ছন্দ/সংজ্ঞাপরিচয়

সংজ্ঞাপরিচয়

 অক্ষর (পৃ ৩-৪)— বাংলায় অক্ষর শব্দের অর্থ অনিশ্চিত। এ শব্দে কখনও বোঝায় হসন্ত বর্ণ, কখনও স্বরান্ত,(যুক্ত বা অযুক্ত) বর্ণ। ছন্দের আলোচনায় অক্ষর শব্দটি সাধারণত একই সঙ্গে এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই জন্যই পু. ণ্য. বা. ন্ শব্দে চার অক্ষর ধরা হয়। অক্ষরসংখ্যা অনেক সময়ই লিপি ও বানানরীতির উপরে নির্ভর করে। তাই আ. ল্. প. না শব্দে চার অক্ষর, অথচ ক. ল্প. না শব্দে তিন অক্ষর। রবীন্দ্রনাথ এই প্রচলিত অর্থেই অক্ষর শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন।

 কেউ কেউ বর্ণ এবং অক্ষর এই শব্দদুটিকে ভিন্নার্থক বলে গণ্য করেন। তাঁদের মতে বর্ণ মানে letter এবং অক্ষর মানে syllable। সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রে এই দুটি শব্দ একার্থেই ব্যবহৃত হয়। উক্ত শাস্ত্রে প্রযুক্ত অক্ষর বা বর্ণ শব্দের দ্বারা অনেক সময় সিলেব্‌ল্ বোঝালেও অক্ষর আর সিলেব্‌ল্ এক নয়। ছন্দ শব্দে দুটি অক্ষর ছ+ন্দ, প্রথমটি অযুক্ত এবং দ্বিতীয়টি যুক্ত। কিন্তু তার সিলেব্‌ল্-বিভাগ হচ্ছে ছন্+দ। শব্দের মধ্যে বা অন্তে যুক্তাক্ষর বা যুক্তবর্ণ থাকলেই অক্ষর-বিভাগ ও সিলেব্‌ল্-বিভাগের পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ বর্ণ বা অক্ষর শব্দকে সিলেব্‌ল্ অর্থে ব্যবহার করেন নি।

 অক্ষরবৃত্ত (পৃ ৫২)— বাংলা ছন্দের তিনটি শাখার (পৃ ১৩২) মধ্যে যে শাখাটিকে রবীন্দ্রনাথ সাধুছন্দ বা সাধুভাষার ছন্দ নাম দেন, তাকে অনেক সময় বলা হয় অক্ষরবৃত্ত। কেননা প্রচলিত হিসাবে এ শাখার সব ছন্দেই একএক অক্ষরকেই একএক মাত্রা বলে গণনা করা হয়। তাই রবীন্দ্রনাথও এই শ্রেণীর ছন্দকে ‘অক্ষরগোনা’ বলে পরিচয় দিয়েছেন (পৃ ১৪২, ১৯২)। কিন্তু অক্ষরবৃত্ত নামটি সমীচীন নয়, কারণ অক্ষর শব্দটাই অনিশ্চিতার্থক। রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, “আক্ষরিক ছন্দ বলে কোনো অদ্ভুত পদার্থ বাংলায় কিংবা অন্য কোনো ভাষাতেই নেই। অক্ষর ধ্বনির চিহ্ন মাত্র” (পৃ ৬১)। ছন্দ ধ্বনির উপরেই প্রতিষ্ঠিত, তার চিহ্নের উপরে নয়।

 অতিপর্ব (anacrusis)— অনেক সময় ছন্দপংক্তির সমুখে একটি করে দুই বা তিন মাত্রা পরিমিত খণ্ডপর্ব থাকে, যা ঠিক ছন্দপংক্তির অন্তর্‌ভুক্ত নয় অথচ যার প্রভাবে ছন্দের দোলায় বেশ একটু বৈচিত্র্য দেখা দেয়। এ-রকম অতিরিক্ত খণ্ডপর্বকে বলা হয় অতিপর্ব (পৃ ১৭১)। অতিপর্ব মূল পংক্তি থেকে একটু বিচ্ছিন্নভাবে উচ্চারিত ও লিখিত হয়। চলতি কথায় এ-রকম উচ্চারণকে বলা হয় ‘আড়ে’ রাখা (পৃ ১০২)। ১২৯-১৩১ পৃষ্ঠায় উদাহৃত তিনটি দৃষ্টান্তের ওরে, এমন, শুনি প্রভৃতি, বিচ্ছিন্ন শব্দগুলি অতিপর্ব।

 অনুষ্টুপ্ (পৃ ৫০)—একটি সংস্কৃত ছন্দোবর্গের নাম। যে সকল সংস্কৃত ছন্দের প্রত্যেকপাদে অর্থাৎ চতুর্থাংশে আটটি করে স্বরাক্ত বর্ণ থাকে তাদেরই সাধারণ নাম অনুষ্টুপ্। অনুষ্টুপ্‌ ছন্দের দুই শ্রেণী। এক শ্রেণীর অনুষ্টুপ্ ছন্দে লঘুগুরুভেদে প্রত্যেক বর্ণের রূপ নির্দি‌ষ্ট থাকে। অন্য শ্রেণীর ধ্বনিবিন্যাস অপেক্ষাকৃত স্বাধীন। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ছন্দসমূহকে বলা হয় অনুষ্টুপ্-বক্ত্র বা শুধু বক্ত্র। বক্ত্রশ্রেণীর সব চেয়ে বেশি প্রচলিত ও পরিচিত বিশেষ ছন্দটির নাম পথ্যাবক্ত্র। বাংলায় পয়ারের যে স্থান, সংস্কৃতে পথ্যাবক্ত্রের সেই স্থান। এই ছন্দের নিয়ম এই— পঞ্চম বর্ণ সব পাদেই লঘু এবং ষষ্ঠ বর্ণ সব পাদেই গুরু; সপ্তম বর্ণ প্রথম ও তৃতীয় পাদে গুরু, কিন্তু দ্বিতীয় ও চতুর্থ পাদে লঘু; অন্যান্য বর্ণের লঘুত্ব-গুরুত্ব নিয়মিত নয়। ৫০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত দৃষ্টান্তটির ছন্দোবিশ্লেষ হচ্ছে এ-রকম।—

|| || || | || |
পাঁচালী না। ম বিখ্যাতা | সাধারণ। মনোরমা।
| || || | || |
পয়ার ত্রি। পদী আদি | প্রাকৃতে হ। য় চালনা

 অনুষ্টুপ্ বর্গের অন্তর্গত এই পথ্যাবক্ত্র ছন্দই সব চেয়ে সুপরিচিত। তাই অনুষ্টুপ্ ছন্দ বলতে সাধারণত এই ছন্দকেই বোঝায়।

 অবয়ব (পৃ ১১৯)—এটিকে যথার্থ পারিভাষিক শব্দ বলা যায় না। পুর্ণযতির ছন্দোবিভাগ অর্থাৎ পংক্তিকেই বলা হয়েছে অবয়ব। অন্যত্র তাকেই বলা হয়েছে রূপকল্প (পৃ ৯৯)। দ্রষ্টব্য ‘চাল’।

 অমিত্রাক্ষর—অমিত্রাক্ষর মানে অমিল। কিন্তু অমিল ছন্দ মাত্রকেই অমিত্রাক্ষর বলা যায় না। ছন্দপরিভাষায় এ শব্দটি একটি বিশিষ্ট রূঢ়ার্থ অর্জন করেছে। রূঢ়ার্থে অমিত্রাক্ষর নামের দ্বারা পয়ারের প্রকারভেদ বোঝা যায়। যে পয়ারের পংক্তিপ্রান্তে মিল থাকে না এবং পংক্তির শেষে ‘বড়ো যতি’ অর্থাৎ পূর্ণযতি স্থাপন আবশ্যিক বলে গণ্য হয় না, সে পয়ারেরই পারিভাষিক নাম অমিত্রাক্ষর (পৃ ১৫৩)। এ ছন্দে পূর্ণযতির বিভাগ প্রায়শই পয়ারের চোদ্দ বা আঠার মাত্রার নির্দিষ্ট পংক্তিসীমা অতিক্রম করে যায়। তাই একে পংক্তিলঙ্ঘক (পয়ার) ছন্দ বলেও অভিহিত করা হয়েছে (পৃ ১৫৬) এবং পয়ার রচনার এই নূতন রীতিকে বলা হয়েছে পংক্তিলঙ্ঘন, লাইন ডিঙোনো চাল (পৃ ৬৯) বা প্রবহমানতা (enjambement, পৃ ২১৫)। কিন্তু ‘সংস্কৃতের অমিত্রাক্ষর রীতি’ (পৃ ১৯০) বলতে পংক্তিলঙ্ঘন বোঝায় নি, শুধু মিলহীনতাই বুঝিয়েছে।

 অযুগ্মধ্বনি (open syllable)—দ্রষ্টব্য ‘ধ্বনি’।

 অসমমাত্রার ছন্দ (পৃ ৩৬)—যে ছন্দে পূর্ণপর্বের আয়তন ছয় মাত্রা তাকে কোথাও বলা হয়েছে ‘ছয়মাত্রার ছন্দ’ (পৃ ১১-১২) এবং কোথাও বলা হয়েছে’ ‘ষড়ঙ্গী’ (পৃ ১০০)। এ ছন্দের পর্বগুলিতে অনেক স্থলেই দুটি করে তিনমাত্রার উপপর্ব থাকে। উপপর্বের এই আয়তনের হিসাবে রবীন্দ্রনাথ এ ছন্দকে তিনমাত্রার ছন্দ (পৃ ২৪২), তিনবর্গ মাত্রার ছন্দ, ত্রৈমাত্রিক ছন্দ প্রভৃতি নানা নাম দিয়েছেন। তিন সংখ্যাটা অসম অর্থাৎ বিজোড়। সেজন্য এ ছন্দকে তিনি ‘অসমমাত্রার ছন্দ’ নামেও অভিহিত করেছেন। যে ছন্দের উপপর্ব দুইমাত্রা-পরিমিত তাকে বলেছেন ‘সমমাত্রার ছন্দ,’ আর দুই মাত্রা ও তিন মাত্রার দু-রকম উপপর্ব নিয়ে গঠিত ছন্দকে বলেছেন ‘বিষমমাত্রার ছন্দ’ (পৃ ১৪-১৫, ৩৫-৩৬)।

 বিষমমাত্রার ছন্দের উপপর্বগুলি স্বভাবতই সমান নয়। এজন্য বিষমমাত্রার ছন্দকে এক স্থলে ‘অসমান মাত্রার ছন্দ’ (পৃ ১৩-১৪) এবং অন্যত্র ‘অসমমাত্রার ছন্দ’ (পৃ ১৪, ১৪১) নামও দেওয়া হয়েছে। ‘অসমান মাত্রাভাগের ছন্দ’ (পৃ ১৩৩) বলতে কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য বিষয় বোঝাচ্ছে। এখানে মাত্রাভাগ মানে যতিবিভাগ বা পর্ব (পৃ ১৩৫ পাদটীকা ১)।

 ষন্মাত্রপর্বিক ছন্দের উপপর্বে সাধারণত তিন মাত্রা থাকে বলেই তাকে বলা হয়েছে অসমমাত্রার ছন্দ। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ ছন্দের পর্বে অনেক সময় তিনটি করে দুইমাত্রার উপপর্বও থাকে (পৃ ১০০-১০১, ২৩৯)।

 আর্যা.(পৃ ১৫৩)—সংস্কৃত মাত্রাবৃত্ত বিভাগের অন্তর্গত একটি ছন্দোবর্গের নাম আর্যা। আর্যার রূপভেদ অনেক। তার মধ্যে যে রূপটি সব চেয়ে বেশি পরিচিত তার নাম পথ্যার্যা। তাই আর্যা ছন্দ বলতে সাধারণত এই পথ্যার্যা ছন্দকেই বোঝায়। আর্যাবর্গের প্রধান নিয়মগুলি হচ্ছে এই।—

 ১। প্রতি গণে বা পর্বে চার কলামাত্রা থাকা চাই। আর্যা হচ্ছে মূলত একটি চতুর্মাত্রপর্বিক ছন্দোবর্গের নাম।

 ২। প্রথমার্ধে সাড়ে সাত পর্ব, ত্রিশ মাত্রা।

 ৩। দ্বিতীয়ার্ধেও সাড়ে সাত পর্বই গণনা করা হয়। কিন্তু এই অর্ধের ষষ্ঠ পর্বটি একমাত্রক বলে স্বীকার্য। সুতরাং এর মোট মাত্রাসংখ্যা সাতাশ।

 ৪। প্রথম বা দ্বিতীয় কোনো অর্ধেই অযুগ্মসংখ্যক পর্বগুলি মধ্যগুরু (| || |) হতে পারে না। কিন্তু প্রথমার্ধের ষষ্ঠ পর্বটি মধ্যগুরুই হওয়া চাই, বিকল্পে চতুর্লঘু হতে পারে।

 যে আর্যা ছন্দের উভয়ার্ধেই তৃতীয় পর্বের অর্থাৎ বার মাত্রার পরে যতি থাকে তার বিশেষ নাম পথ্যার্যা| আর যে আর্যার কোনো এক অর্ধে বা উভয়ার্ধে সাড়ে তিন পর্বের অর্থাৎ চোদ্দ মাত্রার পরে যতি পড়ে তার নাম বিপুলার্যা। আর্যার আরও বহু রূপভেদ আছে। তার মধ্যে পথ্যার্যার প্রয়োগই দেখা যায় সব চেয়ে বেশি। পথ্যার্যার দৃষ্টান্ত—

 | || |
আ পরি | তোষাদ্ | বিদুষাং || ন সাধু | মন্যে | প্রয়োগ | বিজ্ঞা | নম্।
 |
বলবদ | পি শিক্ষি | তানাম্ || আত্ম- | ন্যপ্র- | ত্য | য়ং চে | তঃ।

—অভিজ্ঞানশকুন্তলম, প্রথম অঙ্ক

উভয়ার্ধেই শেষ ধ্বনিটি দ্বিমাত্রক। শুধু সংস্কৃতে নয়, প্রাকৃতেও আর্যার বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। আর্যা ছন্দে পাদবিভাগের অসমানতা তথা যতিস্থাপনের স্বাধীনতা এ ছন্দকে অনেকাংশে গদ্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছে (পৃ ১৫৩, ১৫৭)।

 উপপর্ব—দ্রষ্টব্য ‘পর্ব’।

 একতালা—দ্রষ্টব্য ‘তাল’।

 কলা (পৃ ৯৬)—একটি লঘুধ্বনি উচ্চারণ করতে যে সময় লাগে, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রে তাকেই বলা হয় কলা। সংস্কৃত ও প্রাকৃতে এই কলাই মাত্রারূপে ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ কলাসংখ্যা দ্বারাই ছন্দোগত ধ্বনি পরিমিত হয়। তাই ‘চতুষ্কল গণ’ বলতে বোঝায় চতুর্মাত্রক পর্ব। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই শব্দটিকে অন্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি সাধারণত পর্বকেই বলেছেন কলা। যেমন—মেঘ ডাকে | গম্ভীর | গরজনে (পৃ ১০৪), সকল বেলা | কাটিয়া গেল (পৃ ১০২), অন্তর তার | কী বলিতে চায় (পৃ ১০৩) প্রভৃতি দৃষ্টান্তের চার, পাঁচ ও ছয় মাত্রার পর্বকেই তিনি কলা বলে পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কোনো স্থলে উপপর্বকেও বলেছেন কলা। যেমন—শ্রাবণ-গগন, | ঘোর ঘনঘটা (পৃ ১০৫), এ দৃষ্টান্তটা হচ্ছে ‘ষড়ঙ্গী’ এবং রবীন্দ্রনাথের মতেই এর প্রতিকলায় ছয় মাত্রা গণ্য হওয়া উচিত (পৃ ১০০-১০১)। কিন্তু তা না করে তিনি এই দৃষ্টান্তটির প্রতিকলায় গণনা করেছেন তিন মাত্রা, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে উপপর্বকেই বলেছেন কলা।

 কাওয়ালি—দ্রষ্টব্য ‘তাল’।

 গগনাঙ্গ (পৃ ১০৮)—একটি প্রাকৃত ছন্দ। এ ছন্দের প্রতিপাদে কুড়িটি স্বরান্ত অক্ষর এবং পঁচিশ কলামাত্রা থাকে। মাত্রাস্থাপনের বিশেষ বিধান এই যে, পাদের প্রথমেই থাকবে একটি চতুষ্কল গণ (অর্থাৎ চার কলামাত্রার পর্ব) এবং পাদের শেষ দুটি অক্ষর হবে যথাক্রমে লঘু ও গুরু। অন্যান্য অক্ষরের লঘুত্ব-গুরুত্ব নিয়মিত নয়। যথা—

 | ||
ভংজিঅ | মলঅচোলবই ণিবলিঅ গংজিঅ গুজ্জরা।

 চতুষ্পদ— দ্রষ্টব্য ‘পদ’।

 চরণ—দ্রষ্টব্য ‘পদ’।

 চলন (পৃ ৩৪) — এটি পারিভাষিক শব্দ নয়। রবীন্দ্রনাথ এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন ছন্দপংক্তির বিভাগ অর্থে। এক রকম বিভাগকে বলা যায় পর্ব এবং পর্বের উপবিভাগকে বলা যায় উপপর্ব। চলন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কখনও পর্ব অর্থে, কথনও উপপর্ব অর্থে। যেমন—

শরদচন্দ | পবন মন্দ | বিপিন ভরল | কুসুমগন্ধ |

এটি হচ্ছে ষড়ঙ্গী অর্থাৎ যন্মাত্রপর্বিক ছন্দ। রবীন্দ্রনাথের মতে এর প্রতিপদক্ষেপে অর্থাৎ চলনে ছয় মাত্রা (পৃ ৩৪)। সুতরাং চলন মানে পর্ব। তার পরেই চার মাত্রার চলন বা পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত (পৃ ৩৫) দিয়েছেন এবং অন্যত্রও (পৃ ৪০) এ-রকম চলনের উল্লেখ করেছেন। এ সব স্থলেও চলন মানে পর্ব। কিন্তু আবার দুই মাত্রার (সমমাত্রার) তথা তিন মাত্রার (অসমমাত্রার) চলনের কথাও বলা হয়েছে (পৃ ৩৫-৩৬)। সে সব স্থলে চলন মানে উপপর্ব। যেমন—‘নয়নধারায় | পথ সে হারায় | চায় সে পিছন | পানে’ এটাও ষড়ঙ্গী, কেননা এর প্রতিপদক্ষেপে ছয় মাত্রা। অন্য পরিভাষায় এর প্রতিপর্বে ছয় মাত্রা এবং প্রতিউপপর্বে তিন মাত্রা। সুতরাং এ স্থলে তিন মাত্রার চলন বলতে উপপর্বই বোঝাচ্ছে। সমচলন, অসমচলন, বিষমচলন প্রভৃতি কথায় (পৃ ৩৫-৩৬) চলন মানে উপপর্ব।

 চাল (পৃ ৩৪)—এটিও পারিভাষিক শব্দ নয়। ছন্দের পূর্ণযতির বিভাগ বা পংক্তিকেই বলা হয়েছে চাল। একএকটি পূর্ণযতির পরে প্রত্যেক ছন্দেরই পূর্ণরূপের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই এই পূর্ণযতির বিভাগ বা চালকে প্রদক্ষিণ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। যেমন—

শরদচন্দ পবন মন্দ বিপিন ভরল কুসুমগন্ধ
ফুল্ল মল্লি মালতি যুথি মত্ত মধুপ ভোরনী।

এখানে “আটটি চলনে এই ছন্দের চাল সারা হচ্ছে।” অর্থাৎ আটটি পর্ব নিয়ে এই ছন্দের পূর্ণরূপ বা পংক্তি গঠিত হয়েছে; কেননা আট পর্বের পরেই উক্ত পূর্ণরূপের এক প্রদক্ষিণ সমাপ্ত হয়েছে, তার পরেই পুনরাবর্তন। সুতরাং এখানে চাল বা প্রদক্ষিণ মানে পূর্ণযতির বিভাগ অর্থাৎ পংক্তি। কিন্তু তার পরেই চাল বা প্রদক্ষিণ বলতে পংক্তি না বুঝিয়ে বোঝাচ্ছে দুই পংক্তি নিয়ে গঠিত শ্লোক বা যুগ্মক (couplet)। যেমন—

মহাভার | তের কথা | অমৃত স | মান।
কাশীরাম | দাস কহে | শুনে পুণ্য | বান

এখানে চার পর্বের পরে পূর্ণযতি, তার পরেই পুনরাবর্তন। সুতরাং আট পদক্ষেপে (চলনে) এর প্রদক্ষিণ (চাল), এই উক্তিতে বুঝতে হবে এখানে দুই পংক্তির যুক্ত রূপটাই অভিপ্রেত। অন্যত্র (পৃ ১২) ত্রিপদী প্রভৃতি বন্ধের পদবিভাগ অর্থেও চাল শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। দ্রষ্টব্য ‘প্রদক্ষিণ’।

 চৌতাল—দ্রষ্টব্য ‘তাল’।

 চৌপদী (পৃ ১১)—যে ছন্দোবন্ধের প্রতিপংক্তিতে চার পদ অর্থাৎ অর্ধ যতির বিভাগ থাকে, তাকেই বলা যায় চৌপদী। পয়ার (বা দ্বিপদী) এবং ত্রিপদীর ন্যায় চৌপদীও ত্রিবিধ: সাধু ছন্দের অক্ষরগোনা, প্রাকৃত-বাংলার সিলেব্‌ল্‌গোনা এবং মাত্রাবৃত্তের কলাগোনা।

প্রথম শীতের মাসে |
শিশির লাগিল ঘাসে |
হুহু করে হাওয়া আসে |
হিহি করে কাঁপে গাত্র।

এই পংক্তিটিতে চার পদ সুস্পষ্ট। প্রতিপদে ‘অক্ষর’সংখ্যা হিসাবে আট মাত্রা। ‘হাওয়া’ শব্দের ‘ওয়া'র উচ্চারণরূপ wa, সুতরাং এক অক্ষর। এটা সাধু ছন্দের চৌপদী পংক্তি। প্রাকৃত-বাংলার চৌপদীর দৃষ্টান্ত এই (পৃ ১৭)।—

কই পালঙ্ক, কই রে কম্বল |
কপ্‌নি-টুকরো রইল সম্বল |
একলা পাগলা ফিরবে জঙ্গল |
মিটবে সংকট ঘুচবে ধন্দ ৷

প্রতিপদে সিলেব্‌ল্‌সংখ্যা হিসাবে আট মাত্রা। এর সাধুরূপ দ্রষ্টব্য ১৮ পৃষ্ঠায়। এর মাত্রাবৃত্ত রূপ হতে পারে এ-রকম—

শয্যা-বস্ত্র নাই |
শুধু কৌপীন চাই |
অরণ্যে তার ঠাঁই |
অন্তরে নাই ভয়-চিন্তা।

এর প্রতিপদে কলাসংখ্যা হিসাবে আট মাত্রা, কেবল চতুর্থ পদে এগার কলামাত্রা।

 রবীন্দ্রনাথ মনে করেন পয়ার ত্রিপদী চৌপদী সবই দুইবর্গ মাত্রার ছন্দ (পৃ ১৩); সেজন্য এগুলিকে কখনও বলেছেন সমমাত্রার ছন্দ (পৃ ৩৬), আর কখনও বলেছেন দ্বৈমাত্রিক ছন্দ (পৃ ৬৭)। অর্থাৎ তাঁর মতে এ সব ছন্দোবন্ধ দুইমাত্রার উপপর্ব নিয়েই গঠিত হয়। পয়ার সম্বন্ধে এই উক্তি সত্য বটে, কিন্তু ত্রিপদী-চৌপদী সম্বন্ধে এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কেননা তিন মাত্রার উপপর্ব কিংবা তিন ও দুই মাত্রার পর্যায়ক্রমিক উপপর্ব নিয়েও ত্রিপদী চৌপদী হতে পারে। ত্রৈমাত্রিক উপপর্বের চৌপদীর দৃষ্টান্ত দিলাম (পৃ ১৩৯)।—

সে ধারার টানে | তরীখানি চলে,
সেই ডাক শুনে | মন মোর টলে,
এই টানাটানি | ঘুচাও জগার,
হয়েছে বিষম | দায়।

এই চৌপদী পংক্তিটির প্রতিপদে দুই পর্ব; প্রতিপর্বে ছয় ও প্রতিউপপর্বে তিন মাত্রা, শেষ উপপর্বটি অপূর্ণ। প্রথম পাঁচটি পর্বে— উপযতি লুপ্ত, সুতরাং উপপর্ববিভাগ সুস্পষ্ট নয়। এটাও চৌপদী, অথচ এটা দুইবর্গ মাত্রার ছন্দ নয়, এটুকুই লক্ষণীয়।

 ‘পদ’ শব্দের সংজ্ঞাপরিচয় দ্রষ্টব্য।

 ছন্দ (পৃ ১১৫)—ছন্দ কথাটি বিভিন্ন স্থলে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক অর্থ সৌষম্য বা সুসংগত ভঙ্গি। যেমন—মুখের ছন্দ, ছবির ছন্দ, চলার ছন্দ। ছন্দশাস্ত্রেও ছন্দ কথাটি প্রসঙ্গভেদে অন্তত তিনটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, পদ্যরচনার বিশেষ রীতি বা পদ্ধতি। যেমন—সাধু- বা সংস্কৃত-বাংলার ছন্দ, প্রাকৃত-বাংলার বা ছড়ার ছন্দ। দ্বিতীয়ত, ছন্দ মানে স্পন্দ বা rhythm। যেমন—সম ও অসম চলনের ছন্দ, চার মাত্রার ছন্দ। গদ্য-ছন্দ বলতেও গদ্যের স্পন্দ বা রিদ্‌ম্‌ই বোঝায়। যে গদ্যে সুস্পষ্ট স্পন্দ অনুভূত হয় তাকেই বলা যায় ছন্দোময় গদ্য। তৃতীয়ত, ছন্দ মানে পদ্য রচনার বন্ধ বা পদসমাবেশ। যেমন— পয়ার, ত্রিপদী, অমিত্রাক্ষর, মন্দাক্রান্তা। সংকীর্ণার্থে ছন্দ শব্দটি পদ্যরচনার রীতি, স্পন্দ ও বন্ধ এই তিনের যে-কোনো একটিকে বোঝাতে পারে, ব্যাপকার্থে ওই তিনের সমষ্টিকেই বোঝায়। দ্রষ্টব্য ১১৫ পৃষ্ঠা পাদটীকা ১ এবং ‘লয়’ শব্দের সংজ্ঞাপরিচয়।

 ঝাঁপতাল—দ্রষ্টব্য ‘তাল’।

 ঝুল্লণা (পৃ ১০৯)—প্রাকৃত মাত্রাবৃত্ত রীতির একটি ছন্দোবন্ধের নাম ঝুল্লণা। ঝুল্লণা দুই ‘রূপকল্প’ বা পংক্তি নিয়ে গঠিত। প্রতিপংক্তিতে তিন পদ; প্রথম ও দ্বিতীয় পদে দশ কলামাত্রা এবং তৃতীয় পদে সতর কলামাত্রা। যতিও তিনটি; প্রথম ও দ্বিতীয় পদের পরে অর্ধযতি, তৃতীয় পদের পরে পূর্ণযতি। প্রাকৃতপৈঙ্গল গ্রন্থে প্রদত্ত ঝুল্পণার বর্ণনাটিও এই ছন্দেই রচিত। ঝুল্লণার বাংলা প্রতিরূপ এই—

