ছড়া/খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে

খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে;
পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।
আপনি এল ব্যাক্‌টিরিয়া, তাকে ডাকা হয় নাই।
হাঁসপাতালের মাখন ঘোষাল বলেছিল, ভয় নাই।
সে বলে, সব বাজে কথা, খাবার জিনিস খাদ্য—
দশ দিনেতেই ঘটিয়ে দিল দশ জনারই শ্রাদ্ধ।
শ্রাদ্ধের যে ভোজন হবে কাঁচা তেঁতুল দরকার,
বেগুন-মুলোর সন্ধানেতে ছুটল ন্যাড়া সরকার।
বেগুন মুলো পাওয়া যাবে নিল্‌ফামারির বাজারে,
নগদ দামে বিক্রি করে তিন টাকা দাম হাজারে।
দুমকাতে লোক পাঠিয়েছিল বানিয়ে দেবে মুড়কি,
সন্দেহ হয় ওজন-মত মিশল তাতে গুড় কি।
সর্ষে যে চাই মন দু-তিনেক ঝোলে-কালে বাটনায়,
কালুবাবু তারি খোঁজে গেলেন ধেয়ে পাটনায়।
বিষম খিদেয় করল চুরি রামছাগলের দুধ,
তারি সঙ্গে মিশিয়ে নিলে গম-ভাঙানির খুদ।
ওই শোনা যায় রেডিয়োতে বোঁচা গোঁফের হুমকি;
দেশ-বিদেশে শহর-গ্রামে গলা-কাটার ধুম কী।
খাঁচায় পোষা চন্দনাটা ফড়িঙে পেট ভরে—
সকাল থেকে নাম করে গান, হরে কৃষ্ণ হরে!

বালুর চরে আলুহাটা, হাতে বেতের চুপড়ি,
খেতের মধ্যে ঢুকে কালু মুলাে নিল উপড়ি।
নদীর পারে কিচির-মিচির লাগালাে গাঙ্‌শালিখ যে,
অকারণে ঢােলক বাজায় মুলাে-খেতের মালিক যে।
কাঁকুড়-খেতে মাচা বাঁধে পিলেওয়ালা ছােকরা,
বাঁশের বনে কঞ্চি কাটে মুচিপাড়ার লােকরা।
পাটনীতে নীল-কুঠির গঞ্জে খেয়া চালায় পাটনি,
রােদে জলে নিতুই চলে চার-পহরের খাটনি।
কড়া-পড়া কঠিন হাতে মাজা কাসার কাঁকনটা,
কপালে তার পত্রলেখা উল্কি-দেওয়া আঁকনটা।
কুচোমাছের টুকরি থেকে চিলেতে নেয় ছোঁ মেরে—
মেছনি তার সাতগুষ্টি উদ্দেশে দেয় যমেরে
ও পারেতে খড়্গপুরে কাঠি পড়ে বাজনায়,
মুন্‌শিবাবু হিসেব ভােলে জমিদারের খাজনায়।
রেডিয়ােতে খবর জানায়, বােমায় করলে ফুটো—
সমুদ্দুরে তলিয়ে গেল মালের জাহাজ দুটো।
খাঁচার মধ্যে ময়না থাকে—বিষম কলরবে
ছাতু ছড়ায়, মাতায় পাড়া আত্মারামের স্তবে।


হুইস্‌ল্ দিল প্যাসেঞ্জারে সাঁৎরাগাছির ড্রাইভার—
মাথায় মােছে হাতের কালি, সময় না পায় নাইবার।

ননদ গেল ঘুঘুডাঙায়, সঙ্গে গেল চিন্তে—
লিলুয়াতে নেমে গেল ঘুড়ির লাঠাই কিনতে।
লিলুয়াতে খইয়ের মােওয়া চার ধামা হয় বােঝাই,
দাম দিতে হয় টাকার থলি মিথ্যে হল খোঁজাই।
ননদ পরল রাঙা চেলি, পালকি চড়ে চলল—
পাড়ায় পাড়ায় রব উঠেছে গায়ে-হলুদ কল্য।
কাহারগুলাে পাগড়ি বাঁধে, বাঁদি পরে ঘাঘরা,
জমাদারের মামা পরে শুঁড়তোলা তার নাগরা।
পাঁড়েজি তার খড়ম নিয়ে চলেন খটাৎ খটাৎ,
কোথা থেকে ধোবার গাধা চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ।
খয়রাডাঙার ময়রা আসে, কিনে আনে ময়দা—
পচা ঘিয়ের গন্ধ ছড়ায়, যমালয়ের পয়দা।
আকাশ থেকে নামলাে বােমা, রেডিয়াে তাই জানায়—
অপঘাতে বসুন্ধরা ভরল কানায় কানায়।
 খাঁচার মধ্যে শ্যামা থাকে, চিরকুটে খায় পােকা—
 শিস দেয় সে মধুর স্বরে, হাততালি দেয় খােকা।


