চিতা-শয্যা।

গাঢ় অমাবস্যা-নিশি ঘোর অন্ধকার,
আছন্ন কালিমা মেঘে শূন্য চারিধার,

বদন বিস্তার ক’রে, গ্রাসিবারে বসুধারে,

মন্দ পদক্ষেপে যেন আসে দণ্ডধর।
এসে যেন সঙ্কুচিত বিশ্বচরাচর।

এহেন নিশীথে বসি প্রকোষ্ঠে আপন,
সর্ব্ব-সংহারিনী মূর্ত্তি করি দরশন,</poem>

চপলা বিকট হাসে, ভুবন চমকে ত্রাসে,
গম্ভীরে জলদ করে ভীম গরজন।
স্তব্ধ বিশ্ব সেই রবে স্তম্ভিত পবন।


হেরি দুনয়নে সুধু অনন্ত আঁধার,
গাঢ়তর কালিমায় ঢাকা চারিধার,
সহসা জলদ রাশি, ভেদিয়া সম্মুখে আসি,
দাঁড়াইল নারী এক অপূর্ব্ব রূপসী।
ফুলের কবরী শিরে, দেহে ফুলরাশি।


প্রফুল্ল কমল দুটি মৃণাল সহিত,
চারু করলে তার হয়েছে শোভিত,
গলে পুষ্প কমাল, বক্ষঃস্থলে পুষ্প-ঢালা,
জীবন্ত যৌবন যেন কুসুমের বেশে।
দাঁড়াইল কাছে মোর, মুখে মৃদু হেসে।


গরমে শিহরি শেষে চিনিনু তাহায়,
বিজন-সঙ্গিনী মম প্রিয় কল্পনায়,
বদন গম্ভীর করে, কহিল বিষাদ-স্বরে,
আইনু দেখিয়া এক দৃশ্য ভয়ঙ্কর,
দেখিতে বাসনা যদি হও অগ্রসর।


চলিনু কল্পনা-সাথে ঘোর ত্রিযামায়,
দেখিতে ভীষণ দৃশ্য, বিরাজে কোথায়,
নদনদী গিরিবন,  করি কত উল্লঙ্ঘন,
উপনীত দুইজনে বিস্তীর্ণ শ্মশানে—
তরু-শূন্য—প্রাণি-শূন্য—গৃহশূন্য স্থানে।


শ্মশানের বক্ষঃস্থলে নেত্রপাত করি
নিরখি ভীষণ দৃশ্য উঠিনু শিহরি,
উন্মাদিনী চিতাহাসে, দাঁড়ায়ে তাহার পাশে,
সুন্দর আয়ত-তনু যুবা এক জন,
রূক্ষ-কেশ—রক্ত-নেত্র—ভীম-দরশন।


একপদ পুরোভাগে, অপর পশ্চাতে,
অনতিবৃহৎ এক দণ্ডধরি হাতে,
জ্বলন্ত চিতার ক্রোড়ে, প্রবীণা রমণী পোড়ে,
নিবিড় চিকুর-জাল, বিস্তীর্ণ শিয়রে,
দুইখানি ক্ষীণ বাহু পড়ি দুই ধারে।


বদন অঙ্গারে টাকা চেনা নাহি খায়,
ক্ষীণ অঙ্গে অগ্নি-শিখা খেলিয়া বেড়ায়,

দেহ ভস্ম নাহি হয়, পরিধানও দগ্ধ নয়,
সহসা দেখিলে হেন জ্ঞান হয় মনে,—
জীবিতা প্রাচীনা সুপ্ত অনল-বিতানে।

১০


সভয়ে যুবার পার্শ্বে করিয়া গমন,
জিজ্ঞাসিনু কার চিতা,—সে বা কোন জন;
তুলিয়া জ্বলন্ত আঁখি,  আমার বদনে রাখি,
তীব্র ভাবে কতক্ষণ চাহিয়া রহিল,
ভয়ঙ্কর দৃষ্টির—হৃদয় কাঁপিল।

১১


রাখি ভূমে কাষ্ঠদণ্ড জলদ গম্ভীরে,
কহিল ভীষণস্বরে মোর পানে ফিরে,
“বুঝি বঙ্গবাসী হবে, নহিলে কেনবা কবে,
কারচিত, দেখ নর জননী তোমার;”
হস্তে সরাইয়া দিল জ্বলন্ত অঙ্গার।

১২


“সাতশত বর্ষ আজ দিবারাত্র ধ’রে
এই শ্মশানের বক্ষে এই চিতা পোড়ে,
শব দগ্ধ নাহি হয়, দেহও এমতি রয়,
ঢালিয়াছি কুম্ভপূরে সিন্ধুসম জল,
নিবে না এ চিতানল জ্বলিছে কেবল।”

