চূর্ণ প্রতিমা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
পরদিন বেলা আটটার পর আমি বাড়ী হইতে বাহির হইলাম এবং একখানি সেকেণ্ড ক্লাশ ভাড়াটীয়া গাড়ীতে উঠিয়া কোচমানকে কুমারটুলি যাইতে হুকুম করিলাম।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি কুমারটুলিতে উপস্থিত হইলাম। নফরের দোকান খুঁজিয়া লইতে অধিক বিলম্ব হইল না। সে অঞ্চলে নফরের মত কারিগর অতি অল্পই ছিল, সুতরাং নফরের নাম ডাক যথেষ্ট।
নফরের দোকানের সম্মুখেই আমার গাড়ী থামাইতে বলিলাম। গাড়ী থামিলে, নামিয়া কোচমানকে ভাড়া চুকাইয়া দিলাম। কোচ- মান আশার অধিক অর্থ পাইয়া হাসিমুখে সেলাম করিয়া বিদায় হইল।
শশব্যস্তে একজন লোক দোকানের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল। বলিল, “কি চান্ মশায়? ভিতরে আসুন না।”
লোকটাকে দেখিয়া বোধ হইল, তাহারই নাম নফর। তাহাকে দেখিতে কৃষ্ণবর্ণ, স্থূল, নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব্ব। তাহার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। অতি শিষ্ট শান্ত; একজন পাকা দোকানদার।
ঘরের ভিতরে চারিজন লোক মাটীর পুতুল গড়িতেছে। সকলেই কাজে ব্যস্ত। সম্মুখে এক একটা মাটীমাখান ছোট চৌকি। চৌকির উপর এক এক তাল কাল মাটী ও কতকগুলি করিয়া ছাঁচ, একটা হাঁড়ীতে খানিক কাদাগোলা জল ছিল।
আমি সেই লোকের মিষ্টকথায় পরিতুষ্ট হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “এইটী কি নফরের দোকান?”
লোকটা একে আমায় গাড়ী হইতে নামিতে দেখিয়াছে, তাহার উপর আমার পরিচ্ছদ নিতান্ত সামান্য ছিল না। নফরের সহিত দেখা করিব বলিয়াই আমি বাবু সাজিয়া গিয়াছি। লোকটা যখন শুনিল, “আমি নফরের দোকান খুঁজিতেছি, তখন সে এক গাল হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞা হাঁ, এইটীই এই অধীনের দোকান। আমারই নাম নফর।”
আগেই বলিয়াছি যে, আমিও সেইরূপ ভাবিয়াছিলাম। বলিলাম, “তোমারই নাম নফর? তুমি না কি খুব ভাল পুতুল গড়িতে পার? শুনিয়াছি, এ অঞ্চলে তোমার মত কারিগর আর নাই।”
এইরূপ প্রশংসাবাদ শুনিয়া নফর আন্তরিক সন্তুষ্ট হইল। বলিল, “আপনি ভিতরে আসিয়া দেখুন। দোষ গুণ নিজেই বিচার করিবেন।”
আমার উদ্দেশ্যও সেইরূপ ছিল। নফরের সঙ্গে তাহার দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরের একটা কোণে আর একখানি চৌকি রহিয়াছে; কিন্তু সেখানে কোন লোক নাই।
নফর আমাকে আর একটা ঘরে লইয়া গেল। দেখিলাম, সেখানে একটা কাচের আলমারির মধ্যে নানারকমের ভাল ভাল পুতুল সাজান রহিয়াছে। প্রায় আধ ঘণ্টাকাল পুতুলগুলি অতি মনোযোগের সহিত দেখিলাম, যতবার দেখি, আশ যেন আর মেটে না। যে পুতুলের দিকে চাই, চক্ষু যেন আর নাড়িতে ইচ্ছা করে না। শুনিলাম, পুতুলগুলি কাঁচা মাটীর। কাঁচা মাটীর উপর তেমন সুন্দর রং আর কখনও দেখি নাই। নফরের কাজ দেখিয়া তাহার সুখ্যাতি না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। বলিলাম, “এই সকল পুতুল কি তুমি নিজে গড়িয়াছ?”
