চীন ভ্রমণ/চীন জাহাজে যাত্রিদল



চীন জাহজে যাত্রিদল

 রেঙ্গুন হইতে চীন জাহাজ ছাড়িয়াছিল। জাহাজে সকল জাতীয় সকল শ্রেণীর যাত্রী। প্রতি বন্দরে কতক লোক উঠিল, কতক নামিল। একটি বাড়ীতে যেমন অনেক লোক থাকে, জাহাজেও সেইরূপ সকল যাত্রিই একত্রে কাল যাপন করিত; সর্ব্বদা দেখাসাক্ষাৎ ও মেশামিশি হইত। বিভিন্ন জাতীয় লোকদের এইরূপ একত্রে দেখিয়া তাহাদের আকৃতি ও আচার-ব্যবহারের যে সকল পার্থক্য মনে হইতে, তাহা বুঝাইবার জন্য এই কয়টি ঘটনা লিখিলাম। এখানে তাহাদের প্রতি কার্য্য লক্ষ্য করিতাম। তীরে নামিয়া লোকদের দেখিলে এরূপ পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ দেখা যায় না।

 পিানাঙএ একটি চীনে বালক উঠিল, সে আমার কথাবার্ত্তা সম্বন্ধে অনেক কাজে সাহায্য করিত। তার পিতা গরিব লোক, খাবার ফিরি করিত। অনেক বৎসর বিদেশে কাজ করিবার পর সপরিবারে বাড়ী যাইতেছে। ছেলেটি পিনাঙ্ মিশনরী স্কুলে বিনা বেতনে ইংরাজী পড়িতেছে। খুব বুদ্ধিমান ছেলে, দু'কথা বলিলেই মনের ভাব বুঝিয়া নেয়। আমি যে মুখস্থ করিয়া একটু চীন ভাষা শিখিতে চেষ্টা করিতেছিলাম, তাই অভ্যাস করিবার জন্য ইহার সঙ্গে দুই একটি চীনে ভাষায় কথা কহিতাম। বালকটীর নাম “উসিন্”। তাহার সঙ্গে দেখা হলেই ব'লতাম,—"উসিন্ লাই চুপেং।” অর্থাৎ, -"উসিন্ আমার কাছে এসো। তোমাদের দেশের দুই একটি খবর ব'লে দাও।” শব্দটা ঠিক হইবে বলিয়া আমি আবার চীংকার করিয়া বলিতাম, আর জাহাজ শুদ্ধ চীনেম্যানেরা হাসিয়া খুন হইত। আমি সেই সময়ে চীনে স্ত্রীলোকদের মুখের দিকে চাহিতাম, হাসিবার কথা হইলেও তাহারা অপরিচিত লোকের কাছে হাসা ভদ্রোচিত নয় মনে করিয়া হসিত না।

 উসিনের পিতা ভাত মাছ ও তারকারী বেচিত। আর উসিনের মা আহারের সময় উসিনকে দিয়ে খাবার চাহিয়া পাঠাইত। সে স্ত্রীর থাবার দিবার সময়, যত ভাল ভাল মাছ ও মাংস খণ্ড-সব গুলি বাছিয়া বাহির করিয়া দিত। দেখিতাম, অন্যকে খাবার দিবার সময় তাহার এমন হাত উঠিত না।

 একটি বৃদ্ধ চীনেম্যান একটি অল্পবয়স্কা মগ রমণীকে বিবাহ করিয়া নিজ দেশে লইয়া যাইতেছে। সে বোধ হয়, রেঙ্গুনেই কোন কাজ-কম্ম করিত, এখন বাড়ী ফিরিতেছে। তাহার অনেক গুলি ছোট ছোট ছেলে আছে, তাহার মধ্যে একটি দুগ্ধপোষ্য। ঐ চীনেম্যানের বৃদ্ধা মাতাও সঙ্গে ছিলেন। তিনি পুত্রবধূকে মেয়ের মত যত্ন করেন, দেখিলাম। ছোট ছোট নাতি গুলি তাঁর কোলে পিঠে চড়িয়া আবদার করে। তাঁর তাতে আনন্দের আর সীমা থাকে না। আমাদের বাড়ীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে এই দৃশ্য আমি রোজই দেখি। তাই তাহাদিগকে দেখিতে আমার বড় ভাল লাগিত। দেশে পৌঁছিলে জাহাজ হইতে নামিয়া তাহাদের সকলের মুখে হাসি আর ধরে না। অপরিচিতিকে পরম আত্মীয় করিয়া সে বম্মারমণী যে আপনার দেশ আত্মীয়-স্বজন ছাড়িয়া এই আড়াই হাজার মাইল আসিয়াছেন,তাহতেও তাঁহার মন বিচলিত দেখিলাম না। সেই চীনেম্যান তাঁহাকে অতি যত্ন করিয়া নামাইল,সেই দুধের ছেলেটিকে নিজে কোলে লইল, স্ত্রীকে একটি সামান্য দ্রব্যের ভারও বইতে দিল না।

