২২

মহেন্দ্র ঘরে ফিরিয়া আসিবা মাত্র তাহার মুখ দেখিয়াই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের কুয়াশার মতো এক মুহূর্তেই কাটিয়া গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করিয়া মহেন্দ্রের সামনে সে যেন মুখ তুলিতেই পারিল না। মহেন্দ্র তাহার উপরে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, “এমন অপবাদ দিয়া চিঠিগুলা লিখিলে কী করিয়া।”

 বলিয়া পকেট হইতে বহুবার-পঠিত সেই চিঠি তিনখানি বাহির করিল। আশা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “তোমার পায়ে পড়ি, ও চিঠিগুলা ছিঁড়িয়া ফেলো।”

 বলিয়া মহেন্দ্রের হাত হইতে চিঠিগুলা লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িল। মহেন্দ্র তাহাকে নিরস্ত করিয়া সেগুলি পকেটে পুরিল। কহিল, “আমি কর্তব্যের অনুরোধে গেলাম, আর তুমি আমার অভিপ্রায় বুঝিলে না? আমাকে সন্দেহ করিলে!”

 আশা ছলছল চোখে কছিল, “এবারকার মতো আমাকে মাপ করো। এমন আর কখনোই হইবে না।”

 মহেন্দ্র কহিল, “কখনো না?”

 আশা কহিল, “কখনো না।”

 তখন মহেন্দ্র তাহাকে টানিয়া লইয়া চুম্বন করিল।

 আশা কহিল, “চিঠিগুলা দাও, ছিঁড়িয়া ফেলি।”

 মহেন্দ্র কহিল, “না, ও থাক্‌।”

 আশা সবিনয়ে মনে করিল, “আমার শাস্তিস্বরূপ এ চিঠিগুলি উনি রাখিলেন।’

 এই চিঠির ব্যাপারে বিনোদিনীর উপর আশার মনটা একটু যেন বাঁকিয়া দাঁড়াইল। স্বামীর আগমনবার্তা লইয়া সে সখীর কাছে আনন্দ করিতে গেল না— বরঞ্চ বিনোদিনীকে একটু যেন এড়াইয়া গেল। বিনোদিনী সেটুকু লক্ষ্য করিল এবং কাজের ছল করিয়া একেবারে দূরে রহিল।

 মহেন্দ্র ভাবিল, ‘এ তো বড়ো অদ্ভুত! আমি ভাবিয়াছিলাম, এবার বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়া দেখা যাইবে— উল্টা হইল। তবে সে চিঠিগুলার অর্থ কী।’

 নারীহৃদয়ের রহস্য বুঝিবার কোনো চেষ্টা করিবে না বলিয়াই মহেন্দ্র মনকে দৃঢ় করিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, ‘বিনোদিনী যদি কাছে আসিবার চেষ্টা করে, তবু আমি দূরে থাকিব।’ আজ সে মনে মনে কহিল, ‘না, এ তে ঠিক হইতেছে না। যেন আমাদের মধ্যে সত্যই কী একটা বিকার ঘটিয়াছে। বিনোদিনীর সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা আমোদ-প্রমোদ করিয়া এই সংশয়াচ্ছন্ন গুমটের ভাবটা দূর করিয়া দেওয়া উচিত।’

 আশাকে মহেন্দ্র কহিল, “দেখিতেছি, আমিই তোমার সখীর চোখের বালি হইলাম। আজকাল তাঁহার আর দেখাই পাওয়া যায় না।”

 আশা উদাসীন ভাবে উত্তর করিল, “কে জানে, তাহার কী হইয়াছে।”

 এ দিকে রাজলক্ষ্মী আসিয়া কাঁদো-কাঁদো হইয়া কহিলেন, “বিপিনের বউকে আর তো ধরিয়া রাখা যায় না।”

 মহেন্দ্র চকিত ভাব সামলাইয়া লইয়া কহিল, “কেন মা।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কী জানি বাছা, সে তো এবার বাড়ি যাইবার জন্য নিতান্তই ধরিয়া পড়িয়াছে। তুই তো কাহাকেও খাতির করিতে জানিল না। ভদ্রলোকের মেয়ে পরের বাড়িতে আছে, উহাকে আপনার লোকের মতো আদর-যত্ন না করিলে থাকিবে কেন।”

