উদাসীন।


পাষাণে বাঁধিনু প্রাণ তবু কেন মন
নিরন্তর অনিবার হয় উচাটন?
বিসর্জ্জিনু স্মৃতিচিহ্ন বিস্মৃতির জলে
তথাপি অন্তর কেন পুড়িছে অনলে?

আইনু সন্ন্যাসী হ’য়ে দূর দেশান্তরে,
হায় রে সে সব পুন কেন মনে পড়ে!
সেই ত উদাস মন সেই সে যাতনা,
সেই সে নীরস আঁখি অতৃপ্ত বাসনা।
কোথায় সে সুখ এবে যাহার আশায়,
ছিঁড়িলাম জীবনের সন্তোষ-লতায়।
মায়া মোহ স্নেহ প্রেম করিরা বর্জ্জন,
এই কি হইল শেষ অশ্রু বিসর্জ্জন।
কেন আঁখি ফেল বারি কেন কাঁদ মন?
বারেক ভুলিতে দাও এ ঘোর বেদন।
ওই দেখ শ্বেত আভা গগনের গায়,
নীরবে গোধূলি সনে কেমন মিশায়।
শান্তি নিকেতন ওই প্রাচীন বিটপী,
কত সুগম্ভীর ভাবে শোভিছে অটবী।
এই শুন ঝিঁ ঝিঁ ডাকে জগত ঘুমায়,
নীরব উদ্যান কত সুগম্ভীর তায়!
কেমন গোধূলি ছায়া চারি দিকে ভাসে,
এ শোভা হেরিয়া তবু নেত্রে অশ্রু আসে!
আবার ঝরিল অশ্রু—কোথা ভগবান,
নিবাও এ স্মৃতি-শিখা করুণা নিধান।

অন্তরে শ্মশান লয়ে কত কাল হায়,
ভ্রমিব উদাস হয়ে জীবের ধরায়।
প্রতিশ্বাসে অগ্নি শিখা হয় উদ্গীরণ।
প্রত্যেক পলকে পোড়ে যুগল নয়ন।
একি লীলা পিতা তব, সহে না বেদনা
রাখ তব দেব-খেলা,—নিবাও যাতনা।
এখনি নিতে পারি মনের অনল,
পরকাল ভাবি নাথ ডরাই কেবল।
এস পিতা, লহ হরি বারেক চেতন,
ভুলি এ ভবের কথা জুড়াই জীবন।
ভুলি জন্মভূমি—হায় জাগিল আবার,
সংসারের চিত্রপট হৃদয়-মাঝার।
নমি মাতঃ! পদযুগে, জীবিত এখন,
পামর মানবকুলে তব কুসন্তান।
আসিয়াছি দেশান্তরে তবু কাণে শুনি,
সেই স্নেহ স্রোতস্বিনী সুমধুর ধ্বনি।
নীরব নিশীথে কভু গভীর স্বপনে,
ভাসে তব প্রতিমূর্ত্তি মুদিত নয়নে।
সুখের শৈশব হায়, এখনো স্মরণ,
সেই ক্রোড় সে আদর স্নেহের চুম্বন!

গভীর ত্রিযামা নিশি নীরব ভুবন,
শয্যার কোমল ক্রোড়ে করিয়া শয়ন
থাকিতাম। তুমি মাত! শুভ্র বাতি করে,
দেখিতে আমায় ধীরে প্রবেশিতে ঘরে।
ভাবিয়ে সুসুপ্ত হায় কতই যতনে,
আদরে প্রগাঢ় স্নেহে চুম্বিতে বদনে।
ফুরাল সে দিন, পুন উদিল যৌবন,
বাড়িল সে সঙ্গে তব আশা আকিঞ্চন।
কেন মা জননী হয় কেন এ সন্তানে,
তুষিলে পাযূষ দানে তেমন যতনে।
নিষ্ঠুর মানব আমি পামর সন্তান,
ভাল প্রতিশোধ তার করিলাম দান।
এখনো কি ঝরে মত! নয়নে তোমার,
অন্তর বিদীর্ণ হয়ে শোকের আসার!
এখনো কি পূজ নিত্য ইষ্ট দেবতায়,
সন্তানের সনাতন মঙ্গল আশায়?
জানি আমি চিরদিন ঝরিবে নয়ন,
চিরদিন ইষ্ট দেব করিবে অর্চ্চন।
দিবা সন্ধ্যা দীর্ঘ শ্বাসে বাড়িবে হুতাশ,
তবু ত্যজিবে না মাত! আমার প্রয়াস।

কিন্তু হায় এ পামর নির্ম্মম হৃদয়,
করুণা পরশে আর দ্রবিবার নয়।
পাষাণে বেঁধেছি প্রাণ পাষাণ রহিব,
এই তরুতলে বসি একাকী কাঁদিব।
হইবে গভীর নিশি দূরে ঝিঁঝিঁরব,
আঁধারে ডুবিবে বিশ্ব জগত নীরব।
এই শুষ্ক তৃণদলে করিয়ে শয়ন।
খুলিয়ে প্রাণের দ্বার করিব রোদন।
কত যে গভীর সুখ এ হেন রোদনে,
কেঁদেছে যে এক বার সেই জন জানে।
আবার উদিলে শশী উঠিয়া বসিব,
হেরি সুললিত শোভা আপনি হাসিব।
শাখায় ফুটিবে ফুল লতায় কমল,
নাচিবে মলয়ে ধীরে নব পত্র দল।
গাহিবে কোকিল দূরে ছুটিবে সুস্বর,
মধুর সঙ্গীত-স্রোতে প্লাবিবে অন্তর।
কিন্তু নিরন্তর মাত! অন্তর তোমার,
বিষম বিষাদ তাপে হইবে অঙ্গার।
অসহ্য এ চিন্তা, বিভু হউন সহায়,
ভুলি জননীর দুখ ভুলিব তাঁহায়।

 পুনঃ তুমি! এস প্রিয়ে বহু দিন পরে,
সম্বোধি বারেক আজ প্রণয়ের ভরে।
ললিত লবঙ্গ-লতা কোমল গঠন,
সলাজ প্রণয়-পূর্ণ যুগল নয়ন।
হাস্য-বিকসিত মুখ প্রভাত-নলিনী,
ভালবাসা-স্রোতস্বিনী প্রণয়ের খনি।
বসন্ত-কুসুম এই নবীন যৌবন,
লজ্জা-প্রেম-বিগলিত অপূর্ব্ব গঠন।
কোন্ শিব পূজি প্রিয়ে পেয়েছিলে বর,
তাই সে লভিলে পতি নিষ্ঠুর পামর?
হেরিতে আমার পানে সজল নয়নে,
অন্তরের দুখ যেন তুলিয়া বদনে।
চাহিলে তোমার পানে লজ্জায় বদন,
নত করি লুকাইতে মনের বেদন।
কাঁদিয়াছি কত দিন হইয়া নির্জন,
তাহাও গোপনে থাকি করেছি শ্রবণ।
তবু মুহূর্ত্তের তরে করিয়ে যতন,
করি নাই প্রেম-ভরে হৃদয়ে স্থাপন।
দেখিতাম শুনিতাম প্রেয়সি সকল,
ভাবিতাম কাঁদিতাম অন্তরে কেবল।

ভাবিতে পাগল পতি প্রাণের সরলা,
বুঝিতে নারিতে প্রিয়ে অন্তরের জ্বালা।
ভালবাসি না হায় ছিল যদি মনে,
কেন বান্ধিলাম তোরে উদ্বাহ বন্ধনে।
আঘ্রাণ করিতে যদি নাহি ছিল মন,
কেন তুলিলাম হেন কানন-প্রসূন?
পরিব না গলে যদি হেন রত্ন-হার,
কেন গাঁথিলাম মাল্যে এ প্রেম-ভাণ্ডার।
তুষিব না যত্নে যদি আছিল অন্তরে,
স্বাধীন বিহঙ্গ কেন বাঁধিনু পিঞ্জরে?
ছিল শোভি বনরাজি ফুল্ল সরোজিনী,
সৌরভে পূরিয়া বন বিশ্ব-বিনোদিনী।
হেরি কোন ভাগ্যবান উন্মত্ত নয়নে,
লইত হৃদয়ে তুলি পরম যতনে।
রাজার উদ্যান কিম্বা ধনীর আগারে,
ফুটিয়া থাকিত সদা আনন্দের ভরে।
অনন্ত দুখিনী কেন করিলাম হায়,
নব অঙ্কুরিত চারু প্রেম-লতিকায়।
ভুলেছি অনেক, ক্রমে ভুলিব সকল,
ভুলিতে নারিব কিন্তু তোমায় কেবল।