চীন ভ্রমণ/হং কং (প্রথম প্রস্তাব)



হং কং

প্রথম প্রস্তাব

 সাত দিনের দিন প্রাতে হংকং বন্দরে প্রবেশ করিলাম। বাহির দিক্ থেকে দেখিতে এমন সুন্দর দেশ আমি কখন কোথায়ও দেখি নাই। সমুদ্র ভেদ ক’রে পাহাড় উঠেছে; সহরটি সেই পাহাড়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। পাহাড়টি ১৭০০ ফিটেরও বেশী উচু। সমুদ্রজলের ধার হহঁতে স্তরে স্তরে অতিসুদৃশ্য বাড়ী গুলি যেন উপরে উপরে সাজান র’য়েছে। সে দৃশ্য বর্ণনায় বুঝান যায় না,—চ'খে না দেখলে অনুমান করা অসম্ভব।

 ঠিক সমুদ্রের উপকূলেই প্রস্তর নির্ম্মিত চওড়া রাস্তা। তার উপরেই সারি সারি,—ঠিক একরকম দেখতে, চারিতলা বাড়ী। দূর হ’তে দেখতে ঠিক যেন ছোট পায়রার থোপের মত। মনে হয়, যেন সমুদ্রজলের উপর হইতেই গাথিয়া তোলা। তার গায়ে নীল বর্ণের চীনে হরফে নানা কথা লেখা আছে। এ সকল স্থান পাহাড়েরই রাজত্ব, পাতারের দেশ; পথ, ঘাট, ঘর বাড়ী সবই পাতারে বাঁধান। বন্দরে গভীর জল। অথচ উপকূলে সিঙ্গাপুরের মত একটিও জেটি নাই। এত ঘন বসতির দেশে জাহাজ কিনারায় লাগিলে সমুদ্র-তীরে দোকান গুলিতে তিষ্ঠান দায়; আর অত গভীর জলে জেটীই বা তৈয়ার হবে কেমন ক’রে? সেই জন্য এখানে জাহাজ দূরে নঙর করে এবং বড় বড় চীনে বজরা ও জাঙ্কের সাহায্যে মোট-ঘাট নাবান উঠান হয়। শ্রমদক্ষ চীনে কুলির সাহায্যে তাহা গুরুতর কাজ ব’লেই মনে হয় না। অনায়াসে ও অতি অল্প সময়ে রাশি রাশি মাল বোঝাই হ'য়ে যায়।

 যাত্রীদের নামিতে উঠিতেও নৌকার আবশ্যক। কিন্তু এ সকল নৌকা সাম্‌পানের মত নয় এবং তাহদের গঠন প্রণালীও অন্যরূপ; সাম্‌পান অপেক্ষা আয়তনেও অনেক বড়। সাদা সাদা একরূপ হাল্‌কা কাঠ দিয়া অতি নিপুণতার সহিত গঠিত ও অতি সুকৌশলে পরিচালিত। ইহার ‘ছত্রী’ আছে এবং পিছনে একটী হা’ল ও বসিয়া বসিয়া অনেকগুলি দাঁড় টানিবার ব্যবস্থা আছে। পাল উঠাইবার এবং নামাইবার ব্যবস্থা অতি সুন্দর; পালগুলি মাদুরের, ক্যাম্বিসের নয়। এত তাড়াতাড়ি ইহা চলা-ফেরা করে যে, পালের সাহায্য অনবরতই লাইতে হয়। পাল সর্ব্বদা তোলাই আছে,—তা যে দিকেই হাওয়া হোক না কেন। হাল্‌কা নৌকাখানি পাল ও দাঁড়ের সাহায্যে তীরের মত ছুটে। বায়ুভরে এক একবার বিষম কাৎ হয়, কিন্তু নৌকা এত হাল্‌কা যে, ডুবিবার কোন ভয় নাই। আর সেই সময় নৌকায় সমুদ্রের ঢেউ লাগিয়া অতি মধুর কল্-কল্ শব্দ হয়।

