস্যার সম্বন্ধেও পরলোকগত মনীষিগণের মতামত জানিবার চেষ্টা করিতেন। এইভাবে পরলোক তত্ত্বের অনুশীলনের সত্যাসত্য বা ভালমন্দ বিচারের এ সময় নহে, এ স্থানও নহে। সকলে বা অনেকে যে এ যুগে এ সকল ভৌতিক কাণ্ডে বিশ্বাস স্থাপন করিবেন, এমনটাও আশা করা যায় না। বরং অধিকাংশ লোকেই এসকল প্রয়াসকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চাহেন। সুতরাং বিলাতের বা য়ুরোপের তর্কবাদিদিগের সমক্ষে এ সকল তত্ত্বের আলোচনা বড় কম সাহসের পরিচয় দেয় না। ষ্টেড্ অকুতোভয়ে তাঁর সিয়ান্সে (Seanceএ) যে সকল কথাবার্ত্তা হইত, প্রকাশ্য সংবাদপত্রে তাহা বাহির করিতেন। ইহাতে অনেক লোকেই তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া পড়িতেছে, ইহাও তিনি জানিতেন। এজন্য তাঁর ব্যবসায়েরও বিস্তর ক্ষতি হইতেছিল, ইহাও তিনি দেখিতেছিলেন। কিন্তু যাহা নিজে সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতেন, লোকের মুখ চাহিয়া তিনি কখনো তাহা প্রচার করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। ইহাতেই তাঁর চরিত্রের জোর কতটা ছিল, ইহা সহজেই বোঝা যায়। এ বিষয়েও ষ্টেড্ ইংরেজের সেরা ছিলেন।
যেমন তাঁর সত্যানুরাগ, তেমনি তাঁর স্বদেশপ্রীতি ও মানবহিতৈষাতেও ষ্টেড্ ইংরেজ-চরিত্রের উচ্চতন উৎকর্ষলাভ করিয়াছিলেন। ইংরেজ তাঁর দেশকে যেমন ভালবাসেন, জগতের আর কোনো জাতির লোক বোধ হয় তাদের নিজেদের দেশকে তেমন ভালবাসে না। ইংরেজের প্রেম কাজে ফোটে, কেবল ভাবে বা কথায় উচ্ছ্বসিত হয় না। ষ্টেড্ স্বজাতিকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন, দুনিয়ায় যে ইংরেজের মত আর কোনো জা’ত যে ছিল বা আছে ভিতরে ভিতরে তিনি যে তাহা বড় বিশ্বাস করিতেন, এমনো মনে হয় না। তাঁর চক্ষে ইংরেজ আদর্শ মানুষ। কিন্তু সে ইংরেজ খাঁটি ইংরেজ, ইংরেজের জাতীয় চরিত্রের উন্নত আদর্শভ্রষ্ট যে সকল লোক জগতের ভিন্ন ভিন্ন দেশে যাইয়া ইংরেজ নামে কলঙ্ক আরোপ করিতেছে, ষ্টেডের চক্ষে সে ইংরেজ আদর্শমানুষ ছিল না। এইজন্য ইংরেজের মধ্যে যা কিছু ভাল, তাহাই তিনি রক্ষা করিবার ও বাড়াইবার জন্য ব্যস্ত ছিলেন, মন্দকে কখনো আদর করিয়া পুষিয়া রাখিতে চান নাই। ব্রিটিশ উপনিবেশে এবং ভারতবর্ষে আসিয়া যে সকল ইংরেজ ইংরেজত্বভ্রষ্ট হইয়া যায়, যারা ইংরেজের সত্যবাদিতা, ইংরেজের ন্যায়পরতা, ইংরেজের উদারতা, ইংরেজের মানবহিতৈষা ভুলিয়া যাইয়া, একটা অযথা ও আত্মঘাতী অহঙ্কারকে আশ্রয় করিয়া, অপর জাতির লোকের উপরে অন্যায় প্রভুত্ব ও অমানুষী অত্যাচার করিয়া থাকে, তাহাদের ইংরেজত্বের অভিমানের সঙ্গে ষ্টেডের বিন্দু পরিমাণেও সহানুভূতি ছিল না। অন্যদিকে ষ্টেডের মানবহিতৈষাও, বলিতে গেলে, তাঁর গভীর স্বজাতি বাৎসল্যেরই রূপান্তর মাত্র ছিল। তিনি আপনার জাতিকে ও আপনার সভ্যতা ও সাধনাকে এতটা ভাল বাসিতেন যে একদিকে যেমন সেইজন্য, নিজের জাতের আদর্শ ও চরিত্রকে বিশুদ্ধ রাখিবার ও উন্নত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, সেইরূপ অন্যদিকে, এই আদর্শ ও এই সভ্যতা ও সাধনা যাহাতে জগতের সকল লোকে