ছন্দ/বাংলা শব্দ ও ছন্দ

বাংলা শব্দ ও ছন্দ

 বাংলা শব্দ উচ্চারণের মধ্যে কোথাও ঝোঁক[] নাই, অথবা যদি থাকে সে এত সামান্য যে, তাহাকে নাই বলিলেও ক্ষতি হয় না। এইজন্যই আমাদের ছন্দে অক্ষর গনিয়া মাত্রা নিরূপিত হইয়াছে। কথার প্রত্যেক অক্ষরের মাত্রা সমান। কারণ কোনো স্থানে বিশেষ ঝোঁক না থাকাতে অক্ষরের বড়ো ছোটো প্রায় নাই। সংস্কৃত উচ্চারণে যে দীর্ঘহ্রস্বের নিয়ম আছে তাহাও বাংলায় লোপ পাইয়াছে। এই কারণে উচ্চারণ-হিসাবে বাংলাভাষা বঙ্গদেশের সমতল-প্রসারিত প্রান্তরভূমির মতো সর্বত্র সমান।[] জিহ্বা কোথাও বাধা না পাইয়া ভাষার উপর দিয়া যেন একপ্রকার নিদ্রিত অবস্থায় চলিয়া যায়; কথাগুলি চিত্তকে পদে পদে প্রতিহত করিয়া অবিশ্রাম মনোযোগ জাগ্রত করিয়া রাখিতে পারে না।[] শব্দের সহিত শব্দের সংঘর্ষণে যে বিচিত্র সংগীত উৎপন্ন হয় তাহা সাধারণত বাংলা ভাষায় অসম্ভব; কেবল একতান কলধ্বনি ক্রমে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের চেতনা লোপ করিয়া দেয়।[] একটি শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ হৃদয়ংগম হইবার পূর্বেই অবিলম্বে আর-একটি কথার উপরে স্খলিত হইয়া পড়িতে হয়। বৈষ্ণর কবির একটি গান আছে—

মন্দপবন, কুঞ্জভবন,
কুসুমগন্ধ-মাধুরী।

এই দুটি ছত্রে অক্ষরের গুরুলঘু নিরূপিত হওয়াতে এই সামান্য গুটিকয়েক কথার মধুর ভাবে সমস্ত হৃদয় অধিকার করিয়া লয়। কিন্তু এই ভাব সমমাত্রক[] ছন্দে নিবিষ্ট হইলে অনেকটা নিষ্ফল হইয়া পড়ে। যেমন—

মৃদুল পবন, কুসুমকানন,
ফুলপরিমল-মাধুরী।

 ইংরেজিতে অনেক সময় আট-দশ লাইনের একটি ছোটো কবিতা লঘুবাণের মতো ক্ষিপ্রগতিতে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া মর্মের মধ্যে বিদ্ধ হইয়া থাকে। বাংলায় ছোটো কবিতা আমাদের হৃদয়ের স্বাভাবিক জড়তায় আঘাত দিতে পারে না। বোধ করি কতকটা সেই কারণে আমাদের ভাষার এই খর্বতা আমরা অত্যুক্তি দ্বারা পূরণ করিয়া লইতে চেষ্টা করি।[] একটা কথা বাহুল্য করিয়া না বলিলে আমাদের ভাষায় বড়োই ফাঁকা শুনায় এবং সে কথা কাহারো কানে পৌঁছায় না। সেইজন্য সংক্ষিপ্ত সংহত রচনা আমাদের দেশে প্রচলিত নাই বলিলেই হয়। কোনো লেখা অত্যুক্তি পুনরুক্তি বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং আড়ম্বরপূর্ণ না হইলে সাধারণত গ্রাহ্য হয় না।

