চরিত-কথা (বিপিনচন্দ্র পাল)/রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্র-সম্বর্দ্ধনা—একদিক্
রবীন্দ্রনাথের সম্বর্দ্ধনা করিয়া, বাঙ্গালী আজ আপনাকেই লোক সমক্ষে সম্বর্দ্ধিত করিয়াছে। কোনো জাতির যখন আত্মচৈতন্যের উদয় হয়, তখন তারা এইরূপ করিয়াই আপনাদের সমাজের মহৎলোকদিগের মহত্ত্বের সমাদর করিয়া, পরোক্ষভাবে আপনাদিগকে বাড়াইয়া তুলে। যে গুণের আদর জানে না, সে আপনিও গুণহীন হইয়া পড়িয়া থাকে। যে যোগ্য ব্যক্তির উপযুক্ত সম্বর্দ্ধনা করিতে কুণ্ঠিত হয়, সে আপনিও যোগ্যতাভ্রষ্ট হইয়া রহে। বাঙ্গালী একদিন গুণীর আদর ভুলিয়া গিরাছিল। যোগোর সম্বর্দ্ধনা যে সমাজের একটা অতি প্রধান কর্ত্তব্য, বাঙ্গলার সমাজ একদিন এ বিধানকে উপেক্ষা করিয়া চলিয়াছিল। মধুসূদন ও হেমচন্দ্রের অন্ত্যলীলা তার সাক্ষী। কিন্তু বাঙ্গলার সে আত্মবিস্মৃতি ক্রমে ঘুচিয়া যাইতেছে। এই কয় বৎসরে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের এই সম্বর্দ্ধনাও তারই প্রমাণ।
রবীন্দ্র সম্বর্দ্ধনা—আর এক দিক্
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধ আপনার প্রতিভা-বলেই এইরূপ সমৃদ্ধ রাজসিক সম্বর্দ্ধনা পাইয়াছেন, একেবারে এত বড় কথাটা বলিতেও সঙ্কোচ হয়। সরস্বতীর বরপুত্র হইয়াও, রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্মীর কোমল অঙ্কেই ভূমিষ্ঠ হন। আজীবন তিনি সেই সম্পদের মধ্যেই লালিত-পালিত, সেবিত-বর্দ্ধিত হইয়া আসিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি বা মনীষী নহেন। তিনি “প্রিন্স” দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র। কলিকাতার প্রসিদ্ধ ধনী ঠাকুর বংশের কুল-প্রদীপ। বাঙ্গলার বুনিয়াদী ও ইংরেজের বানানো রাজ-রাজড়ার সঙ্গে তাঁর পরিবার-পরিজনের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। তাঁর কুলের গৌরব ও ধনের গৌরব, রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক কবি-প্রতিভার সঙ্গে মিলিত হইয়া স্বর্ণ-সোহাগা যোগ সম্পাদন করিয়াছে। এরূপ যোগাযোগ সংসারে অতি বিরল। এই শুভযোগ না হইলে আজ রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালীর দ্বারা যে সমারোহসহকারে সম্বর্দ্ধিত হইয়াছেন, সেরূপ ভাবে সম্বর্দ্ধিত হইতেন কি না সন্দেহের কথা।
ইহাতে রবীন্দ্রনাথের অগৌরবের কথা কিছুই নাই। যেখানেই নানা ভাবের, নানা চরিত্রের, নানাবিধ শিক্ষাদীক্ষাপ্রাপ্ত নানা লোকে সমবেত হইয়া, একসঙ্গে কোনো পূজা-অর্চ্চনার আয়োজন করে, সেখানে এরূপ ভাবের খিচুড়ী পাকিয়া যাইবেই যাইবে। এ ক্ষেত্রে কখনো সকলে এক ভাবাপন্ন হইয়া আসে না। কেহ বা অর্চ্চিতের রূপে মুগ্ধ হইয়া আসে, কেহ বা তাঁর গুণে বশ হইয়া আসে; কেহ বা স্বার্থের সন্ধানে কেহ বা পরমার্থের অন্বেষণে আসে। আর কেহ বা সম্পূর্ণরূপেই উদাসীন ও উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে, শুধু যজ্ঞের জনতা বৃদ্ধি করিবার জন্যই পূজাস্থানে আসিয়া ভিড় করিয়া দাঁড়ান। কিন্তু এই সকলের দ্বারা উপাসকের অধিকারই জ্ঞাপিত হয়। উপাসকের ক্ষুদ্রতার দ্বারা কুত্রাপি উপাস্যের যোগ্যতার কোনো হানি হয় না। যিনি যে ভাবেই রবীন্দ্র-সম্বর্দ্ধনায় যোগ দিন না কেন, তাঁর ভাব তাঁহাকেই কেবল ক্ষুদ্র বা মহৎ করিয়াছে, তদ্বারা রবীন্দ্রনাথের যোগ্যতার কিছুই হ্রাস-বৃদ্ধি হয় নাই। এ যোগ্যতা রবীন্দ্রনাথের কুলের নহে। এ যোগ্যতা তাঁর কৌলিক ধনমর্য্যাদার নহে। এ যোগ্যতা তাঁর অলৌকিক কবি-প্রতিভার। তাঁর পৈত্রিক কুল ও ধনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই কবি-প্রতিভার এরূপ মণিকাঞ্চন যোগ না থাকিলে, বাঙ্গালী হয় ত আজ এইভাবে তাঁর সে শুদ্ধ সাত্ত্বিকী যোগ্যতার সম্বর্দ্ধনা করিত না। কিন্তু তাহাতে কেবল আমাদেরই হীনতা প্রকাশিত হইত, রবীন্দ্রপ্রতিভার অযোগ্যতা প্রমাণিত হইত না।
বাঙ্গলা সাহিত্যে ও বাঙ্গালী জীবনে রবীন্দ্রনাথ
বাঙ্গলা ভাষা ও বাঙ্গলা সাহিত্যকে যাঁহারা এই কালে অভূতপূর্ব্ব শ্রীসম্পদে বিভূষিত কবিয়াছেন, বাঙ্গালীর জ্ঞান ও বাঙ্গালীর ভক্তিকে, বাঙ্গালীর আদর্শ ও বাঙ্গালীর আশাকে, বাঙ্গালীব ধর্ম্ম ও বাঙ্গালীর কর্ম্মকে যাঁরা ইদানীন্তনকালে নানা প্রকারে ফুটাইয়া ও বাড়াইয়া তুলিয়াছেন; রবীন্দ্রনাথ যে তাঁদের অগ্রণীদলভুক্ত এ কথা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না। ডাক্তার যেমন শব-ব্যবচ্ছেদ করিয়া শারীরতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন, সাহিত্য-সমালোচক যদি সেই প্রণালীতে রবীন্দ্রনাথের চিত্তের ও চরিত্রের বিশ্লেষণ করিতে আরম্ভ করেন, তবে এদিক ওদিক দিয়া, অনেক অপূর্ণতা খুঁজিয়া পাইবেন, জানি। বাঙ্গলার অপরাপর শ্রেষ্ঠ কবিদিগের তুলনায় রবীন্দ্রের প্রতিভার সমালোচনা করিলে, তিনি