 বিনোদিনী শোবার ঘরে বসিয়া বিছানার চাদর সেলাই করিতেছিল। মহেন্দ্র প্রবেশ করিয়া ডাকিল, “বালি।”

 বিনোদিনী সংযত হইয়া বসিল। কহিল, “কী মহেন্দ্রবাবু।”

 মহেন্দ্র কহিল, “কী সর্বনাশ। মহেন্দ্র আবার বাবু হইলেন কবে।”

 বিনোদিনী আবার চাদর-সেলাইয়ের দিকে নত চক্ষু নিবন্ধ রাখিয়া কছিল, “তবে কী বলিয়া ডাকিব।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তোমার সখীকে যা বল— চোখের বালি।”

 বিনোদিনী অন্য দিনের মতে ঠাট্টা করিয়া তাহার কোনো উত্তর দিল না— সেলাই করিয়া যাইতে লাগিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “ওটা বুঝি সত্যকার সম্বন্ধ হইল, তাই ওটা আর পাতানো চলিতেছে না!”

 বিনোদিনী একটু থামিয়া দাঁত দিয়া সেলাইয়ের প্রান্ত হইতে খানিকটা বাড়তি সুতা কাটিয়া ফেলিয়া কহিল, “কী জানি, সে আপনি জানেন।”

 বলিয়াই তাহার সর্বপ্রকার উত্তর চাপা দিয়া গম্ভীরমুখে কহিল, “কলেজ হইতে হঠাৎ ফেরা হইল যে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “কেবল মড়া কাটিয়া আর কত দিন চলিবে।”

 আবার বিনোদিনী দন্ত দিয়া সুতা ছেদন করিল এবং মুখ না তুলিয়াই কহিল, “এখন বুঝি জিয়ন্তের আবশ্যক?”

 মহেন্দ্র স্থির করিয়াছিল, আজ বিনোদিনীর সঙ্গে অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ভাবে হাস্যপরিহাস উত্তরপ্রত্যুত্তর করিয়া আসর জমাইয়া তুলিবে। কিন্তু এমনি গাম্ভীর্যের ভার তাহার উপর চাপিয়া আসিল যে, লঘু জবাব প্রাণপণ চেষ্টাতেও মুখের কাছে জোগাইল না। বিনোদিনী আজ কেমন একরকম কঠিন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিতেছে দেখিয়া মহেন্দ্রের মনটা সবেগে তাহার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল— ব্যবধানটাকে কোনো একটা নাড়া দিয়া ভূমিসাৎ করিতে ইচ্ছা হইল। বিনোদিনীর শেষ বাক্যঘাতের প্রতিঘাত না দিয়া, হঠাৎ তাহার কাছে আসিয়া বসিয়া কহিল, “তুমি আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছ কেন। কোনো অপরাধ করিয়াছি?”

 বিনোদিনী তখন একটু সরিয়া সেলাই হইতে মুখ তুলিয়া দুই বিশাল উজ্জ্বল চক্ষু মহেন্দ্রের মুখের উপর স্থির রাখিয়া কহিল, “কর্তব্যকর্ম তো সকলেরই আছে। আপনি যে সকল ছাড়িয়া কলেজের বাসায় যান, সে কি কাহারো অপরাধে। আমারও যাইতে হইবে না? আমারও কর্তব্য নাই?”

 মহেন্দ্র ভালো উত্তর অনেক ভাবিয়া খুঁজিয়া পাইল না। কিছুক্ষণ থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার এমন কী কর্তব্য যে না গেলেই নয়?”