 বাংলা পড়িবার সময় অনেক পাঠক অধিকাংশ স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করিয়া টানিয়া টানিয়া পড়েন।[] নচেৎ সমমাত্র হ্রস্বস্বরে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ কুলাইয়া উঠে না। বাংলার বক্তারা অনেকেই দীর্ঘ উচ্চারণ প্রয়োগ করিয়া বক্তৃতা বৃহৎ ও গম্ভীর করিয়া তোলেন। ভালো ইংরেজ অভিনেতার অভিনয়ে দেখিতে পাওয়া যায় এক-একটি শব্দকে সবলে বেষ্টন করিয়া প্রচণ্ড হৃদয়াবেগ কিরূপ উদ্দামগতিতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে। কিন্তু বাংলা অভিনয়ে শিথিল কোমল কথাগুলি হৃদয়স্রোতের নিকট সহজেই মাথা নত করিয়া দেয়, তাহাকে ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না। এইজন্য তাহাতে সর্বত্রই একপ্রকার দুর্বল সমায়ত সানুনাসিক ক্রন্দনস্বর ধ্বনিত হইতে থাকে। এইজন্য আমাদের অভিনেতারা যেখানে শ্রোতাদের হৃদয় বিচলিত করিতে চান সেখানে গলা চড়াইয়া অযথাপরিমাণে চিৎকার করিতে থাকেন এবং তাহাতে প্রায়ই ফললাভ করেন।

 মাইকেল তাঁহার মহাকাব্যে যে বড়ো বড়ো সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন— শব্দের স্থায়িত্ব, গাম্ভীর্য এবং পাঠকের সমগ্র মনোযোগ বন্ধ করিবার চেষ্টাই তাহার কারণ বোধ হয়।[] ‘যাদঃপতিরোধঃ যথা চলোর্মি-আঘাতে’ দুর্বোধ হইতে পারে, কিন্তু ‘সাগরের তট যথা তরঙ্গের ঘায়’ দুর্বল; ‘উড়িল কলম্বকুল অম্বর-প্রদেশে’ ইহার পরিবর্তে ‘উড়িল যতেক তীর আকাশ ছাইয়া’ ব্যবহার করিলে ছন্দের পরিপূর্ণ ধ্বনি নষ্ট হয়।[]

 বাংলা শব্দের মধ্যে এই ধ্বনির অভাববশত বাংলায় পদ্যের অপেক্ষা গীতের প্রচলনই অধিক।[১০] কারণ গীত সুরের সাহায্যে প্রত্যেক কথাটিকে মনের মধ্যে সম্পূর্ণ নিবিষ্ট করিয়া দেয়। কথায় যে অভাব আছে সুরে তাহা পূর্ণ হয়। এবং গানে এক কথা বার বার ফিরিয়া গাহিলে ক্ষতি হয় না। যতক্ষণ চিত্ত না জাগিয়া উঠে ততক্ষণ সংগীত ছাড়ে না। এইজন্য প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে গান ছাড়া কবিতা নাই বলিলে হয়।

 সংস্কৃতে ইহার বিপরীত দেখা যায়। বেদ ছাড়িয়া দিলে সংস্কৃত ভাষায় এত মহাকাব্য খণ্ডকাব্য সত্ত্বেও গান নাই। শকুন্তলা প্রভৃতি নাটকে যে দুই-একটি প্রাকৃত গীত দেখিতে পাওয়া যায় তাহা কাব্যের মধ্যে স্থান পাইতে পারে না। বাঙালি জয়দেবের গীতগোবিন্দ আধুনিক এবং তাহাকে একহিসাবে গান না বলিলেও চলে। কারণ, তাহার ভাষালালিত্য ও ছন্দোবিন্যাস এমন সম্পূর্ণ যে তাহা সুরের অপেক্ষা রাখে না; বরং আমার বিশ্বাস সুরসংযোগে তাহার স্বাভাবিক শব্দনিহিত সংগীতের লাঘব করে। কিন্তু

মনে রৈল সই মনের বেদনা।
প্রবাসে যখন যায় গো সে
তারে বলি বলি বলা হল না।[১১]

