চিত্ত-মুকুর/স্বপ্ন প্রতিমা
স্বপ্ন প্রতিমা।[১]
১
ভাঙ্গিল নিদ্রার ঘোর খুলি নয়ন
এ ত সেই কক্ষ, কিন্তু কোথা সে স্বপন।
মুদিনু নয়ন পুন,
যদি পাই দরশন,
হা! পোড়া কপাল নিদ্রা আসিল না আর।
কোথা স্বপ্ন কোথা আমি সে প্রতিমা কার।
২
বিষাদে নিশ্বাস ত্যজি গবাক্ষ-সদনে
বসিনু কাতর মনে চাহিয়া গগনে।
সুদূর গগন-কোলে।
শশাঙ্ক পড়েছে ঢলে,
বিদায়ের ম্লান হাঁসি নিশির অধরে,
নিষ্প্রভ তারকা গুলি ডুবিছে অম্বরে।
৩
সহসা স্মৃতির দ্বার হইল মোচন,
আবার ভাসিল মনে সে সুখ স্বপন।
চুর্ণ শশীৱাশি করে
রমণীর মূর্ত্তি গড়ে
দেখাইয়া ছিল স্বপ্ন যেই প্রতিমায়,
দেখিনু মানস-নেত্রে গগনের গায়।
৪
সুধামাখা সেই হাসি ফুটন্ত অধরে,
সুটানা নয়নে মরি সেই দৃষ্টি ঝরে,
সেই নাশা সেই ভুরু
সে উরস সেই ঊরু।
অবিকল সেই মূর্ত্তি স্বপনে যাহারে
দেখিয়াছি মুগ্ধ নেত্রে, উন্মত্ত অন্তরে।
৫
বিস্মিত নয়নে তারে হেরি বার বার
চিনিতে নারিনু তবু সে প্রতিমা কার
হাসিয়া অঙ্গুলি তুলি
ঈষৎ উত্তরে হেলি
প্রতিমা দেখায়ে দিল বিচিত্র কানন।
পশিল শ্রবণ-মূলে “আছে কি স্মরণ।”
৬
“আছে কি স্মরণ?”—একি! অধিক বিস্ময়ে
আদিষ্ট উদ্যান পানে দেখিলাম চেয়ে।
সকলি স্বপনময়
প্রকৃতি ঘুমায়ে রয়,
তরুরাজি-কোলে এক চারু সরোবর,
সলিল হিল্লোল গুলি করে থর থর।
৭
সেই সরসীর ক্ষিপ্ত হিল্লোলের গায়,
বালক বালিকা দুটি ধীরে ভেসে যায়,
এক বৃন্তে বাঁধা যেন,
দুইটি কমল হেন,
পরস্পরে ধরি কর সন্তরণ করে,
“চেন কি এ দুই মুর্ত্তি?” শুনিনু অচিরে।
৮
চিনিব না কেন—হায়! কিন্তু কেন আর
শৈশবের সেই চিত্র নয়নে আমার!
ওযে সেই সরোবর
সেই তরু মনোহর,
সেই তীর—সে সোপান, বাল্য-ক্রীড়া স্থল,
চির পরিচিত মম ওই সে হিল্লোল।
৯
ওই মোরা দুই জনে, হায় রে সে দিন!
এখনো তেমতি নব—হয়নি প্রবীন,
বাল্য আনন্দেতে হেঁসে,
হিল্লোলে চলেছি ভেসে,
ওই সেই শিশু আমি, শিশু-বিনোদিনী,
শৈশব-হৃদয়ে মম প্রফুল্ল নলিনী।
১০
কোথায় সে দিন আজ! কোথায় দুজন
কোথা শৈশবের সেই প্রিয় আকিঞ্চন।
কালের ভীষণ স্রোতে
দুই জনে দুই পথে
বৃন্ত-চ্যুত এখনো সে ক্ষত বক্ষঃস্থল।
ডুবিয়া বিস্মৃতি-জলে হয়নি শীতল।
১১
নয়ন পালটি দেখি সে উদ্যান নাই।
সে সরসী সেই ছবি আর কিছু নাই।
চূর্ণ তুলারাশি প্রায়
শুভ্র জলদের গায়
কুমার কুমারী দুই করে কর ধরে,
দাঁড়ায়ে নিরবে—নেত্রে অশ্রুজল ঝরে।
১২
কুমারীর বধূ বেশ সজ্জিত ভূষণে,
কিশোর লাবণ্য ঢাকা কৌশিক বসনে,
দুই জনে পরস্পরে,
কাতর বদনে হেরে।
অকস্মাৎ চারুচিত্র মিশিল গগনে।
“চেনকি এ দুই জনে?” শুনিনু শ্রবণে।
১৩
চিনিব না! হায় মোর মর্ম্মের ভিতরে
আঁকা আছে ওই চিত্র চিরদিন তরে।
এই যে হতাশ মনে
দাঁড়াইয়া দুইজনে।
দুজনার দুই প্রাণ ভাঙ্গিতে উদ্যত।
কেন কর নেত্রে আর এ চিত্র স্থাপিত।
১৪
অকুল নৈরাশ্য-স্রোতে হতাশ অন্তরে,
ভাসায়ে দিয়েছি প্রাণ ওই করে ধরে,
হৃদয়ের গ্রন্থিচয়
একে একে সমুদয়—
ছিঁড়িয়াছি ওই দিন—হৃদয় আদিত্য
অস্ত গেছে ওই চিত্রে জনমের মত!
১৫
“এই বার দেখ চেয়ে” হৈল দৈববাণী,
অমনি ভাসিল নেত্রে সেই ছবিখানি।
“শৈশবের প্রাণেশ্বর,
দুখিনী বিনোদে ধর”
শূন্য হ’তে পদ-প্রান্তে পড়িল রমণী,
সহসা সুখের স্বপ্ন ভাঙ্গিল অমনি।
- ↑ কোন সুহৃদের অনুরোধে এই কবিতাটি লিখিত হয়।