ছন্দ/বিহারীলালের ছন্দ
বিহারীলালের ছন্দ
সাময়িক কবিদিগের সহিত বিহারীলালের একটি প্রধান প্রভেদ তাঁহার ভাষা। ভাষার প্রতি আমাদের অনেক কবির কিয়ৎপরিমাণে অবহেলা আছে। বিশেষত মিত্রাক্ষর ছন্দের মিলটা তাঁহারা নিতান্ত কায়ক্লেশে রক্ষা করেন। অনেকে কেবলমাত্র শেষ অক্ষরের মিলকে যথেষ্ট জ্ঞান করেন এবং অনেকে ‘হয়েছে, করেছে, ভুলেছে’ প্রভৃতি ক্রিয়াপদের মিলকে মিল বলিয়া গণ্য করিয়া থাকেন। মিলের দুইটি প্রধান গুণ আছে, এক তাহা কর্ণতৃপ্তিকর আর এক অভাবিতপূর্ব। অসম্পূর্ণ মিলে কর্ণের তৃপ্তি হয় না, সেটুকু মিলে স্বরের অনৈক্যটা আরো যেন বেশি করিয়া ধরা পড়ে এবং তাহাতে কবির অক্ষমতা ও ভাষার দারিদ্র্য প্রকাশ পায়। ক্রিয়াপদের মিল যত ইচ্ছা করা যাইতে পারে, সেরূপ মিলে কর্ণে প্রত্যেকবার নূতন বিস্ময় উৎপাদন করে না, এইজন্য তাহা বিরক্তিজনক ও ‘একঘেয়ে’ হইয়া উঠে। বিহারীলালের ছন্দে মিলের এবং ভাষার দৈন্য নাই। তাহা প্রবহমান নির্ঝরের মতো সহজ সংগীতে অবিশ্রাম ধ্বনিত হইয়া চলিয়াছে। ভাষা স্থানে স্থানে সাধুতা পরিত্যাগ করিয়া অকস্মাৎ অশিষ্ট এবং কর্ণপীড়ক হইয়াছে, ছন্দ অকারণে আপন বাঁধ ভাঙিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু সে কবির স্বেচ্ছাকৃত, অক্ষমতাজনিত নহে। তাঁহার রচনা পড়িতে পড়িতে কোথাও এ-কথা মনে হয় না যে, এইখানে কবিকে দায়ে পড়িয়া মিল নষ্ট বা ছন্দ ভঙ্গ করিতে হইয়াছে।
...প্রথম উপহারটি ব্যতীত ‘বঙ্গসুন্দরী’র অন্য সকল কবিতার ছন্দই পর্যায়ক্রমে বার এবং এগার অক্ষরে ভাগ করা। যথা—
সুঠাম শরীর পেলব লতিকা,
আনত সুষমা কুসুম-ভরে;
চাঁচর চিকুর নীরদ-মালিকা
লুটায়ে পড়েছে ধরণী ’পরে।
এ-ছন্দ নারীবর্ণনার উপযুক্ত বটে, ইহাতে তালে তালে নূপুর ঝংকৃত হইয়া উঠে। কিন্তু এ-ছন্দের প্রধান অসুবিধা এই যে, ইহাতে যুক্ত-অক্ষরের স্থান নাই। পয়ার ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দে লেখকের এবং পাঠকের অনেকটা স্বাধীনতা আছে। অক্ষরের মাত্রাগুলিকে কিয়ৎপরিমাণে ইচ্ছামতো বাড়াইবার কমাইবার অবকাশ আছে।[১] প্রত্যেক অক্ষরকে একমাত্রার স্বরূপ গণ্য করিয়া একেবারে একনিশ্বাসে পড়িয়া যাইবার আবশ্যক হয় না। দৃষ্টান্তের দ্বারা আমার কথা স্পষ্ট হইবে।
হে সারদে দাও দেখা,
বাঁচিতে পারিনে একা,
কাতর হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয়;
কি বলেছি অভিমানে
শুনো না শুনো না কানে,
বেদনা দিও না প্রাণে ব্যথার সময়।
ইহার মধ্যে প্রায় যুক্ত-অক্ষর নাই। নিম্নলিখিত শ্লোকে অনেকগুলি যুক্তাক্ষর আছে, অথচ উভয় শ্লোকই সুখপাঠ্য এবং শ্রুতিমধুর।
পদে পৃথ্বী, শিরে ব্যোম,
তুচ্ছ তারা সূর্য সোম,
নক্ষত্র নখাগ্রে যেন গনিবারে পারে;
সমুখে সাগরাম্বরা
