চীন ভ্রমণ/হং কং (দ্বিতীয় প্রস্তাব)
হং কং।
[ দ্বিতীয় প্রস্তাব। ]
জাহাজ নঙর করিলেই যে তখনি নামা যায়, তাহা নহে | ডেকের চারিদিক কাঁধের সমান উচু মোটা কাঠের পাঁচিরে ঘেরা। এইটি খুলিতে হয়। ডেক হইতে জল প্রায় ১০ কি ১৫ হাত নীচে। সেখানে নামিবার জন্য সিঁড়ি ফেলিতে হয়। এ সব ঠিক হইলেও প্রথম অবস্থায় যাত্রীর এত ভিড় হয় যে, তাহার ভিতর দিয়া যাতায়াত করা দুঃসাধ্য। ইত্যবসরে অসংখ্য ফিরিওয়ালা নানাপ্রকার বিক্রায়ের দ্রব্য লইয়া জাহাজে বেচিতে আসে। আহারের দ্রব্যই তার মধ্যে সর্ব্ব প্রধান।
বড় বড় বাঁকে করিয়া ভাত,তরকারী,মাছ,মাংস ইত্যাদি নানা রকম রাঁধা দ্রব্যাদি আনিয়া ফিরিওয়ালা জাহাজের আশে পাশে দোকান খুলিয়া বসে। জিনিষগুলি এমন সুকৌশলে সাজান যে, রাশি রাশি দ্রব্যাদি থাকিলেও একটী পড়ে না বা ভাঙ্গে না,—বাহির করিয়া লইতে বা রাখিতে কোন অসুবিধা হয় না। ফিরিওয়ালদের ভারেই উনান আছে। গরম থাকিবে বলিয়া সেই সব উনানে দ্রব্যগুলি বসান থাকে। সব খাবারই গরম পাওয়া যায়।
নিজে অগ্নিমান্দ্যে ভুগি ব’লে পরে কি খায়, কেমন ক’রে থায় ও কিরূপ হজম করে এ সংবাদ লইতে বড়ই ইচ্ছা হয়। তাই অনিমেষনয়নে চীনেম্যানদের খাওয়া দেখিতাম।
তাহারা কখনও আহারের সময় উত্তীর্ণ হ'তে দেয় না;শত কাজ থাকিলেও যথাসময়ে খাইবেই খাইবে। গরম জিনিষ ভিন্ন কখনও ঠাণ্ডা জিনিষ তাহারা থায় না। কখনও হাত দিয়ে খায় না। “চপ ষ্টীক্" নামক এক প্রকার কাঠি আছে, তাহাই ডান হাতের অঙ্গুলির দুই ফাঁকে দুইটি ধরিয়া তদ্বারাই আহারীয় দ্রবাদি অতি দক্ষতার সহিত উঠাইয়া খায়। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, তাহাদের প্রধান আহার ভাত ও মাছ। মাঝখানে একটি বড় পাত্রে করিয়া ভাত রাখা হয়। পাত্রের চতুঃপার্শে কাঠের থালার উপর কাচকড়ার বাটীতে তরকারী সাজান থাকে। সকলে চতুর্দ্দিকে ঘিরিয়া বসে। প্ৰত্যেকে এক একটী ছোট পেয়ালা করিয়া ভাত লইয়া বাম হাতে কারিয়া মুখের কাছে ধরে ও ডান হাতের কাটী দিয়া অল্প অল্প ভাত মুখের মধ্যে উঠাইয়া দেয়; আর মধ্যে মধ্যে এইরূপে তারকারীর বাটী হইতেও তরকারী উঠাইয়া লইয়া মুখে দেয়। ছিবড়ে বা মাছের কাঁটা ঐ কাঠি দিয়া মুখ হইতে বাহির করিয়া লইয়া সম্মুখে এক জায়গায় জমা করে। এত দক্ষতার সহিত তাহারা কাঠি দুটী চালনা করে যে, একটি ভাত বা একটু তরকারী স্থানান্তরে পড়ে না। অনেকেই এক বাটি হইতে তরকারী লইয়া থাকে। বিক্রেতাও মধ্যে মধ্যে আপনার দ্রব্য হইতে উঠাইয়া লইয়া খায়। এক সঙ্গে খায় ও বেচে। “সক্ড়ী” বলিয়া কোনও বিচার নাই। খেয়ে
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
