চরিত-কথা (বিপিনচন্দ্র পাল)/অক্ষয়চন্দ্র ও সাহিতু-সম্মিলন
অক্ষয়চন্দ্র & সাহিত্য-সম্মিলন
[বঙ্গদর্শন—বৈশাখ, ১৩২০]
চট্টগ্রামের সাহিত্যসম্মিলন অক্ষয়চন্দ্রকে সভাপতিত্বে বরণ করিয়া অতি ভাল কাজই করিয়াছেন। আজ অক্ষয়চন্দ্র বাঙ্গলা সাহিত্যজগতে একটা পুণ্যস্মৃতির মতন হইয়া পড়িয়াছেন বটে, আধুনিক বাঙ্গালী পাঠকেরা বা বাঙ্গলা লেখকেরা প্রত্যক্ষভাবে অক্ষয়চন্দ্রের প্রভাব যে অনুভব করিয়া থাকেন, এমন বলা যায় না। কিন্তু হহা এই জগতেরই চিরন্তন বিধান। পুরাতন সর্ব্বত্রই ক্রমে চলিয়া যায়, তার স্থলে নূতন আসিয়া অভিষিক্ত হয়। কিন্তু তাই বলিয়া, প্রকৃতপক্ষে পুরাতনের মর্য্যাদা কোনও মতেই যে কমিয়া যায়, তাহাও নহে। নূতন পুরাতনকে অগ্রাহ্য করিতে পারে, কিন্তু সমাজের প্রাণের মূলে, ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রীরূপে যে সাক্ষী চৈতন্য বিরাজিত আছে, সে জানে পুরাতনের পুরাতত্ত্বকে আত্মসাৎ করিয়াই নূতনের যাবতীয় শক্তি-সাধ্যের প্রকাশ হইয়া থাকে। এই জন্যই ইতিহাস সর্ব্বদা সকল স্থানেই পুরাতনের সমধিক পক্ষপাতী হয়। সম্যক্দর্শী সুধীগণ, এই কারণেই, সর্ব্বদা প্রাচীনের প্রতি ভক্ত্যবনত হইয়া থাকেন। চট্টগ্রামের সাহিত্য-সম্মিলনী অক্ষয়চন্দ্রের সম্বর্দ্ধনা করিয়া এই সম্যক দর্শন ও এই ভক্তি প্রবণতারই পরিচয় প্রদান করিয়াছেন।
বাঙ্গলা সাহিত্যে অক্ষয়চন্দ্রের স্থান কোথায় ও স্থায়িত্ব কতটুকু হইবে, বলা সহজ নহে। অক্ষয়চন্দ্র সাহিত্যে কোনও নূতন যুগের প্রবর্ত্তন করেন নাই। তাঁর অলোকসামান্য কবি-প্রতিভার কিম্বা অনন্যসাধারণ চিন্তাশীলতার যে কোনও দাবী আছে, এমনও বলা অসম্ভব। কিন্তু যেমন চুড়াতেই মন্দির নির্ম্মিত হয় না, সেইরূপ কেবল অলোকসামান্য প্রতিভা বা অনন্যসাধারণ চিন্তাশক্তির দ্বারাই কোনও সাহিত্য বা সমাজ-জীবনও গড়িয়া উঠে না। বহু বস্তুর সাহচর্য্যে, বহু শক্তির সমবায়ে, বহু গুণের সম্মিলনে, দুনিয়ার যত কিছু ভাল জিনিষ সকলই উৎকর্ষ লাভ করিয়া থাকে। সেইরূপ ছোট বড় বহু সাহিত্যিকের সমবেত চেষ্টা ও শক্তি দ্বারাই সাহিত্যেরও পরিপুষ্টি সাধিত হয়। যুগ প্রবর্ত্তক মহাপুরুষ একজনই হয়েন। কিন্তু তাঁর অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ থাকেন। এই সকল সাঙ্গোপাঙ্গকে লইয়াই তিনি তাঁর যোগধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা করেন। ইহাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধটা একান্তই অঙ্গাঙ্গী, কোনও মতেই আকস্মিক নহে। বাঙ্গলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র একজন যুগপ্রবর্ত্তক মহাপুরুষ বলিয়া গণ্য হইয়াছেন। তিনি বাঙ্গলা ভাষাতে, বাঙ্গালীর চিন্তাতে ও ভাবেতে, আদর্শে ও চরিত্রে যে শক্তি সঞ্চার করিয়া গিয়াছেন, তাহারই প্রেরণায় আজ পর্য্যন্ত বাঙ্গলার হিন্দুসমাজ আপনার নিয়তি-পথে চলিতেছে। এরূপ শক্তি-সঞ্চার রাজা রামমোহনের পরে, এক কেশবচন্দ্র ব্যতীত আর কেহ করেন নাই। এ সকল ক্ষেত্রে তুলনায় সমালোচনা করা সর্ব্বদা সঙ্গত নহে। কেশবচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্র এই দু’জনার মধ্যে কে বড় কে ছোট, এ প্রশ্ন তোলাই অন্যায়। বাঙ্গালী দু’জনার নিকটেই সমভাবে ঋণী। ইহাঁরা মূলে একে অন্যকেই সাহায্য করিয়াছেন। পরস্পরে পরস্পরের আদশ ও প্রেরণাকে পূর্ণতর করিয়া তুলিয়াছিলেন, এমনই বা বলা যাইতে পারে। কিন্তু কি কেশবচন্দ্র কি বঙ্কিমচন্দ্র দুই মহাপুরুষের কেহই আপন আপন সাঙ্গোপাঙ্গকে ছাড়িয়া এ কাজটা করিতে পারিতেন না। প্রতাপচন্দ্র, গৌরগোবিন্দ, অঘোরনাথ, বিজয়কৃষ্ণ, প্রভৃতিকে একদিকে ও এক সময়ে কেশবচন্দ্র যেমন আপনার অলোকসামান্য প্রতিভার প্রেরণার দ্বারা ফুটাইয়াছিলেন, ইহাঁরাও সেইরূপ আপন আপন সাধনসম্পত্তি দিয়া কেশবচন্দ্রের প্রতিভাকে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিয়াছিলেন। এ জগতে একাকিত্বের মধ্যে মৃত্যুর অবসাদই কেবল পাওয়া যায়, জীবনের প্রেরণা মিলে না। যেমন কেশবচন্দ্র আপনার সাঙ্গোপাঙ্গগণের গুণেই এত বড় হইয়া উঠিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রও সেইরূপ, আধুনিক বাঙ্গলাসাহিত্যক্ষেত্রে, আপনার সহচর ও সহযোগিগণের শক্তি ও সাধনাকে আশ্রয় ও আত্মসাৎ করিয়াই এমন অনন্যসাধারণ উৎকর্ষ লাভ করেন। যে সে লোক আপনার উপযোগী লোক বাছিয়া লইয়া, নিজের পার্শ্বে টানিয়া