ছড়িয়ে রয়েছে ধরা,
কটাক্ষে কখন যেন দেখিছে তাহারে।
এই দুটি শ্লোকই কবির রচিত ‘সারদামঙ্গল’ হইতে উদ্ধৃত। এক্ষণে ‘বঙ্গসুন্দরী’ হইতে দুইটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া তুলনা করা যাক।
একদিন দেব তরুণ তপন
হেরিলেন সুরনদীর জলে,
অপরূপ এক কুমারীরতন
খেলা করে নীল নলিনীদলে।
ইহার সহিত নিম্নউদ্ধৃত শ্লোকটি একসঙ্গে পাঠ করিলে প্রভেদ প্রতীয়মান হইবে।
অপ্সরী কিন্নরী দাঁড়াইয়ে তীরে
ধরিয়ে ললিত করুণা-তান,
বাজারে বাজারে বীণা ধীরে ধীরে
গাহিছে আদরে স্নেহের গান।
“অপ্সরী কিন্নরী” যুক্ত-অক্ষর লইয়া এখানে ছন্দোভঙ্গ করিয়াছে।[২] কবিও এই কারণে বঙ্গসুন্দরীতে যথাসাধ্য যুক্ত-অক্ষর বর্জন করিয়া চলিয়াছেন।[৩]
কিন্তু বাংলা যে ছন্দে যুক্ত-অক্ষরের স্থান হয় না সে ছন্দ আদরণীয় নহে। কারণ ছন্দের ঝংকার এবং ধ্বনিবৈচিত্র্য যুক্ত-অক্ষরের উপরেই অধিক নির্ভর করে। একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা নাই, তার উপরে যদি যুক্ত-অক্ষর বাদ পড়ে, তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। তাহা শীঘ্রই শ্রান্তিজনক তন্দ্রাকর্ষক হইয়া উঠে এবং হৃদয়কে আঘাতপূর্বক ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না।[৪] সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা এবং যুক্ত-অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগূঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন, সেইজন্য তাঁহার অমিত্রাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়।[৫]
আর্যদর্শনে বিহারীলালের সারদামঙ্গল-সংগীত যখন প্রথম বাহির হইল, তখন ছন্দের প্রভেদ মুহূর্তেই প্রতীয়মান হইল। সারদামঙ্গলের ছন্দ নূতন নহে, তাহা প্রচলিত ত্রিপদী; কিন্তু কবি তাহা সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছেন। বঙ্গসুন্দরীর ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, সেই মিষ্টতা একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন, কিন্তু সারদামঙ্গলের গীতসৌন্দর্য অনুকরণসাধ্য নহে।
- ↑ তুলনীয়: পদ্মার ছন্দের বিশেষ গুণ...বাড়ানো-কমানো যায় পৃ ১২০।
- ↑ তুলনীয়: বদনমণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া পৃ ৫৫ ও ১২৩, লৌহশৃঙ্খলের ডোর পৃ ৬৬, এবং রয়েছে পড়িয়া শৃঙ্খলে বাঁধা পৃ ৬৭।
- ↑ প্রাক্মানসী যুগের রবীন্দ্রসাহিত্যেও যুক্তাক্ষরবর্জনের প্রয়াস দেখা যায়। লক্ষণীয়: ‘সেইজন্যে যুক্ত-অক্ষর...সমতল করে যাচ্ছিলুম’ ইত্যাদি, পৃ ৬৬-৬৭।
- ↑ তুলনীয়: জিহ্বা কোথাও...জাগ্রত করিয়া রাখিতে পারে না পৃ ১৭২।
- ↑ তুলনীয়: মাইকেল তাঁহার মহাকাব্যে...পরিপূর্ণ ধ্বনি নষ্ট হয় পৃ ১৭৪।