ছন্দ/গদ্যকবিতা ও ছন্দ

গদ্যকবিতা ও ছন্দ

 গীতাঞ্জলির গানগুলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কি না। মনে আছে সত্যেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেম, তিনি স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু চেষ্টা করেননি। তখন আমি নিজেই পরীক্ষা করেছি, ‘লিপিকা’র অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলি আছে। ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয়নি, বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ।

 তারপরে আমার অনুরোধক্রমে একবার অবনীন্দ্রনাথ এই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।[] আমার মত এই যে, তাঁর লেখাগুলি কাব্যের সীমার মধ্যে এসেছিল, কেবল ভাষাবাহুল্যের জন্য তাতে পরিমাণরক্ষা হয়নি। আর-একবার আমি সেই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছি।

 এই উপলক্ষ্যে একটা কথা বলবার আছে। গ্যকাব্যে অতিনিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্যকাব্যে ভাষায় ও প্রকাশরীতিতে যে একটি সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীনক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেকদুর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস এবং সেইদিকে লক্ষ্য রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি। এর মধ্যে কয়েকটি কবিতা আছে তাতে মিল নেই, পদ্যছন্দ আছে; কিন্তু পদ্যের বিশেষ ভাষারীতি ত্যাগ করবার চেষ্টা করেছি।[] যেমন— তরে, সনে, মোর প্রভৃতি যে-সকল শব্দ গদ্যে ব্যবহার হয় না সেগুলিকে এইসকল কবিতায় স্থান দিইনি।

 পুনশ্চ (প্রথম সং), ভূমিকা—১৩৩৯ আশ্বিন

  1. দ্রষ্টব্য ‘পাহাড়িয়া’ নামক চারটি গদ্যকবিতা; বিচিত্রা ১৩৩৪ শ্রাবণ-কার্তিক।
  2. কোমল গান্ধার, শালিখ, অস্থানে, ঘরছাড়া, ছুটি, গানের বাসা, পয়লা আশ্বিন, এই সাতটি কবিতায় মিল নেই, চলতি বাংলার চন্দ আছে। ‘মৃত্যু’ কবিতায় আছে সাধু বাংলার ছন্দ, ‘খেলনার মুক্তি’ প্রভৃতি যে ছয়টি কবিতা ‘পরিশেষ’ থেকে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে গৃহীত হয়েছে সেগুলিতেও তাই। এই সাতটি কবিতায় সাধু ছন্দ ব্যবহৃত হলেও সাধুভাষারীতি ব্যবহৃত হয়নি—সাধু ছন্দে হসন্তমধ্য চলতি ক্রিয়াপদের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ ছাড়া এই কাব্যের অনেক কবিতাই অল্পবিস্তর ছন্দঘেঁষা, আগাগোড়া ছন্দ রক্ষিত না হলেও নানাস্থানেই কিছুকিছু ছন্দ এসে পড়েছে।