চিত্ত-মুকুর/কলঙ্কী জয়চন্দ্র

চিত্ত-মুকুর।
কলঙ্কী জয়চন্দ্র।

কলঙ্কী নরের মন নরক সমান,
কি দরিদ্র কিবা রাজা দুই সমতুল;
সাক্ষাতে উভয় চিত্তে আনন্দের ভাণ,
বিরলে জ্বলন্ত চিতা যন্ত্রণার মূল।
দিনেকের তরে কিম্বা ক্ষণেকের তরে,
কণামাত্র পাপ যদি পরশে কাহায়,
ভীষণ ভুজঙ্গ দন্তে যে বিষ উগরে,
সেই বিষ বহে সদা শিরায় শিরায়;
বিস্মৃতি-সাগরে চিত্ত করিলে মগন,
নাহি পরিত্রাণ তবু দহিবে জীবন।

আনন্দপ্রবাহে যদি ভাষাও হৃদয়,
সদা কলকণ্ঠ যদি পরশে শ্রবণ,
সদা অপ্সরার রূপ নয়নে উদয়,
অজস্র পীযূষ যদি কর আস্বাদন,

তবু থামিবে না বিষ অন্তরে অন্তরে,
প্রত্যেক শিরায় উহা বিদ্যুতের প্রায়,
ছুটিবে উন্মত্ত-স্রোতে আজীবন তরে,
ঔষধ নাহিক বিশ্বে নিবাতে উহায়;
চিকিৎস্য করালদন্ত সর্পের দংশন,
অচিকিৎস্য হতভাগ্য পাপীর বেদন।


ওই বসি বরাঙ্গনা সুরম্য ভবনে
ঢালিয়া নিবিড় কায় পালঙ্ক উপরে,
দুই খানি কাম-ধনু যুগল নয়নে,
চিরপূর্ণ তূণ বাঁধা বক্ষের উপরে;
কেমন হাসিয়া তার নায়কের সনে
করিতেছে প্রেমালাপ—উহার অন্তরে
কি জ্বলন্ত শিখা আছে দেখিও গোপনে,
স্মরিয়া আপন পপি আপনি শিহরে;
সাগরের জলে যদি ডুবায় হৃদয়,
তথাপি উহার পাপ ধুইবার নয়।

8

ওই পুনঃ বসি পাপী প্রেয়সির সনে
নিরখিছে নিষ্কলঙ্ক বদন তাহার,

নিরখিছে প্রেমপূর্ণ যুগল নয়নে,
শুনিতেছে প্রেমালাপ সুধার আধার;
তথাপি দহিছে পাপ অভাগার মনে,
তবু নিরানন্দ চিত্ত হায়রে উহার,
বিগত পাপের স্রোত উথলি স্মরণে,
অনুতাপ বিন্ধে হৃদে শলা শত বার;
নির্ম্মল সাধুর সুখ মুহূর্ত্তের তরে,
উদিবে না আজীবনে পাপীর অন্তরে।


ওই নিরখিছ যারে স্বর্ণসিংহাসনে
শতরত্নে বিমণ্ডিত, ফুটিছে অধরে
কেমন মধুর হাসি-দেখিও নির্জ্জনে
কি জ্বলন্ত ব্যথা আছে উহার অন্তরে;
কবে হরিয়াছে কার সতীত্ব রতন,
বধিয়াছে কিম্বা কবে জীবন কাহার,
সেই পাপময়ী চিন্তা করিয়া স্মরণ,
অনুতাপে সদা চিও দহিবে উহার;
জাগ্রতে স্মৃতির শিখা নিদ্রায় স্বপন
চন্দ্র সূর্য্য মত নিত্য দিবে দরশন।

রাজা, রাজ্য-দুই শব্দ শুনিতে মধুর;
কিন্তু কি যন্ত্রণা আছে এ চারি অক্ষরে
রাজা বিনা এ সংসারে বুঝে কয় জনে?
উচ্চ শব্দে মুগ্ধ হয় যত মূঢ় নরে,
উন্নত প্রাসাদে বসি স্বর্ণসিংহাসনে
হতভাগ্য নরপতি যে সুখ না পায়,
পর্ণের কুটিরে কিম্বা তৃণের শয়নে
সামান্য ভিক্ষুক সদা ভুঞ্জিতেছে তায়;
দেখিতে শুনিতে ভাল কেবল রাজন
সতত চিন্তায় তার আকুল জীবন।