 আমাদের চীন কমোডোরর শ্যালিকাও সেই জাহাজে ছিলেন। তাহার রং ঠিক বরফের মত শুভ্র। তাহার পা'দু'খানি সঙ্কুচিত, সুতরাং জাহাজ দুলিবার সময় দ্বিতীয় শ্রেণীর হইতে ক্যাবিনে নামিতে হইলে খুব সন্তৰ্পণে অপরের সাহায্য লইয়া তাঁহাকে নামিতে হইত। তিনি ভাল করিয়া চলিতে পারিতেন না। কাপ্তেন একদিন কমোডোরকে জিজ্ঞাসা করিলেন,–“Commodore, ইনি কে?” কমোডোর বলিল,—“Wife’s sister going to his husband.” অর্থাৎ, -“আমার স্ত্রীর বোন স্বামীর কাছে যাচ্ছেন।” পিজন ইংলিসে his এবং her প্রভৃতি পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গবাচক সর্ব্বনাম শব্দে কোন প্রভেদ নাই।

 প্রথম শ্রেণীতে অনেক গুলি রমণী ছিলেন,তাহার মধ্য কাহারও কাহারও বর্ণ তুষারের মত শুভ্র, চেহারা ক্ষীণ ও দীর্ঘ। চিবুক অত্যন্ত উচু ও চীনদেশীয় স্ত্রীলোকের মত কালো রেসমের পোষাক পৱা। ইঁহাদের সহিত অনেক লোকজন ছিল। শুনিলাম, ইহারা মাঞ্চু জাতীয় স্ত্রীলোক। চীনের রাজবংশ এই মাঞ্চু তাতার জাতীয়। তাঁহারা কাহারও সহিত মিশিতেন না।

 ইহাদের ঘরের পাশেই একটি ঘরে একজন স্ত্রীলোক থাকিতেন,তাঁহাকে আমরা উঠিবার দিন ও নামিবার দিন মাএ দেখিয়াছিলাম। আর কোনও দিন তিনি ঘরের বাহির হন নাই। সর্বাঙ্গ সাদা পরিচ্ছদে ঢাকা-অন্য কোনও রং নাই। তাঁহার সঙ্গে একটি দাসী থাকিত। তাঁহার স্বামী, কাছে পৃথক এক ক্যাবিনে থাকিতেন। আমি যদিও তাঁহাদের খুব নিকটেই থাকিতাম,কিন্তু তাঁহাকে কখনও তাঁহার স্ত্রীর ঘরে যাইতে দেখি নাই। ইনি কোরিয়া দেশের স্ত্রীলোক। এমন অবরোধপ্রথা পৃথিবীর আর কোনও দেশেই নাই। বিবাহের পর স্বামী ভিন্ন কোনও পুরুষ,এমন কি, নিজের পিতাভ্রাতাও ইহাদের মুখ দেখিতে পান না। শুনিলাম সিওলে রাত্রিকালে স্ত্রীলোকেরা ছোট ছোট কাগজের লণ্ঠন হাতে করিয়া পথে বাহির হয় বলিয়া পুরুষেরা রাত্রে পথে বাহির হইতে পারে না। তবুও ভাল, এত অবরোধ সত্ত্বেও বাহিরে বেড়াইবার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, অন্য দেশে যে তাহাও নাই, দিনরাত ঘরে বন্ধ থাকে।

 কোরিয়া দেশে প্রায়ই স্বামী অপেক্ষা স্ত্রী বয়সে বড় হইয়া থাকে। বিবাহের প্রথা ও অতি চমৎকার। বর বিবাহের সময় ক’নের বাড়ী গিয়া দরজায় জানু পাতিয়া বসিয়া একটি হংসী ছাড়িয়া দেন। আমাদের দেশে পুরাকালে নলরাজার বিবাহেও দময়ন্তীর নিকট সোনার হাঁস দূতস্বরূপ প্রেরিত হইয়াছিল। কিন্তু এখানে হংসের অন্য তাৎপর্য্য আছে। নিম্নোক্ত ঘটনা লইয়া এরূপ প্রথা প্রচলিত হইয়াছে। পুরাকালে একদা এক হংসমিথুন ক্রীড়ায় রত ছিল, এক ব্যাধ শরবিদ্ধ করিয়া হংসটিকে মারিয়া ফেলে। হংসী কাতর স্বরে চীৎকার করিতে লাগিল। তাহার পর সে যতদিন বাঁচিয়া ছিল, মধ্যে মধ্যে সেই স্থানে তার সঙ্গীকে খুঁজিতে আসিত ও না দেখিয়া করুণস্বরে বিলাপ করিত। দম্পতী-যুগলের প্রণয় এইরূপ প্রগাঢ় ও অধিনাশী হইবে বলিয়াই হংস লহঁয়া এই ঘটনার অভিনয় করা হয়। বিবাহ প্রথার ইহাই একটী অঙ্গ। হিন্দু বিবাহ যেমন শালগ্রাম নহিলে আইন সঙ্গত হয় না, হংস সম্বন্ধে সেখানেও সেইরূপ। হংস-মিথুনের এই ঘটনাটি ঠিক আমাদের রামায়ণের ক্রৌঞ্চ-মিথুনের ঘটনার মত। সকল দেশেই মানবহৃদয়ের চিন্তাৱ গতি বুঝি একই পথে প্রধাবিত।

