চিত্ত-মুকুর/সলিল প্রতিমা
সলিল-প্রতিমা।
১
সুন্দর নিদাঘ-সন্ধ্যা শান্ত নভস্তল,
শ্যামাঙ্গিনী যমুনার হৃদয় নির্ম্মল,
বহে মৃদু সমীরণ, নদী-বক্ষ নিরজন,
একা ভাসি তরি’পরে তরঙ্গিণী-জলে,
শূন্যময় দুই তীর সুধু তরি চলে,
শূণ্য দৃষ্টি শূন্য মন, তবু করি দরশন,
নয়ন নদীর জলে অন্তর কোথায়!
ক্ষেপণির মৃদু রব শ্রবণে মিশায়।
সলিল-আবর্ত্ত হৈরি, যায় ছুটি ঘূরি ফিরি,
আবার অনতিদূরে সলিলে মিশায়
অস্তমান ভানু-ছবি নাচিয়া বেড়ায়।
২
সহসা একটি ছবি সলিল-হৃদয়ে
দেখিনু মানস-নেত্রে রয়েছে মিশায়ে;
মলিন বিজলি-মত, ভস্ম মাখা মরকত,
ছিন্ন লতা কিম্বা যথা তপন কিরণে
হতাশ আয়েষা কিম্বা বঙ্কিম-কল্পনে।
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছোটে, নয়নে তরঙ্গ ওঠে,
বিষাদের জ্যোতি ফোটে নীরব বদনে,
একখানি ফটোগ্রাফ হেরিছে সঘনে।
কখন চুম্বন করে, কভু রাখে বক্ষোপরে,
সতৃষ্ণ নয়নে পুনঃ করে দরশন।
নিরখি অন্তর হ’ল বিষাদে মগন।
৩
অচেতন কাণে পুনঃ করিনু শ্রবণ
সলিল-প্রতিমা মুখে করুণ বচন౼
“কত সাধ কত আশা, কত প্রেম ভালবাসা,
প্রাণেশ্বর নিরন্তর রেখেছি অন্তরে,
বারেক তোমায় যত্নে দেখাবার তরে;
সুচিকন পুষ্পহার, গাঁথিয়াছি কতবার,
দোলাইতে তব গলে—কতই যতনে
কবিতা লিখেছি কত মনের বেদনে।
অশ্রুমুখে বিধাতায়, ডাকি সদা কত হায়,
বধির বিধাতা নাথ আমার কপালে”
পূরিল যুগল আঁখি পুনঃ অশ্রুজলে।
8
“কেন উদাসীন নাথ কি দুঃখ অন্তরে
বারেক হৃদয় খুলে কই না আমারে
নবীন বয়সে হেন, উদাসীন বেশে কেন,
ত্যজি গৃহ পরিজন, ভ্রম দেশান্তরে?
একবার বল নাথ দুখিনী কান্তারে।
এতই বেদনা যদি, কেন দূরে নিরবধি,
এস কাছে প্রাণেশ্বর কাঁদি দুই জনে।
মুছাইব অশ্রুজল অঞ্চল বসনে
ধন নাই— দুখ তাই, ধনে প্রয়োজন নাই।
উভয়ে পরম সুখে রব তরুতলে”
পূরিল খুগল আঁখি পুন অশ্রুজলে।
৫
“এস নাথ বড় সাধ কাঁদিব দুজনে
হেরিব সে স্লান মুখ সজল নয়নে,
বদনে বদন রাখি, তব অশ্রুজল মাখি,
ঘুমাব হৃদয়ে পড়ি ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলি,
কোথা রবে দুখ—নাথ সব যাবে ভুলি।
ভিখারিণী-বেশ ধরে প্রমিব হে দ্বারে দ্বারে,
আপনি খাওয়াব হাতে, সেবিব যতনে;
ভুলাইব নাথ তব মনের বেদনে।
অন্য দুখ থাকে মনে, তাও নাথ প্রাণপণে,
ঘুচাতে সেবিব পদ দিবাদণ্ড পল
এস নাথ একবার নিকটে কেবল।”
৬
কাঁদিল পরাণ শুনি রমনী-রোদন
কাঁদিল নয়ন হেরি রমনী-রতন!
যতনে আদর করে, জিজ্ঞাসিনু স্নেহভরে,
“কে তুমি দুখিনী ভাস সলিল-শয়নে,
তুলিয়া শোকের সিন্ধু পঙ্কজ-বদনে?
অস্ফুট মুকুল হায়, এ গভীর প্রেম তায়,
কে তুমি সরলে, বল কোন ভাগ্যবান
এ অমৃত স্রোতে সদা যুড়ায় পরাণ?”
মুছিয়া নয়নজল, ফুলায়ে বদন তল,
কহিল কাঁপায়ে দুটি চারু ওষ্ঠাধর
“আমি অভাগিনী নাথ তুমি প্রাণেশ্বর”