তাঁদের চাইতে কোথায় বড় বা কোথায় ছোট, এ সকল কথা লইয়া অনেক তর্ক-বিতর্ক উঠিতে পারে, ইহাও মানি। বাঙ্গলা গদ্যে রবীন্দ্রনাথের দান কতটা ও স্থান কোথায়, এ প্রশ্ন লইয়াও মতভেদ হইতে পারে, স্বীকার করি। রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নের সাধনা ও সমাজের আদশ সর্ব্ববাদীসম্মত হওয়া সম্ভবই নহে। এ সকল মতান্তর অনিবার্য্য। কিন্তু এ সকল খণ্ডতা দ্বারা কোনো মহিয়সী প্রতিভার বিচার-বিবেচনা হয় না, হইতেই পারে না। কোনো কিছুরই সত্যকে তার আংশিকতার মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। রূপের যাচাই করিতে হইলে যেমন তাহাকে সমগ্রভাবে দেখিতে হয়, ভাগ ভাগ করিয়া দেখিলে সত্য দেখা হয় না, রূপ-বস্তুটা সমগ্রেই থাকে, একত্বেই বিরাজ করে, খণ্ডে খণ্ডে পৃথকভাবে তাহাকে পাওয়া যায় না; নাক, কাণ, চোক, হাত, পা, কটি, চুল, রং এ সকল খুঁটিনাটি ধরিলে প্রকৃত রূপের পরিচয় পাওয়া যায় না, তার ঠিক মূল্য নির্দ্ধারণও সম্ভব হয় না। অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন মনীষীদিগের অলৌকিক প্রতিভার বিচার ও সেইরূপ সমগ্রের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াই করিতে হয়। টুকরা টুকরা করিয়া, তাহাকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া, ওজন করিতে গেলে, সত্যিকার বস্তুটা যে কি ও কত বড়, তাঁর সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয় না। যাঁরা খুঁটিনাটি ধরিয়া রবীন্দ্র-প্রতিভার বিচার আলোচনা করিতে যাইবেন, তাঁরা কদাপি সে প্রতিভার সম্যক পরিচয় পাইতে পারিবেন না। রবীন্দ্র কবি। রবীন্দ্র ঋষি। রবীন্দ্র শক্তিশালী লেখক। রবীন্দ্র জনপ্রিয় লোকনায়ক। জাতীয় জীবনের বিশাল কর্ম্মক্ষেত্রে রবীন্দ্র ধর্ম্ম প্রচারক ও সমাজ-সংস্কারক। এই ত্রিশ বৎসর কাল, তাঁহার অলোকসামান্য প্রতিভা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বিভাগে আত্মপ্রকাশের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাইয়াছে। ঋজু কুটিল ভাবে, তির্য্যক গতিতে, তাঁহার জীবন ও কর্ম্মস্রোত এই পঞ্চাশবৎসর কাল এক নিত্য লক্ষ্যাভিমুখে ছুটিয়াছে। তিনি নানা সময়ে নানা কথা কহিয়াছেন। নানা মত প্রচার করিয়াছেন। নানা আদর্শের অনুসরণ করিয়াছেন। অথচ তাঁর জীবনে ও চিন্তার ভাবে ও কর্ম্মে, এই সকল বিভিন্ন আদর্শ ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়া যাহা সর্ব্বদা আত্মপ্রকাশের প্রয়াস পাইয়াছে, সে বস্তু এক, বহু নহে। সে বস্তুর রূপ অনেক, কিন্তু স্বরূপ এক। সেই স্বরূপেই রবীন্দ্র-প্রতিভার প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রের প্রতিভাকে বুঝিতে হইলে, সর্ব্বাদৌ তার এই ভিতরকার স্বরূপটিকে ধরিতে হইবে।
রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ
আর আপনার স্বরূপে রবীন্দ্র জ্ঞানীও নহেন, কর্মীও নহেন, কিন্তু শুদ্ধ কবি। এই কবি বস্তু যে কি, তাহা দেখিলে চেনা যায়, কিন্তু মুখে বলিয়া বোঝান সহজ নহে। রসাত্মক বাক্যকে কাব্য বলা যাইতেও বা পারে, কিন্তু রসাত্মক বাক্যরচনায় নিপুণতা থাকিলেও, কেহ সত্য সত্য কবি নাও হইতে পারেন। চোকে যাহা দেখা যায় না, তাহাই দেখা; কাণে যাহা শোনা যায় না, তাহাই শোনা; যাহা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ নহে, তাহারই প্রত্যক্ষ লাভ করা, আর এ সকল অতীন্দ্রিয় বিষয়কে প্রত্যক্ষ করিয়া ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ রূপরসের সঙ্গে তাহাদিগকে মিলাইয়া দিয়া, এক অভূত অদ্ভুত ভাবজগতের সৃষ্টি করা, ইহাই কবির সত্যধর্ম্ম। প্রকৃত কবি তর্ক করেন না, যুক্তি করেন না, বিচার করেন না, আলোচনা করেন না, কেবল আপনার অন্তশ্চক্ষুতে সত্য ও সৌন্দর্য্য দেখেন, আর এই রূপে যাহা দেখেন, তাহাই ভাষার তুলিকায় আঁকিয়া লোকসমক্ষে ধারণ করেন। এই অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিই কবির প্রাণ। এই জন্য ঋষিদিগের ন্যায় কবিও দ্রষ্টা কিন্তু দার্শনিক নহেন, জ্ঞাতা কিন্তু বৈজ্ঞানিক নহেন। দার্শনিক সম্যক বিচারের উপরে আপনার সিদ্ধান্তকে স্থাপন করেন। কবি শুদ্ধ আত্মানুভূতির উপরে সত্যের প্রতিষ্ঠা করেন। বিচারের জন্য চারিদিক্ দেখা আবশ্যক। শুদ্ধ অনুভূতির জন্য এরূপ সম্যকদর্শন নিষ্প্রয়োজন। আমরা আজিকালি যাহাকে বিজ্ঞান বলি, যাহা প্রকৃতপক্ষে কেবল জড়বিজ্ঞান মাত্র, এই বিজ্ঞানও বিষয়ীকে পশ্চাতে রাখিয়া বিষয়কেই সর্ব্বথা এগিয়ে দেয়। জ্ঞাতার নহে, কিন্তু জ্ঞেয়ের প্রকৃতি ও গুণাদির পরীক্ষা করাই এই বিজ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য। সুতরাং এই বিজ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয়ের বিশ্লেষণ করিয়া তাহার গুণ ও ক্রিয়াদি আবিষ্কার