যেই রাজদণ্ড রহে নৃপতির করে,
সামান্য সুবর্ণপাতে হয়েছে গঠিত;
অচেতন ধাতুমাত্র—উহার ভিতরে
ধর্ম্মের পবিত্র আত্মা রয়েছে স্থাপিত।
রাজামাত্রে রাজ দণ্ড করেছে ধারণ,
কিন্তু কজনের করে হয়েছে শোভিত;
অধর্ম্মে করেছে যেই রাজ্যের শাসন,
রাজদণ্ড সদা তার হয়েছে কম্পিত।

ধার্ম্মিকের করে উহা ধর্ম্মেতে উজ্জ্বল,
অধার্ম্মিক করে শুধু সুবর্ণ কেবল।


গভীর নিশিতে একা নির্জ্জন উদ্যানে,
দুরাচার জয়চন্দ্র করিছে ভ্রমণ;
কি চিন্তা বিরাজে আজ অভাগার মনে,
চল লো কল্পনে! মোরা করি দরশন।
নির্জ্জন প্রকোষ্ঠে বসি খুলিতে হৃদয়,
শঙ্কিত ভাবিয়া ভিত্তি করিবে শ্রবণ;
পালঙ্কে চাপিয়া বক্ষ ভাবিতেও ভয়,
পালঙ্ক বুঝিবে চিন্তা করিয়া স্মরণ
শিহরিছে স্থির তরু করি দরশন,
ভাবিছে উহার(ও) বুঝি আছয়ে শ্রবণ।


“এই-ত চক্রান্ত শেষ কিন্তু পরিণাম,
ভাবিতে এখন কেন শরীর শিহরে;
যে কৌশল সৃজিয়াছি নিজ মনস্কাম
নিশ্চয় সফল হবে, গর্ব্বিত পৃথুরে
রাখিব শৃঙ্খলে বাঁধি সিংহাসনতলে,
সৃজিব পাদুকা তার সুবর্ণ মুকুটে,

রাজ্ঞী তার রবে পরিচারিকা-মণ্ডলে,
প্রেয়সীর কাছে সদা রবে করপুটে;
এই বার চূর্ণ হবে গর্ব্ব পাপাত্মার,
কিন্তু কেন কাঁপিতেছে হৃদয় আমার?”

১০

“হৃদয়ের মর্ম্মস্থলে কঠোর বচনে,
উচ্চৈঃস্বরে যেন আত্মা করে তিরস্কার;
ফিরাইতে চাই মন—তীব্র আকর্ষণে,
যেন মন-সূত্র ধরি টানে পুনর্ব্বার।
‘অধর্ম্ম-অধর্ম্ম’ শুধু পশিছে শ্রবণে
কি অধর্ম্ম করিয়াছি না পারি বুঝিতে;
আঁধারে ভীষণ চিত্ত নিরখি নয়নে,
সতত যন্ত্রণা যেন উথলিছে চিতে,
অচেতন শীলা কিংবা তরু গুল্মচয়,
নিরখিলে বোধ হয় যেন মূর্ত্তিময়।”

১১

“ভ্রাতৃদ্রোহী?—এই যদি অধরম হয়,
পাপাত্মার শান্তি তবে কোথায় সংসারে?
গর্ব্বিতের দর্প তবে কিসে হবে ক্ষয়,
কে ঘুচাবে জগতের হেন অত্যাচারে?