আয়ত্ত ও অধিকার করিতে পারে, তার জন্য ও সর্ব্বদাই লালায়িত ছিলেন। দুনিয়ার লোক ইংরেজের মত স্বাধীন ও লব্ধ-প্রতিষ্ঠ হউক, ইরেজ রাষ্ট্র যেমন নিয়মতন্ত্র, ইংরেজ রাজা যেমন প্রজামতের অধীন, সকল দেশের রাষ্ট্র ও রাজা সেইরূপ হউক, ষ্টেড্ সর্ব্বদাই ইহা চাহিতেন। তারই জন্য জগতের যেখানে প্রজাস্বত্ব সম্প্রসারণে সঙ্গত প্রয়াস হইতেছে দেখিতেন, যেখানেই স্বেচ্ছাতন্ত্রের স্থানে নিয়মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার আয়োজন বা চেষ্টা হইতেছে শুনিতেন, সেখানেই সেই সকল প্রয়াসের সঙ্গে সর্ব্বদা সহানুভুতি করিতে অগ্রসর হইতেন। কি পোল্যাণ্ডের, কি ফিন্ল্যাণ্ডের, কি মিশরের, কি ভারতবর্ষের, কি চীনের, কি পারশ্যের, সকল দেশের স্বাধীনতার উপাসকগণ বিলাতে যাইয়া, তীর্থস্থানে যেমন দেশদেশান্তরের যাত্রী মিলিত হয়, সেইরূপ ষ্টেডের বাড়ীতে সম্মিলিত হইতেন। এখানে আফ্রিকার কাফ্রি লোক-নায়ককে দেখিয়াছি। পারশ্যের প্রজাতন্ত্রের অধিনায়কগণকেও দেখিয়াছি। যাঁরা তুরস্কের রাষ্ট্রতন্ত্র প্রবর্ত্তিত করিয়াছেন, সেখানেও প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করিতেছেন, সেই সকল ইয়ংটার্ককে (Young Turksকে) এখানে দেখিয়াছি। ফিন্ল্যাণ্ডে, পোল্যাণ্ডে, সকল দেশে যাঁরা স্বদেশসেবায় জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, বিলাতে গেলে, ষ্টেডের বাড়ীতে সকলেরই নিমন্ত্রণ হইত, সেখানে সকলেই মিলিত হইতেন। ষ্টেডের বৈঠকখানা আধুনিক সভ্যজগতের শ্রেষ্ঠজনের একটা পবিত্র সম্মিলন ক্ষেত্র ছিল, বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। আর এই অদ্ভূত সম্মিলন, গৃহস্বামীর উদার মানবপ্রেমেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ দান করিত।
জীবদ্দশায় স্টেড যে সকল উন্নত আদর্শের কথা প্রচার করিতেন, মরণ সময়েও তাহারই চরণে আত্মবলিদান দিয়া গিয়াছেন। মরণকালেই মানুষকে সত্যভাবে চেনা যায়। অকূল পাথারে পড়িয়া মানুষের সংসারের সকল আশ্রয় যখন নিঃশেষে লুপ্ত হইয়া যায়, তখনই তার জীবনের সত্যিকার সাধনটা যে কি ছিল, তাহা আপনা হইতে বাহির হইয়া পড়ে। ষ্টেডেরও তাহাই হইয়াছে। অবলাকুলের হিতব্রতে ষ্টেড্ যৌবনের প্রারম্ভেই জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। সেই ব্রতের সাধনেই Maiden Tribute রচিত ও প্রকাশিত হয়। তারই জন্য কারাগারে তাঁর লাঞ্ছনা। অসহায়ের সহায়তা করিতে ষ্টেড্ কখনও পরাঙ্মুখ হইয়াছেন, তার শত্রুরাও এমন কথা বলে না। আর অকূল সমুদ্রে, ভগ্ন অর্ণবতরী বক্ষে, অবলা ও শিশুদিগকে নৌকায় তুলিয়া দিয়া শেষে ধীর ভাবে, আপনি সেই জাহাজের সঙ্গে অতলে ডুবিয়া গিয়া ষ্টেড্ সেই পবিত্র জীবনব্রতই উদযাপন করিয়াছেন। ইংরেজ চরিত্রের মহত্ত্ব কোথায়, য়ুরোপীয় সভ্যতা ও সাধনার দেবত্বটুকু কোন্খানে,—টাইটানিক জাহাজের এই অন্তিমদৃশ্যে তাহাই ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই পবিত্র দৃশ্য যখন মানসপটে ভাসিয়া উঠে, তখন আর ইংরেজ জাতিকে অশ্রদ্ধা, য়ুরোপীয় সভ্যতা ও সাধনাকে অবজ্ঞা করিতে পারি না।