 জাহাজ থামিবা মাত্র অতিশয় বাস্ততার সহিত শত শত নৌকা, যাত্রী নামাবার জন্য জাহাজের চারি দিকে আসিয়া ঘিরিল। চাহিয়া দেখি, প্রায় সকল নৌকাই চীনে স্ত্রীলোকের দ্বারা পরিচালিত। হা’ল ধরিয়াছে স্ত্রীলোক, দাঁড় টানিতেছে স্ত্রীলোক। এমন দৃশ্য পূর্ব্বে কখন দেখি নাই, কখন শুনিও নাহি। স্বাধীনভাবে, সানন্দচিত্তে নৌকায় দিবারাত্র বাস হেতু স্বাস্থ্যের যে এতটা প্রফুল্লতা জন্মে, তা তাদের প্রত্যেক অঙ্গে,—প্রত্যেক হাব-ভাবে জানা যায়। নীল পোষাকের উপর সাদা রঙের পূর্ণ বিকাশ—ঠিক যেন ছবির মত দেখায়। প্রাতঃকালীন সূর্য্য-রশ্মি সেই সকল মুখের উপায় পড়িয়া স্বচ্ছ সরোবরে শ্রেণীবদ্ধ প্রস্ফুটিত পদ্ম ফুলের ন্যায় দেখাইতে লাগিল। আমি যতদিন হংকং বন্দরে ছিলাম, প্রতিদিনই প্রত্যুষে ক্যাবিনের ছোট গোঁজলা দিয়ে ঐরূপ সুন্দর দৃশ্য দেখে আমার সুপ্রভাত হ’ত।

 নৌকায় তারা সপরিবারে বাস করে। স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ৯০ চীন ভ্রমন। সকলে একত্র থাকিয়া, একত্র কাজ করিয়া, সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করে। এই নৌকাতেই তাদের জন্ম, তাদের বিবাহ, বংশ বৃদ্ধি ও মৃত্যু। কত পুরুষ ধরিয়া এরূপ চলিতেছে। জমির উপর তাদের থাকবার ঠাই নাই,—দেশে এত লোকারণ্য, এত স্থানাভাব। চীন দেশে এরূপ নৌকার ঘর-বাড়ী অনেক আছে। এক হংকং সহরেই চারি লক্ষ লোকের মধ্যে বিশ হাজার লোক এইরূপ জলে বাস করে। ক্যাণ্টনে আরও অধিক। শ্যাম রাজ্যের রাজধানী বেংকক্ সহরেও এরূপ অনেক আছে এবং আমাদের ভারতবর্ষে কাশ্মীর দেশেও এরূপ অনেক দেথা যায়। এক একটী নৌকা ছেলে-পিলেয় ভর্ত্তি। তারাও মা-বাপকে সাহায্য করে। কোন স্ত্রীলোক হয়ত পিছনে হা’ল ধরিয়াছে,—তার পিঠে একটী কচি ছেলে বাঁধা। অন্যান্য ছোট বড় ছেলেমেয়েগুলি লগী ফেলে, দাঁড় বেয়ে তার সাহায্য করিতেছে। কাজে সাহায়্য হবে ব’লে সকল চীনে মাঝিই বিয়ে করে। এতে শীঘ্র শীঘ্র তাদের ছেলে পিলে হয় যে, মনে হয়, এক বছর, দেড় বছর মাত্র ছেলেমেয়েগুলি সব পিঠেপিঠি হ’য়েছে। একখানি ছোট বোটে চৌত্রিশ বৎসর বয়স্ক একটি চীনেম্যানের নয়টী সন্তান দেখিলাম। আমাকেও হারিয়েছে! অনবরত সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে সকলেরই শরীর বেশ সুস্থ। পাছে জলে ডুবে যায়, এই আশঙ্কায় অনেক ছেলের গলায় একটা ঝুড়ির মত হালকা জিনিষ বাঁধা থাকে। জলে প’ড়ে গেলেও মাথা ভাসতে থাকবে ব’লে এরূপ করা হয়। সেইটুকু নৌকার ভিতর অনেকের রন্ধনাদি করিবারও ব্যবস্থা আছে। একটী ছোট খাঁচাতে মুর্গী বা হাঁস পোষা আছে,—তারা ডিম দেয়। অনেকে আবার ফিরিওয়ালাদের কাছ থেকে ভাত তরকারী ইত্যাদি কিনে খায়,নিজেরা রাঁধে না। চীন ফিরিওয়ালার দেশ। লোকেরা নিজ নিজ কাজ নিয়েই ব্যস্ত,—আহারাদি বা অন্য আবশ্যকীয়, কাজের বিষয় তাহাদিগকে কিছুই ভাবতে হয় না। ফিরিওয়ালারাই সব যোগায়; ভাতও ফিরি ক’রে বিক্রি হয়। চীনে স্ত্রীলোক জামা-কাপড় রীপু ক’রে বেড়ায় ও অন্য ফিরিওয়ালা আফিম, চা ও চুরুট বেচে যায়।

