চীন ভ্রমণ/চীন সমুদ্র
চীন সমুদ্র।
সিঙ্গাপুর হইতে হংকং সতেরশো ষাট মাইল দূর। তথায় পৌঁছিতে ছয় দিন লাগে। সিঙ্গাপুর হইতেই চীন সমুদ্র আরম্ভ হইয়াছে। হংকং হইতেও অনেক দুর অবধি এই চীন সমুদ্র বিস্তৃত; সুতরাং সারা পথই চীন সমুদ্রের উপর দিযা যাইতে হয়। যখন জাহাজ সিঙ্গাপুর হইতে ছাড়িয়া উওরমুখী হইল, তখন জাহাজের কর্ম্মচারীরা বলিতে লাগিলেন, এইবার বিষম পরীক্ষার স্থল আসিবে। আমার এই প্রথম সমুদ্রযাএা বলিয়া আমি ওসকল কথার তাৎপর্য্য কিছুই উপলব্ধি করতে পারিলাম না।
এক দিন বেশ গেলাম। সুনীল সমুদ্র,সে দিন ধীর স্থির। ছয় দিন ক্রমাগত যাইতে হইবে বলিয়া সকলেরই মন স্থির ছিল। জাহাজে চীনেম্যান ও অন্যান্য যাত্রীর ঠাসাঠাসি ভিড়। অনবরত দিনরাত নানা প্রকার চীনে লোক চোখের উপর থাকায়, তাদের কার্যাকলাপ, গড়ন পিঠন, রীতিনীতি সকলই বেশ করিয়া দেখিবার সুযোগ হইত এবং সামান্য বিষয়টি মনোযোগের সহিত দেখিতাম ও নোট বইতে লিখিয়া রাখিতাম।
নূতন নূতন নানাদেশ, নানা প্রকারের লোকজন দেখিয়া মনে আনন্দের আর সীমা থাকিত না। তারা আমাদেরই মত আহার বিহার করে দেখিয়া যেন নিকট আত্মীয় বলে মনে হতো। মনের যে অপ্রসন্ন ভাব এবং শরীরের যে অবসন্নতার জন্য সমুদ্রযাত্রা মনস্থ করিয়াছিলাম, তাহা দিন দিন অনেক কমিয়া যাইতে লাগিল। অগ্নিমান্দ্য ও অনিদ্রা যাইয়া বেশ ক্ষুধা ও সুনিদ্রা হইতে লাগিল। যে সকল সহযাত্রীর সহিত অনবরত মিশিতাম, তাঁহারা কত দেশ বেড়াইয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে কত ধনী সওদাগর ছিলেন। কেহ কেহ বা ভ্রমণকারী কর্ম্মচারী, বহু দিন ধরিয়া ও অঞ্চলের সকল দেশে ঘুরিতেছেন। কোন্ জিনিষের কোথায় কত দাম, কোন্ দ্রবা কোথা কত সস্তায় উৎপন্ন হইতে পারে, কিরূপ বস্তু কোথায় আবশ্যক, ইত্যাদি সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আজীবন দেশে দেশে ফিরিতেছেন। অর্থোপার্জ্জন কি সহজে হয়? তাঁহাদের সহিত সদা সর্ব্বদা বসিয়া সেই সকল বিষয়ের ও নানা দেশের কথাবার্ত্তা হইত। তাহার মধ্যে অনেক ধনী চীনে সওদাগর ও অপর ধনী লোকও ছিলেন। চীনেরা ইউরোপীয়ানদের সহিত সমকক্ষ হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করিতেছেন। খুব কম লোকই চাকরীর জন্য লালায়িত। তাঁহারা সবাই অল্প-বিস্তর ইংরাজী জানেন। তাঁহাদের নিকট হইতে তাঁহাদের দেশ ও তথাকার আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে অনেক খবর পাইতাম। জাপানী,ইহুদী,পার্শী,ইউরোপীয়ান ও আমেরিকান ভদ্র স্ত্রী-পুরুষ ও অনেক ছিলেন। সুতরাং জনতাপূর্ণ সহরে থাকিলে যেমন সঙ্গীর অভাব হয় না, জাহাজেও সেইরূপ বেশ আনন্দই সময় কাটিত।
