ছন্দ/প্রমথ চৌধুরীকে
চিঠিপত্র
প্রমথ চৌধুরীকে লেখা
চলতি কথায় একটা লম্বা ছন্দের[১] কবিতা লিখেছি। এটা কি পড়া যায় কিংবা বোঝা যায় কিংবা ছাপানো যেতে পারে। নাম-রূপের মধ্যে রূপটা আমি দিলুম, নাম দিতে হয় তুমি দিয়ো।[২]
যারা আমার সাঁঝ-সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো
আপন হিয়ার পরশ দিয়ে, এই জীবনের সকল সাদা-কালো
যাদের আলো-ছায়ার লীলা, বাইরে বেড়ায় মনের মানুষ যারা
তাদের প্রাণের ঝরনাস্রোতে আমার পরান হয়ে হাজার-ধারা
চলছে বয়ে চতুর্দিকে। কালের যোগে নয় তো মোদের আয়ু,
নয় সে কেবল দিবস-রাতির সাতনলি হার, নয় সে নিশাসবায়ু।
নানান প্রাণের প্রেমের মিলে নিবিড় হয়ে আত্মীয়ে বান্ধবে
মোদের পরমায়ুর পাত্র গভীর ক’রে পুরণ করে সবে।
সবার বাঁচায় আমার বাঁচা আপন সীমা ছাড়ায় বহুদূরে,
নিমেষগুলির ফল পেকে যায় বিচিত্র আনন্দরসে পুরে;
অতীত হয়ে তবুও তারা বর্তমানের বৃত্ত-দোলায় দোলে,—
গর্ভ হতে মুক্ত শিশু তবুও যেমন মায়ের বক্ষে কোলে
বন্দী থাকে নিবিড় প্রেমের বাঁধন দিয়ে। তাই তো যখন শেষে
একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে
আঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায়, তখন রিক্ত শীর্ণ জীবন মম
শুষ্ক রেখার মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণী সম
শূন্য বালুর একটি প্রান্তে ক্লান্তবারি স্রস্ত অবহেলায়।
তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনের অপরাহ্ণ-বেলায়
তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে দিনের আলো—
বলে নে ভাই, “এই যা দেখা, এই যা ছোঁওয়া, এই ভালো, এই ভালো।
এই ভালো আজ এ-সংগমে কান্নাহাসির গঙ্গাযমুনার
ঢেউ খেয়েছি, ডুব দিয়েছি, ঘট ভরেছি, নিয়েছি বিদায়।
এই ভালো রে প্রাণের রঙ্গে এই আসঙ্গ সকল অঙ্গে মনে
পুণ্য ধরার ধুলো-মাটি ফল-হাওগ-জল তৃণ-তরুর সনে।
এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান গাওয়া এই ভাষায়,
তারার সাথে নিশীথ-রাতে ঘুমিয়ে পড়া নূতন প্রাতের আশায়।”
এই জাতের সাধু ছন্দে আঠার অক্ষরের আসন থাকে।[৩] কিন্তু এটাতে কোনো কোনো লাইনে পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছে। ফার্স্ট ক্লাসের এক বেঞ্চিতে ছ-জনের বেশি বসবার হুকুম নেই কিন্তু থার্ড ক্লাসে ঠেলাঠেসি ভিড়, এ সেইরকম। কিন্তু যদি এটা ছাপাও তাহলে লাইন ভেঙো না, তাহলে ছন্দ পড়া কঠিন হবে। স্মল পাইকায় মার্জিন কম দিয়ে ছাপলে পঁচিশ অক্ষর ধরতে পারবে।
- ↑ প্রাকৃত-বাংলার মহাপয়ার বা দীর্ঘপয়ার; অধিকন্তু এটি পংক্তিলঙ্ঘক বা লাইন-ডিঙানো চালে রচিত। এ-ধরনের ছন্দের এটিই প্রথম নিদর্শন, তাই ‘এটি কি পড়া যার’ এ প্রশ্ন করা হয়েছে।
- ↑ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সবুজপত্রে’ (১৩২৪ জ্যৈষ্ঠ) ‘পরমায়ু’ নামে। পরে ‘পলাতকা’য় ‘শেষ গান’ নামে ও ‘পূরবী’তে ‘পূরবী’ নামে গৃহীত হয়। প্রত্যেকবারই কবিতাটি কিছু-কিছু পরিবর্তিত হয়েছে।
- ↑ তুলনীয়: গম্ভীর পাতাল, যথা... পৃ৪৬, ১২০ এবং হিমাদ্রির ধ্যানে যাহা...পৃ ৬৯৷