চরিত-কথা (বিপিনচন্দ্র পাল)/শ্রীযুক্ত গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রীযুক্ত গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঙ্গলার ইতিহাসে গুরুদাস বাবুর স্থান
বাঙ্গলা দেশের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে গুরুদাস বাবুর নাম থাকিবে কি না, জানি না। না থাকাই সম্ভব। ইতিহাস সচরাচর যে সকল বস্তুর স্মৃতিকে সযত্নে রক্ষা করে, গুরুদাস বাবুতে সে বস্তু বেশি নাই। যাহা অলোকসামান্য, ইতিহাস কেবল তাহাকেই স্মরণীর করিয়া রাখে। গুরুদাস বাবুর এরূপ অলোকসামান্য কোনো কিছু নাই। তাঁর অনেক বিদ্যা আছে, কিন্তু অনন্যসাধারণ বিশেষজ্ঞতা নাই। শ্রেষ্ঠ মেধা আছে, কিন্তু অলৌকিক প্রতিভা নাই। গুরুদাস বাবু কর্ম্মী; আর তাঁর কর্ম্ম সর্ব্বদাই ধর্ম্ম ও নীতি, শাস্ত্র ও লোকাচারের সম্মান করিয়া চলে। এই জন্য যাঁহারা সচরাচর এ সংসারে কলহ-কোলাহল—মুখর কর্ম্মজাল বিস্তার করিয়া, সস্তায় একটা ঐতিহ্য-কীর্ত্তি অর্জন করে, গুরুদাস বাবু সে জাতীয় কর্ম্ম—নায়ক নহেন। তথাপি দেশের লোকে তাঁহাকে গভীর শ্রদ্ধা করে; এতটা শ্রদ্ধা বাঙ্গলাদেশের সকল শ্রেণী ও সকল সম্প্রদায়ের লোকের প্রাণ হইতে, আর কাহারো প্রতি অর্পিত হইতেছে কি না, সন্দেহ। দেশের লোকে তাঁহার বিদ্যার সম্বর্দ্ধনা করে; তাঁহার বিনয়-সৌজন্যের সমাদর করে; তাঁহার বাহ্যাড়ম্বরশূন্য ধর্ম্মনিষ্ঠার ও আত্মনিষ্ঠার পূজা করিয়া থাকে। সকল প্রকারের জন হিতকর কর্ম্মে তাঁহার নেতৃত্ব কামনা করে। সকল স্বাদেশিক সাধুঅনুষ্ঠানে তাঁহার সহানুভূতি ও সাহচর্য, তাঁর পরামর্শ ও আশীর্ব্বাদ ভিক্ষা করে। কিন্তু তিনি যে তাহাদের চিন্তা ও ভাব, আশা ও আদর্শকে ফুটাইয়া তুলিয়া, অতি ঘনিষ্ঠভাবে তাহাদের অন্তর্জ্জীবনের সঙ্গে জড়িত হইয়া আছেন, এমনটা কখনো অনুভব করে না। আর এ জগতে যাঁহায়া, মিত্রভাবেই হউক আর শত্রুভাবেই হউক, আপনাদের সমসাময়িক জনমণ্ডলীর জ্ঞান, রস, আশা, আদর্শ, প্রয়াস ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হইয়া থাকেন, ইতিহাস কেবল তাঁহাদেরই স্মৃতিকে জাগাইয়া রাখিতে চাহে।
ঐতিহাসিক কীর্ত্তির বিশেষত্ব
কিন্তু ইতিহাসে যাঁহাদের নাম থাকিয়া যায়, কেবল তাঁহারাই যে সমাজের শ্রেষ্ঠ জন, কেবল তাঁহাদেরই নিকটে যে সমাজ অশেষ ও অশোধনীয় ঋণজালে আবদ্ধ থাকে, অপরের নিকটে থাকে না, এমন কথা কিছুতেই বলা যায় না। ফলতঃ ইতিহাস যে কেবল ভালকেই মনে করিয়া রাখে, মন্দকে ভুলিয়া যায়, তাহাও নহে। রোমের ইতিহাস পুণ্যশ্লোক মার্কাস্ অরিলিয়সের যেমন, তেমনি ক্রুরমতি নীরোরও নামকে স্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের প্রাচীন পুরাণ-কথায় রামও আছেন, রাবণও আছেন; যুধিষ্ঠিরও আছেন, দুঃশাসনও আছেন। ভারতের পুণ্যস্মৃতি জনকের নামও মাথায় করিয়া রাখিয়াছে, বেণ রাজার নামও ভুলিয়া যায় নাই। ইতিহাস কেবল ভালকেই স্মরণীয় করিয়া রাখে, মন্দকে রাখে না, তাহা নয়। ভাল হউক, মন্দ হউক, যাহা কিছু অলোকসামান্য, ইতিহাস তাহাকেই আঁকড়াইয়া ধরে। মানবের প্রকৃতি হইতেই তো ইতিহাসের বিচার-পদ্ধতির উৎপত্তি। আর যাহা নিত্য, তাহা অপেক্ষা যাহা নৈমিত্তিক, যাহা স্থিতিহেতু, তাহা অপেক্ষা যাহা গতি-সহায়; মানুষের মন তাহারই দ্বারা সমধিক আকৃষ্ট হইয়া থাকে। এই কারণে যাঁহারা জনসমাজের স্থিতির সহায়, তাঁহাদিগকে উপেক্ষা করিয়া, যাঁহারা জনসমাজের গতির হেতু হইয়া উঠেন, ইতিহাস তাঁহাদিগের স্মৃতিকেই বিশেষভাবে জাগাইয়া রাখিতে চাহে। যে সকল শক্তির সমবায়ে বা সংঘর্ষণে সমাজ-জীবন বিবর্ত্তিত হয়, ইতিহাস তাহাকেই ভাল করিয়া লক্ষ্য করে। আর সমাজ-বিবর্ত্তনে ভাল ও মন্দ দুই মিশিয়া থাকে। আলো ও ছায়ার সমাবেশ ব্যতিরেকে যেমন কোনো তৈলচিত্র ফুটিয়া উঠে না; যেইরূপ ভাল ও মন্দের সংঘর্ষ ব্যতীত সমাজজীবনও গড়িয়া উঠিতে পারে না। ভাল ও মন্দের মধ্যে যে স্বাভাবিক বিরোধ আছে, তাহারই দ্বারা, সেই বিরোধের ফলস্বরূপই, জনসমাজ বিবর্ত্তিত হইতেছে। এই দেবাসুর-সংগ্রাম মানব-সমাজের নিত্য ধর্ম্ম। আর তারই জন্য, এই মানব-সমাজের বিবর্ত্তনের যথাযথ বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা যে ইতিহাসের কর্ম্ম, সেই ইতিহাস লোকে যাহাকে ভাল বলে কেবল তাহাকেই স্মরণীয় করিয়া রাখে না; কিন্তু ভাল হউক, মন্দ হউক, যাহা কিছু শক্তিশালী, যাহা কিছু অনন্যসাধারণ, যাহা কিছু গতির কারণ, ইতিহাস সর্ব্বদা তাহাকেই নিরপেক্ষভাবে ধরিয়া রাখিতে চাহে।
ঐতিহাসিক বিবর্ত্তনের প্রণালী
আর অলোকসামান্য প্রতিভাই সচরাচর জনমণ্ডলীর প্রাণে নূতন জ্ঞান, নূতন ভাব, নুতন আদর্শ, নূতন আশার সঞ্চার করিয়া, যুগে যুগে সমাজের এই গতিশক্তিকে প্রবুদ্ধ ও পরিচালিত করিয়া থাকে। এই সকল নূতন তাব ও আদর্শের প্রেরণায়, যাহা পূর্ব্বে পাওয়া যায় নাই, তারা পাইবার জন্য জনগণের চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠে। এই লোভ হইতে নূতন কর্ম্মের আয়োজন, এবং এই কর্ম্মচেষ্টা হইতেই সমাজের বিবর্ত্তন ও বিকাশ সাধিত হয়। অলোকসামান্য প্রতিভা সমাজের গতি-বেগ বুদ্ধি করে বলিয়াই ইতিহাসে তাহার এত গৌরব। কিন্তু জনসমাজের কল্যাণকল্পে যেমন তার গতি-শক্তির তেমনি তার স্থিতিশক্তিরও আবশ্যক। যেখানে সমাজের গতি-শক্তি তার সনাতন স্থিতি-শক্তিকে একান্তভাবে অভিভূত করিয়া ফেলে, সেখানেই সমাজ-চৈতন্য একেবারে আত্মবিস্মৃত হইয়া, উন্মাদিনী বিপ্লবশক্তির ক্রীড়াপুগুলি হয় এবং অচিরে বিনাশের মুখে যাইয়া পড়ে। আবার যেখানে সমাজের স্থিতি-শক্তি একান্তভাবে তাহার স্বাভাবিক গতিশীলতাকে চাপিয়া রাখিতে বা পিষিয়া মারিতে চেষ্টা করে, সেখানে কিছুদিনের জন্য সমাজ নিতান্ত স্থবির হইয়া পড়ে এবং শুদ্ধ গতানুগতিক পথ ধরিয়া জড়গতিমাত্র প্রাপ্ত হয়, জীবন-চেষ্টা প্রকাশ করিতে পারে না। আর স্বভাবের গতিরোধ করিয়া কিছুকালের জন্য স্থবিরত্ব লাভ করে বলিয়াই, তাহারই প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ, পরিণামে প্রবল বিপ্লবের মুখে যাইয়াই পড়ে। এই জন্য, সমাজের চিরন্তন কল্যাণকল্পে, তাহার স্বাভাবিক বিবর্তন—পথ অবাধ ও প্রশস্ত রাখিতে হইলে, তাহার গতি—শক্তি ও স্থিতি—শক্তি উভয় শক্তিকেই, আপন আপন অধিকারে, সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা আবশ্যক হয়।
সমাজ-জীবনের ত্রিধারা
কারণ, জনসমাজের বিবর্ত্তন-চেষ্টা গতি-শক্তি ও স্থিতি-শক্তি উভয়কেই সমভাবে অবলম্বন করিয়া চলে। একদল লোক যখন কোনো অভিনব ভাব বা আদর্শের প্রতি ঐকান্তিক অনুরাগবশতঃ আন্তরিকভাবে সমাজের গতিবেগকে বাড়াইয়া তুলিতে চান; অপর এক দল লোক তখন, সমাজের অবস্থার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার বিধিব্যবস্থার এবং অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানেরও পরিবর্ত্তনে যে অপরিহার্য্য হইয়া উঠে এবং এই পরিবর্ত্তনের একান্ত প্রতিরোধ করিলে সমাজের গুরুতর অকল্যাণ সাধিত হয়, ইহা বিচার না করিয়া, সমাজস্থিতির দোহাই দিয়া, প্রাণপণে এই প্রবুদ্ধ গতিশক্তিকে চাপিয়া রাখিতে চেষ্টা করেন। আর এই দুই দলই সমাজ-বিবর্ত্তনের প্রত্যক্ষ হেতুরূপে, ইতিহাসে স্মরণীয় হইয়া রহেন। কিন্তু যাঁহারা এক দিকে দিক্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া, এইরূপে সমাজের গতিবেগকে আত্যন্তিক ভাবে বাড়াইয়া তোলেন, তাঁহারা যেমন সমাজের দৈর্ঘ্য ও শান্তি নষ্ট করিয়া, তাহার আভ্যন্তরীণ প্রাণবস্তুকে পীড়িত করেন; সেইরূপ যাঁহারা অন্যদিকে অভিনব যুগধর্ম্মের ও কালধর্ম্মের প্রতি অমনস্ক হইয়া, এই প্রবুদ্ধ গতিবেগকে জোর করিয়া প্রতিরোধ করিতে বদ্ধপরিকর হন, তাঁহারাও সেইরূপই অযথা সংগ্রাম বাঁধাইয়া, সমাজ-প্রাণকে রক্ষা করিতে যাইয়াই, তাহাকে নষ্ট করিতে উদ্যত হন। কিন্তু যাঁহারা এই সংগ্রামে প্রবৃত্ত না হইয়া, ধীরভাবে তার পরিণাম লক্ষ্য করিতে থাকেন এবং যতক্ষণ না এই সংগ্রামের নিবৃত্তি হইয়া নূতনের ও পুরাতনের মধ্যে একটা উচ্চতর সন্ধি ও সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ততক্ষণ কোন এক পক্ষকে একান্তভাবে অবলম্বন না করিয়া যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে, এই কলহ-কোলাহলের মধ্যে সমাজের মর্ম্মস্থলে যে সনাতন প্রাণবস্তু আপনাকে লুকাইয়া রাখিতে চেষ্টা করে, তাহাকেই কেবল ধরিয়া বসিয়া রহেন, —তাঁহারাই প্রকৃতপক্ষে সমাজের মেরুদণ্ডস্বরূপ। কোন সমাজে, কালপ্রভাবে, তাহার পূর্ব্বকৃত ও অধুনা-চেষ্টিত কর্ম্মবশে, এইরূপ সমর-সঙ্কট উপস্থিত হইলে, যাঁহারা নূতনের লোভেও আত্মবিস্মৃত হন না, আর তার ভয়বিভীষিকাতেও বিক্ষিপ্ত হইয়া উঠেন না,— কামবশাৎ নূতনকেও আলিঙ্গন করিতে ধাবিত হন না, আর কার্পণ্যবশাৎ পুরাতনের জীর্ণতাকেও আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহেন না; কিন্তু ইহাদের পরস্পরের গুণাগুণ ও দাওয়াদাবীর পরীক্ষা হইয়া পরিণামে যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হইবেই হইবে, ধীরভাবে তাহারই প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকেন,—প্রত্যেক যুগসন্ধিস্থলে, সমাজের সনাতনী প্রাণশক্তি তাঁহাদিগকেই আশ্রয় করিয়া আত্মরক্ষা করে। কলহকোলাহলপ্রিয় ইতিহাস এই সকল লোকের খোঁজ লয় না। কিন্তু ইতিহাসের দ্বারা উপেক্ষিত হইরাও, আসন্ন সমাজ-বিপ্লবের মুখে, এই সকল ধর্ম্মনিষ্ঠ, কর্ম্মনিষ্ঠ, আত্মনিষ্ঠ, শান্ত ও সমাহিতচিত্ত সুধীজনই অতি সন্তর্পণে, সেই সঙ্কটকালে, সমাজের সনাতন প্রকৃতিটীকে প্রাণে পূরিয়া বাঁচাইয়া রাখেন।