আঁচায় না ও মলত্যাগের পর জলশৌচ করে না, কাগজ ব্যবহার করে। জল ব্যবহারে বড়ই নারাজ। এক পেয়ালা রাঁধা ভাত ও চার রকম তারকারীর মূল্য ২ সেণ্ট, অর্থাৎ দু’পয়সা মাত্র। এইরূপ দুই পেয়ালামাত্র ভাত পাইলেই তাহার এক বেলার খোরাক হয়। তারা তিন বেলা থায়,—সকাল ৮টা দুপুর ১টা ও সন্ধ্যা ৬টা। খাবার পরিমাণ ধরিলে, আমরা দুইবারে যত খাই তদপেক্ষা তাহারা অনেক কম খায়।
চীনেম্যানদের হজমশক্তি এত সতেজ থাকে। তার অনেক কারণ আছে। কাঠি দিয়া অল্প অল্প ভাত উঠাইয়া খায় বলিয়া আস্তে আস্তে বেশ চিবাইয়া খাওয়া হয়। খেতে বসে তারা কখনও জল খায় না। ঠাণ্ডা সরবৎ প্রভৃতি জিনিষ কখনও খায় না। মাঝে মাঝে ছোট পেয়ালায় ক'রে দুধ চিনি বিহীন সবজে চা সিদ্ধ খায়; একত্রে বসিয়া খাইতে খাইতে নানা গল্প করে। পরিমাণে অল্প খায়। আস্তে আস্তে অনেক ক্ষণ ধরিয়া খায়। যথেষ্ট কায়িক পরিশ্রম করে। ধনী হইলেও বসিয়া শুইয়া সময় কাটায় না। অন্য কিছু করিবার না থাকিলে জুয়া খেলে। লেখা পড়ার সহিত বড় একটি সম্বন্ধ নাই। সদা সন্তুষ্ট চিত্তে মনের আনন্দ লইয়াই আছে। সকল শ্রান্তি, সকল ব্যথা আফিম সেবনে জুড়ায়। এই সকল নানা কারণে যা খায় তাই সুহজম হয়, দেহও খুব সুস্থ ও সবল থাকে। আজ কাল যে আমাদের দেশে দেশশুদ্ধ লোক ডিসপেপসিযায়(অগ্নিমান্দ্য রোগে) ভুগচে, তার একটি প্রধান কারণ তাড়াতাড়ি খাওয়া। পাঁচ পাঁচটি আঙ্গুলোর সাহায্যে, আফিস স্কুল যাইবার ব্যস্ততায়, ভালরূপে না চিবাইয়া তাড়াতাড়ি আহার সেরে ফেলা অনুচিত। আমাদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া একটি অবহেলার কাজ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। চীনেম্যানদের কিন্তু খাওয়াটাই সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান কাজ।
তবে তারা খায় যা তা। সে সব থাদ্যের কথা ভাবিলেও বমি আসে। অতি জঘন্য দ্রব্যাদি,—যাহা সকল দেশের সকল লোকের হেয়, চীনেম্যানরা তাহা আদরের সহিত খায়। যদিও তেলাপোকা খাওয়া দেখি নাই, কৃমিজাতীয় একরূপ পোকা খাওয়া স্বচক্ষে দেখিয়ছি। অতি উপাদেয় খাদ্য বলিয়া তার জন্য আলোহিদা বেশী দাম দিতে হয়। ছোট ইন্দুর, বড় ইন্দুর ভাজা দোকানে দোকানে টাঙ্গান থাকে। পাখীর মধ্যে হাঁস ইহাদের বড় প্রিয় খাদ্য। সুধু পালক ও নাড়ি-ভূঁড়ি বাদে পায়ের নখ হইতে মুখের ঠোঁট অবধি রাখিয়া আস্ত ভাজা হয়। চতুষ্পদের মধ্যে পাঁঠা, ভেড়া প্রভৃতি উপাদেয় মাংস থাকিতে ইহারা শৃকরমাংসই সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় বলিয়া মনে করে। তারমধ্যে আবার সর্বাপেক্ষা সুস্বাদু অংশ নাসিকার অগ্রভাগটুকু। জীব জন্তুর নাড়ী ভূঁড়ির ভিতর হইতে বিষ্ঠাদি সাফ করিয়া তার ভিতর পোড়া মাংস পুরিয়া ভাজা অতি উপাদেয় খাদ্য। আর চর্ব্বি ও রক্ত দিয়া এক প্রকার ঝোল প্রস্তুত হয়। তাতেই ডুবিয়ে এই সকল মাংস খাইতে তারা আরও ভালবাসে। আমার নিজের যদিও খাওয়া দাওয়া সম্বন্ধে বড় ঘৃনা নাই,তবু আমারও এ সব কথা মনে হলে স্থির-সমুদ্রে সমুদ্র-পীড়া হবার উপক্রম হতো! কিন্তু এরা যেরূপ পরিস্কার পরিচ্ছন্নভাবে খায়, তা দেখলে এত জঘন্য জিনিষ খাওয়ার সে বিকটত্ব তাহা কতক পরিমাণে ক'মে যায়।