১৩


শিহরিনু নিরখিয়া রমণীর মুখ
যাতনায় ক্লিষ্ট যেন মূর্ত্তিমতী দুখ
নয়নের ঊর্ধ্বকোলে, নেত্র-তারা রহে ঢলে
জীবন চন্দ্রমা মরি নিষ্প্রভ নয়নে,
অস্ত যায় আঁধরিয়া রমণী বদনে।

১৪


লহরে লহরে শিখা শবের উপরে
বিকট ভৈরব রঙ্গে হেসে নৃত্য করে,
কভু শিরে কভু পায়, বহ্ণি -শিখা ছুটে ধায়,
আবার দাঁড়ায়ে বক্ষে ভীমরঙ্গে হাসে,
নিরখি সে চিনল কাঁপিলাম ত্রাসে।

১৫


তুষার-তর্জ্জনী মম বক্ষের উপরে
রাখিয়া কহিল যুবা সুগম্ভীর স্বরে,
“চিনিলে কি চিতা কার,—চিতা ভারত মাতার
এইধর জননীর রাজ নিদর্শন,”
মুকুট রতনদণ্ড করিল অর্পণ।

১৬


সভয়ে মুকুট দণ্ড করিনু ধারণ,
নিরখিতে হায় মোর কাঁদিল নয়ন;

ছিন্ন মুকুটের গায়, ভগ্ন-হীরা সমুদায়,
মনি-চ্যুত রাজ দণ্ড তাও অর্দ্ধখান,
কেকরিল এ দুর্দ্দশা কার হেন প্রাণ।

১৭


চাহিনু চিতার পানে হাসিছে অনল,
অচেতন তনু তায় পড়ি অচঞ্চল,
সাধ হৈল একবার প্রাণশূন্য প্রাচীনার
করে দণ্ড শিরে করি মুকুট স্থাপন,
জননীর রাজবেশ করি দরশন।

১৮


“যাও চলি” পুন যুবা কহিল গম্ভীরে
“ভারতের প্রতি ঘরে এই চিহ্ণ ধরে,
বালবৃদ্ধ কি তরুণে, দেখাইও প্রতি জনে,”
তর্জ্জনী হেলায়ে পথ করি প্রদর্শন
রাখিল বদনে মম আরক্ত নয়ন।

১৯


সভয়ে ফিরায়ে আঁখি উপদিষ্ট পথে
চলিনু বিহ্বল-চিত্তে কল্পনার সাথে,
গাঢ়তর অন্ধকার, লক্ষ্যশূন্য চারিধার,
গগনে জীমূত বৃন্দ গর্জ্জিছে গম্ভীরে,
ধাঁধিয়া নয়ন, দৃষ্টি রোধিছে চিকুরে।

২০


পশ্চাতে ফিরিয়া দেখি জ্বলে চিতানল
পার্শ্বে ভীম-কায় মূর্ত্তি দাঁড়ায়ে অচল
স্থির-চিত্তে কতক্ষণ, করি চিত। দরশন
পশিল শ্রবণ-মুলে অস্ফুট বচন౼
“দেখ ফিরে পার্শ্বে তব পুন কোন জন।”

২১


চকিতে চাহিয়া দেখি অতি ভয়ঙ্কর।
সম্মুখে শবের ছায়া-কাঁপিল অন্তর;
ক্ষীণ হস্ত প্রসারিয়া,౼ শবনেত্রে নিরখিয়া,
কহিল, “মুকুটদণ্ড কর প্রত্যর্পণ,
ভীরু তুমি, পথে দৈত্য করিবে হরণ।”

২২


ছায়ার দক্ষিণ হস্ত মুকুট ধরিল,
বাম হস্ত রাজ দণ্ডে আসি পরশিল,
সভয়ে চীৎকার করে, পড়িনু শ্মশানোপরে,
কতক্ষণ ছিনু তথা নাহিক স্মরণ,
নেত্র খুলি দেখি কক্ষে করিয়া শয়ন।

২৩


কল্পনা নাহিক পার্শ্বে প্রকোষ্ঠ নির্জ্জন
গগনে অজস্র ধারা হইছে পতন,

প্রাচীরে আলোক হাসে, মসী, পত্র পড়ি পাশে
শূন্যমনে কতক্ষণ বসিয়া রহিনু,
কতবার স্মরি চিতা শিহরি উঠিনু।

২৪


তদবধি কত রাত্রি গগনের গায়,
দেখিয়াছি সেই শব সর্জীব ছায়ায়,
ক্ষীণ হস্ত প্রসারিয়া, শবনেত্রে নিরখিয়া,
পরশিতে হস্ত মম শূন্যে নামি আসে,
অমনি নয়নদ্বয় মুদিয়াছি ত্রাসে।