চোখের বালি/৪২
৪২
রাত্রেই মহেন্দ্র শয্যা ছাড়িয়া গেছে শুনিয়া রাজলক্ষ্মী বধূর প্রতি অত্যন্ত রাগ করিলেন। মনে করিলেন, আশার লাঞ্ছনাতেই মহেন্দ্র চলিয়া গেছে। রাজলক্ষ্মী আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহেন্দ্র কাল রাত্রে চলিয়া গেল কেন।”
আশা মুখ নিচু করিয়া বলিল, “জানি না মা।”
রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, এটাও অভিমানের কথা। বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “তুমি জান না তো কে জানিবে। তাহাকে কিছু বলিয়াছিলে?”
আশা কেবলমাত্র বলিল, “না।”
রাজলক্ষ্মী বিশ্বাস করিলেন না। এ কি কখনো সম্ভব হয়।
জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাল মহিন কখন গেল।”
আশা সংকুচিত হইয়া কহিল, “জানি না।”
রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “তুমি কিছুই জান না। কচি খুকি। তোমার সমস্ত চালাকি।”
আশারই আচরণে ও স্বভাবদোষেই যে মহেন্দ্র গৃহত্যাগ হইয়াছে, এ মতও রাজলক্ষ্মী তীব্র স্বরে ঘোষণা করিয়া দিলেন। আশা নতমস্তকে সেই ভর্ৎসনা বহন করিয়া নিজের ঘরে গিয়া কাঁদিতে লাগিল। মনে ভাবিল, ‘কেন যে আমাকে আমার স্বামী একদিন ভালোবাসিয়াছিলেন তাহা আমি জানি না, এবং কেমন করিয়া যে তাঁহার ভালোবাসা ফিরিয়া পাইব তাহাও আমি বলিতে পারি না।’ যে লোক ভালোবাসে তাহাকে কেমন করিয়া খুশি করিতে হয় তাহা হৃদয় আপনি বলিয়া দেয়; কিন্তু যে ভালোবাসে না তাহার মন কী করিয়া পাইতে হয় আশা তাহার কী জানে। যে লোক অন্যকে ভালোবাসে তাহার নিকট হইতে সোহাগ লইতে যাওয়ার মতো এমন নিরতিশয় লজ্জাকর চেষ্টা সে কেমন করিয়া করিবে।
সন্ধ্যাকালে বাড়ির দৈবজ্ঞ-ঠাকুর এবং তাঁহার ভগিনী আচার্য-ঠাকরুন আসিয়াছেন। ছেলের গ্রহশান্তির জন্য রাজলক্ষ্মী ইঁহাদিগকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলেন। রাজলক্ষ্মী একবার বউমার কোষ্ঠী এবং হাত দেখিবার জন্য দৈবজ্ঞকে অনুবোধ করিলেন এবং সেই উপলক্ষে আশাকে উপস্থিত করিলেন। পরের কাছে নিজের দুর্ভাগ্য-আলোচনার সংকোচে একান্ত কুণ্ঠিত হইয়া আশা কোনোমতে তাহার হাত বাহির করিয়া বসিয়াছে, এমন সময় রাজলক্ষ্মী তাঁহার ঘরের পার্শ্বস্থ দীপহীন বারান্দা দিয়া মৃদু জুতার শ পাইলেন— কে যেন গোপনে চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে। রাজলক্ষ্মী ডাকিলেন, “কে ও।”
প্রথমে সাড়া পাইলেন না। তাহার পর আবার ডাকিলেন, “কে যায় গো।”
তখন নিরুত্তরে মহেন্দ্র ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।
