চীন ভ্রমণ/পিনাঙ (দ্বিতীয় প্রস্তাব)



পিনাঙ।

[দ্বিতীয় প্রস্তাব]

 কি জানি কেন, যত যায়গায় গেলাম, তথাকার সকলকে ভারতবাসী অপেক্ষা সুস্থ শবীর, সন্তুষ্টচিত্ত ও সুখী বলিয়া মনে হইতে লাগিল। তাদের বুদ্ধি কম; সুতরাং উচ্চাশাও কম। আর উচ্চাশা নাই বলিয়া তাদের মনের অসন্তুষ্ট ও অশান্তিও নাই। অপূর্ণ উচ্চাশা হইতেই মনে অশান্তি আসে; তাই ভারতবাসীর শরীর এত অসুস্থ,—মন এত দুর্ব্বল। মালয় চীনেম্যানের সে অশান্তির ছায়া মোটেই পড়ে নাই। তাই তাদের শরীর এত সুস্থ ও দেহ এত সবল।

 এ সকল অঞ্চলের যত লোক-ব্রহ্মবাসী, মালয়, চীনেম্যান বা জাপানী,—সকলেরষ্ট শরীরের গঠন ও রীতি-নীতির অনেকটা মিল আছে। সকলেই মঙ্গোলিয়ান জাতিভুক্ত। গালের হাড় উচু; চোখগুলি ছোট ছোট ও ঈষৎ বাঁকা, রংটি ফ্যাকাসে; মুখে লোম অতি অল্প জন্মে এবং চুলগুলি লম্বা ও সোজা। ইহাদের সকলেরই প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। ময়দার বড় একটা ব্যবহার নাই। প্রায় সকলের ধর্ম্মেই অল্পবিস্তর বৌদ্ধ-ধর্ম্মের সংমিশ্রন আছে। বোধ হয় তাহাদের দেশে শুকনা মাছ খাওয়ার এত যে প্রচলন,তাহাও “অহিংসা পরমো ধম্মঃ” হইতে উৎপন্ন। নিজ হাতে প্রাণীহত্যা করিতে নাই,কিন্তু অন্যে মারিয়া দিলে খাইবার কোন আপত্তি নাই! সকলেরই ঢলঢ'লে পোষাক। অধিকাংশ লোকই আফিং ও চা-সেবী। সকলেই যেন চীনেম্যানের অনুকরণ করে। স্ত্রীলোকেরা চুল লইয়া ব্যস্ত। তাহারা পরিপাটী করিয়া খোঁপা বাধে ও সেই খোঁপাটী অনাবৃত রাখে এবং মরাল গ্রীবাটী সকলকে দেখাইতে ভালবাসে। তাই প্রাণান্তেও তাহারা মাথায় ঘোমটা দেয় না। এ অঞ্চলে কোথাও স্ত্রীলোকদের মস্তকাবরণের (head dress) প্রচলন নাই।

 যেমন একধারে সহরঠাসা লোক ও দোকান তেমনি অন্য দিকে ফাঁকা স্থানও আছে। সেখানে ধনীদের বাগান ও পাতরের বসত বাড়ী; এবং গরীবদের বাঁশ ও নারিকেল পাতা নির্ম্মিত কুঁড়ে ঘর। বড় বড় নারিকেল গাছের বন—এক একটী গাছ আমাদের দেশের গাছ অপেক্ষা তিন চারিগুণ উচ্চ; তাহার ফলগুলিও তদনুরূপ বড়। কিন্তু তার ভিতরের শাঁস সেরূপ পুরু নয় বা এদেশের নারিকেলের মত মিষ্টও না। রাশি রাশি নারিকেল পিনাঙ হইতে রেঙ্গুনে আমদানি হয়। বহ্মদেশীয় স্ত্রীলোকেরা তাহা কুচি কুচি কাটিয়া চিঁড়ে ও নানাবিধ খাবার প্রস্তুত করে এবং পচা মাছের সঙ্গে মিশাইয়া “নপ্পি” নামক চাটনীও প্রস্তুত করে। নারিকেলের মালাটি হুকার খোলের জন্য ও ব্যবহৃত হয়। পিনাঙ এর বাঁশগাছগুলিও দেখিতে অতি সুন্দর। ইহাদ্বারা চেয়ার কৌচ আদি অনেক দ্রব্য প্রস্তুত হয়; সে দ্রব্যগুলি অতি সুচারু ও দামেও অতি সস্তা। লজ্জাবতী লতায় জমি একেবারে আচ্ছন্ন। লাল গোলাকার ফুলগুলির পাশে সতেজ পাতাগুলি মানুষের পদসঞ্চারে, বেগগামী রিকসের হাওয়ায়, ধূলাতে বা মাছির ভরে অহরহ বুঁজিতেছে ও খুলিতেছে। আমি আমার পকেট বহিতে পুরিয়া ঐ লজ্জাবতীর অনেকগুলি পাতা ও ফুল আনিয়াছি।

 যে বন্দরে যখন জাহাজ লাগিত,আমি তখনই আমার “বয়"কে আমার কামরায় খাবার রাখিতে বলিয়া সহর দেখিবার জন্য জাহাজ হইতে নামিতাম। যদিও বিদেশ-বিভুঁই, তথাপি যেখানে সেখানে যাইতে ও বেড়াইতে আমার একটুও ভয় কারিত না! সর্ব্বদাই মনে হইত, সুশাসিত রাজ্যে সকলেরই ধন-প্রাণ নিরাপদ। ভীষণ বর্ব্বর জাতিরাও প্রখর সুনিয়মে নিয়ন্ত্রিত হইয়া নিরুপদ্রবে সমাজের হিতকর কার্য্যে রত হইয়াছে।

 সকল স্থানেই তীরে নামিয়া প্রথম যাইতাম ডাকঘরে। সেখানে চিঠিপত্র লিখিয়া সহর-ভ্রমণে বাহির হইতাম। ডাকঘরের সকল কর্ম্মচারী চীনেম্যান হইলেও তাঁহারা কিন্তু ইংরাজী বুঝেন। তাঁহাদের নিকট হইতে তথায় দেখিবার উপযুক্ত কি কি দ্রব্য বা স্থান আছে, তাহা জানিয়া লইতাম। তাঁহোৱাও সসম্মানে ও সযত্নে চীনে রিক্সওয়ালাকে বুঝাইয়া দিতেন, আমাকে কোথায় কোথায় লইয়া যাইতে হইবে।

 পিনাঙে প্রধান দুইটী দেখিবার জিনিষ আছে,—চীন দেশের ধর্ম্মমন্দির এবং জলপ্রপাত।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, পিনাঙ একটা পর্ব্বতময় স্থান; শুধু পিনাঙ নহে,পরে আমরা যেখানে যেখানে গেলাম, তাহার সকল স্থানই পর্ব্বতময়; পাতরের স্থান। রেঙ্গুনের মত উর্ব্বর সমতল ক্ষেত্র আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। চীনে সমুদ্রতীরও পর্ব্বতময়। জাপানও আগ্নেয়-গিরিসমাকুল পর্ব্বতময় দ্বীপ। তবে পিনাঙে ঠিক সমুদ্রতীরেই খানিকটা সমতলভূমি আছে,সহরটি তথায় অবস্থিত। উহার পিছনে ও চারিপাশে উচু উচু পাহাড়। অনেকগুলি ছোট নদী এই পাহাড় হহঁতে বাহির হইয়া, সহরের মধ্য দিয়া কুল্ কুল্ রবে সমুদ্রে গিয়া পড়িয়াছে। তাই পিনাঙে,—রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, হংকং প্রভৃতির মত পানীয় জলের অভাব নাই।

