চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ/প্রথম খণ্ড/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
বার
কবি জয়দেবের খ্যাতি দেখতে দেখতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লো।
প্রত্যেক পূজাপার্ব্বণে জয়দেব পুণ্য-সলিলা গঙ্গায় স্নান করতে যেতেন। দীর্ঘ পথ তাঁকে পায়ে হেঁটে যেতে হতো আবার দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ফিরতে হতো।
সেবার পৌষ-সংক্রান্তির পুণ্য দিবস সমাগত-প্রায়। জয়দেব প্রত্যেক বৎসর পৌষ-সংক্রান্তি-দিনে গঙ্গাস্নানের জন্যে যাত্রা করতেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেবার পৌষ-সংক্রান্তির আগের দিন শয্যাশায়ী হলেন। ভক্তের মনে নিদারুণ দুঃখ দেখা দিল। তাহলে কি এবার আর গঙ্গাস্নান হবে না? কাতরে গঙ্গাদেবীকে আহ্বান করেন এবং সারাদিন ধরে তাঁর স্তব করেন।
পৌষ-সংক্রান্তির প্রভাতে কেন্দুবিল্ব গ্রামের লোকদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অবাক হয়ে তারা দেখে, অজয়ের দুই কূল উপছে এসেছে বন্যা, অজয়ের শাদা জলে এসে মিশেছে গঙ্গার গৈরিক জল। পূর্ব্ববাহিনী স্রোত আজ কোন্ রহস্যময়ের ইঙ্গিতে পশ্চিমমুখী হয়ে ছুটেছে।
জয়দেব আনন্দে আত্মহারা হয়ে দেখেন, কদম্বখণ্ডীর ঘাটে বইছে গঙ্গার স্রোত-জল। উন্মাদের মতন সেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন, বলেন, অসীম করুণাময়ী মা, সন্তানের মিনতিতে আজ তুমি এলে বন্যারূপে তার কাছে। জয় মা পতিতপাবনী, মর্ত্ত্যসুরধুনী!
কদম্বখণ্ডীর ঘাটে গঙ্গার আগমন, হয়ত কিম্বদন্তী কিন্তু এই কিম্বদন্তী থেকে বোঝা যায়, কি প্রগাঢ় ছিল কবি জয়দেবের ভক্তি! তাঁর জীবনের সমগ্র কাহিনী আমাদের জানা নেই কিন্তু এই সব কিম্বদন্তী থেকে তাঁর চরিত্রের যে আভাস পাওয়া যায়, তা থেকে একথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পরবর্ত্তী যুগে শ্রীচৈতন্য বাংলাদেশে প্রেম ও ভক্তির যে নব-উন্মাদনা নিয়ে আসেন, তার স্পষ্ট লক্ষণ ফুটে ওঠে জয়দেবের জীবনে ও সাধনায়। জয়দেবের অলৌকিক প্রেম আর ভক্তি হলো মহাপ্রভুর অগ্রদূতস্বরূপ। তাঁর জীবন ও সাধনার ভেতর দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে সেই মহারূপান্তরের প্রস্তুতি দিয়ে গেলেন। গীতগোবিন্দে তিনি যে প্রেমের গান গাইলেন, সেই প্রেমকে জীবনে দিব্য সত্যরূপে ফুটিয়ে তোলবার জন্যেই এলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য।