গুরুদাস বাবু ও আধুনিক শিক্ষিত সম্প্রদায়
বাঙ্গলার স্বদেশী সমাজ একটা প্রবল বিপ্লবস্রোতের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছে। আর এই সঙ্কটকালে যে অত্যল্পসংখ্যক ধীর—প্রকৃতি সুধীজনকে আশ্রয় করিয়া আমাদের সমাজের সনাতন প্রাণবস্তু আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছে, গুরুদাস বাবু তাঁহাদের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান। যে বিদেশীয় শিক্ষা ও সাধনার প্রভাবে এই যুগান্তর উপস্থিত হইয়াছে, গুরুদাস বাবু সেই শিক্ষা ও সাধনাকে সুন্দররূপেই অধিগত করিয়াছেন। এ দেশের আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের তিনি অগ্রণী। যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই বিদেশীয় শিক্ষা ও সাধনার সেতু-স্বরূপ হইয়া আছে, গুরুদাস বাবু তাহার অন্যতম অধিনায়ক। কিন্তু গুরুদাস বাবুর সমসাময়িক ইংরেজি-শিক্ষা-প্রাপ্ত সম্প্রদায়ের অনেকেই যেরূপভাবে এই শিক্ষাদীক্ষারদ্বারা একান্ত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন, গুরুদাস বাবু কখনো সেরূপ হন নাই। অন্যদিকে যাঁহারা এই শিক্ষাদীক্ষা পাইয়াও, ইহার প্রতি একটা গভীর ও অযৌক্তিক বিরাগ বশতঃ এই শিক্ষাদীক্ষাতে দেশ মধ্যে যে অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের স্রোত আনিয়াছে, সর্ব্বতোভাবে তাহার প্রতিরোধ করিতে বদ্ধপরিকর হন; গুরুদাস বাবু কখনো একান্তভাবে তাঁহাদেরও সঙ্গে মিশিয়া যান নাই। মানুষের বিদ্যা তাহার ভৃত্য হইয়াই থাকিবে, তাহারই ঈঙ্গিতসাধনে সর্ব্বদা নিযুক্ত হইবে; ইহাই বিদ্যালাভের সত্যলক্ষ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা আজিকালি সর্ব্বস্বান্ত হইয়া যে বিদেশীয় বিদ্যা—অর্জ্জনের চেষ্টা করিতেছি, তাহা অনেক স্থলেই আমাদের ভৃত্য না হইয়া, আমাদের প্রভু হইয়াই বসিতেছে। আমরা অনেকেই এই অভিনব বিদ্যাকে নিজেদের কর্ম্মে নিয়োগ করিতে পারিতেছি না; প্রত্যুত এই বিদ্যাই আমাদিগকে ভয়াবহ পর-ধর্ম্মে নিয়োগ করিতেছে। মানুষের শিক্ষা ও সাধনা তাহার আত্মজ্ঞানেরই স্ফুরণ করিবে; ইহাতেই শিক্ষাদীক্ষার স্বার্থকতা লাভ হয়। কিন্তু বর্ত্তমান বিদেশীয় শিক্ষা ও সাধনা আমাদের আত্মজ্ঞানের স্ফুরণ না করিয়া, অনেক সময় কেবল আত্মবিস্মৃতিই জন্মাইয়া দেয়। এই বিদেশী বিদ্যার বলে আত্মলাভ করা দূরে থাক্, অনেক সময় আমরা আত্মবিক্রয় করিয়াই বসি। এইরূপ আত্মবিস্মৃতি ও আত্মবিক্রয় আমাদের ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়ের সাধারণ ধর্ম্ম হইয়া গিয়াছে। সংস্কারক ও সংস্করণ-বিরোধী, উভয় দলেরই মধ্যে ইহা দেখা যায়। এক শ্রেণীর সমাজ ও ধর্ম্মসংস্কারক সর্ব্বজনসমক্ষে, স্পর্দ্ধাসহকারে, নিল্লর্জ্জভাবে, যেমন এই বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনাকে আলিঙ্গন করিবার জন্য বাহু প্রসারিত করিয়া রহিয়াছেন; যাঁহারা এই প্রকাশ্য প্রয়াসের প্রতিরোধ করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন, তাঁহারাও গোপনে গোপনে সেই বিজাতীয় ভাবকেই অজ্ঞাতসারে প্রাণ মধ্যে বরণ করিয়া তুলিতেছেন। ভগবানকে যেমন মিত্রভাবে ভজনা করিয়াও পাওয়া যায়, শত্রুভাবে সাধন করিয়াও পাওয়া যায়, আর শাস্ত্রে বলে, শত্রুভাবে সাধন করিলে যত সত্ত্বর সিদ্ধিলাভ হয়, মিত্রভাবের ভজনার তত সত্ত্বর হয় না; —সেইরূপ কোনো বিদেশীয় সভ্যতা-সাধনাকেও মিত্রভাবে ও শত্রুভাবে, উভয় ভাবেই পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম্ম ও সমাজ-সংস্কারকেরা মিত্রভাবে য়ুরোপের ভজনা করিতেছেন। সংস্করণ-বিরোধী “পুনরুত্থানকারিগণ” শত্রুভাবে তার সাধনা করিতেছেন। আর কার্যতঃ উভয় পক্ষই সমভাবে তাহার দ্বারা অভিভূত হইয়া পড়িয়াছেন। সংস্কারকগণের উপরে ঘুরোপের প্রভাব প্রত্যক্ষ, সংস্করণ-বিরোধিগণের উপরে প্রচ্ছন্ন—দু’এর মধ্যে এইমাত্র প্রভেদ।
"সংস্কারক” ও সংস্করণ- বিরোধী
সংস্কারকগণ অসাধারণ অভ্যুদয়সম্পন্ন বিদেশীয় সমাজের বিধিব্যবস্থা ও অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানাদিকে যথাসাধ্য নিজেদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য লালায়িত হইয়াছেন। আর এইরূপে বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনার বাহ্য উপকরণগুলিকে সযত্নে সংগ্রহ করিতে যাইয়া, স্বল্পবিস্তর আত্মহারা হইয়া পড়িতেছেন। স্বদেশী সভ্যতা ও সাধনার যে একটা অতি ভাল দিক্ আছে, এ কথা ইহাঁরা অস্বীকার করেন না। বরং এই ভালটুকুকে রক্ষা করিবার জন্যই যে সংস্কারের প্রয়োজন, ইহাই বলিয়া থাকেন। কিন্তু কোনো সমাজের বহিরঙ্গগুলিকে গ্রহণ করিয়া তার ভিতরকার প্রকৃতিগত আদর্শ ও স্বভাবকে বর্জ্জন করা যে কখনো সম্ভব হয় না, এটী তাঁহারা বোঝেন না। বিদেশীয় সমাজের বাহিরের উপকরণ ও আয়োজনগুলিকে প্রাণপণে সংগ্রহ করিব, আর স্বদেশের সমাজের ভিতরকার প্রাণটাকেও ধরিয়া রাখিব এবং তাহারই মধ্যে পূরিয়া দিয়া একটা উৎকষ্টতম সমাজ গড়িয়া তুলিব, ইহা যে একেবারে অসম্ভব ও অসাধ্য,— এই মোটা কথাটা অনেকেই তলাইয়া দেখেন না। প্রত্যেক জীবের আত্মপ্রয়োজনেই তার দেহটা গড়িয়া উঠে। জীবদেহের বহিরঙ্গগুলি একটা আকস্মিক ঘটনাপাতের অচেষ্টিত ফল নহে। সমাজ-জীবন এবং সমাজ-দেহ সম্বন্ধেও ইহাই সত্য। প্রত্যেক সমাজের রীতিনীতি, আচার-বিচার, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানাদি সেই সমাজের আত্মপ্রয়োজনে, তার আভ্যন্তরীণ জীবন-চেষ্টার ফলেই গড়িয়া উঠে, কোন আকস্মিক ঘটনাপাতে, আপনা হইতে গজায় না, অথবা অন্য সমাজ হইতেও উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসে না। দেহের সঙ্গে দেহীর সম্বন্ধ যেমন অঙ্গাঙ্গী—ইংরেজিতে ইহাকে অর্গেনিক রিলেষণ (Organic relation) বলে—প্রত্যেক সমাজের রীতিনীতি, বিধিব্যবস্থা, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানাদির সঙ্গে সেই সমাজজীবনের সম্বন্ধও সেইরূপ অঙ্গাঙ্গী, আকস্মিক নহে। কাণ টানিলেই যেমন আপনা হইতেই মাথাও সরিয়া আইসে, সেইরূপ কোন সভ্যতা ও সাধনার বাহিরের ঠাটটাকে কোথাও খাড়া করিতে গেলেই, তার প্রাণটাও যে তার সঙ্গে সঙ্গে আপনা হইতে আসিয়া পড়িবে, ইহা নিশ্চিত। বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনার বহিরঙ্গসাধনে নিযুক্ত হইলে, তার অন্তরঙ্গটুকুকেও লইতেই হইবে। আর এরূপ ভাবে, স্বেচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক, তার দেহ ও প্রাণ উভয় বস্তুকেই যদি আত্মসাৎ করিতে হয়, তবে স্বদেশের সত্য প্রাণটাকে কিছুতেই রক্ষা করা সম্ভব হইবে না। সংস্কারকগণ যে ভাবিতেছেন, তাঁরা বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনার ভাল ভাল অনুষ্ঠানপ্রতিষ্ঠানগুলিকেই গুণিয়া বাছিয়া, নিজের সমাজে গ্রহণ করিবেন, আর তার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দেশের সনাতন আদর্শটীকেও বাঁচাইয়া রাখিবেন, ইহা নিতান্তই অলীক কল্পনা মাত্র। প্রত্যেক সভ্যতা ও সাধনাতেই ভাল ও মন্দ দুই আছে। আর এই ভাল ও মন্দ, ছায়াতপের ন্যায়, পরস্পরের সঙ্গে অচ্ছেদ্যরূপে মিশিয়া আছে। সকল সমাজের রীতিনীতি ও বিধিব্যবস্থার মধ্যেই ভাল ও মন্দের এই অঙ্গাঙ্গী যোগ রহিয়াছে। যে সমাজে যে সকল রীতিনীতি ও আচার-বিচার, সামাজিক বিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে, আপনা হইতেই গড়িয়া উঠে, সে সমাজে, তার সঙ্গে সঙ্গে লোকচরিত্রের মধ্যেই ভালকে রক্ষা করিবার ও মন্দকে রোধ করিবার একটা অপূর্ব্ব কৌশলও আপনা হইতেই ফুটিয়া উঠে। অপর সমাজ যদি এই সকল রীতিনীতি বাহির হইতে গ্রহণ করিতে যায়, তাহা হইলে, ভাল মন্দ দুই তাহাকে লইতে হয়। কিন্তু তার ভালটীকে বাড়াইয়া দিয়া মন্দটীকে রোধ করিবার এই সহজ কৌশলটী সে সমাজ কিছুতেই লাভ করিতে পারে না। কারণ এই সহজ কৌশলটী ধার করিয়া পাওয়া যায় না। আর এই জন্যই অনুকরণপ্রয়াসী সংস্কারচেষ্টা, সমাজের অন্তঃপ্রকৃতির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় না বলিয়া, সর্ব্বদাই ভয়াবহ পরধর্ম্ম হইয়া উঠে। আমাদের আধুনিক ধর্ম্মও-সমাজ-সংস্কারকগণ যেমন এইরূপে বিদেশের সমাজের বহিরঙ্গসাধনে সচেষ্ট হইয়া, সেই সমাজের ভিতরকার ভাব ও আদর্শের দ্বারা উত্তরোত্তর অভিভূত হইয়া, তাহারই ফলে স্বদেশের ভিতরকার সনাতন প্রাণস্রোতের বাহিরে যাইয়া পড়িতেছেন; সংস্করণ-বিরোধিগণও সেইরূপই, অন্যভাবে ও অন্য কারণে, সেই সনাতন প্রাণ-স্রোত হইতে একান্তভাবেই সরিয়া যাইতেছেন। সংস্কারকগণ বিদেশীয় সমাজের বাহিরের আচারানুষ্ঠানাদির মধ্যে নিজেদের সমাজের প্রাণরূপী সনাতন আধ্যাত্মিক আদর্শটীকে পূরিয়া, তাহাকে সময়োপযোগী ও কার্যক্ষম করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এই পরদেহে যে সে প্রাণ থাকিবে না, থাকিতে পারে না; তৎপ্রতি ইহাদের দৃষ্টি নাই। সংস্করণ-বিরোধিগণ বিপরীত পথ ধরিয়া স্বদেশের সমাজের প্রাচীন ও প্রচলিত রীতিনীতি ও বিধিব্যবস্থার মধ্যে বিদেশের সভ্যতা ও সাধনার প্রবল প্রাণটাকে পূরিয়া দিয়া, নিজেদের সমাজের বাহ্য় ঠাটটাকে সতেজ ও সময়োপযোগী করিতে চাহিতেছেন। আমাদের পুরাতন সমাজ-দেহ বিদেশের এই নবীন প্রাণের টান যে কখনই সহিতে পারিবে না, তৎপ্রতি ইহাঁদের দৃষ্টি নাই। আর এইরূপ উভয় পক্ষই বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনার দ্বারা অভিভূত হইয়া পড়িয়াছেন। সংস্কারকগণ নিজেদের সভ্যতা ও সাধনার বহিরঙ্গটাকে স্বল্পবিস্তর ভাঙ্গিয়া চুরিয়া, বিদেশীয় সমাজের ছাঁচে, নিজেদের সমাজকে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছেন। এই ব্যগ্রতার পশ্চাতে একটা পাদ্রিজনসুলভ, কল্পিত, বিশ্বমানবী প্রেমের প্রেরণাই আছে; নিজেদের সমাজ-জীবন ও সমাজ-প্রকৃতির কোনো সত্য ধারণা নাই। অন্যদিকে যাঁহারা প্রাণপণে এই সংস্কার-প্রয়াসের প্রতিরোধ করিয়া, সমাজের “সনাতনী”টুকুকে সযত্নে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন, তাঁহাদের এই ব্যাকুলতাতে তাঁহাদের সরল স্বদেশপ্রীতিই প্রকাশিত হয়, কিন্তু নিজেদের সমাজ-জীবন সম্বন্ধে প্রাকৃতজনসুলভ দেহাত্মধ্যাসটা যে বিন্দু পরিমাণেও বিচলিত হইয়াছে, ইহা প্রমাণিত হয় না। তাঁহারা সমাজের দেহটাকেই, তার বাহ্য বিধিব্যবস্থা ও আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতিকেই সমাজের সনাতন প্রাণ বলিয়া ধরিতেছেন আর তারই জন্য, কালের প্রভাব এবং পূর্ব্বকৃত কর্ম্মের অপরিহার্য পরিণামের প্রতি বিন্দুমাত্রও দৃকৃপাত না করিয়া, সমা জের বাহিরের ঠাটটাকে রক্ষা করিলে তার ভিতরকার প্রাণটাও রক্ষা পাইবে ভাবিয়া, যাঁহারা এই ঠাটটাকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া, নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে চান, তাঁহাদের সর্ব্ববিধ সংস্কার-চেষ্টার প্রতিরোধ করিতেছেন। এইরূপে আমাদের সংস্কারকদল যেমন সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার নামে, দেশের প্রাচীন ও প্রচলিত সমাজগঠনকে ভাঙ্গিয়া দিয়া, তাহার স্থলে বিলাতী আদর্শের একটা রজত-প্রধান শ্রেণীভেদকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিতেছেন; সেইরূপ সংস্করণ-বিরোধিগণও আশ্রমভ্রষ্ট সুতরাং ধর্ম্মহীন যে বর্ত্তমান বর্ণভেদ সমাজে প্রচলিত আছে, তারই ভিতরে বিলাতী শ্রেণীভেদের প্রাণটাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, প্রাচীন বর্ণাশ্রমধর্ম্মের ক্ষয়োন্মুখ বহিরঙ্গটাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছেন। একদল বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনার দেহটাকে, আর একদল তার প্রাণটাকে লইয়া টানাটানি করিতেছেন। সুতরাং একপক্ষ সজ্ঞানে, আর একপক্ষ অজ্ঞাতসারে, কিন্তু উভয় পক্ষই সমভাবে, সত্যকার স্বাদেশিকতা হইতে ভ্রষ্ট হইয়া, বিদেশীয় সভ্যতা ও সাধনার দ্বারা একান্ত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছেন। আর এই দুই দলই, দুই ভিন্ন দিক দিয়া, দেশের সত্যিকার সনাতন সভ্যতা ও সাধনার মূল ভিত্তিটাকে ভাঙ্গিয়া দিতেছেন।
গুরুদাস বাবুর “মধ্যপথ"
গুরুদাস বাবু এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বিদলের কোনটারই অন্তর্ভূত নহেন। প্রচলিত অর্থে, তাঁহাকে কিছুতেই সমাজ-সংস্কারক বলা সঙ্গত হইবে না। তিনি নিজেই কোন মতে সংস্করণবিরোধী বলিয়া পরিচিত হইতে রাজি নহেন। মানব-সমাজ যে নিয়ত পরিবর্ত্তনশীল, ইহা তিনি জানেন। মধ্যে মধ্যে ইহার ব্যতিক্রম হইলেও, মোটের উপরে এই সকল সামাজিক পরিবর্ত্তন যে উন্নতিমুখী, ইহাও তিনি মানেন। সমাজের অবস্থার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক প্রাচীন রীতিনীতিও যে পরিবর্ত্তনযোগ্য হইয়া পড়ে, ইহা তিনি স্বীকার করেন। “হিন্দুসমাজে সংস্কারের অনেক স্থান আছে, সংস্কারকের অনেক কার্য্য্য আছে”—এ কথা মুক্তকণ্ঠে প্রচার করিতেও তিনি কুণ্ঠিত নহেন। [১] সুতরাং মোটের উপরে সমাজসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে, প্রচলিত সমাজসংস্কারকদিগের সঙ্গেও গুরুদাস বাবুর মতের মিল আছে। তবে মতের মিল থাকিলেও কার্য্যের মিল নাই। তারই জন্যই গুরুদাস বাবুকে প্রচলিত অর্থে সমাজসংস্কারক বলা সঙ্গত নহে। সমাজসংস্কারকেরা সচরাচর সমাজের গতির বেগটাই বাড়াইয়া দিবার জন্যই ব্যস্ত; তার গতির দিক্টা স্থির রহিল কি না, তৎপ্রতি তাঁহাদের তেমন সজাগ দৃষ্টি নাই। আর এই খানেই তাঁহাদের সঙ্গে গুরুদাস বাবুর যা' কিছু বিরোধ। সাধারণভাবে সমাজসংস্কারকদিগের সদুদ্দেশ্যের সঙ্গে গুরুদাস বাবুর আন্তরিক সহানুভূতিই আছে। এই জন্য আপনি নিষ্ঠাবান ও একাত্ত স্মৃতি-অনুগত হিন্দু হইয়াও গুরুদাস বাবু কখনো শ্রুতি-স্মৃতি-বিরোধী সংস্কারক-সম্প্রদায়ের নিন্দাবাদে প্রবৃত্ত হন নাই। বরং তাঁরা যে সাধু-ইচ্ছার দ্বারা প্রণোদিত হইয়া সংস্কারকার্য্যে ব্রতী হইয়াছেন, সেই ইচ্ছার সফলতার জন্যই, তাঁহাদিগকে “অগ্রপশ্চাৎ ও চারিদিক দেখিয়া শুনিয়া সাবধানে” চলিতে বলেন। [২]
হিন্দুর সমাজানুগত্য
এই সংযম ও সম্যক্দৃষ্টিই গুরুদাস বাবুর কর্ম্মজীবনের মূলসূত্র। সমাজের কল্যাণের জন্য, প্রয়োজন মত, তার প্রাচীন ও প্রচলিত বিধিব্যবস্থার পরিবর্ত্তন করা যাইতে পারে। কোন চিন্তাশীল এবং বিশেষজ্ঞ হিন্দুই এ পরিবর্ত্তনের একান্ত বিরোধী নহেন। প্রাচীনকে বর্জ্জন করাই যে মহাপাপ, হিন্দুর বিবর্ত্তন-ইতিহাসে এমন অদ্ভুত কথা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। যাহা প্রাচীন ও প্রচলিত তাহাকে ভাঙ্গাই যে অধর্ম্ম, গুরুদাস বাবুও এমন মনে করেন না। আবশ্যক হইলে, হিন্দু তাঁর দেবতার মন্দিরও তো ভাঙ্গিয়া থাকেন। কিন্তু সে ভাঙ্গার ভাব ও ধরণ পৃথক্। সে ভাঙ্গাতে তাঁর দেবতাও লুপ্ত হন না, তাঁর দেবভক্তিও নষ্ট হয় না। দেবতার পীঠস্থান বলিয়াই তো দেবমন্দিরের মাহাত্ম্য ও পবিত্রতা। তারই জন্য তো সামান্য ইটকাঠের ঘর ভক্তের ভক্তির বিষয় হইয়া উঠে। হিন্দুর সমাজ, সেইরূপ, হিন্দুর ধর্ম্মের বহিরাবরণ ও কায়ব্যূহস্বরূপ। ধর্ম্মাবহ ও পাপলুদ বলিয়া হিন্দুর শ্রুঁতি যাঁহার বন্দনা করিয়াছেন, তিনি নিতান্ত নিরাকার ভাবমাত্র নহেন। কেবল মানুষের হৃদয়-আকাশেই তাঁর প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা হয় না। যেমন প্রত্যেক মানুষের প্রাণে, তাঁর ধর্ম্মবুদ্ধিকে আশ্রয় করিয়া, তিনি আত্মপ্রকাশ করেন; সেইরূপ যে সমাজে সে ব্যক্তি বাস করেন, সেই সমাজ-দেহে, তার রীতিনীতি এবং বিধিব্যবস্থার মধ্যেও তিনি আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকেন। এই জন্য প্রত্যেক সমাজের বিধিব্যবস্থা, সেই সমাজের প্রাণগত ধর্ম্মের বহিরঙ্গ ও বহিঃপ্রতিষ্ঠা হইয়া রহে। অতএব হিন্দু আপনার দেহকে যেমন দেবতার মন্দির বলিয়া ভাবেন, তাঁর দেহ-পুরে যেমন তিনি সর্ব্বান্তয্যামী ও সর্ব্বলোকসাক্ষী নারায়ণকেই একমাত্র পুরস্বামীরূপে দেখিয়া সংযত চিত্তে, পবিত্রভাবে দেহের সেবা করেন; সেই রূপ আপনার সমাজকেও হিন্দু সেই ধর্ম্মাবহ ও পাপনুদ পরমপুরুষের বহিরঙ্গ ও কায়ব্যূহ বলিয়া ভক্তি করেন। এই কারণেই নিষ্ঠাবান হিন্দুর চক্ষে তাঁর সমাজের আনুগত্য ও ধর্ম্মের আনুগত্য একই কথা হয়।