আনিতে পারে না। আর যে সে লোক আপনার পারিপার্শ্বিক শক্তি ও সাধনাকে এমনভাবে আত্মসাৎ করিয়াও লইতে পারে না। এরূপভাবে যাঁহারা দুর্লক্ষ্য সূত্রে চারিদিক হইতে উপযোগী সহচরদিগকে আপনার কাছে টানিয়া আনিতে পারেন ও টানিয়া আনিয়া তাহাদের মধ্যে আপনাকে ও আপনার মধ্যে তাহাদিগকে মিলাইয়া মিশাইয়া দিতে পারেন, তাঁরাই সত্য সত্য মহাপুরুষ বলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েন। বাঙ্গলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র এ কাজটা যেমন ভাবে ও যতটা পরিমাণে করিয়াছিলেন, এমন আর কেহ করিতে পারেন নাই। বোধ হয় এ আকর্ষণী শক্তি কিয়ৎ পরিমাণে রাজা রামমোহনেরও ছিল। তিনিও কতকগুলি প্রতিভাশালী লোককে আপনার চারিদিকে টানিয়া আনিয়াছিলেন। কিন্তু সে কালের ভিতরকার খবর আমরা তেমন জানি না। রাজার প্রখর প্রতিভার আওতায় পড়িয়া তাঁর সমসাময়িক প্রতিভাশালী বাঙ্গালীগণের প্রতিভা লোক সমাজে আত্মপ্রকাশের অবসর পায় নাই। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র না কি কতকটা আমাদেরই সময়ের লোক; তাঁকে দেখিয়াছি, তাঁর সঙ্গে কথাবার্ত্তা কহিয়াছি, তাঁর প্রতিভার স্ফুরণের সমগ্র ইতিহাসটাই একরূপ আমাদের চক্ষের উপরে গড়িয়া উঠিয়াছে, সুতরাং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদিগের সকলকে না হউক, অনেককে আমরা স্বল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠভাবেই দেখিয়াছি ও জানিয়াছি, আর সেই জন্যই বাঙ্গলা দেশটা যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের অলোকসামান্য প্রতিভার নিকটে ঋণী, সেইরূপ তারাপ্রসাদ, রাজকৃষ্ণ, অক্ষয়চন্দ্র, হেমচন্দ্র প্রভৃতির নিকটে কতটা পরিমাণে যে ঋণী ছিল, ইহার সংবাদও আমরা কতকটা রাখিয়াছি। আর বঙ্কিমচন্দ্রের অন্তরঙ্গদের মধ্যে, অক্ষয়চন্দ্রই যেন, আমার মনে হয়, সর্ব্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ ছিলেন। তারাপ্রসাদ, রাজকৃষ্ণ, হেমচন্দ্র প্রভৃতি আর সকলেই অবসর মত সাহিত্যসেবা করিতেন। একমাত্র অক্ষয়চন্দ্রই সাহিত্যসেবাকে জীবনের মুখ্য কর্ম্ম বলিয়া বরণ করিয়া লইয়াছিলেন। এই জন্য এক সময়ে অক্ষয়চন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শনের প্রধান সহায় হইয়া উঠেন। সে কালের বঙ্গদর্শনে অক্ষয়চন্দ্রের কোন কোন রচনা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের বলিয়া সন্দেহ হইত। গ্রন্থসমালোচনার ভার অনেকটা বোধ হয় অক্ষয়চন্দ্রের উপরেই অর্পিত ছিল। সম্ভবতঃ কোন কোন সমালোচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ছাপ’ও থাকিত। সেই সব সাহিত্যসমালোচনার মধ্যে তাহাদের মত এমন করিয়া প্রখরে মধুরে মিলাইতে এমন করুণ কঠোর কষাঘাত করিতে আর কেহ পারিতেন কি না, সন্দেহ। “মালঞ্চনিবাসিনা মধুসূদন সরকাবস্য”কে এই ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বৎসরেও ভুলিতে পারি নাই। আর আমার পরলোকগত বন্ধ আনন্দচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের “হেলেনা কাব্যের” ভূমিকায় যে অত্যুক্তি ছিল তাহার প্রতি বঙ্গদর্শন যে তীব্র বিদ্রূপ বর্ষণ করিয়াছিল,—সে বিদ্রূপের মধ্যে কতবিধ রস উথলিয়া উঠিয়াছিল, তাহাও মনে আছে। ফলতঃ বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন প্রচার বন্ধ হইয়া অবধি বাঙ্গলা সাহিত্যে সেরূপ সমালোচনার নিপুণতা আর কোথাও দেখিতে পাই নাই। নব পর্য্যায় বঙ্গদর্শনে শ্রীযুক্ত চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় মহাশয় কিছুদিন সে ধারা রাখিয়াছিলেন, আর মাঝে মাঝে সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয় সে পুরাতন স্মৃতিকে জাগাইয়া তুলেন; কিন্তু সচরাচর আজ বাঙ্গলাসাহিত্যে সমালোচকের ধর্ম্মাসনে তেমন একটীও যোগ্য ব্যক্তিকে দেখিতে পাই না। ইংরেজের আদালতে যেমন মোকদ্দমার সংখ্যা যতই বাড়িয়া যাইতেছে, ততই সরাসরি বিচারের পদ্ধতিটাও অযথা পরিমাণে প্রচলিত হইয়া পড়িতেছে, বাঙ্গলাসাহিত্যেও গ্রন্থকারের সংখ্যা যতই বাড়িয়া যাইতেছে, ততই সরাসরিভাবে সাহিত্যসমালোচনার প্রবৃত্তি এবং রীতিও যেন বাড়িয়া চলিয়াছে। বাঙ্গলা সাহিত্যে এখন অনেকস্থলে সমালোচকের পদে মোসাহেব অধিষ্ঠিত। এ অবস্থার সাহিত্যের সম্মান রক্ষা বাস্তবিকই দায় হইয়া পড়িয়াছে। আর চারিদিকের এই অবনতিধারা প্রত্যক্ষ করিয়াই বঙ্কিমচন্দ্র ও অক্ষয়চন্দ্র যে কাজটা এক সময়ে এমন অসাধারণ কৃতিত্ব সহকারে করিতেন, তার মূল্য ও মর্য্যাদা যেন আমার চক্ষে ক্রমেই বাড়িয়া যাইতেছে।