তখন শুক্ল পক্ষ। যে দিন জাহাজ ছাড়ে, তার পর দিনই পূর্ণিমা। সন্ধ্যা ৭ টার সময় ডিনার হইত। তার পর সকলে ডেকের উপর আরাম-কেদারায় বসিয়া নির্ভাবনায় জোৎস্নাপুলকিতা শুভ্র-যামিনীর সৌন্দর্য্য দেখিতাম ও উন্মুক্ত নির্ম্মল বায়ু সেবন করিতাম। নীল সমুদ্রজলের উপর শ্বেত ফেনপুঞ্জ যেন কিশলয়ের উপর রাশীকৃত ফুলের মত মনে হইত। এখানকার লোণা জল রাত্রিতে জোনাকের মত জ্বলে। স্থির সমুদ্রে জাহাজ যখন ঈষৎ দোলে, তখন বড়ই আরাম বোধ হয়; মনে হয়, আস্তে আস্তে ঘুম পাড়াবার জন্য কে যেন কোলে করিয়া দোলাইতেছেন।
কিন্তু সেই পূর্ণিমার নিশায় পশ্চিম আকাশে মেঘ উঠিল; বায়ুও জোরে বহিতে লাগিল; জাহাজও বেশী বেশী দুলিতে লাগিল পরে আর ডেকে থাকা গেল না। ক্যাবিনে যাইয়া শুইলাম। পরদিন প্রাতে উঠয়া দেখি, প্রকৃতির শান্তময়ী মূর্ত্তি একবারে পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে। সমুদ্রবক্ষ অদ্য তেমন স্থির নাই, তরঙ্গমালায় পরিপূর্ণ। জাহাজ আর আগেকার মত মৃদুমন্দ দোলে না, -ভীষণ বেগে ও তরঙ্গের উপর উঠিতেছে ও পড়িতেছে। ডেকের উপর নিরুদ্বেগে বসিবার যো নাই, হাওয়ার এমনই জোর। তরঙ্গগুলি বিষম বেগে জাহাজের গায়ে আসিয়া প্রতিহত হইতেছে। সে শব্দও অতি ভয়াবহ।
ক্রমে জাহাজ যতই উওর দিকে অগ্রসর হতে লাগিল, হাওয়ার জোর ও তুফান ততই বাড়িতে লাগিল। আরও এক দিন যাওয়ার পর দেখিলাম, আকাশ বাতাস ও সমুদ্রের অবস্থা এরূপ হইয়াছে যে, ডেকে আসা দূরে থাকুক, খাড়া হইয়া দাঁড়ান ও চলা পর্যন্ত অসম্ভব হইল। এক একটি ঢেউ পঞ্চাশ ষাট ফিট উচু। ইহার উপর জাহাজখানি উঠিতেছে ও পরক্ষণেই সজোরে পড়িতেছে।জাহাজের এপাশ হইতে ওপাশ ধৌত করিয়া ঢেউ চলিয়া যাইতেছে। ঢেউয়ে কতকগুলি আহারর জন্য রক্ষিত ভেড়া ভাসাইয়াই লইয়া গেল। জল ঢুকিবে বলিয়া কেবিনের ক্ষুদ্র জানালাও বন্ধ করা হইল। সেখানে থাকিলে গরমে ও বমির উদ্বেগে বিশেষ কষ্ট হয়। এরূপ স্থলে অনেকেই দ্বিতীয় শ্রেণীর বৈঠক-কুঠরীতে গিয়া আশ্রয় লয়। জাহাজের মধ্যস্থলে অবস্থিত বলিয়া সেই স্থানটি সর্ব্বাপেক্ষা কম দোলে। পিছনের প্রথম শ্রেণীতে সে সময়ে অবস্থিতি করা অতি কষ্টকর। তাই আজকালকার নুতন ফ্যাসানের অনেক জাহাজে প্রথম শ্রেণী মাঝেই অবস্থিত।