 প্রথম শ্রেণীতে কতকগুলি স্ত্রীলোক ছিল, তাহারা ইউরোপীয় ও চীনে মিশ্রিত জাতি, পুর্ব্ব-উপদ্বীপে বাস করে। ইউরোপীয়দের মত নাসিকা উন্নত, অথচ গালের হাড় ও উঁচু। ইহারা চীনে স্ত্রীলোকের মত ঢল ঢ'লে ইজের ও চায়না কোট বা বিবিদের মত গাউন কিছুই পরে না। তাহাদের পোষাক,—পরনে রেসমের লুঙ্গী ও গায়ে এক গা' গহনা। ইহারা পান সুপারি ও চুরট খায় এবং। পান করে। ইহারা খুব খাইতে পারে। প্রত্যহ প্রাতে উঠিয়া দেখিতাম রাত্রিতে গুরু আহারের পরও, ঘুম ভাঙ্গিলে মুখ হাত পা' ধুইবার পূর্ব্বেই ইহারা ক্ষুধায় অধীর হইয়া রাশীকৃত মিষ্টান্ন আহার করিতেছে। ইহারা প্রত্যুষে উঠিয়া যাহা খায়, তাহাতে আমি সাত দিন জীবন ধারণ করিতে পারি!

 বালতি করিয়া জল আনিতে গিয়া, একজন বলিষ্ঠাকায় চীনেম্যান জাহাজ দুলিতে ছিল বলিয়া পা’ পিছলাইয়া পড়িয়া গেল। তাহার অত্যন্ত আঘাত লাগিল। তবুও সে কাতর হইল না বা অন্যের সাহায্য চাহিল না। আমাদের দেশের লোক এমন পড়িয়া গেলে, কত লোক আহা-উহু করে। কিন্তু চীনেবা সেরূপ কিছুই করে না। অদূরে কতকগুলি চীন ও অন্যান্য জাতীয় স্ত্রীলোক ছিলেন। তাঁহারা যদিও প্রকাশ্যে সাহায্য করিলেন না, তবুও তা তাদের মুখে সহানুভূতি প্রকাশ পাইল।

 এক চীনেম্যান রক্ত-আমাশয়ে শয্যাগত হইয়া পড়িল। সে উত্থানশক্তি রহিত; বন্দরে পৌঁছিলে তাহার আপনার ভাই তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া গেল। আমরা তাহাকে হাঁসপাতালে পাঠাইয়া দিলাম। আনেকগুলি স্ত্রীলোক তাহার সাহায্যের জন্য তাহার হাতে একটি দুটি-কারিয়া তাম্র-মুদ্রা দিলেন।

 ছেলের বড় অসুখ তারযোগে এই সংবাদ পাইয়া একজন ভদ্র চীনেম্যান পিনাঙ হইতে হংকং এ তাহাকে দেখিতে আসিতে আসিতেছিলেন। তাহার সময় আর কাটে না। মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে জাহাজের কর্ম্মচারীদের জিজ্ঞাসা করিতেন, জাহাজ হংকং এ কতক্ষণে পৌছিেবে। সিঙ্গাপুর আসিয়া তারের খবর পাইলেন,সব শেষ হইয়া গিয়াছে। তিনি যত অধীরে হইবেন মনে করিয়াছিলাম, তাহার কিছুই কিন্তু দেখিলাম না; কেবল নির্ব্বাক্ এবং ম্রিয়মান হইয়া বসিয়া পড়িলেন,—চোখের জল পড়িল না। তাঁহার শোকের কথা শুনিয়া বর্ম্মা দেশীয় একটি স্ত্রীলোক আপনার ছেলেকে কোলে লইয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। তিনি সে চীনেম্যানের কোনও সম্পৰ্কীয় লোক নহেন।

 প্রথম শ্রেণীর যাত্রীর মধ্যে একটি ইউরোপীয়, তাহার ভীমাকৃতি স্ত্রী ও দুইটি শিশু ছিল। মেম সাহেব অহরহ তাঁহার চীনে আয়ার সহিত কলহ করিতেন। এত চেঁচাইতেন যে, লোক জমিত। তাঁহার স্বামী Shakespearএর “Taming of the Shrew” (কুঁদুলী-দমন) নামক নাটকের “পিট্রসিওর” মত দেখিতে খুব ঢেঙা ও মনের দৃঢ়তাব্যঞ্জক ঘন কাল মস্ত গোঁফওয়ালা! তিনি স্ত্রী অপেক্ষা আরও চেঁচাইয়া স্ত্রীকে খুব জব্দ রাখিতে পারিতেন। এক দিন স্ত্রী বসিয়া একটি সিল্কের বডি শেলাই কৱিতে করিতে আয়ার উপর খুব রাগিয়া উঠিলেন। তাঁহার স্বামী আয়ার উপর যেন আরও রাগিয়া, চেঁচাইয়া-আয়াকে বকিতে বকিতে-টেবিল চাপড়াইয়া -কাচের গ্লাস ভাঙ্গিয়া -তাঁহার স্ত্রী যে রেশমের জামাটি শেলাই করিতেছিলেন, সেইটি লইয়া ছিাড়িয়া ফেলিলেন। স্ত্রী তৎক্ষণাৎ চুপ! আপনিই সেই জামাটি মেজে হইতে উঠাইয়া লইয়া নির্ব্বাক হইয়া রহিলেন। এটি স্ত্রীকে জব্দ করিবার জন্য কেবলমাএ রাগের অভিনয় বলিয়াই মনে হইল। নয়ত আয়ার উপর রাগ করিয়া স্ত্রীর জিনিষ লোকসান করবেন কেন!

 দ্বিতীয় শ্রেণীতে একটি জাপানী ভদ্রলোক, তাঁহার স্ত্রী ও শ্যালিকাকে লইয়া এময়ে যাইতেছিলেন। ইঁহার বৃহৎ গালার কারবার আছে। তিন জনই এক ঘরে থাকিতেন। তিন জনে সর্ব্বদাই আমোদ-প্রমোদ লইয়া ব্যস্ত। জাপানী রমণীরা সর্ব্বদাই চেঁচাইয়া কথা কইিতেন ও উচ্চ রবে হাসিতেন। কে কত ভারী,তাই দেখিবার জন্য পরস্পরকে কোলে করিয়া তুলিতেন। পুরুষটিও স্ত্রীলোকদিগকে ও স্ত্রীলোেকরাও পুরুষটিকে সকলের সম্মুখে কোলে করিয়া তুলিতেন! আর আর লোক অবাক হইয়া তাঁহাদেৱ অদ্ভুত রঙ্গরহস্য দেখিত। তাহাতে তাঁহাদেৱ ভ্রক্ষেপও ছিল না। সময় সময় স্ত্রীলোকেরা এলোচুলে হাত ও গলাকাটা নাইটগাউন মাত্র পরিয়া ক্যাবিন হইতে ডেকের উপর আসতেন। একে খর্ব্বাকৃতি, তাহাতে লম্বা লম্বা কালো চুল পায়ের গুলফ অবধি পড়িত, চোখ ছোট ও গাল উঁচু বলিয়া হাসিলেই চোখ দুটি বুঁজিয়া গিয়া দেখিতে অতি সুন্দর হইত; সকলেরই চক্ষু সেই দিকে ছুটিত। ইহাতে তাঁহাদের কিছুমাত্র লজ্জাবোধ হইতে না। যেমন বালক-বালিকারা একত্র খেলা করে, তাঁহারাও তেমনি সরলমনে নিঃশঙ্কচিত্তে খেলা করিতেন। তাঁহাদেব এইরূপ স্বাধীন ভাবে খেলা করিতে দেখিয়া আমাদের অনেকেরই মনে কতই অযথা কুৎসিত কল্পনা আসিত।

 জাহাজে আমি ছাড়া আর একটি হিন্দু পরিবার ছিল। এক ব্যবসাদার চোবে তাহার স্ত্রী ও একটি শিশু কন্যাকে লইয়া যাইতেছিল। স্ত্রীর কালো ফুল-ষ্টকিং-পরা পায়ে রূপার অলঙ্কার ছিল; ঘাগরাটি রঙ্গিন ছিটের; নাকে নখ ও কানে বড় বড় অনেকগুলি মাকড়ি। তাহারা ডেকযাত্রী। আর তাহাদের পাশেই দুই জন জাপানী ও একটি জাপানী রমণী থাকিত। সেই জাপানীদের সঙ্গে দুই এক ঘণ্টার মধ্যে চোবের স্ত্রীর এত বন্ধুত জন্মিয়া গেল যে, যদিও সে তাহদের কথা বুঞ্চিত না, তবু দিনরাত্রি জাপানীদের কাছে থাকিত। সে হিন্দিতে ও তাহারা নিজের ভায়ায় কথা কহিত। তবে ভাবে, আন্দাজে অর্থের বিনিময় হইত। কথা বুঝুক বা না বুঝুক, সর্ব্বদাই তাহাদের সঙ্গে হাসিত। জাপানীরা কলা ও গাব আনিয়াছিল, চোবের স্ত্রীকে তাহা খাইতে দিত। সে তাহা কিছুমাত্র ইতস্ততঃ না করিয়াই খাইত। চোবে নিজে কি্ন্তু কি সব ভাজাভুজি আনিয়াছিল,তাহাই খাইত। কাহারও ছোঁয়া খাইত না। কিন্তু চোবেকে দেখিতম, স্ত্রীর যেন গোলমটি!