অক্ষয়চন্দ্রের চিন্তার মৌলিকতা না থাকিলেও, ভাষার একটা অনন্যসাধারণ শক্তি ও সরলতা আছে, ইহা অস্বীকার করা অসম্ভব। আর এ বস্তুটা তাঁর নিজস্ব। কবিতা রচনায় রবীন্দ্রনাথ যে অসাধারণ শব্দসম্পদের পরিচয় দান করিয়াছেন, গদ্য লেখাতে অক্ষয়চন্দ্র সে সম্পদেরই প্রমাণ প্রদান করিয়াছেন। সুললিত, সহজবোধ্য, বিবিধ রসোদ্দীপক শব্দধারার সৃষ্টি-কুশলতায় বাঙ্গলা লেখকদিগের মধ্যে অক্ষয়চন্দ্রের নকলনবিশ অনেক হইয়াছেন, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী একজনও হয়েন নাই, সকল সময়ে যে অক্ষয়চন্দ্রের শব্দ প্রবাহ ঠিক সার্থক হয় তাহা নাও বা বলা যাইতে পারে। সে ধর্ম্ম রবীন্দ্রনাথের কাব্যেও যে নাই, এমন কথাই কি বলা যায়? কিন্তু শব্দের যে একটা নিজস্ব মোহিনী প্রভাব আছে, সুযোজিত ধ্বনিধারার যে একটা মাদকতাসঞ্চারিণী শক্তি আছে, এও তো সত্য। সাহিত্যিক মাত্রেই, রসাত্মক বাক্য যোজনা করিতে যাইয়া, স্বল্পবিস্তর পরিমাণে এই মাদকতা-সঞ্চারিণী শক্তিকে উদ্বোধিত করিয়া থাকেন। এ অধিকার যাঁর নাই, তিনি চিন্তাশীল হইতে পারেন, বহু জ্ঞানের অধীশ্বর হইতে পারেন, বহু তত্ত্বের আবিষ্কর্ত্তাও হইতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যিক হইতে পারেন না। স্বর্ণকারের ব্যবসায় যেমন টাকা কড়ি লইয়া, সাহিত্যিকের ব্যবসায় সেইরূপ শব্দ লইয়া। যার যে পরিমাণে টাকা কড়ি চালাইবার ক্ষমতা থাকে, সেই যেমন স্বর্ণকারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহাজনপদবাচ্য হয়; সেইরূপ যে লেখকের শব্দ-সম্পদ যত বিশাল ও সেই শব্দরাশির যথাযোগ্য যোজনায় নিপুণতা যাঁর যত বেশি, সাহিত্যজগতে তিনি তত শ্রেষ্ঠ—সাহিত্যাচার্য্য উপাধি পাইবার উপযুক্ত। এই হিসাবে অক্ষয়চন্দ্রকে ন্যায়তঃই সাহিত্যাচার্য্য বলিতে পারা যায়। বাঙ্গলা গদ্যরচনায় এমন তুবড়ী ফুটাইয়া তুলিতে আর কেহ পারিয়াছেন বলিয়া জানি না।
এ জগতে সকল বস্তুরই উপযোগিতা যত কমিয়া আসে, তার সঙ্গে সঙ্গে উপকারিতাও ক্রমে কমিয়া যায়। অক্ষয়চন্দ্রেব গদ্যরচনার প্রণালীটী আজ হয়ত ঠিক তেমন ভাবে আর উপযোগী নহে। দেশের মধ্যে চিন্তাশক্তি জাগিয়া উঠিয়াছে। বস্তুজ্ঞান জন্মুক আর নাই জন্মুক, বস্তুলাভের আকাঙ্ক্ষাটা বেশই জাগিয়া উঠিতেছে। লোকচিত্ত এখন শব্দের মোহিনী মায়া কাটাইয়া গভীরতর ভাবে অর্থের অন্বেষণে ছুটিতেছে। ক্রমে এ ভাবটা বাঙ্গলা সাহিত্যেও স্বভাবতঃই প্রতিষ্ঠালাভ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। এইজন্য বাঙ্গলা গদ্যের আদর্শ কিয়ৎ পরিমাণে বদলাইয়া যাইতেছে। সাহিত্যের শক্তি এককালে ধ্বনিগত ছিল, এখন ক্রমে ক্রমে চিন্তাকে, গবেষণাকে, যুক্তি-বিচারকে আশ্রয় করিয়া আত্ম-প্রতিষ্ঠা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। যে লেখার অন্তরালে চিন্তার জোর আছে, তাহাই এখন শক্তিশালী লেখা বলিয়া গণ্য হয়। কেবল ভাবের, রসের, শব্দের ফোয়ারার উপরে সাহিত্য-সম্পদ ও সাহিত্যিকের প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রতিষ্ঠা করা আর সম্ভব নহে। এই কারণে অক্ষয়চন্দ্র যে গদ্যরচনাপ্রণালী প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলেন, তাহার মূল্যও আজিকার বাজারে ক্রমে কমিয়া যাইতেছে। আজিকার বাঙ্গলাসাহিত্যে গদ্য-রচনার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ। বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের পর অক্ষয়চন্দ্র, চন্দ্রনাথ, কি কালীপ্রসন্ন, ইঁহারা সকলেই সাহিত্যে মহারথী ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু বাঙ্গলাভাষায় গদ্য রচনার ক্ষমতাটা যে কত বড়, ইহা রবীন্দ্রনাথ যেমনটা প্রমাণ করিয়াছেন, ইহাদের কেহই তেমনটা প্রমাণ করিতে পারেন নাই। এমন নিরেট গাঁথুনী বাঙ্গলা ভাষার শক্তিতে যে সম্ভব ইহা লোকে পূর্ব্বে কল্পনাও করিতে পারিত না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার সমক্ষে অক্ষয়চন্দ্রের গদ্য-সাহিত্যসৃষ্টি আজ অনেকটা মলিন হইয়া পড়িলেও এক সময়ে তিনিও যে বাঙ্গলা শব্দকে লইয়া বিচিত্ররসের খেলা খেলিয়াছিলেন, আর সে খেলাতে বাঙ্গালী চকিত, পুলকিত, স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল, ইহাও