 এ অঞ্চলের অধিকাংশ লোকই অল্প-বিস্তর ইংরাজী জানে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজী, খোঁনা স্বরে কহিয়া ইহারা নেহাৎ আবশ্যকীয় মনের ভাবগুলি প্রকাশ করে। পৃথিবীর পূর্ব্ব-অঞ্চলের বাণিজ্যস্থান মাত্রেরই সাধারণ ভাষা ইংরাজী। শুনেছি নাকি ভূমধ্য সাগরের আশে পাশে সকল স্থানেই ফরাসী ভাষাই চলতি। দক্ষিণ আমেরিকায় সেইরূপ স্পেনিস ভাষাই প্রচলিত। এরূপ ভাঙ্গা ভাঙ্গা খোঁনা ইংরাজীর নাম “পিজন ইংলিস্"। তার না আছে ব্যাকরণের ঠিক, না আছে উচ্চারণের ঠিক,—কোনরূপে মনের ভাব প্রকাশ করা মাত্র। ভাষাশাস্ত্রে সুপণ্ডিত মরিস্ সাহেব তাঁহার “ভাষা-বিজ্ঞান' নামক পুস্তকে বলিয়াছেন যে, ভবিষ্যতে এই পিজন ইংলিসই জগতের ভাষা হ’য়ে দাঁড়াবে। একথাও অসম্ভব বোধ হয় না। এ অঞ্চলের যেখানে গেলাম, তথাকার অধিবাসীরা, -অজ্ঞই হোক আর বিজ্ঞই হোক, অল্প-বিস্তর পিজন ইংলিস জানে; রাজ্যবিস্তার ও বাণিজ্যবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষাই পৃথিবীর ভাষা হইবে। ফরাসী ভাষার এতদিন যেরূপ প্রাধান্য ছিল, কালক্রমে ইংরাজীই তাহা অধিকার করিবে।

 পূর্ব্বোক্ত নৌকার লোকেরাও এইরূপ ইংরাজী ভাষার দর-দস্তুর করে। পিজন ইংলিশের দু’একটা উদাহরণ দিলে পাঠক বেশ বুঝতে পারবেন। একদিন নৌকা-ভাড়া দেবার জন্য আমার কাছে কিছু ভাঙ্গান ছিল না। সুতরাং নৌ-সিমন্তিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম,— “ডলারের চেঞ্জ(ভাঙ্গানি) আছে?” স্ত্রীলোকটী বলিল,—“Dollar me not got” অর্থাৎ,—“ড়লারের ভাঙ্গানি আমার নাই।” আর এক দিন হংকং সহর দেখে ফিরতে অনেক রাত্রি হ’য়েছিল। “সামপান” “সামপান” ক’রে হাঁক দিলাম,—একজন স্ত্রীলোক নৌকা নিয়ে এল! অত অন্ধকার রাতে অতগুলি জাহাজের মধ্যে ঠিক আমার জাহাজখানি খুঁজে নেওয়া বড় সোজা কথা নয়। স্ত্রীলোকটী আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,—“সিপ্"? অর্থাৎ-যে জাহাজে আমি যাইতে চাই তার নাম কি? আমি বলিলাম,—“পালামকোটা।”

 স্ত্রীলোক। পালামকোটা,—ইংলিস সিপ্? অর্থাৎ,—ইঃরাজের জাহাজ কি?

 আমি। হাঁ -ইংলিস সিপ্।

 স্ত্রীলোক। Two masts অর্থাৎ, তার কি দুইটী মাস্তুল আছে?

 আমি। হাঁ, Two masts.

 স্ত্রীলোক। From Singapore? অর্থাৎ সিঙ্গাপুর থেকে আসছে কি?

 আমি। হাঁ, From Singapore.

 স্ত্রীলোক। To Amoy tomorrow? অর্থাৎ, -কাল কি এময় যাবে?