ইহ। কাব্যকলায় অসম্পূর্ণ, অতএব সুরের প্রতি ইহার অনেকটা নির্ভর। সংস্কৃত শব্দ এবং ছন্দ ধ্বনিগৌরবে পরিপূর্ণ। সুতরাং সংস্কৃতে কাব্যরচনার সাধ গানে মিটাইতে হয় নাই, বরং গানের সাধ কাব্যে মিটিয়াছে। মেঘদূত সুরে বসানো বাহুল্য।

 হিন্দিসাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না। কিন্তু এ-কথা বলিতে পারি, হিন্দিতে যে-সকল ধ্রুপদ খেয়াল প্রভৃতি পদ শুনা যায় তাহার অধিকাংশই কেবলমাত্র গান, একেবারেই কাব্য নহে। কথাকে সামান্য উপলক্ষ্যমাত্র করিয়া সুর শুনানোই হিন্দি গানের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলায় সুরের সাহায্য লইয়া কথার ভাবে শ্রোতাদিগকে মুগ্ধ করাই কবির উদ্দেশ্য। কবির গান, কীর্তন, রামপ্রসাদী গান, বাউলের গান প্রভৃতি দেখিলেই ইহার প্রমাণ হইবে। অতএব কাব্যরচনাই বাংলাগানের মুখ্য উদ্দেশ্য, সুরসংযোগ গৌণ। এইসকল কারণে বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারে রত্ন যাহা কিছু পাওয়া যায় তাহা গান।

 সাধনা—১২৯৯ শ্রাবণ

  1. এই প্রসঙ্গের বিস্তৃত আলোচনা ‘বাংলা ছন্দ’ নামক প্রথম প্রবন্ধে দ্রষ্টব্য।
  2. তুলনীয়: বাংলা দেশটি যেমন সমভূমি... পৃ. ৩, সমতল বাংলা আপন কাব্যের ভাষাকে সমতল করে দিয়েছে পৃ ৪৮।
  3. তুলনীয়: মন চলে যায় ঘুমিয়ে পড়া গাড়োয়ানকে নিয়ে রাতের বেলার গোরুর গাড়ির মতো পৃ ১২৩-২৪।
  4. এই উক্তি সাধু বা সংস্কৃত বাংলার সম্বন্ধে প্রযোজ্য, চলতি বা প্রাকৃত বাংলার সম্বন্ধে নয়। প্রাকৃত-বাংলার প্রকৃতি সমতল নয় এবং তাতে শব্দের সংঘাতজাত সংগীতবৈচিত্র্যও আছে, একথা বহুস্থলেই বলা হয়েছে। দ্রষ্টব্য পৃ ৬-৮, ১৭-১৮, ৪৯-৫১ ইত্যাদি।
  5. অন্যত্র (পৃ ৩৫-৩৬) সম, অসম ও বিষম মাত্রার ছন্দের কথা বলা হয়েছে। সেখানে সমমাত্রার ছন্দ মানে জোড়মাত্রার ছন্দ। এখানে সে অর্থ নয়। এখানে সমমাত্রক ছন্দ মানে সমতল অর্থাৎ ধ্বনির হ্রস্বদীর্ঘতা বা উচ্চনীচতা-হীন ছন্দ। পরবর্তী ‘সমমাত্র হৃস্বস্বর’ লক্ষিতব্য। ৩ পৃষ্ঠাতেও এই অর্থে ‘সমমাত্রিক ছন্দ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে।
  6. দ্রষ্টব্য ২-৩ পৃষ্ঠা।
  7. তুলনীয়: কবিতা পড়িতে হইলে আমরা সুর করিয়া পড়ি পৃ ৪।
  8. দ্রষ্টব্য ১২২ পৃষ্ঠা।
  9. তুলনীয়: হিমালয় নামে গিরি... পৃ ১২৩।
  10. দ্রষ্টব্য ৩-৪ পৃষ্ঠা।
  11. কবিওয়ালা রাম বসুর (১৭৮৬-১৮২৮) গান। দ্রষ্টব্য: সুশীলকুমার দে-প্রণীত History of Bengali Literature পৃ ৩৭৭ এবং জীবনস্মৃতি, অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী।