চেনা দায়/বন্ধকে জুয়াচোর
(১) বন্ধকে জুয়াচোর।
কামিনীর বয়ঃক্রম এখন পঞ্চাশ বৎসরের অধিক হইয়াছে। কায়স্থবংশ-সম্ভূতা বলিয়া সে সকলের নিকট পরিচয় দিয়া থাকে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে যে কোন কুল উজ্জ্বল করিয়াছে, তাহা আমরা অবগত নহি। তাহার বাল্য পরিচয় আমরা পাই নাই, যৌবনের পরিচয় যতদুর অবগত হইতে পারিয়াছি, বা তাহার যৌবনের কার্য্য-কলাপের কথা যতদুর আমাদিগের কর্ণগোচর হইয়াছে, তাহার যথাযথ পরিচয় আমি কোন ক্রমেই এই দপ্তরের ভদ্রবংশীয়া পাঠিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারি না। কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, কামিনীর বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর অতিক্রান্ত হইলে পর, তাহার যৌবনের ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়া নিজ উদরান্নের সংস্থানের নিমিত্ত তাহাকে অপর ব্যবসা অবলম্বন করিতে হইয়াছিল।
কামিনী যদি কোনরূপ সদ্ব্যবসা অবলম্বন করিয়া তাহার উদরান্নের চেষ্টা করিত, তাহা হইলে তাহার কার্য্য-বিবরণী আজ আমাকে লোক-সমাজে প্রকাশ করিতে হইত না। কামিনী যখন প্রথম তাহার এই নূতন ব্যবসা আরম্ভ করে, তখন কেহই মনে করিয়াছিলেন না যে, কামিনী অসদ্উপায় অবলম্বন করিয়া অর্থ উপার্জ্জনের চেষ্টা করিতেছে। বস্তুতঃ তাহার কার্য্যের গতিতে, প্রথম প্রথম তাহার জুয়াচুরির কোন লক্ষণই প্রকাশ পায় নাই, বরং সকলেই তাহার কথায় বিশ্বাস করিত। বিশেষতঃ ভদ্রমহিলাগণের নিকট তাহার একটু সবিশেষরূপ প্রতিপত্তি জন্মিয়াছিল।
কামিনী অতিশয় চতুরা, তাহার মুখ অতিশয় মিষ্ট, গৃহস্থগণের অন্দরে প্রবেশ করিয়া মহিলাগণের সহিত মিলিত হইবার ক্ষমতা তাহার অদ্বিতীয়। কোন কায না থাকিলেও, সে স্থিরভাবে আপন বাড়ীতে কখনও বসিয়া থাকিত না, বিনা-কাযে এবাড়ী ওবাড়ী করিয়া বেড়াইত, ও গৃহস্থ-মহিলাগণের সহিত গল্প করিয়া দিন কাটাইত। পাঠকপাঠিকাগণ সকলেই জানেন যে, ভদ্রগৃহস্থের অনেকের অনেক সময়ে হঠাৎ কিছু না কিছু অর্থের প্রয়োজন হইয়া পড়ে, অথচ বিশেষ কষ্ট হইলেও লোক-লজ্জা ও অপমানের ভয়ে আপন আপন অলঙ্কারাদি বন্ধক দিয়া অপরের নিকট কর্জ্জ করিয়া অর্থ সংগ্রহ করিতে কেহই সহজে সম্মত হন না। কামিনী ভদ্রমহিলাগণের এই অভাব পূরণে প্রথমতঃ প্রবৃত্ত হয়, অর্থাৎ কাহারও কোনরূপ সামান্য অর্থের প্রয়োজন হইলে, কামিনী তাঁহার অলঙ্কারাদি অপর স্থানে কম সুদে বন্ধক দিয়া টাকা আনিয়া দিত। পরিশেষে টাকার সংস্থান হইলে, সুদসমেত টাকা মিটাইয়া দিয়া সেই সকল অলঙ্কার ফিরাইয়া আনিত। ইহাতে