প্রজার পাপের শাস্তি প্রদানে রাজায়,
রাজার পাপের শাস্তি দিবে কোন্ জন?
রাজার উপরে রাজা দণ্ডিতে তাহায়,
আছে যদি তবে ইহা পাপ কি কারণ?
অধার্ম্মিক হয় যদি গুরু আপনার,
নিশ্চয় দণ্ডিতে পাপ উচিত তাহার।”

১২

“বিনয়ে চাহিনু যবে স্বত্ব আপনার,
যে উত্তর করেছিল দুরাত্মা তখন;
ধিক্‌ মোরে। এখনো সে অধরে তাহার,
সেই জিহ্বা রহিয়াছে সর্পের মতন।
উচিত তখনি শাস্তি প্রদানিতে তার,
বুঝি না কেন যে হস্ত উঠেনি তখন;
গরলের মত সেই বচন তাহার,
ভাসিতেছে চিত্তে মোর সদা সর্ব্বক্ষণ।
যত দিন অসম্পূর্ণ প্রতিজ্ঞা আমার,
দহিবে হৃদয় সদা গরলে তাহার।”

১৩

“পাষাণের বক্ষ আর ক্ষত্রিয় হৃদয়,
এক উপাদানে দুই হয়েছে গঠিত।

পাষাণে অস্ত্রের লেখা অনন্ত অক্ষয়,
অপমান ক্ষাত্র বক্ষে আজন্ম অঙ্কিত।
সমগ্র ভারত যদি হয় একত্তর,
তথাপি প্রতিজ্ঞা মম করিব সাধন।
শুকাবে সাগর কিংবা লুটাবে ভূধর,
প্রতিজ্ঞা নিষ্ফল মম হবে না কখন।
ক্ষত্রিয়ের পণ আর লিপি বিধাতার,
ভবিতব্য দুই-দুই সম-দুর্নিবার।”

১৪

“রাজ-নীতি একমাত্র সহায় আমার,
শত্রুর নিধন অস্ত্র ইহায় গ্রথিত।
সূত্রে সূত্রে মিলাইয়া যদি একবার,
পারি নিক্ষেপিতে লক্ষ্য করি নিরূপিত;
সমগ্র ভারত কিংবা সমগ্র ভূতল,
রোধে যদি তবু উহা অব্যর্থ সন্ধান,
আলোড়ি গগণ বক্ষঃ, সাগরের জল,
শক্তিশেল সম উহা বিন্ধিবে পরাণ।
সম্ভব নিষ্ফল হবে সহস্রের বল,
ব্যর্থ নাহি হবে কভু নীতির কৌশল।”

১৫

“নির্ব্বোধ যবন অন্ধ রতনের লোভে
ভাবিয়াছে দিব রত্ন খুলিয়া ভাণ্ডার,
দহিবে অন্তর তার পরিণামে ক্ষোভে
রিক্ত হস্তে একে একে হবে সিন্ধুপার।
মূর্খ নহে জয়চন্দ্র, তস্করের আশা
পূরাইরে শূন্য করি গৃহ আপনার;
সিন্ধু লুটি বাড়িয়াছে বিষম পিপাসা
এই বার প্রতিফল পাইবে তাহার
তাড়িত মার্জ্জার মত বসিয়া আফ্‌গানে,
হেরিবে সতৃষ্ণ নেত্রে ভারতের পানে।”

১৬

সহসা মর্ম্মর শব্দ পশিল শ্রবণে,
অমনি বিদ্যুৎ-বেগে ফিরায়ে নয়ন
নিরখিল চারিদিক্‌‌ শশঙ্কিত মনে,
ভাবিল যবন বুঝি করিছে শ্রবণ।
ত্যজি দীর্ঘশ্বাস শেষে কহিল গম্ভীরে,
“কেন এত ভয় আজ হৃদয়ে আমার?
জগৎ নিমগ্ন যেন সন্দেহের নীরে
প্রত্যেক ঝলকে ভীতি হয়েছে সঞ্চার।

কেমনে আমার সেই নির্ভয় হৃদয়,
হইল শিশুর মত সতত সভয়?”

১৭

“মৃত্যু-দুর্নিবার তাহা, অদ্য কিংবা অন্যদিন
অবশ্য ঘটিবে, নাহি ভাবি তার তরে,
তবে কোন ত্রাসে চিত্ত আনন্দবিহীন,
কে সুহৃদ্‌ আছে হেন জিজ্ঞাসিব কারে?
ইচ্ছা করে চিন্তা হতে যাই পালাইয়া
অথবা তুলিয়া ফেলি স্মৃতির দর্পণ,
কিংবা জন স্রোতে আত্ম-বিস্মৃতি লভিয়া,
বারেক শীতল করি অন্তর-বেদন।
নিবে যাও শশধর তারকানিকর,
সহিতে পারে না আলো আমার অন্তর।”

১৮

“সংসার! কি ক্ষুদ্র তুমি নয়নে আমার,
জগৎ! কি মরুময় আমার নয়নে!
প্রকৃতি কি বিষমাখা আকৃতি তোমার!
সম্পদ কি তুচ্ছতম আজ মম মনে!
স্নেহ মায়া প্রেম তোর এত কি দুর্ব্বল
নাহি পার ফিরাইতে অভাগার মন?

ক্ষত্রিয়ের প্রতিহিংসা এত কি প্রবল!
মুহূর্ত্তের তরে শান্ত নাহি হয় মন!
না হয় পৃথুরে ক্ষমি রব মিত্র ভাবে,
কিন্তু অন্তরের জ্বালা তা’হলে কি যাবে?

১৯

ভবিষ্যৎ তোর গর্ভে অভাগীর তরে,
কি আছে সঞ্চিত খুলি বারেক দেখাও;
অনিশ্চিততার তীব্র যন্ত্রণা অন্তরে,
পারি না সহিতে—কিম্বা দেখাইয়া দাও
নিরাপদ স্থান হেন নাহিক যেখানে—
চিন্তা ক্ষোভ আশা তৃষ্ণা, ত্যজিয়া সংসার
ত্যজি আত্ম পরিজন রত্ন-সিংহাসনে,
করিব নির্ম্মল মনে আত্মার সংস্কার।
সাগরের জলে রাজ্য হউক মগন,
থাকিব অনন্যচিত্তে মুদিয়া নযন।”

২৫

“যদি সন্ধি ভঙ্গ করে সাহাব্‌ উদ্দীন,
আক্রমে কনোজ যদি করি প্রতারণা;
শঠতায় যবনেরা সতত প্রবীণ,
তবেই ত সিদ্ধ হবে সকল কামনা।

হত-বল সৈন্য দল দিল্লীর সমরে
নারিবে রোধিতে উগ্র যবনের বল;
পাবক স্ফুলিঙ্গ মত পশিয়া নগরে,
ধন প্রাণ ক্ষত্রিয়ের হরিবে সকল।
বারেক যবন সেনা প্রেবেশে যে স্থান,
দগ্ধ করি গৃহ দ্বার করয়ে শ্মশান।”

২১

“এই শিরঃ যাহে আজ শোভিছে রতন,
যবন দাসত্বভারে হবে অবনত;
এই হস্ত রাজ-দণ্ড করিয়া ধারণ,
পূজিতে যবন পদ হবে নিয়োজিত;
বলয়ের পরিবর্ত্তে শোভিবে শৃঙ্খলে,
উদ্যানের পরিবর্ত্তে রুদ্ধ কারাগার;
কিম্বা দিবে তুলি পদ এই বক্ষঃস্থলে,
উঃ! এ চিন্তা হৃদে সহেনা-ক আর।
ভবিষ্যৎ রুদ্ধ কর কবাট তোমার!
এ নরকচিত্র নেত্রে সহেনা-ক আর!”

২২

ত্যজিল সুদীর্ঘ শ্বাস চাহি শূন্য পানে,
নিবাবার তরে যেন গগনের আলো;

ভাবিল অলোক রাশি পশিয়া পরাণে,
অদৃশ্য ভাবনাগুলি করিছে উজ্জ্বল।
মুদিল নয়ন পুনঃ আবরিয়া কর,
কিন্তু হৃদয়েতে যাহা হয়েছে অঙ্কিত
মুদিলে নয়ন কেন হইবে অন্তর!
বরং উজ্জ্বলতর হবে অনুভূত।
স্মৃতি-চিহ্ন হবে লোপ মুদিলে নয়ন,
কিন্তু অপনীত কেন হইবে বেদন।

২৩

জয়চন্দ্র! ভবিষ্যৎ দেখিলে এখন,
আর কেন, পাপ চিন্তা কর পরিহার!
অবিশ্বাসী মিথ্যাবাদী সতত যবন,
অলীক আশ্বাসে মুগ্ধ হইও না তার।
এখনি ছুটিয়া যাও পৃথুর সদনে,
বীর তিনি ক্ষমিবেন অবশ্য তোমায়;
যে বিপদ সৃজিয়াছ ভেবে দেখ মনে
এই প্রায়শ্চিত্ত ভিন্ন নাহিক উপায়,
লজ্জা হয়, হৃৎপিণ্ড কর উৎপাটন,
করো-না ক্ষত্রিয়-নামে কলঙ্ক অর্পণ।

২৪

কালের বিশালবক্ষে জ্বলন্ত অক্ষরে,
থাকিবে অঙ্কিত এই কলঙ্ক তোমার।
ঘৃণিত হইয়া রবে চিরদিন তরে,
হিন্দুমাত্র প্রাতঃসন্ধ্যা দিবে তিরস্কার।
ছি ছি হেন নীচ বৃত্তি হৃদয়ে তোমার?
কেন নিমন্ত্রিলে হয় দুরাত্মা যবনে?
অপহৃত রাজ্য তব করিবে উদ্ধার—
কিন্তু পরিণাম তার ভেবে দেখ মনে,
অপহৃত রাজ্য তব আছিল স্বদেশে,
যবন-সাহায্যে তাহা পশিবে পারস্যে।

২৫

আর ভারতের এই সৌভাগ্য তপন
তোমার অদৃষ্টসনে হবে অস্তমিত;
হিন্দু-রাজ্য ভন্ন উপকূলের মতন
দিনে দিনে কাল-গর্ভে হইবে নিহিত,
ফলিবে ইহায় যেই ফল বিষময়,
কেবল নহে তব দুঃখের কারণ;
কত শত বর্ষ ইহা হিন্দুর হৃদয়—
দহিবে, হায়রে তাহা জানে কোন জন?

সাধিতে কলুষ-ব্রত ওরে দুরাচার!
ভারত-অদৃষ্ট কেন করিছ আঁধার

২৬


অদূরে তরুর পার্শ্বে দাঁড়া’য়ে গোপনে
স্থির সৌদামিনীরূপা একটি রমণী,
বদন গম্ভীর, দৃষ্টি প্রখর নয়নে,
নীরবে শুনিতেছিল রাজার কাহিনী
যন্ত্রণায় জয়চন্দ্র মুদিলে নয়ন
অগ্রসরি দাঁড়াইল সম্মুখে তাহার;
স্থির দৃষ্টে নিরখিয়া ডাকিল তখন।
প্রাণেশ্বর!—
শিহরিয়া জয়চন্দ্র খুলিল নয়ন
হেরিল সম্মুখে তার রমণী-রতন।

২৭


“শৈল! তুমি কেন এই অনাবৃত স্থানে?
গভীর নিশায়—এই নিশীথ শিশির।
জান না কি অপকারী, দেখ দেহ পানে
এখন(ও) আরোগ্য নহে তোমার শরীর,
চল গৃহে, বলি হস্ত করিল ধারণ;
বিস্ফারি নয়ন, শৈল কহিল গম্ভীরে,

আমা হ’তে মূল্যবান্ তোমার জীবন,
তোমার উচিত নহে ভ্রমিতে শিশিরে;
আমার—হায়রে যার সমুদ্রে শিবির
কি করিবে নাথ তার নিশির শিশির”।

২৮


“যে অনল বক্ষঃস্থলে—থাক্‌ সে সকল,
বল প্রাণেশ্বর তব কি ভাবনা মনে?
গত দিনকত ধরি নিরখি কেবল।
নিমগ্ন সতত তুমি গভীর চিন্তনে।
কারণ জিজ্ঞাসি যদি বিস্ফারি নয়ন।
আমার বদনে চাহ, পুনঃ জিজ্ঞাসিতে
ফিরায়ে নয়ন ভূমে প্রহরি চরণ
‘কিছু না’ বলিয়া উঠি দাঁড়াও ত্বরিতে;
তথাপি জিজ্ঞাসি যদি, সঞ্চালিয়া কর
বিরক্তে ইঙ্গিত কর হইতে অন্তর”।

২৯


“ভাবিতাম পূর্ব্বে ইহা চিত্তের বিকার,
দিন দুই পরে চিত্ত হইবে সুস্থির;
দিনে দিনে বৃদ্ধি এবে হইছে ইহার,
বল নাথ কেন এত হইলে অধীর?”

