চরিত-কথা (বিপিনচন্দ্র পাল)/শ্রীযুক্ত অশ্বিনীকুমার দত্ত

শ্রীযুক্ত অশ্বিনীকুমার দত্ত

স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হইতে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও স্বাদেশিক কর্ম্মক্ষেত্রে একটা নূতন বস্তুর আমদানী হইয়াছে। ইহার নাম নেতা বা নায়ক বা “লীডার”। ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে এ কথা আমরা শুনি নাই। কৃষ্ণদাস জমিদার-সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন না, মুখপাত্র বা প্রতিনিধি ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বা আনন্দমোহন, শিশিরকুমার কি কালীচরণ, ইঁহাদের কেহই সেকালে নেতা উপাধি লাভ করেন নাই, কিন্তু দেশের নব্যশিক্ষাপ্রাপ্ত সমাজে ইঁহাদের অসাধারণ প্রতিপত্তি ছিল। আমার মনে হয় যে, সে সময়ে আমরা যে ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার আদর্শ ধরিয়া চলিতেছিলাম, তাহা কোনও লোকবিশেষের নেতৃত্বের দাবী সহ্য করিতে পারিত না বলিয়াই, সে যুগে আমাদের মধ্যে নেতার বা নায়কের বা লীডারের প্রতিষ্ঠা হইতে পারে নাই। এখন যে বস্তুকে আমরা নেতা বলি সে বস্তু তখনও ছিল। মনের ভাবে তো আর সংসারে কোথাও বস্তু-বিপর্যয় ঘটে না। তবে আমরা তখন সে বস্তুকে নেতা বা নায়ক বা লীডার বলিয়া ডাকিতাম না, ইহাই কেবল সত্য।

 আর আজ আমরা এই সকল নাম দান করিতেছি বলিয়াই যে নূতন বস্তু লাভ করিতেছি, এমনই কি বলা যায়? সুরেন্দ্রনাথ–প্রমুখ কর্ম্মী ও মনীষীগণ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মুখপাত্র এবং প্রতিনিধি তখনও ছিলেন, এখনও আছেন। আমরা এখন তাঁহাদিগকে প্রতিনিধি না বলিয়া নেতা বলিতে বেশি ভালবাসি; কিন্তু তাই বলিয়া যে আমাদের কথার জোরে তাঁরা নেতা বা নায়ক হইয়া উঠেন, এমনও বলা যায় না। ফলতঃ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকৃত নায়কত্ব লাভ করা এমন সহজ ব্যাপারও নহে।

শ্রীযুক্ত অশ্বিনীকুমার দত্ত

আমরা লেখাপড়া জানি কিম্বা না জানিলেও জানি বলিয়া আমাদের যে অভিমান জন্মিয়াছে, তাহার দরূণই কেহ আমাদের প্রকৃত নেতা হইতে পারেন না। আমরা বিচার করি, যুক্তি করি, পরখ করি, লাভালাভ গণনা করি, তার পরে যাঁর কথা আমাদের মনোমত হয়, তাঁহাকে আমাদের মুখপাত্র বলিয়া গ্রহণ করি। কিন্তু কাহারও কথায় আমরা উঠিতে বসিতে পারি না। কাহারও পশ্চাতে যাইয়া আমরা দলবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইতে জানি না। কাহারও মান বা প্রাণ রক্ষার জন্য আমরা আমাদিগের যথাসর্ব্বস্ব উৎসর্গ করিতে পারি না। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত লোকের মধ্যে ক্বচিৎ ধর্ম্মের ব্যাপারে সম্ভব হইলেও, সাধারণ রাষ্ট্রীয় কর্মক্ষেত্রে ইহা সম্ভবপর নহে। এই জন্যই কেবল ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপরে যাঁহাদের · প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাঁহাদিগকে লোক-প্রতিনিধি বলা যায়, কিন্তু লোক-নায়ক বলা যায় না।

 বস্তুতঃ আমাদের বর্তমান কর্ম্মিগণের মধ্যে কেবল একজনমাত্র প্রকৃত লোকনায়ক আছেন বলিয়া আমার মনে হয়, তিনি বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্ত।

 অশ্বিনীকুমার শিক্ষিত, কিন্তু কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নহেন; সদ্বক্তা, কিন্তু দৈবীপ্রতিভাসম্পন্ন বাগ্মী নহেন। সুললিত বাক্য যোজনা করিয়া তিনি বহু লোককে উপদেশ দিতে পারেন, কিন্তু শব্দ ও ভাবের বন্যা ছুটাইয়া তাহাদিগকে আত্মহারা করিয়া ক্ষেপাইয়া তুলিতে পারেন না। তিনি সাহিত্যিক,—তাঁর ভক্তিযোগ বাংলাভাষার একখানি অতি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ; কিন্তু যে সাহিত্য-সৃষ্টির দ্বারা সমাজে নূতন আদর্শ ও নূতন উৎসাহ ফুটিয়া উঠে, সে সৃষ্টি-শক্তি তাঁর নাই। তিনি দরিদ্র নহেন, পিতৃদত্ত সম্পত্তির দ্বারা তাঁর সাংসারিক সচ্ছলতা সম্পাদিত হয়; কিন্তু যতটা ধনের অধিকারী হইলে, সেই ধনের শক্তিতে লোকে সমাজপতি হইয়া উঠে, অশ্বিনীকুমারের সে বিভব নাই। অশ্বিনীকুমার বি, এল পাশ করিয়া কিছুদিন ওকালতি করিয়াছিলেন; সে দিকে মনোনিবেশ করিলে তিনি আধুনিক ব্যবহারজীবিগণের অগ্রণীদলভুক্ত হইতে পারিতেন না যে, এমনও মনে হয় না। কিন্তু অশ্বিনীকুমার সে দিকে বিধিমত চেষ্টা করেন নাই। সুতরাং বড় উকীল কৌন্সিলী হইয়াও লোকে সমাজে যে প্রতিপত্তি ও প্রভাব লাভ করে, অশ্বিনীকুমার তাহা পান নাই। সরকারী কর্ম্মে কৃতিত্বের দ্বারাও সমাজে এক জাতীয় নেতৃত্বলাভ করা যায়। অশ্বিনীকুমারের পিতা উচ্চ রাজকর্ম্মচারী ছিলেন; ইচ্ছা করিলে অশ্বিনীকুমারও সহজেই একটা ডেপুটিগিরি জুটাইতে পারিতেন, আর তাঁর বিদ্যার ও চরিত্রের গুণে রাজকার্যে তিনি যে খুবই কৃতিত্ব এবং উন্নতি লাভ করিতে পারিতেন, সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু অশ্বিনীকুমার এ সকলের কিছুই করেন নাই। যে গুণ থাকিলে, যে কর্ম্ম ও কৃতিত্ব–বলে, সচরাচর আমাদের মধ্যে লোকনেতৃত্বলাভ হয়, অশ্বিনীকুমার তার কিছুরই দাবী করিতে পারেন না। তথাপি, তাঁর মতন এমন সত্য ও সাচ্চা লোক-নায়ক বাংলার প্রসিদ্ধ কর্ম্মিগণের মধ্যে আর একজনও আছেন বলিয়া জানি না।

 ফলতঃ আমার মনে হয় যে, আমাদের চিন্তানায়ক অনেক আছেন, কিন্তু লোকনায়ক নাই। কেহ বক্তা, কেহ (বলিলেও চলে) করি; কেহ মসীজীবী, কেহ ব্যবহারজীবী; কেহ বা ধনে, কেহ বা পদে বড়। এই সকল লোকে মিলিয়া দেশের মনের গতি ও কর্ম্মের আদর্শ বদলাইয়া দিয়াছেন ও দিতেছেন। ইঁহারা না থাকিলে বাংলা আজ যেখানে গিয়া দাঁড়াইয়াছে, সেখানে যাইতে পারিত না। ইঁহারা দেশের প্রাণতা বাড়াইয়া দিয়াছেন, লোক-চরিত্রকে উদার ও উন্নত করিয়াছেন। কিন্তু ইঁঁহারা কেহই, সত্য অর্থে, লোকনায়ক নহেন। লোকে ইঁহাদের পুস্তক আনন্দ করিয়া পড়ে, ইঁহাদের বক্তৃতা আগ্রহ করিয়া শোনে, ইঁহাদের গুণগান প্রাণ খুলিয়া করে; ইঁহাদিগকে সভাসমিতিতে উচ্চ আসনে লইয়া গিয়া বসায়, পথে দেখা হইলে সসম্ভ্রমে ইঁহাদিগকে পথ ছাড়িয়া দেয়; দেশ-হিতকর অনুষ্ঠানাদিতে ইঁহাদিগকে আদর করিয়া পৌরহিত্যে বরণ করে। এ সকলই করে; করে না কেবল, সত্যভাবে, ইঁহাদের অনুবর্তন। যতদিন লোকের মনের সঙ্গে ইঁহাদের কথা মিলিয়া যায়, লোকের ভাবের সঙ্গে ইঁহাদের উপদেশ মিশ খায়, লোকে যাহা আপনা হইতে চাহে যতদিন ইঁহারা সে পথে নিজেরা চলিতে ও তাহাদিগকে চালাইতে রাজি থাকেন, ততদিন ইঁহাদিগকে সকলে মাথায় করিয়া রাখে। কিন্তু মতভেদ উপস্থিত হইলেই ইঁহাদিগকে অবলীলাক্রমে, সরাসরিভাবে, ছাড়িয়া আসিতেও দ্বিধা-বোধ করে না। ইহাকে প্রকৃত লোকনায়কত্ব বলে না, বা বলা সঙ্গত নহে।

 প্রকৃত লোকনায়ক এদেশে ক্রমে লোপ পাইয়া যাইতেছে। এক সময়ে, হিন্দু ও মুসলমান–সমাজে, যে জাতীয় লোকনায়ক স্বচক্ষে দেখিয়াছি, তাহা আর আজ দেখিতে পাই না। ইহার প্রধান কারণ এই যে, আমাদের আধুনিক শিক্ষাতে আমাদিগকে দেশের লোকের প্রাণ হইতে ক্রমশঃই যেন দূরে লইরা গিয়া ফেলিতেছে। প্রথমতঃ আমাদের পিতৃপিতামহেরা যে ভাবে আপন আপন গ্রামের সঙ্গে একাত্ম হইয়া বাস করিতেন, আমরা আর তাহা করি না। তাঁরাও সময় সময়, বিষয়-কর্ম্মের খাতিরে গ্রাম ছাড়িয়া দূরদূরান্তে বাস করিতেন বটে, কিন্তু অনেক স্থলেই তাঁহাদের স্ত্রীপুত্রেরা গ্রামেই থাকিতেন। যেক্ষেত্রে তাঁহারা পরিবার সঙ্গে লইয়া কর্ম্মস্থলে যাইতেন, সেখানেও গ্রামের সমাজের সঙ্গে তাঁহাদের প্রাণগত, অন্তরঙ্গ যোগ কখনও নষ্ট হইত না। বিদেশে প্রবাসে তাঁরা অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়া যে অর্থ উপার্জ্জন করিতেন, গ্রামে আসিয়া, আপনার আত্মীয়কুটুম্ব, প্রতিবেশী ও বন্ধুবর্গের মধ্যেই সে অর্থ ব্যয় করিতেন। পরোক্ষভাবে দশে তাঁহাদের অর্থের ভাগী ও ভোগী হইত; সাক্ষাৎভাবে তাঁহারা তাঁহাদের প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠার দ্বারা সময়ে অসময়ে অনেক সাহায্যলাভ করিত। বিবাহ ও শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া-কর্ম্মে, দোলদুর্গোৎসবাদি নৈমিত্তিক পূজাপার্বণে, নিত্য দেবসেবা ও অতিথিসেবার ভিতর দিয়া, গ্রামের লোকের সঙ্গে তাঁহাদের একটা নিকট সম্বন্ধ জমাট হইয়া যাইত। আর এই জন্য, তাঁরা যেখানে যাইয়া দাড়াইতেন, শত শত লোকে সেখানে যাইয়া তাঁহাদের পৃষ্ঠপোষক হইয়া দাড়াইত। তাঁরা যে কাজ করিতে যাইতেন, সকলে সে কাজে রত হইত। তাঁরা যে পথ দেখাইতেন, সকলে বিনা ওজরে, বিনা বিচারে, সে পথ ধরিয়া চলিত। তখন দেশে সত্যকার লোক–নেতৃত্ব ছিল। ইঁহারাই সেকালে প্রকৃত লোক-নায়ক ছিলেন।