ষ্টীমারের উপরেই ফিরিওয়ালাদের নিকট বসিয়া চীনেম্যানরা কিরূপে খাইতে লাগিল, এখানে সেই বর্ণনাই করিলাম। নিজ নিজ বাড়ীতে ও হোটেল প্রভৃতি স্থানে যেরূপ আহার করে, তাহাও অনেকটা ঐরূপ। সচরাচর তারা চেয়ারে বা টুলে বসিয়া কাজ করে ও টেবিলে খায়। অনন্যোপায় না হইলে কখনও মাটিতে উবু হইয়া বসিয়া আহার করে না এবং কাজও করে না। জাপানীরা কিন্তু আমাদের মত মাটিতে বসিয়া আহার করিতে ভালবাসে এবং মাটীতে বসিয়া কাজ করার ও পক্ষপাতী। তবে আমাদের মত বসে না, –হাঁটু পাতিয়া বসার মত বসে।
এই খানেই চীনে হোটেলের কথা বলিয়া রাখি। হংকং সহরে চীনেদের একটা হোটেলে আমি গিয়াছিলাম। সেখানে অনেক নূতন জিনিষ এবং নূতন প্রথা দেখিলাম। চীনে হোটেল গলি-ঘুজিতে। আমি যে হোটেলের কথা বলচি, এ হোটেলটি খুব বড়; সহরের মধ্যে জনতাপূর্ণ একটী স্থানে অবস্থিত এবং যারপর নাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। হোটেল লোকে লোকারণ্য। অনবরত লোক ঢুকিতেছে ও বাহির হইতেছে। দরজায় চীনেম্যান কেরাণীরা লোকের হিসাব রাখিতেছে। ইউরোপীয় বা অন্য জাতীয় কর্ম্মচারী কেহই নাই। হোটেলটি দু ভাগে বিভক্ত; একভাগে সাহেবী রকমের খানা হয়, অপর দিকে চীনে বকমের; শেষোক্ত ধারেই ভিড় বেশী।
হংকং সহরের একজন চীনে গৃহস্থের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। সেই আমাকে খাওয়াইবার জন্য হোটলে আনে। আমার দেখা মাত্র উদ্দেশ্য ছিল। যেদিকে চীনেম্যানের খাওয়া হয়, সেই দিকটিই আমার ভাল লাগিল। তৎপরে হোটেলের অপর দিকেও গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাজান ঘরগুলি বিশ্রী অশ্লীল ছবিতে পরিপূর্ণ। চীনেম্যানরা ব্রাণ্ডী,হুইস্কী প্রভৃতি তেজস্কর মদ পান করে না। আফিমসেবিদের ওসব বড় সহ্য হয় না; কারণ আফিমে আলস্য আসে ও মদে উত্তেজনা বাড়ায়। তাই তারা নেহাত ক্ষীণবল বিয়ার রম প্রভৃতি মদ্য ভালবাসে। তাও আবার অর্দ্ধেক লিমনেড মিশিয়ে পান করে। এরূপ মদ খাওয়া দেখে আমি আর হেসে বাঁচি না। আর ইহাদের ‘চাট’ কুমড়ার বিচি ভাজা, শসাসিদ্ধ ও সর্ব্বতীনেবু। আহারের সময় খাদ্যদ্রব্যের ছিবড়ে কাঁটা ইত্যাদি সেই ধোপ দেওয়া টেবিলঢ়াকা কাপড়ের উপরেই ফেলিতে হয়; আহারান্তে সব শুদ্ধ চাদরখানি উঠিয়ে 珍 নিয়ে যায়। খাওয়া শেষ হইলে পরিস্কার কাচকড়র পাত্রে অডিকলম সুগন্ধি গরম জল ও সাবাঙ এবং এক একখানি ধবধবে ভিজান ভাঁজ করা তোয়ালে এক একটি লোকের জন্য প্রস্তুত থাকে। হাত মুখ ধুইয়া মুছিয়া চুরট থাইতে খাইতে বাহির হইতে হয়। এত উপাদেয় দ্রব্যাদি উপভোগ করার মূল্য এক ডলার মাত্র।