 আমি। হাঁ, কাল এময় যাবে?

 এই সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সেই চতুরা মেয়ে মাঝি এত জাহাজের মাঝে আমাকে ঠিক জাহাজে পৌছিয়ে দিল।

 নৌকায় বসিয়া ইতস্তুতঃ দেখতে দেখতে দেখলাম যে সে একাই হাল ধ’রেছে, পালও তুলেছে। তাকে আর কেউ সাহায্য ক’রবার নাই। ছোট ছোট ছেলে গুলি ছত্রীর ভিতর ঘেঁষাঘেষি করে এ ওর গায়ে পা ভুলে দিয়ে ঘুমাচ্চে। দুই তিন মাসের একটি ছোট মেয়ে একধারে শুয়ে রয়েছে। মায়ের জন্য তার পাশেই একটু অতি অপ্রশস্ত শুইবার ঠাঁই।

 বিস্মিত হ’য়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার স্বামী কোথা?” স্ত্রীলোকটী বলিল,—“তিনি মাস হ’ল মারা গিয়েছেন; তখন এই মেয়েটি আমার পেটে।” বল‍্তে বল‍্তে তার যেন সব অতীত কথা স্পষ্ট মনে জেগে উঠ‍্ল; গলার স্বর বাষ্প-গদগদ হ’ল। অন্ধকারে যেন এক ফোঁটা পবিত্র চক্ষুজল চোখে মুক্তার মত দেখা দিল। কি ক’রবে। উপর হইতে কেড়ে নিয়েছেন, উপায় তা নাই। তাঁরই ছোট ছোট প্রতিমূর্ত্তিগুলিকে দেখে সে কোনরূপে দিন গুজরান করে। যার শরীরে স্বাস্থ্য আছে, উচ্চ আশা ত্যাগ করিতে পারিলে তার আবার ভাবনা কিসের? জাহাজে পৌঁছিলে পর ৩০ সেণ্টের পরিবর্ত্তে আমি তাকে কিছু বেশী দিলাম। নির্ব্বাক কৃতজ্ঞতা যে কাকে বলে সেই দিন আমি প্রথম দেখলাম।

 চীন দেশে মেয়ে-পুরুষে দিন নাই রাত নাই সর্ব্বক্ষণই খাটে। কখনও কখনও বা শিশুটিকে পিঠ থেকে নামিয়ে কোলে নিয়ে মাই দেয় ও ভয়ে ভয়ে এবং সলজ্জ দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে দেখে, কেউ তার দিকে, চেয়ে দেখছে কি না। চীনেম্যানরা তাকায় না, অন্য দেশের লোকেরা তাকায়।

 চীনে বোটওয়ালীর কথা বল‍্তে গিয়ে এতখানি হইল তার কারণ, আমি চীনেম্যান সম্বন্ধে যা কিছু দেখেছি, তা আমার বড় বিস্ময়কর ব’লে মনে হয়েছে। কলিকাতা হ’তে এত পথ গিয়াছিলাম কেবল দেশে চীনেম্যান দেখব ব’লে। ব্রহ্ম ও মালয় দেশ আমার তত ভাল লাগে নাই। তাদের সম্বন্ধে বেশী কিছু জানিও না লিখিও নাই। পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে পর্যবেক্ষণ করিয়াছি।

 এই সকল চীনে বড় বজরা ও কিস্তী নৌকা (জাঙ্ক) ও সাম‍্পান ছাড়া বন্দরে বিস্তর অর্ণবপোতও দেখ‍্লাম। নানা দেশের ছোট বড় নানা আকারের অর্ণবপোত নানা রকমের নিশান উড়িয়ে গতায়াত করিতেছে। তার মধ্যে অনেক গুলিতেই “ড়্রাগন” আঁকা নিশান উড়িতেছে। ইংলেণ্ডের যেমন “ইউনিয়ন জ্যাক,” চীন রাজ্যের তেমনি “ড্রাগন” —গিরগিটির মত এক রকম জানোয়ার অঙ্কিত নিশান। লাল কালো হল‍্দে রঙে ড্রাগন আঁকা, —দেখলে মনে হয় যেন যথার্থই হাঁ ক’রে কামড়াতে আসছে! চীনারাজ্য নিকটে ব’লে সকল জাতিই এখানে চীনে নিশান উড়ায়। এই সকল জাহাজের মধ্যে অনেকগুলিই রণতরী,—মানোয়াবী জাহাজ ও ক্রুজার জাতীয় জাহাজ দিনের মধ্যে দশ পোনের খানি যাতায়াত করে। তাহাদের সম্ভাষণার্থ হংকং এর নিকটস্থ কাউলন কেল্লা হইতে অহরহ তোপধ্বনি শুনা যায়। চীন সমুদ্রে গিয়া অবধি আমার সর্বদাই রুষ-জাপান যুদ্ধের কথা মনে হ’ত। সকল সভ্য দেশেরই রণতরী, পাছে কোন গোলমাল উঠে এই আশঙ্কায়, সদাই যুদ্ধার্থ সুসজ্জিত আছে। জাহাজের সকল লোকের মুখেই রুষ-জাপান যুদ্ধের কথা।