অস্বীকার করা যায় না। সে জাতীয় সাহিত্যসৃষ্টিতে আজিও অক্ষয়চন্দ্র অনন্যপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রাধান্য ভোগ করিতেছেন। তবে তাঁর গদ্যের আদর্শটা যে আজি কালি লোকচক্ষে কতকটা হেয় হইয়া পড়িয়াছে, ইহা বস্তুতঃ অক্ষয়চন্দ্রেরও দোষ নহে। দোষ তাঁর অনুকরণকারীদের। ইহাঁদের না ছিল অক্ষয়চন্দ্রের ধারণা, না ছিল তাঁর চিন্তার শক্তি বা রসানুভূতির প্রাখর্য্য,—ছিল কেবল কাণ। তাই তাঁহারা কেবল কাণের জোরে অক্ষয়চন্দ্রের গদ্যরচনার প্রণালীর অনুকরণ করিতে যাইয়া, তাহার ভিতরকার শক্তি ও সৌন্দর্য্যকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছেন। অকৃতি অথচ গুরুমর্য্যাদালোলুপ শিষ্যের হাতে পড়িয়া অনেক গুরুরই যেমন দুর্দ্দশা ঘটে, শিষ্যের আতিশয্য দেখিয়া লোকের গুরুর প্রতিও অশ্রদ্ধা জন্মিয়া যায়, অক্ষয়চন্দ্রের অকৃতি অনুকরণকারীদের হাতে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভারও সেই দশা ঘটিয়াছে। এ উৎপাতের আবির্ভাব না হইলে আজি পর্য্যন্তও বাঙ্গলা সাহিত্যে অক্ষয়চন্দ্রের পূর্ব্ব স্থান বজায় থাকিত।
অন্যান্য দেশে জ্ঞানালোচনার জন্য বড় বড় সভা-সমিতি আছে। আমরা এ পর্য্যন্ত কেবল রাষ্ট্রীয় কোলাহল লইয়াই বিব্রত ছিলাম। দেশের অন্যান্য অভাব ও অভিযোগের, ভাব ও কর্ম্মচেষ্টার প্রতি দৃকপাত করিবার অবসর ছিল না। এ বিষয়ে বাঙ্গলা দেশে যে পরিমাণ অনবধানতা দেখিতে পাওয়া যায়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে তাহা দেখা যায় নাই, বোম্বাইএ বহুকাল হইতে, গ্রীষ্মের প্রাক্কালে, একটা করিয়া বিদ্বজ্জন-সমাগম হইয়া থাকে। এই উপলক্ষে দেশের মনীষীগণ বিবিধ বিষয়ে সারগর্ভ প্রবন্ধাদি পাঠ করিয়া জ্ঞানচর্চ্চার সহায়তা করিবার চেষ্টা করেন। এ সকল সভাতে বহুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ সমবেত হইয়া বিবিধ তত্ত্বের আলোচনা করেন, মান্দ্রাজেও কিছুকাল হইতে এই পদ্ধতিটী প্রচলিত হইয়াছে। সেখানেও প্রতিবর্ষে বসন্ত সময়ে, কোনও পর্ব্বাহকে আশ্রয় করিয়া এক একটা বিদ্বজ্জন সমাগম হয়। এবারে এই উপলক্ষে অনেক গুলি সারগর্ভ প্রবন্ধ পঠিত হইয়াছে, তাহার সংক্ষিপ্ত সারসংগ্রহ স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। বোম্বাই ও মান্দ্রাজের এ সকল সভা কতকটা ইংলণ্ডের ব্রিটিশ এসোসিয়েষণের ছাঁচে গঠিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। আমরা এ পর্য্যন্ত এরূপ কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করি নাই। কিন্তু বিগত কতিপয় বৎসর হইতে বাঙ্গলাসাহিত্য-সম্মিলন সেরূপ ভাবে গড়িয়া উঠিতেছে বলিয়া মনে হয়। অন্ততঃ এই বার্ষিক সম্মিলনটীকে আমাদের নিজেদের সাহিত্য ও সাধনার একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠানরূপে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করা কর্ত্তব্য। এখানে দেশের শ্রেষ্ঠতম মনীষীগণ সমবেত হইয়া বিবিধ তত্ত্বের আলোচনা করিবেন, চিন্তার রাজ্যে, ভাবের রাজ্যে, বিজ্ঞানের রাজ্যে, কাব্যের রাজ্যে, মৌলিকগবেষণায় ও রসসৃষ্টিব্যাপারে, দর্শনে, ইতিহাসে, সঙ্গীতে, স্থাপত্যে, চিত্রে ও ভাস্কর্য্যে, সমস্ত জীবনের ও স্বজাতিব সাধনার বিবিধ বিভাগে, বৎসর কাল মধ্যে আমরা কতটা উন্নতিলাভ করিয়াছি, কোন্ দিকে কতটা নূতন চেষ্টা ইইয়াছে, কোন্ দিকে কতটা সংশোধন আবশ্যক, এ সকল বিষয়ের আলোচনা করিবেন। এইরূপে ইংরেজ মনীষীসমাজে ব্রিটিশ এসোসিয়েষণ যে স্থানটা অধিকান করিয়া আছে, বাঙ্গলার সুধীমণ্ডলীমধ্যে আমাদের এই সাহিত্য-সম্মিলন ঠিক সেই স্থানটী অধিকার করুক, এই দিকেই এই বার্ষিক অনুষ্ঠানটীকে ফুটাইয়া ও গড়িয়া তুলিতে হইবে। আমবা কেহ কেহ, হয় ত ইতিমধ্যেই, এই ভাবে এই সাহিত্য সম্মিলনকে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছি।