করিতেই ব্যস্ত। এই পথে যে ভাবের যতটুকু সত্য পাওয়া যায়, বৈজ্ঞানিক তারই অন্বেষণ করেন। কিন্তু কবির পথ এ নহে। কবি বস্তুর ভিতরকার গুণাগুণের প্রতি লক্ষ্য করেন না, কিন্তু বস্তু-সাক্ষাৎকারে তাঁর আপনার অন্তরে কোন্ রসের কতটা উদ্রেক হইল, তাহাই দেখেন ও আস্বাদন করেন। বৈজ্ঞানিক যেরূপ বস্তু-তন্ত্রতা চাহেন, কবির সেরূপ বাহ্য বস্তু-তন্ত্রতার একান্তই প্রয়োজনাভাব। বৈজ্ঞানিকের অধিকার বাহিরে, বিষয়-জগতে। কবির অধিকার ভিতরে, অন্তর্জগতে। বৈজ্ঞানিক বহির্ম্মুখীন ও বিষয়াভিমুখীন। কবি অন্তর্মুখীন ও আত্মাভিমুখীন। বৈজ্ঞানিক বাহিরের প্রামাণ্য না পাইলে, সত্যের প্রতিষ্ঠা হইল বলিয়া বিশ্বাস করেন না। কবি ভিতরের ভাবের, রসের, আত্মানুভূতির প্রামাণ্যকেই সত্যপ্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট মনে করিয়া বাহিরের প্রামাণ্যের প্রতি উদাসীন হইয়া থাকেন। কবিতে ও বৈজ্ঞানিকে এই প্রভেদ। অন্তর্দৃষ্টি ও আত্মানুভূতি, এই সকলই কবি-প্রতিভার স্বরূপ। এই স্বরূপলক্ষণ যে কবির কবিত্বে যতটা বেশী প্রকাশিত হয়, তাঁর কবি— প্রতিভাকেই সেই পরিমাণে শ্রেষ্ঠ বলিতে হইবে।
রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভা
এই কষ্টিপাথর দিয়া পরীক্ষা করিলে, রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভাকে কেবল বাঙ্গলার নহে, সমগ্র সভ্যজগতের কবিসমাজে অতি উচ্চ আসন দিতেই হইবে। শব্দ-সম্পদে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কবি আরও আছেন। চিত্রাঙ্কনের চাতুর্য্যেও তাঁর সমকক্ষ কিম্বা তাঁহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট শিল্পীও পাওয়া যাইতে পারে; কিন্তু রসানুভূতির তীক্ষ্ণতা ও অধ্যাত্ম-দৃষ্টির প্রসার ও গভীরতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কবি, বিদ্যাপতি চণ্ডী দাসের পরে, বাঙ্গলায় জন্মিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। আর কালধর্ম্মবশতঃ বৈষ্ণব কবিদিগের মধ্যেও যতটা প্রসারতা ফুটিয়া উঠিবার অবসর পায় নাই, যুগপ্রভাবে রবীন্দ্রনাথে সে প্রসারতা ফুটিয়া উঠিয়াছে বলিয়া মনে হয়। তবে রবীন্দ্রনাথ অনুভূতির বিস্তৃতিতে ও অনুভাব্য বিষয়ের বিচিত্রতাতে যতটা উৎকর্ষ লাভ করিয়াছেন, অন্য দিকে সেই পরিমাণে তাঁর রসানুভূতির গভীরতা ও বাস্তবতা বৈষ্ণব-কবিদিগের অপেক্ষা হীন বলিয়াই মনে হয়। বৈষ্ণব কবিগণ কেবল কবি ছিলেন না, অতি উচ্চ অধিকারের সাধক ও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথেরও ধর্ম্মপিপাসা প্রবল। সাধনের আকাঙ্ক্ষাও বহুদিন হইতেই জন্মিয়াছে। আপনার অলৌকিক কবিপ্রতিভার স্ফূরণেই তিনি জীবনের সার্থকতা লাভ হইল মনে করেন না। ধর্ম্মকে এবং ব্রহ্মকে না পাইলে, তার সকলি বিফল ও ব্যর্থ হইয়া গেল,—রবীন্দ্রনাথের এ ভাবটা ক্রমশঃই বাড়িয়া উঠিতেছে। তাঁর আপনার সম্প্রদায় মধ্যে যে সাধন প্রচলিত আছে, সে সাধনেও রবীন্দ্রনাথ এখন আর উদাসীন নহেন। কিন্তু বৈষ্ণব কবিদিগের সাধনায় এমন একটা বস্তুতন্ত্রতা ছিল, আমাদের এই নবীনযুগের প্রযুক্ত সাধনায় সে বস্তুতন্ত্রতা নাই। প্রাচীন ধর্ম্ম সকলেই গুরুমুখী। সকলেই অবতাররূপে বা গুরুরূপে ভগবানের একটা বহিঃপ্রকাশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। বৈষ্ণব-কবিগণ ভগবানের দ্বিবিধ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলেন। এক অন্তরে—চৈত্য গুরুরূপে; অপর বাহিরে—মোহান্ত গুরুরূপে। এই জন্যই তাঁদের সাধনা যুগপৎ অন্তর্ম্মুখীন ও বস্তুতন্ত্র হইরাছিল। রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তে ও সাধনায় কেবল চৈতা গুরুরই স্থান আছে, বৈষ্ণবেরা যাঁহাকে মোহান্তগুরু বলেন, তার স্থান নাই। ভগবান চৈত্যগুরুরূপে জীবের অন্তরে, তার ভিতরকার জ্ঞানভাবাদির ভিতর দিয়া, তার স্বানুভূতিকে আশ্রয় করিয়াই প্রকাশিত হন। চৈত্যগুরুকে অগ্রাহ করিলে চলে না। কিন্তু এই চৈত্য প্রকাশ আংশিক, পূর্ণ নহে। এই প্রকাশে জীবের অহংবুদ্ধি ভগবানকে ওত প্রোতভাবে ঘেরিয়া থাকে। এখানে জীব অনেক সময় আপনার প্রাকৃত বুদ্ধির সিদ্ধান্ত ও অসংস্কৃত প্রবৃত্তির খেয়ালকেই আপনার ইন্দ্রিয়বিকার প্রসূত বিবিধ রসরাগে রঞ্জিত করিয়া, ভগবৎপ্রকাশ বলিয়া ভ্রম করিয়া থাকে। মোহান্ত গুরু এই ভ্রম নিরস্ত করিয়া থাকেন। চিত্তে যে ভগবৎ প্রকাশ হয়, তাহা যখন মোহান্তগুরু বা সদ্গুরুতে তাঁর যে অধিষ্ঠান হয়, তার সঙ্গে মিলিয়া যায়,—চৈত্যপ্রকাশ ও মোহান্ত প্রকাশ যখন একে অন্যের সমর্থন ও পরস্পরকে প্রতিষ্ঠিত করে, তখনই ভিতরকার আদর্শ ও ভাব সত্যোপেত ও বস্তুতন্ত্র হয়। বৈষ্ণবসাধনাতে ভিতর-বাহিরের এই অপূর্ব্ব সমাবেশ আছে বলিয়া, বৈষ্ণবকবিগণ একান্ত অন্তর্ম্মুখীন হইয়াও অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে কদাপি বস্তুতন্ত্রতা ভ্রষ্ট হন নাই। রবীন্দ্রনাথের সাধনার সঙ্গে তুলনায় বৈষ্ণবকবিদিগের সাধনার ইহাই বিশেষত্ব। আর এই বস্তুতন্ত্র সাধন গুণেই তাঁহারা রবীন্দ্রনাথকে কোনো কোনো দিকে একান্তভাবেই অতিক্রম করিয়া রহিয়াছেন, নতুবা তাঁদের প্রতিভা ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাতে জাতিগত শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্ট-ভেদে কোনো বিশেষ তারতম্য আছে কি না সন্দেহ।