সমুদ্রের এরূপ ভীষণ অবস্থায় যাহা ঘটিয়া থাকে, তাহাই ঘটিতে লাগিল। সকলেই, বিশেষ নূতন সমুদ্রযাত্রীরা সামুদ্রিক পীড়ায় কাতর হইতে লাগিল। স্ত্রীলোকেরা প্রথমে আহার ছাড়িলেন ও শয্যাশায়িনী হইলেন। সকলেই প্রায় অল্প-বিস্তর পীড়াক্রান্ত হইলেন। কেহ উঠে না, চলে না, নিজ স্থান ছাড়ে না, –যেখানে সেখানে বমি করে। যখন তখন বমির শব্দ; কেবল কষ্টপ্রদ বমির চেষ্টামাত্র,— উঠে অতি কম। প্রথম শ্রেণীর খাইবার ঘরে ৩৩ জনের আসনের এগারটি মাত্র আসন ভর্ত্তি, তার মধ্যে ৭ জন জাহাজের উচ্চ কর্ম্মচারী অভ্যস্ত বলিয়া তাঁদেরই কেবল সামুদ্রিক পীড়া হইল না। অন্য সকলেই অল্প-বিস্তর ভুগিল। আর লেখক নিজে কাতর হইয়া একেবারে নিরম্বু উপবাসে প্রায় তিন দিন পড়িয়ছিলেন। সে যাতনার কথা বর্ণনা করা যায় না। তবে অল্পদিনেই তাহা সহ্য হইয়া যায়,তাই রক্ষা; নইলে সমুদ্রযাত্রা অসম্ভব হইত।
সামুদ্রিক পীড়া আরম্ভের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তুর চীনেম্যান যাত্রী মারা যাইতে লাগিল। প্রত্যহ দুই একটি করিয়া মৃতদেহ সমুদ্রবক্ষে ফেলিয়া দেওয়া হইত। আশ্চর্য এই যে,চীনেম্যান ছাড়া অন্য জাতীয় যাত্রী একটিও মরিল না। তাঁহার কারণ পূর্ব্বেই আভাসে বলিয়াছি। চীনেম্যানদের মধ্যে হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব বড়ই বেশী। তাদের হৃদযন্ত্র বড়ই দুর্ব্বল। অহরহ বমির বেগ তাহাদের দুর্ব্বল হৃদয় সহ্য করিতে না পারায় হঠাৎ মৃত্যু ঘটিত। দেখা যাইত, কেহ বা আপনার কাপড়ের সিন্দুকের উপর শুইয়াই মারিয়া আছে, কেহ বা দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়াই শেষ হইয়া গিয়াছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বৃদ্ধ,—সারা জীবন বিদেশে খাটিয়া অর্থ উপর্জন করিয়া বাড়ী যাইতেছিল;নিজের দেশে মৃত্যু চীনেম্যানের বড়ই প্রার্থনীয়; দেশের উপর তাদের এতই ভালবাসা। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের উপর অনেকেরই তত ভালবাসা নাই। গৃহ-পালিত পশুর মধ্যে দুই শ্রেণীর জন্তু দেখা যায় কুকুর ও ঘোড়া মানুষ চেনে,—আবাস-স্থানের উপর তত বেশী অনুরক্ত নহে। প্রভু যেখানে যায় অকাতরে অনুগমন করে। কিন্তু গরু বিড়ালের ব্যবহার অন্যরূপ। তাহারা ঠাঁই চেনে, লোক তত চেনে না। গৃহ অধিবাসী শূন্য হইলে তাহারা সেই খানে থাকিতে ভাল বাসে। চীনেরা এ হিসাবে দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। তাই স্বদেশপ্রিয় হইলেও ভাই মরিলে ভাই কাঁদে না। তাহার দুরবস্থায় অর্থ সাহায্য করিতে চাহে না। ইহার কারণ পরে বলিব।