আর যাঁরা এই আদর্শ মনে লইয়া চট্টগ্রামের সাহিত্য সম্মিলনের কার্য্যবিবরণের বিচার আলোচনাতে প্রবৃত্ত হইবেন, তাঁরা সভাপতি মহাশয়ের অভিভাষণে যে কিয়ৎপরিমাণে নিরাশ হইবেন না, এমন বলিতে পারা যায় না। অক্ষয়চন্দ্র বাঙ্গলা সাহিত্যের বঙ্কিম যুগের এক জন প্রধান কর্ম্মী। তাঁর চক্ষের উপরে বাঙ্গলায় এক নবযুগের আবির্ভাব হইয়াছিল। তিনি সাক্ষাৎভাবে এ যুগের জন্ম কর্ম্ম সকলই অবগত আছেন। আমরা তাঁর নিকটে বিগত চল্লিশ বৎসরের সাহিত্যের ভিতর কাব্য বিকাশের ইতিহাসটা শুনিব, আশা করিয়াছিলাম। বঙ্গদর্শন প্রথমে বাঙ্গলা দেশে ও বাঙ্গলাভাষাতে যে নূতন আদর্শ ফুটাইয়া তোলে, তার পরে ক্রমে সেই ভাব, সেই শক্তি, সেই চিন্তা, পরিপক্কতা প্রাপ্ত হইয়া, তাঁর আপনাব “নব জীবনে” ও বঙ্কিমচন্দ্রের “প্রচারে” যে আকার ধারণ করে, কেমন করিয়া বঙ্গদর্শনের প্রথম বয়সের বহির্ম্মুখীনতা ক্রমে আপনাকে খুঁজিতে যাইয়া, আপনাকে হারাইয়া ফেলিবার আয়োজন করিয়া তুলে, এবং ক্রমে পুনরায় আত্মস্থ হইয়া, নিজের মধ্যে ফিরিয়া আসিবার জন্য লালায়িত হয়, কেমন করিয়া একদিকে “নবজীবন” ও অন্য দিকে “প্রচার” এই প্রত্যাবর্ত্তনের ইতিহাসরূপে বাঙ্গলাসাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তারপর ক্রমে আজ সেই প্রত্যাবর্ত্তনই পূর্ণতর, গভীরতর, বিশদতর আকারে, সমধিক সত্যোপেত হইয়া, এক বিরাট ও সর্ব্বতোমুখী সমন্বয় ও সামঞ্জস্যের পথে আসিয়া দাঁড়াইতেছে—বাঙ্গালীর প্রাণপণের এই চল্লিশ বৎসরের এই পবিত্র পুরাণ-গাথা অক্ষয়চন্দ্রের মুখে শুনিয়া কৃতার্থ হইব, ভাবিয়াছিলাম। এ কথার সঞ্জয়-রূপে, বাঙ্গলাসাহিত্যিকদিগের মধ্যে আজ এক অক্ষয়চন্দ্রই বাঁচিয়া আছেন। এই আশা করিয়া যাঁরা তাঁর চট্টগ্রামের অভিভাষণটা পড়িতে বা শুনিতে গিয়াছিলেন, তাঁরা যে হতাশ হইয়াছেন, ইহা কিছুই বিচিত্র নহে।
কিন্তু এ হতাশ সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। সকলে সকল কাজ করিতে পারে না। বঙ্কিমযুগের সাহিত্য-সমালোচনার কাজ এ বয়সে অক্ষয়চন্দ্রের পক্ষে অসম্ভব। তবে তিনি একটা কাজ করিতে পারিতেন। কেবল এবারতের দিক দিয়া চল্লিশ বৎসরের সাহিত্যের গতি কোন্ দিকে, ভাল কি মন্দ, উন্নত না অবনত হইয়াছে, এ কথাটা অক্ষয়চন্দ্র যেমন ভাবে উপদেশ দিতে পারিতেন, তেমনভাবে উপদেশ দিবার শক্তি ও অধিকার বাঙ্গলা সাহিত্যিকদিগের মধ্যে আর কাহারও বড় বেশী আছে কি না সন্দেহ। এই এবারতে—ইংরেজীতে ইহাকে style বলে,—অক্ষয়চন্দ্র এক সময়ে অসাধারণ কৃতিত্বলাভ করিয়াছিলেন। আজকাল তো, বলিতে গেলে দু’চার জন লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকের লেখাতে ভিন্ন এবারত বস্তুটাই বাঙ্গলা সাহিত্য হইতে লোপ পাইবার উপক্রম হইয়াছে। এ বিষয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙ্গলাসাহিত্যের যে অপকার করিতেছেন সাহিত্য-সম্মিলন হইতে তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া আবশ্যক ছিল। আর অক্ষয়চন্দ্রের এ বিষয়ের ব্যবস্থা দিবার যতটা অধিকার আছে, আর কোনও জীবিত সাহিত্যিকের সে অধিকার নাই। অক্ষয়চন্দ্র এ বিষয়ে যে একেবারেই কোনও আলোচনা করেন নাই, তাহাও নহে। কিন্তু আলোচনাটা আরো গভীর, আরো পরিস্ফুট হইলে ভাল হইত।
অক্ষয়চন্দ্র তাঁর অভিভাষণে এবারতের বা styleএর একটা দিকমাত্র দেখাইয়াছেন। ভাষা প্রাণময়ী হইবে। দেশের, অর্থাৎ দশের প্রাণবস্তু সংস্পর্শে ভাষা আপনার প্রাণশক্তি লাভ করিয়া থাকে। সুতরাং দেশের প্রাণের চাবিটী হাতে লইয়া, সাহিত্যিককে সাহিত্যালোচনায় প্রবৃত্ত হইতে হইবে। কথাটা খুবই সত্য। তোড়ায় বাঁধা ফুলের ক্ষণিক রূপ যতই থাকুক না কেন, প্রাণগত রস যে নাই, ইহা সকলেই জানে। ধার করা কথাও কতকটা এইরূপ। তার রস থাকে না, দুদণ্ড পাঠককে মুগ্ধ করিতে পারে, কিন্তু চিরদিনের জন্য স্নিগ্ধ করিবার শক্তি তার থাকে না। ইংরেজ ক্লান্ত হইলে, ক্লিষ্ট হইলে, ‘ডিয়ার’ ‘ডিয়ার’ বলিয়া হাই তুলেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ডিয়ার কথাটা খুবই মিষ্টি হইতে পারে, ইহাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমরা ‘মা’ বলিয়াই হাই তুলি, গা ভাঙ্গি, দুঃখক্লেশে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলি! এই ‘মা’ কথাই আমাদের প্রাণ জুড়াইবার সঙ্কেত। এখানে প্রিয় বলিলেও চলিবে না, জননী বলিলেও চলিবে না। ‘মা’ই বলিতে হইবে। এইরূপ ভাবের রাজ্যে, প্রাণের রাজ্যে, ভিতরকার আদানপ্রদানের ব্যবসায়ে, দেশের ও দশের চিরাভ্যস্ত প্রাণের কথাগুলি ব্যবহার করিতেই হইবে, না করিলে, বাঙ্গলাসাহিত্য ও বাঙ্গলাভাষা একটা জীবন্ত বস্তু আর থাকিবে না। রসসাহিত্যে—কাব্যে, উপন্যাসে, নাটকে,—এই প্রাণের ভাষার সেতুকে আশ্রয় করিয়া দেশের প্রাণের সঙ্গে একটা জীবন্ত যোগ রাখিতেই হইবে। এখানে জলধরপটলসংযোগে কোনও রূপ-রসের বর্ণনাতে রসভঙ্গ হইবেই হইবে। নিতান্ত পরের ধনে পোদ্দারি করিয়া যে সকল ভূঁইফোড় লেখক সহসা সাহিত্য-ক্ষেত্রে একটা দিগ্গজ খ্যাতি লাভের জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠেন, তাঁরা ছাড়া, আর কোনও কবি, বা ঔপন্যাসিক, বা নাটককার, বোধ হয় এ উদ্ভট চেষ্টাও করেন না।