রবীন্দ্রনাথের অন্তর্ম্মুখীনতা
যে ঐকান্তিকী অন্তর্ম্মুখীনতা ও রসানুভূতি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার শ্রেষ্ঠতা প্রমাণিত করে, তাহাই আবার তাঁর দুর্ব্বলতারও মূল কারণ হইয়া আছে। একদিক দিয়া একান্ত অন্তর্ম্মুখীন প্রতিভা যেমন আপনার ভিতরকার ভাব গ্রহণ কবিরা থাকে ও তাঁহাতেই একান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে, অন্যদিকে সেইরূপ সর্ব্বদাই একান্তভাবে বাহিরের প্রেরণারও অধীন হইয়া রহে। একান্ত অন্তর্ম্মুখীন প্রতিভা সত্যের একদেশমাত্র প্রত্যক্ষ করে। সত্য কেবল বাহির লইয়া নহে, কেবল ভিতর লইয়াও নহে। বাহির ও ভিতর, সত্যের এই দুই অঙ্গ। এই দুই অঙ্গে সত্য পূর্ণতা লাভ করে। বাহিরের সঙ্গে ভিতরের যে সম্বন্ধ তাহা আকস্মিক নহে, অঙ্গাঙ্গী। একটাকে ছাড়িয়া, অপরটাকে ধরা সম্ভব নহে। “যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে,” এ কথা যেমন সত্য; যাহা পাই না ব্রহ্মাণ্ডে, তাহা জাগে না ভাণ্ডে, এ কথাও তেমনি সত্য। ভাণ্ডকে ছাড়িয়া ব্রহ্মাণ্ড অন্ধকার। ব্রহ্মাণ্ডকে ছাড়িয়া ভাণ্ড শূন্য, নিরাকার। আর অন্ধকার ও নিরাকার উভয়ই জ্ঞানসীমার বহির্ভূত। দুইএর কোনোটাকেই জ্ঞানগোচর করা সম্ভব নহে। একান্ত অন্তর্ম্মুখীন বুদ্ধি ও প্রতিভা কেবল ভাণ্ডেতেই, কেবল ভিতরকার অনুভূতির মধ্যেই, সত্যের প্রামাণ্য অন্বেষণ ও প্রতিষ্ঠা করিতে চায়; ব্রহ্মাণ্ডের বা বহির্বিষয়ের প্রামাণ্যের প্রতি দৃক্পাতও করে না। ইহার ফলে মতে ও সত্যে, কল্পনাতে ও বস্তুতে মূলতঃ কোনো প্রভেদ আর থাকে না। এ অবস্থায় পরিণামে কেবল ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই বস্তুর প্রামাণ্য হইয়া দাঁড়ায় এবং একমাত্র অনুভূতিই সত্যের আসন অধিকার করিয়া বসে। সত্যের সার্ব্বজনীনতা রাখা তখন একান্তই দুষ্কর হইয়া উঠে। যে তত্ত্বে এই সার্ব্বজনীনতা রক্ষা পায়, রবীন্দ্রনাথ এখনো সে তত্ত্বকে ভাল করিয়া ধরিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। আর তাঁর অলৌকিক প্রতিভার ঐকান্তিকী অন্তর্ম্মুখীনতাই এ পথে সিদ্ধির অন্তরায় হইয়া আছে।
রবীন্দ্রনাথের বাহ্যপ্রেরণার অধীনতা
কিন্তু মানুষ যতই কেন অন্তর্ম্মুখীন হউক না, কিছুতেই সহজে বাহিরের প্রেরণার হাত এড়াইতে পারে না। বৈদান্তিক সাধনে বাহিরের সঙ্গে সর্ব্বপ্রকারের সম্বন্ধ ছেদনের পন্থা ও প্রয়াস দেখিতে পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু সে পথ সন্ন্যাসীর পক্ষেই প্রশস্ত, গৃহীর পক্ষে সাধ্যায়ত্ত নহে। সে পথে চলিতে গেলে, যথাসম্ভব বিষয়ের সঙ্গে সর্ব্ব প্রকারের সম্পর্ক ছেদন করা আবশ্যক হয়। রবীন্দ্রনাথ সে পথের পথিক নন। “ভিক্ষাশনঞ্চ জীবিতম্”—তাঁর জীবনের ধর্ম্ম বা আদর্শ নহে। রবীন্দ্রনাথ গৃহী। রবীন্দ্রনাথ এখন সংযমী, কিন্তু কখনো সন্ন্যাসী ছিলেন না। সুতরাং বাহিরের সম্পর্ক ও প্রেরণা হইতে তিনি মুক্তিলাভ করেন নাই। আর এই জন্যই ক্ষণে ক্ষণে বহির্বিষয়ের তাড়নায়, বাহিরের অভিনব অবস্থার বা অভিজ্ঞতার আঘাতে, এক একবার রবীন্দ্রনাথের মনগড়া জগৎ ভাঙ্গিয়া চুরিয়া যায় ও তাহাকে আবার নূতন করিয়া জীবনের সমস্যাভেদে নিযুক্ত হইতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের উপরে তাঁর পিতার চরিত্রের ও সম্প্রদায়ের
সিদ্ধান্ত ও আদর্শের প্রভাব
এই ঐকান্তিকী অন্তর্ম্মুখীনতা রবীন্দ্রনাথের পৈত্রিক বস্তু। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথেও ইহা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। আধুনিক যুগের ধর্ম্মসংস্কারকদিগের ইহা একরূপ সাধারণ ধর্ম্ম বলিলেও হয়। ষে ব্যক্তিত্বাভিমান আমাদের দেশে ও অন্যত্র শাস্ত্রগুরুর প্রয়োজন ও প্রামাণ্য অস্বীকার করিয়া, আপনার ধর্ম্মের প্রামাণ্যকে একান্ত ভাবেই প্রাকৃত বুদ্ধিবিচারের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিতে অগ্রসর হয়, তাহা এই ঐকান্তিকী অন্তর্ম্মুখীনতারই ফল। এই অন্তর্ম্মুখীনতার আতিশয্য হইতেই, ইংরেজীতে যাহাকে Subjective individualism বলে, তাহার উৎপত্তি হয়। এই নিঃসঙ্গ স্বানুভূতির উপরেই বহুদিন হইতে আমাদের ব্রাহ্মসমাজে ধর্ম্মের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া আসিয়াছে। যারা শাস্ত্রগুরু বর্জ্জন