 আর আজ——‘তে হি নো দিবসাঃ গতাঃ’। সে দিনও নাই—সে সমাজও নাই! লোকে লেখাপড়া শিখিয়া, যারা লেখা পড়া জানে না তাহাদের নিকট হইতে পৃথক্‌ হইয়া পড়ে। আমাদের দেশে ‘শিক্ষিত' ও 'অশিক্ষিতে’র, ‘বিজ্ঞে’র ও ‘অজ্ঞে’র মধ্যে এককালে এ সাংঘাতিক ব্যবধান ছিল না। গ্রামের বিদ্যাভূষণ বা তর্কসিদ্ধান্ত বা ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের বাড়ীতে আপামর সাধারণ সকলের অবাধ গতিবিধি ছিল। তাঁর চতুষ্পাঠীতে, যখন তিনি শিষ্যমণ্ডলী-বেষ্টিত হইয়া ব্যাকরণ বা স্মৃতি বা ন্যায়ের অধ্যাপনা করাইতেন, তখনও গ্রামের চাষী ও ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে যাইয়া নীরবে বসিয়া থাকিত এবং তাঁর তামাকাদি সাজিয়া, তাঁর সেবাশুশ্রূষায় নিযুক্ত হইত। তাদের সঙ্গে তাঁর বিদ্যার ব্যবধান যাই থাকুক না কেন, প্রাণের ব্যবধান বড় বেশি ছিল না। আর এই একপ্রাণতা নিবন্ধন, দেশের আপামর সাধারণে এ সকল উদারচরিত ব্রাহ্মণের শাস্ত্রজ্ঞান লাভ না করিয়াও, তাঁহাদের চরিত্রের প্রভাবে, কথাবার্তার গুণে অনেকটা সুশিক্ষিত হইয়া উঠিত। এ শিক্ষা স্কুল-পাঠশালায় মিলে না। আমরা একটু আধটু লেখাপড়া শিথিয়া, চিন্তায়, ভাবে, আদর্শে, অভ্যাসে, সকল বিষয়ে দেশের লোক হইতে এতটা পৃথক্‌ হইয়া পড়িয়াছি যে, তাহাদের কথা আমাদের মিষ্টি লাগে না, আমাদের কথাও তাদের বোধগম্য হয় না। তাদের আমোদপ্রমোদে আমরা গা ঢালিয়া দিতে পারি না; আমাদের উৎসব-ব্যসনাদিতেও তারা আমাদের কাছে ঘেষিতে পারে না। আমাদের বাড়ীতে তারা সাহস করিয়া আসে না, আমরাও আমাদের ক্রিয়াকর্ম্মে তাহাদিগকে আদর করিয়া ডাকি না। ইংরেজকে তারা যে ভাবে দেখে, যেরূপ সম্মান করে, আমাদিগকেও প্রায় সেইরূপই করে। আর এই জন্য দেশের লোকে যেমন ইংরেজের শাসন মানিয়া চলে, কিন্তু আপনা হইতে প্রাণের টানে সরকারের অনুবর্ত্তন করে না, আমাদের আন্দোলন-আলোচনাদিতেও এখন দেশের লোকে ঠিক ঐ ভাবেই আসিয়া যোগদান করে;—খাতিরে করে, ভয়ে করে, বড়লোক ভাবিয়া আমাদের “মাসমিটিংএ” আসিয়া জনতা করে, কিন্তু আপনার জন বলিয়া, অন্তরের টানে, প্রাণের দায়ে আমাদের কাছে তারা আসে না। এ অবস্থায়, প্রকৃত লোকনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভবে না।

 তবে অশ্বিনীকুমারের পক্ষে ইহা অনেকটা সম্ভব হইয়াছে। ইহার প্রধান কারণ এই যে, অশ্বিনীকুমার কখনও সাধারণ ইংরেজিনবিশদিগের মত জীবনটা কাটান নাই। তিনি লেখাপড়া শিখিয়া, কর্ম্মের খাতিরে, যশের লোভে বা সখের দায়ে, আপনার দেশ ছাড়িয়া চলিয়া আসেন নাই। বরিশালেই তিনি তাঁর কর্ম্মক্ষেত্র রচনা করিতে আরম্ভ করেন। বহুদিন পূর্ব্বে অশ্বিনীকুমারের একবার কলিকাতায় আসিয়া বাস করিবার প্রস্তাব হয়, এরূপ শুনিয়াছি। প্রবীণ সাহিত্যিক, ঋষিপ্রতিম রাজনারায়ণ বসু মহাশয় তখন জীবিত ছিলেন। অশ্বিনীকুমার প্রায়ই দেওঘরে যাইয়া বসু মহাশয়ের সহিত মিলিত হইতেন। অশ্বিনীকুমারের কলিকাতায় আসিবার কথা শুনিয়া, রাজনারায়ণ বাবু তাঁহাকে এমন আত্মঘাতী কর্ম্ম করিতে পুনঃপুনঃ নিষেধ করেন। অশ্বিনীকুমার যদি এ নিষেধ না শুনিতেন, আমাদের দশজনের মতন যদি তিনি কলিকাতায় আসিয়া বসবাস করিতেন, তাহা হইলে, বাংলার আধুনিক কর্ম্মজীবনের ইতিহাসে তিনি আজ যে স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছেন, সে স্থান কিছুতেই পাইতেন না, ইহা স্থির নিশ্চয়।