অক্ষয়চন্দ্র তাঁর অভিভাষণে এই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়টীর অবতারণা ও আলোচনা করিয়াছেন। এ ছাড়াও যে সাহিত্যের আর একটা দিক আছে, ইহা যেন তিনি ভুলিয়াই গিয়াছেন, মনে হয়। ভাষা ভাবের বাহন। ভাবে অশেষবিধ বৈচিত্রা থাকে। কোনও একটা রসকে ধরিয়া সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। কখনও ঐশ্বর্য্য, কখনও মাধুর্য্য, কখনও বীভৎস, কখনও বাৎসল্য; কখনও রুদ্র, কখনও করুণ। এখন প্রশ্ন এই যে দেশের ও সমাজের নিম্নস্তরে এ সকল বিবিধ রসের প্রকাশ যথাযোগ্য ভাবে ভাষায় হয় কি? রসের যন্ত্র ভাষা নহে,―স্নায়ু ও পেশি। অশিক্ষিত চাষী যখন রুদ্রভাবে উন্মত্ত হইয়া পড়ে তখন তার হাতের ও বুকের পেশি সকল ফুলিয়া উঠে, তার চক্ষু জবাফুলের মত হয়, মুখভাব সংহার-মূর্ত্তি ধারণ করে;—কিন্তু রুদ্ররসের উপযোগী শব্দ প্রবাহ সে ফুটাইয়া তুলিতে পারে কি? হদ্দমুদ্দ “আয় তো শালা” বলিয়া সে বাক্যস্ফোট করিয়া ছুটিয়া যায়। আচ্ছা, এই চিত্রটী সাহিত্যে ফুটাইতে গেলে, নিতান্ত সহজ, গ্রাম্যজন বোধসুলভ ভাষায় কি তাহা সম্ভব হইবে? সমাজের নিম্নস্তরের অন্তরটা শিশুর মতন; তাদের ভাষাও স্বল্পবিস্তর শিশুরই ভাষা-আধ আধ। তাদের মুখে ঐ ভাষাতে সকল রসই ফুটিয়া উঠে, আর ফুটিয়া উঠে, কেবল শব্দ সহায়ে নয়, কিন্তু মুখের ভাবে, চলনের বা দাঁড়ানর ভঙ্গীতে। পুস্তকে তো আর এই সকল আনুসঙ্গিক রসগুলিকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। করিতে গেলে, হয় এ সকলের লিপিচিত্র আঁকিয়া তুলিতে হইবে, না হইলে, যে রস ইহারা কতকটা কথায়, কতকটা হাবেভাবে প্রকাশ করে, সেই রসের উপযোগী ভাষা ব্যবহার করা প্রয়োজন। অক্ষয় বাবু যে এ সকল কথা জানেন না, বা বুঝেন না, এমন অসঙ্গত ও অবাস্তব কথা কল্পনাও করি না। কিন্তু তিনি এই অভিভাষণে এদিকে বিশেষ মনোযোগ করেন নাই বলিয়া, এবারতের বা style এর সমালোচনা হিসাবে তাঁর বক্তৃতাটী অপূর্ণ রহিয়া গিয়াছে।
আর এবারতের বা styleএর সম্বন্ধে অক্ষয়চন্দ্র যে দিকটা দেখাইয়াছেন, তাহা সত্য হইলেও আংশিক সত্য মাত্র, ক্ষেত্র বিশেষেই তাঁর বিধান শিরোধার্য্য করা কর্ত্তব্য, সকল ক্ষেত্রে তাঁর কথা মানিয়া চলিতে গেলে ভাষার গতির দিকটা, উন্নতির দিকটা, জটিলতার ভিতর দিয়া যে কলাকুশলতা প্রকাশিত হয়, সেই প্রাণহারী জটিলতার দিক্টা যে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে না, এমন কথা বলিতে পারি না; অক্ষয়চন্দ্রের মতন এমন সুকৃতি লেখক নিজেও এ কথা বলিবেন, বলিয়া বোধ হয় না। কিন্তু এ ছাড়া এবারতের আর একটা দিক্ও আছে। সে দিক্টার প্রতি লক্ষ্য করিয়াও অক্ষয়চন্দ্র কোনও উপদেশ করেন নাই। বাঙ্গলা ভাষার এবারতটা বাঙ্গলায় হইবে, আর কোনও দেশের হইবে না, ইহা সকলেই স্বীকার করিবেন। কিন্তু কথাটা যে কত বড়, সকল বাঙ্গালী সাহিত্যিকও ইহা ভাল করিয়া সর্ব্বদা ধারণা করিয়া থাকেন কি না সন্দেহ। মানুষের চেহারা যেমন, ভাষার এবারত সেইরূপ। অর্থাৎ সকল মানুষের রক্ত মাংস পেশি অস্থি মজ্জা মেদ, শারীর উপাদান ও শারীর প্রকৃতি মোটের উপরে এক হইলেও, এই সকল উপাদান ও এই প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়াই প্রত্যেক মানুষের মুখে, ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, বিশেষ এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্রিয়াতে এমন একটা বিশেষত্ব ফুটিয়া উঠে, যাহা অপর সকল মানুষে ফুটে না। শরীর সম্বন্ধে এই বিশেষত্বটুকুই সে ব্যক্তির নিজত্ব বা ব্যক্তিত্ব। সেইরূপ মনেরও একটা বিশেষত্ব আছে। যে ভাবে সে চিন্তা করে, যে ছাঁচে ফেলিয়া সে জগতের অশেষবিধ বস্তু ও বিষয়কে আপনার মনের ভিতরে গুছাইয়া রাখে, এবং যে আকারে এ সকল বিষয় সে অন্যের নিকটে প্রকাশ করে, এ সকলের ভিতর দিয়া, তার মনের নিজত্ব বা ব্যক্তিত্ব বস্তু ফুটিয়া উঠে। এইটীই তার নিজের ‘এবারত’ বা style; এই এবারতটা মানুষের মনের, চিন্তার, ভাব-রাজ্যের, অন্তর্জ্জগতের চেহারা। কার চিন্তার ছাঁচটা কিরূপ, কার মনের শক্তি ও গতি কোন্ দিকে, তার এবারতের ভিতর দিয়া তাহা