বন্ধকদাতা ও গৃহীতার পরস্পরের কেহই জানিতে পারিত না যে, সেই অলঙ্কার কাহার, কেইবা বন্ধক দিতেছে, এবং কাহার নিকটেই বা বন্ধক দেওয়া হইতেছে। এই কার্য্য করিয়া কামিনী যে কিছুই পাইত না, তাহা নহে। পারিতোষিক বলিয়া হউক, গাড়িভাড়া প্রভৃতি বলিয়া হউক, বা সুদের অল্প-বিস্তর করিয়াই হউক, সে এই উপায়ে নিজের অন্নের সংস্থান করিতে সমর্থ হইত। এইরূপে কিছুদিবস অতীত হইবার সঙ্গে সঙ্গে মহিলামহলে ক্রমে তাহার পরিচয় হইতে লাগিল, অনেকেই তাহাকে বিশ্বাস করিতে লাগিলেন, অনেকে তাহার সাহায্যে অর্থাদি কর্জ্জ লইতে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং অলঙ্কার প্রভৃতি বিক্রয়ের প্রয়োজন হইলে অনেকে তাহারই সাহায্যে সেই কার্য্য সম্পন্ন করিতে লাগিলেন।
এইরূপে যতদিবস অতিবাহিত হইতে লাগিল, কামিনীর পশার ততই বাড়িতে লাগিল। সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহার উপার্জ্জনও বাড়িয়া গেল। আয় বাড়িলেই ব্যয় বাড়ে, ইহা এই জগতের নিয়ম। সুতরাং কামিনীর কার্য্যও সেই নিয়মের বহিভূত হইতে পারিল না। কেন যে তাহার ব্যয় বাড়িয়া গেল, তাহার কারণ আমি পাঠিকাগণের নিকট বর্ণনা করিতে অসমর্থ। কিন্তু আয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবিক তাহার ব্যয় অধিক হইতে লাগিল; ব্যয় বাড়িলেই অর্থেরও অধিক প্রয়োজন হইয়া পড়িল। সদুপায় অবলম্বনে এ পর্য্যন্ত কামিনী যত অর্থ উপার্জ্জন করিতেছিল, তাহাতে আর তাহার ব্যয় সঙ্কুলান হইল না। সদুপায়ের পরিবর্ত্তে অসদুপায় অবলম্বন করিয়া কামিনী এখন অর্থ সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইল।
পাঠকপাঠিকাগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, পিত্তলের গহনা এই কলিকাতা সহরের মধ্যে কিরূপ ভাবে দিন দিন প্রচলিত হইতেছে। পিত্তলের অলঙ্কার, গিল্টির গহনা, কেমিকেল স্বর্ণের অলঙ্কার প্রভৃতি নানাপ্রকার নামে পিত্তলের গহনা এই কলিকাতার বাজারে অহরহঃ বিক্রীত হইতেছে। মহিলাগণ সর্ব্বদা যে প্রকার সুবর্ণ অলঙ্কার ব্যবহার করিয়া থাকেন, সেই প্রকারের সমস্ত পিত্তলের গহনা আজকাল কলিকাতার বাজারে পাওয়া যায়। সেই সকল গহনা দেখিতে এই পরিষ্কার, এবং এরূপ কৌশলের সহিত গিল্টি করা যে, উহা দেখিয়া সহজে কেহই অনুমান করিতে পারেন না যে, উহা সুবর্ণের অলঙ্কার নহে, পিত্তলের। সুবর্ণ-ব্যবসায়ীগণও সময় সময় উহা সহজে চিনিয়া উঠিতে পারেন। কষ্টিপাথরে কষিয়া দেখিয়াও সময় সময় তাহারাও মহাভ্রমে পতিত হন। সেই সকল অলঙ্কারের মধ্যে কোন কোনটী এরূপ কৌশলের সহিত গিল্টি করা যে, সেই সকল গহনা একবার পুড়াইয়া লইলেও পিত্তল বলিয়া সহজে অনুমান করা যায় না।
