চীন ভ্রমণ/পিনাঙ (প্রথম প্রস্তাব)

পিনাঙ।

[ প্রথম প্রস্তাব। ]

 রেঙ্গুন হইতে জাহাজ ছাড়িয়া দুই দিন দুই রাত ক্রমাগত যাওয়ার পর চতুর্থ দিন ভোরে জমি দেখা গেল। এ সকল জমি রেঙ্গুনের মত সমতলভূমি নয়; কেবল পর্ব্বতময়। উপকূলের চতুর্দ্দিকেই সমুদ্র হইতে মাছ ধরিবার বিপুল আয়োজন দেখিলাম; বড় বড় কাল রঙ্গের খুঁটী দিয়া স্থান ঘেরা-জাল ফেলা। ধীবরদের থাকিবার জন্য তীরে ছোট ছোট করুগেট আয়রণের ঘর। পা’ল তোলা নৌকার অহরহ তীর আচ্ছন্ন। ভাত আর মাছই এ সকল দেশের প্রধান আহার। এই সকল মাছ শুকাইয়া বহু দিন পর্য্যন্ত বেশ রাখা যায় ও তাহাই অন্য দূরবর্ত্তী স্থানে রাশি রাশি রপ্তানি হয়। এখানকার সকল দেশেই শুটকে মাছ একটা উপাদেয় খাদ্য। এ সকল দেশে কত নূতন রকমের মাছ দেখা যায়। ‘জেলী ফিস’ (Jelly fish) নামক এক প্রকার মাছ ঠিক জলের উপর ভাসিয়া বেড়ায়। চিত্র-বিচিত্র করা ছাতার মত দেখিতে। তার চতুর্দ্দিক হইতে যেন নানা রঙ্গের ফল-ফুল ঝুলিতেছে। (Cuttle fish) 'কাটেল ফিস’ নামক আর এক রকম লম্বা লম্বা দাঁড়াসংযুক্ত গোল মাছ মাথা নীচের দিকে করিয়া জলের ভিভর ঘুরিয়া বেড়ায়। ইহারা বড় হিংস্ৰক ও প্রণীভোজী; কিন্তু চীনেম্যানেরা অতি উপাদেয় মনে করিয়া এই জাতীয় শুকনা মাছ খায়।

 বন্দরে জাহাজ ঢুকিবামাত্রই অসংখ্য “সামপান” আসিয়া জাহাজের চারি ধার ঘিরিল; মাঝিরা সকলেই চীনেম্যান। তাহারা তাহাদের প্রিয় নীলবর্ণের ঢলঢ়’লে পোষাক পরিয়া ক্ষিপ্রহস্তে দাঁড় বাহিয়া জাহাজের সহিত চলিতে লাগিল। চীনে যাত্রীদের সহিত উচ্চৈঃস্বরে খোনা খোন চীনে ভাষায় তাহাদের কথাবাৰ্ত্তা চলিতে লাগিল। বোধ হয় তীরে নামাইবার দর দস্তুরের কথা হইতেছিল। জাহাজের উপর দড়ি ছুড়িয়া দিয়া তাহারা সেই দড়ি ধরিয়া জাহাজে উঠিল। সিন্দুক ও তোরঙগুলিও দড়ি বাধিয়া জাহাজ হইতে সামপানে ফেলিয়া দিতে লাগিল। বিষম কোলাহল হইতে লাগিল ও ব্যগ্রতার চিহ্ন চারিদিকে দেখা গেল। কাড়াকাড়ি, মারামারি দেখিয়া আমি মনে করিলাম, নিশ্চয়ই কতকগুলি লোক মরিবে ও জখম হইবে; কিন্তু সেরূপ কোন দূর্ঘটনা হইল না।

 মালয়দেশ হইতেই চীনেম্যানের দেশ আরম্ভ হইল বলিলেই চলে। রেঙ্গুনে তিন ভাগের এক ভাগ চীনেম্যান। এখানে শতকরা ৮০ জন চীনেম্যান। প্ৰায় সব ব্যবসাদার চীনে। কুলি মুটে মজুর অধিকাংশই চীনে। অসংখ্য জীন-রিক্সা বা ঠেলাগাড়িওয়ালা; সকলেই চীনে। চীনেম্যান সম্বন্ধে এত কথা বলিবার আছে যে,তাহা এ প্রবন্ধে কুলাইবে না; স্বতন্ত্র প্রবন্ধে সেই সকল কথা বলা হইবে। চীনেরা অদ্ভুত জাতি। আকৃতি, রীতি, নীতি, আচার, ব্যবহার ও ভাষা,—সকল রকমেই ইহারা আমাদের হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন।

 তীরে একটি বড় (Clock Tower) ক্লক টাওয়ার ও তার ধারেই একটি ছোট জেটি আছে। সেখান হইতে বোঝাই হইয়া মালপত্র ছোট রেলগাড়ী সহযোগে সহরের ভিতর নীত হইতেছে। রাস্তাগুলি চওড়া ও অতি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, সাদা কাঁকর ও বালি দিয়ে বাঁধান। ঠেলাগাড়ী ছাড়া ঘোড়ার গাড়ী বেশী নাই বলিয়া রাস্তা খারাপও হয় না। আমাদের কলিকাতার মত ঐ রাস্তার ধারে ফুটপাথ নাই। দুই ধারেই দোকান। অধিকাংশ দোকানেই বিলম্বিত-বেণী চীনেম্যান নিবিষ্টচিত্তে আপন আপন কাজ করিতেছে। রিক্স গাভী চতুর্দ্দিকে অবিশ্রান্ত যাতায়াত করিতেছে। একবার জাহাজ হইতে কিনারায় নামিলে হয়; অমনি দশখানি রিক্স তোমাকে ঘেরিবে।