আজি রাতের যে ফুলগুলি
জীবনে মম উঠিল দুলি
ঝরুক তারা কালি প্রাতের ফুলেরে দিতে প্রাণ।

—বীথিকা, মরণমাতা

 তাল[]— গানের সুরপ্রবাহের গতিসাম্য রক্ষার জন্যে কালপরিমাপের যে ব্যবস্থা, তাকেই বলা হয় তাল। এই ব্যবস্থা অনুসারে গীতকালকে কতকগুলি অংশে বিভক্ত করা হয়। এই কালপর্ব গানভেদে বিভিন্ন রকমের হয়। এই কালপর্ব বা তালবিভাগের বৈচিত্র্যের দ্বারাই গানের ছন্দ নিয়ন্ত্রিত হয় (পৃ ২১, ২১৭)। গানের তালবিভাগ ও পদ্যের পর্ব- বা উপপর্ব-বিভাগ মূলত একজাতীয় বস্তু। গানের কালপরিমাপের একক বা য়ুনিটকে বলা হয় মাত্রা। মাত্রার আয়তন আপেক্ষিক; সুরপ্রবাহের লয় অর্থাৎ গতিবেগের দ্রুততা বা মন্থরতা-ভেদে একই গানের মাত্রা হ্রম্ব বা দীর্ঘ হয়। কালপর্বের মাত্রাসংখ্যা ও আবর্তনের ভিন্নতা অনুসারে গানের তালের বিভিন্ন নাম আছে। এই গ্রন্থোক্ত তালগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া গেল।

 একতালা— ত্রিমাত্রক বিভাগের তালবিশেষ। একতালায় চারটি করে বিভাগ থাকে এবং প্রত্যেক বিভাগে থাকে তিন মাত্রা (পৃ ৯৭-৯৮)। মোট মাত্রাসংখ্যা বার। একতালা নামের সার্থকতা সুস্পষ্ট নয়।

 কাওয়ালি— এর প্রতিবিভাগ চতুর্মাত্রক। কাওয়ালির তালে চারটি বিভাগ এবং প্রত্যেক বিভাগে চার মাত্রা (পৃ ১২)। মোট মাত্রাসংখ্যা ষোল। কাওয়ালির এক বিভাগে ফাঁক ও তিন বিভাগে তালি পড়ে। এজন্য কাওয়ালিকে তেতালা বলে গণ্য করা হয়।

 চৌতাল— এই তাল ছয়টি দ্বিমাত্রক বিভাগ নিয়ে গঠিত। একতালার ন্যায় এরও মোট মাত্রাসংখ্যা বার। এর দ্বিতীয় ও চতুর্থ ভাগে ফাঁক, বাকি চার ভাগে তালি। এজন্যই এর নাম চৌতাল।

 ঝাঁপতাল— এটি হচ্ছে দশ মাত্রার তাল। এর মাত্রাবিদ্যাস হয় দুই-তিন+দুই-তিন এই পর্যায়ক্রমে। চিত্ত আজি | দুঃখদোলে ইত্যাদি দৃষ্টান্তটি (পৃ ১৫৫) প্রচলিত ঝাঁপতাল নয়। কেননা এর মাত্রাবিন্যাসক্রম হচ্ছে তিন-দুই+ তিন-দুই। তবে এটিকে ঝাঁপতালের প্রকারভেদ বলে গণ্য করা চলে। রবীন্দ্রনাথ এই ঝাঁপতালজাতীয় বিশিষ্ট তালটির নাম দিয়েছেন ‘ঝম্পক’।

 দাদরা— এটি একতালার মতোই একটি ত্রিমাত্রক বিভাগের তাল। প্রধান পার্থক্য এই যে, একতালায় চার বিভাগ ও মোট মাত্রাসংখ্যা বার, কিন্তু দাদরার দুই বিভাগ ও মোট মাত্রাসংখ্যা ছয়। দাদরার লয় দ্রুত।

 ধামার— চোদ্দ মাত্রার তাল। এই তালের তিন বিভাগ এবং এর মাত্রাবিন্যাসপদ্ধতি হচ্ছে পাঁচ-পাঁচ-চার।

 বনের পথে পথে | বাজিছে বায়ে ইত্যাদি দৃষ্টান্তটির (পৃ ২৬) তালবিভাগ হচ্ছে তিন-দুই-দুই+তিন-দুই। সুতরাং এটি স্পষ্টতই চৌতাল, একতালা, ধামার বা ঝাঁপতালের পর্যায়ে পড়ে না। বস্তুত এটি একটি নূতন তাল।

 এই হল ‘তাল’ শব্দের সংগীতশাস্ত্রসম্মত পারিভাষিক অর্থ। এই অর্থে তাল শব্দের দ্বারা কয়েকটি কালপর্ব বা তালবিভাগ নিয়ে গঠিত সমগ্র পংক্তির পূর্ণরূপ বোঝায়। এ ছাড়াও তাল শব্দের একটি অপারিভাষিক সাধারণ অর্থ আছে। এই অর্থে তাল মানে রিদ্‌ম্ বা ‘ছন্দঃস্পন্দন’। যেমন, ‘তিনমাত্রার তাল’ (পৃ ২১৭) মানে তিন মাত্রার স্পন্দবিভাগ বা উপপর্ব। দ্রষ্টব্য ‘লয়’।

 তিনমাত্রার ছন্দ—যে ছন্দের উপপর্ব বা ‘চলন’ তিনমাত্রা-পরিমিত তাকে বলা হয়েছে তিনের ছন্দ (পৃ ৩৬), তিনের মাত্রার ছন্দ (পৃ ৪৪), ত্রৈমাত্রিক ভূমিকার ছন্দ (পৃ ৫৪), ত্রৈমাত্রিক ছন্দ (পৃ ৬৭), তিনমাত্রার ছন্দ (পৃ ৭৩) বা তিন য়ুনিটের ছন্দ (পৃ ২১৩)। এরই অপর নাম অসম ছন্দ। অর্থাৎ ছয়মাত্রা পর্বের ছন্দকেই রবীন্দ্রনাথ বলতেন তিনমাত্রার ছন্দ।

 বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথ দুই প্রকৃতির দুটি বিভিন্ন ছন্দকে তিনমাত্রার ছন্দ নামে অভিহিত করেছেন। তিনমাত্রার ছন্দ মানে তিনমাত্রা-উপপর্বের ছন্দ। মাত্রাবৃত্তবর্গের ছয়মাত্রাপর্বের ছন্দে প্রতিউপপর্বে থাকে তিন মাত্রা (পৃ ৭৩)। যথা—

চাষের: সময়ে | যদিও: করিনি | হেলা,
ভুলিয়া: ছিলাম | ফসল: কাটার | বেলা।

এর প্রতিপর্বে ছয় মাত্রা এবং প্রতি পূর্ণ উপপর্বে তিন মাত্রা সুস্পষ্ট।

শরতে: শিশির | বাতাস: লেগে
জল ভরে আসে | উদাসী: মেঘে।

এখানে দ্বিতীয় লাইনের প্রথম পর্বের উপপর্ববিভাগ সুস্পষ্ট নয়। ‘ভরে’ শব্দের মধ্যবর্তী উপযতি লুপ্ত হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।

 এই দুটি দৃষ্টান্তই মাত্রাবৃত্তবর্গীয়। প্রতিপর্বে ছয় মাত্রা নিয়ে এদের রূপ। সুতরাং এ দুটিকে তিনমাত্রা-উপপর্বের ছন্দ বলতে বাধা নেই।

 রবীন্দ্রনাথের মতে বাংলা প্রাকৃতবর্গের ছন্দও তিনমাত্রা-উপপর্ব নিয়ে গঠিত (পৃ ৬২)। যথা—

বৃষ্টি: পড়ে- | টাপুর: টুপুর | নদেয়: এল- | বা-ন

এখানেও প্রতিউপপর্বে তিন মাত্রা গণনীয়। তিনটি উপপর্বে এক মাত্রার ফাঁক রয়েছে, আবৃত্তির টানে সে ফাঁক পূরণ করে নিতে হয়। মাত্রাবৃত্তবর্গের ত্রৈমাত্রিক ছন্দে এ-রকম ফাঁক রাখা চলে না। প্রাকৃতবর্গের ছন্দে সাধারণত মাঝে মাঝে উক্তরকম ফাঁক থেকে যায়, তবে প্রয়োজনমতো বেফাঁক ছন্দও রচনা করা চলে (পৃ ৬৪)। যথা—

স্বপ্ন: আমার | বন্ধন্-হীন | সন্ধ্যা: তারার | সঙ্গী
মরণ: যাত্রী | দলে।

কোনো উপপর্বেই ফাঁক নেই। দ্বিতীয় পর্বে উপযতি লুপ্ত হয়েছে বলে উপপর্ববিভাগ সম্ভব নয়। ধা হক, এ-রকম বেফাঁক ছন্দকে লৌকিক ও মাত্রাবৃত্ত উভয় বর্গের অন্তর্গত বলেই গণ্য করা যায়। এ-রকম উভচারী ছন্দের দৃষ্টান্ত বিরল। দ্রষ্টব্য ‘ফাঁক’।

 মাত্রাবৃত্তবর্গীয় তিনমাত্রার ছন্দে অমিত্রাক্ষরের মতো যতিস্থাপনের স্বাধীনতা নেই, অর্থাৎ এ ছন্দকে প্রবহমান করা চলে না (পৃ ২১৫)। প্রাকৃতবর্গীয় ছন্দে প্রবহমানতার বিষয় অন্য প্রসঙ্গে আলোচিত হল। দ্রষ্টব্য ‘অসমমাত্রার ছন্দ’।

 ত্রিপদী (পৃ ১২)—ষে ছন্দোবন্ধের প্রতিপংক্তিতে পদসংখ্যা অর্থাৎ অধর্যতির বিভাগসংখ্যা তিন, তাকেই বলা যায় ত্রিপদী। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন পয়ার-চৌপদীর ন্যায় ত্রিপদীও দুইবর্গ-মাত্রার ছন্দ (পৃ ১২), অর্থাৎ দুইমাত্রা-উপপর্বের ছন্দ। বস্তুত অসম- এবং বিষম-পর্বিক ছন্দেও দ্বিপদী ত্রিপদী চৌপদী সবই হতে পারে। অসম- ও বিষম-পর্বিক দ্বিপদী প্রভৃতি একমাত্র কলাগোনা পদ্ধতিতেই রচিত হয়। কিন্তু সমপর্বিক দ্বিপদী প্রভৃতি বন্ধ কলাগোনা, অক্ষরগোনা ও সিলেব্‌ল্‌গোনা এই তিন পদ্ধতিতেই রচিত হতে পারে। দ্রষ্টব্য ‘চৌপদী’, ‘দ্বিপদী’ ও ‘পয়ার’।

 অক্ষরগোন। ত্রিপদীর দৃষ্টান্ত আছে ১২ এবং ৩৩ পৃষ্ঠায়। উভয়ত্রই তৃতীয় পদে দুই মাত্রা করে বেশি আছে। কিন্তু ১১৯ পৃষ্ঠার ‘চেয়ে থাকে মুখপানে’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটিতে তৃতীয় পদে দুই মাত্রা কম। এই দুই নিয়মই সুপ্রচলিত। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন সারদামঙ্গল কাব্যের ছন্দও ত্রিপদী (পৃ ১৭৮)। বস্তুত তা নয়। ত্রিপদীর ভঙ্গিতে লিখিত হলেও আসলে ওই ছন্দের প্রতিপংক্তিতে আছে চার পদ। তৃতীয় লাইনটা দ্বিপদী, আট মাত্রার পরে পদচ্ছেদ অর্থাৎ অর্ধযতি সুস্পষ্ট। প্রথম দুই পদের সঙ্গে তৃতীয় পদের মিল নেই বলে তৃতীয় ও চতুর্থ পদ এক লাইনে লিখিত হয়েছে। কিন্তু মিল না থাকলেও ওই যতিটি ঠিকই আছে। যেখানে আকস্মিকভাবে মিল এসে গেছে সেখানে এই পদবিভাগ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে না। দৃষ্টান্ত এই (পৃ ১৭৭)—

কি বলেছি অভিমানে
শুনো না শুনো না কানে,
বেদনা দিও না প্রাণে
ব্যথার সময়।

 দণ্ডকল (পৃ ১০৯)— এই ছন্দে প্রতিপাদে বত্রিশ কলামাত্রা থাকে। প্রাকৃতপৈঙ্গলে এই বত্রিশ মাত্রার সমাবেশরীতি সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ নেই। তবে এই ছন্দের পরিচয় ও দৃষ্টান্ত দেওয়া উপলক্ষ্যে যে দুটি রচনা পাওয়া যায় তার থেকে মনে হয় প্রতিপংক্তির প্রথম দুই মাত্র। আড়ে থাকবে, অর্থাৎ প্রতিপংক্তির গোড়াতেই একটি করে দুই মাত্রার অতিপর্ব থাকা চাই, আর প্রতিপংক্তির শেষ ধ্বনিটি গুরু অর্থাৎ দ্বিমাত্রক হওয়া চাই। ‘কুংতঅরু’র (পৃ ১০৯) কুং এবং ‘কুঞ্জপথে’র (পৃ ১১০) কুঞ্, এই দুটিকে অতিপর্ব বলে গণ্য করলেই এ ছন্দের আসল রূপ পরিস্ফুট হবে। রবীন্দ্ররচিত দৃষ্টান্তটিকে যদি এভাবে রূপান্তরিত করে দেওয়া যায়—

আজি জ্যোৎস্নাহসিত রাতে
মল্লিকা-মালা হাতে
চলিয়াছে সখীসাথে
কুঞ্জপথে-।

তা হলেই দণ্ডকল ছন্দের প্রকৃতি অব্যাহত থাকবে। এখানে অতিপর্ব সহ বত্রিশ মাত্রা গণনীয়। সুতরাং দণ্ডকল ছন্দের ভাগগুলি অসমান বলে মনে করা যায় না।

 দল (পৃ ১০৯)— প্রাকৃতপৈঙ্গলের টীকায় এই শব্দটি পূর্ণযতির বিভাগ অর্থাৎ পংক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই অর্থে ‘দল’ শব্দটির প্রয়োগ প্রায় দেখা যায় না। বস্তুত এটি পারিভাষিক শব্দ নয়।

 দল শব্দের একটি অর্থ পাপড়ি। যেমন— ফুলের দল, শতদল কমল। এরই সাদৃশ্যে কথাটিকে শব্দপর্ব বা সিলেব্‌ল্ অর্থে পারিভাষিক শব্দ হিসাবে স্বীকার করে নিলে সুবিধা হয়। তা হলে সিলেব্‌ল্‌লগোনা (syllabic) ছন্দকে সহজেই ‘দলমাত্রিক’ ছন্দ বলে বর্ণনা করা যায়। তেমনি দুই সিলেব্‌ল্‌ ও তিন সিলেব্‌ল্ -এর শব্দকেও অনায়াসেই দ্বিদল ও ত্রিদল শব্দ বলে পরিচিত করা যায়। যেমন— ছন্‌+দ দ্বিদল শব্দ, বুদ+ধি+মান্ ত্রিদল শব্দ। তা ছাড়া open syllableকে বলা যায় মুক্তদল (দ, ধি) এবং closed syllableকে বলা যায় রুদ্ধদল (ছন্, বুদ্, মান্)। অযুগ্মধ্বনি-যুগ্মধ্বনি অপেক্ষা মুক্তদল-রুদ্ধদল অধিকতর সহজবোধ্য ও নিশ্চিতার্থক। দ্রষ্টব্য ‘ধ্বনি’, ‘যুগ্মধ্বনি’ ও ‘সিলেব্‌ল্’।

 দাদরা— দ্রষ্টব্য ‘তাল’।

 দুইমাত্রার ছন্দ (পৃ ৩৮)—যে ছন্দের উপপর্ব বা ‘চলন’ দুইমাত্রাপরিমিত তাকেই বলা হয়েছে দুইমাত্রার ছন্দ বা দ্বৈমাত্রিক ছন্দ (পৃ ৬৭)। এরই অপর নাম সমমাত্রার ছন্দ। অর্থাৎ চতুর্মাত্রপর্বিক ছন্দকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন দুইমাত্রার ছন্দ। এই ছন্দেই অমিত্রাক্ষরের প্রবহমানতা স্বাভাবিক (পৃ ১৫৪)। দ্রষ্টব্য ‘সমমাত্রার ছন্দ’।

 দ্বাদশাক্ষর ছন্দ (পৃ ২২৬)—এটি পারিভাষিক নাম নয়। যে ছন্দোবন্ধের প্রতিলাইনে বারটি করে অক্ষরমাত্রা থাকে, তাকেই রবীন্দ্রনাথ দ্বাদশাক্ষর বলে বর্ণনা করেছেন। পয়ারের প্রতিলাইনে থাকে চোদ্দ অক্ষর। তারই তুলনায় একে বলা হয়েছে দ্বাদশাক্ষর। ২২৭ পৃষ্ঠায় যে দৃষ্টান্তটি উদ্ধৃত হয়েছে সেটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর প্রত্যেক লাইনে আছে দুটি করে ছয় মাত্রার পর্ব। যেমন—

সে প্রভামণ্ডলী | মাঝে সমুজ্জ্বলা।

এ-রকম ছয়মাত্রা-পর্বের ছন্দে অযুক্তযুক্তনির্বিশেষে অক্ষরমাত্রার প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথের কানকে পীড়া দিত। তাই তিনি বলেছেন, এ-রকম ছন্দে ‘প্রত্যেক যুক্ত অক্ষরে রসনা বাধা প্রাপ্ত হয়’ (পৃ ২২৭)। সেইজন্য তিনি নিজেও এককালে ‘তিনমাত্রামূলক’ অর্থাৎ ছয়মাত্রা-পর্বের ছন্দে যুক্তাক্ষর বর্জন করে চলতেন (পৃ ৬৬, ১২৫)। পরবর্তী কালে মানসী রচনার সময়ে যখন তিনি এইজাতীয় ছন্দে অক্ষরমাত্রার পরিবর্তে কলামাত্রা গণনার রীতি প্রবর্তন করেন, তখন আর ‘দ্বাদশাক্ষর’-শ্রেণীর ছন্দে যুক্তাক্ষর প্রয়োগে বাধা রইল না (পৃ ৫, ৬৭, ১২৫)। ফলে মানসী রচনার সময় থেকে বাংলা সাহিত্যে ছয়মাত্রা-পর্বের ছন্দে অক্ষরমাত্রা গণনার রীতি অর্থাৎ যুগ্মধ্বনি বা রুদ্ধদলকে সংকুচিত করে একমাত্রা বলে গণনার রীতি অচল হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতে আজকাল এই রীতির ছন্দে রুদ্ধদলের সংকোচন ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বা অত্যাচার (পৃ ৫৪, ১২৪, ২১৪)। কড়ি ও কোমল কাব্যের ‘বিরহ’ এবং মানসী কাব্যের ‘ভুলভাঙা’, এই দুটি কবিতা রচনার সময় (১৮৮৭) থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছয়মাত্রা-পর্বের ছন্দে সংকুচিত রুদ্ধদলের প্রয়োগ বর্জন করেন। এইজাতীয় ছন্দে উক্তপ্রকার ধ্বনিসংকোচের ফলেই ‘প্রত্যেক যুক্ত অক্ষরে রসনা বাধা প্রাপ্ত হয়’। তাই তাঁর মতে দ্বাদশাক্ষর-জাতীয় ছন্দে যুক্তাক্ষর (শব্দের মধ্য- ও অন্ত-স্থিত) ব্যবহার ‘অত্যাচার’ অর্থাৎ ‘ছন্দোভঙ্গ’ (পৃ ১৭৮) বলেই গণ্য।

 রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তিনি দায়ে পড়ে একটিমাত্র রচনায় এ-রকম অত্যাচার করেছেন অর্থাৎ ছয়মাত্রা-পর্বের ছন্দে যুগ্মধ্বনি বা রুদ্ধদলকে সংকুচিত করে এক য়ুনিট বা কলামাত্রা বলে গণ্য করেছেন (পৃ ১২৪-২৫, ২১৪-১৫)। যথা—

প্রভু বুদ্ধ লাগি | আমি ভিক্ষা মাগি।

বস্তুত ‘বিরহ’ এবং ‘ভুলভাঙা’ রচনার (১৮৮৭) পরবর্তী কালেও রবীন্দ্রসাহিত্যে এ-রকম রচনার আরও দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, মানসী কাব্যেরই কোনো কোনো রচনাতে এ-রকম ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন, ‘নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতাটিতে (১৮৮৮) আছে—

বসন্ত কি নাই | বনলক্ষ্মী তাই |
কাঁদিছে আকুল | স্বরে?

অতঃপর চিত্রা কাব্যের ‘দুঃসময়’-নামক কবিতাটি (১৮৯৪) উল্লেখযোগ্য। এর প্রথম দুই লাইন এই—

বিলম্বে এসেছ | রুদ্ধ এবে দ্বার,
জনশূন্য পথ | রাত্রি অন্ধকার।

—দুঃসময়, চিত্রা (রচনাবলী ৪)
‘কথা’ কাব্যের ‘প্রভু বুদ্ধ লাগি’ ইত্যাদি পূর্বোল্লিখিত কবিতাটি (শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা, ১৮৯৭) ‘দুঃসময়’ রচনার পরবর্তী। ‘কাহিনী’ গ্রন্থের ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ নাটিকাটিতেও (১৮৯৭) কিছু কিছু ব্যতিক্রমের দৃষ্টাক্ত আছে। যথা—

মরেওনি বটে | জন্মেওনি কভু।...
খবর্দার কেউ | নোড়ো চোড়ো নাকো।

এগুলিকে দ্বাদশাক্ষর ছন্দের পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। বস্তুত এগুলি মাত্রাবৃত্ত বা কলাগোনা ছয়মাত্রা-পর্ব ছন্দের ব্যতিক্রম মাত্র। অতঃপর এ প্রসঙ্গে নৈবেদ্য কাব্যের (১৯০১) প্রথম কবিতাটির উল্লেখ করা যেতে পারে। যথা—

তোমার বিচিত্র | এ ভবসংসারে |
কর্মপারাবার | পারে হে,
নিখিল জগৎ | জনের মাঝারে |
দাঁড়াব তোমারি | সম্মুখে।

এটিও ছয়মাত্রা-পর্বের ছন্দ। অথচ এখানে যুগ্মধ্বনি বা রুদ্ধদলকে সংকুচিত করে এক কলামাত্র। বলে গণ্য করা হয়েছে। ফলে এ সব রচনা পড়বার সময় যুক্তাক্ষরগুলিতে রসনা বাধা প্রাপ্ত হয়। এইজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তখন ছন্দের সদর রাস্তা ও গ্রাম্য রাস্তার মতো এবড়ো-খেবড়ো থাকত, অভ্যাসের গতিকে কেউ সেটাকে নিন্দনীয় বলে মনেও করেনি’ (পৃ ৬৬)।

 দ্বিপদী—যে ছন্দোবন্ধের প্রতিপংক্তিতে পদসংখ্যা অর্থাৎ অর্ধযতির বিভাগসংখ্যা দুই, তাকেই বলা যায় দ্বিপদী। ত্রিপদী-চৌপদীর ন্যায় দ্বিপদীও প্রকৃতিভেদে ত্রিবিধ: সাধু ছন্দের অক্ষরগোনা, প্রাকৃত-বাংলার সিলেব্‌ল্‌গোনা এবং মাত্রাবৃত্তের কলাগোনা।

 দ্বিপদীরই প্রকারবিশেষের প্রচলিত নাম পয়ার। যে দ্বিপদীর প্রথম পদে আট এবং দ্বিতীয় পদে ছয় মাত্রা, তাকেই বলা হয় পয়ার। পয়ারের প্রথম পদে দুই পর্ব এবং দ্বিতীয় পদে দেড় পর্ব; প্রতিপর্বে চার মাত্রা এবং প্রতিউপপর্বে দুই মাত্রা। এই জন্যই রবীন্দ্রপরিভাষায় পয়ারকে সমমাত্রার ছন্দ, দুইবর্গ-মাত্রার ছন্দ, দ্বৈমাত্রিক ভূমিকার ছন্দ ইত্যাদি নাম দেওয়া হয়েছে।

 পয়ার অক্ষরগোনা, সিলেব্‌ল্‌গোনা ও কলাগোনা, এই তিন রকমই হতে পারে। দ্রষ্টব্য ‘পয়ার’।

 যে-সব দ্বিপদী দুইমাত্রা-উপপর্ব নিয়ে গঠিত নয়, তাদের শুধু কলাগোন। রূপই হয়, অন্য রূপ আজকাল স্বীকৃত হয় না।

সকল: বেলা | কাটিয়া: গেল ||
বিকাল: নাহি | যায়।

দুই ছত্রে লেখা হলেও এখানে ছন্দের পংক্তি একটাই (পৃ ১০৭-০৮)। পংক্তিটা দ্বিপদী; প্রত্যেক পদ তিন-দুই মাত্রার বিষম পর্ব নিয়ে গঠিত, শেষ পদ খণ্ডিত। এ রকম ছন্দের কলাগোনা রূপই চলে, অক্ষরগোনা কিংবা সিলেব্‌ল্‌গোনা রূপ অচল। আরএকটা দৃষ্টান্ত (পৃ ৭১) এই।—

তরণী বেয়ে শেষে | এসেছি ভাঙা ঘাটে।

এটা তিন-দুই-দুই মাত্রার বিষমপর্বিক একপদী। এরও অক্ষরগোনা রূপ অচল। যেমন—

সায়াহ্ন অন্ধকারে | এসেছি ভগ্ন ঘাটে।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, এর কোমর ভেঙে গেছে (পৃ ৭২)। এর কারণ অসম- ও বিষম-পর্বিক ছন্দের ‘শোষণশক্তি’ অর্থাৎ সংকোচনক্ষমতা নেই। কিন্তু এসব ছন্দ যে যুগ্মধ্বনিকেই সইতে পারে না তা নয়। তার দৃষ্টান্তও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন (পৃ ৭২)।—

অন্ধ রাতে যবে | বন্ধ হল দ্বার।

এখানে যুগ্মধ্বনিগুলি সংকুচিত না হয়ে সম্প্রসারিতই হয়েছে।

 দ্বিপদী শব্দটি রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেন নি। অবশ্য এক স্থানে (পৃ ১১৮) ওই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু পারিভাষিক অর্থে নয়।

 ধামার—দ্রষ্টব্য ‘তাল’।

 ধ্বনি (পৃ ৫৩)—অপারিভাষিক অর্থে ধ্বনি মানে স্বর বা রব। যেমন— কুহুধ্বনি, ধ্বনিমাধুর্য। ছন্দশাস্ত্রের পরিভাষায় ধ্বনি মানে সিলেব্‌ল্ অর্থাৎ একপ্রযত্নোচ্চারিত শব্দাংশ (পৃ ৫৩, ৭৪, ৯০)। র+বীন্+দ্র শব্দে তিনটি ধ্বনি বা সিলেব্‌ল্। ছন্দের আলোচনায় ধ্বনি শব্দটি যখন লঘু, গুরু, অযুগ্ম, যুগ্ম প্রভৃতি বিশেষণাধীন অথবা গণনীয় বিষয় হয়, তখনই এটি সিলেব্‌ল্‌ অর্থে স্বীকার্য। আকৃতিভেদে ধ্বনি দ্বিবিধ, অযুগ্ম এবং যুগ্ম। দৈ, বৌ, দুই্‌, ঢেউ্‌ প্রভৃতি রুদ্ধস্বরান্ত এবং জল্, তান্, দিন্‌, কুল্‌, শেষ্ প্রভৃতি ব্যঞ্জনান্ত ধ্বনিকে বলা যায় যুগ্মধ্বনি (closed syllable) এবং মা, কি, নু, সে, দো প্রভৃতি মুক্তস্বরান্ত ধ্বনিকে বলা যায় অযুগ্মধ্বনি (open syllable)। ‘সৌভাগ্য’ শব্দে সৌ এবং ভাগ্ যুগ্মধ্বনি, গ্য অযুগ্মধ্বনি। সুতরাং ‘যুগ্মধ্বনি’ শব্দটার পরিবর্তে শুধু ‘সিলেব্‌ল্’ শব্দ ব্যবহার করাই যথেষ্ট নয় (পৃ ৫৩)। দ্রষ্টব্য ‘দল’।

 পংক্তি (পৃ ১৫৩)—অপারিভাষিক অর্থে পংক্তি মানে লাইন বা ছত্র (পৃ ১০৭)। পারিভাষিক অর্থে অপ্রবহমান বন্ধের পূর্ণযতিবিভাগের নাম পংক্তি।

 প্রবহমান বন্ধেও অপ্রবহমান বন্ধের নির্দিষ্ট পূর্ণযতি-বিভাগকেই পংক্তি বলা হয় (পৃ ১২২)। অর্থাৎ প্রবহমান বন্ধে পূর্ণযতির বিভাগকে পংক্তি বলা হয় না, কেননা ভাবের প্রয়োজনে পূর্ণযতিনির্দিষ্ট পংক্তিসীমাকে অতিক্রম করে যাওয়াই এই বন্ধের বৈশিষ্ট্য। এই জন্যই প্রবহমানতার নাম দেওয়া হয়েছে পংক্তিলঙ্ঘন (পৃ ১৫৬)। এই বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করেই রবীন্দ্রনাথ অমিত্রাক্ষর ছন্দকে পংক্তিলঙ্ঘক নামে অভিহিত করেছেন।

 পংক্তি বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন স্থলে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। যথা— অবয়ব, চাল, পদ, প্রদক্ষিণ, রূপকল্প।

 পদ—পারিভাষিক অর্থে পদ মানে অর্ধ যতিনির্দিষ্ট ছন্দোবিভাগ। দ্বিপদী, ত্রিপদী, চৌপদী প্রভৃতি শব্দে পদ কথাটি পারিভাষিক অর্থেই প্রযুক্ত হয়। পয়ার ছন্দের প্রতিপংক্তি অর্ধযতির দ্বারা দুই পদে বিভক্ত (পৃ ১০)। অর্থাৎ পয়ারপংক্তি হচ্ছে আসলে দ্বিপদী। ত্রিপদীর প্রতিপংক্তি তিন পদে বিভক্ত (পৃ ১২)। চৌপদীতে চার পদ (পৃ ১১)। ‘প্রথম শীতের মাসে···হি হি করে কাঁপে গাত্র’ এই পংক্তিটিকে ‘আট মাত্রার ঝোঁক’ দিয়েই পড়া যাক আর ‘ছয় মাত্রার কায়দায়’ই পড়া যাক, এই পংক্তিটি যে চৌপদী তাতে সন্দেহ নেই; কারণ উভয় রীতিতেই এটি তিনটি অর্ধ যতির দ্বারা চার ভাগে বিভক্ত হয়। এই প্রসঙ্গে সহজপাঠ প্রথম ভাগের একটি কবিতার (সপ্তম পাঠ) ছন্দও উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এ ছন্দটি দুই মাত্রায় অথবা তিন মাত্রায় পড়া যায়’। দুই মাত্রা, যথা—

কাল | ছিল | ডাল | খালি।
আজ | ফুলে | যায় | ভরে।

এ হচ্ছে উপপর্ব-বিভাগ, প্রতিউপপর্বে দুই মাত্রা। অর্থাৎ আসলে এটি চতুর্মাত্রপর্বিক ছন্দ। এখানে পর্ববিভাগ না দেখিয়ে উপপর্ববিভাগ দেখানো হয়েছে। তিন মাত্রা, যথা—

কাল ছিল ডাল | খালি—।
আজ ফুলে যায় | ভরে—।

এ হচ্ছে পর্ববিভাগ, প্রতিপর্বে ছয় মাত্রা। অর্থাৎ এটি ‘ছয় মাত্রার কায়দায়’ পড়ার বিভাগ। এর প্রতিউপপর্বে তিন মাত্রা। কিন্তু এখানে উপযতি লোপ পেয়েছে। তাই দণ্ডচিহ্নের দ্বারা তিন মাত্রার উপপর্ব বিভাগ না দেখিয়ে একেবারে পর্ববিভাগই দেখানো হয়েছে। ‘তিন মাত্রার তালে’ পড়া আর ‘ছয় মাত্রার কায়দায়’ পড়া মূলত একই। তিন মাত্রার উপপর্ব নিয়েই ছয় মাত্রার পর্ব গঠিত হয়।

প্রথম: শীতের | মাসে—।
শিশির: লাগিল | ঘাসে—।

এ হচ্ছে উপপর্ব-বিভাগ। এখানে উপযতি লোপ পায়নি (পৃ ১১)।

 এই প্রসঙ্গে ‘নটরাজ’ কাব্যের (১৯৩১) ‘মনের মানুষ’ কবিতাটিও স্মরণীয়। গ্রন্থের পাদটীকায় কবি স্বয়ং এই কবিতাটির ছন্দোবিশ্লেষ করেছেন এভাবে।— “এই ছন্দ চৌপদীজাতীয় নহে। ইহার যতিবিভাগ নিম্নলিখিতরূপে—

কত না দিনের | দেখা
কত না রূপের | মাঝে।
সে কার বিহনে। একা
মন লাগে নাই | কাজে।”

অর্থাৎ এটিকে চার মাত্রার কায়দায় পড়তে হবে না, ছয় মাত্রার কায়দায় পড়াই কবির অভিপ্রেত। চিহ্নযোগে দেখানো না হলেও এর তিনমাত্রাউপপর্বের বিভাগ সহজেই বোঝা যায়। চতুর্থ লাইনে এই বিভাগ কানে লাগে না। কারণ এখানে উপযতি লুপ্ত হয়েছে।

 অপারিভাষিক অর্থে পদ মানে পূর্ণযতিনির্দিষ্ট ছন্দোবিভাগ অর্থাৎ পংক্তি। যেমন—চতুর্দশপদী কবিতা। রবীন্দ্রনাথ এই অর্থে ই পদ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন বেশি (পৃ ৬৯-৭০, ৭৩, ১০১)। চতুর্দশপদী কবিতা মানে চোদ্দ পংক্তির কবিতা, যদিও এর প্রত্যেক পংক্তিই পারিভাষিক অর্থে দ্বিপদী। অনুরূপভাবে রবীন্দ্রনাথ চার পংক্তি বা লাইনের রচনাকে চৌপদী নামে অভিহিত করেছেন। ফাল্গুনী নাটকে এ-রকম চৌপদী রচনার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। যথা—

যে পদ্মে লক্ষ্মীর বাস, দিন অবসানে
সেই পদ্ম মুদে দল সকলেই জানে।
গৃহ যার ফুটে আর মুদে পুনঃপুনঃ
সে লক্ষ্মীরে ত্যাগ করো, শুন, মূঢ়, শুন।

পারিভাষিক অর্থে এটিকে চৌপদী চলা চলে না। অপারিভাষিক অর্থে এই ‘রচনা’টিকে চৌপদী বলা যেতে পারে, কিন্তু ছন্দের বিচারে এর প্রতি পংক্তিই দ্বিপদী।

 কোনো কোনো স্থলে পর্ব এবং অন্যত্র উপপর্ব অর্থেও পদ শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে। যেমন—‘কাঁপিলে: পাতা | নড়িলে: পাখি’ এখানে প্রত্যেকটি উপপর্ব পদ নামে অভিহিত হয়েছে (পৃ ১৪)। ‘অহহ কল | -য়ামি বল | -য়াদিমণি | -ভূষণং’ এই দৃষ্টান্তটির প্রত্যেক পর্ব (পাঁচ মাত্রার) পদ নামে বর্ণিত হয়েছে (পৃ ৪০)। পয়ারের পর্বকে কোথাও বলা হয়েছে ‘পদক্ষেপ’ (পৃ ৩৫), আবার অন্যত্র পয়ারের পদকেই ‘পদক্ষেপ’ বলা হয়েছে (পৃ ৪১)।

 সংস্কৃতে শ্লোকের একচতুর্থাংশকে পাদ বা পদ বলা হয়। ‘চরণ’ পদের প্রতিশব্দ। এই হিসাবে উক্ত চতুর্থাংশ বোঝাতে চরণ শব্দও ব্যবহৃত পদ ও চরণ কখনও বিভিন্নার্থে প্রযুক্ত হয় না। বাংলায় পংক্তি অর্থে পদ শব্দের ন্যায় চরণ শব্দের প্রয়োগও দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ছন্দ-আলোচনায় কোনো অর্থেই চরণ শব্দ ব্যবহার করেন নি। পংক্তি অর্থাৎ পূর্ণযতির বিভাগ বোঝাতে তিনি সাধারণত পদ শব্দই ব্যবহার করেছেন (পৃ ১০৩, ১০৭)।

 পদ ও চরণ এই দুটি সমার্থক শব্দকে বিভিন্নার্থে প্রয়োগ করা সংগত নয়। আর, পদ শব্দটিকেও একই সঙ্গে অর্ধযতির বিভাগ ও পূর্ণযতির বিভাগ এই দুই অর্থে ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় নয়। ত্রিপদী চৌপদী প্রভৃতি সর্বস্বীকৃত পারিভাষিক কথায় পদ শব্দের যা অর্থ, তাই স্বীকার্য।

 পয়ার (পৃ৭০-৭১)—যে ছন্দোবন্ধের পংক্তি আট মাত্রা ও ছয় মাত্রার দুই পদ নিয়ে গঠিত তার প্রচলিত পারিভাষিক নাম পয়ার। পয়ারপংক্তি দ্বিপদী, আট মাত্রার পরে অর্ধযতি। আধুনিক কালে আট ও দশ মাত্রার দীর্ঘ পয়ার রচনার রীতি দেখা দিয়েছে (পৃ ৪৬, ৬৯)। দ্বিজেন্দ্রনাথের স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যে (১৮৭৫) এই দীর্ঘ দ্বিপদীর প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু আঠার মাত্রার ‘মহাপয়ার’ অর্থাৎ দীর্ঘ দ্বিপদী ‘দ্বিজেন্দ্রনাথের সৃষ্টি’ (পৃ ১২০) এবং স্বপ্নপ্রয়াণেই ‘এর প্রথম প্রবর্তন দেখা গেছে’ (পৃ ৪৬), এ কথা স্বীকার্য নয়। রঙ্গলালের পদ্মিনী-উপাখ্যান কাব্যেও (১৮৫৮) এই মহাপয়ারের দৃষ্টান্ত আছে। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই ছন্দ রচনার প্রবর্তনা পেয়েছিলেন স্বপ্নপ্রয়াণ থেকেই এবং তিনিই এটিকে সুপ্রচলিত করেছেন।

 প্রকৃতিভেদে পয়ার ত্রিবিধ। প্রথম, সাধু ছন্দের ‘অক্ষরগোনা’ পয়ার। দৃষ্টান্ত—সতত হে নদ তুমি ইত্যাদি (পৃ ১৪২)। এই অক্ষরগোনা পয়ারের বহু দৃষ্টান্ত আছে গ্রন্থের নানা অধ্যায়ে। এ ছন্দে এক ‘অক্ষরে’ এক মাত্রা ধরা হয়। দ্বিতীয়, ছড়া বা লোকসাহিত্যের ‘মাত্রাগোনা’ পয়ার। দৃষ্টান্ত—এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা ইত্যাদি (পৃ ১৪৩)। এ ছন্দে প্রত্যেক সিলেব্‌ল্‌কেই এক মাত্রা বলে গণ্য করা হয়। শব্দের হসন্ত বর্ণকে বাদ দিয়ে গণনা করলে তার সিলেব্‌ল্‌-সংখ্যাই পাওয়া যায়া ‘এপার্’ শব্দে দুই সিলেব্‌ল্‌, সুতরাং দুই মাত্রা। এটাই লৌকিক ছন্দের রীতি। পলাতকার ছন্দকেও রবীন্দ্রনাথ লৌকিক রীতির পয়ার বলেই মনে করেন, যদিও তা ‘বেড়াভাঙা’ অর্থাৎ অসমপংক্তিক ও প্রবহমান (পৃ ১৫৭)। আঠার মাত্রার লৌকিক দীর্ঘপয়ারের দৃষ্টান্তও আছে। এই দীর্ঘপয়ার প্রবহমান ও অপ্রবহমান দুই-ই হতে পারে (পৃ ১৮৮)। তৃতীয়, মাত্রাবৃত্ত (পৃ ১৩২ পাদটীকা ৫) বা কলাগোনা পয়ার। এ ছন্দে এক কলায় এক মাত্রা ধরা হয়। অযুগ্মধ্বনিতে এক কলা, যুগ্মধ্বনিতে দুই কলা। মানসী কাব্যের ‘নিষ্ফল উপহার’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত পয়ারের প্রথম দৃষ্টান্ত— ‘নিম্নে যমুনা বহে’ ইত্যাদি (পৃ ১৮১ এবং পাদটীকা)। অনতিকাল পরেই রবীন্দ্রনাথ এই নূতন রীতির পয়ার রচনা ত্যাগ করেন (পৃ ৬৭) এবং উক্ত ‘নিষ্ফল উপহার’ কবিতাটিকে ‘নিম্নে আবর্তিয়া ছুটে যমুনার জল’ ইত্যাদি রূপে সাধু বা অক্ষরগোনা পয়ারে পরিবর্তিত করেন (পৃ ১২৩)। সম্ভবত তিনি মাত্রাবৃত্ত পয়ার রচনায় তৃপ্তিলাভ করতে পারেন নি। আরও পরবর্তী কালে কিন্তু তিনি মাত্রাবৃত্ত রীতিতে বহু পয়ার রচনা করেছেন (পৃ ৭৮)। পরবর্তিকালীন মাত্রাবৃত্ত পয়ারের একটি দৃষ্টান্ত এই—

সূর্য চলেন ধীরে সন্ন্যাসী বেশে
পশ্চিম নদীতীরে সন্ধ্যার দেশে
বনপথে প্রান্তরে লুণ্ঠিত করি
গৈরিক গোধূলির ম্লান উত্তরী।

—তপস্যা, পাঠপ্রচয় চতুর্থ ভাগ

পয়ারের ন্যায় ত্রিপদী-চৌপদীও সাধু, লৌকিক ও মাত্রাবৃত্ত -ভেদে ত্রিবিধ। দ্রষ্টব্য ‘মালঝাঁপ’।

 পয়ারজাতীয় ছন্দ (পৃ ৬৬-৬৭)—রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন সাধু, সমমাত্রার বা দুইমাত্রার ছন্দ তাকেই বলেছেন পয়ারজাতীয়, পয়ারশ্রেণীয় (পৃ ১১৮) বা পয়ারসম্প্রদায় (পৃ ৬৭)। এই বর্গের ছন্দকেই বলা হয় অক্ষরবৃত্ত বা অক্ষরগোনা (পৃ ১৪২); প্রচলিত মতে অক্ষরসংখ্যা অনুসারেই এ শ্রেণীর ছন্দের মাত্রাগণনা করা হয়।

 অক্ষরবৃত্ত নামের মতো পয়ারজাতীয় নামটিও সমীচীন নয়। কেননা বাংলা ছন্দের তিন শাখাতেই পয়ার রচনা প্রচলিত। ত্রিবিধ পয়ারের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে।

 এই পয়ারজাতীয় ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে তার শোষণশক্তি (পৃ ৩৮) বা স্থিতিস্থাপকতা (পৃ ১২১)। এ কথার অর্থ এই যে, এ রীতির ছন্দে ব্যঞ্জনান্ত যুগ্মধ্বনিকে প্রায় সর্বত্রই সংকুচিত করে এক মাত্রায় পরিণত করা হয়, ফলে যথেচ্ছভাবে যুক্তাক্ষরবহুল শব্দ প্রয়োগ করলেও মাত্রাবৃদ্ধি দোষ ঘটে না। বলা প্রয়োজন যে, এ রীতির ছন্দে শব্দের অন্তস্থিত যুগ্মধ্বনির সংকোচন হয় না।

 পর্ব (পৃ ৯৪)—পংক্তির লঘুঘতিনির্দিষ্ট বিভাগকে বলা হয় পর্ব। পর্বই ছন্দের প্রধান নির্ভর। পর্বের প্রকৃতি, আকৃতি ও সমাবেশপদ্ধতির দ্বারাই ছন্দের রূপ ও অবয়ব নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পর্বের চেয়ে উপপর্বকেই ছন্দের প্রধান অবলম্বন মনে করতেন। তাই তিনি সমস্ত বাংলা ছন্দকে সম, অসম ও বিষম এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন (পৃ ১৫)। সমমাত্রার ছন্দ মানে দুইমাত্রা-উপপর্বের ছন্দ; অসমমাত্রার ছন্দ মানে তিনমাত্রা-উপপর্বের ছন্দ ও আর, যে ছন্দের পর্ব তিনমাত্রা- ও দুইমাত্রা-উপপর্বের সমবায়ে গঠিত তাকেই বলেছেন বিষমমাত্রার ছন্দ। উপপর্ব বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ কখনও ব্যবহার করেছেন ‘চলন’ (পৃ ৩৫) এবং কখনও ব্যবহার করেছেন ‘ভূমিকা’ (পৃ ৫৪)। ত্রৈমাত্রিক ভূমিকা মানে তিন মাত্রার উপপর্ব।

 উপপর্বকে ছন্দের প্রধান অবলম্বন মনে করলেও রবীন্দ্রনাথ পর্ববিভাগকে অস্বীকার করেননি। যখন তিনি বলেন পাঁচ মাত্রার ছন্দ (পৃ ১৫), তখন পাঁচ মাত্রার পর্ব-গঠিত ছন্দই তাঁর অভিপ্রেত; ছয় মাত্রার ছন্দ, ছয়মাত্রার কায়দা (পৃ ১১-১২) বা ‘ষড়ঙ্গী’ (পৃ ১০০) বলতে ছয়মাত্রা-পর্বের ছন্দ বোঝায়। পর্ব শব্দ ব্যবহার না করলেও তার প্রতিশব্দ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি অপারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন—পা (পৃ ১১), পদক্ষেপ (পৃ ৩৪), মাত্রাভাগ (পৃ ৯২), পূর্ণভাগ (পৃ ৯৬), ভাগ (পৃ ১০০), কলা (পৃ ১০১), ধ্বনিগুচ্ছ (পৃ ১৫৩)। এক জায়গায় তিনি পর্ব শব্দটি ব্যবহার করেছেন সংস্কৃত ছন্দের যতিবিভাগ অর্থে (পৃ ১৯০)। সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রে পর্ব অর্থে ‘গণ’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন—চতুষ্কল গণ, মানে চার-কলামাত্রার পর্ব।

 পর্বাঙ্গ (পৃ ৯৫)—এটি অমূল্যবাবুর ব্যবহৃত পরিভাষা। রবীন্দ্রনাথ নিজে এই শব্দটি ব্যবহার করেন নি। পর্বের উপযতি-নির্দিষ্ট উপবিভাগকে অর্থাৎ উপপর্বকেই অমূল্যবাবু বলেন পর্বাঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ তাকে কখনও বলেছেন ‘চলন’, কখনও ‘ভূমিকা’।

 প্রদক্ষিণ (পৃ ৩৪)— ছন্দের পূর্ণযতির বিভাগ অর্থাৎ পংক্তিকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন প্রদক্ষিণ। এ শব্দটিকে পারিভাষিক বলে মনে করা যায় না। এর অর্থেরও স্থিরতা নেই। দ্রষ্টব্য ‘পংক্তি’।

 প্রস্বর (accent)—ইংরেজিতে যাকে বলা হয় এক্‌সেণ্ট্ তার বাংলা অপারিভাষিক নাম ঝোঁক। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ নানা প্রসঙ্গেই এক্‌সেণ্ট্ অর্থে ঝোঁক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘ইংরেজিতে প্রত্যেক শব্দেরই একটি নিজস্ব ঝোঁক আছে’ (পৃ ১)। ছন্দের পরিভাষায় ঝোঁক বা এক্‌সেণ্ট্‌কে বলা যায় প্রস্বর; তাতে প্রস্বরণ, প্রস্বরিত, প্রাস্বরিক প্রভৃতি শব্দ গঠনের সুবিধা হয়।

 বাংলা গদ্যে উচ্চারণের ঝোঁকটা সাধারণত বাক্যের আরম্ভে পড়ে (পৃ ১)। কিন্তু প্রয়োজনমতো ‘বাক্যের পর্বে পর্বে’ও ঝোঁক দেওয়া যায়। আর “বাংলা ছন্দে যে পদবিভাগ হয় সেই প্রত্যেক পদের গোড়াতেই একটি করিয়া ঝোঁকালো শব্দ কাপ্তেনি করে” (পৃ ৯)। এখানে ‘পদ’ শব্দ প্রয়োজনমতো পদ, পর্ব বা উপপর্ব অর্থে গ্রহণীয়। এর দৃষ্টান্ত দ্রষ্টব্য ১১-১৫ পৃষ্ঠায়। বাংলা ছন্দে যতিবিভাগের গোড়াতে যেখানে ঝোঁক পড়ে সেখানেই তালি দিতে হয় এবং তদনুসারেই ছন্দের স্পন্দন বা লয় অর্থাৎ রিদ্‌ম্ ধরা পড়ে (পৃ ৪২-৪৩)। তিনমাত্রার ঝোঁক (পৃ ৯৮) কথার দ্বারা বোঝা যায় তিনমাত্রা-উপপর্বের ঝোঁক।

 একটা প্রচলিত ধারণা এই যে, শুধু চলতি বাংলার ছড়াজাতীয় ছন্দেই ঝোঁক বা প্রস্বরের প্রভাব দেখা যায় অর্থাৎ শুধু এইজাতীয় ছন্দকেই বলা যায় প্রাস্বরিক ছন্দ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে-সব দৃষ্টান্তে প্রস্বরচিহ্ন দিয়ে ঝোঁক বা তালি দেবার নিয়ম ও বৈচিত্র্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন, সেগুলি প্রায় সবই ছড়াজাতীয় ছন্দোরীতির বহির্বর্তী। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মতে বাংলা ছন্দের তিন শাখাতেই ঝোঁক বা প্রস্বরের ক্রিয়া আছে এবং সর্বত্রই ছন্দের প্রত্যেক যতিবিভাগের গোড়াতেই ঝোঁক পড়ে। ‘খুব তার | বোলচাল | সাজ ফিট | ফাট’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটি (পৃ ৭০) ছড়াজাতীয় নয়। এটি রচিত হয়েছে কলামাত্রিক ছন্দে, অথচ এ ছন্দটা যে বেশ ঝোঁকালো তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তবে চলতি বাংলার ছড়াজাতীয় দলমাত্রিক (syllabic) ছন্দেই প্রস্বরের প্রভাব বেশি, এ কথা রবীন্দ্রনাথের উক্তি থেকেও বোঝা যায়।‘বাংলার অসাধু ভাষাটা খুব জোরালো ভাষা’ (পৃ ৬) এবং বাংলা ভাষার চলতি রীতিতেই তার ‘অন্তরের স্বাভাবিক সুর’ (পৃ ৭) প্রকাশ পেয়েছে, আর এ জন্যই চলতি বাংলার ছন্দকেই বলা হয়েছে ‘বাংলা ভাষার স্বাভাবিক ছন্দ’ (পৃ ১৭০-৭১)। “বাংলা চলতি ভাষার ধ্বনিটা হসন্তের সংঘাতধ্বনি, এই জন্য ধ্বনিহিসাবে সংস্কৃতের চেয়ে ইংরেজির সঙ্গে তাহার মিল বেশি” (পৃ ১৭, ১২৮)। ছন্দের দিক্ থেকেও ইংরেজির সঙ্গে চলতি বাংলা ছন্দের মিল দেখা যায়; উভয়ত্রই ‘হসন্তের সংঘাতধ্বনি’কে ছন্দের কাজে লাগানো হয়। ‘কই পালঙ্ক, কই রে কম্বল’ ইত্যাদি দৃষ্টান্ত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ইহার সঙ্গে Ah distinctly I remember শ্লোকটি মিলাইয়া দেখিলে দেখা যাইবে ধ্বনির বিশেষ কোনো তফাত নাই” (পৃ ১৭)। এই মিল শুধু দলবিভাজনগত নয়, প্রস্বরস্থাপনগতও বটে। উভয়ত্রই প্রস্বর বা ঝোঁক পড়েছে ছন্দোবিভাগগুলির আদিতে। কিন্তু ইংরেজি ছন্দের সঙ্গে বাংলা চলতি ছন্দের অমিলও আছে। “দেখা গিয়াছে ইংরেজি ছন্দে ঝোঁক পদের [ছন্দোবিভাগের] আরম্ভেও পড়িতে পারে, পদের শেষেও পড়িতে পারে; কিন্তু “বাংলায় আরম্ভে ছাড়া পদের আর কোথাও ঝোঁক পড়িতে পারে না” (পৃ ১৯)।

 প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ—দ্রষ্টব্য ‘শাখা’।

 ফাঁক (পৃ ১০)—এটি একটি অপারিভাষিক শব্দ। রবীন্দ্রনাথ এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। এক জায়গায় এটি ব্যবহৃত হয়েছে ছেদ বা যতি অর্থে (পৃ ৯৪)। কোনো কোনো স্থলে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মাত্রাসংযোগের অবকাশ অর্থে (পৃ ১০)। যেমন—

মহাভারতের কথা | অমৃতসমান--।

এই পয়ারপংক্তিটার প্রথম পদে আট মাত্রা এবং দ্বিতীয় পদে ছয় মাত্রা গণনা করাই সাধারণ রীতি। রবীন্দ্রনাথও তাই করেন (পৃ ৭১, ১৪৩)। কিন্তু তিনি কখনও কখনও পয়ারে চোদ্দ মাত্রা গণনা না করে ষোল মাত্রাও ধরেছেন। সে ক্ষেত্রে তিনি চোদ্দটি শ্রুতমাত্রার পরে পূর্ণযতির স্থলে আরও দুটি অশ্রুতমাত্রা আছে বলে ধরে নেন; চোদ্দটি শ্রুতমাত্রাকে বলেছেন ‘উচ্চারিত মাত্রা’ বা ‘ধ্বনির মাত্রা’ এবং দুটি অশ্রুতমাত্রাকে বলেছেন ‘অনুচ্চারিত মাত্রা’ বা ‘যতির মাত্রা’ (পৃ ৪১,৪৬, ১১৮)। এই যতির মাত্রার অবকাশকেই বলেছেন ফাঁক। পয়ারে শুধু পূর্ণযতির স্থলে নয়, অর্ধযতির স্থলে এবং অন্যত্রও দুই মাত্রার ফাঁক রাখা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন (পৃ ১২০)।

