চোখের বালি/১৬
বিহারী ভাবিল, ‘আর দূরে থাকিলে চলিবে না, যেমন করিয়া হউক, ইহাদের মাঝখানে আমাকেও একটা স্থান লইতে হইবে। ইহাদের কেহই আমাকে চাহিবে না তবু আমাকে থাকিতে হইবে।’
বিহারী আহ্বান-অভ্যর্থনার অপেক্ষা না রাখিয়াই মহেন্দ্রের ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। বিনোদিনীকে কহিল, “বিনোদ-বোঠান, এই ছেলেটিকে ইহার মা মাটি করিয়াছে, বন্ধু মাটি করিয়াছে, স্ত্রী মাটি করিতেছে— তুমিও সেই দলে না ভিড়িয়া একটা নূতন পথ দেখাও— দোহাই তোমার!”
মহেন্দ্র। অর্থাৎ—
বিহারী। অর্থাৎ আমার মতো লোক, যাহাকে কেহ কোনো কালে পোঁছে না—
মহেন্দ্র। তাহাকে মাটি করো। মাটি হইবার উমেদারি সহজ নয় হে বিহারী, দরখাস্ত পেশ করিলেই হয় না।
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “মাটি হইবার ক্ষমতা থাকা চাই, বিহারীবাবু।”
বিহারী কহিল, “নিজগুণ না থাকিলেও হাতের গুণে হইতে পারে। একবার প্রশ্রয় দিয়া দেখোই-না।”
বিনোদিনী। আগে হইতে প্রস্তুত হইয়া আসিলে কিছু হয় না, অসাবধান থাকিতে হয়। কী বল ভাই, চোখের বালি। তোমার এই দেওরের ভার তুমিই লও-না, ভাই।
আশা তাহাকে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঠেলিয়া দিল। বিহারীও এ ঠাট্টায় যোগ দিল না।
আশার সম্বন্ধে বিহারীর কোনো ঠাট্টা সহিবে না, এটুকু বিনোদিনীর কাছে এড়াইতে পারে নাই। বিহারী আশাকে শ্রদ্ধা করে এবং বিনোদিনীকে হালকা করিতে চায়, ইহা বিনোদিনীকে বিঁধিল।
সে পুনরায় আশাকে কহিল, “তোমার এই ভিক্ষুক দেওরটি আমাকে উপলক্ষ করিয়া তোমারই কাছে আদর ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে— কিছু দে, ভাই।”
আশা অত্যন্ত বিরক্ত হইল। ক্ষণকালের জন্য বিহারীর মুখ লাল হইল, পরক্ষণেই হাসিয়া কহিল, “আমার বেলাতেই কি পরের উপর বরাত চালাইবে, আর মহিনদার সঙ্গে নগদ কারবার!”
বিহারী যে সমস্ত মাটি করিতে আসিয়াছে, বিনোদিনীর ইহা বুঝতে বাকি রহিল না। বুঝিল বিহারীর সম্মুখে সশস্ত্র থাকিতে হইবে।
মহেন্দ্রও বিরক্ত হইল। খোলসা কথায় কবিত্বের মাধুর্য নষ্ট হয়। সে ঈষৎ তীব্র স্বরেই কহিল, “বিহারী, তোমার মহিনদা কোনো কারবারে যান না— হাতে যা আছে তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।”
বিহারী। তিনি না যেতে পারেন, কিন্তু ভাগ্যে লেখা থাকিলে কারবারের ঢেউ বাহির হইতে আসিয়াও লাগে।
বিনোদিনী। আপনার উপস্থিত হাতে কিছুই নাই, কিন্তু আপনার ঢেউটা কোন্ দিক হইতে আসিতেছে।
বলিয়া সে সকটাক্ষ হাস্যে আশাকে টিপিল। আশা বিরক্ত হইয়া উঠিয়া গেল। বিহারী পরাভূত হইয়া ক্রোধে নীরব হইল; উঠিবার উপক্রম করিতেই বিনোদিনী কহিল, “হতাশ হইয়া যাবেন না বিহারীবাবু। আমি চোখের বালিকে পাঠাইয়া দিতেছি।”
বিনোদিনী চলিয়া যাইতেই সভাভঙ্গে মহেন্দ্র মনে মনে রাগিল। মহেন্দ্রের অপ্রসন্ন মুখ দেখিয়া বিহারীর রুদ্ধ আবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কহিল, “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও করো— বরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে সরলহদয়া সাধ্বী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না। এখনো বলিতেছি তাহার সর্বনাশ করিয়ো না।”