 প্রথম যৌবনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করিয়া অশ্বিনীকুমার বরিশালে যাইয়া স্বদেশসেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। সে সময়ে লাট রিপন্ প্রবর্ত্তিত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বা Local Self-governmentএর খুব প্রাদুর্ভাব ছিল। ইংরেজি শিক্ষিত সমাজ, বিশেষতঃ দেশের ব্যবহারজীবিগণ এই স্বায়ত্তশাসনেতেই দেশের ভবিষ্যতের স্বাধীনতার পত্তন হইল ভাবিয়া উৎসাহ সহকারে মিউনিসিপ্যালিটি এবং ডিস্ট্রীক্ট্বোর্ডের কার্যে প্রবৃত্ত হন। অশ্বিনীকুমারও সেই পথ ধরিয়াই নিজের সহরের এবং জেলার সেবাতে নিযুক্ত হন। এবং ক্রমে ওকালতী পরিত্যাগ করিয়া লোকশিক্ষার কার্যে প্রবৃত্ত হন। যতদূর আমার মনে আছে, বোধ হয় তিনি বহুকাল ধরিয়া আপনার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের কাজ করিয়াছিলেন। ক্রমোন্নতি সহকারে অশ্বিনীকুমারের উচ্চশ্রেণীর ইংরেজি বিদ্যালয় কলেজে পরিণত হয়। এবং অশ্বিনীকুমার একজন মনীষাসম্পন্ন স্বার্থত্যাগী লোকশিক্ষকের খ্যাতিলাভ করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ই সর্ব্বপ্রথমে বিশেষভাবে আমাদের মধ্যে অল্প বেতন লইয়া উচ্চ ইংরেজি শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা করেন। আজিকালি দেশে এ শ্রেণীর অনেকগুলি বে-সরকারী স্কুল-কলেজ হইয়াছে, কিন্তু এক বিদ্যাসাগর মহাশয় ব্যতীত এই বে-সরকারী স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠাতাগণের প্রায় অপর সকলেই, এগুলিকে জীবিকা— উপার্জ্জনের একটা প্রশস্ত উপার রূপে গ্রহণ করেন। কিন্তু অশ্বিনীকুমার তাহা করেন নাই। সে প্রয়োজনও তাঁর ছিল না। ফলতঃ আমাদের দেশে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরে, অশ্বিনীকুমারের মতন আর কেহ এতটা নিঃস্বার্থভাবে স্বদেশীয়দিগের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রচার করিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হন নাই। এইজন্য আজি পর্য্যন্ত অশ্বিনীকুমারের স্কুল ও কলেজের পরিচালনাকার্য্যে কোনও প্রকারের ব্যবসাদারীর পরিচয় পাওয়া যায় নাই। অশ্বিনীকুমার লোকশিক্ষার জন্য বহু বৎসর ধরিয়া আপনার সময়, শক্তি এবং অর্থ অকাতরে দান করিয়াছেন, কখনো তাহার এক কপর্দ্দকেরও প্রতিদানের প্রত্যাশা করেন নাই। এই জন্যই বোধ হয় তাঁহার শিক্ষার ও চরিত্রের প্রভাব এ দেশের, বিশেষতঃ পূর্ব্ববঙ্গের, ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্তযুবকমণ্ডলীর মধ্যে এতটা ছড়াইয়া পড়িয়াছে। প্রধনতঃ অশ্বিনীকুমারের শিষ্যেরাই পূর্ব্ববঙ্গের জেলায় জেলায় সাচ্চা স্বদেশীর পুরোহিত হইয়া বসিয়া আছেন। স্বদেশী যে পূর্ব্ববঙ্গে এতটা শক্তিশালী হইয়াছিল, এবং এখনো হইয়া আছে, তাহার প্রধান কারণ অশ্বিনীকুমারের চরিত্র ও শিক্ষা। স্কুল ও কলেজ খুলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দ্দিষ্ট গ্রন্থাবলী পড়াইয়াই যুবকগণের শিক্ষার কাজ শেষ হইল, অশ্বিনীকুমার কখনো এমনটা মনে করেন নাই। শিষ্যদিগের চরিত্রগঠনের জন্যও তিনি সর্ব্বদা প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন। চরিত্রগঠনের উপায় কেবলমাত্র উপদেশ নহে, কিন্তু সদ্নুষ্ঠান। অশ্বিনীকুমার আপনার স্কুল ও কলেজের যুবকমণ্ডলীর মধ্যে ক্রমে ক্রমে বিবিধ সদনুষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করিতে আরম্ভ করেন। চরিত্রগঠনের মূলে পরার্থপরতাসাধন। লোকসেবার ভিতর দিয়া যে ভাবে ও যে পরিমাণে এই পরার্থপরতা– সাধন করিতে পারা যায়, আর কোনও উপায়ে তাহা পারা যায় না। অশ্বিনীকুমারের শিষ্যেরা দল বাঁধিয়া বরিশালের আর্তজনের সেবায় নিযুক্ত হইতেন। বহু দিন হইতেই বরিশালে মাঝে মাঝে বিসূচিকার নিরতিশয় প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকে। অশ্বিনীকুমারের স্কুল এবং কলেজের যুবকেরা সে সব সময়ে জাতিবর্ণনির্বিশেষে লোকের ঘরে ঘরে যাইয়া রোগীর শুশ্রূষা করিয়াছেন। মামলা-মোকদ্দমা উপলক্ষে পল্লীগ্রাম হইতে বহু লোক সর্ব্বদাই বরিশালে যাতায়াত করে। বরিশাল মুসলমানপ্রধান স্থান। সহরের এই সকল অভ্যাগতদিগের মধ্যে মুসলমানদিগের সংখ্যাই বেশী হয়। ইহারা সহরে আসিয়া মোসাফেরখানায় বা হোটেলে আশ্রয় লইয়া থাকে। এই সকল হোটেলের স্বাস্থ্যরক্ষার কোনো ব্যবস্থাই যে নাই, ইহা বলা বাহুল্য মাত্র; বিশেষতঃ আপনার পরিবার পরিজন হইতে দূরে আসিয়া এরূপ বন্ধুহীন স্থানে বিসূচিকা দ্বারা আক্রান্ত হইলে লোকের কত না দুর্গতি হয়, ইহা সহজেই অনুমান করা যায়। অশ্বিনীকুমারের শিষ্যেরা সর্ব্বদা নিতান্ত আপনার জনের মত এই সকল অসহায় রোগীর সেবা করিয়া আসিয়াছেন। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য এবং কায়স্থ সন্তানেরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করিয়া ইহাদিগের মলমূত্র পরিষ্কার করিয়াছেন। অশ্বিনীকুমার এবং তাঁহার বন্ধুবর্গ অকাতরে এই সকল বিপন্ন লোকের ঔষধ এবং পথ্যাদির ব্যবস্থা করিয়াছেন। 'বরিশালের এই সেবকদল অনেক বন্ধুহীন লোকের মৃতদেহের সৎকার পর্যন্ত করিয়াছেন। সহরের বরাঙ্গনাগণ পর্য্যন্ত ইহাদের এই সেবা হইতে কখনো বঞ্চিত হয় নাই। অশ্বিনীকুমারের শিষ্যেরা বিপন্ন রোগীর শুশ্রূষা করিতে যাইয়া কখনো কোনো দিন কোনো প্রকারের জাতিবর্ণের বিচার করেন নাই। আকালে, অন্নকষ্টে, হিন্দুমুসলমাননির্ব্বিশেষে ইহারা দেশের এবং বিদেশের সম্পন্ন লোকদিগের নিকট হইতে দ্বারে দ্বারে অর্থ ভিক্ষা করিয়া বিপন্ন জনের ক্ষুন্নিবারণের উপায় করিয়া দিয়াছেন। অশ্বিনীকুমারের লোক-সেবা কেবল যে সহরে আবদ্ধ ছিল তাহা নহে। বহু দিন হইতে অশ্বিনীকুমারের স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। কতকটা নিজের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য, আর কতকটা আপনার বিষয়কর্ম্ম উপলক্ষেও তিনি আপনার জেলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নৌকাযোগে ঘুরিয়া বেড়াইয়া থাকেন। এই সকল সফরের সময় দেশের গরীব লোকেরা সর্ব্বদাই নানা বিষয়ে তাঁহার সাহায্য এবং সেবা পাইয়া আসিয়াছেন; অশ্বিনীকুমারের নৌকা কোথাও আসিয়াছে, শুনিলেই সে স্থানের গরীব লোকেরা আপন আপন শরীর-মনের বোঝা লইয়া নিতান্ত আপনার জন ভাবিয়া তাঁহার নিকটে যাইয়া উপস্থিত হইয়া থাকে। রোগী ঔষধ চায়, দরিদ্র অর্থ চায়, জিজ্ঞাসু উপদেশ চায়, আর যাহার চাহিবার কিছুই নাই, সেও তাঁহাকে চক্ষে দেখিয়া কেবল মাত্র কৃতার্থ হইবার জন্য তাঁহার কাছে যাইয়া উপস্থিত হয়। সকলের অভাব বা প্রার্থনা যে তিনি সর্ব্বদা পূরণ করিতে পারিয়াছেন, তাহা নহে। ভগবানের নিকটেও মানুষ সর্ব্বদা কত কি চায়, কিন্তু যাহা চায় তাহাই যে পায়, এমন নহে; তথাপি ঈপ্সিতলাভ না হইলেও তাহাদের প্রাণে শাস্তিলাভ হইয়া থাকে। অশ্বিমীকুমারের সম্বন্ধেও কতকটা তাই হয়। সকলের প্রার্থনা পূরণ করা তাঁহার সাধ্যাতীত, কোনো মানুষই তাহা পারে না। তবে মিষ্ট কথায়, স্নেহসিক্ত সম্ভাষণে অন্তরের সহানুভূতি ও সমবেদনা দিয়া সকল মানুষই অপর মানুষের প্রাণটা ঠাণ্ডা করিয়া দিতে পারে। অশ্বিনীকুমার এটা সর্ব্বদাই করিয়াছেন। এই জন্য বরিশালের জনসাধারণের সঙ্গে বহুদিন হইতে তাঁহার একটা গভীর প্রাণের যোগ গড়িয়া উঠিয়াছে।

 কি সহজ উপায়ে, তিনি লোকের মনোরঞ্জন করিতেন, পারে আমাদের পক্ষে অনেক সময় তাহা কল্পনা করিয়া উঠাও অসম্ভব হইয়া পড়ে। একটা সামান্য ঘটনার কথা মনে পড়িল। সে বেশী দিনের কথা নয়; স্বদেশী আন্দোলনের তখন খুব প্রাদুর্ভাব। বরিশালে একটা অতি বিস্তৃত ও স্বল্পবিস্তর সঙ্গতিসম্পন্ন নমঃশূদ্র-সমাজ আছে। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ খৃষ্টীয়ান হইয়া গিয়াছে; কেহ কেহ লেখাপড়াও শিখিয়াছে। এই সকল সূত্রে পাশ্চাত্য সাম্যবাদের প্রভাবও কিয়ৎপরিমাণে এই নরঃশূদ্র-সমাজে প্রবেশ করিয়াছে। নমঃশূদ্রেরা কোনও বিষয়েই দেশের অপরাপর শূদ্রগণ অপেক্ষা হীন নহে; অথচ ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চতর শ্রেণীর লোকেরা স্বচ্ছন্দে অপর শূদ্রদের জল গ্রহণ করেন; নমঃশূদ্রের জল গ্রহণ করেন না। নমঃশূদ্রেরা এ জন্য আপনাদিগকে অযথা অপমানিত মনে করিয়া এই প্রথার বিরুদ্ধে একটা প্রবল আন্দোলন জাগাইয়া তুলিয়াছেন। স্বদেশীর মুখে নমঃশূদ্রদিগের এই আন্দোলনটা বেশই বাড়িয়া উঠে। স্বদেশীদলের আত্মবিরোধ বাধাইবার জন্য স্বদেশীর বিরোধিগণ নমঃশূদ্রদিগের এই আন্দোলনে নানা ভাবে ইন্ধন প্রদান করিতে আরম্ভ করে। বরিশালের একজন নিষ্ঠাবান স্বদেশসেবক নমঃশূদ্রকে একদিন কেহ বলেন যে, “বাবুরা ত ‘বন্দে মাতরম্' বলিয়া ভাই ভাই একঠাঁই করিয়াছেন, কিন্তু তোমাদিগকে নমঃশূদ্র বলিয়া ঘৃণা করেন কেন? ভদ্রসমাজে তোমাদের জল চলে না, হুঁকা চলে না, তবুও তোমরা তাদের ভাই; কথাটী মন্দ নয়!” এ কথা শুনিয়া এই ব্যক্তির মনে একটা খটকা বাধিয়া যায়। সে সময়ে অশ্বিনীবাবু সেই অঞ্চলেই উপস্থিত ছিলেন। আপনার সন্দেহ মিটাইবার জন্য এই নমঃশূদ্র স্বদেশসেবক অশ্বিনীকুমারের নিকট যাইয়া উপস্থিত হইলেন। অশ্বিনীকুমারের সঙ্গে তাঁর পূর্ব্বে সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। অশ্বিনীকুমার আপনার নৌকায় নিজের শয্যার উপরে বসিয়া ছিলেন। শয্যার নিকটেই একটা ফরাশ পাতা ছিল। নমঃশূদ্রটা অশ্বিনীকুমারের প্রকোষ্ঠের দ্বারদেশে যাইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিলেন; অশ্বিনীকুমারও অমনি দাঁড়াইয়। অভ্যাগতকে প্রতিনমস্কার করিলেন এবং সেই প্রকোষ্ঠের ভিতরে তাঁহাকে ডাকিয়া তাঁহার পরিচয় লইয়া তাহার সঙ্গে যাইয়া সেই ফরাশে বসিলেন। তার পর অশ্বিনীকুমার তাঁহার প্রয়োজন জানিতে চাহিলে নমঃশূদ্রটী বলিলেন—“বাবু, আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু তাহা জিজ্ঞাসা করা এখন অনাবশ্যক; আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পাইয়াছি। আপনি যখন আমাকে লইয়া এক বিছানায় বসিয়া কথা কহিয়াছেন তাহাতেই, বুঝিয়াছি, 'বন্দে মাতরম্' সত্য এবং আমরা আপনাদের ভাই।” ঘটনাটী অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু ইহাতে কি সহজ, কি সামান্য ও স্বাভাবিক উপায়ে অশ্বিনীকুমার বরিশালে সর্ব্বসাধারণের চিত্তের উপরে আপনার এই অনন্যপ্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়াছেন ইহা বুঝিতে পারা যায়।

 সে কালের অধিকাংশ ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙ্গালীর মতন প্রথম যৌবনে অশ্বিনীকুমারও ব্রাহ্মসমাজের চিন্তা ও আদর্শের দ্বারা স্বল্পবিস্তর অভিভূত হইয়াছিলেন। এমন কি এক সময়ে তাঁর যৌবন-বন্ধুরা ভাবিয়াছিলেন যে বুঝিবা অশ্বিনীকুমার প্রকাশ্যভাবেই ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইয়া পড়েন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের যুক্তিবাদ এবং ধর্ম্মের আদর্শকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিয়াও অশ্বিনীকুমার তাহার সমাজ-দ্রোহিতার সঙ্গে প্রাণ খুলিয়া যোগদান করিতে পারেন নাই। এই জন্যই দেশে ফিরিয়া, পিতার আদেশে, খাঁটি হিন্দু পদ্ধতি অনুসারে বিবাহ করিয়া, গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ করিলেন। আমি যতদূর জানি মত ও বিশ্বাসে অশ্বিনীকুমার এখনও অনেকটা ব্রাহ্মভাবাপন্নই হইয়া আছেন; কিন্তু এ সত্ত্বেও বোধ হয় এ পর্য্যন্ত প্রচলিত হিন্দুসমাজের নিতান্ত বিরোধী কোনও আচার ব্যবহারে লিপ্ত হন নাই। খাদ্যাখাদ্য ও আচার-বিচার সম্বন্ধে তিনি চিরদিনই উদার হিন্দুর মতন জীবন যাপন করিয়া আসিয়াছেন। অশ্বিনীকুমারকে যাঁরা পছন্দ করেন না, তাঁরা ইহাকে তাঁর কাপুরুষতার লক্ষণ বলিয়া প্রচার করেন। তাঁর বন্ধুরা বলেন, অশ্বিনীকুমার নিতান্ত সত্যবাদী ও ধর্মভীরু বলিয়াই সমাজবিধি মানিয়া চলেন। আমার মনে হয় যে, যে উপাদানে দ্রোহি-চরিত্র রচিত হয়, অশ্বিনীকুমারের মধ্যে সে বস্তু কোনও দিনই বেশী ছিল না। থাকিলে তিনি যেমনটী হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছেন ও যে কাজটী করিয়াছেন, তাহা করিতে পারিতেন বলিয়াও বোধ হয় না।

 একটা ছবির মধ্যে যেমন আলো ও ছায়ার যথাযোগ্য সমাবেশেই তার সৌন্দর্য্য ফুটিয়া উঠে, মানুষের চরিত্রেও সেইরূপ ভালমন্দ মিশিয়া, তার বিশিষ্টতাকে গড়িয়া তোলে। অশ্বিনীকুমারের মধ্যে যে কিছু দুর্ব্বলতা লোকে লক্ষ্য করে, তাহার সঙ্গেই তাঁর চরিত্রের অনন্যসাধারণ শক্তিও অতি ঘনিষ্ঠ, অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশিয়া আছে। এক্ষেত্রে মন্দটুকুকে ছাটিয়া ভালটুকু রাখা সম্ভব হয় না। দ্রোহিতা মাত্রেই প্রবল রাজসিকতার ফল। সমাজ-সংস্কারকেরা সকলেই রাজসিক স্বভাবের লোক। এমন কি, পুরাতনকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া যে সকল যুগপ্রবর্ত্তক মহাপুরুষ বা অবতার নব নব যুগধর্ম্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁদের সকলকেই স্বকার্য্যসাধনের জন্য এই রজোধর্ম্মের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়। এই জন্য আমাদের দেশের যুগাবতার মাত্রেই ক্ষত্রিয় ছিলেন। এক পরশুরামকেই ব্রাহ্মণ দেখিতে পাই, কিন্তু পরশুরামও ব্রাহ্মণকুলেই কেবল জন্মিয়াছিলেন, ব্রাহ্মণ্যধর্ম পালন করেন নাই; জন্মে ব্রাহ্মণ হইয়াও কর্ম্মে-সর্ব্বতোভাবেই তিনি ক্ষত্রিয় হইয়াছিলেন। এই রাজসিকতা হইতেই সর্ব্বপ্রকারের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রেরণা আইসে। আর সংস্কার, বিদ্রোহ, সকলই এই আত্মপ্রতিষ্ঠার রূপান্তর ও নামান্তর মাত্র। অশ্বিনীকুমারের মধ্যে কোনও দিন এই আত্মপ্রতিষ্ঠার বা এই সংগ্রামশীলতার, বা এই প্রখর রাজসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় নাই। এগুলি থাকিলে তাঁর চরিত্র এমন মোলায়েম, ও তাঁর জীবনব্রত এতটা সফল হইতে পারিত না।

 অশ্বিনীকুমার প্রকাশ্যভাবে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত না হইলেও বহুদিন পর্য্যন্ত ব্রাহ্মমতাবলম্বী ছিলেন, য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ এবং ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতাই ব্রাহ্মমতের মূল ভিত্তি। এই দুইটী সিদ্ধান্তকে আশ্রয় করিয়াই, ব্রাহ্ম আচার্য্যগণের প্রকৃতিগত আস্তিক্যবুদ্ধি বর্ত্তমান ব্রাহ্মধর্ম্মকে গড়িয়া তুলিয়াছে। আর এই যুক্তিবাদ ও অনধীনতার আদর্শ উভয়ই ইংরেজিশিক্ষার প্রত্যক্ষ ফল। ইংরেজি শিখিয়া আমরা সকলেই এ গুলির দ্বারা একদিন স্বল্পবিস্তর অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলাম। অশ্বিনীকুমারও এ প্রভাবকে অতিক্রম করিতে পারেন নাই। কিন্তু বয়োবৃদ্ধি সহকারে, অন্তর্দৃষ্টি জাগিতে আরম্ভ করিলে এবং সংসারের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাইয়া সকল বিষয়ের চারিদিক অনুধাবন করিবার শক্তি জন্মিলে, চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রকেই প্রথম যৌবনের এই নিরঙ্কুশ অনধীনতা ও যুক্তিবাদের প্রভাব হইতে অল্পবিস্তর মুক্ত করিয়া দিতে থাকে। প্রথম যৌবনে আমরা নিজেদের বিচারবুদ্ধিকেই সত্যাসত্য ও ধর্ম্মাধর্ম্মের একমাত্র মাপকাঠি বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলাম। তখন বুঝি নাই যে এ পথে যাইলে বস্তুতঃ সত্যে ও মতে কোনও পার্থক্য থাকে না, আর ধর্ম্মের ও সত্যের কোনও সনাতন, সার্ব্বভৌমিক প্রতিষ্ঠাও মিলে না। আমার বিচারবুদ্ধি যদি সত্যাসত্যের একমাত্র কষ্টিপাথর হয়, তবে তোমার বিচার-বুদ্ধিই বা তাহা হইবে না কেন, ব্যক্তিত্বাভিমানী যুক্তিবাদ এ. প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারে না। এ পক্ষে য়ুরোপেও ক্রমে একটা মানসিক অরাজকতা জাগিয়া উঠিয়াছে। এই কারণেই সেখানে সমাজবন্ধন ও রাষ্ট্রবন্ধন উভয়ই অত্যন্ত শিথিল হইয়া, আধুনিক সভ্যতা ও সাধনার মূল ভিত্তিকে পর্য্যন্ত বিধ্বস্ত করিবার উপক্রম করিয়াছে। অশ্বিনীকুমার বয়োবৃদ্ধি সহকারে এই যুক্তিবাদের অপূর্ণতা প্রত্যক্ষ করিয়া সদ্‌গুরুর আশ্রয়লাভ করেন। আর তদবধি তাঁর ধর্ম্মজীবন ও কর্মজীবন উভয়ই এক অভিনব পথ ধরিয়া ফুটিয়া উঠিতে আরম্ভ করে।

 এই সদ্‌গুরু তত্ত্বটী যে কি ইহা এখনও আমাদের নব্য শিক্ষিত সমাজ ভাল করিয়া ধরিতে পারেন নাই। গতানুগতিক পন্থা অবলম্বনে যাঁরা গুরুকরণ করিয়া এদেশে ধর্ম্মসাধন করেন, তাঁরাও কেবল নিষ্ঠাগুণে কোনও কোনও স্থলে সাধনপথে বিশেষ অগ্রসর হইলেও, প্রকৃত গুরুতত্ত্ব যে কি ইহা কিছুই বুঝেন বলিয়া মনে হয় না। গুরুকরণ ও গুরুশক্তিকে তাঁরা একটা অতিলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বলিয়াই মনে করেন, আর গুরুনির্ব্বাচনেও প্রায় কোনও প্রকারের বিচারবিবেচনা করেন না। অধিকাংশ লোকে কুলগুরুকেই সদ্‌গুরু বলিয়া মনে করেন, অপর কেহ কেহ বা কুলগুরু ত্যাগ করিয়া কোনও সাধুপুরুষের নিকটে দীক্ষা লইয়া, দীক্ষাগুরুকেই সদ্‌গুরু বলিয়া ভাবিয়া থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কুলগুরু বা দীক্ষাগুরু এঁদের দু’এর কেহই সদ্‌গুরু নহেন। কুলগুরুতে আর সদ্‌গুরুতে যে প্রভেদ অনেক, একথা আজি কালি একটু আধটু ধর্ম্মচর্চ্চা যাঁরা করেন, তাঁরা সকলেই স্বল্পবিস্তর বুঝিয়া থাকেন। জন্মনিবন্ধন যে কেহ অপরের ধর্মপথের সহায় ও নায়ক হইতে পারে না, এই মোটা কথাটা এদিনে আর কাহাকেও বুঝাইতে হয় না। শিক্ষিত লোকেরা এখন আর কুলগুরু গ্রহণ করেন না; অধিকাংশ লোকে কোনও গুরুই গ্রহণ করেন না, যাঁরা করেন, তাঁরা কোনও সাধুসন্তের নিকটে মন্ত্রদীক্ষা লইয়া, ধর্মসাধন করিবার চেষ্টা করেন। দীক্ষাগুরু কুলগুরু অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ হইলেও, কেবল ধর্ম্মসাধনেই তিনি শিষ্যের সহায় হইতে পারেন মাত্র, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অপ্রকট ও অব্যক্ত ভগবদ্বস্তুকে আত্মপ্রভাবে শিষ্যের অন্তরে প্রকট ও ব্যক্ত করিবার অধিকার তাঁরও নাই। দীক্ষাগুরু সাধক বা সিদ্ধপুরুষ পর্য্যন্ত হইতে পারেন; তিনি পথ দেখাইয়া দিতে পারেন, আপনার আধ্যাত্মিক শক্তিপ্রভাবে শিষ্যের চিত্তকে অধিকার করিয়া, তাঁহার অস্তরে সাধনের ও ভক্তির প্রেরণা পর্য্যস্ত প্রদান করিতে পারেন। কিন্তু সাধ্য—বস্তুকে প্রকাশ করিতে পারেন না। এটী কেবল সদ্‌গুরুরই কর্ম্ম। আর এই জন্যই সদ্‌গুরুকে লোকে ও শাস্ত্রে ভগবানের বিগ্রহ বলিয়া গ্রহণ করিয়া থাকে। কুলগুরু বা দীক্ষাগুরুর এই অধিকার নাই। এক অর্থে মানুষ মাত্রই মানুষের গুরু; আর কেবল মানুষই বা বলি কেন, পশুপক্ষীকীটপতঙ্গাদির নিকটও মানুষ কত শিক্ষালাভ করে বলিয়া তাহারাও গুরুপদবাচ্য। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড—জড় জীব সকলেই এক অর্থে ভগবানের প্রকাশও বটে; সকলেই সেই অব্যক্তকে নিয়ত ব্যক্ত করিতেছে। সকলেই তাঁর অবতার। কিন্তু এইরূপ ব্যাপক ও সাধারণ অর্থে সদ্‌গুরুকে ভগবানের বিগ্রহ বলা যায় না। ঈশ্বর নিরাকার ও চৈতন্যস্বরূপ, তিনি আমাদের অন্তরে অন্তর্য্যামিরূপে রহিয়াছেন। তিনি পরমাত্মা, তিনি সর্ব্বাত্মা, তিনি বিশ্বাত্মা। কিন্তু জীব তাঁহাকে দেখে কৈ? সকল জ্ঞানকে যিনি উদ্বুদ্ধ করিতেছেন, জ্ঞান তাঁহাকে ধরিতে পারে না। পারে না এইজন্য যে তিনি জ্ঞানের মূলেই আছেন, জ্ঞানের বিষয়রূপে, জ্ঞেয়রূপে সকলের প্রত্যক্ষ হন না। ভগবান সদ্‌গুরুরূপেই জীবে সাক্ষাৎকার হইয়া থাকেন। যিনি অন্তর্য্যামী, তিনিই সদ্‌গুরু। ভাগবত ভগবানকেই আচার্য্য বলিয়াছেন— আচার্য্যকে মনুষ্যজ্ঞানে কখনও অসূয়া করিবে না। আর দ্বিবিধরূপ ধারণ করিয়া শ্রীভগবান জীবের সর্ব্বপ্রকারের অমঙ্গল নিরস্ত করিয়া, তাহার সদগতি করিয়া থাকেন। ইহার এক অন্তর্যামিরূপ, আর এক মোহান্ত বা সদ্‌গুরু। কেবল অন্তরবৃত্তি বা আত্মপ্রত্যয় বা সহজজ্ঞান বা ইণ্টুইষণের দ্বারা আমরা কোনও জ্ঞানলাভ বা রসাস্বাদন করি না। অন্তরে যার ছাঁচ আত্মপ্রত্যয়রূপে রহিয়াছে, তার অনুরূপ বস্তু যতক্ষণ না বাহিরে প্রকাশিত হয়, ততক্ষণ সেই অন্তরের আত্মপ্রত্যয় জাগিয়া উঠে না। ভিতরের ঐ ছাঁচে বাহিরের বস্তু পড়িলেই আমাদের জ্ঞানলাভ হইরা থাকে। অন্তরের ঐ আত্মপ্রত্যয়কে ইংরেজিতে subjective intuitions বলে—কেবল intuitions ও বলিয়া থাকে। আর বাহিরের বস্তুকে object বলে। ইন্‌টুইষণ বা আত্মপ্রত্যয়কে forms of knowledge, আর বাহিরের বিষয়কে contents of knowledge বলে। এই ছাঁচের বা forms’ এর সঙ্গে এই contents বা বস্তুর মিলন হইরাই সর্বপ্রকারের জ্ঞান ফুটিয়া উঠে। আমাদের সদ্‌গুরুতত্ত্ব এই দার্শনিক সিদ্ধান্তের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ভিতরে ঈশ্বরের জ্ঞান আত্মপ্রত্যয়রূপে আছে, ইহা সত্য। কিন্তু এ জ্ঞান আমাদের জ্ঞানগোচর নহে। যখন বাহিরে ঈশ্বরের ধর্ম্মসম্পন্ন কোনও বস্তুর সাক্ষাৎকার লাভ করি, তখনই কেবল আমাদের ভিতরকার ঐ ঐশ্বরজ্ঞান জাগিয়া উঠে। বাহিরে, সংসারে, পিতাকে দেখিয়াই ভগবানের পিতৃত্ব, এখানে মাতাকে দেখিয়াই তাঁহার মাতৃত্ব, এখানকার সখাসখীদের সখ্য আস্বাদন করিয়াই তাঁহার সখ্য, এখানকার মাধুর্য্যসম্ভোগ করিয়াই তাঁহার মাধুর্যের জ্ঞানলাভ করিয়া থাকি। এ সকল জ্ঞান ভিতরেরই বস্তু বটে, কিন্তু বাহিরের সংস্পর্শ-লাভ না করিলে এই ভিতরের জ্ঞান জাগে না। এইজন্য “যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে”, একদিকে যেমন এই কথা অতি সত্য, সেইরূপ অন্যদিকে, যাহা দেখি না ব্রহ্মাণ্ডে তাহা জাগে না ভাণ্ডে, এই কথাও ঠিক ততটাই সত্য। ভাণ্ড সত্যের আধখানা, ব্রহ্মাণ্ড তার অপরার্দ্ধ। এই দুই’এতে সত্য পূর্ণ ও প্রকট হয়। এখন প্রশ্ন এই—-ভগবানকে আমরা জানিতে পারি, না জানিতে পারি না। কেবল অন্তর্য্যামিরূপে তাঁহাকে জানিলে, তাঁর আধখানা মাত্র জানা হয়। ফলতঃ বাহিরে তাঁর যে সকল প্রকাশ হয় ও হইতেছে, সেগুলিকে ছাড়িয়া, তাঁর অন্তর্য্যামিরূপেরও কোনও সত্য ও অর্থ প্রতিষ্ঠিত হয় না। অন্তরে আমাদের যে সদসদ্জ্ঞান বা ধর্ম্মবুদ্ধিকে তিনি জাগাইয়া দেন, তার সঙ্গে বাহিরের বিষয়-রাজ্যের ও সমাজ-জীবনের সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও অঙ্গাঙ্গী। আমাদের ধর্মাধর্ম্ম আমরা যে সমাজে বাস করি, বা যে সকল বিভিন্ন সমাজের সঙ্গে বিবিধ সম্বন্ধে আবদ্ধ হই, তারই আশ্রয়ে ফুটিয়া থাকে। বাহিরে যার প্রকাশ হয় না, ভিতরে তার জ্ঞান জাগে না, জাগিতে পারে না। ভগবানকে বাহিরে দেখিলে তবে ভিতরে তাঁর সত্য জ্ঞানলাভ করা সম্ভব হয়। এইজন্য ভগবানের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ যে সকল মহাপুরুষের মধ্যে হয়, তাঁহারাই জগতে সকল ধর্মের প্রত্যক্ষ আশ্রয় হইয়া রহেন। ইহাই অবতারের মূল অর্থ ও মুখা প্রয়োজন। ইহাই সদ্‌গুরুতত্ত্বেরও প্রতিষ্ঠা। যাঁহার মধ্যে শিষ্যের অন্তরের আত্মপ্রত্যয়নিহিত ভগবদ্‌বাদ ও ভগবদাদর্শ প্রকট হইয়া, তাহার ভক্তি ও আনুগত্যকে একান্তভাবে টানিয়া লয়, তিনিই প্রকৃতপক্ষে সদ্‌গুরুপদবাচ্য। তাঁহাকে দেখিয়াই শিষ্য ও সাধক, আপনার সাধ্যবস্তুর প্রত্যক্ষলাভ করেন। অবতারেরা যুগে যুগে প্রকাশিত হন, সদ্‌গুরুতে ভগবান নিত্য অবতীর্ণ। এই সদ্‌গুরুতত্ত্বেতেই স্বাধীনতা ও আনুগত্যের, স্বানুভূতি ও শাস্ত্রের, মত ও সত্যের, আত্মপ্রত্যয় ও বিষয়-প্রত্যক্ষের, সকল সমস্যার চূড়ান্ত মীমাংসা হইয়া থাকে। এখানেই সর্ব্বধর্ম্ম সমন্বয় হয়। অশ্বিনীকুমার প্রথম যৌবনের ব্যক্তিত্বাভিমানী যুক্তিবাদের অপূর্ণতা প্রত্যক্ষ করিয়া, সদ্‌গুরুচরণাশ্রয় পাইয়াই ক্রমে স্বাধীনতার সঙ্গে আনুগত্যের সমন্বয় পক্ষে অগ্রসর হইতে আরম্ভ করেন।  অশ্বিনীকুমার এই উদার ও গভীর গুরুতত্ত্ব বুঝিয়া, পরে গুরুকরণ করিয়াছিলেন, ইহা মনে হয় না। দীক্ষা গ্রহণের পূর্ব্বে অতি অল্পলোকেই এই তত্ত্বের মর্ম্ম বুঝিতে পারেন। বিশেষতঃ আমরা আজি কালি যেরূপ শিক্ষাদীক্ষা পাইয়া থাকি, তাহাতে এই গভীর তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা কিছুতেই সহজ নহে। এই তত্ত্ব গুরুগ্রহণের পরে, গুরুকৃপাতেই কেবল, ক্রমে ক্রমে শিষ্যের প্রাণে ফুটিয়া উঠে। একালে অধিকাংশ শিক্ষিত লোকই সাধু মহাপুরুষবিশেষের উন্নত ও উদার চরিত্রে মুগ্ধ হইয়াই তাঁদের শরণাপন্ন হন। অশ্বিনীকুমারও, বোধ হয়, এই ভাবেই, তাঁর গুরুদেবের চরণে যাইয়া প্রথমে উপস্থিত হন। একদিকে তাঁর সহজ ধর্ম্মপিপাসা মামুলী ব্রাহ্মধর্ম্মের রূপকোপাসনা ও মানস-কল্পিত সাধনভজনে মিটাইতে পারে নাই। অন্যদিকে মামুলী ব্রাহ্ম-সিদ্ধান্তের যুক্তিবাদ সত্যের সম্যক্ প্রামাণ্যও প্রতিষ্ঠা করিতে পারে নাই। ইহাতে জ্ঞান ও ভাব, দু’এর কিছুই পরিপূর্ণ তৃপ্তিলাভ করিতে পারে নাই। আর এই দ্বিবিধ অভাব পরিপূরণের আশাতেই, বোধ হয়, অশ্বিনীকুমার গুরুগ্রহণ করেন। প্রথম যৌবনে, ইংরেজি শিক্ষার ও য়ুরোপীয় যুক্তিবাদের বা র‍্যাশনিলিজ্মে‌র (Rationalism) প্রভাবে যাঁরা ব্রাহ্মসমাজের আশ্রয়ে আসিয়া, পরে গুরুদীক্ষাগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁদের প্রায় সকলের ভিতরকার কথাই ইহা। অশ্বিনীকুমারের অন্তর্জীবনের কাহিনী যে অন্যরূপ এরূপ অনুমানের কোনও হেতু আছে বলিয়া বোধ হয় না। আর এই পথে আসিয়া গুরুগ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া, অশ্বিনীকুমার একেবারেই যে আমাদের দেশের প্রাচীন গুরুতত্ত্বটী পূর্ণমাত্রায় বুঝিয়াছিলেন, এমন 'কল্পনা করা কঠিন।

 সদ্‌গুরুতত্ত্ব সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলে, গুরুর চরণে একান্ত আত্মসমর্পণ অনিবার্য্য হইয়া উঠে। যিনি অন্তর্য্যামী, তিনিই সদ্‌গুরু, অন্তরে যাঁর প্রেরণা জাগে, বাহিরে তিনিই আপনি আপনাকে প্রকাশ করিয়া, সেই প্রেরণার প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করেন, এই কথাই আমাদের দেশের পুরাতন গুরুতত্ত্বের মূল কথা। এই কথাটা বুঝিলে আত্মপ্রত্যয়ের হাতে আপনাকে ছাড়িয়া দেওয়া, আর শ্রীগুরুর হাতে আপনাকে ছাড়িয়া দেওয়া দুই এক হইয়া দাঁড়ায়। ভিতরে যিনি ধর্ম্মাবহ, অন্তরে আমাদের ধর্ম্মবুদ্ধির ভিতর দিয়া যিনি সর্ব্বদা আমাদিগকে ভালমন্দের উপদেশ দান করেন, তিনিই যদি বাহিরে, চাক্ষুষ “মোহান্ত”—গুরুরূপে প্রকাশিত হন, তখন এই গুরুর আদেশ আর ইংরেজিতে যাহাকে কনস্যন্স (Conscience) এবং আমাদের আধুনিক বাঙ্গলা ভাষায় যাহাকে বিবেক বলে, এই উভয়ই এক হইয়া যায়। সুতরাং বিবেকবাণী আর গুরুবাক্য সমান মর্য্যাদা ও প্রামাণ্য প্রাপ্ত হয়। প্রকৃত গুরুতত্ত্ব এই কথাই বলে। তবে ভিতরের conscience বা বিবেকবাণী আর বাহিরের গুরুবাক্যের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইলে, কোন্‌টা বলবত্তর হইবে, একথা ওঠে বটে। সদ্‌গুরুতত্ত্ব বলে, এরূপ বিরোধ অসম্ভব। ফলতঃ সদ্‌গুরু কে আর সদ্‌গুরু কে নহেন, এখানেই তার প্রকৃত পরীক্ষাও হইয়া থাকে। সদ্‌গুরু স্বয়ং অন্তর্য্যামী। তিনি শিষ্যের অন্তর জানেন, কেবল ইহাই নহে, তার অন্তরে যে সকল প্রেরণা জাগে তারও প্রেরয়িতা তিনি আপনি। শিষ্যের অন্তরে তিনিই জিজ্ঞাসার উদয় করান, আবার বাহিরে মোহান্তরূপে বা আচার্য্যরূপে তিনিই শাস্ত্রাদি ব্যাখ্যা করিয়া, সে জিজ্ঞাসার নিবৃত্তিও আপনিই করিয়া থাকেন। কোন্ পথে, কি ভাবে শিষ্যের জীবন ফুটিয়া উঠিয়া, ক্রমে সে চরম সাধ্য লাভ করিবে, ইহা তিনি জানেন। জানিয়া সেই পথেই অন্তরের প্রেরণা ও বাহিরের উপদেশাদির দ্বারা তিনি তাহাকে অলক্ষিতে লইয়া যান। এই প্রকৃত গুরুপন্থা ত্রিগুণাতীত। এপথে সংসারের লৌকিক ভালমন্দের বাহ্য বিচার-বিধানের প্রয়োগ চলে না। লৌকিক বিচারে যাহা নিতান্ত মন্দ, তার ভিতর দিয়াও নিয়তই ত মামুষের জীবনে কত অদ্যূত ভাল ফুটিয়া উঠে। গুরুতত্ত্ব যারা মানেন না, তাঁরাও ত এই কথাটা অস্বীকার করেন না। মানুষ মন্দ করে, পাপ করে, অশেষবিধ অহিতাচারে নিযুক্ত হয়, অথচ ভগবান তাহাকে সেই মন্দের, সেই অহিতের, সেই পাপের ভিতর দিয়াই, অপূর্ব্ব কৌশলে, অযাচিত করুণাগুণে, তাহাকে কল্যাণের ও পুণ্যের পথে লইয়া গিয়া দাঁড় করান, একথা সকলেই কহেন। হয় বলিতে হয় যে এ সকল স্থলে ভগবানের বিশেষ বিধান সার্ব্বজনীন কার্যকারণসম্বন্ধকে বাতিল করিয়া, পাপীয় মুক্তির ব্যবস্থা করিয়া দেয়, না হয়, ঐ মন্দের মধ্যেই এই ভালর, ঐ পাপের ভিতরেই এই পুণ্যের বীজ লুকাইয়া ছিল, ইহা স্বীকার করিতে হয়। পাপ পাপই প্রসব করে; পুণ্য হইতে পুণ্যই উৎপন্ন হয়। যুক্তি ও নীতি এই কথাই বলে। আর ইহাই যদি এ ক্ষেত্রে শেষ কথা হয়, তাহা হইলে খৃষ্টীয়ানী অনন্তনরকবাস, কিম্বা বৌদ্ধ কর্ম্মবাদ, ভিন্ন, আর কোনও কিছুর প্রতিষ্ঠা হয় না। আর নরকবাদ এবং কর্ম্মবাদ উভয়ই ভাগবতী করুণাকে সঙ্কুচিত ও অসমর্থ করিয়া রাখে। যাঁরা ভগবানের করুণায় বিশ্বাস করেন, তাঁরা মন্দের ভিতর দিয়াই ভাল, অকল্যাণের ভিতর দিয়াই কল্যাণ, পাপের ভিতর দিয়াই পুণ্যের প্রকাশ হয়, এই কথা সর্ব্বদাই মানিয়া লন। আর এই সত্যকে প্রামাণ্য সিদ্ধান্তের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিতে গেলেই, আমাদের ভালমন্দ সকল প্রেরণাই অন্তর্য্যামী পুরুষ হইতে আসে, ইহা স্বীকার করিতেই হয়। ফলতঃ পারমার্থিক দৃষ্টিতে ভালমন্দের ভেদাভেদ থাকিতেই পারে না। সে দৃষ্টি সমদৃষ্টি। সে ভাব দ্বন্দ্বাতীত। আর সুখদুঃখ যেমন দ্বন্দ্ব, ভালমন্দ, পাপপুণ্য, এগুলিও সেইরূপ দ্বন্দ্ব। সম্যক্দৃষ্টির নিকটে সুখ আর দুঃখ দুই’ একই বস্তুর দুইদিক্ মাত্র, সেইরূপ ভাল এবং মন্দও এই বস্তুর দুইদিক্ ভিন্ন আর কিছু নহে। আজি যাহা মন্দ, কাল তাহা ভাল হয়। আজ যাহা ভাল কাল তাহা মন্দ হইয়া পড়ে। দেশ, কাল, পাত্রের বিভিন্নতার দ্বারাই এ সকল ভালমন্দের বৈষম্য ও বিচার হইয়া থাকে। ফলতঃ যাহাকে conscience বা ধর্ম্মবুদ্ধি বা বিবেকবাণী বলি, তাহাও ত সর্ব্বদা এক কথা কহে না। এই ধর্ম্মবুদ্ধিরও বিকাশ হয়। এই ধর্ম্মবুদ্ধিও আজ এক কথা, কাল এক কথা বলে। সুতরাং গুরু আজ যাহাকে যে উপদেশ দান করেন, কাল যদি তাহাকে অন্যতর উপদেশ দেন, অথবা একজনকে যাহা আদেশ করেন, অন্যকে যদি তার বিপরীত আদেশ করেন, তাহাতে তাঁর উপদেশের মর্য্যাদা বা প্রামাণ্য নষ্ট হয় না ও হইতে পারে না। তবে প্রকৃত সদ্‌গুরুর উপদেশের সঙ্গে শিষ্যের অন্তরগত প্রেরণার কখনও কোনও গুরুতর বিরোধ হয় না ও হইতে পারে না। হয়না এই জন্য যে তিনি ঐ অত্তর দেখিয়াই উপদেশ করেন। যে উপদেশ শিষ্য গ্রহণ করিতে পারিবে না, এমন উপদেশ করিয়া সদ্‌গুরু কদাপি শিষ্যকে বিব্রত ও অপরাধী করেন না। বরং তিনি তার অন্তরে অন্তর্যামিরূপে যে ভাব বা যে আকাঙ্ক্ষা বা যে জিজ্ঞাসা জাগাইয়া দেন, বাহিরে মোহান্তরূপে সেইভাবের, আকাঙ্ক্ষার বা জিজ্ঞাসার উপযোগী উপদেশ দিয়াই, তাহাকে ধর্ম্মপথে লইয়া চলেন। কিন্তু আমরা মানুষের মধ্যে যে ভগবানের পূর্ণ প্রকাশ হইতে পারে, ইহা বিশ্বাস করিতে পারি না, এইজন্য আমরা সদ্‌গুরু দেহধারী মানুষ বলিয়া, তিনিই যে আবার অন্তর্যামীও, একথা কিছুতেই ধারণা করিতে পারি না। আর এই অক্ষমতা-নিবন্ধনই সদ্‌গুরুর আশ্রয় পাইয়াও, আমরা একাত্তভাবে গুরুচরণে আত্মসমর্পণ করিতে পারি না। অশ্বিনীকুমারও এটা পারিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। তাঁর গুরু যে কেবল বাহিরের উপদেষ্টা নন, কিংবা তাঁর গুরুকৃপা যে একটা অলৌকিক উপায়ে ভগবানের শক্তি ও দয়াকে উদ্বুদ্ধ করিয়া তাঁর কল্যাণ সাধন করে না, অপিচ ভগবানই যে ঐ গুরুদেহকে আশ্রয় করিয়া, “চৈতাবপুষা” —অন্তর্য্যামিরূপে ও মোহান্তরূপে, ভিতরবাহিরে দুইদিকে তাঁহার জীবনকে চালাইয়া লইয়া যাইতেছেন, এ সকল কথা তিনি ভাল করিয়া ধরিয়াছেন কি না সন্দেহ। আমাদের কাহারই এ পর্য্যন্ত এ ভাগ্য হয় নাই। আর হয় নাই বলিয়াই আমরা সংসারতরঙ্গে পড়িয়া দিবানিশি এমন হাবুডুবু খাইয়া থাকি। অশ্বিনীকুমার এ পর্য্যন্ত খৃষ্টীয় নীতিবাদকে ছাড়াইয়া উঠিতে পারিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। তিনি খৃষ্টীয়ান্ সাধকের চক্ষেই তাঁর গুরুকে দেখেন, প্রকৃত হিন্দু সাধকের চক্ষে দেখিতে শিখেন নাই। আধুনিক খৃষ্টীয়ানেরা যিশুখৃষ্টকেই গুরুরূপে বরণ করেন। এই গুরু-খৃষ্টবাদ আর আমাদের সদ্‌গুরুতত্ত্ব মূলে একই সিদ্ধান্তের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইলেও, দু’এতে প্রভেদ বিস্তর। কোনও হিন্দু আপনার গুরুকে জীবনের আদর্শরূপে বরণ করে না। খৃষ্টীয়ান সাধকেরা যিশুকে তাঁদের জীবনের আদর্শ বলিয়া নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করিয়া থাকেন। যিশুর অনুকরণ করাই আধুনিক খৃষ্টীয়ান সাধকের মুখ্য চেষ্টা। যিশুচরিত্রলাভই এই সাধনার চরম সাধ্য। কিন্তু হিন্দুসাধক কোনও দিন ভগবানকে বা আপনার গুরুকে অনুকরণ করেন না। ভগবানকে তাঁরা ভক্তি করেন, গুরুর উপদেশ তাঁরা পালন করেন, কিন্তু ভগবানকে বা গুরুকে আপনাদের জীবনের আদর্শরূপে কোনও দিন কল্পনা করেন না। তাঁরা অধিকারীভেদ মানেন। জীবের অধিকার এক আর ভগবানের অধিকার অন্য। শিষ্যের অধিকার এক আর গুরুর অধিকার অন্য। ভগবান বিশ্বে কতভাবে লীলা করিতেছেন; তিনি সৃষ্টি করেন, রক্ষা করেন, বিনাশ করেন, সকলই করেন। তিলি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে নির্ম্মম ভাবে নষ্ট করেন। তাঁর শক্তিকে আশ্রয় করিয়াই পাপী পাপ করে; আবার পুণ্যাত্মারা সেই শক্তির প্রেরণাতেই পুণ্যকর্ম্ম করেন। এ সকলই তাঁর দ্বারা হইতেছে। জীবের পক্ষে ভগবচ্চরিত্রলাভ কেবল অসাধ্য যে তাহা নয়, ভগবানের অনুকরণের ইচ্ছামাত্র মহাপাপ। সদ্‌গুরু সম্বন্ধেও ঐ কথা। সদ্‌গুরু ভাগবতী তনু লাভ করিয়া ভগবল্লীলারসে নিমগ্ন হইয়া, কত প্রকারের আপাতবিসদৃশ কথা বলেন ও বিসদৃশ কর্ম্ম‌ করেন। ভিন্ন ভিন্ন শিষ্যকে তাঁরা বিভিন্ন উপদেশ দেন। একজনকে যাহা বিহিত ও ভাল বলিয়া আচরণ করিতে বলেন, অন্যজনকে তাহা অবিহিত ও মন্দ বলিয়া বর্জ্জন করিতে উপদেশ দেন। এ অবস্থায় শিষ্যের পক্ষে আপনার অধিকারকে উল্লঙ্ঘন না করিয়া, গুরুর অনুসরণ করা অসম্ভব। এরূপ প্রয়াসেও গুরুতর অপরাধ হইয়া থাকে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা এ সকল নিগূঢ় কথা ভাল করিয়া ধরিতে পারে না।আমাদের নীতিবাদ সকল মানুষকে ভগবচ্চরিত্রলাভ করিতে উপদেশ দেয়। কিন্তু গুরুর অনুকরণ করা নহে, অনুগত হওয়াই শিষ্যের প্রধান ধর্ম্ম। হিন্দু শিষ্য তাহাতেই কেবল এই বলিয়া প্রার্থনা করেন—