 বিনোদিনী অত্যন্ত সাবধানে সূচিতে সুতা পরাইতে পরাইতে কহিল, “কর্তব্য আছে কিনা, সে নিজের মনই জানে। আপনার কাছে তাহার আর কী তালিকা দিব।”

 মহেন্দ্র গম্ভীর চিন্তিত মুখে জানালার বাহিরে একটা সুদুর নারিকেল গাছের মাথার দিকে চাহিয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনোদিনী নিঃশব্দে সেলাই করিয়া যাইতে লাগিল। ঘরে ছুঁচটি পড়িলে শব্দ শুনা যায়, এমনি হইল। অনেকক্ষণ পরে মহেন্দ্র হঠাৎ কথা কহিল। অকস্মাৎ নিঃশব্দতাভঙ্গে বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল, তাহার হাতে ছুঁচ ফুটিয়া গেল।

 মহেন্দ্র কহিল, “তোমাকে কোনো অনুনয়-বিনয়েই রাখা যাইবে না?”

 বিনোদিনী তাহার আহত অঙ্গুলি হইতে রক্তবিন্দু শুষিয়া লইয়া কহিল, “কিসের জন্য এত অনুনয়-বিনয়। আমি থাকিলেই কী, আর না থাকিলেই কী। আপনার তাহাতে কী আসে যায়।”

 বলিতে বলিতে গলাটা যেন ভারী হইয়া আসিল; বিনোদিনী অত্যন্ত মাথা নিচু করিয়া সেলাইয়ের প্রতি একান্ত মনোনিবেশ করিল— মনে হইল, হয়তো বা তাহার নত নেত্রের পল্লবপ্রান্তে একটুখানি জলের রেখা দেখা দিয়াছে। মাঘের অপরাহ্ল তখন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলাইবার উপক্রম করিতেছিল।

 মহেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে বিনোদিনীর হাত চাপিয়া ধরিয়া রুদ্ধ সজল স্বরে কহিল, “যদি তাহাতে আমার আসে যায়, তবে তুমি থাকিবে?”

 বিনোদিনী তাড়াতাড়ি হাত ছাড়াইয়া লইয়া সরিয়া বসিল। মহেন্দ্রের চমক ভাঙিয়া গেল। নিজের শেষ কথাটা ভীষণ ব্যঙ্গের মতো তাহার নিজের কানে বারংবার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। অপরাধী জিহ্বাকে মহেন্দ্র দন্ত দ্বারা দংশন করিল তাহার পর হইতে রসনা নির্বাক্ হইয়া রহিল।

 এমন সময় এই নৈঃশব্দ্যপরিপূর্ণ ঘরের মধ্যে আশা প্রবেশ করিল।

 বিনোদিনী তৎক্ষণাৎ যেন পূর্ব-কথোপকথনের অনুবৃত্তিস্বরূপে হাসিয়া মহেন্দ্রকে বলিয়া উঠিল, “আমার গুমর তোমরা যখন এত বাড়াইলে, তখন আমারও কর্তব্য তোমাদের একটা-কথা রাখা। যতক্ষণ না বিদায় দিবে ততক্ষণ রহিলাম।”

 আশা স্বামীর কৃতকার্যতায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া সখীকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। কহিল, “তবে এই কথা রহিল। তাহা হইলে তিন-সত্য করে, যতক্ষণ না বিদায় দিব ততক্ষণ থাকিবে, থাকিবে, থাকিবে।”

 বিনোদিনী তিনবার স্বীকার করিল। আশা কহিল, “ভাই চোখের বালি, সেই যদি রহিলেই তবে এত করিয়া সাধাইলে কেন। শেষকালে আমার স্বামীর কাছে তো হার মানিতে হইল।”

 বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরপো, আমি হার মানিয়াছি, না, তোমাকে হার মানাইয়াছি?”

 মহেন্দ্র এতক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া ছিল; মনে হইতেছিল, তাহার অপরাধে যেন সমস্ত ঘর ভরিয়া রহিয়াছে, লাঞ্ছনা যেন তাহার সর্বাঙ্গ পরিবেষ্টন করিয়া। আশার সঙ্গে কেমন করিয়া সে প্রসন্নমুখে স্বাভাবিক ভাবে কথা কহিবে। এক মুহূর্তের মধ্যে কেমন করিয়া সে আপনার বীভৎস অসংযমকে সহাস্য চটুলতায় পরিণত করিবে। এই পৈশাচিক ইন্দ্রজাল তাহার আয়ত্তের বহির্ভূত ছিল। সে গম্ভীরমুখে কহিল, “আমারই তো হার হইয়াছে।”