বলিতে বলিতে বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল।
মহেন্দ্র রুদ্ধরোষে কহিল, “বিহারী, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। হেঁয়ালি ছাড়িয়া স্পষ্ট কথা কও।”
বিহারী কহিল, “স্পষ্টই কহিব। বিনোদিনী তোমাকে ইচ্ছা করিয়া অধর্মের দিকে টানিতেছে এবং তুমি না জানিয়া মূঢ়ের মতো অপথে পা বাড়াইতেছ।”)
মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিয়া কহিল, “মিথ্যা কথ! তুমি যদি ভদ্রলোকের মেয়েকে এমন অন্যায় সন্দেহের চোখে দেখ, তবে অন্তঃপুরে তোমার আসা উচিত নয়।”
এমন সময় একটি থালায় মিষ্টান্ন সাজাইয়া বিনোদিনী হাস্যমুখে তাহা বিহারীর সম্মুখে রাখিল। বিহারী কহিল, “এ কী ব্যাপার। আমার তো ক্ষুধা নাই।”
বিনোদিনী কহিল, “সে কি হয়। একটু মিষ্টিমুখ করিয়া আপনাকে যাইতেই হইবে।”
বিহারী হাসিয়া কহিল, “আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হইল বুঝি? সমাদর আরম্ভ হইল?”
বিনোদিনী অত্যন্ত টিপিয়া হাসিল— কহিল, “আপনি যখন দেওর তখন সম্পর্কের যে জোর আছে; যেখানে দাবি করা চলে সেখানে ভিক্ষা করা কেন। আদর যে কাড়িয়া লইতে পারেন! কী বলেন মহেন্দ্রবাবু।”
মহেন্দ্রবাবুর তখন বাক্যস্ফুর্তি হইতেছিল না।
বিনোদিনী। বিহারীবাবু, লজ্জা করিয়া খাইতেছেন না, না রাগ করিয়া? আর কাহাকেও ডাকিয়া আনিতে হইবে?
বিহারী। কোনো দরকার নাই। যাহা পাইলাম, তাহাই প্রচুর।
বিনোদিনী। ঠাট্টাা? আপনার সঙ্গে পারিবার জো নাই। মিষ্টান্ন দিলেও মুখ বন্ধ হয় না।
রাত্রে আশা মহেন্দ্রের নিকটে বিহারী সম্বন্ধে রাগ প্রকাশ করিল— মহেন্দ্র অন্য দিনের মতো হাসিয়া উড়াইয়া দিল না, সম্পূর্ণ যোগ দিল।
প্রাতঃকালে উঠিয়াই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ি গেল। কহিল, “বিহারী, বিনোদিনী হাজার হউক ঠিক বাড়ির মেয়ে নয়— তুমি সামনে আসিলে সে যেন কিছু বিরক্ত হয়।”
বিহারী কহিল, “তাই নাকি! তবে তো কাজটা ভালো হয় না। তিনি যদি আপত্তি করেন, তার সামনে নাই গেলাম।”
মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইল। এত সহজে এই অপ্রিয় কার্য শেষ হইবে তাহা সে মনে করে নাই। বিহারীকে মহেন্দ্র ভয় করে।
সেইদিনই বিহারী মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে গিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মাপ করিতে হইবে।”
বিনোদিনী। কেন বিহারীবাবু।
বিহারী। মহেন্দ্রের কাছে শুনিলাম, আমি অন্তঃপুরে আপনার সামনে বাহির হই বলিয়া আপনি বিরক্ত হইয়াছেন; তাই ক্ষমা চাহিয়া বিদায় হইব।
বিনোদিনী। সে কি হয় বিহারীবাবু। আমি আজ আছি কাল নাই, আপনি আমার জন্য কেন যাইবেন। এত গোল হইবে জানিলে আমি এখানে আসিতাম না। এই বলিয়া বিনোদিনী মুখ ম্লান করিয়া যেন অশ্রুসংবরণ করিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেল।