আশা খুশি হইবে কি, মহেন্দ্রের লজ্জা দেখিয়া লজ্জায় তাহার হৃদয় ভরিয়া গেল। মহেন্দ্রকে এখন নিজের বাড়িতেও চোরের মতো প্রবেশ করিতে হয়। দৈবজ্ঞ এবং আচার্য-ঠাকরুন বসিয়া আছেন বলিয়া তাহার আরো লজ্জা হইল। সমস্ত পৃথিবীর কাছে নিজের স্বামীর জন্য যে লজ্জা, ইহাই আশার দুঃখের চেয়েও যেন বেশি হইয়া উঠিয়াছে। রাজলক্ষ্মী যখন মৃদু স্বরে বউকে বলিলেন, “বউমা, পার্বতীকে বলিয়া দাও, মহিনের খাবার গুছাইয়া আনে” তখন আশা কহিল, “মা, আমিই আনিতেছি।”
বাড়ির দাসদাসীদের দৃষ্টি হইতেও সে মহেন্দ্রকে ঢাকিয়া রাখিতে চায়।
এ দিকে আচার্য ও তাঁহার ভগিনীকে দেখিয়া মহেন্দ্র মনে মনে অত্যন্ত রাগ করিল। তাহার মাতা ও স্ত্রী দৈবসহায়ে তাহাকে বশ করিবার জন্য এই অশিক্ষিত মূঢ়দের সহিত নির্লজ্জভাবে ষড়যন্ত্র করিতেছে, ইহা মহেন্দ্রের অসহ্য বোধ হইল। ইহার উপর যখন আচার্য-ঠাকরুন কণ্ঠস্বরে অতিরিক্ত মধুমাখা স্নেহরসের সঞ্চার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভালো আছ তো বাবা?” তখন মহেন্দ্র আর বসিয়া থাকিতে পারিল না; কুশলপ্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়া কহিল, “মা, আমি একবার উপরে যাইতেছি।”
মা ভাবিলেন মহেন্দ্র বুঝি শয়নগৃহে বিরলে বধূর সঙ্গে কথাবার্তা কহিতে চায়। অত্যন্ত খুশি হইয়া তাড়াতাড়ি রন্ধনশালায় নিজে গিয়া আশাকে কহিলেন, “যাও যাও, তুমি একবার শীঘ্র উপরে যাও, মহিনের বুঝি কী দরকার আছে।”
আশা দুরুদুরুবক্ষে সসংকোচ পদক্ষেপে উপরে গেল। শাশুড়ির কথায় সে মনে করিয়াছিল, মহেন্দ্র বুঝি তাহাকে ডাকিয়াছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনোমতেই হঠাৎ ঢুকিতে পারিল না, ঢুকিবার পূর্বে আশা অন্ধকারে দ্বারের অন্তরালে মহেন্দ্রকে দেখিতে লাগিল।
মহেন্দ্র তখন অত্যন্ত শূন্যহৃদয়ে নীচের বিছানায় পড়িয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়া কড়িকাঠ পর্যালোচনা করিতেছিল। এই তো সেই মহেন্দ্র, সেই সবই, কিন্তু কী পরিবর্তন। এই ক্ষুদ্র শয়নঘরটিকে একদিন মহেন্দ্র স্বর্গ করিয়া তুলিয়াছিল— আজ কেন সেই আনন্দস্মৃতিতে-পবিত্র ঘরটিকে মহেন্দ্র অপমান করিতেছে। এত কষ্ট, এত বিরক্তি, এত চাঞ্চল্য যদি, তবে ও শয্যায় আর বসিয়ো না মহেন্দ্র। এখানে আসিয়াও যদি মনে না পড়ে সেই-সমস্ত পরিপূর্ণ গভীর রাত্রি, সেই-সমস্ত সুনিবিড় মধ্যাহ্ন, আত্মহারা কর্মবিস্মৃত ঘনবর্ষার দিন, দক্ষিণবায়ুকম্পিত বসন্তের বিহ্বল সন্ধ্যা, সেই অনন্ত অসীম অসংখ্য অনির্বচনীয় কথাগুলি, তবে এ বাড়িতে অন্য অনেক ঘর আছে, কিন্তু এই ক্ষুদ্র ঘরটিতে আর এক মুহূর্তও নহে।
আশা অন্ধকারে দাঁড়াইয়া যতই মহেন্দ্রকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল ততই তাহার মনে হইতে লাগিল, মহেন্দ্র এইমাত্র সেই বিনোদিনীর কাছ হইতে আসিতেছে, অহার অঙ্গে সেই বিনোদিনীর স্পর্শ, তাহার চোখে সেই বিনোদিনীর মূর্তি, কানে সেই বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর, মনে সেই বিনোদিনীর বাসনা একেবারে লিপ্ত জড়িত হইয়া আছে। এই মহেন্দ্রকে আশা কেমন করিয়া পবিত্র ভক্তি দিবে, কেমন করিয়া একাগ্রমনে বলিবে ‘এসো, আমার অনন্যপরায়ণ হৃদয়ের মধ্যে এসো― আমার অটলনিষ্ঠ সতী প্রেমের শুভ্র শতদলের উপর তোমার চরণ-দুখানি রাখো।’ সে তাহার মাসির উপদেশ, পুরাণের কথা, শাস্ত্রের অনুশাসন কিছুই মানিতে পারিল না— এই দাম্পত্যস্বর্গচ্যুত মহেন্দ্রকে সে আর মনের মধ্যে দেবতা বলিয়া অনুভব করিল না, সে আজ বিনোদিনীর কলঙ্কপারাবারের মধ্যে তাহার হৃদয়দেবতাকে বিসর্জন দিল। সেই প্রেমশূন্য রাত্রির অন্ধকারে তাহার কানের মধ্যে, বুকের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে, তাহার সর্বাঙ্গে রক্তস্রোতের মধ্যে, তাহার চারি দিকের সমস্ত সংসারে, তাহার আকাশের নক্ষত্রে, তাহার প্রাচীরবেষ্টিত নিভৃত ছাদটিতে, তাহার শয়নগৃহের পরিত্যক্ত বিরহশয্যাতলে একটি ভয়ানক গম্ভীর ব্যাকুলতার সঙ্গে বিসর্জনের বাদ্য বাজিতে লাগিল।
বিনোদিনীর মহেন্দ্র যেন আশার পক্ষে পরপুরুষ, যেন পরপুরুষেরও অধিক, এমন লজ্জার বিষয় যেন অতি-বড়ো অপরিচিতও নহে। সে কোনমতেই ঘরে প্রবেশ করিতে পারিল না।
এমন সময় কড়িকাঠ হইতে মহেন্দ্রের অন্যমনস্ক দৃষ্টি সম্মুখের দেয়ালের দিকে নামিয়া আসিল। তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া আশা দেখিল, সম্মুখে দেয়ালে মহেন্দ্রের ছবির পার্শ্বেই আশার একখানি ফোটোগ্রাফ ঝুলানো রহিয়াছে। ইচ্ছ। হইল, সেখানা আঁচল দিয়া ঝাঁপিয়া ফেলে, টানিয়া ছিঁড়িয়া লইয়া আসে। অভ্যাসবশত কেন যে সেটা চোখে পড়ে নাই, কেন সে যে এতদিন সেটা নামাইয়া ফেলিয়া দেয় নাই, তাহাই মনে করিয়া সে আপনাকে ধিক্কার দিতে লাগিল। তাহার মনে হইল, যেন মহেন্দ্র মনে মনে হাসিতেছে এবং তাহার হৃদয়ের আসনে যে বিনোদিনীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত সেও যেন তাহার জোড়া ভুরুর ভিতর হইতে ঐ ফোটোগ্রাফটার প্রতি সহাস্য কটাক্ষপাত করিতেছে।
অবশেষে বিরক্তিপীড়িত মহেন্দ্রের দৃষ্টি দেয়াল হইতে নামিয়া আসিল। আশা আপনার মূর্খতা ঘুচাইবার জন্য আজকাল সন্ধ্যার সময় কাজকর্ম ও শাশুড়ির সেবা হইতে অবকাশ পাইলেই অনেক রাত্রি পর্যন্ত নির্জনে অধ্যয়ন করিত। তাহার সেই অধ্যয়নের খাতাপত্রবইগুলি ঘরের একধারে গোছানো ছিল। হঠাৎ মহেন্দ্র অলসভাবে তাহার একখানা খাতা টানিয়া লইয়া খুলিয়া দেখিতে লাগিল। আশার ইচ্ছা করিল, চীৎকার করিয়া ছুটিয়া সেখানা কাড়িয়া লইয়া আসে। তাহার কাঁচা হাতের অক্ষরগুলির প্রতি মহেন্দ্রের হৃদয়হীন বিদ্রূপদৃষ্টি কল্পনা করিয়া সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াইতে পারিল না। দ্রুতপদে নীচে চলিয়া গেল― পদশব্দ গোপন করিবার চেষ্টাও রহিল না।
মহেন্দ্রের আহার সমস্তই প্রস্তুত হইয়াছিল। রাজলক্ষ্মী মনে করিতেছিলেন, মহেন্দ্র বউমার সঙ্গে রহস্যালাপে প্রবৃত্ত আছে; সেইজন্য খাবার লইয়া গিয়া মাঝখানে ভঙ্গ দিতে তাঁহার প্রবৃত্তি হইতেছিল না। আশাকে নীচে আসিতে দেখিয়া তিনি ভোজনস্থলে আহার লইয়া মহেন্দ্রকে খবর দিলেন। মহেন্দ্র খাইতে উঠিবা মাত্র আশা ঘরের মধ্যে ছুটিয়া গিয়া নিজের ছবিখানা ছিঁড়িয়া লইয়া ছাদের প্রাচীর ডিঙাইয়া ফেলিয়া দিল, এবং তাহার খাতাপত্রগুলা তাড়াতাড়ি তুলিয়া লইয়া গেল।
আহারান্তে মহেন্দ্র শয়নগৃহে আসিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী বধূকে কাছাকাছি কোথাও খুঁজিয়া পাইলেন না। অবশেষে একতলায় রন্ধনশালায় আসিয়া দেখিলেন, আশা তাঁহার জন্য দুধ জ্বাল দিতেছে। কোনো আবশ্যক ছিল না। কারণ, যে দাসী রাজলক্ষ্মীর রাত্রের দুধ প্রতিদিন জ্বাল দিয়া থাকে সে নিকটেই ছিল এবং আশার এই অকারণ উৎসাহে আপত্তি প্রকাশ করিতেছিল; বিশুদ্ধ জলের দ্বারা পূরণ করিয়া দুধের যে অংশটুকু সে হরণ করিত সেটুকু আজ ব্যর্থ হইবার সম্ভাবনায় সে মনে মনে ব্যাকুল হইতেছিল।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এ কী বউমা, এখানে কেন। যাও, উপরে যাও।”
আশা উপরে গিয়া তাহার শাশুড়ির ঘর আশ্রয় করিল। রাজলক্ষ্মী বধূর ব্যবহারে বিরক্ত হইলেন। ভাবিলেন, ‘যদি-বা মহেন্দ্র মায়াবিনীর মায়া কাটাইয়া ক্ষণকালের জন্য বাড়ি আসিল, বউ রাগারাগি মান-অভিমান করিয়া আবার তাহাকে বাড়িছাড়া করিবার চেষ্টায় আছে। বিনোদিনীর ফাঁদে মহেন্দ্র যে ধরা পড়িল, সে তো আশারই দোষ। পুরুষমানুষ তো স্বভাবতই বিপথে যাইবার জন্য প্রস্তুত, স্ত্রীর কর্তব্য তাহাকে ছলে বলে কৌশলে সিধা পথে রাখা।’
রাজলক্ষ্মী তীব্র ভর্ৎসনার স্বরে কহিলেন, “তোমার এ কিরকম ব্যবহার বউমা। তোমার ভাগ্যক্রমে স্বামী যদি ঘরে আসিলেন, তুমি মুখ হাঁড়িপানা করিয়া অমন কোণে কোণে লুকাইয়া বেড়াইতেছ কেন।”
আশা নিজেকে অপরাধিনী জ্ঞান করিয়া অঙ্কুশাহতচিত্তে উপরে চলিয়া গেল এবং মনকে দ্বিধা করিবার অবকাশমাত্র না দিয়া এক নিশ্বাসে ঘরের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইল। দশটা বাজিয়া গেছে। মহেন্দ্র ঠিক সেই সময় বিছানার সম্মুখে দাঁড়াইয়া অনাবশ্যক দীর্ঘকাল ধরিয়া চিন্তিতমুখে মশারি ঝাড়িতেছে। বিনোদিনীর উপরে তাহার মনে একটা তীব্র অভিমানের উদয় হইয়াছে। সে মনে মনে বলিতেছিল, ‘বিনোদিনী কি আমাকে তাহার এমনই ক্রীতদাস বলিয়া নিশ্চয় স্থির করিয়া রাখিয়াছে যে, আমার কাছে আমাকে পাঠাইতে তাহার মনে লেশমাত্র আশঙ্কা জন্মিল না। আজ হইতে যদি আমি আশার প্রতি আমার কর্তব্য পালন করি, তবে বিনোদিনী কাহাকে আশ্রয় করিয়া এই পৃথিবীতে দাঁড়াইবে। আমি কি এতই অপদার্থ যে, এই কর্তব্যপালনের ইচ্ছা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। বিনোদিনীর কাছে কি শেষকালে আমার এই পরিচয় হইল। শ্রদ্ধাও হারাইলাম, ভালোবাসাও পাইলাম না― আমাকে অপমান করিতে তাহার দ্বিধাও হইল না!’ মশারির সম্মুখে দাঁড়াইয়া দৃঢ়চিত্তে প্রতিজ্ঞা করিতেছিল, বিনোদিনীর এই স্পর্দ্ধার সে প্রতিবাদ করিবে, যেমন করিয়া হউক আশার প্রতি হৃদয়কে অনুকুল করিয়া বিনোদিনীকৃত অবমাননার প্রতিশোধ দিবে।
আশা যেই ঘরে প্রবেশ করিল, মহেন্দ্রের অন্যমনস্ক মশারি-ঝাড়া অমনি বন্ধ হইয়া গেল। কী বলিয়া আশার সঙ্গে সে কথা আরম্ভ করিবে, সেই এক অতি দুরূহ সমস্যা উপস্থিত হইল।
মহেন্দ্র কাষ্ঠহাসি হাসিয়া, হঠাৎ তাহার যে কথাটা মুখে আসিল তাহাই বলিল। কহিল, “তুমিও দেখিলাম আমার মতো পড়ায় মন দিয়াছ। খাতাপত্র এই-যে এখানে দেখিয়াছিলাম, সেগুলি গেল কোথায়।”
কথাটা যে কেবল খাপছাড়া শুনাইল তাহা নহে, আশাকে যেন মারিল। মূঢ় আশা যে শিক্ষিত হইবার চেষ্টা করিতেছে, সেটা তাহার বড়ো গোপন কথা; আশা স্থির করিয়াছিল, এ কথাটা বড়োই হাস্যকর। তাহার এই শিক্ষালাভের সংকল্প যদি কাহারো হাস্যবিদ্রূপের লেশমাত্র আভাস হইতেও গোপন করিবার বিষয় হয়, তবে তাহা বিশেষরূপে মহেন্দ্রের। সেই মহেন্দ্র যখন এতদিন পরে প্রথম সম্ভাষণে হাসিয়া সেই কথাটারই অবতারণা করিল, তখন নিষ্ঠুরবেত্রাহত শিশুর কোমল দেহের মতো আশার সমস্ত মনটা সংকুচিত ব্যথিত হইতে লাগিল। সে আর কোনো উত্তর না দিয়া মুখ ফিরাইয়া টিপাইয়ের প্রান্ত ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
মহেন্দ্রও উচ্চারণমাত্র বুঝিয়াছিল, কথাটা ঠিক সংগত, ঠিক সময়োপযোগী হয় নাই; কিন্তু বর্তমান অবস্থায় উপযোগী কথাটা যে কী হইতে পারে তাহা মহেন্দ্র কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না। মাঝখানের এত বড়ো বিপ্লবের পরে পূর্বের ন্যায় কোনো সহজ কথা ঠিকমত শুনায় না; হৃদয়ও একেবারে মূক, কোনো নূতন কথা বলিবার জন্য সে প্রস্তুত নহে। মহেন্দ্র ভাবিল, বিছানার ভিতরে ঢুকিয়া পড়িলে সেখানকার নিভৃত বেষ্টনের মধ্যে হয়তো কথা কওয়া সহজ হইবে। এই ভাবিয়া মহেন্দ্র আবার মশারির বহির্ভাগ কোঁচা দিয়া ঝাড়িতে লাগিল। নূতন অভিনেতা রঙ্গভূমিতে প্রবেশের পূর্বে যেমন উৎকণ্ঠার সঙ্গে নেপথ্যদ্বারে দাঁড়াইয়া নিজের অভিনেতব্য বিষয় মনে মনে আবৃত্তি করিয়া দেখিতে থাকে, মহেন্দ্র সেইরূপ মশারির সমুখে দাঁড়াইয়া মনে মনে তাহার বক্তব্য ও কর্তব্য আলোচনা করিতে লাগিল। এমন সময় অত্যন্ত মৃদু একটা শব্দ শুনিয়া মহেন্দ্র মুখ ফিরাইয়া দেখিল, আশা ঘরের মধ্যে নাই।