 বলিয়াই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

 অনতিকাল পরেই আবার মহেন্দ্র ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বিনোদিনীকে কহিল, “আমাকে মাপ করো।”

 বিনোদিনী কহিল, “অপরাধ কী করিয়াছ ঠাকুরপো।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তোমাকে জোর করিয়া এখানে ধরিয়া রাখিবার অধিকার আমাদের নাই।”

 বিনোদিনী হাসিয়া কছিল, “জোর কই করিলে, তাহা তো দেখিলাম না। ভালোবাসিয়া ভালো মুখেই তো থাকিতে বলিলে। তাহাকে কি জোর বলে। বলো তে ভাই চোখের বালি, গায়ের জোর আর ভালোবাসা কি একই হইল।”

 আশা তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হইয়া কহিল, “কখনোই না।”

 বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, তোমার ইচ্ছা আমি থাকি, আমি গেলে তোমার কষ্ট হইবে, সে তো আমার সৌভাগ্য। কী বলো ভাই চোখের বালি, সংসারে এমন সুহৃদ কয়জন পাওয়া যায়। তেমন ব্যথার ব্যথী, সুখের সুখী অদৃষ্টগুণে যদিই পাওয়া যায়, তবে আমিই বা তাহাকে ছাড়িয়া যাইবার জন্য ব্যস্ত হইব কেন।”

 আশা তাহার স্বামীকে অপদস্থভাবে নিরুত্তর থাকিতে দেখিয়া ঈষৎ ব্যথিতচিত্তে কহিল, “তোমার সঙ্গে কথায় কে পারিবে ভাই! আমার স্বামী তো হার মানিয়াছেন, এখন তুমি একটু থামো।”

 মহেন্দ্র আবার দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইল। তখন রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করিয়া বিহারী মহেন্দ্রের সন্ধানে আসিতেছিল। মহেন্দ্র তাহাকে দ্বারের সম্মুখে দেখিতে পাইয়াই বলিয়া উঠিল, “ভাই বিহারী, আমার মতে পাষণ্ড আর জগতে নাই।”

 এমন বেগে কহিল, সে কথা ঘরের মধ্যে গিয়া পৌঁছিল।

 ঘরের মধ্য হইতে তৎক্ষণাৎ আহ্বান আসিল, “বিহারী-ঠাকুরপো!”

বিহারী কহিল, “একটু বাদে আসছি, বিনোদ-বোঠান।”

 বিনোদিনী কহিল, “একবার শুনেই যাও-না।”

 বিহারী ঘরে ঢুকিয়াই মুহূর্তের মধ্যে একবার আশার দিকে চাহিল— ঘোমটার মধ্য হইতে আশার মুখ যতটুকু দেখিতে পাইল, সেখানে বিষাদ বা বেদনার কোনো চিহ্নই তো দেখা গেল না। আশা উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, বিনোদিনী তাহাকে জোর করিয়া ধরিয়া রাখিল; কহিল, “আচ্ছা বিহারী-ঠাকুরপো, আমার চোখের বালির সঙ্গে কি তোমার সতিন-সম্পর্ক। তোমাকে দেখলেই ও পালাতে চায় কেন?”

 আশা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া বিনোদিনীকে তাড়না করিল।

 বিহারী হাসিয়া উত্তর করিল, “বিধাতা আমাকে তেমন সুদৃশ্য করিয়া গড়েন নাই বলিয়া।”

 বিনোদিনী। দেখছিস ভাই বালি? বিহারী-ঠাকুরপো বাঁচাইয়া কথা বলিতে জানেন— তোর রুচিকে দোষ না দিয়া বিধাতাকেই দোষ দিলেন। লক্ষ্মণটির মতো এমন সুলক্ষণ দেবর পাইয়াও তাহাকে আদর করিতে শিখিলি না— তোরই কপাল মন্দ।

 বিহারী। তোমার যদি তাহাতে দয়া হয় বিনোদ-বোঠান, তবে আর আমার আক্ষেপ কিসের।

 বিনোদিনী। সমুদ্র তো পড়িয়া আছে, তবু মেঘের ধারা নহিলে চাতকের তৃষ্ণা মেটে না কেন।

 আশাকে ধরিয়া রাখা গেল না। সে জোর করিয়া বিনোদিনীর হাত ছাড়াইয়া বাহির হইয়া গেল। বিহারীও চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল। বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, মহেন্দ্রবাবুর কী হইয়াছে বলিতে পার?”