হিন্দুর সমাজ-তত্ত্ব
কারণ, হিন্দুর নিকটে তাঁর সমাজ, কতকগুলি মনুজগোষ্ঠির স্বেচ্ছানির্ব্বাচিত বা ঘটনাক্রমে সংগঠিত, একটা মিলনভূমি নহে। মানুষ কখনো ইচ্ছা করিয়া, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, সমাজবদ্ধ হইয়া থাকে বটে; কিন্তু এ সকল স্বকৃত সমাজ তার মূল সমাজেরই অন্তর্গত হয়, কিন্তু সে সমাজের সমধর্ম্ম লাভ করে না। ব্রাহ্মসমাজ, আর্য্যসমাজ, বৈষ্ণবসমাজ, ভারত-সভা, জমিদারী-পঞ্চায়ৎ, জাতীয়-মহাসভা বা কন্গ্রেস্ এবং প্রাদেশিক সমিতি বা কন্ফারেনস্—এগুলি স্বেচ্ছাবদ্ধ সমাজ। কিন্তু মানুষকে সামাজিক জীব বলিয়া আমরা যে সমাজের প্রতি নির্দ্দেশ করিয়া থাকি, সে সমাজ এই জাতীয় সমাজ নহে। ফরাসীবিপ্লবের অধিনায়কগণ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে, একটা কল্পিত সামাজিক সর্ত্তের বা সোসিয়াল্ কনট্র্যাক্টের (social contract) উপরে মানবসমাজের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে, এই সিদ্ধাত্ত অবলম্বন করিয়া, সেই সর্ত্তের উপরেই জনমণ্ডলীর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বত্বস্বাধীনতাকে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন বটে; কিন্তু বহুদিন সে কল্পিত সিদ্ধান্ত পরিত্যক্ত হইয়াছে। য়ুরোপীয় পণ্ডিতেরাও এখন আর মানবসমাজকে এইরূপ একটা স্বেচ্ছাবদ্ধ ও স্বকৃত মিলনভূমি বলিয়া মনে করেন না। হিন্দু কথনোই এরূপ অদ্ভুত সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করিতে যান নাই। হিন্দু চিরদিনই এটা জানেন যে মানুষ যেমন আপনার খুসি বা খেয়ালমত এই ভৌতিক দেহ ধারণ করে না, সেইরূপ সে আপনার ইচ্ছামত সমাজবিশেষেও জন্মগ্রহণ করে না। তার জন্মসম্বন্ধীয় সর্ব্ববিধ ব্যাপারই তার প্রাক্তনকর্ম্মবশে সংঘটিত হইয়া থাকে। তার প্রাক্তনকর্ম্মই তাহাকে আপনার নির্দ্দিষ্ট ফল-অনুযায়ী ভৌতিক দেহেতে আবদ্ধ করে। আর সেই প্রাক্তনকর্ম্ম-বশেই মানুষ সমাজ-বিশেষে জন্ম-গ্রহণ করিয়া, সেই সমাজের কর্ম্মজালে আবদ্ধ হইয়া পড়ে। এই দেহের সঙ্গে যেমন, তার নিজের সমাজের সঙ্গেও সেইরূপ, মানুষের যাবতীয় সম্বন্ধ আকস্মিক নহে কিন্তু অঙ্গাঙ্গী। যেখানে সে ঘটনাবশে, পরজীবনে, সমাজান্তর গ্রহণও করে, সেখানেও তার মূল ও জন্মগত সমাজ-প্রকৃতিটীকে সে সঙ্গে লইয়াই যায়। সেই স্বেচ্ছানির্ব্বাচিত নূতন সমাজে, নূতন কর্ম্ম সঞ্চিত হইয়া, কালক্রমে এই প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটিলেও, যে সমাজে তার জন্ম হইয়াছিল, সেই সমাজের মূল ছাপটা তার অন্তঃপ্রকৃতি ও বহিরাচরণ হইতে কখনোই একেবারে মুছিয়া যায় না। প্রত্যুত বংশপরম্পরায় তার বৈজিকগুণ সংক্রামিত হইয়া, এই স্বেচ্ছাগৃহীত নূতন সমাজেও, চিরদিনের জন্ম না হউক, অন্ততঃ বহুদিন পর্য্যন্ত, তার বংশধরগণের চিন্তাতে ও চরিত্রে, সেই মূল সমাজের কতকগুলি বিশেষত্ব রক্ষিত হইয়া থাকে। আর ইহাতেই সমাজের সঙ্গে সেই সমাজান্তর্গত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধ যে আকস্মিক নহে, কিন্তু নিতান্তই অঙ্গাঙ্গী, এই সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজের সঙ্গে সাজান্তর্গত জনগণের যে সম্বন্ধ তাহা একান্তই অপরিহার্য্য ও অঙ্গাঙ্গী বলিয়াই, হিন্দু কখনো আপনার সমাজকে নির্জীব মনে করেন নাই। তাঁহার দেহে যেমন একটা প্রাণবস্তু আছে, যাহা চক্ষে দেখা যায় না, কিন্তু দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরস্পরের মধ্যে যে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত, যে সম্বন্ধকে অবলম্বন করিয়া, সর্ব্ববিধ দৈহিক চেষ্টা প্রকাশিত হইতেছে, তাহারই মধ্যে এই প্রাণবস্তু প্রত্যক্ষ হইয়া থাকেন; তেমনি তাঁহার সমাজেও একটা প্রাণবস্তু আছে, হিন্দু এ কথায় চিরদিনই বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছেন। এই সমাজ-প্রাণকেও চক্ষে দেখা যায় না। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরস্পরের মধ্যে যে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ রহিয়াছে, তাহারই বিবিধ চেষ্টার ভিতরে এই সমাজপ্রাণও প্রত্যক্ষ হইয়া থাকেন। আর হিন্দুর এ সিদ্ধান্তকে য়ুরোপীয়দের পক্ষেও আজিকালি একটা অদ্ভুত কল্পনা বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া সম্ভব নহে। কারণ য়ুরোপীয় পণ্ডিতেরাও এখন এই কথাই বলিতেছেন। আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদ্গণ মানবসমাজে জীবধর্ম্ম আরোপ করিয়া, তাহাকে নিঃসঙ্কোচে জীব-উপাধি প্রদান করিয়াছেন। সোসিয়াল্ অর্গেনিজ্ম্ (social organism) বা সমাজজীব কথাটা য়ুরোপীয় চিন্তায় সর্ব্বথা গৃহীত হইয়াছে। আর এটা যদি কেবল একটা কথার কথা না হয়, এর পশ্চাতে যদি কোনো প্রামাণ্য সিন্ধান্তের প্রতিষ্ঠা হইয়া থাকে, তবে জনসমাজের ভিতরে একটা আত্মস্ফুরিত প্রাণন-চেষ্টারও প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য্য হইয়া উঠে। জীব বলিলেই তার একটা ব্যক্তিত্ব বা নিজত্ব আছে, এটী বোঝায়। এই ব্যক্তিত্ব বা নিজত্ব সাধারণ জীবধর্ম। জীবমাত্রেরই একটা নিজস্ব লক্ষ্য ও সেই লক্ষালাভের জন্য যথোপযুক্ত উপায়-নির্ব্বাচন ও সেই উপায়— অবলম্বনে আপনার সফলতালাভের প্রয়াস করিবার একটা আভ্যন্তরীণ শক্তিও আছে। জীবের সর্ব্ববিধ জীবন-চেষ্টার ভিতর দিয়া তার জীবনের এই চরমলক্ষ্যটী নিয়ত ফুটিয়া উঠে। জীবের ভিতরকার ও বাহিরের বিভিন্ন সম্বন্ধ ও সর্ব্ববিধ বিধিব্যবস্থা এই লক্ষ্যটীর সন্ধানেই চলে। জনসমাজেরও সমষ্টিভাবে একটা গতি, একটা ঐতিহাসিক বিবর্ত্তন-চেষ্টা, একটা নিয়ম আছে, ইহা সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু গতি আছে, তথাপি নির্দ্দিষ্ট গস্তব্য নাই; বিধান আছে, তথাপি কোনো স্থির লক্ষ্য নাই; নিয়ম আছে, তথাপি সে নিয়ম কোন কিছুই স্থিরভাবে আয়ত্ত, প্রকাশিত বা প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহে না,—ইহা কুত্রাপি জীবধর্ম্ম বলিয়া গণ্য হয় না। এরূপ অসঙ্গতি বুদ্ধিতে আসে না, কল্পনা করাও অসম্ভব। কিন্তু জনসমাজকে কেবল অর্গেনিজম্ বলিলেই যথেষ্ট বলা হয় না। জনসমাজে শুদ্ধ জীবত্ব আরোপ করিয়াই, তার প্রকৃতি ও গতির সম্যক্ অর্থ প্রকাশ করা যায় না। জনসমাজকে, এই জন্য, কেবল অর্গেনিজম্ না বলিয়া বিইংই (Being) বলিতে হয়। ইতালীয় মনীষী মহামতি ম্যাট্সিনী মানবসমাজকে এই বিইং উপাধি প্রদান করিয়াছেন। য়ুরোপীয়দের মধ্যে আধুনিক কালে, বোধ হয়, ম্যাট্সিনীই মানবসমাজের মূল প্রকৃতিটী অতি পরিষ্কার রূপে ধরিয়াছিলেন। Humanity is a Being—-আধুনিক যুগে ম্যাটসিনীই প্রথমে অকুতোভয়ে এ কথাটা বলিয়াছেন। আর বিইং (Being) বস্তু অচেতন নহে, সচেতন। তাহা স্বপ্রকাশ ও স্বপ্রতিষ্ঠ। তার আত্মজ্ঞানই তার গতির কারণ ও স্থিতির ভূমি হইয়া আছে। পাশ্চাত্যেরা যাহাকে বিইং (Being) বলেন, হিন্দু তাহাকে আত্মা বলেন। আমরা যাহাকে “আমি” বলি, যাহাকে অপর মানুষে তুমি বা তিনি বলে, এই অহং-প্রত্যয়বাচক বস্তুই আত্মবস্তু। তাহাই স্বপ্রকাশ ও স্বপ্রতিষ্ঠ। এ বস্তু আপনি আপনার গতি-হেতু ও স্থিতি-ভূমি। হিন্দুর শাস্ত্রে, জীবান্তর্য্যামী এই আত্মবস্তুকেই নারায়ণ বলিয়াছেন। “জীবহৃদে জলে বসে সেই নারায়ণ।” এই নারায়ণই ব্যষ্টিভাবে জীরান্তর্য্যামী—পরমাত্মা। আর এই নারায়ণই, সমষ্টিভাবে, মহাবিষ্ণুরূপে, সমগ্র মানবসমাজেরও আত্মা। ম্যাট্সিনী যে বস্তুকে লক্ষ্য করিয়া “হিউম্যানিটী ইজ এ বিইং” { Humanity is a Being) এই কথা বলিয়াছেন, সেই বস্তুকে প্রত্যক্ষ করিয়াই, হিন্দুসাধক মহাবিষ্ণু নাম দিয়াছেন। এই হিউম্যানিটীর ভাব বা আদর্শকে য়ুরোপের নিকট হইতে ধার করিয়া, বিশ্বমানব উপাধি দিয়া নিজেদের জাতীয় সাধনায় বা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করা হিন্দুর পক্ষে একান্তই অনাবশ্যক। [৩] আমাদের মহাবিষ্ণুতে এই ভাবটী যেমন সুন্দররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে, য়ুরোপের হিউম্যানিটীতে এখনো তেমন ফুটিয়া উঠে নাই। কোথাও কোথাও খৃষ্টীয়-সাধনায় খৃষ্টেতে বরং এ ভাবটা ফুটিয়াছে। এই মহাবিষ্ণুই বিশ্ব-আত্মা। এই দেহ নারায়ণেরই কায়ব্যূহ। তিনিই হৃষীকেশ,— এই সকল জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্ম্মেন্দ্রিয়ের প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্তা। তিনিই আমাদের অন্তরস্থ পর-আত্মা বা পরমাত্মা,—বিজ্ঞান-চৈতন্যের আশ্রয় ও প্রতিষ্ঠা। তিনিই কর্ম্মাধিপ,—— দেহমনের সর্ব্ববিধ চেষ্টার নিয়ামক ও ফলদাতা। আবার সমষ্টিভাবে, মহাবিষ্ণুরূপে, এই নারায়ণই সমাজ-দেহে বাস করিতেছেন। জনসমাজ এই মহাবিষ্ণুরই কায়ব্যূহ-স্বরূপ। তিনিই ধর্ম্মাবহ ও পাপনুদ সমাজ-নিয়মের একমাত্র নিয়ন্তা। সমাজ-বিবর্ত্তনের তিনিই একমাত্র প্রবর্তক ও পরিচালক। ম্যাট্সিনী যে হিউম্যানিটীকে বিইং বলিয়াছেন, সেই তত্ত্বই বস্তুতঃ আমাদের শাস্ত্রোক্ত নারায়ণ বা মহাবিষ্ণু। আর আপনার সমাজকে হিন্দু এই সর্ব্বান্তর্য্যামী, এই সমাজান্তর্য্যামী, এই বিশ্ব-আত্মা মহাবিষ্ণুর বহিঃপ্রকাশ ও কায়ব্যুহরূপে দেখেন বলিয়াই, তাঁহার নিকটে সমাজের আনুগত্য ও ধর্ম্মের আনুগত্য একই কথা হইয়াছে।
হিন্দুসমাজতত্ত্বে গতি-শক্তির স্থান
কিন্তু তাই বলিয়া হিন্দু যে কখনো আপনার সমাজের প্রাচীন ও প্রচলিত বিধি-ব্যবস্থার পরিবর্ত্তন করিতে উদ্যত হন না, এবং এই সকল পরিবর্ত্তন প্রবর্ত্তিত করিবার সময় প্রচলিত সমাজ—বিধির আনুগত্য অস্বীকার করেন না, এমনো নয়। হিন্দুর চক্ষে সমাজটা দেহমাত্র, নারায়ণই এ দেহের প্রাণ। আর প্রাণের প্রয়োজনেই দেহ; দেহের প্রয়োজনে তো প্রাণ নয়। প্রাণ দেহের সঙ্গে যুক্ত থাকিয়াও, সর্ব্বদাই দেহ অপেক্ষা বড় হইয়া রহে। নারায়ণ সর্ব্বদাই সমাজ হইতে বড়। আর সমাজের রীতিনীতি যখন কালবশে নারায়ণের আত্মপ্রকাশের অনুপযোগী হইয়া, তাঁর আত্মপ্রয়োজনেই, পরিবর্ত্তনযোগ্য হইয়া উঠে, তখন তিনি স্বয়ং সাধুমহাজনগণেতে আবিষ্ট বা অবতীর্ণ হইয়া, এই সকল পরিবর্ত্ত- নযোগ্য বিধিব্যবস্থা রহিত করিয়া, নূতন বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত করেন। তখন হিন্দু নিঃসঙ্কোচে এই মহাজনপন্থার আনুগত্য গ্রহণ করিয়া, প্রচলিত ও পুরাপ্রতিষ্ঠিত পরিবর্ত্তনযোগ্য সামাজিক বিধিব্যবস্থার পুরাতন আনুগত্য পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। এই প্রণালীতে যেখানে সমাজের সংস্কার সাধিত হয়, যেখানে এই সংস্কারচেষ্টা শুদ্ধ সমাজের ব্যক্তিগণের স্বাভিমতের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। সমাজ-সংস্কারের নামে, তখন সমাজের জনগণমধ্যে অসংযত ব্যক্তিত্বাভিমান জাগ্রত হইয়া, তাহাদিগকে স্ব-স্ব-প্রধান করিয়া, সমাজশাসনকে শিথিল করিয়া দেয় না। সেখানে প্রাকৃতজনের অশোধিত বিচারবুদ্ধি ও অসংযত ভোগলালসার দ্বারাই প্রচলিত রীতিনীতির পরিবর্তনযোগ্যতাও প্রমাণিত হয় না এবং প্রাচীন ও প্রচলিত বিধিব্যবস্থার বশ্যতা অস্বীকার করিতে যাইয়া, সমাজসংস্কারচেষ্টা সমাজমধ্যে অরাজকতা আনয়ন করিতে পারে না। যুগে যুগে, এই ভাবেই হিন্দুসমাজের সংস্কার ও বিবর্ত্তন ঘটিয়া আসিয়াছে। মহাজনপন্থার অনুসরণ করিয়াই হিন্দু সর্ব্বদা আপনার সমাজের সংস্কার ও শোধন করিয়াছেন। আর এই কারণেই, প্রাচীন ও প্রচলিত সমাজবিধিকে অগ্রাহ্য করিয়াও, হিন্দু প্রকৃতপক্ষে কখনো সর্ব্বধর্ম্মমূল যে সমাজানুগত্য তাহাকে একান্তভাবে বর্জ্জন করেন নাই, করিবার প্রয়োজনও কদাপি হিন্দুসমাজে উপস্থিত হয় নাই।
মহাজন-পন্থার প্রণালী
কিন্তু কোনো সমাজের সকল লোকই সর্ব্বদা সেই সমাজের মূল প্রকৃতিকে সজ্ঞানে আয়ত্ত করিতে পারে না। সকলেই তার শ্রেষ্ঠতম বিধান বা উৎকৃষ্টতম আদর্শানুযায়ী আপনাদিগের জীবনকে গড়িয়া তোলে না। এই জন্য কালবশে যুগে যুগে যখনি সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তন আবশ্যক হইয়াছে, তখন সকল হিন্দুই যে এই মহাজনপন্থা আশ্রয় করিয়াছেন, এমন বলা যায় না। আর কোনো যুগেই যুগপ্রবর্ত্তক মহাজনেরা সেই যুগের প্রারম্ভেই আবির্ভূতও হন না। প্রথমে নানা কারণে সমাজ-মধ্যে নূতন আদর্শ ও নূতন শক্তি প্রতিষ্ঠিত হইতে আরম্ভ করে। তখন অল্পে অল্পে নূতনে ও পুরাতনে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইয়া, সমাজমধ্যে বিশৃঙ্খলা আনয়ন করিতে থাকে। আর তখন হইতেই এই সকল যুগপ্রবর্ত্তক মহাজনগণের আগমনের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার আয়োজনও আরম্ভ হয়। কিন্তু এই সকল সামাজিক বিশৃঙ্খলার একান্ত আতিশয্য না হওয়া পর্য্যন্ত তাঁহারা আবির্ভূত হন না। কারণ ধর্ম্মের গ্লানি এবং অধর্ম্মের অভ্যুদয় একটা বিশেষ মাত্রা লাভ না করিলে, যুগপ্রবর্ত্তক মহাজনগণ আত্মপ্রকাশ করেন না। সুতরাং প্রত্যেক যুগসন্ধিস্থলেই, এক দল লোকে মহাজনপদাশ্রয় লাভ না করিয়াও, শুদ্ধ আপনাদের বিচারবুদ্ধির প্রেরণাতেই সমাজের প্রবুদ্ধ গতিশক্তিকে অবলম্বন করিয়া থাকেন। সে সময়ে আর একদল লোক সমাজস্থিতিরক্ষার্থে প্রাচীন ও প্রচলিত রীতিনীতিকেই আশ্রয় করিয়া রহেন। কিন্তু যথাসময়ে মহাজনেরা আবির্ভূত হইলেই যে সকলে বা অনেকে একযোগে তাঁহাদিগকে আশ্রয় করেন, তাহাও নহে। তখনো একদল লোকে প্রাচীনকেই ধরিয়া রহেন। হিন্দুসমাজের বিবর্ত্তন-ইতিহাসেও এটা সর্ব্বদাই দেখা গিয়াছে। ভগবান বুদ্ধদেবের সমসাময়িক আর্যাগণ সকলেই বা অধিকাংশই তাঁহার শরণাপন্ন হন নাই। কেহ কেহ যেমন তাঁহাকে গ্রহণ করিয়াছিলেন, তেমনি কেহ কেহ আত্যন্তিক আগ্রহ সহকারে তাঁহার শিক্ষা ও সাধনার প্রতিরোধও করিয়াছিলেন। আর বহুসংখ্যক লোকই তাঁহার আনুগত্যও গ্রহণ করেন নাই, তাঁহার প্রতিপক্ষতাও করেন নাই, কেবল যাহা ছিল, তাহাকেই ধরিয়া রহিয়াছিলেন। মহাপ্রভুর সময়ে, আমাদের এই বাঙ্গলাদেশেও তাহাই দেখা গিয়াছে। আর আমাদের এ কালেও যে যুগভাবপ্রবর্ত্তক মহাজনের আবির্ভাব হয় নাই, এমনো তো নয়। কিন্তু সকলেই কি তাঁহাদিগকে আশ্রয় করিয়াছেন, বা করিতে পারিয়াছেন?
ফলতঃ এরূপ সর্ব্বদাই হইয়াছে ও সর্ব্বদাই হইবে। কারণ, সকল মানুষের প্রকৃতি সমান নয়। কারো প্রকৃতি বা তামসিক, কারো বা রাজসিক, আর কারো বা শুদ্ধ সাত্ত্বিক। যাঁরা নিতান্ত তামসিক, তাঁরা এ মহাজনপন্থা অবলম্বন করিতে পারেন না। তাঁদের অবিবেক, তাঁদের জড়তা, তাঁদের ভয়প্রমাদাদি এ পথে চলিবার একান্ত অন্তরায় হইয়া রহে। সেইরূপ যাঁরা নিতান্তই সাত্ত্বিক, যাঁহাদের তমঃ ও রজঃ উভয়ই অন্তরস্থ সত্ত্বগুণের দ্বারা একান্ত অভিভূত হইয়াছে, সেই সকল সহজসিদ্ধ বা কৃপাসিদ্ধ সাধু-সজ্জনেরা, যুগধর্ম্ম— প্রবর্ত্তক মহাজনগণের প্রতি ভক্তিমান হইয়াও, প্রয়োজনাভাবে, প্রত্যক্ষরূপে তাঁহাদের ঐকান্তিক আনুগত্য গ্রহণ করিয়া, তাঁহাদের কর্ম্মস্রোতে আপনাদিগকে ভাসাইয়া দেন না। যাঁহাদের অন্তঃপ্রকৃতি রজোপ্রধান, তাঁহারাই প্রত্যেক যুগসন্ধিস্থলে, সমাজের প্রবুদ্ধগতি-শক্তিকে আশ্রয় করিয়া আপনাদের প্রকৃতির চরিতার্থতা অন্বেষণ করেন। আর ইঁহাদের মধ্যে যাঁহাদের অন্তরস্থ রজোগুণ বর্দ্ধীয়মান সত্ত্বের দ্বারা অভিভূত হইতে আরম্ভ করে, তাঁহারাই যুগপ্রবর্ত্তক মহাজনগণকে একান্তভাবে অবলম্বন করিতে অগ্রসর হন। কারণ, যুগপ্রবর্ত্তক মহাজনগণ আপনারা ত্রিগুণাতীত হইলেও, চতুঃপার্শ্বস্থ রজোগুণপ্রধান লোকদিগকে অবলম্বন করিয়াই স্ব স্ব আবির্ভাবের বিশেষ প্রয়োজন সিদ্ধি করিয়া থাকেন। যুগপ্রবর্ত্তক মহাজনগণের প্রথম শিষ্যেরা সকলে না হউন, অনেকেই, রজোপ্রভাবে তাঁহাদের শরণাপন্ন হইয়া, প্রাচীন ও প্রচলিত সংস্কার ও পন্থাকে পরিহার করিয়া, নূতন সাধন ও শাসন গ্রহণ করেন। ক্রমে এই নূতন সাধন ও শাসনের ফলেই, তাঁহাদের অন্তরস্থ সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পাইয়া প্রথমে তাঁহাদের রজোগুণকে অভিভূত করে, পরে, ইহাঁদের মধ্যে যাঁহারা বিশেষ সুকৃতিসম্পন্ন, তাঁহারা ক্রমে ত্রিগুণাতীত হইয়া, ভাগবতী তনু লাভ করিয়া থাকেন। কিন্তু পরিণামে সত্ত্বাধিক্য হইলেও, আদিতে, নূতন পন্থা অবলম্বন সময়ে, রজোগুণের আতিশয্য থাকা একান্তই আবশ্যক হয়। নতুবা সকলে যুগপ্রবর্ত্তক— মহাজন-পন্থা অবলম্বন করিতে পারে না। আর এই কারণেই হিন্দুর যাবতীয় যুগাবতার ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভব। কেবল এক পরশুরামই, অবতারগণমধ্যে, ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু তিনিও ব্রাহ্মণকুলে জন্মিয়াছিলেন মাত্র; ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম অবলম্বন করেন নাই। পরন্তু ত্রিভুবনকে নিঃক্ষত্রিয় করিবার জন্যই তাঁহাকে রজঃপ্রধানা রাগাত্মিকা ক্ষত্রিয়প্রকৃতি আশ্রয় করিয়া, ক্ষাত্রবৃত্তি অবলম্বন করিতে হইয়াছিল। হিন্দুর কিম্বদন্তিপ্রসিদ্ধ যুগাবতারগণের ক্ষত্রিয়ত্বের পশ্চাতে সমাজবিজ্ঞানের একটা অতি সত্য ও নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত রহিয়াছে বলিয়া মনে হয়।
গুরুদাসবাবু ও মহাজনপন্থা
গুরুদাস বাবুর মধ্যে কখনো এই রজোগুণের কোনো প্রকারের আতিশয্য দেখা যার নাই! “কর্ম্মনাং অশমঃ স্পৃহা”—ইহাই রজের প্রধান লক্ষণ। এই গুণ “তৃষ্ণাসঙ্গ-সমুদ্ভবং।” ইহা “রাগাত্মিকা।” গুরুদাস বাবুর কর্ম্ম-চেষ্টা আছে। এখন পর্য্যন্তও জনহিতকর কর্ম্মে তাঁর বিন্দু পরিমাণ আলস্য বা ঔদাসীন্য দেখা যায় না। কিন্তু কর্ম্মচেষ্টা থাকিলেও কখনোই কর্ম্মে তাঁর অশম স্পৃহা দেখা যায় নাই। তাঁর কর্ম্মচেষ্টা তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভব নহে, ধর্ম্মবুদ্ধি-প্রণোদিত। সুতরাং আমাদের অপরাপর কর্ম্মনায়কগণের মধ্যে প্রায়শঃই যে একটা আত্মপ্রতিষ্ঠার ভাব ও ফলাফলসন্ধিৎসু চাঞ্চল্য লুকাইয়া থাকে, গুরুদাস বাবুতে তাহা লক্ষিত হয় নাই! আর তাঁর প্রকৃতির ভিতরে এই রজোগুণের আতিশয্য নাই বলিয়াই, যে মহাজনপন্থা অবলম্বন করিয়া, অতি প্রাচীনকাল হইতে যুগে যুগে হিন্দুসমাজের বিবর্ত্তন হইয়া আসিয়াছে, যাহাকে আশ্রয় করিয়া হিন্দুসমাজ প্রত্যেক যুগসন্ধিসময়ে আপনার গতিশক্তি ও স্থিতিশক্তির মধ্যে এমন সুন্দর ও সহজ সন্ধি ও সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে পারিয়াছেন, গুরুদাস বাবু, আপনার কর্মজীবনে বা ধর্ম্মজীবনে, কোথাও একান্তভাবে সেই মহাজনপস্থা অবলম্বন করিতে পারেন নাই। গুরুদাস বাবুর ভিতরকার প্রকৃতিই এমন যে তিনি বৌদ্ধযুগের আদিতে জন্মিলে; কখনই একান্তভাবে ভগবান বুদ্ধদেবের শরণাপন্নও হইতে পারিতেন না, তাঁর প্রতিবাদীও হইতেন না। কিন্তু বুদ্ধদেবের শিক্ষা ও সাধনার প্রতি অন্তরে ভক্তিমান হইয়া, সেকালের ক্রিয়াবহুল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্ম ও বৈদিক পন্থাকেই ধরিয়া রহিতেন। মহাপ্রভুর সময়ে, এই বাঙ্গলাদেশে জন্মগ্রহণ করিলেও, গুরুদাস বাবু তাহাই করিতেন। সে কালের বহুসংখ্যক বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ও কায়স্থদিগের ন্যায় গুরুদাস বাবুও হয় ত মহাপ্রভুর সিদ্ধান্ত ও সাধন গ্রহণ করিতেন, কিন্তু কখনই তাঁর একান্ত অনুগত হইয়া, সমাজের প্রচলিত স্মৃতি-আনুগত্য বর্জ্জন করিতে পারিতেন না। আর আমাদের এই কালে, বাঙ্গলার হিন্দুসমাজের গতিশক্তি যে সকল মহাজনকে আশ্রয় করিয়া, সমাজের “পরিবর্ত্তনযোগ্য” রীতিনীতির সংস্কার সাধনের প্রয়াসী হইয়াছে, গুরুদাস বাবু ইঁহাদের সকলেরি প্রতি ভক্তিমান, কাহাকেই অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করেন না; কিন্তু আবার কাহাকেই একান্ত ভাবে আশ্রয় করিয়া, সমাজের পরিবর্তনযোগ্য রীতিনীতির আনুগত্যও পরিত্যাগ করিতে অগ্রসর হন নাই।
গুরুদাস বাবু ও লৌকিকাচার
মোটা কথা এই যে—
যোগী ত্রিকালজ্ঞঃ সমুদ্রলঙ্ঘনক্ষমঃ
তথাপি লৌকিকাচারং মনসাঽপি ন লঙ্ঘয়েৎ॥
“যোগী ত্রিকালজ্ঞ এবং সমুদ্রলঙ্ঘনক্ষম হইলেও, কদাপি আপনার মনেও লৌকিকাচারকে উল্লঙ্ঘন করিবেন না”—ইহাই গুরুদাস বাবুর কর্মজীবনের মূলসূত্র হইয়া আছে। গুরুদাস বাবু, মোটের উপরে, বর্ত্তমান হিন্দুসমাজের অনেক বিধিব্যবস্থা ও রীতিনীতিরই পরিবর্ত্তন যে আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছে, ইহা জানেন ও মানেন। আর এ সকল মত প্রচার করিতেও তিনি কুণ্ঠিত হন না। কিন্তু যতদিন না সমাজ সমষ্টিভাবে এগুলিকে গ্রহণ করিয়াছে, অর্থাৎ যতদিন না এগুলি লৌকিকাচারে প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে, ততদিন তিনি এ সকল সংস্কার কার্য্যে পরিণত করিতে প্রস্তুত নহেন। কিছুকাল পূর্ব্বে পর্য্যস্ত এদেশের হিন্দুসমাজে যে অতি অল্পবয়সে বালক-বালিকাদের বিবাহ হইত, গুরুদাস বাবু তার প্রতিবাদী। চতুর্দ্দশ কি পঞ্চদশ বর্ষেই সচরাচর “স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরসংসর্গলিপ্সার” উদ্রেক হয়; আর যে বয়সে এই প্রবৃত্তির উদ্রেক হয়, তখনই তাহাকে “নির্দিষ্ট পাত্রে ন্যস্ত করিয়া নিবৃত্তিমুখী করিবার জন্য” নরনারীকে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করা কর্তবা—বিবাহের বয়সসম্বন্ধে গুরুদাস বাবু এই সিদ্ধান্তই করিয়াছেন। [৪] কিন্তু কার্য্যতঃ বিবাহের বয়স নির্দ্ধারণ করিতে যাইয়া তিনি দ্বাদশ হইতে চতুর্দশ বর্ষ পর্য্যন্তই তাহাদের বিবাহ দেওয়া কর্ত্তব্য, এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁর নিজের বুদ্ধি ও বিচার মতে চতুর্দ্দশ হইতে পঞ্চদশ বর্ষই বালিকাদের বিবাহের নিম্নতম কাল নির্ধারিত হওয়াই বিধেয়। “অসামান্য পবিত্র ও সংযতচিত্ত” নরনারীর পক্ষে আরো অধিক বয়সে বিবাহ করিলেও, ধর্ম্মহানি হয় না, এ কথাও তিনি অস্বীকার করেন না। কিন্তু তথাপি কেবল লৌকিকাচারের মুখাপেক্ষী হইয়াই, গুরুদাস বাবু, দ্বাদশ হইতে চতুর্দ্দশ বর্ষই বালিকার বিবাহের উপযুক্ত বয়স বলিয়া নির্দ্ধারণ করিয়াছেন। ত্রিশ বৎসর পরে, বাঙ্গলার হিন্দুসমাজের লৌকিকাচারে যদি অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ বর্ষের যুবতীগণের বিবাহ প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হইয়া যায়,গুরুদাস বাবু যে তখনো এই দ্বাদশ হইতে চতুর্দ্দশ বর্ষের নিয়মকেই ধরিয়া থাকিবেন, এমন বোধ হয় না। যেমন বাল্যবিবাহের সংস্কারসম্বন্ধে, সেইরূপ হিন্দুসমাজের প্রচলিত জাতি-বিচারসম্বন্ধেও, লোকাচারে যে পরিমাণে শিথিলতা বা ঔদার্য্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে, গুরুদাস বাবু কেবল তাহাই গ্রহণ করিতে রাজি আছেন। পরমার্থদৃষ্টিতে যে জাতি-বিচারের স্থান নাই, গুরুদাস বাবু ইহা স্বীকার করেন।
"বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি
শুনিচৈব স্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমন্বর্শিনঃ॥
গাভী হস্তী কুকুরকে ব্রাহ্মণে চণ্ডালে।
পণ্ডিতেরা সমভাবে দেখেন সকলে॥
এবং রামচন্দ্র স্বয়ং গুহক চণ্ডালের সহিত মিত্রতা করিয়াছিলেন। অতএব হীনজাতি বলিয়া কাহাকেও অবজ্ঞা করা হিন্দুর কর্তব্য নহে।” *[৫] গীতার এই উক্তি অনুসারে, আর গুণকর্ম্মবিভাগের দ্বারাই প্রথমে চতুর্ব্বর্ণের উৎপত্তি হয়, এই কৃষ্ণোক্তি স্মরণ করিয়া, হিন্দুসমাজে এখন যে আকারে জাতিবিচার প্রতিষ্ঠিত আছে, সঙ্গত বলিয়া তাহার সমর্থন করা সম্ভব নহে; গুরুদাস বাবু ইহা জানেন। কিন্তু সমাজের লোকমত এখনো এতটা অগ্রসর হয় নাই। তবে বাঙ্গলার হিন্দুসমাজে আজিকালি জাতিবিচারটা কেবল পানাহার ও বিবাহেতেই আবদ্ধ হইয়া আছে। সুতরাং মধ্য যুগের হিন্দুয়ানীর “লৌকিকাচারং মনসাঽপি ন লঙ্ঘয়েৎ”—এই আদেশ মনে রাখিয়াই যেন, গুরুদাস বাবুও “আহার ও বিবাহ বাদ দিয়া” অন্যান্য বিষয়ে জাতির প্রাচীর যে ভাঙ্গা যাইতে পারে, ভাঙ্গাই যে কর্ত্তব্য, ইহা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। আর যে যুক্তি অবলম্বনে +[৬] বিবাহ ও আহার এই দুই বিষয়েই এখন জাতিবিচার মানিয়া চলা কর্ত্তব্য, অন্য বিষয়ে নহে, গুরুদাস বাবু এই সিদ্ধাস্ত করিয়াছেন, তাহা দেখিয়াও লৌকিকাচারই যে তাঁহার সামাজিক কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যনির্দ্ধারণে প্রধান ও সম্ভবতঃ একমাত্র তৌলদণ্ড, এই ধারণাই বদ্ধমূল হইয়া যায়।
গুরুদাস বাবুর সামাজিক সিদ্ধান্ত
আর গুরুদাস বাবুর মতন এমন সম্যক্দর্শী, এত তীক্ষ্ণবুদ্ধি সদ্বিচারক মনীষীর সিদ্ধান্তেও সামান্য লৌকিকাচার যে এতটাই অদ্ভুত প্রাধান্য ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, ইহার কারণ নির্দ্দেশ করাও একাস্ত কঠিন নহে। প্রথমতঃ গুরুদাস বাবু আযৌবনকাল আইনকানুন লইয়াই দিন কাটাইয়াছেন। আর সকল সভ্যদেশের ব্যবহার-শাস্ত্রেই লোকাচার অদ্ভুত প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে। যে সকল লোকাচারের আরম্ভকাল জনগণের স্মৃতি হইতে একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, সকল সভ্যসমাজেই সে জাতীয় লৌকিকাচারকে প্রত্যক্ষ আইনের সুস্পষ্ট বিধানের সমান মর্য্যাদা দেওয়া হয়। বিবাহ, দায়ভাগ প্রভৃতি সামাজিক স্বত্বাস্বত্ব নির্দ্ধারণে এইরূপ লৌকিকাচার শ্রুতি-স্মৃতি অপেক্ষাও বলবত্তর বলিয়া গণ্য হয়। আর ব্যবহার শাস্ত্রে লৌকিকাচারের এতটা অদ্ভুত প্রভুত্ব দেখিয়াই, ব্যবহারজীবী গুরুদাস বাবুর প্রাণে তাহার প্রতি এমন অপরিসীম মর্য্যাদা জন্মিয়াছে। গুরুদাস বাবু ব্যবহারবিদ (jurist) ও নীতিবিদ্ (moralist) দু’ই। কেবল ব্যবহারবিদ্ বলিলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হইবে, জানি। কিন্তু তথাপি তাঁর সাধনায় ও সিদ্ধান্তে বাবহারবিদের দিক্টা যে পরিমাণে ফুটিয়া উঠিয়াছে, ঠিক নীতিবিদের দিক্টা সে পরিমাণে ফুটিয়া উঠিয়াছে কি না সন্দেহ! গুরুদাস বাবু জীবনের গুরুতর সমস্যাসকলকে কতটা পরিমাণে যে সমিচিন ব্যবহারবিদের চক্ষে দেখেন ও সর্ব্বদা ব্যবহার তত্ত্বের যুক্তিপ্রণালীর অবলম্বনে এ সকলের যথোপযোগী মীমাংসা করিতে চেষ্টা করেন, তাঁর “জ্ঞান ও কর্ম্ম” গ্রন্থের প্রায় সর্ব্বত্রই ইহার প্রমাণ পাওয়া যা
একদিকে যেমন তাঁর ব্যবসায়ের দীর্ঘ অভ্যাস অন্যদিকে সেইরূপ তাঁর তত্ত্ব-সিদ্ধান্তও গুরুদাস বাবুর এই লোকাচারানুগত্যকে গড়িয়া তুলিয়াছে। তত্ত্বসম্বন্ধে গুরুদাস বাবু শঙ্কর-বেদাস্তাবলম্বী। শঙ্কর-বেদান্ত মতে, বিশেষতঃ যে মায়াবাদ শঙ্কর-সিদ্ধান্ত বলিয়া এদেশে চলিয়া গিয়াছে, তাহাতে, জীব ও জগতের সত্য ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই। রজ্জুতে সর্পভ্রমের ন্যায়, এই জীব ও জগতের পরিচ্ছিন্ন-জ্ঞান পরমার্থতঃ মিথ্যা। মায়াতেই এই সংসারের উৎপত্তি, মায়াতেই ইহার স্থিতি। সংসারের বিবিধ সম্বন্ধসকলের কোনো নিত্যলক্ষ্য বা পারমার্থিক প্রতিষ্ঠা নাই। সুতরাং প্রচলিত শঙ্করসিদ্ধান্তে সমাজ-ধর্ম্ম ও সামাজিক উন্নতি-অবনতি, সকলই অতি নিচের কথা; সাধনার্থীর নিকটে ইহার মূল্য থাকিলেও, সিদ্ধ পুরুষের নিকটে কোনো সত্য, কোনো মূল্যই নাই। ধর্ম্মাধর্ম্ম, পাপপুণ্য প্রভৃতির ব্যবহারিক সতা ও সার্থকতা আছে মাত্র; পারমার্থিক সত্য ও সার্থকতা নাই। অতএর দেহগুদ্ধি বা ভূতশুদ্ধি, ইন্দ্রিয়সংযম, মনঃসংযম, উপরতি, তিতিক্ষা, এ সকল সাধনসম্পৎলাভের জন্য উপযোগী অভ্যাসের ক্ষেত্র বলিয়াই সংসার প্রয়োজনীয়। সাধনসম্পৎ লাভ হইয়া ক্রমে বিবেক-বৈরাগ্যাদি ও সর্ব্বশেষে ব্রহ্মাত্মৈকত্বানুভূতি বা কৈবল্যসিদ্ধি হইলে, সর্পের খোলস যেমন আপনা হইতেই, অনাবশ্যক বলিয়া, তাহার গাত্র হইতে খসিয়া পড়ে, সেইরূপ জীবের সংসার ও তাহার যাবতীয় সামাজিক সম্বন্ধাদিও তাহার মন হইতে আপনি খসিয়া পড়িয়া যায়। কিন্তু কেবল মায়াবাদীর নিকটেই যে সংসারের সম্বন্ধসকল অনিতা, ও অনিত্য বলিয়াই পারমার্থিক দৃষ্টিতে অলীক, তাহা নহে। কোনো হিন্দুসিদ্ধান্তেই এ সকলের অনিত্যতা অস্বীকৃত হয় নাই। যাঁরা মায়াবাদী নহেন, তাঁরাও এগুলিকে নিত্য বা; সত্য বলেন না। সুতরাং এ সকল ক্ষণস্থায়ী সম্বন্ধের অতীত হইবার চেষ্টা সকল সাধনেই আছে। তবে মায়াবাদী এ সকলের পশ্চাতে কোনো স্থায়ী রস প্রত্যক্ষ করেন না। আর যাঁরা মায়াবাদী নহেন, তাঁরা সংসারের সর্ব্ববিধ অনিত্য সম্বন্ধের মধ্যেও কতকগুলি স্থায়ী রসের প্রতিষ্ঠা করেন, এবং এই সকল রসকে রস—স্বরূপ যে পূর্ণব্রহ্ম তাঁহারই নিখিলরসামৃতসিন্ধুর উপরিস্থ তরঙ্গভঙ্গ বলিয়া গ্রহণ করেন। এ সংসারে পিতাপুত্রের যে কায়িক সম্বন্ধ তাহা প্রত্যক্ষতঃই অনিত্য। প্রাকৃতজনে যে বাৎসল্যরস আস্বাদন করে তাহাও অস্থায়ী, সন্তানের জন্মের সঙ্গে তাহার উৎপত্তি হয়, আর সস্তান গত হইবার পরে সচরাচর তাহা ক্ষীণ হইয়া, দীর্ঘকাল পরে, লুপ্তপ্রায় হয়। কিন্তু এই সম্বন্ধের পশ্চাতে একটা স্থায়ী বাৎসল্যরস আছে। এই স্থায়ী রসই, দেশকালাধীন এই সংসারে লৌকিক পিতামাতার সঙ্গে পুত্রকন্যার যে সম্বন্ধ, তাহারই মধ্য দিয়া আত্মপ্রকাশ করিতেছে। এ রস ভগবৎ-প্রকৃতির অন্তর্গত, সুতরাং পারমার্থিক ও নিতা। সংসারের বিভিন্ন সম্বন্ধ এই স্থায়ী ভাগবতীলীলা-রসকে আশ্রয় করিয়া প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সকল সম্বন্ধের অন্তরালে, শাস্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর এই পঞ্চ স্থায়ী রস বিদ্যমান রহিয়াছে। আর এই জন্য, এই পঞ্চ স্থায়ী রস বিদ্যমান রহিয়াছে। আর এই জন্য, এই পঞ্চ স্থায়ী রসের প্রকাশ ও আলম্বন বলিয়া, সংসারেরও একটা পারমার্থিক সত্য ও মাহাত্ম্য, মর্য্যাদা ও মূল্য আছে। জীব ও সংসার অত্যন্ত অনিত্য নহে, অত্যন্ত নিত্যও নহে; কিন্তু নিত্যানিত্যমিশ্রিত। ইহাকে পরিণামী নিত্য বলা যায়। আর পরিণামী নিত্য বলিয়াই, এই সংসার ভাগবতী-লীলার আশ্রয় হইয়া আছে। এই লীলা— প্রয়োজনেই মনুষ্যসমাজ মহাবিষ্ণু বা নারায়ণের কায়ব্যূহ হইয়াছে। কিন্তু ব্রক্ষ্মস্বরূপের আত্মচরিতার্থতার জন্যই, সেই অদ্বৈত-স্বরূপেরই মধ্যে, যে একটা দ্বৈত-সম্বদ্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়, যে দ্বৈত-সম্বন্ধ বা ভেদাভেদকে অবলম্বন করিয়াই ভগবান নিত্যলীলাপর হইয়া আছেন, শঙ্কর-সিদ্ধান্তে এই তত্ত্বের কোনোই স্থান ও সঙ্গতি নাই। সুতরাং ভগবল্লীলারসপর বৈষ্ণবসিদ্ধান্তে যে ভাবে ও যে অর্থে মহাজনপন্থা আশ্রয় করিয়া, সমাজের গতিশক্তি ও স্থিতি-শক্তির মধ্যে একটা সুন্দর সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, শঙ্কর-সিদ্ধান্তে তাহা হয় নাই, হওয়া সম্ভব নহে। এখানে লৌকিকাচারের পন্থা অবলম্বন করিয়াই এই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিদ্বয়ের স্বাভাবিক বিরোধ ভঞ্জনের চেষ্টা করিতে হয়। তাহার আর অন্যপথ নাই।
সংসার মায়ামাত্র। সমাজসম্বন্ধ সকল মায়িক। মানুষের স্নেহমমতা, প্রেয়-ও-শ্রেয়বোধ, ভালমন্দজ্ঞান, ধর্ম্মাধর্ম্মবিচার, সকলই অবিদ্যাবদ্বিষয়ানী। সুতরাং নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে কার্য্যের যে একটা সঙ্গতি রাখিতেই হইবে, এখানে এমন কোনো কথা নাই। আমাদের এ সকল মতামত যখন মিথ্যা, কার্য্যাকার্য্য যখন মিথ্যা, মতের সঙ্গে কার্য্যের মিলন-বিরোধও যখন মিথ্যা; তখন বিশ্বাসের সঙ্গে কাজের মিল হইল কি না হইল, তাহাও মিথ্যা। এ সকলের ব্যবহারিক সত্য থাকিলেও পারমার্থিক মর্য্যাদা নাই। এ সকল ব্যবহারিক দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় হইলেও, পারমার্থিক দৃষ্টিতে অলীক। প্রচলিত শঙ্কর-সিদ্ধান্তে সংসারধর্ম্মের কোনই পারমার্থিক সতা ও মর্য্যাদা নাই। চিত্তশুদ্ধি করিয়া ক্রমে সর্ব্ববিধ দ্বৈতবোধ নষ্ট করাই, শঙ্কর-বেদান্তমতে, সমাজধর্ম ও সমাজবন্ধনের একমাত্র লক্ষ্য হইয়া পড়ে। সমাজবন্ধন ও সামাজিক সম্বন্ধ সকল জীবের বহিমুর্খীনও বহুমুখী প্রবৃত্তি সকলকে সংযত ও নিবৃত্তিমুখী করিয়া দিয়াই, এই পারমার্থিক উদ্দেশ্যসাধনের সহায়তা করে। আর একমাত্র সংযম ও নিবৃত্তিসাধনই যখন সমাজধর্ম্মের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, তখন লৌকিকাচারের বশ্যতা অস্বীকার করিয়া যে কোনো উদ্দেশ্যে ও যে কোনো আকারেই সমাজের বিরুদ্ধে দ্রোহীভাব অবলম্বন করা হউক না কেন, তাহাতেই সমাজবন্ধনের এই মুখ্য উদ্দেশ্যসিদ্ধির বিষম ব্যাঘাত জন্মিয়া থাকে। সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে গেলেই কোনো না কোনো আকারে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতেই হয়। এরূপ আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ জনগণের পক্ষে আাপনার ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া রাখা একান্তই কঠিন হইয়া পড়ে। আর সর্ব্ববিধ আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াসের মধ্যেই যে কলহবিরোধ জাগিয়া থাকে, তাহাতে অন্তরের দ্বৈতভাব ও ভেদবুদ্ধিকে জাগাইয়াই রাখে, নষ্ট করিবার সাহায্য করে না। সুতরাং লৌকিকাচারকে অগ্রাহ্য করিয়া সমাজ-সংস্কার করিবার চেষ্টা করিলে, সে চেষ্টা মোক্ষপথের অন্তরায় হইয়া উঠে। এই জন্য শঙ্করমতাবলম্বী সাধুসন্ন্যাসীসমাজে একদিকে প্রচণ্ড জ্ঞানালোচনা ও জ্ঞানপন্থার প্রতি ঐকান্তিক পক্ষপাতিত্ব, অন্যদিকে তামস— প্রকৃতিসুলভ নিশ্চেষ্টতা ও লৌকিকাচারের আত্যন্তিক আনুগত্য, এ দুই দেখা গিয়া থাকে। একদিকে—বিচারে, চিন্তায়, সাধনায় ও সিদ্ধান্তে—এ সকলে সর্ব্ববিধ দ্বৈতভাব ও ভেদবুদ্ধির নিন্দা করিয়াও, কার্য্য কালে ইঁহারা প্রায় সর্ব্বদাই সমাজ-প্রচলিত সর্ব্বপ্রকারের ভেদ ও বৈষম্যের সম্পূর্ণ মর্য্যাদা রাখিয়া চলিবার জন্য ব্যগ্র হন। শঙ্কর স্বয়ংও ইহার অন্যথাচরণ করেন নাই। মধ্যযুগের হিন্দুয়ানী লৌকিকাচারকে যে এমন করিয়া ধর্ম্মের আসনে বসাইতে চাহিয়াছে, শঙ্কর-বেদান্তের সঙ্গে ইহার অতিশয় ঘনিষ্ঠ যোগ আছে বলিয়া মনে হয়। আর আজিও হিন্দুসমাজের সকল সম্প্রদায়মধ্যেই শঙ্কর-সিদ্ধান্তের প্রভাব, প্রত্যক্ষভাবেই হউক আর প্রচ্ছন্নভাবেই হউক, নিরতিশয় প্রবল রহিয়াছে বলিয়াই, আমাদের শ্রেষ্ঠতম মনীষীগণও লৌকিকাচারের আনুগত্য পরিত্যাগ করিতে এত ভয় পাইয়া থাকেন। গুরুদাস বাবুর লৌকিকাচারের ঐকান্তিক আনুগত্যের অন্তরালেও শঙ্কর-বেদান্তের প্রভাব সুস্পষ্টই লক্ষিত হইয়া থাকে।