বিহারী ক্ষণকালের জন্য মনে করিল, “মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমি বিনোদিনীকে অন্যায় আঘাত করিয়াছি।’
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রাজলক্ষ্মী বিপন্নভাবে আসিয়া কহিলেন, “মহিন, বিপিনের বউ যে বাড়ি যাইবে বলিয়া ধরিয়া বসিয়াছে।”
মহেন্দ্র কহিল, “কেন মা, এখানে তার কি অসুবিধা হইতেছে।”
রাজলক্ষ্মী। অসুবিধা না। বউ বলিতেছে, তাহার মতো সমর্থ বয়সের বিধবা মেয়ে পরের বাড়ি বেশিদিন থাকিলে লোকে নিন্দা করিবে।
মহেন্দ্র ক্ষুদ্ধভাবে কহিল, “এ বুঝি পরের বাড়ি হইল।”
বিহার বসিয়াছিল; মহেন্দ্র তাহার প্রতি ভর্ৎসনাদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।
অনুতপ্ত বিহারী ভাবিল, ‘কাল আমার কথাবার্তায় একটু যেন নিন্দার আভাস ছিল; বিনোদিনী বোধ হয় তাহাতেই বেদনা পাইয়াছে।’
স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া বিনোদিনীর উপর অভিমান করিয়া বসিল।
ইনি বলিলেন, “আমাদের পর মনে কর, ভাই!”
উনি বলিলেন, “এতদিন পরে আমরা পর হইলাম!”
বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কি তোমরা চিরকাল ধরিয়া রাখিবে, ভাই।”
মহেন্দ্র কহিল, “এত কি আমাদের স্পর্ধা।”
আশা কহিল, “তবে কেন এমন করিয়া আমাদের মন কাড়িয়া লইলে।”
সেদিন কিছুই স্থির হইল না। বিনোদিনী কহিল, “না ভাই, কাজ নাই, দুদিনের জন্য মায়া না বাড়ানোই ভালো।”
বলিয়া ব্যাকুল চক্ষে একবার মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল।
পরদিন বিহারী আসিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, যাবার কথা কেন বলিতেছেন। কিছু দোষ করিয়াছি কি— তাহারই শাস্তি?”
বিনোদিনী একটু মুখ ফিরাইয়া কহিল, “দোষ আপনি কেন করিবেন, আমার অদৃষ্টের দোষ।”
বিহারী। আপনি যদি চলিয়া যান তো আমার কেবলই মনে হইবে, আমারই উপর রাগ করিয়া গেলেন।
বিনোদিনী করুণ চক্ষে মিনতি প্রকাশ করিয়া বিহারীর মুখের দিকে চাহিল; কহিল, “আমার কি থাকা উচিত হয়, আপনিই বলুন-না।”
বিহারী মুশকিলে পড়িল। থাকা উচিত, এ কথা সে কেমন করিয়া বলিবে। কহিল, “অবশ্য আপনাকে তো যাইতেই হইবে, না-হয় আর দু-চারদিন থাকিয়া গেলেন, তাহাতে ক্ষতি কী।”
বিনোদিনী দুই চক্ষু নত করিয়া কহিল, “আপনারা সকলেই আমাকে থাকিবার জন্য অনুরোধ করিতেছেন, আপনাদের কথা এড়াইয়া যাওয়া আমার পক্ষে কঠিন, কিন্তু আপনারা বড়ো অন্যায় করিতেছেন।”
বলিতে বলিতে তাহার ঘনদীর্ঘ চক্ষুপল্লবের মধ্য দিয়া মোটা মোটা অশ্রুর ফোঁটা দ্রুতবেগে গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।
বিহারী এই নীরব অজস্র অশ্রুজলে ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, “কয়দিন মাত্র আসিয়া আপনার গুণে আপনি সকলকে বশ করিয়া লইয়াছেন, সেইজন্যই আপনাকে কেহ ছাড়িতে চান না— কিছু মনে করিবেন না বিনোদ-বোঠান, এমন লক্ষ্মীকে কে ইচ্ছা করিয়া বিদায় করিবে।”
আশা এক কোণে ঘোমটা দিয়া বসিয়া ছিল, সে আচল তুলিয়া ঘন ঘন চোখ মুছিতে লাগিল।
ইহার পরে বিনোদিনী আর যাইবার কথা উত্থাপন করিল না।