 প্রথমেই চীনদের মঠ দেখিতে গোলাম। উহা সহরের বাইরে প্রায় ৫০০ ফিট উচ্চ একটি পাহাড়ে অবস্থিত। ঠিক সেই পাহাড়ের গা বাহিয়া একটি ছোট স্রোতস্বতী যেন মৃদুস্বরে স্তুতি গান করিতে করিতে মন্দির প্রদক্ষিণ করিয়া চলিয়াছে। পাতরে বাঁধান সিঁড়ি, প্রাচীর, অট্টালিকা, বাগান, পুরোহিতের ঘর, দেবগৃহ স্তরে স্তরে উঠিয়াছে। বাগানের চারিদিকের নালায় কত পদ্মগাছ ঝরণার জলস্রোতে জন্মিয়াছে। বাগানের মধ্যে একটী উচ্চ ফোয়ারা। ঘরে পুরোহিতেরা একত্রে বসিয়া রহিয়াছে, কেহবা টেবিলে বসিয়া আহার করিতেছে। তাহাদের মস্তক মুণ্ডিত, বিনানী নাই। তাঁহারা সযত্নে আমাকে মন্দিরের সকল স্থান দেখাইলেন। তাঁহাদের ভাষা বুঝাইয়া দেয়, এমন কোন লোক ছিল না। ইঙ্গিতে যতদূর বুঝা যায়, বুঝিলাম। দেবগৃহে ভীষণাকার দেবতা বা দৈত্যের মূর্ত্তি সংস্থাপিত। মুখে ক্রোধব্যঞ্জক ভ্রূকুটি; হাতে বদ্ধমুষ্টি বা যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র; দাঁড়াইবার ভঙ্গী যেন আক্রোশপূর্ণ। সকল মূর্ত্তিরই কর্কশ ভাব। নম্র ভাবের একটী মূর্ত্তিও নাই। একটীও স্ত্রীলোকের বা বালকের মূর্ত্তি নাই। শুনিলাম পৌত্তলিক তেওস্ত ধর্ম্মোক্ত এই মূর্ত্তিগুলি চীনেম্যানদের বীর পূর্ব্ব পুরুষগণেরই মূর্ত্তি। চীনেম্যানদের বাড়ীর দেওয়ালেও এইরূপ ছবির পট দেখা যায়। যাঁহারা বিপুল পরাক্রমে চীনকে শত্রুহস্থ হইতে বাঁচাইয়াছেন, এ সকল তাঁহাদেরই প্রতিমূর্ত্তি। অধিকাংশ চীনবাসিগণ এই সকল মূর্ত্তিকেই পূজা করিয়া থাকেন। তবে মন্দিরের কোন কোন ঘরে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধদেবেরও প্রশান্তমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত দেখিলাম। চীনাবাসিগণ এই সকলকে আলো, ধূপ, ধূনাদি দিয়া পূজা করেন।