জানামি ধর্ম্মং নচ মে প্রবৃত্তিঃ
জানাম্যধর্ম্মং নচ মে নিবৃত্তিঃ।
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন
যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি।

 কিন্তু ইংরেজি শিখিয়া যে সকল যুক্তি ও সিদ্ধান্তের সাহায্যে আমরা একালে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিমার্জিত করিয়া থাকি, তাহার দ্বারা হিন্দুর এই সদ্‌গুরুতত্ত্বের নিগূঢ় মর্ম্ম ও রহস্য ভেদ করা সহজ নহে। খৃষ্টীয়ান সাধনাতেও এই তত্ত্ব যে একেবারে ফুটিয়া উঠে নাই, তাহা নহে। বিগত খৃষ্টীয় শতাব্দীর যুরোপীয় ধর্ম্ম— বিজ্ঞান কিয়ৎপরিমাণে এই তত্ত্বের উপরেই খৃষ্টীয় সিদ্ধান্তকে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছে। আধুনিক বিজ্ঞান যখন অতিলৌকিক শাস্ত্রের প্রাচীন প্রামাণ্য নষ্ট করিয়া, ধর্ম্মতত্ত্বকে মানুষের সহজ বুদ্ধি বা আত্মপ্রত্যয় বা ইণ্টুইষণের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিতে আরম্ভ করিল, তখন খৃষ্টীয়ান দার্শনিকেরা এই আত্মপ্রত্যয়বাদের অপূর্ণতা দেখাইয়া, এই আত্মপ্রত্যয়কে পূর্ণ করিবার জন্যই, যিশুখৃষ্টকে ভগবানের বহিঃপ্রকাশরূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে লাগিলেন। বাহিরে সত্যের প্রকাশ না হইলে ভিতরে তার যে সহজজ্ঞান রহিয়াছে তাহা ফোটে না ও জাগে না, ইহা প্রত্যক্ষ কথা। কার্যকারণ সম্বন্ধের একটা সহজ জ্ঞান, আত্মপ্রতায় বা ইন্‌টুইষণ আমাদের প্রকৃতির ভিতরে, প্রতোকের অন্তরে নিহিত রহিয়াছে, ইহা সত্য হইলেও, যতক্ষণ বাহিরে, বিষণ্ণ রাজ্যে কোনও বিশেষ কারণ হইতে একটা বিশেষ কার্য্যের উৎপত্তি হইতে না দেখা যায়, ততক্ষণ এই আত্মপ্রত্যয় বা ইণ্টুইষণ যে জাগে না, ইহাও ত তেমনি সত্য। অতএব ঈশ্বর সম্বন্ধে কেবল একটা আত্মপ্রতায় আছে, ইহা মানিলেই ঈশ্বরসত্তার প্রতিষ্ঠা হয় না। এই আত্মপ্রত্যয়কে জাগাইবার জন্য তাহার উপযোগী বহির্বিষয়ের প্রকাশও অত্যাবশ্যক হয়। কেবল মনোগত আস্তিক্যবুদ্ধিতে ভগবৎপ্রতিষ্ঠা হয় না। ভগবানকে বাহিরেও দেখিতে হয়। এই জন্যই তাঁর অবতারের প্রয়োজন। অবতার ব্যতীত সত্য ও প্রত্যক্ষ ঈশ্বর তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা কখনই হইতে পারে না। যিশুখৃষ্ট মানুষের ঐশ্বরিক আত্মপ্রত্যয় বা ইণ্টুইষণের বহির্বিষয়রূপে প্রকট হইয়া, ধর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত কবিয়াছেন। এই ভাবেই বিগত খৃষ্টীয় শতাব্দীর উদার ও উন্নত য়ুরোপীয় ধর্ম্মবিজ্ঞান আত্মপ্রতায় বাদের সঙ্গে অবতারবাদের সমন্বয় সাধন করিয়া, ধর্ম্মের অতিপ্রাকৃত প্রামাণ্যকে সংশোধন করিয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছে। আর এখানেই এই আধুনিক খৃষ্টতত্ত্ব আমাদের পুরাতন সদ্‌গুরুতত্ত্বের সঙ্গে অনেকটা মিলিয়া গিয়াছে। আধুনিক উন্নত ও উদার খৃষ্টীয় সিদ্ধান্তে যিশুখৃষ্টই, সদ্‌গুরুর আসনে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন। কিন্তু আমরা যে খৃষ্টীয়ান সিদ্ধান্তের কথা সচরাচর এদেশে শুনিতে পাই, তাহাতে এ সকল গভীর কথার কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। মামুলী খৃষ্টীয়ান ধর্ম্মে এ তত্ত্ব এখনও ভাল করিয়া আয়ত্ত করিতে পারে নাই। প্রচলিত য়ুরোপীয় দর্শনাদিতেও এই সত্যটা এখন পর্যন্ত পরিস্ফুট হয় নাই। সুতরাং আমরা ইংরেজি শিখিয়া ইহার কোনই পরিচয় পাই না। আমাদের আধুনিক শিক্ষা দীক্ষা এখনও খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিত্বাভিমানী যুক্তিবাদকে অবলম্বন করিয়াই চলিয়াছে।

 খৃষ্টীয় সমাজেও এখন অনেক লোকে যিশুখৃষ্টকে কেবল একজন আদর্শপুরুষ বলিয়া গ্রহণ করিয়া থাকেন। কিছুদিন হইতে এই ভাবটাই রুরোপ ও আমেরিকায় প্রধান হইয়া উঠিয়াছে। খৃষ্টেতে ঐকান্তিক আত্মসমর্পণ অপেক্ষা, আপনার সাধনবলে খৃষ্টচরিত্রের অনুশীলন ও অনুকরণ করিয়া ঐ উদার ও বিশুদ্ধ চরিত্রলাভই এখন খৃষ্টীয় সাধনের সাধ্য হইয়া পড়িয়াছে। খৃষ্টীয়ান সাধু ও সাধকেরা আপনাদের কর্তব্যাকর্ত্তব্য নির্ধারণে এখন— “যিশু এই অবস্থায় কি করিতেন?” এই প্রশ্নেরই আলোচনা করিয়া থাকেন, আর তিনি যাহা করিতেন, যেরূপ চলিতেন, তাহা করিতে ও সেইরূপ চলিতেই চেষ্টা করেন। অশ্বিনীকুমারও, আমার মনে হয়, কতকটা এরূপভাবেই আপনার গুরুদেবের পদাঙ্কানুসরণ করিয়া আপনার ধর্ম্মজীবন ও কর্ম্মজীবনকে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন। তাঁর বিস্তৃত কর্ম্মজীবনে যখনই যে সমস্যা উপস্থিত হইয়াছে, তখনই—এ অবস্থায় তাঁর গুরুদেব কি করিতেন, তিনি এই প্রশ্ন তুলিয়া, তার যথাসাধ্য মীমাংসা করিয়াই, আপনার কর্তব্য নির্দ্ধারণ করিতে গিয়াছেন। আর এই জন্যই সময় সময় লোকে তাঁর কর্ম্মজীবনে কতকটা দুর্ব্বলতা, এমন কি অব্যবস্থিততা এবং অসামঞ্জস্যেরও পরিচয় পাইয়াছে বলিয়া ভাবিয়াছে। হিন্দুর নিকটে ইহা গুণের কথা না হইয়া, অত্যন্ত দোষের কথাই হয়। হিন্দুর সাধনার একটা অতি মামুলী কথা আছে যে দেবতাদের উপদেশেরই অনুসরণ করিবে, কদাপি তাঁহাদের কর্ম্মের অনুকরণ করিবে না। আমাদের বিদেশীয় ভাবাপন্ন বিচারবুদ্ধি প্রায়ই এ কথাটাকে উপহাস্যাস্পদ বলিয়া উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করে। কখনও কখনও ইহাকে অতিশয় হীন বাক্য বলিয়াও ঘৃণা করিয়া থাকে। ইংরেজি প্রবাদ বাক্যে বলে উপদেশ অপেক্ষা আচরণ শ্রেষ্ঠ। এই হিসাবে দেবতাদের আচরণ যদি ধর্ম্মবিগর্হিত হয়, তবে তাহাদের আদেশের বা উপদেশের কোনও মূল্য ও সত্য থাকে না। কিন্তু য়ুরোপীয় সাধনা আমাদের অধিকারীভেদ মানে না। অথচ এই অধিকারীভেদই হিন্দুর সাধনার মুখ্য কথা। আমাদের সকল সাধনভজন, কর্ম্মাকর্ম্ম, ধর্ম্মাধর্ম্ম, বিধিনিষেধাদি এই অধিকারীভেদের উপরে প্রতিষ্ঠিত। এইজন্যই দেবতার অধিকারে যা সাজে ও যাহা ধর্ম্ম, মানুষের তাহা সাজে না, মানুষের পক্ষে তাহা অধর্ম্ম, ঈশ্বরকে মানুষের আদর্শ করিলে, সমাজ ধর্ম্ম ও লোকধর্ম্ম সকলই উলট্পালট্ হইয়া যায়। হিন্দু একেশ্বরবাদী, আদ্বৈততত্ত্বের উপরে হিন্দুর সকল সিদ্ধান্তের ও সাধনার প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। বিশিষ্টাদ্বৈত, শুদ্ধাদ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত, বৈষ্ণব, বৈদান্তিক, শাক্ত, শৈব, সকল সিদ্ধান্তই কোনও না কোনও আকারে এই অদ্বৈততত্ত্বকে মানিয়াছেন। আর মূলতত্ত্ব এক বলিয়া, বিশ্বের বহুধা প্রকাশের বা অভিব্যক্তির মধ্যে আপাতত বিরোধ ও বৈষম্য যাই থাকুক না কেন, মূলে একটা সমন্বয় এবং সামঞ্জস্য আছেই আছে। একান্ত ভাল বা একান্ত মন্দ, একাত্ত পাপ বা একান্ত পুণ্য বলিয়া কোনও কিছু জগতে নাই। এক ক্ষেত্রে যাহা ভাল অন্য ক্ষেত্রে তাহাই মন্দ। এক অবস্থায় ও এক অধিকারে যাহা পাপ, অন্য অধিকারে তাহা পাপ নহে। এ সকল কথা হিন্দু সাধনার গোড়ার কথা, সুতরাং মানুষের চক্ষে ও মানুষের পক্ষে যাহা পাপ, দেবতার পক্ষে তাহা দোষাবহ হয় না। জগতের সকল কর্ম্মের মূল কর্তা যখন ঈশ্বর, তখন সকল কর্ম্মাকর্ম্মই তাঁহার কৃত। তিনি আদি কারণ, তিনি অনাদি কারণ। তিনি সর্ব্ব-কারণ। কর্ম্মকর্ম্ম, ধর্মাধর্ম্ম, সকলেরই মূল ও কর্ত্তা তিনি। এ অবস্থায় তিনি জীবের আদর্শ হইতে পারেন কি? মানুষ ভগবানের অনুকরণ করিতে গেলে, তার ধর্ম্মাধর্ম্ম সকলই লোপ পায়। এইজন্য হিন্দু এমন কথা কখনও বলে না। হিন্দু ভগবানকেও যেমন আপনার জীবনের আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করে না, তার গুরুকেও সেইরূপ আদর্শরূপে ভাবে না। গুরুর উপদেশই মান্য, তাঁর কর্ম্ম অনুকরণীয় নহে। শিষ্যকে তার আপন অধিকার মতন তিনি চালাইয়া লইয়া যান, আর নিজে আপনার অধিকার মতন চলিয়া থাকেন। ভাগবতী তনু লাভ না করিলে কেহ সদ্‌গুরু হইতে পারেন না। আর যাঁরা ভাগবতী তনুলাভ করিয়া সংসারে ভগবানের লীলাবিগ্রহরূপে বিচরণ করিয়া জীবকে ভগবানের দিকে লইয়া যান, স্বয়ং ভগবানের চরিত্র যেমন প্রাকৃতজনের অনুকরণীয় নহে, তাঁহাদের চরিত্রও সেইরূপ লোকের অনুকরণীয় হয় না। খৃষ্টীয় দশ— আজ্ঞার মাপকাঠির দ্বারা এ সকল লোকোত্তর মহাপুরুষের চরিত্রের কালি কষা যায় না। লৌকিক নীতির বন্ধনে তাঁরা আবদ্ধ নহেন, তাঁরা নিজেরাই এ সকল নীতির প্রতিষ্ঠা করেন। গুরুচরণে একান্ত ভাবে আত্মসমর্পণ করিয়া তাঁরা ভিতরে যে প্রেরণা প্রেরণ করেন, ও বাহিরে যে সকল ব্যবস্থা ও ঘটনার যোগাযোগ সাধন করেন, তাহার অনুগমন করাই শিষ্যের একমাত্র কর্তব্য। কিন্তু ইংরেজি শিখিয়া আমাদের পক্ষে এরূপ বশ্যতা স্বীকার করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। তারই জন্য আমরা গুরুচরিত্রের অনুকরণ করিতে যাইয়া পদে পদে ভয়াবহ পরধর্ম্মের অনুসরণ করিয়া থাকি।