 সকল জাতিরই জাপানের দিকে টান। এমন কি একটা বৃদ্ধ ফরাসী সওদাগরেরও দেখলাম জাপানের প্রতি সহানুভূতি। তিনি অতি সরলভাবে ব’লতেন,—“যেমন একটা বড় লোকের সঙ্গে একটি ছোট ছেলের কুস্তী হ’লে সকলেরই ছেলেটার দিকে টান হয়, তেমনি সকল লোকেরই জাপানের জন্য সহানুভূতি স্বাভাবিক। তবে জাপান যখন বড় বড় যুদ্ধে জিতবে, তখন আবার অনেক ইউরোপীয়ানের চোখ টাটাবে। এসিয়াবাসীর কাছে ইউরোপের পরাস্ত হওয়া বড় অপমানের কথা। বিজিত অন্যান্য এসিয়াবাসীর তাতে চোখ ফুটুবে। ইংলণ্ডের জাপানপক্ষ সমর্থন কেবল মৌখিক মাত্র। স্বার্থ আছে ব’লেই ইংলণ্ড এরূপ করিতেছে। জাপানের দুর্দ্দিনে ইংলণ্ড কখনও সাহায্যার্থ অগ্রসর হবে না। জাপান হারিলে জাপানের অস্তিত্বই লোপ পাইবে। আর এখন জাপান যতই জিতুক, শেষে তাকে হারিতেই হ'বে -যদি রুষিয়ায় ঘরোয়া গোলমাল না বাধে।”[]

 প্রতি বন্দরেই জাহাজের জন্য সংবাদ পত্র লওয়া হইত,তাহা হইতে যুদ্ধের অনেক খবর পাইতাম। এইতো ভীষণ চীন সমুদ্র, জাপানের দিকে আরও ভীষণতর। টর্পেডোর আঘাতে ও গোলার চোটে যখন জাহাজগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করে, তখন কত শত লোক এক নিমেষের মধ্যে বিনষ্ট হয়। ডুবে মরা, পুড়ে মরা, বম্ব-সেলের আঘাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খণ্ড বিখণ্ড হ’য়ে মরা, কি ভীষণযন্ত্রণাদায়ক! ঐরূপ ব্যাপারই সেখানে দিবানিশি ঘটিতেছে; আত্মীয়স্বজনের কুশল-কামনা ব্যর্থ ক’রে অসংখ্য মানব, পতঙ্গের মত প্রাণ বিসর্জ্জন দিতেছে।

 এদিকে যেমন হংকং দ্বীপ, অপরদিকে অনতিদূরে চীন-সম্রাটের শাসনাধীন চীন দেশ অবস্থিত। দুটী এত নিকট নিকট যে, গোলাগুলি মারিলে তাহা হংকং দ্বীপ হইতে তথায় পৌছায়। অনেক নৌকা ষ্টীমার ও জাহাজ অনবরত হংকং হইতে তথায় যাতায়াত করিতেছে। তার মধ্যে একটী স্থান ক্যাণ্টন।

 চীনরাজ্যের দক্ষিণ অংশে যত নগর আছে, তার মধ্যে ক্যাণ্টন সর্ব্বাপেক্ষা বড় সহর, স্বনাম-প্রসিদ্ধ একটি নদীর তীরে অবস্থিত। হংকং হইতে আমেরিকান কোম্পানীর জাহাজ দিনে দু’খানি সেখানে যায় আসে এবং বারো ঘণ্টায় হংকং হইতে ক্যাণ্টনে গিয়া পৌছায়। পুর্ব্বেই বলিয়ছি এ সকল অঞ্চলে আমেরিকানদের কাজ কারবারই বেশী। সেইরূপ নিকটবর্ত্তী আরও অনেক স্থানে তাদেরই জাহাজ যাতায়াত করে। ক্যাণ্টন যাইবার জাহাজ গুলির নীচের তলায় কেবল 'ট্যাঙ্ক’ অর্থাৎ বড় বড় চৌবাচ্চায় পরিপূর্ণ। সেইখানকার জলে নানা রকমের মাছ জীয়াইয়া আনা হয়। জাহাজের অন্যান্য তালা চীনে যাত্রীতে পরিপূর্ণ। জাহাজে অবস্থিতিকালে চীনে যাত্রীদিগকে একটি প্রশস্ত কামরায় তালা চাবি দিয়া রাখা হয়। এরূপ করার কারণ, পূর্ব্বে চীনদেশে বোম্বেটে দস্যুর সংখ্যা অতিশয় বেশী ছিল। তাহারা যাত্রী সাজিয়া জাহাজে উঠিত এবং জাহাজের সকলকে হত্যা করিয়া তাহাদের সর্ব্বস্ব অপহরণ করিত। তাই সকল যাত্রীদিগকেই আবদ্ধ করিয়া রাখা হয়।

 ক্যাণ্টনের মত বহু লোক-পূর্ণ সহর আর কোথাও নাই। সহরটি আয়তনে খুব বড় নহে, অথচ তথায় ত্রিশ লক্ষ লোকের বাস। কলিকাতায় দশ লক্ষ লোকের বাস। নদীর উপর বোটে বাস করে, এমন লোকের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। নদীমধ্যস্থ একটি দ্বীপে বিদেশীদের আড্ডা। সেখানে যাইবার সাঁকো পথে সর্ব্বদা প্রহারিগণ পাহারা দিয়া থাকে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বিদেশে দ্বীপই সর্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থান। কারণ দেখিতে যতই ভাল মানুষ হউক, নিজদেশে বিদেশীকে অসহায় পাইলে চীনেম্যানরা তাহার প্রতি বড়ই অত্যাচার করে। এখানে আফিম্ বিক্রয়ের কোনও মানা নাই বলিয়া, আফিমসেবী চীনেম্যানরা কাপড় তোরঙ প্রভৃতির ভিতর করিয়া এখান হইতে লুকাইয়া হংকংএ আফিম্ লইয়া যায়। সেই কারণে হংকংএ জাহাজ পৌছিলেই শিখ পুলিস আসিয়া চীনে যাত্রীদের কাপড় ও বাক্সের ভিতর আফিম আছে কিনা তাহার তদন্ত করে।

 জাহাজ নঙর করিয়া সিঁড়ি ফেলিবামাত্র অসংখ্য ফিরিওয়ালারা আসিয়া জাহাজে উঠিল। তারমধ্যে অনেকেই খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপারী। বড় বাঁকে করিয়া রাঁধা ভাত মাছ তারকারী প্রভৃতি আনিয়া, তাহারা দোকান খুলিয়া বসিল। জাহাজে বসিয়াই চীনে যাত্রী তাহাদের নিকট হইতে রাঁধা ভাত তরকারী কিনিয়া থাইতে লাগিল।চীনেম্যানরা আহারের কথা বিস্তৃত করিয়া বলা আবশ্যক; অন্য প্রবন্ধে তাহা বলিব।

  1. এই প্রবন্ধ লেখার পর রুষ-জাপান যুদ্ধ থামিয়াছে। মার্কিন রাজ্যর প্রেসিডেণ্ট রুজভেল্টের আন্তরিক চেষ্টায় উভয় জাতির মধ্যে সন্ধি-বন্ধন হইয়াছে। এই যুদ্ধে জাপান পৃথিবীতে কিরূপ গৌরব,কিরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন,তাহা কাহারও অবিদিত নাই। রুষিয়ার ঘরোয়া-বিবাদ এখনও মিটে নাই। এ গ্রন্থে সে সব কাহিণী বর্ণনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে।—লেখক।