 সকলেই তোমাকে চড়াইতে ব্যস্ত। এত মানুষ, ও মানুষের পরিাপ্রমের মূল্য এত সস্তা যে, দুই জন মিলিয়া একখানি রিকসতে চড়িয়া যতক্ষণ ইচ্ছা বেড়াও। প্রতি ঘণ্টায় ২০ সেণ্ট মাত্র দিতে হইবে। এখানকার মুদ্রার নাম ‘সেণ্ট’ (Cent) ও ‘ডলার” (Dollar)। আমাদের দেশের মুদ্রার এক টাকা ছয় আনায় একটি ডলার পাওয়া যায়। ১০০টী সেণ্টে একটি ডলার হয়। এক টাকায় যেমন ৬৪টি পয়সা, তেমনি ৭০টা সেণ্ট পাওয়া যায়। কলিকাতায় চিঠি লিখিবার জন্য পোষ্টকার্ডের দাম ৩ সেণ্ট ও টিকিটের দাম ৪ সেণ্ট। রিকস গাড়ীগুলি দেখিতে ছোট বগী গাড়ীর মত—দ্বিচক্র, হালকা ও নানা রঙ্গের ফুল, পাখী ইত্যাদি চিত্র-বিচিত্র করা। জানু অবধি পা, কাটা পাজামা ও কনুই অবধি হাত কাটা ঢলঢ়’লে কোট পরিয়া এবং প্রখর আতপ নিবারণের জন্য একটিী চেঁচাড়ীর হ্যাট(Straw hat) মাথায় দিয়া, ঘাম মুছিবার জন্য গলা হইতে একখানি রুমাল ঝুলান সুগঠন চীনেম্যান, যাত্রীসহ দ্রুতবেগে এই গাড়ীগুলি দিনে আট ঘণ্টা দশ ঘণ্টা টানিয়া বেড়াইতেছে। এত অধিক পরিশ্রমের ফলেই তাহারা হৃদরোগগ্রস্ত হয় এবং ১০।১২ বৎসুর এইরূপ পরিশ্রম করার পর, অল্পবয়সে হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। চীনেম্যানদের মধ্যে হৃদরোগ সচরাচরই দেখা যায়।

 মালয়দেশ ও তাহার অধিবাসী সম্বন্ধে আমি বেশী কিছু দেখি নাই; কাৰণ এ সকল স্থানে চীনেমানেই পনর আনা, মালয় অতি কম। তবে যা দেখেছি তাহাতে মনে হয়, সে দেশের লোকেরা অতি দুর্দ্দশাগ্রস্ত। তাহারা বেঁটে, সুস্থকায় ও সবল; কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্য বড় একটা তাহাদের নিজেদের হাতে নাই। এখানকার ভূমিও ব্রহ্মদেশের মত তত ধন-ধান্যে পূর্ণ নয়। ব্রহ্মে তবুও স্ত্রীলোকেরা ব্যবসা করে,—দোকান করে; কিন্তু এখানে কেহই সেরূপ কাজ করে না। একটা কথা প্রচলিত আছে, “Malay is a good horseman” অর্থাৎ ঘোড়ার কাজে মালয় খুব মজবুত যেমন চড়িতে, তেমনি তার তোয়াজ করিতে। সকলেই ছোট কাজ লইয়া আছে। ইহারা হয় ঘোড়ার গাড়ীর সহিস-কোচওয়ানি, নয় পোষ্টপিয়ন, বেহোরা বা পাহারাওয়ালার কাজ করে। অতি পরিপাটী প্রভুদত্ত সুন্দর পোষাক পরিয়া তাহারা সুস্থ শরীরে সন্তুষ্টচিত্তে নিজ নিজ কাজ করিতেছে। তাহারা মুসলমান ধর্ম্মাবলম্বী কিন্তু দাড়ী রাখে না।

 তাহারা আমাদের মত ছোট করিয়া চুল ছাঁটে,—চীনেম্যানের মত আজানুলম্বিত বেণী (Pigtail) ইহাদের নাই। লুঙ্গী পরে, কোট গায়ে দেয় ও বাঁকা করিয়া কেপ (Felt cap) মাথায় দেয়। স্ত্রীলোকদের তেমন অবরোধ প্রথা নাই। অনেকে মাথায় কাপড় অবধি দেয় না। তবে কেহ কেহ মাথায়ও কাপড় দেয় ও বাহিরে যাইবার সময় রিকস গাড়ীর সামনের পরদাটী একটু তুলিয়া দেয় মাত্র।

 তাহাদের মসজিদ প্যাগোডার মত চূড়াবিশিষ্ট, এখানকার মসজিদের মত নহে। তাহাদের ভাষা মালাই; কিন্তু আরবী অক্ষরে লিখিত হয়। বহুদিন পূর্ব্বে মুসলমান ধর্ম্ম প্রচারকালে আরব জাতির প্রভাব, ব্যবসাসূত্রেই হউক বা ধর্ম্ম প্রচারার্থ ই হউক, এই সকল দেশ অবধি প্রসারিত হইয়াছিল। সেই সময় হইতে এদেশে মুসলমানধর্ম্ম ও আরবী অক্ষর প্রচলিত হইয়াছে। ব্রহ্মদেশ ডিঙ্গাইয়া আরব জাতির ধর্ম্ম ও বর্ণমালা এখানে যে কেমন করিয়া, কাহা কর্ত্তৃক প্রথম প্রবর্ত্তিত হইয়াছে,তাহা জানিবার উপায় নাই। —