 শুনিয়াই বিহারী থমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “তাহা তো জানি না। কিছু হইয়াছে নাকি।”

 বিনোদিনী। কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো ভালো বোধ হয় না।

 বিহারী উদ্বিগ্নমুখে চৌকির উপর বসিয়া পড়িল। কথাটা খোলসা শুনিবে বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে ব্যগ্র ভাবে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল। বিনোদিনী কোনো কথা না বলিয়া মনোযোগ দিয়া চাদর সেলাই করিতে লাগিল।

 কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া বিহারী কহিল, “মহিনদার সম্বন্ধে তুমি কি বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিয়াছ।”

 বিনোদিনী অত্যন্ত সাধারণভাবে কহিল, “কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো ভালো বোধ হয় না। আমার চোখের বালির জন্যে আমার কেবলই ভাবনা হয়।” বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেলাই রাখিয়া উঠিয়া যাইতে উদ্যত হইল।

 বিহারী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “বোঠান, একটু বসো।”

 বলিয়া একটা চৌকিতে বসিল।

 বিনোদিনী ঘরের সমস্ত জানালা-দরজা সম্পূর্ণ খুলিয়া দিয়া কেরোসিনের বাতি উসকাইয়া সেলাই টানিয়া লইয়া বিছানার দূর প্রান্তে গিয়া বসিল। কহিল, “ঠাকুরপো, আমি তো চিরদিন এখানে থাকিব না— কিন্তু আমি চলিয়া গেলে আমার চোখের বালির উপর একটু দৃষ্টি রাখিয়ো— সে যেন অসুখী না হয়।”

 বলিয়া যেন হৃদয়োচ্ছ্বাস সংবরণ করিয়া লইবার জন্য বিনোদিনী অন্য দিকে মূখ ফিরাইল।

 বিহারী বলিয়া উঠিল, “বোঠান, তোমাকে থাকিতেই হইবে। তোমার নিজের, বলিতে কেহ নাই, এই সরলা মেয়েটিকে সুখে দুঃখে রক্ষা করিবার ভার তুমি লও— তুমি তাহাকে ফেলিয়া গেলে আমি তো আর উপায় দেখি না।”

 বিনোদিনী। ঠাকুরপো, তুমি তো সংসারের গতিক জান। এখানে বরাবর থাকিব কেমন করিয়া। লোকে কী বলিবে।

 বিহারী। লোকে যা বলে বলুক, তুমি কান দিয়ে না। তুমি দেবী— অসহায়া বালিকাকে সংসারের নিষ্ঠুর আঘাত হইতে রক্ষা করা তোমারই উপযুক্ত কাজ। বোঠান, আমি তোমাকে প্রথমে চিনি নাই, সেজন্য আমাকে ক্ষমা করো। আমিও সংকীর্ণহৃদয় সাধারণ ইতর লোকদের মতো মনে মনে তোমার সম্বন্ধে অন্যায় ধারণা স্থান দিয়াছিলাম; একবার এমনও মনে হইয়াছিল, যেন আশার সুখে তুমি ঈর্ষা করিতেছ— যেন— কিন্তু সে-সব কথা মুখে উচ্চারণ করিতেও পাপ আছে। তার পরে, তোমার দেবী-হৃদয়ের পরিচয় আমি পাইয়াছি— তোমার উপর আমার গভীর ভক্তি জন্মিয়াছে বলিয়াই, আজ তোমার কাছে আমার সমস্ত অপরাধ স্বীকার না করিয়া থাকিতে পারিলাম না।

 বিনোদিনীর সর্বশরীর পুলকিত হইয়া উঠিল। যদিও সে ছলনা করিতেছিল, তবু বিহারীর এই ভক্তি উপহার সে মনে মনেও মিথ্যা বলিয়া প্রত্যাখ্যান করিতে পারিল না। এমন জিনিস সে কখনো কাহারো কাছ হইতে পায় নাই। ক্ষণকালের জন্য মনে হইল, সে যেন যথার্থই পবিত্র, উন্নত— আশার প্রতি একটা অনিৰ্দেশ্য দয়ায় তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। সেই অশ্রপাত সে বিহারীর কাছে গোপন করিল না, এবং সেই অশ্রুধারা বিনোদিনীর নিজের কাছে নিজেকে পূজনীয়া বলিয়া মোহ উৎপাদন করিল।

 বিহারী বিনোদিনীকে অশ্রু ফেলিতে দেখিয়া, নিজের অশ্রুবেগ সংবরণ করিয়া উঠিয়া বাহিরে মহেন্দ্রের ঘরে গেল। মহেন্দ্র যে হঠাৎ নিজেকে পাষণ্ড বলিয়া কেন ঘোষণা করিল, বিহারী তাহার কোনো তাৎপর্য খুঁজিয়া পাইল না। ঘরে গিয়া দেখিল, মহেন্দ্র নাই। খবর পাইল, মহেন্দ্র বেড়াইতে বাহির হইয়াছে। পূর্বে মহেন্দ্র অকারণে কখনোই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইত না। সুপরিচিত লোকের এবং সুপরিচিত ঘরের বাহিরে মহেন্দ্রের অত্যন্ত ক্লান্তি ও পীড়া বোধ হইত। বিহারী ভাবিতে ভাবিতে ধীরে ধীরে বাড়ি চলিয়া গেল।

 বিনোদিনী আশাকে নিজের শয়নঘরে আনিয়া, বুকের কাছে টানিয়া, দুই চক্ষু জলে ভরিয়া কহিল, “ভাই চোখের বালি, আমি বড়ো হতভাগিনী, আমি বড়ো অলক্ষণা।”

 আশা ব্যথিত হইয়া তাহাকে বাহুপাশে বেষ্টন করিয়া স্নেহাৰ্দ্রকণ্ঠে বলিল, “কেন ভাই, অমন কথা কেন বলিতেছ।”

 বিনোদিনী রোদনোচ্ছসিত শিশুর মতো আশার বক্ষে মুখ রাখিয়া কহিল, “আমি যেখানে থাকিব, সেখানে কেবল মন্দই হইবে। দে ভাই, আমাকে ছাড়িয়া দে, আমি আমার জঙ্গলের মধ্যে চলিয়া যাই।”

 আশা চিবুকে হাত দিয়া বিনোদিনীর মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিল, “লক্ষ্মীটি ভাই, অমন কথা বলিস নে— তোকে ছাড়িয়া আমি থাকিতে পারিব না— আমাকে ছাড়িয়া যাইবার কথা কেন আজ তোর মনে আসিল।”

 মহেন্দ্রের দেখা না পাইয়া বিহারী কোনো-একটা ছুতায় পুনর্বার বিনোদিনীর ঘরে আসিয়া মহেন্দ্র ও আশার মধ্যবর্তী আশঙ্কার কথাটা আর-একটু স্পষ্ট করিয়া শুনিবার জন্য উপস্থিত হইল।

 মহেন্দ্রকে পরদিন সকালে তাহাদের বাড়ি খাইতে যাইতে বলিবার জন্য বিনোদিনীকে অনুরোধ করিবার উপলক্ষ লইয়া সে উপস্থিত হইল। “বিনোদ-বোঠান” বলিয়া ডাকিয়া হঠাৎ কেরোসিনের উজ্জ্বল আলোকে বাহির হইতেই আলিঙ্গনবদ্ধ সাশ্রুনেত্র দুই সখীকে দেখিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইল। আশার হঠাৎ মনে হইল, ‘নিশ্চয়ই বিহারী তাহার চোখের বালিকে কোনো অন্যায় নিন্দা করিয়া কিছু বলিয়াছে, তাই সে আজ এমন করিয়া চলিয়া যাইবার কথা তুলিয়াছে। বিহারীবাবুর ভারি অন্যায়। উহার মন ভালো নয়।’ আশা বিরক্ত হইয়া বাহির হইয়া আসিল। বিহারীও বিনোদিনীর প্রতি ভক্তির মাত্রা চড়াইয়া বিগলিত হৃদয়ে দ্রুত প্রস্থান করিল।