নফর হাসিতে হাসিতে উত্তর করিল, “আজ্ঞা না—ইহার কোন পুতুলই আমার হাতে গড়া নয়। আমি এইগুলির ছাঁচ প্রস্তত করিয়াছি। আমার কারিগরেরা সেই ছাঁচের সাহায্যে পুতুল গড়িয়া থাকে।”
আমি বলিলাম, “পুতুলগুলি অতি সুন্দর। কৃষ্ণনগরের কারিগর ভিন্ন এরূপ মাটীর পুতুল আর কেহই গড়িতে পারে না। এমন চমৎকার রং ফলান আর কখনও দেখি নাই।”
আরও কিছুক্ষণ সেই ঘরে থাকিয়া আমরা বাহিরের ঘরে আসিলাম। দেখিলাম, দুইখানি তক্তার উপর কতকগুলি পুতুল রহিয়াছে। নিকটে গিয়া দেখিলাম, একখানি তক্তায় পাঁচটী শিবমূর্ত্তি, অপর তক্তাখানিতে ছয়টী শ্যামামূর্ত্তি। যে চারিজন লোক কাজ করিতেছিল, তাহাদের মধ্যে একজন আর একটী শিব গড়িতেছে। অপর তিনজন অন্য পুতুল গঠন করিতেছে।
অনেক রকম শ্যামামূর্ত্তি এই কলিকাতা সহরে দেখিয়াছি। কলিকাতা ভিন্ন অপরাপর স্থানের শ্যামামূর্ত্তিও আমি অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু সেই ক্ষুদ্র প্রতিমার মত সর্বাঙ্গসুন্দর প্রতিমূর্ত্তি আর কোথাও আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই।
আমি নফরকে সেগুলি দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ঐ প্রতিমাগুলির দাম কত?”
আগেই বলিয়াছি যে, নফর একজন পাকা দোকানদার। সে দেখিল যে, কালীর প্রতিমাগুলি আমার মনোনত ইইয়াছে। তাই বলিল, “আজ্ঞে বেশী নয়—পাঁচ টাকা।”
আ। আর ঐ শিবের মূর্ত্তিগুলি?
ন। আজ্ঞে—একই দর।
আ। মাটীর পুতুলের এত দর? প্রতিমাগুলি আট ইঞ্চির অধিক বড় নয়। আর যখন ইহা ছাঁচে প্রস্তত হয়, তখন এত দরই বা কেন?
ন। আজ্ঞে বড় পরিশ্রম। একটা লোকে চারিদিনের কমে একখানা প্রতিমা গড়িতে পারে না।
আ। এত দরের মাটির পুতুল কয়জনে কিনিতে পারে?
ন। আজ্ঞে, আপনার আশীর্ব্বাদে আমি যোগাইতে পারি না।
আ। পাঁচ টাকা করিয়াই বেচিয়া থাক?
ন। আজ্ঞে না—আর মিথ্যা বলিব না। পাঁচ টাকা জোড়া।
আ। তবে আমায় এক জোড়া দাও।
ন। আপনাকে কিছু বেশী দিতে হইবে।
আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন বাপু! আমার অপরাধ কি?”
আমার কথা শুনিয়া নফর হাসিতে হাসিতে বলিল, “আগে ঐ দরে পুতুলগুলি বিক্রয় করিয়াছি বটে, কিন্ত এখন আর করিতে পারিব না।”
আ। কেন?
ন। আমার একটী কারিগর উন্মাদ হইয়া গিয়াছে। সেই লোকটাই আমার ভাল কারিগর ছিল। ঐ দেখুন না, তাহার চৌকিখানি খালি পড়িয়া রহিয়াছে।
আ। সেই লোকই বুঝি ঐ শ্যামা-প্রতিমাগুলি গড়িয়াছিল?
ন। আজ্ঞা হাঁ।
আ। লোকটা হঠাৎ পাগল হইয়া গেল?
ন। আজ্ঞে হাঁ।
আ। কোন কারণ জানিতে পারিয়াছ?
ন। কই না। তবে বিনা কারণে তাহাকে একদিন হাজতে থাকিতে হইয়াছিল বলিয়াই বোধ হয়, সে পাগল হইয়া গিয়াছে।
আ। সে কি! হাজত হইল কেন?
