ছড়া/ছেঁড়া মেঘের আলো পড়ে
৫
ছেঁড়া মেঘের আলো পড়ে
দেউল-চূড়ার ত্রিশূলে;
কলুবুড়ি শাকসবজি
তুলেছে পাঁচমিশুলে।
চাষা খেতের সীমানা দেয়।
উঁচু ক’রে আল তুলে;
নদীতে জল কানায় কানায়,
ডিঙি চলে পাল তুলে।
কোমর-ঘেরা আঁচলখানা,
হাতে পানের কৌটা,
ঘোষপাড়াতে হন্হনিয়ে
চলে নাপিত-বউটা।
গোকুল ছোড়া গুঁড়ি আঁকড়ে
ওঠে গাছের উপুরি,
পেড়ে আনে খোলো থোলো
কাঁচা কাঁচা সুপুরি।
বর্ষাজলের ঢল নেমেছে,
ছাপিয়ে গেল বাঁধখানা,
পাড়ির কাছে ডুবো ডিঙি
যাচ্ছে দেখা আধখানা।
লখা চলে ছাতা মাথায়
গৌরী ক’নের বর-
ভ্যাঙ ড্যাঙাড্যাঙ বাদ্যি বাজে,
চড়কডাঙায় ঘর।
ভাগু মালী লাউডাঁটাতে
ভরেছে তার ঝাঁকাটা,
কামার পিটোয় দুম্দুমিয়ে
গােরুর গাড়ির চাকাটা।
মাঠের পারে ধক্ধকিয়ে
চলতি গাড়ির ধোঁওয়াতে
আকাশ যেন ছেয়ে চলে
কালাে বাঘের রোঁওয়াতে
কাঁসারিটা বাজিয়ে কাঁসা
জাগিয়ে দিল গলিটা—
গিন্নিরা দেয় ছেঁড়া কাপড়
ভর্তি করে থলিটা।
ভিজে চুলের ঝুঁটি বেঁধে
বসে আছেন সেজো বউ,
মােচার ঘণ্ট বানাতে সে
সবার চেয়ে কেজো বউ।
গামলা চেটে পরখ করে
দড়ি দিয়ে বাঁধা গাই,
উঠোনের এক কোণে জমা
রান্নাঘরের গাদা ছাই।
ভালুক-নাচের ডুগ্ডুগি ওই
বাজছে পাইকপাড়াতে,
বেদের মেয়ে বাঁদর-ছানার
লাগল উকুন ছাড়াতে।
অশথতলায় পাটল গােরু
আরামে চোখ বোঁজে তার,
ছাগল-ছানা ঘুরে বেড়ায়
কচি ঘাসের খোঁজে তার।
ছকু মামী খেতের থেকে
তুলছে মুলাে ভাদুরে,
পিঠ আঁকড়ে জড়িয়ে থাকে
ছেলেটা তার আদুরে।
হঠাৎ কখন বাদুলে মেঘ
জুটল এসে দলে দল,
পশলা কয়েক বৃষ্টি হতেই
মাঠ হয়ে যায় জলে জল।
কচুর পাতায় ঢেকে মাথা
সাঁওতালী সব মেয়েরা
ঘােষের বাগান থেকে পাড়ে
কাঁচা কাঁচা পেয়ারা।
মাথায় চাদর বেঁধে নিয়ে
হাট থেকে যায় হাটুরে,
ভিজে কাঠের আঁঠি বেঁধে
চলছে ছুটে কাঠুরে।
নিমের ডালে পাখির ছানা
পাড়তে গেল ওরা কি,
পকেট ভরে নিয়ে গেল
কাঠবিড়ালির খােরাকি।
হালদারদের মেয়েটা ওই
দেখি তারে যখুনি
মাঠে মাঠে ভিজে বেড়ায়,
মা এসে দেয় বকুনি।
গােলাকৃতি গড়নটা ওর,
সবাই ডাকে বাতাবি—
খুদু বলে, আমার সঙ্গে
সাঙাৎনি কি পাবি।
পুকুর-পাড়ে ছড়িয়ে আছে।
তেলের শিশির কাঁচ-ভাঙা,
জেলের পোঁতা বাঁশের খোঁটায়
বসে আছে মাছরাঙা।
দক্ষিণে ওই উঠল হাওয়া,
বৃষ্টি এখন থামল কি—
গাছের তলায় পা ছড়িয়ে
চিবােয় ভুলু আম্লকি।
ময়লা কাপড় হিস্হিসিয়ে
আছাড় মারে ধোবাতে,
পাড়ার মেয়ে মাছ ধরতে
আঁচল মেলে ডােবাতে।
পা ডুবিয়ে ঘাটের ধারে
ঘােষপুকুরের কিনারায়
মাসিক-পত্র পড়ছে বসে
থার্ড্ ইয়ারের বীণা রায়।
বিজুলি যায় সাপ খেলিয়ে
লক্ লকি।
বাঁশের পাতা চম্কে উঠে
ঝক্ ঝকি।
চড়কডাঙায় ঢাক বাজে ওই
ড্যাড্যাঙ ড্যাঙ।
মাঠে মাঠে মক্ মকিয়ে
ডাকছে ব্যাঙ॥
উদীচী
২১ অগস্ট ১৯৪০