ধরা পড়ে। বাঙ্গালীর একটা মন আছে—অর্থাৎ সমষ্টিগত এই যে বঙ্গসমাজ, বহু শতাব্দ সহস্রাব্দ ধরিয়া এই ভারতবর্ষে যে সমাজ অপরাপর ভারতীয় সমাজ হইতে একটু পৃথক্ হইয়া, একটা কিছু অল্পবিস্তর বিশেষত্ব লইয়া দাঁড়াইয়া আছে ও বাড়িয়া উঠিয়াছে, তার মনের চেহারায় সেটী গাঁথিয়া আছে। বাঙ্গলা সাহিত্যে, খাঁটি বাঙ্গলা এবারতে বা style এ বাঙ্গালীর এই মানসিক চেহারাটা ধরা পড়ে। এই চেহারাটা যেখানে নাই, বাঙ্গলা এবারত, অর্থাৎ বাঙ্গালীর খাঁটি সাহিত্যের ছাঁচটীও সেখানে নাই। এ ছাঁচটী আধুনিক বাঙ্গলাসাহিত্যে খুবই যেন উলট্পালট্ হইয়া যাইতেছে। বিদ্যা যখন হজম হয় না, তখন সাহিত্যে অজীর্ণ-লক্ষণ সর্ব্বত্রই দেখা গিয়া থাকে। বিদেশের বিদ্যাশিক্ষায় কোনও অপরাধ হয় না। না শিখিলে বরং স্বদেশের প্রাণবস্তুর সঙ্গে সঙ্গে স্বজাতির সাহিত্যও জীর্ণ ও সংকীর্ণ হইয়া থাকে। ফলতঃ বিদ্যা কোনও দেশ বা জাতির নিজস্ব বস্তুও নহে। এই একাদশ ইন্দ্রিয় আর এই সকল ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত এই বিচিত্র ব্রহ্মাণ্ড,—এই লইয়াই তো সকল প্রকারের লৌকিক বিদ্যার প্রতিষ্ঠা হয়। এই ইন্দ্রিয়গুলিও সকল মানুষেরই আছে, আর এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডও সকলেরই ভোগদখলে রহিয়াছে। সুতরাং বিদ্যাটাও সকলেরই সম্পত্তি। কিন্তু বিদেশের বিদ্যা শিখিলেই তো হয় না, হজম করাও চাই। এই হজমটা যারা করিতে পারে না, তাদের হাতেই বিদেশের বিদ্যাপ্রভাবে স্বদেশের অন্তঃপ্রকৃতি ও স্বদেশী সাহিত্যের এবারত, উভয়ই নষ্ট পাইবার উপক্রম হয়। এ বিপদটা আমাদের বড় বেশী। আমাদের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিকেরাও সকল সময়ে, সকল বিষয়ে এ বিপদের হাত এড়াইতে পারেন নাই। বিদেশী ধর্ম্মের প্রভাবে, আমাদের মধ্যে, আধুনিক স্বাদেশিক ধর্ম্মসাহিত্যে, এমন কতকগুলি শব্দ ঢুকিয়া পড়িয়াছে, যার সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে আমাদের নিজেদের সভ্যতা ও সাধনার, লোক প্রকৃতির ও সমাজ প্রকৃতির কোনই সঙ্গতি নাই। শব্দ ধার করা যে টাকা ধার করার মতন একটা অতিশয় গুরুতর অন্যায়, এমন কথা বলি না। কিন্তু যখন নিজেদের সাহিত্য ও শাস্ত্রভাণ্ডারে সে অর্থপ্রকাশক শব্দ পাওয়া যায় না, তখনই তো শব্দ ধার করা প্রয়োজন। এ ভাবে ধার করাতে কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু যে বিষয়ে নিজেদের কোনও দৈন্য নাই, সে বিষয়ে পরের পরিভাষা ধার করিয়া আনিলে, নিজের শব্দসম্পত্তির বৃদ্ধি হওয়া তো দূরের কথা, ভাবরাজ্যে এবং জ্ঞানরাজ্যে পর্য্যন্ত একটা অলীকতা আসিয়া পড়ে। শব্দ, বস্তুর বা রসের সঙ্কেত বই তো আর কিছুই নয়! যদি বস্তুই আমাদের না থাকে, যে শব্দ যে রসের সঙ্কেত সে রসের আস্বাদনই যদি আমাদের ভাগ্যে কখনও না ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে শব্দ আনিলেই তো চলিবে না। সে শব্দকে সত্যোপেত ও শক্তিশালী করিতে হইলে, সে বস্তুটাকেও লাভ করিতে হইবে, সে রসেরও সাধনা করা আবশ্যক হইবে। আর এইখানেই যত বিপদ উপস্থিত হইবার আশঙ্কা জাগিয়া উঠে। এ বিপদে পড়িয়া কোনও দিকে কেবল বাঙ্গলা এবারত ও বাঙ্গলা সাহিত্য নয়, কিন্তু বাঙ্গালীর চরিত্র পর্য্যন্ত ভিত্তিহীন ও শক্তিহীন হইয়া পড়িতেছে।
দুই একটী দৃষ্টান্ত দিয়া আমার কথাটা বিশদ করিবার চেষ্টা করিতে পারি। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র বাঙ্গলা ভাষাকে নানা দিকে খুবই ফুটাইয়া তুলিয়াছেন, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবেন, যদিও বাঙ্গলা সাহিত্যের আলোচনায় বিদ্যাসাগর বা অক্ষয়কুমার, বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের মতন, কেশবচন্দ্রের সাহিত্যসেবার বড় একটা বেশী উল্লেখ প্রায় শুনিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু অন্য দিকে কেশবচন্দ্র বাঙ্গলা ভাষায় এমন দু চারিটা নূতন শব্দের প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন, যাহা খাঁটি বাঙ্গলা নয়, যার ভিতরকার বস্তুর বা রসের সঙ্গে আমাদের ভিতরকার পূর্ব্ব অভিজ্ঞতার বা ইতিহাসের কোনই সম্পর্কও নাই। “বিবেক-বাণী” এই জাতীয় একটা কথা। আমাদের চিন্তাতে ও সাধনায় বিবেক শব্দের প্রতিষ্ঠা বহুকাল হইতেই হইয়াছে। উপনিষদ্ যুগে ইহার প্রথম পরিচয় পাই। কিন্তু সে বস্তু আর কেশবচন্দ্র যাকে বিবেক