লৌকিকাচারকে কেবল মধ্যযুগের হিন্দুয়ানীই যে ধর্ম্মের আসনে বসাইয়াছে, তাহা নহে। বর্ত্তমান কালে কোনো কোনো য়ুরোপীয় সিদ্ধাস্তেও তার প্রায় অনুরূপ মর্য্যাদাই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। অষ্টাদশ খৃষ্টশতাব্দীর য়ুরোপীয় চিন্তা, অতিপ্রাকৃত শাস্ত্রপ্রামাণ্য বর্জ্জন করিয়াও সমাজ-স্থিতিরক্ষার্থে একটা বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিপ্রতিষ্ঠ মরালিটীর বা ধর্ম্মনীতির আশ্রয় গ্রহণ করিতে যাইয়া, ফলতঃ লৌকিকাচারকেই ধর্ম্মের আসনে বসাইয়াছে। প্রত্যক্ষবাদী কোমত্-সিদ্ধান্তেও আমাদেরই শঙ্কর—বেদান্তের ন্যায়, সমাজ-বিবর্ত্তনে সমাজের গতিশক্তি ও স্থিতিশক্তির মধে একটা সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা করিবার জন্য, এই লৌকিকাচারই প্রত্যক্ষ ধর্ম্ম বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। কোমত্সিদ্ধান্ত-বাদিগণ, ইংরেজিতে যাঁহাদিগকে পজিটিভিষ্ট্ (Positivist) সম্প্রদায় বলে, —একদিকে যেমন সামাজিক উন্নতির জন্য লালায়িত, সেইরূপ অন্যদিকে সমাজের স্থিতিভঙ্গ-নিবারণের জন্যও একান্ত ব্যগ্র হইয়া থাকেন। তাঁরা কিছুতেই, কার্যতঃ, সমাজের প্রচলিত বিধিব্যবস্থা ও রীতিনীতির প্রভাব নষ্ট করিতে প্রস্তুত নহেন। তাঁহাদের নিকটেও সমাজই ধর্ম্মের কায়ব্যূহস্বরূপ। ক্যাথলিক খৃষ্টীয়মণ্ডলী মধ্যে চার্চ্চ বা রোমক-খৃষ্টীয় সঙ্ঘ যে মর্য্যাদা প্রাপ্ত হয়, ধর্ম্মের বহিঃপ্রকাশ বলিয়া সকলে যেরূপ এই চার্চ্চের বা সঙ্ঘের আনুগত্য স্বীকার করিয়া চলে, প্রত্যক্ষবাদী কোমত্মতাবলম্বিগণ মধ্যে সমাজ সেইরূপ মর্য্যাদাই প্রাপ্ত হয়, এবং সমাজের আনুগত্য মানিয়া চলা, কোমত্মতে নিতান্তই নীতিসঙ্গত বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে। কোমত্— মতের সঙ্গে মধ্যযুগের হিন্দুয়ানীর এই সমাজানুগত্য বা লৌকিকা চারানুগত্যের একটা যে ঐকা আছে, বাঙ্গালী হিন্দুদিগের মধ্যে যাঁরা কোমত্মত গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের শিক্ষায় ও চরিত্রে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। খিদিরপুরের জমিদার, স্বর্গীয় যোগীন্দ্রচন্দ্র ঘোষ,ন্যাশন পত্রের সুযোগ্য সম্পাদক স্বর্গীয় নগেন্দ্রনাথ ঘোষ, ইহাঁরা দু’জনেই কোমত্মতাবলম্বী ছিলেন। নগেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয় জীবনের শেষভাগে এই মত পরিত্যাগ করিয়াছিলেন কি না, জানি না। যোগীন্দ্রচন্দ্র ঘোষ মহাশয় যে পরিত্যাগ করেন নাই, ইহা সকলেই জানেন। আর এঁরা দু’জনই একদিকে ঘোরতর প্রত্যক্ষবাদী ও যুক্তিবাদী হইয়াও হিন্দুসমাজের রীতিনীতি ও সংস্কারাদির ঐকান্তিক আনুগত্য গ্রহণ করিতে কদাপি কুণ্ঠিত হন নাই। ইংরেজ কোমত্- বাদিগণ মধ্যে স্যার হেনরী কটন্ প্রভৃতি প্রায় সকলেই হিন্দুর এই লৌকিকাচারের আনুগত্যকে কখনই ভাঙ্গিয়া দিতে চান নাই; বরং সর্ব্বদাই তাহাকে সঙ্গত বলিয়াই সমর্থন করিয়াছেন। ইহাঁরা পারলৌকিক ধর্ম্মের দিক্ দিয়া হিন্দু রীতিনীতির পোষকতা করেন নাই। সে ধর্ম্মে তাঁদের আদৌ বিশ্বাস ছিল না। কেবল শুদ্ধ সমাজের কল্যাণকামনায়, সমাজস্থিতিরক্ষার্থে, সমাজনীতি বা মরালিটীর দিক্ দিয়াই এ সকলের সমর্থন করিতেন। গুরুদাস বাবু কোমত্মতাবলম্বী নহেন। কিন্তু সমাজনীতিসম্বন্ধে গুরুদাস বাবুর লৌকিকাচারের ঐকান্তিক আনুগত্য যে কোমত্মতের দ্বারা সমর্থিত হইয়া, আধুনিক য়ুরোপীয় নীতিবিজ্ঞানের সঙ্গে ইহার একটা সঙ্গতিসাধনে যে তাঁহার বিশেষ সাহায্য করিয়াছে, ইহাও অস্বীকার করা যায় না। তারই জন্য গুরুদাস বাবুর আধুনিক শিক্ষা এবং সাধনাও তাঁর চরিত্রগত মধ্যযুগের হিন্দুয়ানীর ঐকান্তিক লৌকিকাচারানুগতাকে নষ্ট করিতে পারে নাই।
গুরুদাস বাবুর এই রক্ষণশীলতার আরো একটী বিশেষ কারণ আছে। গুরুদাস বাবু একদিকে য়ুরোপের আধুনিক সাধনা ও অন্যদিকে স্বদেশের সনাতন সাধনার উভয়েরই মূল প্রকৃতিটী ভাল করিয়াই ধরিয়াছেন। এই দুই সাধনা ও সভ্যতার মধ্যে যে বিশাল বৈষম্য আছে, ইহাও তিনি জানেন। আর যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির, সেইরূপ প্রত্যেক সমাজের ধর্ম্মও যে সর্ব্বদাই তার ভিতরকার মূল প্রকৃতি হইতে, সেই প্রকৃতিকে অবলম্বন করিয়াই প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকে, এবং এই জন্য কি ব্যক্তির পক্ষে কি সমাজের পক্ষে, সকলেরই পক্ষে যে পরধঅর্ম্ম ভয়াবহ হয়, ইহাও তিনি বিশ্বাস করেন। আমাদের সমাজসংস্কারপ্রয়াস যে অনেক বিষয়েই ভারতের প্রাচীন সমাজপ্রকৃতিকে উপেক্ষা করিয়া, য়ুরোপের রীতিনীতির স্বল্পবিস্তর অনুকরণচেষ্টায় চলিয়াছে, ইহাও তিনি দেখিতেছেন। য়ুরোপ যে পথে যাইয়া, অসংযত বিষয়-ভোগলালসায় বিক্ষিপ্ত হইয়া, আপনার জীবনসমস্যাকে বিষম জটিল করিয়া তুলিতেছে, নূতন নূতন পন্থার অনুসরণ করিয়া, সমাজের বুকে সমস্যার উপরে সমস্যাই স্তূপাকার করিয়া তুলিতেছে, একটারও সমীচিন মীমাংসা করিতে পারিতেছে না, কখনো পারিবে কি না, তাহারও স্থিরতা নাই; গুরুদাস বাবু এ সকলই জানেন। আর আমরা যে সমাজের হিতেচ্ছু হইয়া, এ সকল না বুঝিয়া, সংস্কারের নামে, অনেক সময়, নিজেদের সমাজের উপরে এই ভয়াবহ পরধর্ম্মের বোঝা চাপাইয়া দিতেছি, ইহাও তিনি প্রত্যক্ষ করিতেছেন। আর এই জন্যই অজ্ঞাত ও অপরীক্ষিত পন্থায় সমাজকে চালাইবার পূর্ব্বে, সে পথ সমাজের অন্তঃপ্রকৃতির অনুযায়ী হইবে কি না, ইহা দেখিবার জন্যই, তিনি সর্ব্বদা এই লৌকিকাচারের মুখাপেক্ষী হইয়া চলিতে চাহেন। কারণ, কি ব্যক্তি কি সমাজ উভয়ই সর্ব্বদা আপনার প্রকৃতিকেই প্রাপ্ত হয়। ইহাকেই আধুনিক জীবতত্ত্বে বা বায়লজিতে, প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের নিয়ম কহে। এই নিয়মাধীন হইয়াই, সামাজিক রীতিনীতি ও বিধিব্যবস্থারও বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠা হইয়া থাকে। কদাপি যে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে না, এমন নহে। কিন্তু যেখানেই ব্যতিক্রম ঘটে, সেখানেই সমাজ পরধর্ম্মবশে আত্মহারা হইয়া, বিপ্লবমুখী ও বিনাশোম্মুখ হইয়া উঠে। গুরুদাস বাবুর রক্ষণশীলতার অন্তরালে এই বিপ্লবের ভয়ই জাগিয়া আছে। বর্ত্তমান সময়ে রক্ষণশীল হিন্দু বলিয়া অনেকেই পরিচিত। কিন্তু ইহাঁরা অনেকেই প্রাচীন সমাজের জীর্ণদেহকে রক্ষা করিবার জন্য যত ব্যস্ত, তার ভিতরকার সনাতন প্রাণবস্তুকে রাখিবার জন্য তত ব্যস্ত নহেন। হিন্দুয়ানীর বাহ্য ঠাটটা বজায় থাকিলেই, হিন্দুর সব রহিল, সেই ঠাটের ভিতরকার প্রাণটা হিন্দু কি অহিন্দু, ভারতীয় কি বিলাতী হইয়া যাইতেছে এ চিন্তা তাঁহাদিগকে স্পর্শ করে না। এক গুরুদাস বাবুই বোধ হয়, আধুনিকশিক্ষাপ্রাপ্ত হিন্দুদের মধ্যে, হিন্দুর সনাতন প্রাণবস্তুকে অক্ষত ও অক্ষয় রাখিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া আছেন। আর এই ব্যগ্রতার জন্যই হিন্দুসমাজের সনাতন প্রাণবস্তু এবং ধর্ম্মবস্তুও, আজ তাঁহাকে ও তাঁহারই মতন ধর্ম্মনিষ্ঠ ও কর্ম্মনিষ্ঠ, সংযত ও সম্যক্দর্শী সুধীজনকে আশ্রয় করিয়া, আসন্ন বিপ্লবমুখে আত্মরক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছে। প্রত্যেক বস্তুরই স্থিতির ভূমি যাহা, তাহা অতি নিগূঢ় ভাবে, চক্ষের অন্তরালে, বসিয়া থাকে। তাহার গতির কারণ যাহা তাহাই বাহিরে ফুটিয়া উঠে। গুরুদাস বাবুর মত লোকনায়কগণ সমাজের স্থিতির সহায় বলিয়া, তাঁহাদের প্রভাব সর্ব্বদা প্রত্যক্ষ হয় না; নতুবা তাঁহাদের শক্তি ও মাহাত্ম্য যে সামান্য, তাহা নহে। ইহাঁরা আছেন বলিয়াই হিন্দুর সমাজের সমাজত্ব, ও হিন্দুর ধর্ম্মের ধর্ম্মত্বটুকু এথনো আমাদের মধ্যে বাঁচিয়া রহিয়াছে।
- ↑ “জ্ঞান ও কর্ম্ম”—৩১৭ পৃষ্ঠা।
- ↑ “জ্ঞান ও কর্ম্ম”-২৮০ পৃষ্ঠা।
- ↑ বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠে মাতৃ-মূর্ত্তি প্রদর্শন করিবার সময়ে মাকে মহাবিষ্ণুর অঙ্কে স্থাপন করিয়াছেন। ইহাই মা'র নিত্যমূর্ত্তি। মহাবিষ্ণুর অঙ্ক হইতেই মা ক্রমে জগদ্ধাত্রী, কালী, দূর্গা রূপে সমাজ-বিবর্ত্তনে প্রকাশিত হইয়া থাকেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মহাবিষ্ণুই য়ুরোপীয়দিগের হিউম্যানিটী।
- ↑ জ্ঞান ও কর্ম্ম-২৮৪ পৃষ্ঠা
- ↑ জ্ঞান ও কর্ম্ম—৩৫৪ পৃষ্ঠা।
- ↑ জ্ঞান ও ধর্ম্ম-৩৫৫ পৃষ্ঠা।