 আমাদের সকলেরই এই দশা। হিন্দুয়ানী ও খৃষ্টীয়ানীর একটা অদ্ভুত মিশ্রণে আমাদের চরিত্র গড়িয়া উঠিয়াছে। অশ্বিনীকুমারের মধ্যে এই দুইটী ভাবই পাশাপাশি দেখিতে পাওয়া যায়। আর এই কারণেই সময় সময় তাঁর আচার-আচরণে দুর্ব্বলতা ও অসামঞ্জস্য ফুটিয়া উঠে।

 অশ্বিনীকুমারের মৌলিক উদ্ভাবনী শক্তি নাই। কোন একটা সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গড়িয়া তুলিবার ক্ষমতাও তাঁহার নাই। সেই জন্মই এ পর্য্যন্ত তিনি তাঁহার চরিত্রের এই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবের একটা যথাযথ সঙ্গতি ও সমন্বয় সাধন করিতে পারেন নাই। পাশ্চাত্যের দিক্ দিয়া তিনি এ পর্যন্ত প্রাচ্যকে দেখেন নাই, বা প্রাচ্যের দৃষ্টি দিয়া পাশ্চাত্যকে বুঝিতে চেষ্টা করেন নাই। ফলে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবের বিশিষ্ট প্রভাবই তাঁহার চরিত্রে পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যামন্দিরে, যুবকবৃন্দের শিক্ষাগুরুরূপে, প্রচারকরূপে, শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের স্বত্বাধিকারের রক্ষিরূপে তাঁহার চরিত্রে আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব দেখিতে পাই। অপরপক্ষে, বিশেষতঃ অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে ভগবানের নাম সংকীর্তনে, ভাগবতাবৃত্তিতে, এবং ভক্তিযোগ বা কর্ম্মযোগের ব্যাখ্যানে—তাঁর চরিত্রে প্রাচ্য ভাবই বেশী ফুটিয়া উঠে।

 আর এই হিন্দুভাব লইয়াই আজ অশ্বিনীকুমার অনন্যলভ্য লোকনায়কের আসনে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন। তিনি কেবলমাত্র একজন লোকশিক্ষক এবং আধুনিক জন-নায়ক হইলে তাঁহার প্রতিপত্তি ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকিত। সে হিসাবেও তাঁর ভক্ত সংখ্যা কম নহে। পরন্তু, আমার বোধ হয় পশ্চিমবঙ্গে—যশোহর হইতে সূদূর শ্রীহট্ট পর্যন্ত—নবাশিক্ষিত যুবকসমাজে তাঁহার অন্যপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাব প্রতিষ্ঠিত আছে। পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলা হইতে দলে দলে ছাত্র আসিয়া তাঁহার বরিশালস্থ কলেজে, তাহাদের জীবনের উৎকৃষ্ট অংশটুকু অতিবাহিত করিয়া গিয়াছে। তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়া তাঁহার চরিত্রের এবং শিক্ষার প্রভাব কেহই অতিক্রম করিতে পারে নাই। তত্রাচ, এ কথা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, অশিক্ষিত জনমণ্ডলীর চিত্তের উপরে তিনি যে ভক্তির আসন লাভ করিয়াছেন, তাহাতেই তাঁহাকে এতটা বড় করিয়া তুলিয়াছে। তাঁর হিন্দুত্বেই অশ্বিনীকুমারের লোকনায়কত্বের মূল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।

 অশ্বিনীকুমারের চরিত্রে শাক্ত অপেক্ষা বৈষ্ণব প্রভাবই বলবত্তর। আধুনিক সাধনায় মানুষকে অতি বড় করিয়া তুলিয়াছে। মানুষের মনুষ্যত্বের উপরেই আজিকার দেবত্ব প্রতিষ্ঠিত। নর-সেবাই দেব-সেবা। আর ইহার সঙ্গে আমাদের বৈষ্ণব সাধনার অতি সুন্দর মিল রহিয়াছে। নরের মধ্যে নারায়ণকে দেখাই, বৈষ্ণব সাধনার মূল সাধ্য—

“অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তমাশ্রিতং”

 ইহাই বৈষ্ণবতত্ত্বের মূলসূত্র। অন্য কোন ধর্ম্মসম্প্রদায়ই এমন স্পষ্ট ও নির্ভীকভাবে মানবের ঈশ্বরত্বের কথা প্রচার করে নাই। মানবের দেহ এবং চিত্তবৃত্তিকে এতটা প্রাধান্য দেওয়া, পিতা-পুত্র, নায়ক—নায়িকা, বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতির সম্বন্ধকে ভগবানের লীলা-বৈচিত্র্য বলিয়া ধরিয়া লওয়া, বৈষ্ণবতত্ত্ব এবং বৈষ্ণব সাধনার বিশেষত্ব। মানবের দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি এবং তাহার চিত্তবৃত্তির বিনাশে বা বিরোধে নহে, কিন্তু এ সকলকে একটা চরম আধ্যাত্মিক আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত করাই বৈষ্ণবধর্ম্মের মূলমন্ত্র। এই ভাব অশ্বিনীকুমারের সামাজিক আচার ব্যবহারে বিশেষরূপে পরিলক্ষিত হয়।;

 সাধারণতঃ অশ্বিনীকুমার হিন্দু সমাজের সমস্ত বিধিনিষেধের পরিপোষক; কিন্তু কর্তব্যের প্রেরণায় তিনি সকল সংস্কারের গণ্ডী কাটাইয়া উঠেন। জাতিভেদের বিরুদ্ধে তিনি কখনও বক্তৃতা দেন নাই, কিন্তু সামাজিক কর্তব্য এবং মানবের কল্যাণের জন্য অনেক স্থলেই তিনি জাতিভেদ প্রথার গ্রন্থি শিথিল করিয়াছেন। তাঁহার শিক্ষার ফলে, কলেরা বা অন্য মহামারীর প্রকোপের সময়, তাঁহার বিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ, উচ্চনীচ জাতিনির্বিচারে, পীড়িতের সেবা শুশ্রূষার ভার গ্রহণ করিয়া থাকে। হতভাগিনী পতিতারাও তাহাদের সে সেবা হইতে বঞ্চিত হয় না। এমন অনেক স্থলে দেখিয়াছি, কুলীন ব্রাহ্মণ সন্তানেরা, বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সঙ্কোচ না করিয়া, স্বহস্তে নীচজাতীয় রোগীর বিছানাদি, মলমূত্রাদি পর্য্যন্ত, পরিষ্কার করিয়াছে। এমন কি সময়ে সময়ে, লোকাভাব ঘটিলে, অস্পৃশ্য চণ্ডালাদির মৃতদেহও আপন স্কন্ধে বহিয়া সৎকার করিয়া আসিয়াছে। দুর্ভিক্ষ এবং মন্বন্তরের সময়, হিন্দু ও মুসলমান দুঃস্থ ব্যক্তিগণ তুল্যভাবে অশ্বিনীকুমারের সেবা পাইয়া আসিয়াছে। বহুবৎসরের নিঃস্বার্থ সামাজিক সেবাই জনসাধারণের হৃদয়-মন্দিরে তাঁহার জন্য এক অক্ষয় স্বর্ণ-সিংহাসনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। তাহাদের কাছে তিনি একজন প্রসিদ্ধ বাগ্মী, ম্যাজিষ্ট্রেটের সহচর বা কমিশনের বিশ্বস্ত বন্ধু নহেন; তাহারা তাঁহাকে তাহাদেরই একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু, দুর্দ্দিনের সহায়, এবং দুঃখে কষ্টে একাত্ত প্রিয়জন বলিয়াই জানে। অগাধ অর্থ দিয়া নহে, বাগ্মিত্বের মোহিনী শক্তি বলেও নহে, জ্ঞানগরিমার প্রভাবেও নহে, কিন্তু জনসাধারণের সহিত চিন্তায়, ভাবে ও কার্য্যে সম্পূর্ণ এক হইয়া যাওয়াই যথার্থ জননায়কের বিশেষত্ব। আমরা এদেশে অধুনা একমাত্র অশ্বিনীকুমারে এই লোকনেতৃত্বের কতকটা আভাস পাই। তত্রাচ, এ ভাব এ দেশে নুতন নহে, ইহা বহু পুরাতন। দেশ-কাল-পাত্রোচিতভাবে কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তিত হইয়া নূতন ভাবে ফুটিয়া উঠিতেছে—এই মাত্র!