বলিয়া চালাইতে চেষ্টা করিয়াছেন, এ বস্তু, এক নহে। আমাদের বিবেক সাধন রাজ্যের একটা অতি নিগূঢ় ও প্রত্যক্ষ বস্তু। অনিত্য সংসারকে নিত্য পরমার্থ হইতে পৃথক্ বলিয়া জানার নাম আমাদের বিবেক। এ বিবেক অতি দুর্ল্লভ বস্তু। লাখের মধ্যে একেরও এ বস্তু লাভ হয় কি না সন্দেহ। কিন্তু কেশব বাবু “বিবেক” বলিয়া যে বস্তুর প্রতিষ্ঠা করিলেন, সিদ্ধ অসিদ্ধ সকলেই তার দাবী করে। এ বস্তু ইংরেজের কন্সিয়ান্স, (Conscience); আমাদের বিবেক নয়। ইংরেজ যাকে conscience বলে, আমরা তাকে ধর্ম্মবুদ্ধি বলিয়া আসিয়াছি। বিবেক ইহার অনেক উপরকার রাজ্যের কথা। আর কেশব বাবু ইংরেজের conscienceকে আমাদের প্রাচীন সাধনার বিবেকের আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, আমাদের আধুনিক ধর্ম্ম-চিন্তার ও ধর্ম্মসাধনার যে একেবারেই কোনও অনিষ্ট করেন নাই, এমনই বা বলা যায় কি? রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গলা ভাষাকে বহুবিধ অভিনব শব্দসম্পদে পরিপুষ্ট করিয়াছেন সত্য, এ ঋণ বাঙ্গালী চিরদিন কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করিবে। কেশবচন্দ্রের মতন, তিনিও দু একস্থলে বিদেশীয় ভাবের অনুকরণে এরূপ দু একটী শব্দের সৃষ্টি করিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ তাঁর বিশ্বমানব কথাটার উল্লেখ করা যায়। ইংরেজের ‘হিউম্যানিটি’ রবীন্দ্রনাথের “বিশ্বমানব”। এই হিউম্যানিটি বস্তু আধুনিক য়ুরোপীয়েরা কল্পনাবলে সৃষ্টি করিয়াছে, সাধনাবলে লাভ করে নাই। ইহা কৃষ্ণত্ব, শুক্লত্ব প্রভৃতির মতন একটা গুণবাচক শব্দ মাত্র, নিজস্ব বস্তুত্ব বা স্বরূপ ইহার কিছুই নাই। অথচ য়ুরোপীয়েরা হিউম্যানিটি বলিয়া যে তত্ত্বকে হাতড়াইতেছে, তাহা আমাদের সাধনাতে বহুকাল হইতে, নারায়ণ নামে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছেন। এই নারায়ণ গুণবাচক শব্দ নহে, বস্তুবাচক শব্দ। নারায়ণ abstraction নহেন, কিন্তু person. আমাদের এমন নারায়ণ থাকিতে য়ুরোপীয় হিউম্যানিটিকে আমাদের ভাষাতে ও চিন্তাতে “বিশ্ব-মানব” রূপে প্রতিষ্ঠা করার কোন প্রয়োজন আছে কি? এইরূপ অকারণে পরের সাধা সুর ভাঁজিতে গিয়া নিজের অভ্যস্ত শ্রেষ্ঠতর স্বরগ্রামকে ভুলিবার উপায় করিয়া আমরা অলক্ষ্যে ভাষার ও সাহিত্যের কোন অমঙ্গল সাধন করিতেছি কি না ইহা ভাবিয়া দেখিবার সময় আসিয়াছে।
অক্ষয়চন্দ্র এদিক্ দিয়া এবারতের (style) আলোচনা করেন নাই। এই সকল দিক্ দিয়া আলোচনা করিতে গেলে তিনি আপনিই আপনার সিদ্ধান্তের অপূর্ণতা প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেন। ভাষা দেশের লোকের প্রাণসংস্পর্শে প্রাণময়ী হইবে, কথাটা অতি সত্য। কিন্তু প্রাণবস্তু তো আর জড় নহে। নিয়তই যে এই প্রাণ স্ফূরিত হইতেছে; নিত্য নূতন জ্ঞানে, নিত্য নূতন শক্তিও নিত্য নূতন রস আকর্ষণ করিয়া, দেশের প্রাণবস্তু উত্তরোত্তর বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। এ প্রাণ যে সেই মহাপ্রাণেরই ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্রতম তরঙ্গভঙ্গ মাত্র। কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রাণের মধ্যেই সেই অনাদি অনন্ত বিশ্ব-প্রাণ, অনাদি অনন্তরূপেই লুকাইয়া আছেন। এই জন্যই এই প্রাণ ক্রমে বাড়িয়া উঠে। এ বিকাশের বিরামও নাই, শেষও নাই। সুতরাং যতটুকু ফুটিয়াছে, তাহাকে ধরিয়াই পড়িয়া থাকিলে চলিবে না। যা এখনও ফোটে নাই—কিন্তু ফুটিবার উপক্রম করিতেছে, তার প্রতিও লক্ষ্য রাখিতে হইবে। সুতরাং কেবল স্থিতির দিক নয়, গতির দিক দেখিয়াও সাহিত্যকে চলিতে হইবে। দশের পুরাভ্যস্ত কথার সাহায্যে, দেশের প্রাণের অন্তঃপুরে সাহিত্যিককে যেমন প্রবেশলাভ করিতে হইবে, সেইরূপ আবার ভিতরের ও বাহিরের অবস্থার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোকের চিত্তে যে সকল নূতন নূতন ভাব ও আদর্শ স্ফুটনোন্মুখ হইতেছে, অভিনব শব্দ সৃষ্টি করিয়া, সে গুলিকেও ফুটাইয়া তুলিতে হইবে, নতুবা সাহিত্যকে সঞ্জীবিত রাখা যে অসাধ্য হইয়া পড়িবে। অক্ষয়চন্দ্র এ সকলই জানেন ও বুঝেন; তবে তাঁর অভিভাষণে এদিক্টা তেমন ফুটিয়া উঠে নাই। লোকে কি জানি তাঁহাকে ভুল বুঝে, এই জন্যই এ সম্বন্ধে এত কথা বলিতে হইল। অক্ষয়চন্দ্র যদি নিজে আর একদিন সাহিত্যের এই গতির দিক্টা ভাল করিয়া বুঝাইয়া দেন, আমরা সকলেই কৃতার্থ হইব।