ন। রথযাত্রার দিন একটী বাবু আমার দোকানে আসিয়াছিলেন। তাঁহার এক কন্যার গলায় একখানি হীরা ছিল। সেই হীরাখানি এই দোকানেই হারাইয়া যায়। অনেক খোঁজ করা হইলেও আমরা কেহই উহা বাহির করিতে পারি নাই। বাবু শেষে আমাদিগকে সন্দেহ করিয়া আমাকে ও আমার পাঁচজন কারিগরকে পুলিসে পাঠাইয়া দেন। সেখানে আমরা নির্দ্দোষী বলিয়া সাব্যস্ত হইলে মুক্তিলাভ করি। আমার বোধ হয়, এইজন্যই লোকটা পাগল হইয়া গিয়াছে।
আ। লোকটার নাম কি?
ন। জহরলাল দে।
আ। বাড়ী কোথায়?
ন। সিকদের পাড়া।
আ। পু্লিস হইতে ছাড় পাইয়া কি জহর এখানে আসিয়াছিল?
ন। আজ্ঞে না।
আ|। তবে তুমি কেমন করিয়া জানিলে যে, সে গাগল হইয়াছে?
ন। আমি তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম।
আ। কেন?
ন। যেদিন আমরা পুলিস হইতে মুক্তি পাই, জহর সেই দিন এখানে কাজ করিতে আইসে নাই। বাড়ীতে আসিবার সময় আমি জহরকে আহারাদির পর এখানে আসিতে বারম্বার বলিয়া দির়াছিলাম। যখন সে তাহা করে নাই, তখন আমি ভাবিলাম যে, তাহার নিশ্চই অসুখ করিয়া থাকিবে। এই জন্যই তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম।
আ। সেখানে গিয়া কি দেখিলে?
ন। দেখিলাম, জহর সেই অল্প সময়ের মধ্যে উন্মাদ পাগল হইয়া গিয়াছে। জহরের বৃদ্ধ পিতা এখনও বর্ত্তমান। তিনি বলিলেন, জহর বাড়ীতে আসিয়া, নিজের ঘরে বসিয়া আপনাআপনি কি বকিতেছিল। তিনি তাহাকে স্নানাহারের কথা বলিলে পর জহর ভয়ানক হাস্য করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ হাসিয়া জহর দাঁড়াইয়া উঠে এবং বেগে তাহার পিতার নিকট আসিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করে। এখনও বৃদ্ধের হাতে, মুখে ও বুকে অনেক দাগ দেখিতে পাওয়া যায়। অনেক কষ্টে অব্যাহতি পাইয়া বৃদ্ধ কতকগুলি প্রতিবেশীর সাহায্যে জহরের হাতে হাতকড়ি দিতে পারিয়াছেন।
আ। জহর এত শীঘ্র পাগল হইয়া গেল কেন, জান?
ন। আজ্ঞে না, সে কথা বলিতে পারিলাম না, কিন্তু জহর পাগল হওয়ায় আমার যথেষ্ট ক্ষতি হইল।
আ। কেন? আর একজনকে শিখাইয়া লইতে পার। জহরকে শিখাইয়াছিল কে?
ন। আজ্ঞে আমি।
আ। তবে আর ভাবনা কিসের?
ন। জহর একদিনে ভাল কারিগর হয় নাই। একটা লোককে ক্রমাগত দশ বৎসর শিখাইলেও জহরের মত কারিগর হইতে পারে কি না বলা যায়না। মনে করিবেন না, আমাদের কার্য্য অতি সহজ।
আ। যতদিন না আর কোন লোক শিক্ষিত হয়, ততদিন তুমি স্বয়ং ওগুলি গড়িবে। ঐ পুতুলগুলির কাট্তি কেমন?
ন। যথেষ্ট। এত বেশী যে, আমি গড়িয়া দোকানে রাখিবার সুযোগ পাইতেছি না। গঠনের আগেই লোকে মূল্য দিয়া যান। পুতুল প্রস্তত হইলে আমি পাঠাইয়া দিয়া থাকি।
আ। তবে কি ঐ সমস্ত পুতুলেরই মূল্য পাইয়াছ?
ন। উহাদের মধ্যে পাঁচ জোড়ার ফরমাইস্ দেওয়া আছে।
আ। এক জোড়া বেশী গড়িলে কেন?