অতি দুর্ব্বল ব্যক্তি বা হৃদরোগগ্রস্ত রোগীর পক্ষে চীন সমুদ্রের মত ভীষণ সমুদ্রে হাওয়া খাইতে যাওয়া বড়ই ভয়ের কথা। অতিশয় বমির বেগে মৃত্যু ঘটা কিছুই আশ্চর্য নয়। আমাদের জাহাজে কিন্তু বায়ুপরিবর্ত্তনের জন্য সমুদ্রযাত্রা করিতেছেন, এমন অনেকগুলি রোগীও ছিলেন। কেহ বা বাতের জন্য, কেহ যক্ষাকাসের জন্য, কেহ অনেকদিন রোগে ভুগিয়া শরীর সারিবার জন্য বেড়াইতে যাইতেছিলেন। তাঁহারা প্রায় সকলেই অতি অল্পদিনেই বিশেষ উপকার পাইয়াছিলেন। শান্ত সমুদ্রযাত্রার মত শরীরের অমন উপকার আর কিছুতেই হয় না। তবে আমাদর জাতির অসুবিধার মধ্যে আহারর একটি মহা অসুবিধা ঘটে। কেবল মাংস অরুচিকর ও অসহ্য হইয়া উঠে; উহা সুসিদ্ধ হয় না বলিয়া স্বাস্থের পক্ষে অপকারও হয়। নিরামিষ আহারের মধ্যে ভাত,পাউরুট্,বিস্কু্ট,মাখ্ন,জ্যাম ও ফল পাওয়া যায়; কিন্তু কোনরূপ তরকারী নাই। কৌটার দুধ ছাড়া অন্য দুধ নাই। তবে নিরামিষ আচার দিয়া ভাত খাওয়া চলিতে পারে।
চীন সমুদ্র অতি বিপদসঙ্কুল স্থান। যে কারণেই হউক, চীন সমুদ্রে বার মাসই অল্প-বিস্তর তুফান হয়। কিন্তু বৎসরের এই সময়,অর্থাৎ নভেম্বর হইতে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ইহা অতি ভয়ানক। সমুদ্র এরূপ তুফান ও তরঙ্গ-সমাকুল হওয়ার কারণ, মৌসুম পরিবর্ত্তন। যখন বঙ্গাপসাগরে মৌসুম পরিবর্ত্তনের সময় তুফান হয়, চীনসমুদ্র তখন কতকটা শান্ত থাকে; কিন্তু এই কয় মাস অহরহ অতি প্রবল বাতাস ক্রমাগত একদিক- অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব্ব দিক হইতে বহিতে থাকে বলিয়া এরূপ তুফান হয়। এরূপ সময়ে জাহাজ উলটে যাওয়া বা ডুবে যাওয়ার কোনও ভয় নাই। প্রধান ভয়, পাছে জাহাজ ঢেউয়ে উঠিবার ও নামিবার সময় তাহার হা'ল ভাঙ্গিয়া যায়। হা'ল ঘুরিলে জাহাঞ্জের গঠিত হয়; উহা ভাঙ্গিয়া গেলে জাহাজ অনন্যেপায়। সমুদ্রে এত ঢেউ খে, তাহা আর সেস্থলে মেরামত হইবার উপায় নাই; জাহাজ ডুবিলে হালকা বোটে করিয়া পালাইবার যো নাই। সে ঢেউয়ে,যে তুফানে,সে বোটও ডুবিয়া যাইবে। জলে অসংখ্যা হাঙ্গার; মানুষ পড়িলেই গিলিয়া ফেলে। আর একটী প্রধান ভয়, চীন-সমুদ্রে বিস্তর নিমজ্জিত চড়া আছে।
গভীর সমুদ্রের জলের রঙ সাধারণত; ঘোর নীল; কিন্তু এখানে অনেক স্থানে হরিদ্রাভ; তার কারণ, জলের নীচে বালুকাময় চড়া। এই কারণেই চীন সমুদ্রের নিকটবর্ত্তী হোয়াংহো সমুদ্রের অর্থ হলদে সমুদ্র। নিমজ্জিত চড়াগুলিতে লাগিলে জাহাজ ফুটা হইয়া যায়। আমরা যখন যাইতেছিলাম তখন “ষ্ট্যানলী” নামক লগুনের কোন জাহাজ রাণ্ড খনির জন্য পাঁচ হাজার চীনে কুলি লইয়া যাইতে যাইতে ঐরূপ একটীি চড়ায় লাগিয়া ফুটা হইয়া যায়। সমুদ্রের মাঝে নিকটবর্ত্তী একটি পাহাড়ে যাত্রীগুলিকে নামাইয়া দিয়া ও মালপত্র সব সমুদ্রজলে ফেলিয়া দিয়া মেরামতের জন্য জাহাজ খানি নিকটবর্ত্তী বন্দরে চলিয়া গেল; অন্য জাহাজ আসিয়া সেই সকল লোকের প্রাণ বাঁচাইল। সে জাহাজ খানিকে ভগ্ন ও খালি অবস্থায় ফিরিবার কালে আমরা স্বচক্ষে দেখিলাম। দেখিয়া জাহাজ শুদ্ধ লোকের আতঙ্কের পরিসীমা রহিল না।