 মন্দির দেখা শেষ হইলে জল-প্রপাত দেখিতে গেলাম। উচ্চ সহর হইতে চারি মাইল দূরে অবস্থিত। পর্ব্বত-পরিখা বেষ্টিত বটানিক্যাল গার্ডেন, সেই খানেই অবস্থিত। ভিতরে ঢুকিলেই জলপ্রপাতের অস্ফুটধ্বনি কাণে যায়। সকল স্থান হইতেই সে ধ্বনি শুনা যায়, কিন্তু বুঝা যায় না। মনে হয়, নির্জ্জনে কে যেন কার কাণে কাণে মিষ্ট কথা কহিতেছে। সে স্থানটী এমন যে, একটি পাখী ডাকিলে চতুর্দ্দিকস্থ পাহাড়ে তাহা কতবার ধ্বনিত হয়। তারই ভিতর কত রকমের গাছ সযত্নে রক্ষিত। ভারতবর্ষ চীন ও অষ্ট্রেলিয়ার বিবিধ জাতীয় গাছ রক্ষা করাই এই বাগানের প্রধান উদ্দেশ্য। পথগুলি উচুনীচু, পাহা’ড়ে পথের মত ক্রমে ক্রমে উচু হইয়া জলপ্রপাতেৰ দিকে গিয়াছে। খানিকদূর গিয়া দূর হইতে জলপ্রপাতটি দেখা গেল। স্তুপাকার জলরাশি পর্ব্বতশিখর হইতে প্রায় ১০০ ফিট নীচে পড়িয়া ফেনা দোলাইতে দোলাইতে সবেগে প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে। খানিক দূর গিয়া সেই সকল জল-তরঙ্গ, উপরে সেতু ও নীচে বাধান পথের মধ্যে দিয়া শৈবালদল কাঁপাইয়া মুদুমন্দ গতিতে চলিয়াছে। চারি পাশে সে দেশের গাছ; গাছগুলি সব সতেজ। এক পাশে আমাদের দেশের চম্পকও দেখিলাম; কিন্তু উহা তত স্ফুর্ত্তি পায় নাই। আমাদের দেশের তেঁতুল গাছগুলি ছোট ছোট, ফল ও তদ্রূপ। হবেই তো, বিদেশে, অস্থানে হাজার চেষ্টা করিলেও জীবনীশক্তি স্বদেশের মত তেমন স্ফুর্ত্তি পায় না। তবে (Orchid) “অরকিড্” গুলি খুব বড়। একপ্রকার পতঙ্গভোজী গাছ আছে, তাহাকে (Pitcher plant)"পিচার প্ল্যাণ্ট্” বলে। সে গাছের “ফুল"গুলি অতি বৃহৎ ও যে যন্ত্রগুলির সাহায্যে গাছটি মাছি ধরিয়া খায়, সে যন্ত্রগুলিতে মশা মাছির কঙ্কালপূর্ণ। (Fruit Dhurion) “ঢুরিয়ান” ফল দেখিতে ঠিক আমাদের কাঁঠালের মত, দুই একটা গাছে ফলিয়াও ছিল; কিন্তু উহা হইতে একরূপ বিকট গন্ধ নিৰ্গত হইতেছিল। ব্রহ্ম, মালয় ও চীনবাসিগণ এই ফলের কিন্তু বিশেষ আদর করিয়া থাকে।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বটানিক্যাল গার্ডেনটী সহর হইতে প্রায় ৪ মাইল দূরে। তাহার নিকটবর্ত্তী স্থানে অনেক পল্লীর দৃশ্য দেখা যায়। দরিদ্র গৃহস্থদের ক্ষুদ্র চালা-ঘরের দুয়ারে গরু বাঁধা। অল্পেতেই তুষ্ট হইয়া লোকগুলি কায়িক পরিশ্রমে, সুস্থ শরীরে, অতিসুখে দিন যাপন করিতেছে। সকলেরই মুখে হাসি,—সর্ব্বত্রই আনন্দের রোল। উদ্যান হইতে বাহির হইয়া একটি স্থানে কিন্তু বড়ই মর্ম্মস্পর্শী দৃশ্য দেখিলাম। কোন গৃহের কর্ত্তা ভর্ত্তা রক্ষক ও পালক আজ ইহধাম ছেড়ে গিয়েছেন। কাপড় ঢাকা তাঁহার শবদেহ গৃহদ্বারে শয়ান আছে। মৃত ব্যক্তিৰ স্ত্রী ধূলায় লুটিয়ে কাঁদচেন। কাপড় তুলে মৃত পতির মুখ দেখতে যাচ্চেন, তাঁর আত্মীয়েরা বাধা দিচ্চে। বড় ছেলেগুলি ও ছোট ছেলে মেয়ে গুলি কাঁদচে। পাড়াপাড়শীরা কাঁদচে। লোকে পথ দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে কাঁদচে। এক প্রতিবেশিনী তার ছোট ছেলে কোলে ক’রে কাঁদচে। তার সেই ছোট ছেলেটীও মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কাঁদচে আর ছোট হাতখানি বাড়িয়ে মায়ের চ'খের জল মুছে দিচ্চে।

 বটানিক্যাল গার্ডেন হইতে আরো খানিক দূরে এক স্থানে দেখি, কতকগুলি কুলি এক জায়গায় বারুদে আগুন দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে পতর ভাঙছে। ৩া’দের মধ্যে একটী কৃষ্ণকায় বলিষ্ঠ লোক সুকণ্ঠে, কান্নার মত অতি করুণস্বরে, গান গাহিতে গাহিতে পাতর বহিতেছিল। তাহার মুখের গড়ন মালয় দেশীর মতও না, চীনেম্যানের মতও না। তাহার নাসিকা উন্নত। আমাদের দেখিয়া সে ঘন ঘন আমার দিকে চাহিতে লাগিল। অবশেষে পাতরগুলি মাটিতে নামাইয়া আমার কাছে আসিয়া হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করিল,—“আপনি কি হিন্দুস্থান হ’তে এসেছেন?” আমি আশ্চর্য্য হ’য়ে উস্তুর দিলাম,—“হাঁ কিন্তু তুমি কেমন ক’রে জানলে?” সে বলিল,—“আমার বাড়ী মাদ্রাজে। আমি বড় রাগী, ঝগড়া ক’রে একটী লোককে খুন করাতে আমার মেয়াদ হ'য়েছিল,বছর কতক হ'ল খালাস পেয়ে আমি এক ব্যবসাদারের সঙ্গে এখানে এসে কুলির কাজ কচ্চি।”  পরে সে আপনিই বলতে লাগিল,—“আমার কেউ নাই, আমি ইংরাজি স্কুলেও কিছুদিন পড়েছিলাম। তার পর এখানে এসে এক মালয় স্ত্রীলোককে বিয়ে করেছি। সে বড় ভাল। সে আমায় বলে, 'তুমি যে দেশে যাবে আমিও সঙ্গে যাব,—মার বারণ শুনব না'।”

 জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম লোকটি রোজ ২০ সেণ্ট রোজগার করে। তার স্ত্রী অনেক ভাল জিনিষ তাকেই খাওয়ায়, আপনি খায় না। সে নিজে সারাদিন খাটে, বাড়ী যেতে পায় না; আর তার স্ত্রী রোজ দুপুরৰেলা ঘরের কাজ সেরে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আজ আসে নাই। স্ত্রীর পায়ে সেদিন একটা পাতর গড়িয়ে চোট লেগেছে। তাই স্ত্রীর পায়ে আাজ সে লসুনের তেল মালিষ ক’রে দিয়ে এসেছে।

 সে বলিল,—“এক জনা বলেছিল— এতেই সেরে যাবে। তার পায়ে বড় ব্যথা হয়েছে,— সে চলতে পারে না।” এই সব কথা এমন সরল কাঁদ-কাঁদ ভাধে ব’লতে লাগল যে, আমার ইচ্ছে হ’চ্ছিল, ছুটে গিয়ে তার স্ত্রীর পায়ে এমন ঔষধ বেঁধে দিয়ে আসি, যাতে তার ব্যথা এখনি ভাল হ’য়ে যায়,—এখনি তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে।

 সেই কুলীর সহিত আমার আরো কথা কহিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমার সহযাত্রী-সঙ্গী একটী সাহেব বড় তাড়াতাড়ি করিতে লাগিলেন; সুতরাং আর বেশী কথা হইল না। আমি কেবল জিজ্ঞাসা করিলাম-“তুমি যে গানটী গাচ্ছিলে, তার মানে কি?” সে যাহা বুঝাইয়া দিল, বাঙ্গালা ভাষায় তার ভাব এইরূপ,—

 “তুমি আমার পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। আমার ঘোর দুর্দ্দিনের সময় তুমি কোথায় ছিলে? জীবনের প্রথম অবস্থায় তোমাকে পাই নাই কেন? এতদিনে পেয়েছি,—সব ব্যথা জুড়িয়ে দিয়েছ, সব কষ্ট ফুলে গেছি।”  যেরূপ অন্তরের সহিত সে গানটী গাচ্ছিল, হিন্দীতে বুঝাইযা দিবার সময়েও যেন “যার পায়ে চোট লেগেছে” তার মধুর ছবি তার অন্তশ্চক্ষুর সামনে এসে দাঁড়াল; তার মুখে খুনে দস্যুর ভাব একটুকুও দেখিলাম না।

 সে আমাদের খানিকটা এগিয়ে দিতে এল। আসিবার সময় তার কাঁধের কাছে একটা দাগ দেখে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ওটা কিসের দাগ? সে ব’ল্লে, “দু’বছর আগে যখন আমি আমার স্ত্রীকে বিয়ে করি তখন আমার শ্বশুর গু পাড়াশুদ্ধ লোক মিলে আমাকে মেরে ছিল। খুব মেরেছিল। কেটে রক্তারক্তি হ’য়েছিল। কত দিন ভুগী। ও তারই দাগ।” তারপর সে আপনিই ব’ল্লে,—“কাজ শেষ হলে যখন বাড়ী যাই আমার স্ত্রী এই জায়গায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর কাঁদে।” তার ওইরূপ সরল কথা শুনে আমার চোখে জল এলো। খুনে অশিক্ষিত কুলী যে মানবহৃদয়ের এত গূঢ় ভাব কোথা থেকে বর্ণন করতে শিখলে তা ভেবে পেলাম না।

 সারাপথ তার কথা ভাবতে ভাবতে জাহাজে ফিরে এলাম। পরদিন বিকালে ঠিক ৫টার সময় পিনাঙ হ'তে জাহাজ ছাড়িল। তখন সেই ক্লক টাওয়ারে মধুর স্বরে ঘড়ি বাজছিল।