চিত্ত-মুকুর/অভাগিণী
অভাগিনী।
১
আহা কি করুণ ছবি রমণি তোমার!
হায় কি কঠিন প্রাণ পোড়া বিধাতার!
নীলোজ্জ্বল এ নয়নে, ঝরে অশ্রু প্রতিক্ষণে,
সুধামাখা এ বদনে, রেখা যন্ত্রণার!
হেমোজ্জ্বল এ বরণে, ম্লানবেশ অযতনে,
ভস্ম আচ্ছাদিত মরি প্রতিমা সোণার!
নিরখি এ বেশ প্রাণ নাহি কাঁদে কার!
এখনো বালিকাবেশ, অনতি-কৌমার শেষ,
মৃণাল লাবণ্য দ্যুতি ঢল ঢল করে;
না জানি কেমন করে, বিধাতারে এ অন্তরে,
করিলে এ বজ্রপাত নিদয় অন্তরে,
স্থাপিলে রাহুর গ্রাসে পূর্ণ শশধরে!
ইচ্ছাকরে বরাঙ্গনে, তুলে লই সযতনে,
মলিন এ দেহখানি পরম আদরে,
মুছাইয়া দিই অশ্রু পবিত্র অন্তরে।
২
নিদারুণ শাস্ত্রকার কোথা এ সময়,
দেখ না বারেক আসি রমণী-হৃদয়,
বসি যবে নিরজনে, ঝরে অশ্রু দুনয়নে,
দেখ্রে সমাজ তার করুণ বদন,
কোমল অন্তর তার, কত পোড়ে অনিবার,
নিদারুণ পিতা মাতা কর দরশন,
হায়রে দুখির দুঃখ বুঝে কোন জন্!
এস তুমি অনাথিনী, আমি তব দুঃখ জানি,
কহনা দুখের কথা আমার সদনে,
এস সখি তুমি আমি কাঁদি দুই জনে;
গগন বিদীর্ণ করে, এস কাঁদি তার স্বরে,
দেখ যদি পশে উহা বিধির শ্রবণ,
অথবা অন্তর খুলে, দগ্ধ প্রাণ করে তুলে,
দেখাও যন্ত্রণা তব-সমাজ তখন,
বুঝিবে অবলা সহে যতেক বেদন।
৩
চির অনাথিনী করি রমণী তোমারে,
সৃজিয়াছে বিধি সুধু কাঁদিবার তরে,
সোণার বরণে তাই, ঢালিয়া দিয়াছে ছাই,
আঁধারিয়া যৌবনের নন্দনকানন,
সুধুই নয়নজল, বরষিতে অবিরল,
এ কুরঙ্গ আঁখি তব হয়েছে সৃজন,
নির্ম্মল শশাঙ্কে হায় কলঙ্ক লেপন!
যৌবন উজ্জ্বল করে, পূর্ণবিম্ব এ অধরে,
সৃজিয়াছে সুধু হায় বিষাদের তরে,
রমণীরে ও অধরে, বিষাদের চিহ্ণ ধরে,
এসোনা এলোনা আর আমার সদনে,
এ করুণ ছবি তব সহে না পরাণে;
সখি মোর মাথা খাও, বিষাদে বিদায় দাও,
ফেটে যায় বুক মরি হেরি ও বয়ানে!
কুসুমে অশনিপাত বড় বাজে প্রাণে!
8
কি সান্ত্বনা দিব আর রমণি তোমায়,
এ অনল শিখা তব নিবিবার নয়,
কাঁদ অয়ি বিষাদিনি, কাঁদ অয়ি অনাথিনি,
হেরিয়া বিদীর্ণ হোক হৃদয় আমার,
এমন নিষ্ঠুর দেশে, এরূপ মধুর বেশে,
কেন জন্মেছিলে তুমি সুধা-নিস্যন্দিনি!
মরুভূমে বাঁচে কভু মৃণাল-নন্দিনী।
এই যদি ছিল মনে, পোড়া বিধি কি কারণে,
এত রূপ দিল ঢালি তোমার বদনে,
অতি কুরূপিনী করে, কেন রাখিল না তোরে,
বিষাদের চিহ্ন তায় মিশায়ে থাকিত,
আঁধারে তিমির আভা লুকায়ে রহিত;
দেখি সে মলিন মুখ, হইত না এত দুখ,
সেনয়নে অশ্রু হেরি কাঁদিত না মন,
কেন তুমি রূপবতী হইলে এখন!
৫
চির অভাগিনী যদি কেন তবে আর,
অকারণ হেন বেশ রমণি তোমার,
খুলে ফেল এ বসন, খুলে ফেল এ ভূষণ,
লুকায়ে রূপের ছটা সাজ বিষাদিনী,
গেরুয়া বসন দিয়ে, চারু তনু আবরিয়ে,
খুলিয়ে চিকুর দাম সাজ সন্ন্যাসিনী,
এ ঘন লাবণ্যে দাও ভস্মের লেপনী;
ত্রিশূল ধরিয়া করে, লেখ তায় স্পষ্টাক্ষরে
“পতিসুখ কাঙ্গালিনী বঙ্গের দুঃখিনী।”
নয়নে ঝরুক জল, শুকাক বদনতল,
গভীর ঝঙ্কারে গাও “আমি অনাথিনী”
রাজরাণী হয়ে মরি সাজ ভিখারিণী।
কমণ্ডলু ধরি করে, বঙ্গবাসী দ্বারে দ্বারে,
কাঁদিয়ে শুনাও তব দুঃখের কাহিনী,
দেখ যদি জাগে তাহে নিদ্রিত অবনী।