করিয়া ধর্ম্মসাধনে প্রয়াসী হইবেন, তাঁদের পক্ষে এই Subjective individualism বা ব্যক্তিগত অনুভূতির হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব ও অসাধ্য ব্রাহ্মসম্প্রদায়প্রবর্ত্তক রাজর্ষি রামমোহন শাস্ত্রও মানিতেন, গুরু-গ্রহণও করিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার নিজের ধর্ম্মের প্রামাণ্য শুদ্ধ স্বানুভূতির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। প্রাকৃত জনে যে শাস্ত্রপ্রামাণ্যে বিশ্বাস করে, রামমোহন সেরূপ শাস্ত্র প্রামাণ্য মানিতেন না, সত্য। কিন্তু ভারতের প্রাচীন ঋষি-সম্প্রদায়-প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তেও এইরূপ অতিপ্রাকৃত শাস্ত্র প্রামাণ্য গৃহীত হয় নাই। রামমোহন এই বিষয়ে প্রাচীন ঋষি পন্থা অবলম্বন করিয়া, যোগবাশিষ্ঠের নির্দ্দেশ অনুসারে, সুশাস্ত্র, সদ্গুরু ও স্বানুভূতি এই তিনের একবাক্যতার উপরেই সত্যের ও ধর্ম্মের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। কিন্তু রাজার পরবর্ত্তী ব্রাহ্ম আচার্য্যগণ ঠিক এই পথ ধরিয়া চলেন নাহ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র উভয়েই শাস্ত্রের প্রামাণ্য ও সদ্গুরুর প্রয়োজন অস্বীকার করিয়া, প্রথমে শুদ্ধ স্বানুভূতির উপরেই ধর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চান। আর শুদ্ধ স্বানুভূতির উপরে ধর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত করিলে, ব্যক্তিগত মতামতে ও সার্ব্বভৌমিক সত্যে, প্রবৃত্তির প্ররোচনাতে ও ধর্ম্মের প্রেরণাতে যে বস্তুতঃ কোনই প্রভেদ রক্ষা করা অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়, মহর্ষি ও বহ্মানন্দ উভয়েই ক্রমে ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। তাই তাঁহারা উভয়েই পরে, আপনাদের সম্প্রদায়কে নিঃসঙ্গ ও নিরঙ্কুশ স্বানুভূতির অরাজকতা হইতে রক্ষা করিবার জন্য আপনারাই শাস্ত্র প্রবর্ত্তক হইয়া পড়েন। মহর্ষি প্রথম বয়সে বেদের প্রামাণ্য অগ্রাহ্য করিয়া, শেষ জীবনে আপনার সঙ্কলিত ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রন্থকেই বাহ্মসম্প্রদায় মধ্যে শাস্ত্রের আসনে বসাইয়াছিলেন। এই ব্রাহ্মধর্ম্মগ্রন্থ ভগবৎ প্রেরণাতেই সঙ্কলিত হয়, ও এই গ্রন্থে সঙ্কলিত শ্রুতিসকলের যে ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তাহাও যে তাঁর নিজের কল্পিত নয়, কিন্তু সর্ব্বতোভাবেই ঈশ্বরানুপ্রাণিত, মহর্ষি ইদানীং বহুবার এই কথা বলিয়াছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ন্যায়, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রও এক সময়ে প্রাচীন শাস্ত্রসংহিতাকে বর্জ্জন করিয়াছিলেন। কিন্তু আপনার শিষ্যমণ্ডলীর স্বানুভূতির অনিয়ন্ত্রিত প্রভুত্বে সমাজে অরাজকতার ও যথেচ্ছাচারের প্রতিষ্ঠার আশঙ্কা করিয়া, শেষে আপনিই “নবসংহিতা” প্রণয়ন করেন। কেশবচন্দ্রের নববিধানমণ্ডলী মধ্যে এই “নবসংহিতা” হিন্দুর মনুসংহিতার ন্যায় স্বীকৃত ও সম্মানিত হইয়া আছে। কিন্তু এ সকল চেষ্টা সত্ত্বেও ব্রাহ্মসম্প্রদায় মধ্যে নিঃসঙ্গ স্বানুভূতি বা Subjective individualism এর প্রভাব এখনো অপ্রতিহত রহিয়াছে।
রবীন্দ্রনাথের পরিবার ও সমাজ
রবীন্দ্রনাথের ঐকান্তিকী অন্তর্ম্মুখীনতা এই নিঃসঙ্গ স্বানুভূতির বা Subjective individualismএরই রূপান্তর মাত্র। এ বস্তু তাঁর পৈত্রিক ও সাম্প্রদায়িক। যে শিক্ষা ও সাধনাতে এই অন্তর্ম্মুখীনতাকে বস্তুসংস্পর্শে সংযত ও শোধিত করিতে পারিত, রবীন্দ্রনাথ সে শিক্ষা ও সাধনা লাভ করেন নাই। কলিকাতার আধুনিক আভিজাত সমাজ একটা সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে বাস করেন। সহরের সমাজে, বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে প্রমুক্ত মেশামেশির অবসর ও প্রবৃত্তি থাকিতেই পারে না। সকলেই আপন আপন সংসার ও স্বার্থের সন্ধানেই ফেরে, একে অন্যের সঙ্গে আলাপ-আত্মীয়তা করিবার অবসর পায় না। যাদের অন্নচিন্তা নাই, সঞ্চিত ধন যাঁহাদিগকে দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জ্জনের শ্রম ও ব্যস্ততা হইতে মুক্তি দিয়াছে, তাঁরাও কেবল আপনার সমশ্রেণীর ধনীজনের সঙ্গেই আলাপ আত্মীয়তা করেন, জনসাধারণের সঙ্গে কোনোরূপ ঘনিষ্ঠতা তাঁদের জন্মিতেই পারে না। পল্লীসমাজে ধনী-নির্ধনের মধ্যে, বিজ্ঞ ও অজ্ঞের মধ্যে, লোকে যাহাদিগকে ভদ্র বলে ও যাদের ইতর বলে, তাহাদের পরস্পরের মধ্যে যেরূপ হইয়া থাকে, এবং এই জন্য যেরূপ একটা মেশামেশি খোলাখুলি ভাব দেখিতে পাওয়া যায়, বড় বড় সহরে, বিশেষ আজিকালিকার দিনে, তাহার একান্তই অভাব হয়। এই মেশামেশির অভাবে কলিকাতার বড়লোকদের পক্ষে দেশের আপামর সাধারণের সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করা একরূপ অসম্ভব ও অসাধ্য। ইঁহাদের জীবনের অন্তঃপুরে জনসাধারণের প্রবেশ পথ নাই। জনসাধারণের জীবনের অন্তঃপুরেও ইঁহাদের কোনো প্রবেশ পথ নাই। চারিদিকের দীনদরিদ্রেরা কিরূপে দিনপাত করে, তাদের সংসারের সমস্যা, প্রাণের আকাঙ্ক্ষা, হৃদয়ের আবেগ, জীবনের সংগ্রাম, কোন্ দিক দিয়া, কি ভাবে যে উঠে পড়ে, প্রতিবেশী ধনীসম্প্রদায় তার কিছুই জানিতে পারেন না। তাঁরা আপনাদের ত্রিতল প্রাসাদের ছাদ হইতে গরীবের খোলার চালা ও মাটীর দেয়াল মাত্র দেখেন। ঐ চালার নীচে, ঐ দেয়ালের মাঝখানে, ঐ ক্ষুদ্র, জঞ্জালময়, কুটার প্রাঙ্গণে, কত আশা, কত ভয়, কত অনুরাগ, কত বিবাগ, কত লোভ ও কত ত্যাগ যে দিনরাত্রি কত ছুটাছুটি করিতেছে, যেখানে জীবে ও শিবে কি যে মাখামাখি, কি যে লীলাখেলা, কি যে হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি লাগিয়া আছে, এ সকল দেখিবার অবসর ও বুঝিবার অধিকার তাঁহাদের হয় না। তাঁদের নিজেদের জ্ঞানের, ভাবের, ভোগের, বিলাসের, সখ্যের ও সৌখীনতার জগৎটাই তাঁদের কাছে প্রত্যক্ষ ও সত্য এবং ইহার বাহিরে যে বিশাল সমাজ পড়িয়া আছে, সেটা তাঁহাদের অপ্রত্যক্ষ ও অজ্ঞাত।
রবীন্দ্রনাথ এই ধনী-সমাজে জন্মিয়া, তাহারই মধ্যে বাড়িয়া উঠেন। তার উপরে মহর্ষি আপনার ধর্ম্মমতের জন্য সমাজচ্যুত হওয়াতে, তাঁর পরিবারবর্গের জীবন কলিকাতার সাধারণ ধনী-সম্প্রদায়ের জীবন অপেক্ষাও সঙ্কীর্ণতর হইয়া পড়ে। রবীন্দ্রের উদার প্রাণ, এই সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হইয়া আপনার স্বাভাবিক মুক্তভাব আস্বাদন করিবার জন্য, আশৈশবই এক সুবিশাল কল্পিত জগৎ রচনা করিয়া, তাহারই মধ্যে বিহার ও বিচরণ করিয়াছে। তাঁর আপনার পরিবারের দুচারটী প্রাণের সঙ্গেই রবীন্দ্রের প্রাণের প্রত্যক্ষ ও সত্য যোগাযোগ ছিল। এই গুটিকয়েক আধারেই রবীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎভাবে লোকচরিত্র অধ্যয়ন ও পর্য্যবেক্ষণ কবিবার অবসর প্রাপ্ত হন। স্নেহের, প্রেমের, ভক্তির এই গুটিকয়েক প্রত্যক্ষ সম্বন্ধের উপরেই রবীন্দ্রনাথ আপনার বিচিত্র রসজগৎ নির্ম্মাণ করিয়াছেন। এর বাহিরে তিনি যাহা গড়িতে গিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার অলোকসামান্য প্রতিভার ঐন্দ্রজালিক প্রভাবই প্রকাশিত হইয়াছে, সত্যের স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।
রবীন্দ্রনাথ শতরঞ্চগালিচামণ্ডিত ত্রিতল প্রাসাদ কক্ষে বসিয়া, মানসচক্ষে কর্দ্দমমর্দ্দিত পিচ্ছল পল্লীপথ প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। সুচিক্কণবপু, সুমার্জ্জিতরুচি, স্বজনবর্গে পরিবৃত থাকিয়া, সুদূর দরিদ্রপল্লীর শুষ্কদেহ, রুক্ষ্মকেশ নরনারী সকলের অপূর্ব্ব তৈলচিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন। অলৌকিক কবিপ্রতিভার এ অঘটন ঘটন পটীয়সী মায়িক প্রভাব সর্ব্বত্রই থাকে। আর এইরূপ মায়িক সৃষ্টির এমন একটা মোহিনীশক্তিও থাকে, যাহাতে মানুষকে এমন করিয়া মাতাইয়া তুলিতে পারে যে, সত্যিকার সুখদুঃখের সাক্ষাৎ সংস্পর্শ সর্ব্বদা সকলকে সেরূপভাবে মাতাইয়া তুলিতে পারে না। কল্পনার তুলিকায় দারিদ্র্যদুঃখ অঙ্কিত করিয়া, সেই চিত্রসহায়ে দারিদ্র্যের মধুটুকুই আমরা আস্বাদন করিয়া থাকি, তার তীক্ষ্ণ হুলটা আমাদের গায়ে বিঁধে না। উৎকৃষ্টতম তৈলচিত্র যেমন কতকটা দূরে দাঁড়াইয়াই দেখিতে হয়, একান্ত নিকটে গেলে, বর্ণের বন্ধুরতা চক্ষুগোচর হইয়া চিত্রের সৌন্দর্য্য নষ্ট করিয়া ফেলে, জন-চিত্র সম্বন্ধেও তাহাই সত্য। এ সংসারে ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত, সকলেরই মধ্যে ছায়াতপের ন্যায় ভালমন্দ মিশিয়া আছে। দূর হইতে ভালটুকুই আমরা অনেক সময় দেখি, মন্দটুকু চক্ষে পড়ে না! এইজন্য দরিদ্র ধনীকে ঈর্ষা করেন, আর কখনো কখনো ধনীও যে আপনার বিষয়ের দুর্ভাবনার ও প্রতিদিনের জীবনের অসার কৃত্রিমতা দ্বারা একান্ত পীড়িত হইয়া, পর্ণকুটীরের সরল, সহজ জীবনের প্রতি লোলুপদৃষ্টি প্রেরণ করেন না, এমনো নহে। কিন্তু প্রমোদ প্রাসাদ হইতে কল্পনার দূরবীক্ষণসহায়ে, দূরস্থিত পর্ণকুটীরের অনাবিল প্রেমলীলা প্রত্যক্ষ করাতে যে আনন্দ জাগিয়া উঠে, সেই পর্ণকুটীরের জীর্ণকন্থার কীটানুলীলা ও শীর্ণদেহ, দীর্ণপ্রাণ কুটীরবাসীদিগের কলহ-কোলাহল প্রত্যক্ষ করিলে আর সে আনন্দটুকু থাকে না। বস্তু সংস্পর্শে এই কল্পিত জগৎ চক্ষের পলকে মায়াপুবীর ন্যায় শূন্যে মিলাইয়া যায়।