চীন সমুদ্রে আর একটা বিপদের কারণ,—“টাইফুন” নামক এক প্রকার ঘূর্ণী ঝড়। জাহাজ তাহাতে পড়িলে আর রক্ষা নাই। জাহাঙ্গ প্রবল ঘুণী বায়ুবেগে চূর্ণ বিচুর্ণ ও উর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত হইয়া ডুবিয়া যায়। কখন কখন এরূপ সময়ে জলস্তম্ভও উৎপন্ন হয়। তাহা ধীরে ধীরে এক ধারে অগ্রসর হইতে থাকে। জাহাজ তাহাতে পড়িলে আর বাঁচাইবার উপায় নাই। এমন কি জাহাজ হইতে আধ মাইল দূরেও যদি জলস্তম্ভ আপনি ভাঙ্গিয়া যায়, তাহা হইলেও জাহাজ বিপদগ্রস্ত হয়। এই কারণে জলস্তম্ভ দেখিলেই দূর হইতে গোলা মারিয়া তাহাকে ভাঙ্গিয়া দিতে হয়। সেই জন্য এবং অন্যান্য কারণে জাহাজে কামান থাকে। যখন নিজে উত্থানশক্তিরহিত হইয়া পড়িয়া থাকিতাম, তখন এই সকল কথা মনে আসিত ও এই সকল ভয়ের দৃশ্য অহরহ মনশ্চক্ষুর সামনে জাগিয়া উঠিত। তখনই মনে হইত, এতে সব আত্মীয় বন্ধুর নিষেধ না শুনে একপ বিপদসঙ্কুল স্থানে জেদ ক’রে এসে ভাল কাজ করি নাই। আবার দুই তিন দিন বাদে যখন সব কষ্ট দূর হ’ল, তখন সে সব যন্ত্রণার কথা ভুলে গোলাম।
এরূপ তুফানেও চীনেম্যানেরা চাইনিজ 'জাঙ্কে' ও বড় বড় চীনে বজরা ক’রে সমুদ্রে মাছ ধরিতে যায়। সেগুলি খুব বড় নৌকা, কেবল পাশ গুলি খুব উচু ও সামনের ও পিছনের গলুই অন্য নৌকার মত সরু না হ’য়ে চেপ্টা। নৌকায় তিনটি মাস্তুল আছে। সেই মাস্তুলগুলিতে পাল তুলে দিলে নৌকা চলে। ঐ নৌকা এরূপ ভাবে গঠিত ও এমন সুদক্ষ ভাবে পরিচালিত যে, অমন সমুদ্রে, অত তুফানেও তাহা ডুবে না। চীনদেশে অর্থোপার্জ্জন করা এত কষ্টকর যে, প্রাণের মমতা একেবারে ত্যাগ ক’রে চীনের এইরূপ অতি ভীষণ চীন সমুদ্রে সপরিবারে মাছ ধরিতে যায়। সপরিবারে কেন বলিলাম, সে কথা পরের প্রবন্ধে বলিব। আর আর্থার-বন্দর অবরোধ কালে এইরূপ চীনে জাঙ্কে করিয়াই খাদ্য সামগ্রী চুপে চুপে বন্দরে ঢুকিত।
এই স্থানে নানা জিনিষ দেখিয়া ও নানা লোকের সঙ্গে মিশিয়া “কূপ মণ্ডক” অবস্থায় থাকিয়া এত দিন যাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই, সেই সব ভাব আমার মনে আসিত। নানা দেশের নানা লোককে আমাদেরই মত আহার-বিহার করিতে দেখিয়া সবাইকে যেন ভাই ভাই ব’লে মনে হতো। হৃদয়ের চিরকাল সঞ্চিত সঙ্কীর্ণতা কত কমিয়া গেল। অর্থোপার্জ্জন যে কত চেষ্টাসাধ্য তাহা সহজে উপলব্ধি করিলাম। পৃথিবী যে কতবড় তা এই প্রথম সমুদ্র-যাত্রাতে কতকটা বুঝিলাম। মানবের কায়িক শক্তি যে কত সামান্য, কত নগন্য তাও উপলব্ধি করিলাম। কেবল বুদ্ধি বলেই মানব এই বিশাল বিশ্ব-রাজ্যে দিগ্বিজয়ী।