 প্রথম শ্রেণীর সম্মুখে মালয় দেশীয় এক ডেকযাত্রী ছিল। সে খুব ফর্সা ও তাহার চেহারা উচ্চবংশীয় লোকের মত। মুখ বিষণ্ণ। সে সর্ব্বদাই চুপ করিয়া থাকিত। গরীব না হইলে আর ডেকযাত্রী হইবে কেন? কিন্তু তাহার ভদ্রোচিত অভিমান ছিল। সে এক খানি বেতের ইজিচেয়ার সঙ্গে অনিয়াছিল; তার উপরেই দিনরাত বসিয়া বা শুইয়া থাকিত; কাহারও সহিত মিশিত না। তাহার সঙ্গে তাহার স্ত্রী ও একটি দেড় বছরের ছেলে ছিল। সকলেরই অতি সুন্দর গড়ন এবং ভদ্রোচিত ব্যবহার ও মুখের ভাব। ডেকযাত্রী স্ত্রীলোকদের থাকিবার আলাহিদা স্থান ছিল। সেইখানে তাঁর স্ত্রী ও শিশুর থাকিবার কথা, কিন্তু সে রমণী স্বামীকে দূরে রাখিয়া থাকিতে পারিত না। সেই চেয়ার খানির পাশে এসে সারা দিন বসিয়া থাকিত। পরস্পরে মুখে বেশী কথা হইত না, চাহনিতেই প্রগাঢ় প্রণয় প্রকাশ পাইত। সে ছেলেটির অতি সুস্থ শরীর ও গোল গাল গড়ন। উলঙ্গ কোমরে একগাছি লাল ঘুনশি ও মাথার মাঝে চুলে লাল ফিতা বাধা; বাকী মাথা কামান। সবে চলিতে শিখিতেছে। আধ-আধ বুলি ব’লে দিন রাত সেই ডেকের উপর ট’লে ট’লে বেড়াইত। জাহাজ শুদ্ধ লোক অনিমিষনয়নে চাইয়া থাকিত -আমার ক্যাবিন থেকে ঢুকতে বেরুতে দেখা যাইত- সে দিক দিয়া গেলে আমার সে দৃশ্য হ’তে চোখ আর ফিরিত না। তাদের দু’জনকে দেখলেই আমার মনে হতো, তারা যেন দু’জনে সংসারে একা পড়েছে যেন, যে কোনও কারণেই হোক্, সমাজদ্বারা পরিত্যক্ত।

 দ্বিতীয় শ্রেণীতে দুইটী মগরমণী একত্র থাকিতেন; তাঁহাদের সহিত কোনও পুরুষ ছিল না। খালি পাইলেই তাঁহারা আমাদের ডেক-চেয়ার দখল করিয়া বসিতেন। কাপ্তেনের কুকুরটি লইয়া উচ্চ হাসি হাসিয়া খেলা করিতেন। অনেক রাত্রি অবধি একলা ছাদে বিক্ষিপ্ত পরিচ্ছদ হয়ে অকাতরে ঘুমাইতেন। লজ্জার বড় ধার ধরিতেন না। শরীরে স্বাস্থ্য ও মনে আনন্দ থাকিলে যেরূপে জীবন কাটে ইহাদের সেইরূপই দেখিতাম। অপরে কি ভাবচে না ভাবচে ভেবে আদব-কায়দার জাঁতায় জীবনকে পেষণের কোনও চেষ্টা ছিল না। বুকের উপর অবধি লুঙ্গী বাঁধা থাকে বলিয়া তাঁহাদের চলা ফেরা যেন আড়ষ্ট-আড়ষ্ট ভাবের। জমিতে পা ঘেঁষিয়া চলিতে হয়। রেঙ্গুনে এক দিন আসিবার সময় মগের নাচ দেখিয়াছিলাম। মগরমণীদল সারিবন্দী হইয়া দাঁড়াইয়া একত্র অঙ্গ হেলাইয়া নাচে, দেখিতে অতি সুন্দর। কিন্তু আমাদের দেশের মত নাচে চঞ্চল অঙ্গ-বিক্ষেপ নাই।

 Fitz Geraldএর যে বিখ্যাত সার্কাস আসিয়া কলিকাতায় খেলা দেখাইয়া গিয়াছে, তাহারা হংকং, সিঙ্গাপুর,পিনাঙ ইত্যাদি স্থানেও ঐরূপ খেলা দেখাইয়া আসিয়াছে। তাহারা আমাদের জাহাজেই ছিল। তাহাদের চাকর-বাকরদের দেখিয়া মনে হইত, নীচ শ্রেণীর ইয়োরোপীয়রা অনেকটা আমাদের দেশের নীচজাতীয় লোকেরই মত। পশুর মত আচার ব্যবহার -খাওয়া শোয়া। সুর ক'রে অঙ্গভঙ্গী করে কথা কওয়া, আর কথায় কখায় দিব্যি গালা; আর অশ্লীল বিষয়ের আলোচনা করা। তাহাদের দলে যে সব স্ত্রীলোক তারে ও ঘোড়ার খেলা দেখাইত, তাহাদেরও স্বভাব সংসৰ্গদোষে ঐরূপ হইয়াছে।

 সকল জাতির স্ত্রীলোকের তুলনায় চীনজাতীয় স্ত্রীলোককে দেখিতাম, সর্ব্বাপেক্ষা ভিন্ন প্রকৃতির; মুখে হাসি নাই,উচ্চ কথা নাই। নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়া সন্তানের যত্ন করিতেন।