কামিনী অল্পে অল্পে এইরূপ কতকগুলি গিল্টির গহনা ক্রয় করিয়া আপনার নিকট রাখিয়া দিল। কোন মহিলা কোন সুবর্ণঅলঙ্কার বন্ধক দিবার নিমিত্ত তাহাকে প্রদান করিলে, তাহার পরিবর্ত্তে সেইরূপের একখানি গিল্টির গহনা অপরের নিকট সুবর্ণ অলঙ্কার পরিচয়ে বন্ধক দিয়া প্রয়োজনমত টাকার সংস্থান করিত; কিন্তু সুবর্ণ অলঙ্কারখানি বিক্রয় করিয়া আপন কার্য্যে ব্যয় করিয়া ফেলিত। যাঁহার অলঙ্কার, তিনি সুদসমেত টাকা প্রদান করিলে, তাহার পরিবর্ত্তে কামিনী সেই পিত্তলের গহনাখানি আনিয়া তাহাকে অর্পণ করিত। সেই অলঙ্কারের অধিকারিণী যদি টাকার সংগ্রহ করিয়া দিতে না পারিতেন, তাহা হইলে সেই পিত্তলের গহনা যাহার নিকট বন্ধক রাখিত, তাহারই নিকট থাকিয়া যাইত। কামিনীর উপর সকলেরই সবিশেষ বিশ্বাস ছিল বলিয়া, তাঁহারা যে তাহা কর্ত্তৃক প্রতারিত হইতেছেন, একথা তাঁহারা স্বপ্নেও মনে করিতেন না।
এইরূপে কামিনী যে কত ভদ্রমহিলার সর্ব্বনাশ করিয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। এইরূপে এই অসদুপায় অবলম্বন করিয়া কিছুদিবস পর্য্যন্ত তাহার ব্যবসা চলিল সত্য; কিন্তু শীঘ্রই তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িল। তাহার এই জুয়াচুরির বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়িবার পরও কিছুদিবস পর্য্যন্ত কামিনী শ্রীঘরে গমন করিল না। কারণ, কুলবধূগণকে পাছে আদালতে গিয়া সাক্ষ্য প্রদান করিতে হয়, এই ভয়ে কেহই তাহার বিপক্ষে নালিশ করিতে সাহসী হইলেন না। অনেকেই কামিনীর উপর নালিশ করিলেন না বলিয়াই যে কামিনী একবারেই নিষ্কৃতি লাভ করিল, তাহা নহে। এইরূপ উপায়ে সে একবার একস্থান হইতে প্রায় তিন সহস্র মুদ্রার মূল্যের অলঙ্কার আত্মসাৎ করায়, সে আমা-কর্ত্তৃক ধৃত হয়। বিচারে তাহার দুই বৎসরের নিমিত্ত কারাবাসের আজ্ঞা হয়। জেল হইতে খালাস হইয়া আসিয়াও সে তাহার সেই জুয়াচুরি ব্যবসা একবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই। যদিও মহিলামহলে তাহার এখন সে পশার বা সেইরূপ প্রতিপত্তি নাই, তথাপি সে তাহার সেই পুরাতন ব্যবসা এখনও একবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই। সুযোগ পাইলে এখনও সে অপরকে প্রতারণা করিয়া থাকে। কিন্তু তাহার অবস্থা এখন অতি শোচনীয়।
পাঠকপাঠিকাগণ মনে করিবেন না যে, কেবল একমাত্র কামিনীই এইরূপে ভদ্রমহিলাগণকে ঠকাইয়া আপন জীবন অতিবাহিত করিয়া থাকে। এই কলিকাতা সহরের মধ্যে এইরূপ কামিনী এখন শত শত বিদ্যমান।