“বলিয়াছি একবার বলি আরবার
শরীর অসুস্থ মম বড়ই এখন
এই প্রশ্ন শৈল মোরে করিও না আর
যাও তুমি নিজ গৃহে করগে শয়ন।”
বেষ্টিয়া হৃদয়ে বাহু—কুঞ্চিত নয়নে
ভ্রমিতে লাগিল জয় সুমন্দ চলনে।

৩০


“অসুস্থ!—ইহা কি তবে ব্যবস্থা তাহার।
অনাবৃত স্থানে এই নিশীথ-ভ্রমণ?
প্রগল্‌ভতা প্রাণেশ্বর ক্ষম অবলার
অবশ্য ইহার আছে অপর কারণ।
অন্তরের পীড়া ইহা মর্ম্মের যাতনা”—
জানু পাতি পতিপদ করিয়া বেষ্টন,
“সত্য করি বল নাথ ত্যজি প্রতারণা
কোন পাপ-ভাবনায় মগ্ন তব মন?
পত্নী যদি না বুঝিল পতির বেদন
স‍ুধু কি তাহার কার্য্য শোভিতে শয়ন”?

৩১


“উঠ শৈল, কেন পড় চরণে আমার
জিজ্ঞাসিছ কিন্তু কিবা বলিব তোমায়,

রাজ-কার্য্যে চিত্ত মগ্ন সতত রাজার
কেনা জানে—কেন পুনঃ জিজ্ঞাস আমায়?
প্রজার অদৃষ্টক্ষেত্র ন্যস্ত যার করে
সে যদি আমোদে মগ্ন রহে সর্ব্বক্ষণ,
ভেবে দেখ ফল যাহা ফলিবে সত্বরে,
রাজ চিত্ত নহে শৈল! আমোদ-কারণ;
একটি ভাবনা সুধু তোমার কেবল
শত ভাবনায় মম হৃদয় চঞ্চল।

৩২


“একটি ভাবনা!” বলি উঠিয়া সত্বর
দাঁড়াইল শৈল গ্রীবা করিয়া উন্নত,
দেহ অস্ত্র দেখাইব চিরিয়া অন্তর
চিন্তার জ্বলন্ত বহ্নি বিরাজিছে কত।
হ’তেম যদ্যপি আমি কৃষক-রমণী
তখন হইত চিত্ত ভাবনা-বিহীন,
সে সৌভাগ্যবতী নহে রাজার রমণী
সতত চিন্তায় তার হৃদয় মলিন;
বুঝিত পুরুষ যদি রমণীর মন
দেখিত তাহার চিত্তে কতই বেদন।’

৩৩


“নাহি প্রয়োজন নাথ, সে সবে এখন
বল কোন্ রাজকার্য্য করিতে উদ্ধার
নিভৃত উদ্যানে একা করিছ ভ্রমণ
মাখিয়া শরীরে এই নিশার নিহার;
শুনিয়াছি সব নাথ হইয়া গোপন,
এ পাপ মন্ত্রণা হায় কে দিল তোমারে?
অসার প্রতিজ্ঞা তব করিতে সাধন,
নিমন্ত্রিছ নিজ গৃহে ঘৃণিত তস্করে!
প্রতিহিংসা যদি তব এতই প্রবল
ক্ষত্রিয় শরীরে তব ছিল না কি বল?”

৩৪


“বীর-প্রসবিনী এই ভারত ভিতরে।
ছিল না কি বীর তব হইতে সহায়?
ভুলিয়া গৌরব নিজ সাধিলে তস্করে!
স্মরিলে আমি যে নাথ মরি হে লজ্জায়!
কায কি সহায় তব, এস মোর সনে।
অপমান প্রতিশোধ প্রদানি তোমার,
এস নাথ আমি অগ্রে প্রবেশিয়া রণে
অপহৃত রাজ্য তব করিব উদ্ধার।

“দেহ দুই করে দুই উলঙ্গ কৃপাণ
দেখিবে যুঝিব একা বিদ্যুৎ সমান।”