 দেখিতাম, যদিও ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় লোকের ভাষা বিভিন্ন বলিয়া তাহারা পরস্পরের সহিত মিশিতে পারিত না, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় ছেলেরা অনায়াসে পরস্পরের সহিত মিলিয়া মিশিয়া খেলা করিত। শিশু-ভাষা যেন একটি স্বতন্ত্র ভাষা, সকল শিশুই জানে,তাই তাহাদের পরস্পরের মনের ভাব বুঝিতে কষ্ট হয় না।  আর একটি দম্পতীর কথা বলি। স্ত্রীলোকটি ফরাসী জাতীয়। প্রথম স্বামী ইঁহাকে কোনও কারণে আদালতের সাহায্য লইয়া পরিত্যাগ করেন। তারপর অনেক দিন ইনি থিয়েটারের অভিনেত্রী ছিলেন। চার পাঁচ বৎসর হইল, এক জন ইংরাজ যুবক সওদাগর হঁহাকে বিবাহ করিয়াছেন। দুটি মেয়ে হইয়াছে। মেয়ে দুইটীর তাহাদের মারই মত চঞ্চল নীল চোখ। বিবাহের ছ'মাস পরেই প্রথম কন্যাটি ভুমিষ্ঠ হয়। এখন ইনি সংসারী হইয়া বেশ সুখী হইয়াছেন। সর্ব্বদা শেলাইয়ের কাজ লইয়াই থাকিতেন। মেয়েদের যত্ন আদরের সীমা ছিল না। কাহারও সঙ্গে মিশিতেন না। স্বভাবের কোনওরূপ চাঞ্চল্য নাই। প্রতি কথাবার্ত্তা আচার-ব্যাবহার সবই উচ্চ আদর্শের। অতীত জীবন হেয় হইলেও এখন তাঁহার প্রকৃতি একেবারে বদলাইয়াছে। তার আর বৈচিত্রা কি? একবার ভুল হইলে কি আর শোধরান যায় না?

 একটা ছোটছেলে বার বার বমি ক’রছিল ও যন্ত্রণায় অত্যন্ত কাতর হয়ে কাঁদছিল ব'লে তার বাবা আমাকে একবার ছেলেটীকে দেখতে নিয়ে গেল। তারা গরীব ডেক যাত্রী। স্ত্রীলোক যাত্রীদের থাকিবার জন্য যে ডেক আছে, আমি সেখানে গিয়ে দেখিলাম ছেলেটী মার কোলে শুয়ে বড়ই কাঁদছে। মা ব্যস্ত হ'য়ে কান্না থামাবার জন্য অনবরত মাই দিচ্ছেন, আর ছেলেটী অতি আগ্রহের সহিত মাই খেয়ে তখনই জমা দুধ বমি করিয়া ফেলিতেছে। খাবার দোষেই এরূপ হইয়াছে, ইহা নিশ্চয় করিয়া আমি মাই দিতে মানা করিলাম ও তাহার পিপাসা শান্তির জন্য একটু একটু মৌরীর জল দিতে বলিলাম। শিশুটী অল্পক্ষণেই সুস্থ হইল দেখিয়া তার বাপ মার আর কৃতজ্ঞতার সীমা রহিল না। পিতা আমার কাছে এ খবর বলতে এলে আমি তাহাকে বুঝিয়ে দিলাম যে-ছেলেদের যত রোগ অধিকাংশই খাওয়ার দোষেই হয়। আগ্রহে দুধ খেলেই যে ক্ষুধা পাইয়াছে বুঝিতে হইবে, তাহা নয় -পিপাসাতেও ঐরূপ করে। তখন দুধ দিলে আরও অপকার হয়। কাঁদলেই যখন তখন স্তন্যপান করিতে দেওয়া ভাল নয়।

 সে এই সকল উপদেশ অতি মনোযোগের সহিত শুনিল ও স্ত্রীকে গিয়া বুঝাইয়া দিল! পরে আপনি পকেট বহিতে সব লিখিয়া লাইল। যে কথা গুলি দুই মিনিটে লেখা যায়, তাহা লিখিতে তার আধঘণ্টা সময় লাগিল।

 একটি লোক একটি চীনে ফুল আমাকে উপহার দিলেন, তার কতকগুলি পাপড়ী ঝরা ও অপরগুলি ঝরিয়া যাইতেছে। অমন ফুল আবার কেহ কাহাকেও উপহার দেয়! জাহাজে বলিয়াই সাজিল। জাহাজে ত ফুল ফুটে না; আর হংকংও প্রকৃতিদত্ত ফুলের রাজা নয়। যাহা ফুটে, তাহা অতি কষ্টে। কি চীনে, কি ইউরোপীয়ান, সকলেই এখানে ফুল ভাল বাসে। তাই ফুলের অসম্ভব দাম।

 যে চীনেম্যনটি আমাকে ফুল উপহার দিয়াছিলেন তাঁর কাছে অনেক গুলি চীনভাষায় লিখিত বই ছিল। যেমন হ'য়ে থাকে, তিনি যেমন ফুলভাল বাসেন তেমনি বই ও ভাল বাসেন। বই গুলিকে অতি যত্নকরে রেখেছেন। বই গুলির পাতার ভিতর ফুলের পাপড়ী দেওয়াছিল। আমি ও অমনি রাখি। ওই খানেই ফুল রাথিবার উপযুক্ত স্থান বলিয়া মনে হয়।

 ছোট পাতলা একপিট ছাপা কাগজে নির্ম্মিত এই চীনে বই গুলি দেখে আমার ইচ্ছা হ’তে লাগল সে গুলি মাথায় রাখি, বুকে করি। নিজে বুঝিবার তো সাধ্য নাই! তবে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম যে ঐ সকল পুস্তকের মধ্যে একখানি চীন দেশীয় প্রবাদ এবং(Quotation) উদ্ধৃত উক্তি সম্বন্ধে পুস্তক ছিল। তাহার দু’একটাির ভাব নীচে উদ্ধৃত করিলাম। বাঙ্গলা সংস্কৃত বা ইংরাজী ভাষায় কতকটা ঐরূপ ভাবের বচন জানা আছে বলিয়া, যেখানে সম্ভব তাহাও লিখিলাম।  “বিনয় ও লজ্জাশীলতা স্ত্রীলোকের কণ্ঠভূষণ স্বরূপ।” চীন দেশীয় স্ত্রীলোককে যে ভাল করিয়া দেখিয়াছে সেই এ কথার তথ্য বুঝিতে পরিবে! এমন স্বভাবসুলভ বিনয়নম্র রমণীজাতি পৃথিবীর আর কোথায়ও নাই।

 আর একটি প্রবাদের এইরূপ অর্থ,—“অসময়ে অতিথি আসিলে সে শত্রুর (তাতার) অপেক্ষাও কষ্টদায়ক হয়।” পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, চীন দেশের লোক মোটেই অতিথি-পরায়ণ নহে; ভাই মরিলে ভাই কাঁদে না, অতি নিকট আত্মীয়ের দুরবস্থায় অর্থসাহায্য করে না। লোকে লোকারণ্য বলিয়া যে দেশে জীবিকা অর্জ্জন অতি কষ্টসাধ্য, সে দেশে অতিথি-সৎকার কিরূপে সম্ভব হইতে পারে?

 “নির্ব্বাণদীপে কিমু, তৈল দানম্।” প্রদীপ নিবিয়া গেলে আর তাহাতে তৈল দিয়া কি হইবে? একথার মর্ম্মান্তিক তাৎপর্য্য প্রাচীন চীনেরাও বুঝিয়াছিল।

 আর একটি প্রবাদে মা ছেলে কে সদুপদেশ দিতেছেন। উহার ভাব,ঠিক নিম্নোক্ত সংস্কৃত শ্লোকটীর মত,—

“সুশীলোভব ধর্ম্মাত্মা, মৈত্রী প্রাণিহিতে রতঃ।
নিম্নগা যথাপঃ প্রবণাঃ পাত্রমা যাতি সম্পদঃ।”

 বড়ই সারগর্ভ ও সদুপদেশ পূর্ণ নীতি কথা। পিতার কোলে উঠিতে পাইলেন না বলিয়া অভিমানে যখন ধ্রুবের ঠোঁট ফুলিতেছিল। তখন তাঁহার মাতা তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “সুচরিত্র হও, ধর্ম্মপরায়ণ হও, সকল লোকের-সকল জীবের মঙ্গল সাধন কর, তাহা হইলে জল যেমন সর্ব্বদা নিম্নগামী হয়, সকল সুখ-সম্পাদও উপযুক্ত বোধে তোমাতেই আসিবে।”

 ব্যথিত-হৃদয়ের উক্তি আর একটি শ্লোকের ভাব কতকটা নিম্নলিখিত শ্লোকের ন্যায়,— 

“চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে।
কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।”

 কি আশ্চর্য্য! এই সকল নানা দেশের লোকের কার্য্য কলাপ দেখিয়া আমার এতদিন মনে হইতেছিল যে, অবস্থা বিশেষে আমরা যে কাজ করি, ইহারাও সকলে ঠিক সেইরূপ করিয়া থাকে। এখন দেখিলাম, লোকে হৃদয়ের ভাব ভাষায় ফুটাইতে গেলেও ঠিক একই সুরে হৃদয়ের উচ্ছ্বাস বাহির হয়।

 তার মধ্যে আর একখানি পুস্তকে দেখিলাম, পুস্তক উৎসর্গ করিবার স্থানে যাহাকে উৎসর্গ করা হইতেছে তাহার নামোল্লেখ নাই,—কেবল লেখা আছে, “চির আরাধ্য—তোমাকে।” যেন গভীর অনুরাগের স্রোত অন্তরে অন্তরে প্রবাহিত হচ্চে—যে কারণেই হোক মুখ ফুটে বলিবার যো নাই।

 আর একখানি পুস্তক কোন চীন মহিলা রচিত। চীন-জাপান যুদ্ধে তাহার প্রণয়ীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আক্ষেপ ক’রে লিখে ছিলেন। কোন ভাবুক পাঠক নীল পেন্সিল দিয়ে তার অনেক গুলি ছত্রের নীচে দাগ দিয়াছেন দেখিলাম। একটী ছত্রের অর্থ সরল ভাষায় এইরূপ,—

 “হে প্রিয়জন! তোমার মধুর স্মৃতি এ জনমে ভুলিবার নয়।”

 ঠিক যেন আমাদের বঙ্গ-সাহিত্যের এই সরল উক্তিটির মত,—

“তুমি যে দিয়েছ দেখা
পাষণে তা আছে লেখা,
হৃদয় ভাঙ্গিলে সে তো মুছিবার নয়।”