আমি এ কথা ভুলি নাই যে, তাঁর পৈত্রিক জমিদারী তত্ত্বাবধানের ভার কয়েক বৎসর ব্যাপিয়া রবীন্দ্রনাথের উপরেই ন্যস্ত ছিল। এবং এই উপলক্ষে তিনি বহুকাল শিলাইদহ ও অন্যান্য স্থানে থাকিয়া সাক্ষাৎভাবে বাঙ্গলার পল্লীজীবন পর্য্যবেক্ষণ করিবার অবসরও পাইয়াছিলেন। কিন্তু এই বাহ্য যোগ নিবন্ধনই যে সে জীবনের অন্তঃপুরে তিনি প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছিলেন, একেবারে এ মীমাংসা করা যায় না। বড় বড় জমিদারীর “বাবুদের” সঙ্গে তাঁহাদের প্রজাসাধারণের কোনো প্রকারের ঘনিষ্ট ও প্রমুক্ত মেশামিশি কুত্রাপি সম্ভব হয় না। রবীন্দ্রনাথের উদার অন্তরে এইরূপ যোগাযোগ স্থাপনের বলবতী আকাঙ্ক্ষার উদয় হওয়া স্বাভাবিক। সাংসারিক ধনপদাদির অবস্থার আকস্মিক তারতম্যকে অগ্রাহ্য করিয়া, মানুষ বলিয়াই মানুষকে শ্রদ্ধা ও প্রীতিভরে প্রাণে টানিয়া লইবার জন্য একটা লালসা ধর্ম্ম প্রাণ রবীন্দ্রনাথের চিত্তকে যে সময় সময় আকুল করিয়া তুলিয়াছে, ইহাও সত্য। সাংসারিক অবস্থার তারতম্য মানুষে মানুষে যে ব্যবধানের সৃষ্টি করে, আপনার আচারব্যবহারে ও সন্তানগণের শিক্ষাদীক্ষায় রবীন্দ্রনাথ সে ব্যবধানটাকে ঘুচাইবার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছেন ও করিতেছেন, ইহাও জানি। কিন্তু এ সকল সাধুচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের প্রাণের উদারতা মাত্রই প্রকাশিত হয়, সে সকল চেষ্টার সফলতা তো আর সপ্রমাণ হয় না। বড় ছোট উভয় পক্ষের সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃতির উপরেই এ সকল চেষ্টার সফলতা নির্ভর করে। আর এ আত্মবিস্মৃতিলাভ কোনো পক্ষেরই সহজ নহে। বিশেষতঃ পাদ্রিজনসুলভ সৌহার্দ্দ্য ও বিশ্বমানবীপ্রেমে কিছুতেই এরূপ আত্মবিস্মৃতি জন্মানো সম্ভব হয় না। এ আত্মবিস্মৃতিলাভ করিতে গেলে, ধনীকে ধনের মূল্যটা ভুলিতে হয়, জ্ঞানীকে জ্ঞানের প্রাধান্যটা ভুলিতে হয়, ললিতকলার উপাসককে ললিত- লালিত্যের সুকুমার অনুভূতিটা ভুলিতে হয়, আর ধার্ম্মিককে অপরের ধর্ম্ম হইতে আপনার ধর্ম্মটা যে শ্রেষ্ঠ, এই ভাবটা পর্য্যন্ত একেবারে বিস্মৃত হইতে হয়। যেখানে সমাজের সাধারণ বিধিব্যবস্থা আপনা হইতেই ধনী ও নির্ধনের, বিজ্ঞ ও অজ্ঞের, ধার্ম্মিক ও অধার্ম্মিকের মধ্যে কোনো প্রকারের আত্যন্তিক ব্যবধান প্রতিষ্ঠার ব্যাঘাত না জন্মায়; যেখানে সামাজিকজীবনে ধনী দরিদ্রের সঙ্গে দৈনন্দিন কার্য্যকলাপের মধ্যে নিঃসঙ্কোচে ও নিরভিমানসহকারে মেশামিশি করেন না; যেখানে বিজ্ঞেরা আপনাদের বিজ্ঞতার উত্তুঙ্গ শৃঙ্গেই খৃষ্টীয়কথাপ্রসিদ্ধ সেণ্ট্ সাইমনের মত, দিবানিশি বসিয়া রহেন, অজ্ঞের ন্যায় অজ্ঞের সঙ্গে প্রমুক্তভাবে মিশিবার প্রবৃত্তি ও অবসর লাভ করেন না; যেখানে ধার্ম্মিক একচক্ষে আপনার সম্প্রদায়গত সিদ্ধান্ত ও সংস্কারাদির শ্রেষ্ঠতা ধ্যান করেন, আর অপর চক্ষে অন্য সম্প্রদায়সকলের সিদ্ধান্ত ও সংস্কারাদির হীনতা দেখিয়া সেগুলিকে উন্নত ও বিশুদ্ধ করিবার জন্য একান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠেন;—সেখানে এ ব্যবধান নষ্ট করা কেবল অসাধ্য যে তাহা নহে, চেষ্টামাত্রেই যে ব্যবধানকে নষ্ট করিতে যাওয়া হয়, তাহাকেই আরো বাড়াইয়া তোলে। এই জন্য এই শতাধিক বৎসরের অশেষ চেষ্টাতেও মার্কিণ সমাজে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের সামাজিক ব্যবধানটা নষ্ট তো হয়ই নাই, বরং এই সাধুচেষ্টারই ফলে শ্বেতকৃষ্ণে বাহিরের আইন কানুনের বৈষম্য যে পরিমাণে কমিতেছে, ভিতরকার মনের ব্যবধানটা যেন সেই পরিমাণেই আরো বাড়িয়া যাইতেছে। রবীন্দ্রনাথ কলিকাতার আধুনিক আভিজাত সমাজে জন্মিয়া তাহারই অঙ্কে, তারই দোষগুণের ভাগী হইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছেন। এই সমাজে এই ব্যবধানটা চিরদিনই আছে। কলিকাতার বড় বড় জমিদারদের জমিদারীতে এ ব্যবধানটা স্থায়ী হইয়া গিয়াছে। সেখানে না আছে প্রজার কুলের আদর, না আছে তার বিদ্যার গৌরব, না আছে তার চরিত্রের মর্য্যাদা। মহর্ষির জমিদারীতেও এ সকলের কোনো বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে বলিয়া শোনা যায় নাই। আর বহুকাল হইতে তাঁহাদের জমিদারীতে যে সকল জমিদারী আচার-নিয়ম প্রবর্ত্তিত রহিয়াছে, তার কিম্বদন্তী পর্য্যন্ত যতদিন প্রজাবর্গের স্মৃতিতে জাগরূক থাকিবে, ততদিন তাহাদের পক্ষে আপনাদের প্রজাত্বের অগৌরব বিস্মত হইয়া, একান্ত প্রমুক্তভাবে জমিদারবাবুদের সঙ্গে মেশামেশি করা সম্ভবই নয়। আর প্রজারা যতদিন না এ অকুণ্ঠা লাভ করিয়াছে, ততদিন কেবল জমিদারের উদারতায় বা বিশ্বমানবপ্রেমে পরস্পরের মধ্যকার পুরুষানুক্রমিক ব্যবধানটা কিছুতেই ঘুচিবারও নহে। আর এই ব্যবধান নষ্ট হয় নাই বলিয়াই, আপনার জমিদারীর পল্লীসমাজের মাঝখানে বহুদিন বাস করিয়াও, ঔদার্য্যসাধনের আন্তরিক আগ্রহ চেষ্টা সত্ত্বেও, রবীন্দ্রনাথ সে সমাজের প্রাণের অন্তঃপুরে প্রবেশ লাভ করেন নাই। অতি নিকটে থাকিয়াও, বাঙ্গলার পল্লীজীবন ও বাঙ্গালীর সাচ্চা প্রাণটা চিরদিনই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া আছে!