৩৫


“কিশোর সন্তান তব হইবে সহায়
বৈশ্বানর তেজে সেও যুঝিবেক রণে
ভয়ে ভীত যদি তুমি, চাহি না তোমায়
পশিতে সমরে, মোরা জননী-সন্তানে
অপহৃত রাজ্য তব করিব উদ্ধার।
সেও যদি ভীত হয়, সুতীক্ষ্ণ কৃপাণে
ছেদন করিব স্তন-যুগল আমার—
পালিয়াছি এত দিন যার দুগ্ধ দানে।
অপুত্র বরং ভাল তথাপি কখন
হে বিধাতঃ! ভীরু পুত্র নাহি হয় যেন।

৩৬


“ভাগ্য-দোষে বীরপত্নী নহে অভাগিনী
কিন্তু ক্ষত্রিয়ের কুলে জনম আমার,
বীর-কন্যা আমি নাথ, বীর-প্রসবিনী
রবি যেমনে পারি গর্ব্ব আপনার।
হ’তে যদি বীর তুমি দেখিতে এখনি
পারি কিনা কাযে যাহা কহিনু কথায়,

এই বক্ষে চুর্ণ হ’ত কতই অশনি
দলিতাম পদে শত্রু মাতঙ্গিনী প্রায়;
যুঝিব দেহেতে রবে যতক্ষণ বল
জয় পরাজয় সুধু অদৃষ্টের ফল।

৩৭


“যবন-আশ্রয় যদি প্রতিজ্ঞা তোমার
তস্করের, পামরের, নীচের আশ্রয়—
কেশাগ্র দেখিতে মোর পাইবে না আর
জনমের মত নাথ হইনু বিদায়।
বিধবা হয়েছি যবে করিব শ্রবণ,
সেই দিন পুনর্ব্বার জনমের তরে,
একত্রে চিতার বক্ষে করিব শয়ন
বক্ষে করি দেহ তব ডাকিব ঈশ্বরে—
এজনমে এই শেষ যেন জন্মান্তরে
বীরপতি করি তোমা সমৰ্পেণ মোরে।”

৩৮


মুছিয়া নয়ন জল ত্বরিত চরণে
প্রেবেশিল শৈলবালা মন্দিরে আপন,
অনিমেষ নেত্রে জয় খাকি কতক্ষণে
বিষাদে নিশ্বাস ত্যজি কহিল তখন;

করিব না যবনের সহায় গ্রহণ
পশিব একাকী আমি দুর্ব্বার সমরে,
হয় সমরক্ষেত্রে হইব নিধন
বীর বলি খ্যাতি তবু করিবে ত নরে।
যা কহিল শৈলবালা সঠীক সকল
জয় পরাজয় শুধু অদৃষ্টের ফল।

৩৯


কিন্তু কাল প্রাতে যবে সাহাব উদ্দীন
ডাকিবে পশিতে রণে তাহার সহিত,
কি উত্তর দিব—সে ত নহে বুদ্ধিহীন,
অভিপ্রায় বুঝিবে সে আমার নিশ্চিত।
এক শত্রু স্মরি যার এত ভয় হয়
দুই শত্রু তার পক্ষে কত ভয়ঙ্কর।
একত্রে উভয় রণ নিশ্চয় দুর্জ্জয়,
তাহে কুম্ভকর্ণ সম যুঝিবে সমর
মহম্মদে নাহি ডরি না ডরি পৃথুরে,
উরি শুধু একা সেই সমরসায়ীরে।

৪০


কি করিব কোথা যাব, কে আছে আমার
কে দিবে বলিয়া মোরে নিগূঢ় উপায়;

রমণীর বীর্য্যহীন হৃদয় যাহার
হা বিধাত! প্রতিহিংসা কেন এত তায়!
কেন জ্বালিনু এই সমর অনল!
কেন নিমন্ত্রিনু এই দুর্জ্জয় যবনে!
অন্তরে বাহিরে বহ্নি হইল প্রবল
একা আমি হেন বহ্নি নিবাব কেমনে?
যা থাকে কপালে লব যবন-আশ্রয়।
দেখিব কৌশল সিদ্ধ হয় কি না হয়।