ন। ছয় জোড়া করিয়া গড়িলে পরিশ্রমের কিছু লাঘব হয়। আর দোকানে রাখিতে না রাখিতে উহাও বিক্রয় হইয়া যাইবে।
আ। ও জোড়াটা আমিই লইব। এখন আমায় কত দিতে হইবে বলিয়া দাও।
ন। আপনার বিবেচনায় যাহা হয় তাহাই দিবেন। আপনি এখন আমার সকল কথাই শুনিয়াছেন; আপনার যাহাতে ভাল হয় তাহাই করুন।
আ। যে পাঁচ জোড়া ফরমাইস মত গড়িয়াছ, সেগুলির কত করিয়া মূল্য লইয়াছ?
নফর হাসিতে হাসিতে বলিল, “প্রতি জোড়া পাঁচ টাকা। আগে আমি জানিতাম না যে, জহর পাগল হইয়া যাইবে।”
আ। যখন তুমি ঐ রকম পুতুল গড়িতে পার, তখন তোমার মূলা বৃদ্ধি করিবার কোন কারণ দেখিতেছি না।
ন। প্রায় পাঁচ বৎসর হইল, জহর ঐ কার্য্য করিতেছে। যে অবধি জহর ঐ কাজ ভাল রকম করিতে শিখিয়াছে, সেই অবধি আমি আর পুতুল গড়ি না। যতই ভাল কারিগর হউক না কেন, পাঁচ বৎসর অভ্যাস না থাকিলে কোন কার্য্যই মনোমত হয় না। আমারও সেই দশা। আমি এখন সাহস করিয়া বলিতে পারি না যে, আমার গড়া শ্যামা-প্রতিমা ঠিক জহরের মত হইবে। বলিতে কি, জহরের এই ছয়টা পুতুল যত সুন্দর হইয়াছে, আগেকারগুলি তত নহে।
আ। ভাল, আর এক টাকা অধিক দিব—ছয় টাকা পাইবে।
নফর আর কোন কথা কহিল না। তখনই সেই তক্তাগুলির কাছে গেল ও একখানি শিব ও একখানি কালী প্রতিমা তুলিয়া লইয়া আমার নিকট ফিরিয়া আসিল।
আমি দুই প্রতিমা দুই হস্তে গ্রহণ করিয়া উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিলাম। দেখিলাম, অতি সুন্দর। ইহা সাধকের কল্পনার ধন, বালকের মনভুলান খেলনা, রমণীর গৃহসজ্জার প্রধান উপকরণ, ধার্ম্মিকের প্রাণের সামগ্রী। গঠন অতি চমৎকার। বর্ণের মাধুরী ও লাবণ্য তদ্রূপ হৃদয়গ্রাহী।
দেখা হইলে প্রতিমা দুইখানি নফরের হাতে ফিরিয়া দিলাম। বলিলাম, “শ্যামার পদতলে মহাদেবের মস্তকে দুইটা সাপ কেন? তোমার সমস্ত কালীপ্রতিমাতেই কি এইরূপ আছে?”
নফর অতি বিনীতভাবে উত্তর করিল, “আজ্ঞে না। যে পাঁচজন এই পাঁচ জোড় পুতুলের ফরমাইস দিয়াছেন, তাঁহারা পরস্পর বন্ধু। তাঁহাদের হুকুম মত মহাদেবের মাথায় দুইটা সাপ দেওয়া হইয়াছে। আর যখন ছয়টী একসঙ্গে গড়া হইয়া ছিল, তখন এটাও অন্য পাঁচটার মত হইয়াছে। আমার আগেকার পুতুলগুলির দুইটা করিয়া সাপ দেওয়া হয়, নাই। আমার বোধ হয়, দুইটা সাপ দেওয়ায় এগুলি দেখিতে আরও সুন্দর হইয়াছে।”
আমি কোন উত্তর করিলাম না। নফর তখন একজন কারিগরকে ডাকিয়া পুতুল দুইটী ভাল করিয়া বাঁধিয়া দিতে বলিল। সে হাত পরিষ্কার করিয়া নফরের হাত হইতে পুতুল দুইটী লইল, এবং দেবদারু কাষ্ঠের একটা ক্ষুদ্র বাক্স মধ্যে রাখিল। পরে বাক্সটী বন্ধ করিয়া একখানি মোটা কাগজে মুড়িয়া আমার হস্তে দিল। আমিও নফরের হাতে মূল্য দিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলাম।