চূর্ণ প্রতিমা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
জমীদার মহাশয়ের কথা শুনিয়া বুঝিলাম, ব্যাপার নিতান্ত সহজ নয়। সাহেব যে কেন আমার উপর এই কার্য্যের ভার দিয়াছেন, তাহাও জানিতে পারিলাম। কিছুকাল চিন্তা করিয়া আমি পার্ব্বতী বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনারা যতক্ষণ সেই দোকানে ছিলেন, ততক্ষণ আর কোন লোক সেখানে গিয়াছিল?”
পার্ব্বতী বাবু উত্তর করিলেন, “আজ্ঞা না।”
আ। আপনি যখন ঘরটী ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়াছেন, তখন আপনি ঘরটীর কথা ভাল রকমই জানেন। বলিতে পারেন, সে ঘরের কয়টী দরজা?
পা। আজ্ঞা, পারি বই কি। দরজা একটী।
আ। জানালা?
পা। দুইটী।
আ। জানালা দুইটীর কাছে কোন্ কোন্ কারিগর বসিয়া ছিল আপনার মনে আছে?
পা। ঘরের যে দিকে জানালা আছে, সে দিকে কোন কারিগর বসে নাই। জানালা দুটীর কাছে বসিবার জায়গাও নাই।
আ। আগনারা যখন হীরক অন্বেষণে বড় ব্যস্ত ছিলেন, তখন হয়ত কোন লোক দোকানে প্রবেশ করিয়াছিল, নতুবা হীরাখানি গেল কোথায়?
পা। আজ্ঞা না, বাহিরের কোন লোক ভিতরে আসিতে কিম্বা ভিতরের কোন লোক বাহিরে যাইতে পারে নাই। আমি সেদিকে বড় সতর্ক ছিলাম।
আ। পুলিস কি বলেন?
পা। পুলিস বলেন, হীরাখানি আর কোথাও পড়িয়া গিয়াছে।
আ। ধুক্ধুকিখানি যখন ঘরের ভিতর পড়িয়াছিল, তখন হীরাও সেইখানে পড়িয়াছে। তবে যদি হীরাখানি ধুক্ধুকির সহিত ভাল করিয়া বসান না থাকে, তাহা হইলে স্বতন্ত্র কথা।
পা। আমার বোধ হয়, হীরাখানি ধুক্ধুকির সহিত ভাল রকমই জোড়া ছিল।
আ। কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন?
পা। হীরকখানি যাচাইবার জন্য আমি একদিন উহাকে ধুক্ধুকি হইতে খুলিতে চেষ্টা করিয়া ছিলাম, কিন্ত কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। নেই জন্য বলিতেছি যে, উহা ভাল করিয়াই জোড়া ছিল।
আ। এ কথা আপনি পুলিসে বলিয়াছিলেন?
পা। আজ্ঞা হাঁ।
আ। পুলিস কি বলিলেন?
পা। আমার কথা বোধ হয় বিশ্বাস করিলেন না, তাঁহাদের নিজের মতই বজায় রাখিলেন।
আ। কারিগর পাঁচজন আর দোকানদারের কি হইল?
পা। মুক্তি পাইয়াছে।
আ। কেন? এরই মধ্যে মুক্তি কেন?
পা। ইন স্পেক্টার মহাশয় বলিলেন যে, যখন তাহাদের কাছে চোরাই মাল কিম্বা তাহার কোন রকম নিদর্শন পাওয়া গেল না, তখন তিনি তাহাদিগকে আর গ্রেপ্তারে রাখিতে পারেন না।
আ। তিনি আইনসঙ্গত কথাই বলিয়াছেন।
পা। এখন উপায়?
আ। উপায় অবশ্যই আছে।
আমার আশ্বাস-বাক্যে পার্ব্বতীচরণ আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, যদি আপনি আমার হীরাখানি বাহির করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে আমি চিরকালের জন্য আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব।
আমি বলিলাম, “আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব, ফল ঈশ্বরের হাতে।”
কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পার্ব্বতী বাবু! আপনার কয়টী সন্তান?”
পা। পাঁচটী;—দুই কন্যা, তিন পুত্র।
আ। জোষ্ঠ কন্যারই নাম সুহাসিনী?
পা। আজ্ঞা হাঁ।
আ। তাহার বয়স কত?
পা। নয় বৎসর।
আ। সুহাসিনীর নিকট হইতেই ত হীরাখানি হারাইয়াছে?
পা। আজ্ঞা হাঁ।
আ। সেই দোকানদারের সহিত আজ আর দেখা করিয়াছিলেন?
পা। আজ্ঞা না। তাহাদের মুক্তির কথা শুনিয়া আমার মন এত খারাপ হইয়াছিল যে, আমি সেই সংবাদ পাইবামাত্র আপনার সাহেবের সহিত দেখা করিবার জন্য বাড়ী হইতে বাহির হই।
ঠিক এই সময় ঘড়ীতে দুইটা বাজিল। পার্ব্বতীচরণ চমকিত হইলেন। বলিলেন, “এত বেলা হইয়াছে—তবে আজ চলিলাম; কিন্তু আমার মন আপনার নিকট পড়িয়া রহিল, আবার কবে আপনার সহিত দেখা করিব বলিয়া দিন?”
আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আপনার আর এখানে আসিবার দরকার নাই। কিছু জানিতে পারিলে আমি নিজেই আপনার বাড়ী যাইব।”