জাহাজ হইতে নামিবার আগেকার আর একটী ঘটনা পাঠক মহাশয়দের জানা উচিত। জাহাজ নঙর করার পর সিঁড়ি ফেলা হইলেই জনা কতক চীনে ধোপানী কাপড় নিতে এলো! তাদের মধ্যে এক জন এলোচুলে প্রথম শ্রেণীর সেলুনে ঢুকলো। সে তথায় আসিবামাত্রই সব চাকর-বাকার তার কাছে পতঙ্গের মত এসে উপস্থিত হ’লো। সেও চির-পরিচিতের মত আতি অল্পসময়ের মধ্যেই কাহাকে বা মিষ্টি হাসি কাহাকেও বা মিষ্ট কথা উপহার দিয়ে আমার ছোকরা চাকরের পিট চাপড়ে ব'ল্লে,—“আ গেল যা দুষ্ট ছেলে,—তুমি আমাকে এতক্ষণ বল নাই যে ডাক্তার সাহেব কাপড় কাচাতে চান!” ছোকরা এরূপ ব্যবহারে বড়ই খুসী হ’য়ে বল্লে, “আমি এখুনি তাই ব’লতে যাচ্ছিলুম ভাই।কিন্তু ৪।৫ দিনের ভেতর দেওয়া চাই।”
তারপর দিন আমাকে বলিল,— “ধোপানী আপনার কাপড় কালাই আনবো ব'ল্লে।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,— “তুমি কেমন ক'রে জানলে? আমি তো এত শীঘ্র তোমাকে তার বাড়ি তাগাদার জন্য যেতে বলি নাই? কেন তবে সন্ধ্যাবেলা তার বাড়ি গিয়েছিলে বাপু?” সে ঘাড় নীচু ক’রে রইল, এ কথায় আর উত্তর দিতে পারিল না। কাপড় কাচিয়া আসার পর সে আমাকে বলিল,—“প্রতি কাপড় খানিয় জন্য ধোপানীকে ১৫ সেণ্ট দিতে হবে।” অন্যে ১০ সেপ্ট দেয় জেনেও আমি দ্বিরুক্তি না ক'রে তাই দিলাম। দশখানি কাপড় কাচার মূল্য ১॥০ ডলার অর্থাৎ দুই টাকা এক আনা লাগিল।
যাত্রীর ভিড় একটু কমিয়া গেলে জাহাজ হইতে নামিলাম। যে নৌকার সাহায্যে তীরে আসিলাম, সে নৌকায় সপরিবারে একটি চীনে গৃহস্থ বাস করে। পা’ল তোলাতে যাই নৌকাখানি বায়ুভরে হেলিল, অমনি আমাদের ভয় হইতেছে বুঝিয়া নৌ-সীমন্তিনী বলিয়া উঠিলেন - “No fear! No fear!” অর্থাৎ-“ভয় নাই,ভয় নাই!”
তীরে নেমে দেখি ক্যাণ্টন হইতে একখানি জাহাজ তখনই আসিয়া পৌঁছিয়াছে। তার যাত্রীদের নিকট আফিম আছে কিনা তদন্ত করিতে করিতে অনেকজন শিখ পাহারাওয়ালা চীনেদের উপর নানারূপ তম্বিতাগাদ করিতেছে। আমরা হিন্দিতে পথ জিজ্ঞাসা করাতে, তাহারা দুইখানি রিকস ডাকিয়া দিল। রিকসওয়ালারা আমাদের দুই জনকে- প্রত্যেকের ৫ সেণ্ট ভাড়ায় পোষ্টাফিসে পৌছিয়া দিল। হংকংএ নামিয়াই প্রথম দৃশ্য দেখিলাম,—কোন চীনে মৃতব্যক্তির অন্ত্যোষ্টির জন্য তাঁহার মৃত দেহ শ্মশানে লইয়া যাইতেছে।
ধনী লোক মারা গিয়েছেন, তাঁর শবদেহ বাক্সে বন্ধ করিয়া লইয়া যাইতেছে, আর তার পিছনে পিছনে রিকসর সারি চলিয়াছে। অনেক গুলিতেই উচ্চৈঃস্বরে রোরুদ্যমানা চীনে স্ত্রীলোক মুখ ঢাকিয়া বাসিয়া আছেন। তাঁহাদের সকরুণ আর্ত্তনাদ শুনিয়া মনটা কেমন হ’য়ে গেল। তারা মৃত আত্মীয়ের স্নেহের কথা ও তাঁহার সহিত চির-বিচ্ছেদের কথা ভাবতে ভাবতে অধীর হ'চ্চেন। আমারও নিজের বাড়ির কথা মনে হ'তে লাগল। জাহাজের উপর অনেক দিন বাদে চিঠি পত্র পাওয়া যায়। কে কেমন আছে ভাবিয়া মনটা যেন বাড়ী আসবার জন্য ব্যস্ত হ’য়ে উঠল।
ডাকঘরে গিয়ে বাড়ীতে চিঠি লিখিব ব’লে টিকিট কিনিবার জন্য একটি ডলার দিলাম। চীনে পোষ্টমাষ্টার বলিল, “এ ডলার এখানে চলবে না।” টাকা সিঙ্গাপুরে চলে না। আবার সিঙ্গাপুরের ডলার এখানে চলে না। আবার এখানকার ডলার এময়ে চলে না। সব আলোহিদা ছাপ মারা, তাই অচল। চীন মুলুকের এইটি এক অদ্ভুত ব্যাপার, পঞ্চাশ যাট ক্রোশ গেলে পরেই যেন সব বদলে যায়। ভিন্ন ভিন্ন রকম চীনে ভাষা, ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রা, ডাকটিকিট, ও আইন। অথচ মানুষ গুলিকে দেখিতে ও তাহাদের রীতিনীতি চীনের দক্ষিণ প্রাস্তু হইতে মাঞ্চুরিয়া অবধি ও চীনের পূর্ব উপকূল হইতে তিব্বত অবধি সবই এক।
পোষ্টাফিস যে স্থানে অবস্থিত তার চারি পাশেই বড় বড় দোকান। ইউরোপীয়ানদের সহিত সমকক্ষ হইয়া এ সকল ব্যবসার দেশে চীনেম্যান ও জাপানীরা ব্যবসা করিতেছে। একটি জাপানী চিত্রকারের দোকানে কতকগুলি অতি সুন্দর সুন্দর চীন-জাপান ও রুষ-জাপান যুদ্ধের ও জাপান দেশীয় গার্হস্থ্যজীবনের এবং অন্যান্য নানা বিষয়ের চিত্র দেখিলাম। চিত্রগুলি সব বড় বড় ও দেখিতে ঠিক যেন সজীব বলিয়া মনে হয়। দু’একটি রেখা দ্বারা আঁকা। চিত্রগুলি এত সুন্দর যে তাহার আবার ফটো তুলিয়া এক একখানি দশ সেণ্ট বিনিময়ে বিক্রয় হয়। তার ক্রেতা অনেক। যে যায় সেই কেনে। আমিও অনেকগুলি কিনে এনেছি। তারই দুই একখানি এই পুস্তকে ছাপাইলাম। তবে একবার ফটো ও আবার উড এনগ্রেভীং হ'য়ে আসল চিত্রগুলির প্রাণ এ ছাপাগুলিতে নষ্ট হ'য়ে গিয়েছে। সে গুলি রঙ ফলান, জীবন্ত চিত্র, -এ ছাপা গুলি আলো-ছায়া বিহীন ছবি মাত্র।
চিত্র দেখিতে আমার বড় ভাল লাগে। দুই তিন ঘণ্টা ঘুরিয়া ঘুরিয়া সে জাপানীর কারখানায় ছবি দেখিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। তিনিও যেন কত কালের বন্ধুর মত আমাকে সব দেখাইয়া লইয়া বেড়াইতে লাগিলেন। আমি সাহেব নহি বাঙ্গালী, একথা শুনে তার আত্মীয়তা যেন আরও বাড়িয়া গেল। একটি ঘরে একটী সুন্দর ছবি দেখিলাম, তার ফটো পাইলাম না। এমন সুন্দর সজীব ছবি আমি কথনও কোথায়ও দেখি নাই। ছবির বিষয়, -“Birth of a Pearl” অর্থাৎ “মুকুতার জন্ম”। স্থির সমুদ্রের নীল জলের উপর ভাসমান একটি ঝিনুকের ডালা খুলে একটি “অনিন্দ্য-সুন্দর-মধুর মূর্ত্তি” রমণী বলচেন-"এই যে আমি এসেছি।” বালারুণের নৈসর্গিক আভাবিশিষ্ট সেই মুখের দিকে চাহিলে সবই সজীব ব’লে মনে হয়। মনে হয় যেন, তাঁর চোখের তারাগুলি নড়চে -চোখে পলক পড়চে। যেন “সাধনার ধনকে” কে অন্তরের সহিত যুগ-যুগান্তর ধ'রে ডাকছিল; এতদিন পরে দেখা দিয়ে জুড়ালেন।