হুইস্‌ল্‌ বাজে ইস্টিশনে, বরের জ্যাঠামশাই
চমকে ওঠে—গেলেন কোথায় অগ্রদ্বীপের গোঁসাই
সাঁৎরাগাছির নাচনমণি কাটতে গেল সাঁতার,
হায় রে কোথায় ভাসিয়ে দিল সোনার সিঁথি মাথার

মোষের শিঙে ব’সে ফিঙে ন্যাজ দুলিয়ে নাচে—
শুধোয় নাচন, সিঁথি আমার নিয়েছে কোন্ মাছে?
মাছের লেজের ঝাপটা লাগে, শালুক ওঠে দুলে—
রোদ পড়েছে নাচনমণির ভিজে চিকন চুলে।
কোথায় ঘাটের ফাটল থেকে ডাকল কোলা ব্যাঙ,
খড়গ্‌পুরের ঢাকে ঢেলে বাজল ড্যাডাঙ ড্যাঙ।
কাঁপছে ছায়া আঁকাবাঁকা, কলমি-পাড়ের পুকুর—
জল খেতে যায় এক-পা-কাটা তিন-পেয়ে এক কুকুর।
হুইস্‌ল্ বাজে, আছে সেজে পাইকপাড়ার পাত্রী,
শেয়ালকাঁটার বন পেরিয়ে চলে বিয়ের যাত্রী।
গ্যাঁ গোঁ করে রেডিয়োটা—কে জানে কার জিত,
মেশিন্‌গানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্যবিধির ভিত।
টিয়ের মুখের বুলি শুনে হাসছে ঘরে-পরে—
রাধে কৃষ্ণ, রাধে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে!


দিন চলে যায় গুন্‌গুনিয়ে ঘুমপাড়ানির ছড়া,
শান-বাঁধানো ঘাটের ধারে নামছে কাঁখের ঘড়া।
আতাগাছের তোতাপাখি, ডালিমগাছে মৌ,
হীরেদাদার মড়্‌মড়ে থান, ঠাকুরদাদার বউ
পুকুর-পাড়ে জলের ঢেউয়ে দুলছে ঝোপের কেয়া,
পাটনি চালায় ভাঙা ঘাটে তালের ডোঙার খেয়া।

খোকা গেছে মোষ চরাতে, খেতে গেছে ভুলে—
কোথায় গেল গমের রুটি শিকের ’পরে তুলে।
আমার ছড়া চলেছে আজ রূপকথাটা ঘেঁষে,
কলম আমার বেরিয়ে এল বহুরূপীর বেশে।
আমরা আছি হাজার বছর ঘুমের ঘোরের গাঁয়ে,
আমরা ভেসে বেড়াই স্রোতের শেওলা-ঘেরা নায়ে।
কচি কুমডোর ঝোল রাঁধা হয়, জোড়-পুতুলের বিয়ে,
বাঁধা বুলি ফুকরে ওঠে কমলাপুলির টিয়ে।
ছাইয়ের গাদায় ঘুমিয়ে থাকে পাড়ার খেঁকি কুকুর,
পান্তিহাটে বেতোঘোড়া চলে টুকুর টুকুর।
তালগাছেতে হুতোম‍্থুমো পাকিয়ে আছে ভুরু,
তক্তিমালা হড়মবিবির গলাতে সাত-পুরু।
আধেক জাগায় আধেক ঘুমে ঘুলিয়ে আছে হাওয়া,
দিনের রাতের সীমানাটা পেঁচোয়-দানোয়-পাওয়া।
ভাগ্যলিখন ঝাপসা কালির নয় সে পরিষ্কার,
দুঃখসুখের ভাঙা বেড়ায় সমান যে দুই ধার।
কামারহাটার কঁকুড়গাছির ইতিহাসের টুকরো,
ভেসে চলে ভাঁটার জলে উইয়ে-ঘুনে-ফুকরো।
অঘটন তো নিত্য ঘটে রাস্তা-ঘাটে চলতে—
লোকে বলে, সত্যি নাকি— ঘুমোয় বলতে বলতে।

সিন্ধুপারে চলছে হেথায় উলট-পালট কাণ্ড,
হাড় গুঁড়িয়ে বানিয়ে দিলে নতুন কী ব্রহ্মাণ্ড।
সত্য সেথায় দারুণ সত্য, মিথ্যে ভীষণ মিথ্যে,
ভালোয় মন্দে সুরাসুরের ধাক্কা লাগায় চিত্তে।
পা ফেলতে না ফেলতেই হতেছে ক্রোশ পার।
দেখতে দেখতে কখন যে হয় এস‍্পার-ওস‍্পার॥

 উদয়ন ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০