 যখন সেই চীনেম্যানটীর নিকট এইসব পুস্তক সম্বন্ধে কথা কহিতে ছিলাম, নীচেকার ডেকে একজন গরিব চীনেম্যান তখন অতি সুমধুর স্বরে বাঁশী বাজাইতেছিল। সকলে তাকে ঘিরে বসেছে। স্ত্রীলোকেরা দূরে থেকে তন্ময় হ’য়ে শুনছেন। সে ঘাড় বাঁকিয়ে বাঁশীতে ফুৎকার দিয়ে কত রকমেরই সুর বার কছিল। বাঁশীর স্বর যেন কাঁদকাঁদ স্বরের মত। আর এত সুস্পষ্ট, ঠিক যেন কে কার নাম ধ’রে ডাকচে। তখন সন্ধ্যার আঁধার ঘিরে আসছিল। আর সুদূর আকাশের এক প্রান্তে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র যেন দেহ ছাড়া আত্মার মত জ্বলছিল।

 একটি ভদ্রবংশীয়া ক্যাণ্টিনবাসিনী রমণী একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু লইয়া একাকী যাইতেছিলেন। তাঁহার অঙ্গ ক্ষীণ ও মুখের ভাব অত্যন্ত মধুর। ছেলেটিকে নানা রংএর একখানি কাপড় দিয়া পিঠে বাঁধিয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়া তিনি ডেকের এক প্রান্তে থাকিতেন। ছেলেটির গায়ে একটু ময়লা বা মাটীর দাগ দেখিতে পারিতেন না। এদিকে তাঁহার এত সাজসজ্জা, কিন্তু মনে বিলাসের লেশমাত্র নাই। লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার প্রয়াস কিছুমাত্র ছিল না। সুসজ্জিতা অন্য জাতীয় স্ত্রীলোকে এরূপ প্রায় দেখা যায় না। যখন তাহার দিকে দেখিতাম, চোখ সহজে ফিরিত না। একদিন চেয়ে দেখছি এমন সময় নির্ব্বাক চাহনীতে রমণী আমার স্থির দৃষ্টিকে তিরস্কার ক’য়ে যেন আমার ঘাড় হেট করে দিলেন। এইরূপে বিষম তিরস্থত হ’য়ে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে মনে মনেই বলিলাম-“টিশি! তোমায় দেখি নাই। যাহার “অনিন্দ্য-সুন্দর-মাধুর” ক্ষীণ গঠন তোমার গঠনেরই কতকটা সদৃশ ছিল, যাহার ছায়া আর এ নশ্বর সংসারে পড়িবে না, তাঁহারই কথা ভাবতে ভারতে তোমার দিকে চেয়েছিলাম।”

 এবার একটি বিপত্নীক চীনেম্যানের কথা বলিয়াই এ সুদীর্ঘ প্রবন্ধ শেষ করিব। হংকং হইতে যখন প্রথম জাহাজে উঠিলেন তখনই তাঁহাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল যে তাঁহাতে নিশ্চয়ই কিছু বিশেষত্ব আছে। অন্য সকলের মত নয়; বেশভূষায়—তাঁহার অবহেলা, এবং দৃষ্টি শন্যময়।

 এক দিনেই তাঁহার মনের ভাব ও জীবনের ইতিহাস জানিলাম। তিনি একজন মধ্যবিত্ত্ব অবস্থার সওদাগর। দেহ ক্ষীণ। বয়স ৩০।৩৫ বৎসর মাত্র। দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী। সর্ব্বদা লোকের জনতা ছেড়ে একা একধারে ব’সে থাকতেন। কাহারও সহিত মিশা নাই-কাহারও সহিত কথা নাই; কেবল অসীম সমুদ্র ও অনন্ত নীল আকাশের দিকে চেয়ে সময় কাটাতেন; কেবল একটি পরিচিত সমবয়স্ক চীনেম্যানের সহিত কখন কখন মনের কথা কহিতেন মাত্র। সে কথার ভাব, চোখের জল ছাড়া কান্নারই রূপান্তর।

 আজ দুই বৎসর হলো তাঁর স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে। আঠার দিনের একটিমাত্র শিশু কন্যা রেখে তিনি চ’লে গেছেন। মাতৃহীনা মেয়েটিকে তিনি মার নামেই ডাকেন। প্রথম প্রসবের পরই তাঁহার মৃত্যু ঘটে। কত ডাক্তার দেখিয়েছিলেন, কিছু হয় নাই। তবু এখনও কেবলই বলেন- “যদি এ চিকিৎসা না ক’রে অন্য চিকিৎসা ক’রতাম হয়তো তিনি ভাল হতেন।”

 জীবনে যেন বিষম বিপ্লব ঘ’টেছে ইহজন্মের মত চারিদিক শূন্য হ’য়ে গেছে। হাত থেকে রুমাল উড়ে গেলে কুড়াইয়া লইতেন না। বৃষ্টি পড়িলে যথাসময়ে সরিয়া বসিতেন না। খাবার ঘণ্টা পড়িলেও খেতে যেতেন না; অন্তরে এমন দারুণ ব্যথা লেগেছে যে-সে কথা, সে প্রসঙ্গ, একবার তুললে হয়-অমনি সবাকার সামনেই ছেলে মানুষের মত আকুল হ'য়ে কাঁদেন।

 ঘড়ির চেন হাতীর দাঁতে আঁকা একখানি ছোট রমণী মুর্ত্তি তাঁর বুকে ঝুলান। ছবির অঙ্গ প্রতাঙ্গগুলি ছোট ছোট কুন্দ ফুলের মত। আর তুষার-ধবল রংটি শ্বেত-করবী ও দ্রোণ পুষ্পের মত সাদা।