রবীন্দ্রনাথের মায়িক সৃষ্টি ও মায়াশক্তি
রবীন্দ্রনাথের অনেক সৃষ্টিই এইরূপ মায়িক। ঊর্ণনাভ যেমন আপনার ভিতর হইতে তন্তু বাহির করিয়া অদ্ভুত জাল বিস্তার করে, রবীন্দ্রনাথও সেইরূপ আপনার অন্তর হইতেই অনেক সময় ভাবের ও রসের তন্তু সকল বাহির করিয়া, আপনার অদ্ভুত কাব্য সকল রচনা করিয়াছেন। তাঁর কাব্য যেমন কচ্চিৎ বস্তুতন্ত্র হইয়াছে, তাঁর চিত্রিত লোকচরিত্রেও অনেক সময় এই বস্তুতন্ত্রতার অভাব দেখিতে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ অনেক ক্ষুদ্র গল্প লিখিয়াছেন, দুচারখানি বৃহদাকারের উপন্যাসও রচনা করিয়াছেন, কিন্তু তাঁর চিত্রিত চরিত্রের প্রতিরূপ বাস্তব জীবনে কচ্চিৎ খুঁজিয়া পাওয়া যায় কি না সন্দেহ। কেবল রবীন্দ্রনাথ যেখানে আধুনিক ইঙ্গবঙ্গের বা তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের চরিত্র চিত্রিত করিতে গিয়াছেন, সেখানেই তাঁর চিত্রগুলি অসাধারণ বস্তুতন্ত্রতা লাভ করিয়াছে। এ বিষয়ে “গোরা”র হারাণ বাবুটী অপূর্ব্ব বস্তু হইয়াছে। কিন্তু এরূপ গুটিকতক চিত্র ব্যতীত রবীন্দ্রনাথের অনেক সৃষ্টিই মায়িক। আর যেমন তাঁর কাব্যে ও গল্পে এই মায়ার প্রভাব বেশী, সেইরূপ তাঁর সমাজসংস্কারের প্রয়াস ও ধর্ম্মের শিক্ষাও বহুলপরিমাণে বস্তুতন্ত্রতাহীন হইয়াছে। তিনি একটা কল্পিত স্বদেশ রচনা করিয়া, তাহারই উপরে একটা সত্য স্বদেশী সমাজ গড়িয়া তুলিতে গিয়াছিলেন। সে মায়ার সৃষ্টি কিছুদিন পরে আপনাতে আপনিই মিলাইয়া গিয়াছে। আশৈশবই রবীন্দ্রনাথের ধর্ম্মের রচনায় ও উপদেশে এই মায়ার প্রভাব বিদ্যমান ছিল। তাঁর স্বাদেশিকতা কেবল শৈশবেই নয়, আজি পর্য্যন্ত বহুল পরিমাণে বস্তুতন্ত্রতাহীন হইয়া আছে। আর আজ তিনি যে এক বিশাল “বিশ্বমানব” কল্পনা করিয়া তাহারই উদারপ্রেমে আত্মসমর্পণ করিতেছেন,—তাহারও প্রতিষ্ঠা প্রত্যক্ষেও নয়, আগমেও নয়, কিন্তু তাঁর অলৌকিক কবিপ্রতিভার অঘটনঘটনপটীয়সী মায়াশক্তিতে।
আর মায়ার মোহিনী শক্তিই আছে, তৃপ্তিদানের অধিকার নাই। এ সংসারে মায়াধীন জীব নিত্যই, পাই পাই পাই না, ধরি ধরি ধরিতে পারি না;—এরূপ অপূর্ণ চেষ্টা ও অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় চঞ্চল হইয়া রহে। রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক সৃষ্টিও পাঠকের প্রাণে এই চিরলোলুপ ও নিত্য-অতৃপ্তভাবের সঞ্চার করে। রবীন্দ্রনাথের কাব্য অনেক সময়ই চিত্তকে মুগ্ধ করে, কিন্তু স্নিগ্ধ করিতে পারে না। জ্ঞানের ভাবের, কর্ম্মের পিপাসা বাড়াইয়া দেয়, কিন্তু সে পিপাসার নিবৃত্তি করিতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের সন্দর্ভ সকল সর্ব্বদাই কাণে মধু ঢালে, প্রাণে গিয়া সাড়া দেয়, বুদ্ধিকে যাইয়া জাগাইয়া তোলে, কিন্তু পাঠককে ক্কচিৎ কোনো স্থির সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হয়। রবীন্দ্রনাথ একবার “ততঃ কিম্?” নামে একটা উপাদেয় প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন। তাঁর নিজের লেখাতেও প্রায় সর্ব্বদাই ঐ দুর্দ্দমনীয় প্রশ্নটা জাগিয়া রহে। রবীন্দ্রনাথের রচনা সর্ব্বদাই বড় মিষ্টি লাগে, কিন্তু সর্ব্বদাই আবার তার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অপূর্ণতা ও অতৃপ্তিবোধ জাগিয়া উঠে। ইহাও মায়ারই ধর্ম্ম।
রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব ও ঋষিত্ব—ভাব ও অভাব
কিন্তু রবীন্দ্রের কবিপ্রতিভার অলৌকিক শক্তিকে মায়িক বলিলে তার কোনই গৌরবের হানি হয় না। কবিত্বের শক্তি সর্ব্বদাই মায়িক। অশরীরীকে শারীরধর্ম্মে বিভূষিত করা, অজ্ঞাত, অজ্ঞেয়কে নামরূপ দিয়া জ্ঞানাধিকারে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত করা, ইহাই কবি-প্রতিভার সাধারণ ধর্ম্ম। ইহাকেই অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়াধর্ম্ম বলে। কবি-প্রতিভা যে কদাপি এই মায়াকে অতিক্রম করিতে পারে না, তাহা নয়। সেখানে কবি শুধু কবি নহেন, কিন্তু সাধক ও; সাধনা বলে কবি যেখানে আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করিয়া, সেই নিগূঢ় তত্ত্বের উপরেই আপনার কবিকল্পনাকে গড়িয়া তুলেন, সেখানে তাঁর প্রতিভা এই মায়াকে অতিক্রম করিয়া যায়। সেখানে কবি ঋষিত্ব লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথের এই পরমপদলাভের অনেক যোগ্যতাই আছে, অভাব কেবল এক বস্তুর। যে বস্তুর অভাব পূরণ করিবার জন্য যিশু যোহনের সম্মুখীন হইয়া তাঁহার নিকটে দীক্ষা প্রার্থনা করিয়াছিলেন, যাহার জন্য শ্রীচৈতন্য ঈশ্বর-পুরীর শরণাগত হন, যে সঞ্চারের অভাবে অধ্যাত্মজীবনের উপকরণ প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান থাকিতেও তাহা কদাপি ফলপ্রসূ হয় না, রবীন্দ্রনাথের অভাব সে বস্তুর। এই সঞ্চারের অভাবেই রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক কবি-প্রতিভা এখনো মায়াতীত সত্যলোক ও ব্রহ্মলোক অধিকার করিতে পারিতেছে না। য়ুরোপপর্য্যটনে না যাইয়া রবীন্দ্রনাথ যদি ভারতের পুণাতীর্থভ্রমণে আজ বাহির হন, তবে হয় ত, ভগবৎপ্রসাদে, ভ্রমিতে ভ্রমিতে কোনো ‘সাধুবৈদ্যের’ সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া এ অভাব পূরণ করিতে পারিতেন। কিন্তু আজ না হউক, এক দিন এ অভাব তাঁর পূর্ণ হইবেই হইবে। তাঁর ক্ষয়োন্মুখ সংসার বেশি দিন তাঁহাকে মনগড়া সিদ্ধান্তের এবং কল্পিত সংস্কারের মায়াজালে বাঁধিয়া রাখিতে পারিবে না।