 সেদিন রাত্রে মহেন্দ্র আশাকে কহিল, “চুনি, আমি কাল সকালের প্যাসেঞ্জারেই কাশী চলিয়া যাইব।”

 আশার বক্ষস্থল ধক্ করিয়া উঠিল কহিল; “কেন।”

 মহেন্দ্র কহিল, “কাকীমাকে অনেক দিন দেখি নাই।”

 শুনিয়া আশা বড়োই লজ্জাবোধ করিল; এ কথা পূর্বেই তাহার মনে উদয় হওয়া উচিত ছিল। নিজের সুখদুঃখের আকর্ষণে স্নেহময়ী মাসিমাকে সে যে ভুলিয়া ছিল, অথচ মহেন্দ্র সেই প্রবাসী-তপস্বিনীকে মনে করিয়াছে, ইহাতে নিজেকে কঠিনহৃদয়া বলিয়া বড়োই ধিক্কার জন্মিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “তিনি আমারই হাতে তাঁহার সংসারের একমাত্র স্নেহের ধনকে সমর্পণ করিয়া দিয়া চলিয়া গেছেন— তাঁহাকে একবার না দেখিয়া আমি কিছুতেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না।”

 বলিতে বলিতে মহেন্দ্রের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হইয়া আসিল, স্নেহপূর্ণ নীরব আশীৰ্বাদ ও অব্যক্ত মঙ্গলকামনার সহিত বারংবার সে আশার ললাট ও মস্তকের উপর দক্ষিণ করতল চালনা করিতে লাগিল। আশা এই অকস্মাৎ স্নেহাবেগের সম্পূর্ণ মর্ম বুঝিতে পারিল না, কেবল তাহার হৃদয় বিগলিত হইয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। আজই সন্ধ্যাবেলায় বিনোদিনী তাহাকে অকারণ স্নেহাতিশয্যে যে-সব কথা, বলিয়াছিল, তাহা মনে পড়িল। উভয়ের মধ্যে কোথাও কোনো যোগ আছে কি না, তাহা সে কিছুই বুঝিল না; কিন্তু মনে হইল, যেন ইহা তাহার জীবনে কিসের একটা সূচনা। ভালো কি মন্দ কে জানে।

 ভয়ব্যাকুলচিত্তে সে মহেন্দ্রকে বাহুপাশে বদ্ধ করিল। মহেন্দ্র তাহার সেই অকারণ আশঙ্কার আবেশ অনুভব করিতে পারিল। কহিল, “চুনি, তোমার উপর তোমার পুণ্যবতী মাসিমার আশীর্বাদ আছে, তোমার কোনো ভয় নাই। তিনি তোমারই মঙ্গলের জন্য তাঁহার সমস্ত ত্যাগ করিয়া গেছেন, তোমার কখনো কোনো অকল্যাণ হইতে পারে না।”

 আশা তখন দৃঢ়চিত্তে সমস্ত ভয় দূর করিয়া ফেলিল। স্বামীর এই আশীৰ্বাদ অক্ষয়-কবচের মতো গ্রহণ করিল। সে মনে মনে বারংবার তাহার মাসিমার পবিত্র পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইতে লাগিল, এবং একাগ্রমনে কহিল, ‘মা, তোমার আশীৰ্বাদ আমার স্বামীকে সর্বদা রক্ষা করুক।’

 পরদিনে মহেন্দ্র চলিয়া গেল, বিনোদিনীকে কিছুই বলিয়া গেল না। বিনোদিনী মনে মনে কহিল, ‘নিজে অন্যায় করা হইল, আবার আমার উপর রাগ! এমন সাধু তো দেখি নাই! কিন্তু, এমন সাধুত্ব বেশি দিন টে’কে না।’