 গানে যতিমাত্রার হিসাব রাখা হয়। কারণ, “সুরের বিরাম হয়, কিন্তু কালের বিরাম হয় না। যেমন সুরের মাত্রা আছে, সেইরূপ বিরামেরও মাত্রা আছে” (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রণীত স্বরলিপিগীতিমালা, প্রথম খণ্ড, তৃতীয় সং, পৃ ৭)। গানে অবিরত-বিরত-নির্বিশেষে সমগ্র গীতকালের হিসাব রাখার প্রয়োজন আছে। কাব্যছন্দের বিচারে এ-রকম হিসাব রাখা অনাবশ্যক। রস্তুত রবীন্দ্রনাথও সর্বত্র, অর্থাৎ অমিত্রাক্ষর, ত্রিপদী, চৌপদী প্রভৃতি সমস্ত বন্ধে, পূর্ণ, অর্ধ, লঘু এবং উপ-যতির মাত্রাগণনা প্রয়োজন মনে করেন নি।

 ধ্বনিসংকোচের অবকাশ অর্থেও ফাঁক শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায় (পৃ ৩৮)। যেমন—

পাষাণ মিলায়ে যায় | গায়ের বাতাসে।

এই পয়ারপংক্তিটাতে যুগ্মধ্বনি আছে মাত্র তিনটি—ষাণ্ যায়্ য়ের্, এবং তিনটিই আছে শব্দের শেষে; বাকি আটটি ধ্বনিই অযুগ্ম। অযুগ্মধ্বনিতে এক মাত্রা এবং যুগ্মধ্বনিতে দুই মাত্রা ধরে হিসাব করলে পাওয়া যাবে প্রথম পদে আট এবং দ্বিতীয় পদে ছয়, মোট চোদ্দ মাত্রা।

           
সংগীত্ তরঙ্‌গি উঠে | অঙ্‌গের্ উচ্‌ছ্বাসে।

এখানেও চোদ্দ মাত্রা। হিসাবটা এই। ছয়টি অযুগ্মধ্বনিতে (‘।’ দণ্ডচিহ্নযুক্ত—ত, গি, উ, ঠে, ছ্বা, সে) ছয় মাত্রা, শব্দের প্রান্তস্থ দুটি অযুগ্মধ্বনিতে (‘ᐱ’ প্রসারচিহ্নযুক্ত—গীত্, গের্) চার মাত্রা এবং শব্দের অপ্রান্তস্থ চারটি অযুগ্মধ্বনিতে (‘ᐯ’ সংকোচচিহ্নযুক্ত—সং, রঙ্, অঙ্, উচ্) চার মাত্রা— মোট চোদ্দ মাত্রা, প্রথম পদে আট এবং দ্বিতীয় পদে ছয়। এই দুই পংক্তির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, দ্বিতীয় পংক্তিতে চারটি যুগ্মধ্বনি সংকুচিত হয়ে মাত্র চার মাত্রার স্থান পেয়েছে, এটাই এই দুই পংক্তির পার্থক্য। এই শ্রেণীর পয়ারে যুগ্মধ্বনিকে সংকুচিত করবার এই যে অবকাশ, তাকেই বলা হয়েছে ‘ফাঁক’। আর, যুগ্মধ্বনিকে একমাত্রা-পরিমাণের মধ্যে সংকুচিত করে আনবার এই যে শক্তি, তাকেই বলা হয়েছে ‘শোষণশক্তি’।

 এই সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, পয়ারের পদক্ষেপ যেখানে ঘন ঘন, সেখানে এই শোষণশক্তির প্রয়োগ চলে না (পৃ ১১, ৩৮)। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, “যদি লেখা যায়

ধরিত্রীর চক্ষুনীর মুঞ্চনের ছলে
কংসারির শঙ্খরব সংসারের তলে।

তা হলে ও একটা স্বতন্ত্র ছন্দ হয়ে যায়” (পৃ ৩৯)। এই দৃষ্টান্তটিকে তিনি পাঁচমাত্রা-পর্বের মাত্রাবৃত্ত বলে ধরে নিয়েছেন, অর্থাৎ এখানে সবগুলি যুগ্মধ্বনিই প্রসারিত ও দ্বিমাত্রক। কিন্তু এটিকে সাধারণ পয়ারের কায়দায়ও পড়া যায়, অর্থাৎ শব্দের আদি- ও মধ্য-স্থিত যুগ্মধ্বনিগুলিকে সংকুচিত করে এই পংক্তিটিকে চোদ্দ মাত্রার সাধারণ পয়ার বলেও গণ্য করা যায়। রবীন্দ্রকাব্যেও তার প্রমাণ আছে।—

সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি সম।

 —মেঘদুত, মানসী

এ সুন্দর অরণ্যের পল্লবের স্তরে।

 —বসুন্ধরা, সোনার তরী

দুটোই পয়ারপংক্তি, তার ঘন ঘন পদক্ষেপও সুস্পষ্ট। অবশ্য এ দুটিকে পাঁচমাত্রা-পর্বের ভঙ্গিতেও পড়া যায়। ঘন ঘন পদক্ষেপওয়ালা পয়ারও যে যুগ্মধ্বনির বোঝা সইতে পারে, এ কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন অন্যত্র (পৃ ৬৮, ৭০)। যথা—

বেণীবন্ধ তরঙ্গিত কোন্ ছন্দ নিয়া।

এবং

তর্ক-যুদ্ধে উগ্র তেজ, শেষ যুক্তি গালি।

 শুধু ধ্বনিসংকোচের অবকাশ নয়, ধ্বনিপ্রসারের অবকাশ অর্থেও ফাঁক শব্দের প্রয়োগ আছে (পৃ ৬২)। এই অর্থটা প্রাকৃত-বাংলা ছন্দের অর্থাৎ লৌকিক ছন্দের সম্পর্কেই প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, এ ছন্দ হচ্ছে আসলে ‘তিন মাত্রার ছন্দ।...এর প্রত্যেক পা ফেলার লয় হচ্ছে তিনের’। অর্থাৎ তাঁর মতে এটি হচ্ছে তিনমাত্রা-উপপর্বের ছন্দ। এখানে ‘পা-ফেলা’ বা পদক্ষেপ মানে উপপর্ব। কিন্তু এ ছন্দে প্রতিপর্বে প্রত্যক্ষত তিন মাত্রা পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে মাত্রার অভাব দেখা যায়। যেমন—

বৃষ্টি | পড়ে- | টাপুর | টুপুর | নদেয় | এল- | বা-ন।

এখানে তিনটি উপপর্বে এক মাত্রা কম দেখা যায়। কিন্তু আবৃত্তির টানে ওই তিন জায়গায় স্বরধ্বনির প্রসার ঘটে, ফলে মাত্রার অভাব পূর্ণ হয়ে যায়। ধ্বনিপ্রসারের এই অবকাশকে বলা হয়েছে ফাঁক।

 রবীন্দ্রনাথের মতে বাংলার প্রাকৃত ছন্দের ‘প্রত্যেক’ পা-ফেলার লয় হচ্ছে তিনের (পৃ ৬২)। কিন্তু অন্যত্র তার বিপরীত কথাই বলেছেন (পৃ ৬৩, ৮৫)। যেমন—

হারিয়ে ফেলা | বাঁশি আমার | পালিয়েছিল | বুঝি
লুকোচুরির | ছলে।

এখানে প্রত্যেক উপপর্বে তিন মাত্রা গণনা করা হয় নি। এমন কি, এটিকে উপপর্বেও বিভক্ত করা হয় নি; করা হয়েছে পর্ববিভাগ। তা ছাড়া এখানে ‘যতির মাত্রা’ ও ধরা হয়েছে অনেকটা সাধু পয়ারের পদ্ধতিতে (পৃ ১২০)।

আমি | যদি | জন্ম | নিতেম | কালি | দাসের | কালে।

এটা উপপর্বেই বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক উপপর্বেই তিন মাত্রা আছে বলে স্বীকৃত হয় নি (পৃ ২১৭)। সুতরাং বাংলার প্রাকৃত ছন্দকে ‘তিনমাত্রার ছন্দ’ বলা কঠিন। যা হক, এ ছন্দে রবীন্দ্রনাথ যে ফাঁক অর্থাৎ ধ্বনিপ্রসার বা মাত্রাসংযোগের অবকাশ আছে বলে মনে করেন সেটুকুই লক্ষণীয়।

 বাংলা লৌকিক ছন্দের এই ফাঁকগুলিকে হসন্ত বর্ণ দিয়ে অনায়াসেই পূর্ণ করা যায়। এ রকম ‘বেফাঁক’ লৌকিক ছন্দের দৃষ্টান্তও তিনি রচনা করে দেখিয়েছেন (পৃ ৬৪)। পূরবী কাব্যের ‘বিজয়ী’ কবিতাটিতেও বেফাঁক রচনার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় (পৃ ২১৭-১৮)।

বিহঙ্গগান | শান্ত তখন | অন্ধরাতের | পক্ষছায়ে।

কিন্তু কবিতাটির সর্বত্র তার বেফাঁক প্রকৃতি বজায় থাকেনি। মহুয়া কাব্যের ‘অর্ঘ্য’ কবিতাটিতে লৌকিক ছন্দের বেফাঁক প্রকৃতি সর্বত্র অব্যাহত আছে। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ইত্যাদি ছড়াটির ‘তিন কন্যে’ পর্বটাকে রবীন্দ্রনাথ যে-ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন (পৃ ৬২), তা না করে ‘তি-ন | কন্যে’ এ-ভাবেও বিশ্লেষণ করা চলত। যা হক, এটিকে তিনি বেফাঁক পদ্ধতিতেও রূপান্তরিত করেছেন (পৃ ৬৩)। তার একটি পর্ব হচ্ছে ‘বিয়ের বাসরে’। এই পর্বটিতে লৌকিক ছন্দের ভঙ্গি অব্যাহত আছে বলা যায় না। এ ছড়াটার আরএক রূপান্তর আছে ১৯২ পৃষ্ঠায়। সেটি সম্বন্ধেও এই মন্তব্যই প্রযোজ্য। ‘শিব ঠাকুরের বিয়ের লগ্নে’ লিখলে ওই ভঙ্গি বজায় থাকত। ‘বিয়ের বাসরে’ এবং ‘শিবু ঠাকুরের বিবাহ হচ্ছে’ থাকলে এই দৃষ্টান্ত-দুটিকে লৌকিক না বলে মাত্রাবৃত্ত বলাই সংগত হবে। রামপ্রসাদের ‘মা আমায় ঘুরাবি কত’ ইত্যাদি গানটির যে বেফাঁক চেহারা দেখানো হয়েছে (পৃ ৬৩) তাও লৌকিক নয়, ছয়মাত্রা-পর্বের মাত্রাবৃত্ত। ‘আমার সকল কাঁটা ধন্য করে’ ইত্যাদি চলতি ছন্দের দৃষ্টান্তটি যে দুটি রূপে পরিবর্তিত হয়েছে (পৃ ৭), তার প্রথমটি ‘মাত্রাবৃত্ত’, দ্বিতীয়টি ‘সাধু’। এগুলিকে বেফাঁক লৌকিক ছন্দের দৃষ্টান্ত বলা যায় না। এই প্রসঙ্গে ‘টুমুস্ টুমুস্ বাদ্যি বাজে’ ছড়াটাও স্মরণীয় (পৃ ২০২)।

 সংগীতশাস্ত্রে ফাঁক শব্দের একটা পারিভাষিক অর্থ আছে। গানে তালের শেষ ঝোঁক বা প্রস্বরকেই বলা হয় ‘ফাঁক’ (পৃ ৯৮)[]। ছন্দের আলোচনায় ফাঁকের এই পারিভাষিক অর্থ প্রযুক্ত হয় না।

 বক্ত্র (পৃ ১৯৯)— অনুষ্টুপ্‌বর্গের পথ্যাবক্ত্র ছন্দে প্রতিপাদের শেষ চার বর্ণের লঘুত্বগুরুত্ব নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন, প্রথম চার বর্ণ অনিয়মিত। তাই ‘অপরং ভবতো জন্ম’ এবং ‘বহূনি মে ব্যতীতানি’, এই দুটি পদের শেষ চার বর্ণের লঘুত্বগুরুত্বক্রমে সমতা আছে, আর প্রথম চার বর্ণের বিন্যাসক্রমে সমতার অভাব ঘটেছে। দ্বিতীয়টির সঙ্গে সমতা রাখতে হলে প্রথমটির রূপ হত ‘অপার ভাবতো জন্ম’। দ্রষ্টব্য ‘অনুষ্টুপ্’।

 বিষমমাত্রার ছন্দ (পৃ ১৫, ৩৬)—যে ছন্দের পর্ব তিন মাত্রা ও দুই মাত্রার দ্বিবিধ উপপর্ব নিয়ে গঠিত, তাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বিষমমাত্রার ছন্দ। দ্রষ্টব্য ‘অসমমাত্রার ছন্দ’।

 তিন-দুই মাত্রার উপপর্ব নিয়ে গঠিত বিষমমাত্রার ছন্দের বিস্তার ও বৈচিত্র্য ঘটানো যেতে পারে নানা ভাবে (পৃ ১৩৩)। যথা—

শিমুল: রাঙ৷: রঙে | চোখেরে: দিল: ভরে।

এখানে প্রত্যেক পর্বে তিন-দুই-দুই মাত্রার তিনটি উপপর্ব।

তটের বুকে লাগে | জলের ঢেউ | তবে সে কলতান | উঠে,
বাতাসে বন-সভা | শিহরি কাঁপে | তবে সে মর্মর | ফুটে।

—গানভঙ্গ, সোনার তরী

এখানে শুধু উপপর্ব নয়, পর্বের বিষমতাও লক্ষণীয়। আরও বৈচিত্র্য আছে স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যে। রবীন্দ্রপরিভাষায় এ সমস্তই বিষমমাত্রার ছন্দ বলে স্বীকার্য। বিষমমাত্রা ছন্দের আরও বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্ত আছে ৪২-৪৩ পৃষ্ঠায়। ‘চাহিছ বারে বারে | আপনারে | ঢাকিতে’, এই দৃষ্টান্তটি মানসী কাব্যের ‘ছিলাম নিশিদিন | আশাহীন | প্রবাসী’ ইত্যাদি ‘বিরহানন্দ’-নামক রচনাটির অবিকল প্রতিরূপ। কবি মানসীতে এটির সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “এই ছন্দে যে যে স্থানে ফাঁক, সেইখানে দীর্ঘ যতিপতন, আবশ্যক।”

 ৩৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘দুই-তিনের যোগে বিষমমাত্রায় ছন্দ’। এখানে দুই ও তিন মাত্রার চলনের যোগ বা সমাবেশের কথা বলাই অভিপ্রেত, বিন্যাসক্রমের কথা নয়। ‘যতই চলে’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটির বিন্যাসক্রম হচ্ছে তিন-দুই ৷

 ভুজঙ্গপ্রয়াত—এটি একটি সংস্কৃত ছন্দ। এই ছন্দের প্রতিপদে লঘু-গুরু-গুরু (৴ — —) এই পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত বারটি বর্ণ থাকে। রবীন্দ্রনাথ এ ছন্দের নাম উল্লেখ করেন নি, কিন্তু বাংলায় সংস্কৃত ছন্দের প্রসঙ্গে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য (শিবের দক্ষালয়যাত্রা) থেকে একটি দৃষ্টান্ত উদ্‌ধৃত করেছেন (পৃ ৫)। যথা—

৴ — — ৴ — — ৴ — — ৴ — —
ম হারুদ্রবেশে মহাদেব সাজে।

এখানে মূলপাঠ একটু বদলে গেছে, মূলে আছে ‘মহারুদ্ররূপে’। কিন্তু তাতে ছন্দে কোনো ত্রুটি ঘটে নি।

 মদিরা (পৃ ৪৭)—এটিও একটি সংস্কৃত ছন্দ। এই ছন্দের প্রত্যেক পদে আটটি করে গণ বা পর্ব থাকে। প্রত্যেক গণের প্রথমে একটি গুরুধ্বনি ও পরে দুটি লঘুধ্বনি থাকে এবং অষ্টম গণে থাকে একটিমাত্র গুরুধ্বনি, এই হচ্ছে এ ছন্দের নিয়ম। এ ছন্দের দৃষ্টান্ত ও বিশ্লেষণ গ্রন্থমধ্যে দ্রষ্টব্য। মদিরা ছন্দের বিন্যাসক্রম (— ৴ ৴) ভুজঙ্গপ্রয়াতের বিন্যাসক্রমের (৴ — —) বিপরীত। গ্রীক ছন্দপরিভাষায় এই দুই ছন্দের ধ্বনিবিন্যাসপদ্ধতি যথাক্রমে dactyl ও anti-Bacchic নামে পরিচিত।

 মন্দাক্রান্তা (পৃ ৪৬)—এই বিখ্যাত সংস্কৃত ছন্দটির প্রতি পদে অর্থাৎ পংক্তিতে থাকে সতরটি করে ‘অক্ষর’ বা ধ্বনি, অর্থাৎ সিলেব্‌ল্। এই সতরটি ধ্বনি আবার তিনটি যতিবিভাগে বিভক্ত; প্রথম ভাগে চার, দ্বিতীয় ভাগে ছয় এবং তৃতীয় ভাগে সাতটি ধ্বনি থাকে। প্রথম ভাগের চারটি ধ্বনিই গুরু, দ্বিতীয় ভাগে শেষ ধ্বনিটি গুরু এবং তৃতীয় ভাগে দ্বিতীয় ও পঞ্চম বাদে বাকি সব গুরু। এই হল মন্দাক্রাস্তার নিয়ম। দৃষ্টান্ত (পৃ ১৯০) দিলেই সহজে বোঝা যাবে—

— — — — ৴ ৴ ৴ ৴ ৴ — — ৴ — — ৴ — —
মেঘালোকে | ভবতি সুখিনোঽ | প্যন্যথাবৃত্তিচেতঃ।

সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রকাররা মন্দাক্রান্তার পংক্তিকে তিনটি যতিবিভাগেই বিভক্ত করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এটিকে বিভক্ত করেন চার ভাগে (পৃ ৪৬-৪৭, ১৯০)। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও তাই করতেন। এঁরা সকলেই উল্লিখিত তৃতীয় অংশটিকে দুই যতিভাগে বিভক্ত করেন; প্রথম ভাগে ধ্বনিসংখ্যা চার এবং দ্বিতীয় ভাগে তিন।

 রবীন্দ্রনাথের মতে মন্দাক্রান্তার ধ্বনিবিভাগ চার-ছয়-চার-তিন। গুরুধ্বনিকে বিশ্লিষ্ট করে দুই মাত্রা বলে ধরলে মন্দাক্রান্তার মাত্রাবিভাগ হয় যথাক্রমে—আট-সাত-সাত-পাঁচ। রবীন্দ্রনাথের ধারণা শেষভাগে চার মাত্রা (পৃ ৪৭,১৯০); কেবল যতির প্রভাবে তা পাঁচ মাত্রায় পরিণত হয়। মাত্রা পরিমাণ হিসাবে মন্দাক্রান্তাকে সর্বপ্রথম বাংলায় রূপান্তরিত করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। যথা—

ফুল তাহে ধরিয়াছে,
লাবণ্যে ভরি’ আছে,
বনেরে করিয়াছে
জীবন-দান।

—স্বপ্নপ্রয়াণ, ৩য় সং (১৯১৪), ২।১৪০

শেষভাগে পাঁচ মাত্রা। সত্যেন্দ্রনাথ-কৃত মন্দাক্রান্তার রূপান্তরেও শেষভাগে পাঁচ মাত্রা।—

ভরপুর অশ্রুর
বেদনা-ভারাতুর
মৌন কোন্ সুর
বাজায় মন।

—কুহু ও কেকা (১৯১২), যক্ষের নিবেদন 

রবীন্দ্রনাথ মন্দাক্রান্তাকে মাত্রা হিসাবে বাংলায় রূপান্তরিত করেছেন তিন স্থলে। তার মধ্যে দুই স্থলেই শেষভাগে চার মাত্রা (পৃ ৯৩, ১৩৪) এবং এক স্থলে পাঁচ মাত্রা (পৃ ১৯০)।

 সংস্কৃত মন্দাক্রান্ত। ‘অমিত্রাক্ষর’, অর্থাৎ তার পংক্তিতে পংক্তিতে কিংবা ভাগে ভাগে মিল থাকে না। মিলহীন মাত্রিক বাংলা মন্দাক্রান্তার দৃষ্টান্ত দ্রষ্টব্য ১৯০ পৃষ্ঠায়।

 মন্দাক্রান্তার শুধু মাত্রিক রূপ নয়, তার মূল ‘আক্ষরিক’ (অর্থাৎ দলমাত্রিক বা সিলেবিক) রূপের বাংলা দৃষ্টান্তও রবীন্দ্রনাথ উদ্‌ধৃত করেছেন (পৃ ৫)। যথা—

ইচ্ছা সম্যক্‌ ভ্রমণগমনে কিন্তু পাথেয় নাস্তি।
পায়ে শিক্লী মন উড়ু উড়ু, এ কি দৈবেরি শাস্তি!

এটির রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দুটিমাত্র পদ উদ্‌ধৃত করেছেন। তার পূর্ণ চতুষ্পদ রূপ এই।—

— — — — ৴ ৴ ৴ ৴ ৴—  — ৴ — — ৴ — —
টঙ্কাদেবী | কর যদি কৃপা | না রহে কোন জ্বালা
বিদ্যাবুদ্ধী | কিছুই কিছু না | খালি ভস্মে ঘি ঢালা।

ইচ্ছা সম্যক্ | তব দরশনে | কিন্তু পাথেয় নাস্তি-।
পায়ে শিক্লী | মন উড়ু উড়ু- | একি দৈবের শাস্তি-।[]

—সুপ্রভাত, ১৩১৭ ভাদ্র, পৃ ৭৫ 

‘কোন’ ‘মন’ এবং ‘দৈবের’ শব্দের শেষ অক্ষরটির অকারান্ত উচ্চারণ করতে হবে। ‘কিছুই’ শব্দের ই-র স্বাতন্ত্র্যও স্বীকার্য। সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রের নিয়মে পদের অন্তস্থিত লঘুধ্বনিও ছন্দের প্রয়োজনমতো গুরু বলে স্বীকৃত হয়। তদনুসারে ‘নাস্তি’ এবং ‘শাস্তি’ শব্দের ইকার দীর্ঘরূপেই উচ্চার্য। এ সব স্থলে পূর্ণযতির প্রভাবেই তৎপূর্ববর্তী লঘুধ্বনিও গুরুত্ব লাভ করে। বাংলায় এই নিয়মটিকে প্রসারিত করে ছন্দের প্রয়োজনে যে-কোনো সুস্পষ্ট যতির পূর্ববর্তী লঘুধ্বনিকে গুরু বলে গণ্য করা চলে। তদনুসারে ‘উড়ু উড়ু’ শব্দের শেষ উকারটির উচ্চারণ হবে দীর্ঘ।

 লক্ষ্য করা প্রয়োজন যে, এই শ্লোকটিতে সংস্কৃত শাস্ত্র অনুসারে প্রতিপংক্তি স্বাভাবিকভাবে তিন যতিভাগে বিভক্ত হয়েছে; বাংলা পদ্ধতি অনুসারে চার ভাগ হয় নি।

 এই প্রসঙ্গে বলা সংগত যে, দ্বিজেন্দ্রনাথ মন্দাক্রান্তাকে রূপান্তরিত করেছেন খাঁটি সংস্কৃত আক্ষরিক ও বাংলা মাত্রিক, এই দুই পদ্ধতিতেই। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ করেছেন শুধু বাংলা মাত্রিক পদ্ধতিতে। তিন জনের বাংলা মাত্রিক পদ্ধতিতে পার্থক্য আছে। দ্বিজেন্দ্রনাথের পদ্ধতি বিশিষ্ট কলামাত্রিক আর রবীন্দ্রনাথের পদ্ধতি সরল কলামাত্রিক। উভয়ের মন্দাক্রান্তাই সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রসম্মত ‘অক্ষর’সংখ্যা -নিরপেক্ষ, মানে তাঁদের মন্দাক্রান্তায় প্রতিপদে সতর ‘অক্ষর’ অর্থাৎ দল (সিলেব্‌ল্) নেই। সত্যেন্দ্রনাথের পদ্ধতিকে বলা যায় দলকলামাত্রিক। তাঁর রচনায় যথানির্দিষ্ট গুরুলঘুক্রমে দলসংখ্যা স্থির আছে, ফলে কলাসংখ্যাও স্থির আছে। তিন জনের রচিত দৃষ্টান্তগুলির পারস্পরিক তুলনা করলেই এই তিন রূপের পার্থক্য ধরা পড়বে। বিশিষ্ট কলামাত্রিক মানে বাংলা অক্ষর-মাত্রিক, অর্থাৎ বাংলা কায়দায় যে পদ্ধতির প্রতি অক্ষরে এক মাত্রা। দ্রষ্টব্য ‘মাত্রা’।

 মাত্রা—এ শব্দটি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মাত্রা শব্দের একটি সাধারণ অর্থ মাপ। এই অর্থে মাত্রা শব্দের প্রয়োগ দ্রষ্টব্য ‘ছন্দের অর্থ’ প্রবন্ধে (পৃ ৪৮-৪৯)। কোনো ক্লাসের সব ছেলেই ‘সমান মাত্রার,’ অর্থ ‘সমান মাপের’। এই অর্থকে আরএকটু নিরূপিত করে নিলে মাত্রা মানে দাঁড়ায় কোনো নির্দিষ্ট য়ুনিট বা একক, যার সাহায্যে কোনো কিছুর পরিমাপ করা যায়। এই বিশিষ্ট অর্থে মাত্রা শব্দের প্রয়োগ আছে ওই ‘ছন্দের অর্থ’ প্রবন্ধেই (পৃ ৩৪-৩৫)।

   
শরদচন্দ পবনমন্দ বিপিন ভরল কুসুমগন্ধ
   
ফুল্ল মল্লি মালতিযুথি মত্তমধুপ ভোরনী-।

এখানে ‘আটটি চলনে ছন্দের চাল সারা হচ্ছে’। অর্থাৎ চালের মাত্রা হচ্ছে চলন। এ দৃষ্টান্তটি সম্বন্ধে আরও বলা হয়েছে, ‘ছয়ের মাত্রায় এ পা ফেলছে এবং আটের মাত্রায় ঘুরে আসছে’। এই উক্তির দ্বিতীয়াংশটির মানে আটটি পদক্ষেপে এর প্রদক্ষিণ। অর্থাৎ প্রদক্ষিণের মাত্রা পদক্ষেপ। চলন ও পদক্ষেপ একার্থক, মানে পর্ব। তেমনি চাল ও প্রদক্ষিণ, দুটোরই মানে পংক্তি। সুতরাং পর্বই পংক্তির মাত্রা বলে গণ্য হয়েছে। উদ্‌ধৃত দৃষ্টান্তটিতে আটটি পর্ব-মাত্রায় এক পংক্তি সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু পর্বের অর্থাৎ চলন বা পদক্ষেপের মাত্রা কি? শরদ, কুসুম, মধুপ প্রভৃতি যুগ্মধ্বনিহীন শব্দে তিন মাত্রা ধরা হয়েছে। অতএব বলতে হবে এ ক্ষেত্রে একটি অযুগ্ম বা লঘু ধ্বনির উচ্চারণকাল অর্থাৎ এক ‘কলা’ই এক মাত্রা বলে গণিত হয়েছে। যুগ্ম বা গুরু ধ্বনিতে দুই কলা, অতএব দুই মাত্রা। ‘চন্দ’ শব্দে একটি গুরুধ্বনি (চন্) ও একটি লঘুধ্বনি (দ), অতএব তিন কলা-মাত্রা। ‘মালতি’ শব্দের ‘মা’এর দীর্ঘ উচ্চারণ, অতএব গুরু; তাই ‘মালতি’ শব্দে চার কলামাত্রা গণনীয়। ‘ভোরনী’ শব্দের ‘ভো’ এবং ‘নী’ও গুরু; অধিকন্তু তার শেষে একটি অনুচ্চারিত মাত্রাও গণনীয়। এই হিসাবে উপরের দৃষ্টান্তটির প্রত্যেক পর্বে (চলনে বা পদক্ষেপে) পাওয়া যাবে ছয়টি করে কলামাত্রা। এর পুরো পরিচয় এই যে, ছয় কলা-মাত্রায় এর পর্ব এবং আট পর্ব-মাত্রায় এর পংক্তি। রবীন্দ্রপরিভাষায় এর চাল বা প্রদক্ষিণের মাত্রা আট এবং চলন বা পদক্ষেপের মাত্রা ছয় (পৃ ৩৫, ৪১)। মনে রাখা প্রয়োজন—চালের মাত্রা চলন, ভাষান্তরে প্রদক্ষিণের মাত্রা পদক্ষেপ, অর্থাৎ পংক্তির মাত্রা পর্ব, আর চলন বা পদক্ষেপের মাত্রা কলা। যার সাহায্যে পরিমাপ করা যায় তারই নাম মাত্রা। এখানে পংক্তি পরিমিত হয়েছে পর্বের সাহায্যে, সুতরাং পর্বই তার মাত্রা; এবং পর্ব পরিমিত হয়েছে কলার সাহায্যে, সুতরাং কলাই তার মাত্রা

 শুধু পর্বকে নয়, রবীন্দ্রনাথ স্থলবিশেষে উপপর্বকেও মাত্রা বলে ধরে নিয়েছেন। কেননা, অনেক সময় তিনি উপপর্বকেই ছন্দের মাপকাঠি বলে গণ্য করেছেন। তাই যখন বলেন ‘তিনের মাত্রার ছন্দ’ (পৃ 88), তখন বুঝতে হবে তিনকলা-পরিমিত উপপর্বের ছন্দ। এখানে মাত্রা মানে উপপর্ব। যখন বলেন ‘তিনের ছন্দ’ (পৃ ৩৬, ৪৪) তখন সেই ছন্দকেই বোঝায় যার প্রতি ‘মাত্রা’য় (এস্থলে, উপপর্বে) তিন কলা।

 দেখা গেল এই গ্রন্থে পর্ব-মাত্রা, উপপর্ব-মাত্রা ও কলা-মাত্রা, এই তিন রকম মাত্রাই স্বীকৃত হয়েছে। তা ছাড়া সিলেব্‌ল্-মাত্রার কথাও পাওয়া যায় নানা স্থানে। “ফল শব্দ বস্তুত এক মাত্রার কথা। অথচ সাধু বাংলাভাষার ছন্দে ইহাকে দুই মাত্রা বলিয়া ধরা হয়” (পৃ ৫-৬)। এর মানে ফল শব্দ এক সিলেব্‌ল্‌এর কথা, কিন্তু সাধু বাংলার ছন্দে এটিকে দুই কলা বলে ধরা হয়। অর্থাৎ সাধু ছন্দে অবস্থাভেদে এক সিলেব্‌ল্‌এও দুই মাত্রা ধরা যায়, কেনন। কলা-ই তার মাত্রা। কিন্তু অ-সাধু বা, প্রাকৃত বাংলার ছন্দে এক সিলেব্‌ল্‌এই এক মাত্রা (পৃ ১৮)। যেমন—

কই্ | পা | লঙ্ | ক || কই্ | রে | কম্ | বল্।

এখানে সিলেবল্‌ই মাত্রা বলে স্বীকৃত। অর্থাৎ অ-সাধু বাংলার ছন্দ হচ্ছে সিলেব্‌ল্-মাত্রার ছন্দ। ‘কই’ শব্দে এক সিলেব্‌ল্‌ এবং অ-সাধু ছন্দে এটি একমাত্রা বলেই গণ্য। যা হক, ফল কই প্রভৃতির ন্যায় একসিলেব্‌ল্‌এর শব্দকেই বলা হয়েছে ‘ঐকমাত্রিক’ (monosyllabic) ধ্বনি (পৃ ১২৮)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যে-ছন্দগুলি বাংলার প্রাকৃত ছন্দ, অক্ষর গণনা করে তাদের মাত্রা নয়’ (পৃ ১৯২)। বস্তুত তাদের মাত্র। সিলেব্‌ল্ গণনা করে। “চলতি ভাষার কাব্য, যাকে বলে ছড়া,•••সেটা পয়ার হলেও অক্ষরগোনা পয়ার হবে না, সে হবে মাত্রাগোনা পয়ার” (পৃ ১৪২)। এখানে মাত্রা মানে সিলেব্‌ল্‌ মাত্রাগোনা মানে সিলেবিক। তার পরেই আছে, ‘বস্তুত সাধুভাষার পয়ারও মাত্রাগোনা’। এখানে মাত্রা মানে অক্ষর। এই দুই উক্তির অভিপ্রায় এই যে,—চলতি ভাষার পয়ার এবং সাধু ভাষার পয়ার দুই-ই মাত্রাগোনা, তবে সাধু ভাষার পয়ার অক্ষরগোনা এবং চলতি ভাষার পয়ার সিলেব্‌ল্‌গোনা। সাধু ছন্দের মাত্রা অক্ষর, অ-সাধু ছন্দের মাত্রা সিলেব্‌ল্‌। ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ ইত্যাদি ছড়াটার যে বিশ্লেষণ আছে (পৃ ১৪৩), তাতেও এ কথা প্রতিপন্ন করাই অভিপ্রায়। ‘মন বেচারির কি দোষ আছে’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটির (পৃ ১৭০-৭১) বিশ্লেষণেও ওই একই অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে।

এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান-গাওয়া এই ভাষায়,
তারার সাথে নিশীথ-রাতে ঘুমিয়ে-পড়া নূতন প্রাতের আশায়।

এই দৃষ্টান্তটি সম্বন্ধে বলা হয়েছে,—“এই জাতের সাধু ছন্দে আঠার অক্ষরের আসন থাকে। কিন্তু এটাতে কোনো কোনো লাইনে পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছে” (পৃ ১৮৯)। অক্ষরসংখ্যা কোনো কোনো লাইনে একুশ পর্যন্ত নেমেছে। অর্থাৎ এটা অক্ষরগোনা সাধু ছন্দ নয়। সাধু ছন্দ হলে এটাতে থাকত আঠার অক্ষর; কিন্তু এখানে আছে আঠার সিলেব্‌ল্ (গাওয়া দুই সিলেব্‌ল্‌, ‘ওয়া’র উচ্চারণরূপ wã বা वा; ‘ঘুমিয়ে’ও দুই সিলেব্‌ল্, তার উচ্চারণ ঘুম্‌য়ে)। সাধু ছন্দের মাত্রা অক্ষর, অ-সাধু ছন্দের মাত্রা সিলেব্‌ল্। এটা হচ্ছে অক্ষরমাত্রিক সাধু দীর্ঘপয়ারের সিলেব্‌ল্‌মাত্রিক অ-সাধু প্রতিরূপ। আর, ‘যুদ্ধ যখন সাঙ্গ হল’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটি (পৃ ১৩১) হল চোদ্দ অক্ষরমাত্রার সাধু হ্রস্বপয়ারের অ-সাধু প্রতিরূপ। অধিকন্তু এই দুই দৃষ্টান্তের দুই রকম পয়ারই প্রবহমান। আসল কথা এই যে, এই দুই দৃষ্টান্তে সিলেব্‌ল্ই ছন্দের মাত্রা, অক্ষর বা কলা নয়। ছন্দপরিভাষায় এ দুটি হচ্ছে প্রবহমান দলমাত্রিক (দীর্ঘ ও হ্রস্ব) পয়ারের দৃষ্টান্ত।

 সিলেব্‌ল্ অর্থে যেমন নানা স্থানে মাত্রা শব্দের ব্যবহার হয়েছে, তেমনি আবার স্থলবিশেষে মাত্রা অর্থে সিলেব্‌ল্ শব্দটির ব্যবহারও দেখা যায়।

এই যে এল | সেই আমারি | স্বপ্নে দেখা | রূপ।

এবং

দুই জনে জুঁই | তুলতে যখন | গেলেম বনের | ধারে।

ইত্যাদি দুটি দৃষ্টান্তে (পৃ ৫৫-৫৬) এই্‌, সেই্‌, দুই্‌, জুঁই্‌, স্বপ্, রূপ্‌, তুল্, খন্ প্রভৃতি ধ্বনি ‘এক সিলেব্‌ল্‌এর বেশি মান দাবি করলে না’ এবং ‘যুগ্মধ্বনিগুলো এক সিলেব্‌ল্‌এর চাকার গাড়িতে অনায়াসে ধেয়ে চলেছে’। মানে, ‘এই’ প্রভৃতি সিলেব্‌ল্‌গুলি এক মাত্রা বলেই গণ্য হয়েছে, দুই মাত্রার মর্যাদা পায়নি। দুটি দৃষ্টান্তই সিলেব্‌ল্‌মাত্রার অ-সাধু পয়ার। পারিভাষিক নাম দলমাত্রিক পয়ার। দ্বিতীয়টি প্রায় বেফাঁক।

মনে পড়ে | দুই জনে | জুঁই তুলে | বাল্যে।

এবং

কাঁধে মই, | খলে ‘কই’ | ভূঁইচাপা | গাছ’।

এই দুই দৃষ্টান্তে (পৃ ৫৫-৫৬) দুই, জুঁই প্রভৃতি ধ্বনি ‘দুই সিলেব্‌ল্‌এর টিকিট পেয়েছে’। মানে, এই সিলেব্‌ল্‌গুলি দুই কলামাত্রা বলে গণ্য হয়েছে, এক সিলেব্‌ল্‌মাত্রা বলে নয়। কারণ দুটি দৃষ্টান্তই কলামাত্রিক পদ্মার।

 যুগ্মধ্বনি কলামাত্রার ছন্দে দুই কলামাত্রা বলে গণ্য হয়, আর সিলেব্‌ল্‌মাত্রার ছন্দে গণ্য হয় এক সিলেব্‌ল্‌মাত্রা বলে।

 কলামাত্রা এবং সিলেব্‌ল্‌মাত্রার ন্যায় অক্ষরমাত্রার কথাও পাওয়া যায় নানা প্রসঙ্গে। সাধু বাংলার ছন্দগুলিতে ‘প্রত্যেক অক্ষরটি এক মাত্রা বলিয়া গণ্য হইয়াছে’ (পৃ ৩)। যেমন—

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।

‘ইহাতে চোদ্দটি অক্ষরে চোদ্দ মাত্রা’। শয্যা কই বস্ত্র কই, দৃষ্টান্তটির বিশ্লেষণেও দেখা যায় আট অক্ষরে আট মাত্রা ধরা হয়েছে (পৃ ১৮)। এক অক্ষরে এক মাত্রা ধরা, এটা হচ্ছে প্রচলিত রীতি। তদনুসারে বস্ • ত্র না লিখে ব • স্ত্র লিখলেই ঠিক হত। কেননা প্রচলিত রীতি অনুসারে ‘হলন্তই [মানে স্বরান্ত] হোক, হসন্তই হোক আর যুক্তবর্ণ ই হোক এই ছন্দে সকলেরই সমান মাত্রা’ (পৃ ৪৯)। সুতরাং ‘বস্’ লিখলে তাতেই দুই মাত্রা ধরতে হয়।

তব চিত্তগগনের | দূর দিক্‌সীমা।

“এখানে ‘দিক্’ শব্দের ক্ হসন্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে একমাত্রার পদবি দেওয়া গেল” (পৃ ৮০)। কেননা, এটা অক্ষরমাত্রার ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন চলতি ভাষার পয়ার ‘অক্ষরগোনা’ পয়ার নয় (পৃ ১৪২) কিংবা “যে-ছন্দগুলি বাংলার প্রাকৃত ছন্দ, অক্ষর গণনা করে তাদের মাত্রা নয়” (পৃ ১৯২), তখনই বুঝতে হবে তিনি সাধু বাংলার ছন্দকে অক্ষরমাত্রার ছন্দ বলেই ধরে নিচ্ছেন। কেননা, ‘সাহিত্যিক কবুলতিপত্রে সাধু ভাষায় অক্ষর এবং মাত্রা এক পরিমাণের বলে গণ্য হয়েছে’ (পৃ ১৪২)।

 কিন্তু এই বিষয়ে তাঁর মনের দ্বিধার পরিচয়ও আছে এ গ্রন্থে। “আমাদের প্রত্যেক অক্ষরটিই যে বস্তুত একমাত্রার এ কথা সত্য নহে। যুক্ত বর্ণ[] এবং অযুক্ত বর্ণ কখনই একমাত্রার হইতে পারে না।...‘পুণ্যবান্’ শব্দটি ‘কাশীরাম’ শব্দের সমান ওজনের নহে” (পৃ ৪)। অন্যত্র আছে “অক্ষরের সংখ্যা গণনা করে ছন্দের ধ্বনিমাত্রা গণনা বাংলায় চলে না” (পৃ ৬২), এবং “আক্ষরিক ছন্দ বলে কোনো অদ্ভুত পদার্থ বাংলায় কিংবা অন্য কোনো ভাষাতেই নেই, অক্ষর ধ্বনির চিহ্নমাত্র” (পৃ ৬১)। তা হলে যে-সব সাধু ছন্দ আক্ষরিক বা অক্ষরমাত্রার ছন্দ বলে পরিচিত তার বিশ্লেষণ করা যাবে কিভাবে? “বস্তুত সাধু ভাষার পয়ারও মাত্রাগোনা” (পৃ ১৪২)। কিন্তু মাত্রা গণনা করা হবে কিভাবে? অক্ষর গণনা করে তো নয়। এর উত্তর বাংলা উচ্চারণে স্বরের ধ্বনিকে টান দিয়ে অতি সহজেই বাড়ানো-কমানো যায় (পৃ ৫৫), অর্থাৎ ব্যবহারের প্রয়োজনে একটা সীমার মধ্যে আমাদের স্বরবর্ণগুলোর সংকোচনপ্রসারণ চলে (পৃ ৬২)। এই সংকোচনপ্রসারণ-ক্ষমতারই নামান্তর ‘স্থিতিস্থাপকতা’। যেমন—

মহাভারতে-র্ কথা অমৃতসমা-ন্- -।
কাশীরা-ম্ দা-স্ কহে শুনে পুণ্‌ণ্যবা-ন্ - -।

এখানে যুগ্মধ্বনি আছে ছয়টি—তের্ মান্‌ রাম্ দাস্ পুণ্ এবং বান্। তার মধ্যে একমাত্র পুণ্ ধ্বনিটা সংকুচিত হয়ে এক মাত্রা বলে গণ্য হয়েছে, বাকি পাঁচটা প্রসারিত হয়ে গণ্য হয়েছে দুই মাত্রা বলে। পুণ্ -এর উচ্চারণ সংক্ষিপ্ত, বাকিগুলির বিক্ষিপ্ত; এই বিক্ষিপ্ত বা প্রসারিত উচ্চারণকেই বলা হয়েছে ‘টান’। অযুগ্মধ্বনিগুলি সর্বত্রই এক মাত্রা। এই হিসাবে প্রতিপংক্তিতে চোদ্দ মাত্রা পাওয়া যাবে। এই হিসাবই সংগত, যুক্ত-অযুক্ত-হসন্ত-নির্বিশেষে চোদ্দ অক্ষরে চোদ্দ মাত্রা গণনা করা সংগত নয়,— রবীন্দ্রনাথের এই অভিমতও (পৃ ১৯২-৯৩) প্রকাশ পেয়েছে নানা স্থানে। ‘সতত হে নদ তুমি’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটির বিশ্লেষণ (পৃ ১৪২- ৪৩) লক্ষিতব্য।

    
উদয়্‌দিগন্‌তে অই্ | শুভ্‌র শঙ্‌খ বাজে।

প্রসারিত যুগ্মধ্বনি (ᐱ-চিহ্নিত) দুই মাত্রা, সংকুচিত যুগ্মধ্বনি (ᐯ-চিহ্নিত) এক মাত্রা, অযুগ্মধ্বনিও (অচিহ্নিত) এক যাত্রা, এইভাবে হিসাব করলেই এই পংক্তিতে চোদ্দ মাত্র। পাওয়া যাবে (পৃ ৫২-৫৩)। এই বিশ্লেষণটা উচ্চারণসংগত এবং এজন্যই স্বীকার্য। অক্ষরসংখ্যায় হিসাবটা উচ্চারণসংগতও নয়, যুক্তিসংগতও নয়। অতএব অক্ষর সংখ্যাগত বিশ্লেষণ স্বীকার্য নয়।

 তা হলে অক্ষরমাত্রাও স্বীকার্য নয়। অক্ষরমাত্রা না হলে সাধু ছন্দের হিসাব হবে কোন্ মাত্রার গণনায়? রবীন্দ্রনাথের ছন্দোবিশ্লেষণপ্রণালী লক্ষ্য করলে বোঝা যায় কলামাত্রা গণনাই তাঁর অভিপ্রেত। তবে সাধারণ কলামাত্রার ছন্দের সঙ্গে এই বিশিষ্ট কলামাত্রার ছন্দের একটা পার্থক্য আছে। সাধারণ কলামাত্রার ছন্দে সমস্ত যুগ্মধ্বনিই প্রসারিত ও দুইকলা-পরিমিত বলে গণ্য হয়। কিন্তু আলোচ্যমান বিশিষ্ট কলামাত্রার ছন্দে সব যুগ্মধ্বনির কলাপরিমাণ সমান নয়। কোথাও তা সংকুচিত এবং এককলা-পরিমিত, আবার কোথাও তা প্রসারিত এবং দুইকলা-পরিমিত। সাধারণত শব্দের অন্তে অবস্থিত হলে প্রসারিত এবং অন্যত্র সংকুচিত হয়; কিন্তু তার ব্যতিক্রমও আছে। এই বিষয়ে বাংলা ভাষার স্বভাবসীমার মধ্যে কবির যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে। নানা প্রসঙ্গেই তা দেখানো হয়েছে। যেমন—

চিম্‌নি ভেঙে গেছে দেখে | গিন্‌নি রেগে খুন,
ঝি বলে আমার দোষ | নেই ঠা-ক্‌রুন ৷

চিম্ গিন্‌ ঠাক্, তিনটিই শব্দের আদিতে অবস্থিত। অথচ প্রথম দুটি সংকুচিত এবং তৃতীয়টি প্রসারিত (পৃ ৭৭)। আবার

চি-ম্‌নি ফেটেছে দেখে | গৃহিণী সরোষ,
ঝি বলে ঠাক্‌রুন মোর | নাই কোনো দোষ।

এখানে চিম্ প্রসারিত এবং ঠাক্ সংকুচিত।

তব চিত্তগগনের | দুর দিক্‌সীমা।

এবং

মনের আকাশে তার | দিক্‌সীমানা বেয়ে।

প্রথম দিক্ ধ্বনিটা প্রসারিত ও দুইকলা-পরিমিত; দ্বিতীয়টা সংকুচিত ও এককলা-পরিমিত (পৃ ৮০)।

 যুগ্মধ্বনির এই সংকোচন প্রসারণের ফলেই অক্ষরসংখ্যার হিসাবে এই ছন্দের পরিমাপ সম্ভব নয়। উপরের চারটি দৃষ্টান্তের প্রত্যেক পংক্তির কলামাত্রার সংখ্যা চোদ্দ; কিন্তু অক্ষরমাত্রা স্বীকার করলে মাত্রার সমতা পাওয়া যাবে না।

 বিশিষ্ট কলামাত্রার ছন্দে যুগ্মধ্বনির সংকোচন ও প্রসারণ দুই-ই চলে একই সঙ্গে। তবে তাতে প্রসারণের চেয়ে সংকোচনের প্রবণতাই বেশি। এই সংকোচনক্ষমতাই এর বিশিষ্টতা। আর এই সংকোচনক্ষমতাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘শোষণশক্তি’ (পৃ ৩৮)। ফলে এ ছন্দেৱ নির্দিষ্ট পংক্তিসীমার মধ্যে সাধারণ কলামাত্রার তুলনায় অনেক বেশি যুগ্মধ্বনির স্থান দেওয়া যায়। প্রয়োজনমতো নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বহুসংখ্যক যুগ্মধ্বনিকে ধারণ করবার এই যে শক্তি, তাকে বলা হয়েছে ‘ভারবহনশক্তি’ (পৃ ১২৯), আর এজন্যই এ ছন্দকে বলা হয়েছে ‘গুরুভারবহ’ ছন্দ (পৃ ৬৯)।

 বাংলা ছন্দে পংক্তির শেষপর্ব অনেক সময়ই অপূর্ণ থাকে। অর্থাৎ ওই পর্বে নির্দিষ্টসংখ্যক ধ্বনিমাত্রা না বসিয়ে এক বা একাধিক মাত্রার অবকাশ রেখে দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ অনেক সময়ই এই অবকাশের মাত্রাসংখ্যাকে হিসাবের মধ্যে ধরেছেন এবং তাকে বলেছেন ‘অনুচ্চারিত মাত্রা’ বা ‘যতির মাত্রা’ (পৃ ৪১, ৪৬)। পয়ারে প্রতিপংক্তিতে চার পর্ব (বা পদক্ষেপ, পৃ ৩৫), প্রতিপর্বে চার মাত্রা, শেষপর্বে উচ্চারিত মাত্রা দুই, অনুচ্চারিত বা যতির মাত্রা দুই। এই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের হিসাব। যদি পর্ববিভাগের কথা না বলে একেবারে পদবিভাগের কথা বলা হয় তবে বলতে হয় পয়ারের প্রতিপংক্তিতে দুই পদ (বা পদক্ষেপ, পৃ ৪১); প্রথম পদে আট মাত্রা, দ্বিতীয় পদেও তাই, দুটি অনুচ্চারিত বা যতির মাত্রা নিয়ে (পৃ ১০, ৭১)।

মহাভারতে-র্ কথা | অমৃতসমা-ন্ - -।
কাশীরা-ম্ দা-স্ কহে | শুনে পুণ্যবান্ - -।

তের্ মান্ রাম্ দাস্ বান্, এই যুগ্মধ্বনিগুলি উচ্চারণের ‘টানে’ প্রসারিত হয়েছে। এগুলি সবই দুইমাত্রা-পরিমিত। কিন্তু মান্ এবং বান্ এই দুটির পরে আরও দুটি অনুচ্চারিত মাত্রা বা যতিমাত্রা ধরা হয়েছে। সুতরাং মান্ ও বান্ এই দুটি যুগ্মধ্বনি টান ও যতির সাহায্যে চার মাত্রায় পরিণত হয়েছে বলা চলে (পৃ ১৯৩)। সব সময়ই যে যতিমাত্রাকে হিসাবের মধ্যে ধরা হয় তা নয়। যতিমাত্রার কথা হিসাবে না এনে কোনো কোনো স্থলে শুধু আট এবং ছয় অক্ষরমাত্রার যোগেই পয়ারের প্রকৃত রূপ ধরা হয়েছে (পৃ ৬৯, ১৪৩, ১৫৭)।

 মাত্রাবৃত্ত (পৃ ১৮১) — বাংলা ছন্দের তিনটি শাখার (পৃ ১৩২) অন্যতম শাখার প্রচলিত পারিভাষিক নাম ‘মাত্রাবৃত্ত’। সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছন্দের প্রধান শাখা দুটি, তার মধ্যে একটির নাম মাত্রাবৃত্ত। এই প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত থেকেই বাংলা মাত্রাবৃত্তের উৎপত্তি হয়েছে। মাত্রাবৃত্ত নামটি অমিত্রাক্ষর নামের ন্যায় রূঢ়ার্থে গ্রহণীয়। কেননা ব্যুৎপত্তিগত সাধারণ অর্থে সমস্ত ছন্দই মাত্রাসাপেক্ষ। যে শ্রেণীর ছন্দকে বলা হয়েছে সাধারণ কলামাত্রার ছন্দ, তারই যোগরূঢ় পারিভাষিক নাম মাত্রাবৃত্ত। দ্রষ্টব্য ‘শাখা’।

 বাংলা মাত্রাবৃত্ত রীতির দুই রূপ, প্রাচীন ও আধুনিক। প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত রীতির আদর্শ পাওয়া যায় জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের ছন্দে। তাই এই রীতিকে বলা যায় জয়দেবী (পৃ ২০০)। আধুনিক মাত্রাবৃত্ত রীতির প্রবতর্ক রবীন্দ্রনাথ। মানসী কাব্য তার উৎসস্থল।

 প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত রীতিতে দীর্ঘস্বর (আ, ঈ, উ, এ, ও) এবং রুদ্ধদল (ঐ— অই্, ঔ— অউ্, বং, দুঃ, ছন্, দস্, বিদ্, দ্বান্) দুই কলামাত্রা বলে গণিত হয়। এই হিসাবে প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত পদ্ধতির ছন্দে প্রতিপর্বে চার, পাঁচ, ছয় বা সাত কলামাত্রা থাকতে পারে। এই গ্রন্থে জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে চারটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত হয়েছে, চারকলা-পর্বের দুটি এবং পাঁচকলা-পর্বের দুটি—

হরিরিহ | বিহরতি | সরসব | সন্তে।[]

এই পংক্তিটিতে (প্রথম সর্গ, তৃতীয় গীত) আছে চার পর্ব এবং প্রতিপর্বে চার কলামাত্রা (পৃ ৩৯)। চারকলা-পর্বের দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি (প্রথম সর্গ, তৃতীয় গীত) এই।—

ললিতল | বঙ্গল | তাপরি | শীলন | কোমল | মলয়স | মীরে।

গ্রন্থমধ্যে এটি অংশত উদ্ধৃত হয়েছে (পৃ ১৯৭)। পূর্ণরূপে এর প্রতিপংক্তিতে সাত পর্ব। প্রথমটির বাংলা প্রতিরূপ এই (পৃ ২০০)—

হেসে | হেসে | হল যে | অস্থির।

দ্বিতীয়টির বাংলা প্রতিরূপ সুপরিচিত (পৃ ১৯৯—২০১)।—

জনগণ | মনঅধি | নায়ক | জয় হে | ভারত | ভাগ্যবি | ধাতা।

পাঁচকলা-পর্বের দৃষ্টান্ত এই (পৃ ৪০)।—

অহহ কল | য়ামি বল | য়াদিমণি | ভূষণম্।

এটির (সপ্তম সর্গ, প্রথম গীত) প্রতিপংক্তিতে চার পর্ব। সাত পর্বের দৃষ্টান্ত আছে গীতগোবিন্দ কাব্যের দশম সর্গে। তার প্রথম পংক্তিটি এই (পৃ ১৫-১৬, ১২৬, ১৯৭)।—

বদসি যদি | কিঞ্চিদপি | দন্তরুচি | কৌমুদী |
হরতি দর | তিমিরমতি | ঘোরম্।

শেষপর্বে এক কলা কম আছে। প্রাচীন রীতিতে রচিত পাঁচকলা-পর্ব ছন্দের আধুনিক বাংলা প্রতিরূপ এই গ্রন্থে নেই, রবীন্দ্রসাহিত্যেও নেই।

 আর্যা ছন্দও মাত্রাবৃত্ত এবং মূলত চতুর্মাত্রপর্বিক (পৃ ২৩৪)। প্রাকৃতেও এই ছন্দের বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রে এ ছন্দকে বলা হয় গাহা অর্থাৎ গাথা।

 এই গ্রন্থে যে কয়টি প্রাকৃত ছন্দের উল্লেখ আছে সেগুলি সবই মাত্রাবৃত্তবর্গীয়। তার মধ্যে মালা ছন্দের (পৃ ১৫৭) দ্বিতীয়ার্ধ গাথার অর্থাৎ আর্যার অবিকল অনুরূপ (পৃ ২৩৪), সুতরাং চতুর্মাত্রপর্বিক। এ ছন্দের প্রথমার্ধের প্রথম ছত্রিশ কলার পর্ববিভাগ অনিয়মিত, অর্থাৎ এই অংশটিকে সুনিরূপিত পর্বে পর্বে বিভক্ত করা আবশ্যিক নয়। মাত্রাবৃত্তের মাত্রাসংখ্যাই সাধারণত নির্দিষ্ট থাকে, অক্ষরসংখ্যা থাকে অনির্দিষ্ট। মালা ছন্দের দ্বিতীয়ার্ধ সম্বন্ধে এ নিয়ম প্রযোজ্য, প্রথমার্ধ সম্বন্ধে নয়। প্রথমার্ধে অক্ষরসংখ্যা (একচল্লিশ) এবং মাত্রাসংখ্যা (পঁয়তাল্লিশ), দুই-ই নির্দিষ্ট আছে।

 গগনাঙ্গ ছন্দও মাত্রাবৃত্তবর্গের অন্তর্গত। অথচ এরও প্রতিপাদে অক্ষরসংখ্যা (কুড়ি) এবং মাত্রাসংখ্যা (পঁচিশ) নির্দিষ্ট আছে (পৃ ২৩৬)। এর প্রথমে থাকে একটি চার কলামাত্রার পর্ব। বাকি একুশ কলাকে চারকলার পর্বে বা পাঁচকলার পর্বে যেভাবে ইচ্ছা বিন্যস্ত করা চলে, কেবল পাদের মোট অক্ষরসংখ্যা ঠিক থাকা চাই এবং শেষ দুটি অক্ষর লঘুগুরুক্রমে বিন্যস্ত হওয়া চাই। গ্রন্থমধ্যে উদ্ধৃত দৃষ্টান্তটি চারকলার পর্বে বিভাজ্য (পৃ ২৩৬)। কিন্তু এটির তৃতীয় পাদে কিছু ত্রুটি আছে। ‘খুরাসাণ’ পাঠে চারকলার প্রথম পর্বটিই পাওয় যায় না। রস্তুত প্রাকৃতপৈঙ্গলের চারটি পাণ্ডুলিপিতে এবং দুইটি টীকায় পাঠ আছে ‘খুরসাণ’। বলা বাহুল্য ছন্দের প্রয়োজনে এই পাঠই গ্রহণীয়। পক্ষান্তরে ‘মুহিম লংঘিঅ’ অংশে এক কলার অভাব দেখা যায়। ‘মোহিঅ’ বা অনুরূপ কোনো পাঠ ধরলেই কোনো ত্রুটি থাকত না। কিন্তু পাঠান্তর বা টীকাগুলিতে এই ত্রুটি পুরণের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

 দণ্ডকল ছন্দও মূলত চতুষ্কলপর্বিক বলে মনে হয় (পৃ ২৪৫)। এই ছন্দটি প্রায় সর্বাংশেই জয়দেবের ‘ললিতলবঙ্গলতা’ বা ‘মুখরমধীরং ত্যজ মঞ্জীরং’ ইত্যাদি রচনার অনুরূপ। পার্থক্য শুধু এই যে, দণ্ডকল ছন্দের প্রথমে থাকে একটি দুইকলার অতিপর্ব এবং সর্বশেষে একটি অতিরিক্ত গুরুধ্বনি।

 ঝুল্লণা ছন্দ মূলত পঞ্চকলপর্বিক (পৃ ২৪০) জয়দেবের ‘বদসি যদি কিঞ্চিদপি’ ইত্যাদি রচনার শেষ অংশে অতিরিক্ত তিন ফলা যোগ করলেই ঝুল্লণা ছন্দ হয়।

 প্রাচীন বা আধুনিক বাংলায় আর্যা, মালা, গগনাঙ্গ প্রভৃতি ছন্দের প্রতিরূপ দেখা যায় না। কিন্তু জয়দেবী ছন্দের প্রাচীন ও আধুনিক অনুকৃতি প্রচুর আছে। জয়দেবের মাত্রাবৃত্ত ছন্দ অনেকাংশে স্বাধীন; সংস্কৃত বা প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রের নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন নয়। প্রাচীন ও আধুনিক বাংলা মাত্রাবৃত্ত রীতির ছন্দ এই স্বাধীন জয়দেবী রীতির আদর্শেই গঠিত হয়েছে। এই গ্রন্থে বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে তিনটি প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত ছন্দের দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত হয়েছে, একটি চতুষ্কলপর্বিক এবং ছুটি ষট্‌কলপর্বিক। চারকলা-পর্বের দৃষ্টান্ত এই (পৃ ৫)।—

সুন্দরি | রাধে | আওয়ে ব | নি-।
ব্রজরম | ণীগণ | মুকুটম | ণি−।

—গোবিন্দদাস, পদকল্পতরু, ২৭০ 

জয়দেবী রীতি অনুসারে এখানে রুদ্ধদল এবং দীর্ঘস্বরান্ত মুক্তদল দ্বিমাত্রক এবং হ্রস্বস্বরান্ত মুক্তদল একমাত্রক বলে স্বীকৃত হয়েছে। ব্যতিক্রম ঘটেছে ‘আওয়ে’ শব্দে। ‘ওয়ে’র উচ্চারণ we বা वे। এটি দীর্ঘস্বরান্ত হলেও তার উচ্চারণ হ্রস্ব। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে জয়দেবী রীতির এ-রকম ব্যতিক্রম এত দেখা যায় যে, এইজাতীয় মাত্রাবৃত্তকে ‘ভাঙা জয়দেবী’ বলেও পরিচিত করা চলে।

 ‘শরদচন্দ পবনমন্দ’ এবং ‘মন্দপবন কুঞ্জভবন’ ইত্যাদি রচনা দুটি (পৃ ৩৫, ১৭২) ছয়কলা-পর্বের দৃষ্টান্ত। এ-দুটির মাত্রাগণনাপদ্ধতি উপরের দৃষ্টান্তটির অনুরূপ। সুতরাং বিশ্লেষণ অনাবশ্যক। বলা প্রয়োজন যে, গীতগোবিন্দ কাব্যে এ-রকম ছয়কলা-পর্বের দৃষ্টান্ত নেই।

 বৈষ্ণব পদাবলীর প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে আ ঈ প্রভৃতি দীর্ঘস্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ রক্ষার প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু এ-রকম দীর্ঘতা বাংলার স্বভাবিক উচ্চারণ-বিরোধী। এইজন্যই পদাবলী সাহিত্যে এ বিষয়ে এত ঘন ঘন স্খলনও দেখা যায়। তথাপি পদাবলীতে যে জয়দেবী পদ্ধতিতে স্বরবর্ণের দীর্ঘতা বহুলপরিমাণে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল তার কারণ ওগুলি গান। গানের সুরে স্বরবর্ণের দীর্ঘতা অস্বাভাবিক বলে বোধ হয় না; কিন্তু পঠনীয় কবিতায় ভাষার স্বাভাবিক উচ্চারণ-সম্মত বাক্‌ছন্দকে মেনে চলতে হয়। এইজন্য আধুনিক কালের পঠনীয় কবিতায় জয়দেবী মাত্রাবৃত্ত রীতি একেবারেই পরিত্যক্ত হয়েছে। আর এইজন্যই জয়দেবী মাত্রাবৃত্তের পুনঃপ্রবর্তনও এখন আর সম্ভব নয় (পৃ ২০১-০২)। কেননা তা হবে বাংলা ভাষার ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ সুতরাং ‘কৃত্রিম’; তথাপি এই কৃত্রিমতাকেই যদি চালাতে চেষ্টা করা হয় তবে রবীন্দ্রনাথ়ের মতে সেটা হবে ‘জবরদস্তি’ বা ‘অত্যাচার’ (পৃ ২০০)। অবশ্য তিনি নিজেও কয়েকটি রচনায় জয়দেবী মাত্রাবৃত্ত রীতির আশ্রয় নিয়েছেন, যেমন জনগণমনঅধিনায়ক। কিন্তু সেগুলি গান। জয়দেবী রীতির ছন্দে সর্বভারতীয়তার স্বাদ আছে। জনগণমন গানটিকে সর্বভারতীয় রূপ দেবার প্রয়োজন ছিল। তাই এটিতে জয়দেবী রীতির ছন্দ তথা বহুলপরিমাণ সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে (পৃ ২০০)।

 আধুনিক কালের পঠনীয় কবিতায় জয়দেবী মাত্রাবৃত্ত রীতি পরিত্যক্ত হল বটে, কিন্তু মাত্রাবৃত্তসুলভ সংগীতমাধুর্য থেকেও বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হল। এই অভাবটা রবীন্দ্রনাথের শ্রুতিরসবোধকে পীড়া দিচ্ছিল। তাই তিনি মানসী কাব্য রচনার সময়ে (১৮৮৭-৯০) এক নূতন মাত্রাবৃত্তরীতির প্রবর্তন করেন (পৃ ২১৪ এবং পাদটীকা ৩)। এই নূতন রীতিকে বলা যায় রাবীন্দ্রিক মাত্রাবৃত্ত। এই হিসাবে বাংলা ছন্দের ইতিহাসে গীতগোবিন্দ কাব্যের পাশেই মানসীর স্থান।

 রাবীন্দ্রিক মাত্রাবৃত্ত রীতির বৈশিষ্ট্য এই যে, এই রীতিতে যুগ্মধ্বনি বা রুদ্ধদল দ্বিমাত্রক বলেই স্বীকৃত হয় কিন্তু আ ঈ প্রভৃতি দীর্ঘ স্বরের দীর্ঘতা স্বীকৃত হয় না, বাংলার স্বাভাবিক উচ্চারণ অনুসারে হ্রস্বদীর্ঘনির্বিশেষে সমস্ত স্বরান্ত বর্ণ ই একমাত্রক বলে গণ্য হয় (পৃ ১৮১)। কিন্তু ঋকারের ব্যবহার নিয়ে একটু দ্বিধা দেখা যায় (পৃ ১৮৫)। কারণ ঋকারের আধুনিক উচ্চারণে তার স্বরবর্ণত্ব লোপ পেয়েছে। বাংলায় এটির উচ্চারণ হয়েছে রি। ফলে ‘তৃণ’কে আমরা বলি ত্রিণ। তা সত্ত্বেও ঋকারের স্বরবর্ণত্ব স্বীকারের একটি প্রয়াস দেখা যায় আধুনিক উচ্চারণে; ছন্দ-পাঠ এবং -রচনার ক্ষেত্রেও এই প্রয়াসের ক্রিয়া সুস্পষ্ট। প্রকৃত ও প্রক্রিয়া তথা বিকৃত ও বিক্রীত শব্দের তুলনা করলেই তা বোঝা যাবে। আধুনিক বাংলা উচ্চারণে বিক্রীত=বিক্‌ক্রিত আর বিকৃত=বি • ক্রিত। এভাবে লঘুপ্রযত্ন উচ্চারণের দ্বারা ব্যজ্ঞনসংঘাত বাঁচিয়ে ঋকারান্ত বর্ণের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা হয়। তাতে জাত বাঁচে বটে কিন্তু ঋকারের স্বরবর্ণত্ব বজায় থাকে না, এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সর্বত্র জাত বাঁচানোও যায় না। দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। গীতগোবিন্দে (চতুর্থ সর্গ, দ্বিতীয় গীত) আছে—

সরসম | সৃণমপি | মলয়জ | পঙ্কম্।

এখানে ‘মসৃণ’ শব্দের উচ্চারণটাও মসৃণ অর্থাৎ লঘুপ্রযত্নকৃত। রবীন্দ্ররচনাতেও এই মসৃণ উচ্চারণ দেখা যায়। যথা—

সন্ধ্যাবেলার | মসৃণ অন্ধ | কারে
এখানে সেখানে | চোখে আলো খোঁচা | মারে।

—প্রহাসিনী, গরঠিকানী

উভয়ত্রই মসৃণ শব্দের উচ্চারণ ম• স্রিণ, অর্থাৎ ব্যঞ্জনসংঘাতহীন। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের রচনাতে এই শব্দটির রেশ অমসৃণ উচ্চারণই দেখা যায়।—

মসৃণ দেহ | উচ্চ ককুদ্ | উদ্ধত বল | বান্।

—তীর্থসলিল, বৈরাগ্যোদয়

এখানে মসৃণ শব্দের উচ্চারণ মস্‌স্রিণ। মসৃণ শব্দের অভীষ্ট ব্যঞ্জনসংঘাতই এখানে ছন্দকে তরঙ্গায়িত করে তুলেছে। তাতে ছন্দের গৌরবই বেড়েছে।

অমৃত, সরীসৃপ, রাজগৃহ, অনাদৃত প্রভৃতি শব্দেরও এ-রকম বৈকল্পিক ব্যবহার দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ এ সব স্থলে ঋকারান্ত বর্ণের লঘুপ্রযত্ন উচ্চারণেরই পক্ষপাতী। যথা—

ধরহ রাগিণী | বিশ্বপ্লাবিনী | অমৃতউৎস | ধারা | ..
সরীসৃপগতি | মিলিল তাহারা | নিষ্ঠুর অভি | মানে।..
রাজগৃহ যত | ভূতলশয়ান | পড়ে আছে ঠাঁই | ঠাঁই।

—সোনার তরী, পুরস্কার 

হেমচন্দ্রের দশমহাবিদ্যায় (মহাদেবের বিলাপ) আছে—

জলনিধি | মন্থনে | অমৃত | উছলিল |
যত সুর | বাঁ-টিল | তা-হে-।

এখানে লঘুপ্রযত্ন উচ্চারণের দ্বারা মৃ ধ্বনিটির স্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হয় নি, ফলে ব্যঞ্জনসংঘাতও বাঁচানো হয় নি। বাংলা সাহিত্যে অমৃত শব্দের এ-রকম প্রয়োগ বিরল নয়।

নিঠুর পীড়নে যার
তন্দ্রাবিহীন কঠিন দণ্ডে মথিছে অন্ধকার
তুলিছে আলোড়ি | অমৃত জ্যোতি | তাঁহারে নমস্ | কার।

—বীথিকা, নমস্কার

এখানে অমৃত শব্দকে অম্‌ম্রিত রূপে উচ্চারণ করা যেতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্যে অমৃত শব্দের এ-রকম প্রয়োগ দেখা যায় না। সুতরাং অমৃত এবং জ্যোতি শব্দের মধ্যে ব্যঞ্জনসংঘাত স্বীকার করে নেওয়া অর্থাৎ অমৃতজ্‌জ্যোতি উচ্চারণই কবির অভিপ্রেত ছিল বলে ধরতে হবে। নিভৃত, প্রকৃত প্রভৃতি শব্দেও ব্যঞ্জনসংঘাত বর্জনীয় | যথা—

যকৃৎ যদি বিকৃত হয়
স্বীকৃত হবে, কিসের ভয়,
না হয় হবে পেটের গোলযোগ।

—প্রহাসিনী, ভোজনবীর

কিন্তু পিতৃ, মাতৃ, ভ্রাতৃ, নেতৃ প্রভৃতি শব্দে ব্যঞ্জনসংঘাত মেনে নেওয়াই প্রচলিত রীতি, এমন কি রবীন্দ্রসাহিত্যেও। যথা—

‘আমরা হইলাম | পিতৃহারা’, | কাঁদিয়া কহে দশ | দিক্,
‘সকল জগতের | বন্ধু যাঁরা | তাঁদের শত্রুরে | ধিক্’।

—কথা, মস্তকবিক্রয় 

মাতৃভূমির লাগি | পাড়া ঘুরে মরেছে,
একশো টিকিট বিলি | নিজ হাতে করেছে।

—খাপছাড়া, ৩৫ 

এখানে পিতৃ ও মাতৃ শব্দের উচ্চারণ যথাক্রমে পিত্রি ও মাত্রি। বাংলা ছন্দের রাজ্যে নেতৃত্ব ও নেত্রীত্ব অভিন্ন। কারণ বাংলা উচ্চারণে নেতৃ ও নেত্রী দুএরই উচ্চারণ নেত্রি।

 বলা প্রয়োজন যে, রাবীন্দ্রিক মাত্রাবৃত্ত অর্থাৎ সরল কলামাত্রিক রীতির ছন্দেই ঋকারান্ত বর্ণের এই দ্বিবিধ প্রয়োগ চলে। বিশিষ্ট কলামাত্রিক বা দলমাত্রিক রীতির ছন্দে ঋকারান্ত বর্ণের বৈকল্পিকতা স্বীকার নিষ্প্রয়োজন। চিত্রা কাব্যের ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ কবিতায় আছে—

মর্ত্যভূমি স্বর্গ নহে,
সে যে মাতৃভূমি,···স্বর্গে তব বহুক অমৃত।

এখানে মাতৃ ও অমৃত শব্দের উচ্চারণ লঘুপ্রযত্ন কি না সে বিচার অনাবশ্যক। বলা বাহুল্য এটা বিশিষ্ট কলামাত্রিক রীতির ছন্দ। সত্যেন্দ্রনাথের তীর্থসলিল কাব্যের স্বদেশ বন্দনা কবিতায় আছে—

স্বদেশ, আমার মাতৃভূমি,
স্বাধীনচেতার ধাত্রী তুমি,
সবে গাহি তোমার জয়-গান।

এখানে মাতৃ ও ধাত্রী শব্দ সমগোত্র ও সমমাত্রক; উভয়ত্রই ব্যঞ্জনসংঘাত সুস্পষ্ট। বলা বাহুল্য এটা দলমাত্রিক রীতির ছন্দ। ‘মাতৃভূমি’কে ‘মাত্রিভূমি’ রূপে উচ্চারণ করলে কোনো রীতির ছন্দেই রসনা ঠোকর খায় না।

 মালঝাঁপ'—পয়ারেরই প্রকারভেদ মাত্র। যে পয়ারবন্ধের প্রথম তিন পর্বে মিল থাকে, প্রাচীন পরিভাষায় তাকেই বলা হয় মালঝাঁপ। রবীন্দ্রনাথ এই নামটি ব্যবহার করেন নি, কিন্তু তার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন (পৃ ১১, ৩৮)। যথা—

বাজে তীর | পড়ে বীর | ধরণীর | পরে।

তিনি মনে করেন, এ ছন্দ ‘যুক্ত-অক্ষরের ভার সয় না’। কিন্তু প্রাচীন বাঙালি কবিরা মালঝাঁপ পয়ারেও যুক্তবর্ণের বোঝা চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য (দ্বিতীয় খণ্ড, কোটালের উৎসব) থেকে একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।—

জয় কালি ভাল ভালি যত ঢালী গাজে।
সেই লম্ফ ভূমিকম্প জগঝম্প বাজে।
ডাকে ঠাট কাট কাট মালসাট মারে।
কম্পমান বর্ধমান বলবান্ ভারে।

এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য ‘ধরিত্রীর চক্ষুনীর’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তের আলোচনা (পৃ ২৬১)।

 মালা (পৃ ১৫৭-৫৮)— যথাস্থানে পাদটীকায় এ ছন্দের পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

 মালিনী (পৃ ১৩৩)—এই সুবিদিত সংস্কৃত ছন্দটির প্রতিপংক্তিতে থাকে পনরটি বর্ণ বা অক্ষর। আট বর্ণের পরে অর্ধযতি এবং বাকি সাত বর্ণের পরে পূর্ণযতি। প্রথম ভাগে শেষ দুটি বর্ণ গুরু, দ্বিতীয় ভাগে দ্বিতীয় ও পঞ্চম বাদে বাকি সব বর্ণ ই গুরু। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, মালিনী ছন্দ আসলে মন্দাক্রান্তারই রকমফের মাত্র। মালিনীর প্রথমাংশ এবং মন্দাক্রান্তার দ্বিতীয়াংশ প্রায় একরূপ; পার্থক্য এই যে, মন্দাক্রান্তার দ্বিতীয়াংশে পাঁচটি লঘুর পরে একটি গুরু কিন্তু মালিনীর প্রথমাংশে ছয়টি লঘুর পরে দুটি গুরু। মালিনীর দ্বিতীয়াংশ এবং মন্দাক্রান্তার তৃতীয়াংশ অবিকল এক। দ্বিজেন্দ্রনাথের পূর্বোদ্ধৃত মন্দাক্রান্তা শ্লোকটিকে মালিনীতে রূপান্তরিত করলেই এই দুই ছন্দের পার্থক্য ও সাদৃশ্য বোঝা সহজ হবে।—

রহ যদি তুমি, টঙ্কা,| না রহে কোন জ্বালা।
কি করিব শিখি’ বিদ্যা, | খালি ভস্মে ঘি ঢালা।
তব দরশন-ইচ্ছা, | কিন্তু-পাথেয় নাস্তি-।
চলিব কি, পদ বাঁধা, | একি দৈবের শাস্তি।

বলা বাহুল্য, ‘কোন’ ‘দরশন’ ‘পদ’ ‘দৈবের’ প্রভৃতি শব্দের শেষ বর্ণটির উচ্চারণ হবে অকারান্ত।

 যতি (পৃ ১৯৭)—ছন্দের ধ্বনিপ্রবাহ অবিচ্ছিন্ন নয়; সৌষম্যসৃষ্টির প্রয়োজনে তাকে কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে সুনিয়মিতভাবে খণ্ডিত করা হয়। ওই খণ্ডনেরই পারিভাষিক নাম যতি। ছেদ, বিরাম, বিরতি প্রভৃতি যতিরই নামান্তর।

 বিরামের গুরুত্বভেদে যতির তারতম্য ঘটে। ‘পদ্যছন্দের প্রধান লক্ষণ পংক্তিসীমানায় বিভক্ত তার কাঠামো। নির্দিষ্টসংখ্যক ধ্বনিগুচ্ছে এক-একটি পংক্তি সম্পূর্ণ। সেই পংক্তিশেষে একটি করে বড়ো যতি’ (পৃ ১৫৩)। পংক্তিসীমায় অবস্থিত এই ‘বড়ে। যতি’কে বলা যায় ‘পুরো যতি’ (পৃ ১০০), অর্থাৎ পূর্ণযতি। উল্লিখিত প্রত্যেক ‘ধ্বনিগুচ্ছ’ অর্থাৎ পর্বের পরেও একটি করে যতি থাকে (পৃ ৬৩, ৭৪, ১৯৩)। এসব যতির গুরুত্ব পূর্ণযতির তুলনায় কম। তাই এ-রকম যতিকে বলা যায় লঘুযতি বা পর্বযতি। আরও এক রকম যতি আছে যার গুরুত্ব পূর্ণযতি ও লঘুযতির মধ্যবর্তী, তাকে বলা যায় ‘আধ। যতি’ (পৃ ১০০) বা অর্ধযতি। আঠার মাত্রার দীর্ঘপয়ারে আট মাত্রার পরে থাকে ‘একটি স্পষ্ট যতি’ (পৃ ১০২) এবং বাকি দশ মাত্রার পরে পূর্ণযতি। চোদ্দ মাত্রার সাধারণ পয়ারেও পংক্তির মাঝখানে অর্থাৎ আট মাত্রার পরে একটি করে যতি থাকে যা লঘুযতির চেয়ে অপেক্ষাকৃত ‘স্পষ্ট’ অথচ যার গুরুত্ব পূর্ণযতির সমান নয় (পৃ ৭০-৭১)। এই অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট যতিকেই বলা যায় অর্ধযতি।

 সাধারণ পয়ারপংক্তির পর্ব বা পদক্ষেপ চারটি (পৃ ৩৫)। যথা—

মহাভার | তের কথা || অমৃত স | মান ৷

পংক্তিশেষে পূর্ণযতি; প্রথম ও তৃতীয় পর্বের পরে লঘুযতি। দ্বিতীয় পর্বের পরবর্তী যতিটি প্রথম ও তৃতীয় যতির চেয়ে স্পষ্টতর অথচ তা পূর্ণযতির সমকক্ষ নয়। এই যতিটিই অর্ধযতি। পূর্ণযতির দ্বারা নির্দিষ্ট ছন্দোবিভাগেরই নাম পংক্তি। তেমনি অর্ধযতির বিভাগই হচ্ছে পদ। পয়ার দ্বিপদী, তার অর্ধর্যতি একটি। ত্রিপদীতে অর্ধযতি দুটি (পৃ ১১৯)। যেমন

যেন ধীর | ধ্রুবতারা ||
কহে কথা | ভাষাহারা ||
জনহীন | সাঁঝে।

কাজেই অর্ধ যতিকে পদযতিও বলা যায়।

 পর্বযতি অপেক্ষাকৃত লঘু, সেজন্যে অনেক সময় পর্বযতির লোপ ঘটানো যায়। অর্থাৎ পর্বযতির নির্দিষ্ট স্থানে না থেমে একেবারে পদযতিতে এসে হাঁফ ছাড়া যায়। দৃষ্টান্ত এই (পৃ ৭০)।—

নিঃস্বতাসংxকোচে দিন || অবসন্ন | হলে।

এখানে প্রথম পর্বের শেষে ধ্বনিপ্রবাহ বিরত হয়নি, অর্থাৎ লঘুযতি লুপ্ত হয়েছে। অর্ধযতির লোপ সাধারণত ঘটে না। সেজন্যে ছন্দের পরিচয়ে অনেক ক্ষেত্রে পর্ববিভাগের কথা না বলে একেবারে পদবিভাগের কথাই উল্লেখ করা হয়। ছন্দের পদবিভাগ পর্ববিভাগের চেয়ে গুরুতর। কিন্তু পর্ববিভাগের কথা মনে না রাখলে ছন্দের সৌষম্যনির্ণয় সম্ভব নয়।

 পদের যেমন পর্ববিভাগ আছে, পর্বেরও তেমনি উপবিভাগ আছে। পর্বের এই উপবিভাগকেই বলা যায় উপপর্ব। লক্ষ্য করলে প্রত্যেক পর্বের মধ্যেই একটি বা দুটি করে ক্ষীণ যতির অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। পর্বের অন্তস্থিত যতির চেয়েও তার মধ্যস্থিত যতি লঘুতর। লঘুতর যতিকে বলা যায় উপযতি। উপযতিই পর্বকে উপপর্বে বিভক্ত করে। উপপর্বের আয়তন দুই মাত্রার কম বা তিন মাত্রার বেশি হয় না। উপপর্বই ক্ষুদ্রতম ছন্দোবিভাগ। এইজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, দুই এবং তিন মাত্রার বিভাগ হচ্ছে সকল ছন্দের মূল (পৃ ১৪২) বা রূঢ়িক উপাদান (পৃ ১২৫)। দুই মাত্রার বিভাগকে বলা হয়েছে সমমাত্রার চলন এবং তিন মাত্রার বিভাগকে বলা হয়েছে অসমমাত্রার চলন (পৃ ৩৫-৩৬)। এখানে চলন মানে উপপর্ব। এই চলন বা উপপর্ব নির্ণীত হয় যে ক্ষীণ বিরতির দ্বারা, তারই নাম উপযতি। যথা—

ফিরে: ফিরে | আঁখি: নীরে | পিছু: পানে | চায়।

এখানে প্রতি পূর্ণপর্বে দুই মাত্রার পরে উপযতি। প্রত্যেক পূর্ণপর্ব দুটি করে দুইমাত্রার উপপর্ব নিয়ে গঠিত। তুলনীয় ‘ধরণীর আঁখিনীর’ ইত্যাদির বিশ্লেষণ (পৃ ৩৮)।

নয়ন: ধারায় | পথ সে: হারায় | চায় সে: পিছন | পানে।

প্রতি পূর্ণপর্ব দুটি করে তিনমাত্রার উপপর্বে বিভক্ত। উপপর্ববিভাগ উপযতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শেষ উপপর্বটি অপূর্ণ।

যতই: চলে | চোখের: জলে | নয়ন: ভরে | ওঠে।

প্রতি পূর্ণপর্বে দুই উপপর্ব। প্রথমটি তিনমাত্রার, দ্বিতীয়টি দুইমাত্রার। এখানেও শেষ উপপর্বটি অপূর্ণ।

 লঘুযতির ন্যায় উপযতিও কখনও কখনও লুপ্ত হয়। দৃষ্টাত্ত পরে দ্রষ্টব্য (পৃ ২৯১)।

 এই গ্রন্থে তারতম্যভেদে যতির পূর্ণ অর্ধ লঘু ও উপ এই চার শ্রেণী প্রত্যক্ষত স্বীকৃত হয়নি। পরোক্ষ স্বীকৃতির প্রমাণ আছে। রবীন্দ্রনাথের ছন্দোবিভাজনপ্রণালী থেকেই সে প্রমাণ পাওয়া যায় পংক্তিশেষের বড়ো যতির কথা স্বতঃস্বীকার্য। পংক্তিমধ্যবর্তী স্পষ্টযতি বা অধর্যতির কথাও আছে এই গ্রন্থে (পৃ ১০২)।—

মন চায় | চলে আসে | কাছে ||
তবুও পা | চলে না।

পংক্তিশেষে পূর্ণযতি। তৃতীয় পর্বটি অপূর্ণ, তার পরেই স্পষ্ট- বা অর্ধ-যতি। আর প্রতিপর্বের পরবর্তী বিভাজনচিহ্ন লঘুযতির সূচক।

নয়নে | নিঠুর | চাহনি ||
হৃদয়ে | করুণা | ঢাকা।

‘ঢাকা’র পরে পূর্ণযতি, ‘চাহনি’র পরে অর্ধযতি। বাকি যতিগুলি উপপর্বের পরিচায়ক, সুতরাং উপযতি (পৃ ১০৩)।

অন্তর তার | কী বলিতে চায় | চঞ্চল চর | ণে।

এখানে উপপর্ববিভাগ দেখানো গেল না, কারণ উপযতিগুলি সবই লুপ্ত হয়েছে। বিভাজনচিহ্নগুলি সবই পর্বযতি বা লঘুযতির পরিচায়ক।

 রবীন্দ্রনাথের মতে বাংলা ছন্দে যতি শুধু ছন্দোবিভাজনের কাজেই লাগে না, তাকে কালব্যাপ্তি দিয়ে মাত্রাপুরণের কাজেও লাগানো হয়। ‘সকল ভাষারই যতি আছে, কিন্তু যতিকে বাটখারাস্বরূপ করে ছন্দের ওজনপূরণ বাংলা ছন্দ ছাড়া আর কোনো ছন্দে আছে কি না জানিনে’ (পৃ ১২৬)। কিন্তু ইংরেজি এবং সংস্কৃত ছন্দেও যতির কালব্যাপ্তি তথা মাত্রাপুরণের কাজ আছে বলে তিনি মনে করতেন। O Goddess ইত্যাদি পংক্তিদুটির বিশ্লেষণে তিনি বিরামমাত্রার অস্তিত্ব ধরে নিয়েছেন (পৃ ৩৯)। এই প্রসঙ্গে One more unfortunate এবং When we two parted ইত্যাদি দৃষ্টান্তদুটির বিশ্লেষণও লক্ষিতব্য (পৃ ১৮)। O Wild West Wind ইত্যাদি দৃষ্টান্তটিতেও সিলেব্‌ল্‌মাত্রা গণনার সঙ্গে যতিমাত্রা গণিত হয়েছে (পৃ ৪৬); বস্তুত এটিতে যতিমাত্রা গণনার অবকাশ নেই। সংস্কৃত ছন্দের মধ্যে ‘বদসি যদি কিঞ্চিদপি’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটিতে দুই যতিমাত্রার অবকাশ দেখানো হয়েছে (পৃ ১২৬); অন্যত্র কিন্তু এক যতিমাত্রাই ধরা হয়েছে (পৃ ১৫-১৬)। বলা বাহুল্য দ্বিতীয়টিই স্বীকার্য।

 বলা সংগত যে, যতিমাত্রার স্বাভাবিক স্থান পংক্তির অন্তে। কখনও কখনও পদের অন্তেও যতিমাত্রা দেখা যায়। যেমন—

পর্ণের পাত্রে- ||
ফাল্গুন রাত্রে- ||
মুকুলিত মল্লিকা মাল্যের বন্ধন।

—গীতবিতান (তৃতীয় সং), পৃ ৫০৫

এভাবে পদের অন্তে যতিমাত্রার অবকাশ রাখার দৃষ্টান্ত সাধারণত দেখা যায় কলামাত্রার ছন্দেই। পর্বের অন্তে এ-রকম অবকাশের দৃষ্টান্ত বিরল।

 রবীন্দ্রনাথের মতে ‘যতিকে কেবল বিরতির স্থান না দিয়ে তাকে পূর্তির কাজে লাগাবার অভ্যাস আরম্ভ হয়েছে আমাদের ছড়ার ছন্দ থেকে’ (পৃ ১২৬)। ছড়ার ছন্দে পর্বে-পর্বে এমন কি উপপর্বে-উপপর্বে মাত্রাপূরণের অবকাশ থেকে যাবার কথা নানা স্থানেই বলা হয়েছে (পৃ ৬২-৬৩)। দ্রষ্টব্য ‘ফাঁক’।

 যুগ্মধ্বনি (পৃ ৫২)— এটি মূলত বর্তমান সম্পাদকের প্রযুক্ত পরিভাষা। ধ্বনি মানে সিলেব্‌ল্ এবং যুগ্মধ্বনি মানে সেই সিলেব্‌ল্‌ যার অন্তে আশ্রিত স্বর বা ব্যঞ্জন অবস্থিত থাকে। যথা— বৈ (=বই্), গৌ (=গউ্), যাও্, ঢং, উঃ, বিদ্, দ্বান্। সুতরাং যুগ্মধ্বনি (closed syllable) এবং যুক্তাক্ষর (compound letter) একার্থক নয়। ‘ছন্দ’ শব্দের ‘ছন্’ যুগ্মধ্বনি, ‘দ’ অযুগ্মধ্বনি; আর ‘ছ’ অযুক্তাক্ষর এবং ‘ন্দ’ যুক্তাক্ষর। ছন্দোবিশ্লেষণে ছন্+দ বিভাগই স্বীকার্য, ছ+ন্দ বিভাগ বর্জনীয়। কারণ সিলেব্‌ল্‌বিভাগই উচ্চারণসম্মত অক্ষরবিভাগ তা নয়। অক্ষর উচ্চারণের অবিকল প্রতিরূপ নয়। বস্তুত বাংলায় অক্ষরগণনা হয় কৃত্রিম লিপিরূপ দেখে। তাই বাংলায় ‘পর্বত’ শব্দে তিন অক্ষর অথচ ‘শরবত’ শব্দে চার অক্ষর গণিত হয়, যদিও উভয় শব্দেই সিলেব্‌ল্‌সংখ্যা দুই। ‘কাশ্মীর’ শব্দে তিন অক্ষর, ‘পশমী’ শব্দেও তাই। অথচ সিলেব্‌ল্‌সংখ্যা উভয়ত্রই দুই।

 যুগ্মধ্বনি শব্দটিকে উল্লিখিত পারিভাষিক অর্থ থেকে ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করবার আশঙ্কা রয়েছে। এই গ্রন্থেও তার নিদর্শন আছে। ‘উদয়’ শব্দে দুই ধ্বনি (syllable), উ+দয়্; উ অযুগ্ম (open) এবং দয়্ যুগ্ম (closed)। ‘দিগন্ত’ শব্দে তিন ধ্বনি, দি+গন্+ত; দি ও ত অযুগ্ম এবং গন্ যুগ্ম। ‘উদয়’এর দয়্ শব্দান্তস্থিত এবং তার উচ্চারণ প্রসারিত, সুতরাং দুই মাত্রা। ‘দিগন্ত’ শব্দের গন্ শব্দমধ্যবর্তী এবং তার উচ্চারণ সংকুচিত, সুতরাং এক মাত্রা। ‘উদয়’ শব্দে অয়্ এবং ‘দিগন্ত’ শব্দে অন্ (পৃ ৫২-৫৩) উচ্চারণসম্মত ধ্বনিবিভাগ অর্থাৎ সিলেব্‌ল্ বলে গণ্য নয়। তা ছাড়া ‘যুগ্মধ্বনি শব্দটার পরিবর্তে ইংরেজি সিলেব্‌ল্ শব্দ ব্যবহার’ (পৃ ৫৩) করাও চলে না; কারণ সিলেব্‌ল্ শব্দ অযুগ্ম ও যুগ্ম উভয় প্রকার ধ্বনিকেই বোঝায়, শুধু যুগ্মধ্বনিকে নয়।

 যুক্তাক্ষর বোঝানো পারিভাষিক যুগ্মধ্বনি শব্দের অভিপ্রেত নয়। কিন্তু এই গ্রন্থের নানা স্থানেই যুগ্মধ্বনি শব্দটি যুক্তাক্ষর অর্থেই গৃহীত হয়েছে।

দুইজনে জুঁই তুলতে যখন
গেলেম বনের ধারে।

ইত্যাদি দৃষ্টান্তটিতে দুই্, জুঁই্, তুল্, খন্, লেম্, নের্ প্রভৃতি আশ্রিতান্ত ধ্বনিকেই বলা হয়েছে যুগ্মধ্বনি (পৃ ৫৬)। এটাই হচ্ছে এই পারিভাষিক শব্দটির অভিপ্রেত। বলা বাহুল্য দুই্, জুঁই্, তুল্ প্রভৃতি যুগ্মধ্বনিগুলি যুক্তাক্ষর নয়। কিন্তু অন্যত্র আছে ‘যুক্ত-অক্ষর অর্থাৎ যুগ্মধ্বনি’ (পৃ ৬৬)। এখানেই সংশয় দেখা দেয়। কেননা কোনো শব্দে যুক্তাক্ষর থাকলেও যুগ্মধ্বনি না থাকতে পারে, আবার যুক্তাক্ষর না থাকলেও যুগ্মধ্বনি থাকতে পারে। ছন্দ শব্দে যুক্তাক্ষর (ন্দ) ও যুগ্মধ্বনি (ছন্) দুই-ই আছে। কিন্তু ক্ষমা ও গ্লানি শব্দে যুক্তাক্ষর (ক্ষ, গ্লা) আছে, যুগ্মধ্বনি নেই। আবার শিউলি ও টোটকা শব্দে যুক্তাক্ষর নেই, কিন্তু যুগ্মধ্বনি (শিউ্, টোট্) আছে। সুতরাং ‘যুক্ত-অক্ষর অর্থাৎ যুগ্মধ্বনি’ কথায় মনে সংশয় জাগে যুগ্মধ্বনি শব্দটি হয়তো পারিভাষিক অর্থে গৃহীত হয়নি। অতঃপর যুক্তধ্বনি (পৃ ৮০), যুক্তবর্ণের ধ্বনি (পৃ ১২২), যুগ্মবর্ণ (পৃ ৬৮) প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ দেখে সন্দেহ থাকে না যুগ্মধ্বনি শব্দটি যুক্তাক্ষর অর্থে ই প্রযুক্ত হয়েছে। অক্ষর ও বর্ণ একার্থক। উভয়েরই একটি অর্থ letter। যথা—নিরক্ষর, বর্ণপরিচয়।

 যুক্তাক্ষর তথা যুক্তবর্ণ বলতে বোঝায় সংযুক্ত letter। রবীন্দ্রনাথ যুগ্মধ্বনি শব্দটিও ওই অর্থেই গ্রহণ করেছেন। তাই যুগ্মধ্বনি, যুক্তধ্বনি, যুগ্মবর্ণ ও যুক্তবর্ণ পরস্পরের প্রতিশব্দরূপে গণ্য হয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি ধ্বনির প্রতিশব্দ হিসাবে স্বর কথাটিকেও অক্ষর, বর্ণ বা letter অর্থে স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই যুক্তাক্ষর অর্থে যুগ্মস্বর কথাটিও ব্যবহৃত হয়েছে (পৃ ৭২-৭৩)। বলা প্রয়োজন যে, যুগ্মস্বর কথাটির পারিভাষিক অর্থ closed vowel বা diphthong (পৃ ১৭১ পাদটীকা ৪ এবং পৃ ১৮১ পাদটীকা ২)। যথা—ঐ (=অই্), ঔ (=অউ্), অও্, ইউ্।

 অযুগ্মধ্বনি ও যুগ্মধ্বনি, এই শব্দদুটি অযুক্তাক্ষর ও যুক্তাক্ষর অর্থে গৃহীত হবার সম্ভাবনা আছে বলে ছন্দের আলোচনায় এ দুটির পরিবর্তে অন্য পরিভাষা গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। অযুগ্মধ্বনি-যুগ্মধ্বনি অপেক্ষা মুক্তদল-রুদ্ধদল নাম দুটি সুষ্ঠুতর। তাতে অর্থগত অনিশ্চয়তা ঘটবার আশঙ্কা থাকে না। তেমনি অযুগ্মস্বর-যুগ্মস্বর না বলে মুক্তস্বর-রুদ্ধস্বর বলাই সংগত। অর্থাৎ অ আ ই উ এ ও প্রভৃতি একক স্বরকে মুক্তস্বর (open vowel) এবং ঐ (=অই্, ওই্), ঔ (=অউ্, ওউ্), অও্, আই্, ইউ্, উই্ প্রভৃতি জোড়াস্বরকে রুদ্ধস্বর (closed vowel) বলা যেতে পারে। দ্রষ্টব্য ‘অক্ষর’, ‘দল’, ‘ধ্বনি’ ও ‘সিলেব্‌ল্।’

 সিলেব্‌ল্‌এর মাত্রা পরিমাণ নির্ণয়-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাংলায় হসন্ত শব্দের পূর্ববর্তী স্বর দীর্ঘ হয়’ অর্থাৎ ‘প্রাক্‌হসন্ত স্বরকে দুই মাত্রার পদবি দেওয়া’ হয় (পৃ ৫৩)। যেমন জ-ল্ ও চাঁ-দ্ শব্দের অ এবং আ দুটি স্বরই দীর্ঘ অর্থাৎ দ্বিমাত্রক। শুধু বাংলায় নয়, সংস্কৃত এবং প্রাকৃতেও তাই। পিঙ্গলাদি সমস্ত প্রাচীন ছান্দসিকের মতেই যুক্তবর্ণের (তথা হস্ বর্ণের) পূর্ববর্তী বর্ণ গুরু অর্থাৎ দ্বিমাত্রক। যেমন— দি-ক্ ও চ-ন্দ্র শব্দের দি ও চ দ্বিমাত্রক। দিক্ শব্দের শুধু ইকার- বা দি-টুকুকে দ্বিমাত্রক বলে গণ্য না করে সমস্ত দিক্ ধ্বনিটাকেই দ্বিমাত্রক বলে গণ্য করা সংগততর, কেননা হসন্ত ক্ অংশটাও ওই দুইমাত্রাপরিমিত কালের মধ্যেই উচ্চারিত হয়। জল শব্দটা ইংরেজি মতে এক সিলেব্‌ল্ বটে, কিন্তু রুদ্ধ (closed) সিলেব্‌ল্; এবং বাংলা কলামাত্রা রীতির ছন্দে এটি দ্বিমাত্রক। কাশীরাম-এর ‘রাম’ও দ্বিমাত্রক। কারণ বিশিষ্ট কলামাত্রার ছন্দে শব্দের অন্তস্থিত রুদ্ধদল দ্বিমাত্রকই হয়। তাই উদয় শব্দের দয়্‌ দ্বিমাত্রক; কিন্তু দিগন্ত শব্দের গন্ একমাত্রক, কারণ এটি শব্দান্তস্থিত নয়। ঐ অর্থাৎ অই্ দ্বিমাত্রক, কিন্তু শুভ্র শব্দের শুভ্ এবং শঙ্খ শব্দের শঙ্ একমাত্রক। এইভাবে হিসাব করলে ‘উদয়দিগন্তে ঐ শুভ্র শঙ্খ বাজে’ এই লাইনটাতে চোদ্দ মাত্রা পাওয়া যাবে, অক্ষরগণনা নিষ্প্রয়োজন—এ কথা বলাই ‘ছন্দোবিৎ’এর অভিপ্রায়। বস্তুত এই লাইনটা নিয়ে কারও কোনো খটকা (পৃ ৫৪) লাগেনি।[] ছন্দোবিশ্লেষণপ্রণালীর পার্থক্যবশতই কবির এই সংশয় দেখা দিয়েছিল।

 ‘বাংলায় হসন্ত শব্দের পূর্ববর্তী স্বর দীর্ঘ হয়,’ এই নিয়মটি সার্বত্রিকও নয়। ‘উদয়দিগন্তে ঐ’ ইত্যাদি লাইনটিতে দয়্ এবং ঐ, এই দুই স্থলে নিয়মটি প্রযোজ্য, কিন্তু গন্, শুভ্ ও শঙ্ এই তিন স্থলে এটি প্রযোজ্য নয়। ‘একটি কথা এতবার হয় কলুষিত’ এই লাইনটিতে (পৃ ৬০) ‘বার্’ এবং ‘হয়্’ এই দুই স্থলে ওই নিয়ম খাটে, কিন্তু ‘একটি’ শব্দে খাটে না। ‘চিমনি ভেঙে গেছে দেখে’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটিতে চিম্‌নি শব্দের প্রয়োগপ্রণালীও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় (পৃ ২৭৬)। ‘মন্‌ বেচারির কি দোষ্ আছে’ (পৃ ১৭০), ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ (পৃ ১৪৩), এইজাতীয় দলমাত্রিক রীতির ছন্দেও সাধারণত ‘প্রাক্‌হসন্ত স্বরকে দুই মাত্রার পদবি’ দেওয়া হয় না।

 লয়—গানে সুর প্রবাহের কালব্যাপ্তিগত গতিসমতার নাম লয় (tempo)। সুরপ্রবাহের গতিবেগের তীব্রতাভেদে লয়কে দ্রুত মধ্য বিলম্বিত প্রভৃতি বিশেষণে নির্দিষ্ট করা হয়। দ্রুত লয়কেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘দুরন্ত’ (পৃ ৩৯)।

 গীতগতির সমতা অর্থাৎ লয় রক্ষার যে ব্যবস্থা, তারই নাম তাল। ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হলেও লয় ও তাল অভিন্ন নয়; তাল লয়ের সহায়ক ও সংরক্ষক। এই গ্রন্থে লয় ও তাল শব্দদুটি সর্বতোভাবে গীতশাস্ত্রানুমোদিত পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।

 এই গ্রন্থের কোনো কোনো উক্তিতে মনে হয় লয় ও তাল একই বস্তু। যেমন, এক জায়গায় আছে, ‘কাব্যে ছন্দের যে কাজ, গানে তালের সেই কাজ’ (পৃ ২১); অন্যত্র আছে, ‘কবিতায় যেটা ছন্দ, সংগীতে সেইটেই লয়’ (পৃ ২৩)। এই দুই উক্তি থেকে তাল ও লয়ের অভিন্নতাবোধই জন্মে। ‘চৌপদীতে কাওয়ালির লয়ে ঝোঁক দিতে হয়’ (পৃ ১২), এই মন্তব্যও উক্ত অনুমানেরই সমর্থক। প্রাকৃত-বাংল। ছন্দকে এক স্থানে বলা হয়েছে ‘তিনমাত্রা লয়ের ছন্দ’ (পৃ ৬৩), তাকেই অন্যত্র বলা হয়েছে ‘তিনমাত্রার তাল’ (পৃ ২১৭)। আবার কোনো কোনো স্থলে লয়-তালের বিরোধও কল্পিত হয়েছে। যেমন, ‘লয়কে যদি মানি তবে তালের সঙ্গে বিবাদ ঘটিলেও ভয় করিবার প্রয়োজন নাই’ (পৃ ২৩), কিংবা ‘লয়ের হিসাব দিলেও তালের হিসাব মেলে না’ (পৃ ২৬)।

 বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ‘লয়’ কথাটিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘স্পন্দন’ (পৃ ৩৩) বা rhythm অর্থে প্রয়োগ করেছেন। ছন্দের এই রিদ্‌ম্‌কে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে ‘ছন্দঃস্পন্দন’ (পৃ ১৪৭)। ছন্দোবদ্ধ রচনার মধ্যে যে ‘প্রাণের স্পন্দন চলতে থাকে, আমাদের চিৎস্পন্দন তার লয়টাকে স্বীকার করে, ঘটতে থাকে গতির সঙ্গে গতির সহযোগিতা বাতাসের হিল্লোলের সঙ্গে সমুদ্রের তরঙ্গের মতো’ (পৃ ১৪৯)। এই স্পন্দন, হিল্লোল বা তরঙ্গই রবীন্দ্রস্বীকৃত অর্থে লয়ের মূলকথা। বেদমন্ত্রে যে ছন্দ প্রথম দেখা দিল, তার ‘ক্রিয়া কেবল জ্ঞানে নয়, তা প্রাণে মনে, স্মৃতির মধ্যে তা চিরকাল স্পন্দিত হয়ে বিরাজ করে। ছন্দের এই গুণ’ (পৃ ১৪৯)। অর্থাৎ স্পন্দন বা রিদ্‌ম্‌ই ছন্দের প্রধান গুণ। এই স্পন্দনগুণ যে-গদ্যরচনার প্রধান বিশিষ্টতা, সেই রিদ্‌মিক প্রোজই (পৃ ২১৮) গদ্যকবিতার বাহন। আর, এইজাতীয় গরচনার স্পন্দনলীলাকে বলা হয়েছে ‘গদ্যছন্দ’।

 এইজন্যই বলা হয়েছে, গদ্যকবিতার “মধ্যে ছন্দ নেই বললে অত্যুক্তি হবে, ছন্দ আছে বললেও সেটাকে বলব স্পর্ধা” (পৃ ২০৫)। এ কথার মানে গদ্যকাব্যে পদ্যের মতো ‘নিশ্চিত ছন্দ’ নেই, আছে তার ‘আভাস’মাত্র (পৃ ১৫২, ২০৫)। অর্থাৎ গদ্যকাব্যে সুনিয়মিত ছন্দ নেই; কিন্তু ছন্দের স্পন্দনলীলাটুকু, তার রিদ্‌ম্‌টুকু আছে। তাকে অন্যত্র বলা হয়েছে ‘ছন্দের গতিলীলা’ (পৃ ১৫২)। আবার রিদ্‌ম্ অর্থে স্পন্দন শব্দের পরিবর্তে ‘ভঙ্গি’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, কারুবিচারে ‘তরঙ্গিত ভঙ্গিটাই বিশেষ আখ্যা পেয়ে থাকে’ (পৃ ৮৩), কিংবা ‘ভঙ্গি নিয়েই ছন্দ’ (পৃ ৮৫)। আর, সঙ্গে সঙ্গে ভঙ্গির পার্থক্যেই লয়ের বিচার করা হয়েছে। এই যে ঢেউখেলানো বা তরঙ্গিত ভঙ্গি, তাকে কখনও বলা হয়েছে গতিভঙ্গি (পৃ ৮৩), কখনও বলা হয়েছে চলনের ভঙ্গি (পৃ ৮৭)। চলন কথার প্রতিশব্দ পদক্ষেপ (পৃ ৩৪)। চলন ও পদক্ষেপ, দুএরই মানে কখনও পর্ব, কখনও উপপর্ব। চলন বা পদক্ষেপের আয়তনভেদে তথা বিভিন্ন আয়তনের সমাবেশভেদে ছন্দে লয়ের অর্থাৎ রিদ্‌ম্‌এর পার্থক্য ঘটে (পৃ ৪২)। এইজন্যই চলন বা পদক্ষেপের ভঙ্গিকে বলা হয়েছে ‘পা-ফেলার লয়’ (পৃ ৬২)।

 চলন বা পদক্ষেপের আয়তন- ও সমাবেশ-গত বৈচিত্র্যের ফলে রিদ্‌ম্ বা লয়ের যে বৈচিত্র্য ঘটে, তার বহু দৃষ্টান্ত আছে ৪২-৪৩ এবং ৮৮-৯১ পৃষ্ঠায়। ‘বিষম মাত্রার লয়’ (পৃ ১৯) কথার দ্বারাও বোঝা যায় পদক্ষেপ- বা চলন-ভঙ্গিরই নামান্তর লয়। এই চলনভঙ্গি বা রিদ্‌ম্ অর্থে লয় শব্দের ন্যায় ‘ছন্দ’ কথাটিরও বহুল প্রয়োগ দেখা যায় এই গ্রন্থে। এটাই স্বাভাবিক, রিদ্‌ম্‌ই ছন্দের প্রাণ। তাই, দুইমাত্রার ছন্দ (পৃ ৩৮) এবং দুইমাত্রার লয় (পৃ ৬৮) মানে একই। তেমনি তিনমাত্রার ছন্দ (পৃ ৬২) ও তিনমাত্রা লয়ের ছন্দ (পৃ ৬৪) অভিন্নার্থক। তাল কথাটিও অনেক স্থলেই ছন্দের স্পন্দনভঙ্গি অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। যাকে বলা হয়েছে তিনমাত্রার ছন্দ বা তিনমাত্রা লয়ের ছন্দ (পৃ ৬২-৬৩) তাকেই অন্যত্র বলা হয়েছে তিনমাত্রার তাল (পৃ ২১৭)। বস্তুত এই সাধারণ অর্থে তাল ও লয় অভিন্ন। কিন্তু তাল শব্দটি যেখানে সংগীতশাস্ত্রের পারিভাষিক অর্থে গৃহীত হয়েছে, সেখানেই তালের সঙ্গে লয়ের ‘বিবাদ’ (পৃ ২৩, ২৬) সম্ভবপর। তালের একএকটি বিভাগই তার চলনভঙ্গির বা লয়ের পরিচায়ক। চিরাগত পারিভাষিক তালের কতকগুলি বাঁধা চলনভঙ্গি আছে। অথচ কাব্য বা গানের ছন্দে নূতন নূতন চলনভঙ্গি বা লয় উদ্ভাবন করা সম্ভবপর। পুরাতন পারিভাষিক তাল এইসব লয়কে মানে না। তাই তালে ও লয়ে বিবাদ ঘটে এবং লয়ের হিসাব পাওয়া গেলেও সাবেক আমলের তালের হিসাব পাওয়া যায় না (পৃ ২৬)।

 শাখা (পৃ ১৩২)—সমস্ত ছন্দেরই প্রাণবস্তু এক, ধ্বনির স্পন্দন অর্থাৎ রিদ্‌ম্। কিন্তু তার প্রকাশ বিভিন্ন, তার লীলা বিচিত্র। ধ্বনিস্পন্দনের এই লীলাবৈচিত্র্যই আমাদের কাছে ছন্দোবৈচিত্র্যরূপে প্রতিভাত হয়। ছন্দশাস্ত্রের কাজ এই বৈচিত্র্যের অন্তর্নিহিত মৌলিক নীতিগুলি আবিষ্কার করা এবং সেগুলির উপরে নির্ভর করে সমস্ত ছন্দকে সুশৃঙ্খলভাবে বিভিন্ন শ্রেণীতে সজ্জিত করা। এই শ্রেণীকেই বলা হয়েছে শাখা।

 ছন্দের শ্রেণীবিভাগ করা যায় নানাভাবে, অর্থাৎ নানা প্রণালী অবলম্বন করে। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আদর্শে বাংলা ছন্দের শ্রেণীবিভাগ করেছেন। প্রথমত তিনি উপপর্বের মাত্রা পরিমাণ অনুসারে সমস্ত ছন্দকে সমমাত্রার, অসমমাত্রার ও বিষমমাত্রার, এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন (পৃ ৩৬)। এ-রকম বিভাগে উপপর্ব রচনার মূলনীতিগুলি অর্থাৎ উপপর্বে মাত্রাসমাবেশের প্রণালীগুলিই অলক্ষিত থেকে যায়। এই বিভাগ উপপর্বের আকৃতিগত; প্রকৃতিগত নয়। ফলে বিভিন্ন প্রকৃতির ছন্দ এক শ্রেণীর অন্তর্গত বলে গণ্য হয়। যেমন—‘নিম্নে যমুনা বহে স্বচ্ছশীতল’ এবং ‘উন্মত্ত যমুনা বহে, আবর্তিত জল’, এই দুটি দৃষ্টান্তই (পৃ ১২৩) সমমাত্রার ছন্দ, যদিও এ দুটির প্রকৃতিগত পার্থক্য প্রচুর। দ্বিতীয়ত রবীন্দ্রনাথ ভাষারীতি অনুসারে সমস্ত ছন্দকে সাধু- বা সংস্কৃত-বাংলার ছন্দ (সাধুছন্দ, পয়ারজাতীয় ছন্দ) এবং চলতি- বা প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ (ছড়ার ছন্দ, লৌকিক ছন্দ), এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। ছন্দের উপরে ভাষারীতির প্রভাব আছে সন্দেহ নেই; কিন্তু ভাষারীতির বিচার ছন্দের শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক নয়। একই ভাষারীতিতে বিভিন্ন প্রকৃতির ছন্দ রচিত হতে পারে এবং একই প্রকৃতির ছন্দ বিভিন্ন ভাষারীতিতে রচনা করা যায়। এই গ্রন্থেও তার দৃষ্টান্ত আছে। যথা——‘বেণীবদ্ধ তরঙ্গিত কোন্ ছন্দ নিয়া’ (পৃ ৬৮), ‘ভ্রূকুটিপ্রচ্ছন্ন চক্ষু কটাক্ষিয়া চায়’ (পৃ ৭০) এবং ‘ছুট্‌ল কেন মহেন্দ্রের আনন্দের ঘোর’ (পৃ ৭৬), এই দৃষ্টান্ত-তিনটির ছন্দোরীতি এক, কিন্তু ভাষারীতি বিভিন্ন—প্রথম দুটি সাধু, তৃতীয়টি চলতি।[] পক্ষান্তরে ‘সন্ধ্যা-আলোর মেঘের ঝালর ঢাকল অন্ধকারে’ (পৃ ৭৬) এবং ‘শুক্লরাতি ঢাক্‌ল মুখ মেঘাবগুণ্ঠনে’ (পৃ ৭৬) একই ভাষারীতিতে রচিত, কিন্তু এ দুটির ছন্দোরীতি এক নয়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, কোনো ছন্দোরীতিতেই অবিমিশ্র সাধু বাংলা চলে না, সর্বদাই সাধু বাংলার সঙ্গে চলতি বাংলার মিশ্রণ ঘটে থাকে। তবে সমস্ত রীতির ছন্দেই বিশুদ্ধ চলতি বাংলা চালানো সম্ভবপর (পৃ ১৩০)। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে রচনা দেখে তার ভাষারীতি নির্ণয় করা যায় না; কিন্তু মাত্রাসমাবেশপ্রণালী দেখে তার ছন্দোরীতি নির্ণয় করা যায়। যেমন—‘দিগ্‌বলয়ে নবশশিলেখা’ (পৃ ৮০) এবং ‘বউ কথা কও, বউ কথা কও, যতই গায় সে পাখি’ (পৃ ৮৩), এ দুটি রচনা দেখে তার ভাষারীতি ঠিক করা যায় না, কিন্তু মাত্রাস্থাপনপদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য করলে ছন্দোরীতি সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকে না। শুধু ভাষা দেখে ছন্দের রীতি নির্ণয় করলে অনেক সময় ভুল করা হবে। যেমন—‘অধীর বাতাস এল সকালে’, ‘নবারুণ চন্দনের তিলকে’ (পৃ ৭৩), ‘শ্রাবণের কালো ছায়া, ‘বর্ষার তমিস্রচ্ছায়া’ (পৃ ১২১), ইত্যাদি রচনার ভাষারীতি দেখে এগুলিকে চলতি বাংলার ছন্দ বললে ভুল করা হবে।  পর্ব বা উপপর্বের মাত্রাস্থাপনরীতি অনুসারে ছন্দের শ্রেণীবিভাগ করলে এইজাতীয় ত্রুটি ঘটে না। এই মাত্রাস্থাপনরীতিকেই বলা যায় ছন্দোরীতি। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছন্দের তিনটি রীতিকেই বলেছেন তিনটি শাখা (পৃ ১৩২)। এই তিন রীতির কথা ‘মাত্রা’ সংজ্ঞার পরিচয় প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। যথা—সিলেব্‌ল্‌মাত্রিক বা দলমাত্রিক রীতি (পৃ ২৭২), সাধারণ কলামাত্রিক বা মাত্রাবৃত্ত রীতি (পৃ.২৭৬, ২৭৮) এবং বিশিষ্ট কলামাত্রিক (প্রচলিত পরিভাষায় অক্ষরবৃত্ত, অক্ষর মাত্রিক বা অক্ষরগোনা) রীতি (পৃ ২৭৬-৭৭)। দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ‘সতত হে নদ তুমি’ ইত্যাদি লাইন-দুটি সুপরিচিত ‘অক্ষরগোনা’ পয়ার (পৃ ১৪২)। অক্ষরগোনা পয়ার মানে অক্ষরমাত্রার (অর্থাৎ বিশিষ্ট কলামাত্রার, পৃ ২৭৩-৭৬) পয়ার। ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ ইত্যাদি লাইন-দুটিও পয়ার; কিন্তু সিলেব্‌ল্‌মাত্রার পয়ার, অক্ষরমাত্রার নয় (পৃ ১৪৩)। ‘নিম্নে যমুনা বহে’ ইত্যাদি লাইন-দুটিও পয়ার (পৃ ১৮১); কিন্তু সাধারণ কলামাত্রার পয়ার, অক্ষরমাত্রারও (অর্থাৎ বিশিষ্ট কলামাত্রারও) নয়, দলমাত্রারও নয়। অর্থাৎ মাত্রাস্থাপনের ত্রিবিধ রীতিভেদে পয়ার ত্রিবিধ—সাধারণ কলামাত্রিক (মাত্রাবৃত্ত), বিশিষ্ট কলামাত্রিক (অক্ষরগোনা) এবং দলমাত্রিক (সিলেব্‌ল্‌গোনা)। পয়ারের ন্যায় ত্রিপদী চৌপদীও ত্রিবিধ।

 পয়ার ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দোবন্ধের তিন রীতির অর্থাৎ বাংলা ছন্দের তিন শাখার নামকরণে প্রচুর মতভেদ দেখা যায়। ছন্দোবদ্ধ কবিতার ভাষার প্রতি লক্ষ্য রেখে রবীন্দ্রনাথ সিলেব্‌ল্- বা দল-মাত্রার ছন্দকে বলেছেন ‘প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ’। এরই নামান্তর ছড়ার ছন্দ বা লৌকিক ছন্দ। অক্ষরমাত্রার অর্থাৎ বিশিষ্ট কলামাত্রার ছন্দকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘সাধুছন্দ’ বা ‘সংস্কৃত-বাংলার ছন্দ’। এরই নামান্তর অক্ষরবৃত্ত। চলতিমিশ্রিত সাধুরীতির ভাষাই এই ছন্দোরীতিয় সাধারণ আশ্রয়। সাধারণ কলামাত্রার ছন্দকে তিনি বিশেষ কোনো নাম দেননি; উৎপত্তির সূত্র ধরে তার পরিচয় দিয়েছেন সংস্কৃত-ভাঙা ছন্দ বলে (পৃ ১৩২)। এরই নামান্তর মাত্রাবৃত্ত। এই ছন্দোরীতি প্রত্যক্ষত সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন হয়নি, হয়েছে প্রাকৃত থেকে। কিন্তু আধুনিক কলামাত্রারীতির প্রবর্তক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং এই রীতি প্রবর্তনের ব্যাপারে তিনি অনেক পরিমাণেই নির্ভর করেছেন গীতগোবিন্দ কাব্যের গানগুলির উপরে। সুতরাং ‘সংস্কৃত-ভাঙা’ পরিচয়টা নিরর্থক বলা যায় না। এই ছন্দোরীতিও সাধারণত চলতিমিশ্রিত সাধু- বা সংস্কৃত-বাংলাতেই রচিত হয়; তবে অমিশ্র প্রাকৃত-বাংলাতেও এই ছন্দোরীতির বহুল প্রয়োগ দেখা যায়।[] এই সাধারণ কলামাত্রিক রীতিরও দুই রূপ (পৃ ২৭৮)। একটি নব্য বা রাবীন্দ্রিক রূপ, মানসী কাব্যে যার প্রথম সার্থক ও ধারাবাহিক প্রয়োগ। আরএকটি রূপ সর্বতোভাবেই সংস্কৃতানুগ, জয়দেবের গীতগোবিন্দের গানগুলিই তার আদর্শ। একে বলা যায় প্রত্ন (archaic) বা জয়দেবী রূপ। এর আধুনিক দৃষ্টান্ত ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ (পৃ ১৯৯-২০০)।

 শার্দুলবিক্রীড়িত (পৃ ২১৩)—এই বিখ্যাত সংস্কৃত ছন্দটির প্রত্যেক পদে অর্থাৎ পংক্তিতে থাকে উনিশ অক্ষর বা বর্ণ। এই উনিশটি অক্ষর আবার দুটি যতিবিভাগে বিভক্ত থাকে; প্রথম যতিবিভাগে বার অক্ষর, দ্বিতীয় যতিবিভাগে সাত অক্ষর। লঘুগুরু হিসাবে এই ছন্দের অক্ষরবিদ্যাস এ-রকম (পৃ ১৪৮)।—

   ৴ ৴ — ৴ — ৴ ৴ ৴ — — — ৴ — — ৴ —
মেঘৈর্মে দু র ম স্ব রং ব ন ভু বঃ | শ্যামাস্ত মাল দ্রুমৈঃ।

এই অসমান যতিবিভাগই শার্দুলবিক্রীড়িত ছন্দকে গদ্যরচনা সুলভ গাম্ভীর্য দান করে। বাংলা অমিত্রাক্ষর ছন্দেরও অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তার যতিবিভাগের অসমতা, আর এই অসমতাই তার গাম্ভীর্যের একটি বড়ো কারণ। যতিবিভাগ অসমান বলে প্রতিবিভাগের মোট মাত্রাপরিমাণও স্বভাবতই অসমান। এইজন্যই রবীন্দ্রনাথ শার্দুলবিক্রীড়িত প্রভৃতি ছন্দকে বলেছেন ‘অসমান মাত্রাভাগের ছন্দ’ (পৃ ১৩৩)।

 শিখরিণী (পৃ ১৩৩-৩৪)— এটিও একটি অসমান মাত্রাভাগের ছন্দ। মন্দাক্রান্তার ন্যায় এটিও অক্ষরের ছন্দ। মন্দাক্রান্তার প্রতিপংক্তি তিনটি যতিভাগে বিভক্ত। কিন্তু শিখরিণীর যতিভাগ দুটি, প্রথম ভাগের অক্ষরসংখ্যা ছয়, দ্বিতীয় ভাগের অক্ষরসংখ্যা এগার। লঘুগুরুক্রমে এই ছন্দের অক্ষরবিন্যাস এ-রকম—

৴ — — — — —| ৴ ৴ ৴ ৴ ৴ — — ৴ ৴ ৴ —

দেখা যাচ্ছে এর প্রথম ভাগে ছয় অক্ষরে এগার মাত্রা, আর দ্বিতীয় ভাগে এগার অক্ষরে চোদ্দ মাত্রা।

 কবি ভারতচন্দ্রের বিখ্যাত নাগাষ্টকং কবিতাটি (রচনাকাল আলুমানিক ১৭৫০ সাল) এই শিখরিণী ছন্দে রচিত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের “ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এই কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে। নাগাষ্টকং শিখরিণী ছন্দে রচিত হলেও এটির কিছু কিছু বিশিষ্টতা আছে। ভারতচন্দ্র নাগাষ্টকংএর অনেক স্থলেই পংক্তিমধ্যে একটি অতিরিক্ত যতি স্থাপন করেছেন এবং সুস্পষ্ট মিল দিয়ে এই যতিটিকে পরিস্ফুট করেছেন। যথা—

৴ — — — — — ৴ ৴ ৴ ৴ ৴ — —  ৴ ৴ ৴ —
ভ ব দ্দেশে শেষে | সু র পু র বিশেষে | ক থ মপি-।...
সমস্তং মে নাগো | গ্রসতি সবিরাগো | হরি হরি-।

এর প্রতিবিভাগের মাত্রাসংখ্যা হচ্ছে যথাক্রমে এগার, নয় এবং পাঁচ। প্রথম এগার মাত্রাও আবার সাত-চার এই দুটি উপবিভাগে এবং নয় মাত্রা পাঁচ-চার উপবিভাগে বিভক্ত। তা ছাড়া, ভারতচন্দ্র দুএক স্থলে শিখরিণীর প্রথম ছয় অক্ষরকে দুই সমান ভাগে বিভক্ত করে তাতেও মিল দিয়েছেন। যথা—

দয়ালো ভূপাল- | দ্বিজকুমুদ জাল- | দ্বিজপতে। ...
কুবর্ণো গোকর্ণঃ | সবিষবদনো | বক্রগমনঃ।

বলা বাহুল্য এর মাত্রাবিভাগ সর্বাংশে পূর্বোদ্ধৃত দুই লাইনের অনুরূপ নয়।

 দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিলাতে পালাতে’ ইত্যাদি কৌতুকরচনাটি (পৃ ১২৩) প্রথম প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকায় ১৮৭৯ সালে রবীন্দ্রনাথের পত্রধারার অন্তর্গত হয়ে। অতঃপর এটি রবীন্দ্রনাথের ‘য়ুরোপপ্রবাসীর পত্র’ নামক গ্রন্থে (১৮৮১) স্থান পায় (পঞ্চম পত্র, পৃ ১০৮)। উভয়ত্রই এটি রবীন্দ্রনাথের কোনো ‘মান্যবন্ধু’র রচনা বলে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাইপ্রবাস’ গ্রন্থ (১৯১৫) থেকে জানা যায় এই কৌতুককবিতাটি দ্বিজেন্দ্রনাথের রচনা। সত্যেন্দ্রনাথের গ্রন্থেও সমগ্র কবিতাটি উদ্ধৃত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় তিন স্থলেই কয়েকটি লাইনে শিখরিণী ছন্দের বিধান রক্ষিত হয়নি। তার প্রথম দুই লাইনেই দুটি ভুল ছিল। যথা— গৌড়ে ও দৌড়ে। এই পাঠে শিখরিণীর বিধান লঙ্ঘিত হয়। ছন্দের ‘প্রকৃতি’ প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ ভুল পাঠই উদ্ধৃত করেছিলেন। বর্তমান সংস্করণে ছন্দের খাতিরে পাঠ ঠিক করে গউড়ে-দউড়ে মুদ্রিত হল।

 দ্বিজেন্দ্রনাথ এই ব্যঙ্গকবিতাটি ভারতচন্দ্রের নাগাষ্টকংএর অনুসরণেই রচনা করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।[] দ্বিজেন্দ্রনাথ ভারতচন্দ্রের মতোই অনেক স্থলে তের অক্ষরের পরে একটি অতিরিক্ত যতি স্বীকার করেছেন, মিল দিয়ে সে যতিকে পরিস্ফুট করেছেন এবং ভারতচন্দ্রের মতো দ্বিবিধ মিলেরই প্রয়োগ করেছেন, যদিও ‘দয়ালো ভূপাল’-জাতীয় মিলের প্রতি তাঁর পক্ষপাত বেশি। তা ছাড়া, দ্বিজেন্দ্রনাথ এক স্থলে ভারতচন্দ্রের মতোই ‘হরি হরি’ কথাটিও ব্যবহার করেছেন। দৃষ্টান্ত দিলেই এ-সব কথার সমর্থন পাওয়া যাবে। যথা—

পিতা মাতা ভ্রাতা | নবশিশু অনাথা | লুট ক’রে,
বিরাজে জাহাজে | মসিমলিন কোর্তা | বুট প’রে।...
সুখ স্বপ্নে আপ্নে | বড় চতুর মানে | হরি হরি-।

এই লাইনগুলির সঙ্গে নাগাষ্টকংএর উদ্ধৃত লাইনগুলির তুলনা করলেই উভয় রচনার সাদৃশ্য নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে। শংকরাচার্যের ‘সৌন্দর্যলহরী’ কাব্যও (পৃ ১৫০) শিখরিণী ছন্দে রচিত। একটু মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এ ছন্দ ভারতচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রনাথ কারও আদর্শ নয়।

 স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যের (১৮৭৫) ‘লজ্জা বলিল’ ইত্যাদি সংস্কৃত-ভাঙা মাত্রাসর্বস্ব শিখরিণী ছন্দের রচনাটিতেও[১০] (পৃ ১৩৩) দ্বিজেন্দ্রনাথ মাত্রাবিভাজনের ব্যাপারে ভারতচন্দ্রেরই অনুসরণ করেছেন। ভারতচন্দ্র ‘ভবদ্দেশে শেষে’ ইত্যাদি অংশে মাত্রাবিভাজন করেছেন এইভাবে।—

সাত+চার | পাঁচ + চার | পাঁচ।

‘লজ্জা বলিল’ ইত্যাদি অংশে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠিক এইভাবেই মাত্রাবিভাজন করেছেন। এত খুঁটিনাটি সাদৃশ্য আকস্মিক নয় বলেই মনে হয়। এই প্রসঙ্গে দেশে-শেষে-বিশেষে এই মিলটার সঙ্গে হবে-তবে-রবে মিলের সাদৃশ্যটাও স্মরণীয়।

 রবীন্দ্রনাথের সামনে নাগাষ্টকংএর আদর্শ ছিল না। তাই তিনি মাত্রাবিভাজনের তথা মিলস্থাপনের ব্যাপারে অন্য আদর্শ গ্রহণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে আরও স্মরণীয় যে, সংস্কৃত-ভাঙা ছন্দ রচনার কাজে দ্বিজেন্দ্রনাথ মেনেছিলেন অক্ষরমাত্রা, আর এই আদর্শে ‘লজ্জা’ শব্দে দুই মাত্রা; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মানতেন কলামাত্রা, এবং কলামাত্রার বিচারে ‘লজ্জ৷’ শব্দে তিন মাত্রা গণনীয়।

 শিখরিণী ছন্দের প্রসঙ্গে স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যের

    
বৃক্ষগণ হেলিত সুশীতল সমীরণে।
    
পুষ্প যত প্রস্ফুটিত পুষ্পময় কাননে।

ইত্যাদি শেষ শ্লোকটির কথাও বলা প্রয়োজন। উক্ত কাব্যের তৃতীয় সংস্করণে (১৯১৪) এই শ্লোকটি সংস্কৃত শিখরিণী ছন্দে রচিত বলে বর্ণিত হয়েছে। বলা বাহুল্য এটি শিখরিণী ছন্দ নয়। এই ভ্রান্ত বর্ণনার দায়িত্ব কার জানি না। স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যের প্রথম সংস্করণেও (১৮৭৫) এই শ্লোকটি ছিল, কিন্তু তার ছন্দপরিচয় দেওয়া ছিল না। আসলে এটি রচিত হয়েছে সংস্কৃত ‘নিশিপালক’ ছন্দে। লঘুগুরুক্রমে এ ছন্দের ধ্বনিবিন্যাস হচ্ছে এ-রকম।—

— ৴ ৴ ৴,— ৴ ৴ ৴,— ৴ ৴ ৴,— ৴ —

 সমমাত্রার ছন্দ (পৃ ১৫)— দুইমাত্রার উপপর্বকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সমচলন বা সমমাত্রার চলন (পৃ ৩৫) এবং সমমাত্রা-চলনের ছন্দকেই তিনি নাম দিয়েছেন সমমাত্রার ছন্দ (পৃ ৩৬-৩৭)। সমমাত্রার চলনকে অন্যত্র বলা হয়েছে সমমাত্রার চাল (পৃ ৭৪) বা দ্বিপদীর চাল (পৃ ১১৮)। আর সমমাত্রার ছন্দকে পরিচয় দিয়েছেন ‘পয়ারজাতীয়’ বলে (পৃ ২১৫); কারণ পয়ারের উপপর্ব গঠিত হয় দুই মাত্রা নিয়ে। এইজন্য পয়ারজাতীয় বা সমমাত্রার ছন্দকে ‘দুইমাত্রার ছন্দ’ নামও দেওয়া হয়েছে (পৃ ৩৮)।

 রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, দুইমাত্রার ছন্দের অর্থাৎ সমমাত্রার ছন্দের একটি অসাধারণ শক্তি বা মহদ্‌গুণ আছে। সে হচ্ছে তার ‘শোষণশক্তি’ (পৃ ৩৮)। একেই অন্যত্র বলা হচ্ছে ‘ভারবহনশক্তি’ (পৃ ১২১)। তাই এ ছন্দের একটি বিশেষণ ‘গুরুভারবহ’ (পৃ ৬৯)। শোষণশক্তি হচ্ছে আসলে সংকোচনশক্তি। যুগ্মধ্বনি অর্থাৎ রুদ্ধদলকে সংকুচিত করে আনবার অসাধারণ শক্তিকেই বলা হয়েছে শোষণশক্তি। যেমন—

সংগীত, তরঙ্গি উঠে | অঙ্গের্ উচ্ছ্বাসে

এখানে সং, রঙ্‌ অঙ্‌ উচ্ এই চারটি রুদ্ধদল সংকুচিত হয়েছে (পৃ ৩৮)। তাই এগুলির মূল্য এক মাত্রা। সংকুচিত না হলে প্রত্যেকটির মূল্য হত দুই মাত্রা। সংস্কৃত ছন্দের নিয়মে ‘চন্দনচর্চিত শব্দটা অক্ষরগণনায় [বস্তুতঃ কলাগণনায়] আট মাত্রা’ (পৃ ১২১)। কিন্তু বাংলা সমমাত্রার ছন্দে অর্থাৎ দুইমাত্রা-উপপর্বের ছন্দে এটা অনেক সময়ই ছয় মাত্রা বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ চন্ ও চর্ দল-দুটি সংকুচিত হয়ে একমাত্রার স্থান নেয়। ফলে ছয় মাত্রার পরিধির মধ্যেই ঠাসাঠাসি করে আট মাত্রার স্থান সংকুলান হয়। যেমন—

চন্দনচর্চিত তার | নীলবর্ণ অঙ্গখানি |
কণ্ঠে শোভে বনপুষ্প | মালা।

এখানে প্রত্যেক পূর্ণ বিভাগে আছে আট মাত্রা এবং প্রত্যেকটিতেই দুটি করে যুগ্মধ্বনি (মানে রুদ্ধদল) সংকুচিত হয়ে এক মাত্রার স্থান পেয়েছে। ‘চন্দনচর্চিত’ ছয় মাত্রা ৷

 ‘কিন্তু দুইমাত্রার ছন্দ মাত্রেরই যে এই রকম অসাধারণ শোষণশক্তি’ তা বলা যায় না (পৃ ৩৮)। উপরের দৃষ্টান্ত-দুটিকেই একটু বদলে দেওয়া যাক।—

সংগীত হিল্লোল | অঙ্গের বায়

এটাও দুইমাত্রার ছন্দ, অর্থাৎ এটাও ‘দুয়ের লয়ে চলে’ (পৃ ৩৯)। অথচ এর শোষণশক্তি নেই, অর্থাৎ এখানে যুগ্মধ্বনি (রুদ্ধদল) সংকুচিত হচ্ছে না।

চন্দনচর্চিত | সুনীল অঙ্গখানি |
কণ্ঠেতে পুষ্পের | মাল্য।

এখানেও প্রতি পূর্ণ বিভাগে আট মাত্রা, কিন্তু এর যুগ্মধ্বনিগুলি প্রসারিত হয়ে দুই মাত্রার স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ হচ্ছে ‘দুর্বল বাহন’ (পৃ ১২১), অর্থাৎ এটা গুরুভারবহ নয়।

 সুতরাং দেখা যাচ্ছে সমমাত্রার অর্থাৎ দুইমাত্রা-উপপর্বের ছন্দের দুই রূপ—প্রসারক ও সংকোচক। এই দুই রূপেরই পারিভাষিক নাম যথাক্রমে ‘সরল কলামাত্রিক’ ও ‘বিশিষ্ট কলামাত্রিক’। এই রূপভেদ আসলে রীতিভেদ, এবং রীতিভেদ হচ্ছে ছন্দের অন্তর্নিহিত প্রকৃতিভেদের পরিচায়ক। রবীন্দ্রনাথের মতে ‘চলনের ভেদেই ছন্দের প্রকৃতিভেদ’ (পৃ ৩৬)। কথাটা অসার্থক নয়, কারণ চলন অর্থাৎ উপপর্বের আয়তনের দ্বারাই ছন্দের রিদ্‌ম্ অর্থাৎ স্পন্দনলীল। নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু মাত্রাস্থাপনের রীতিভেদে উপপর্বেরই প্রকৃতিভেদ ঘটে। সুতরাং ছন্দপ্রকৃতির উপরে চলনভেদের চেয়ে রীতিভেদের প্রভাবই গভীরতর। দ্রষ্টব্য ‘শাখা’।

 এই গ্রন্থে ‘সমমাত্রা’ কথাটি অপারিভাষিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে কোনো কোনে। স্থানে। যেমন—পালামৌ গ্রন্থের গদ্য ‘সমমাত্রায় বিভক্ত নয়’ কিংবা যজুর্বেদের গদ্যমন্ত্রের যে পদবিভাগ তা সমমাত্রার নয় (পৃ ১৫৩)। এখানে সমমাত্রা মানে সমানসংখ্যক-মাত্রাপরিমিত অর্থাৎ সমায়তন।

 অন্যত্র ‘সমমাত্রক ছন্দ’ মানে তরঙ্গভঙ্গিহীন সমতল ছন্দ (পৃ ১৭৩, পাদটীকা ১)। এ রকম মাথায়-সমান লঘুগুরুভেদহীন নিরীহ ও নিস্পন্দ মাত্রাবিন্যাসকেই বলা হয়েছে ‘নখদন্তহীন’ (পৃ ১৭)। গুরুত্বভেদে ধ্বনির অসমতাজাত তরঙ্গলীলাই হচ্ছে ছন্দের প্রাণ। দ্রষ্টব্য ‘লয়’।

 এক স্থলে সমান মাপের মাত্রা এই সাধারণ অর্থেই ‘সমমাত্রা’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে (পৃঃ)।

 সিলেব্‌ল্ (পৃ ৫৩)— বাগ্‌যন্ত্রের একটিমাত্র প্রয়াসে উচ্চারিত শব্দাংশের নাম সিলেব্‌ল্। যেমন— ছন্‌.দ, পুণ্‌.ণ্য.বান্। সিলেব্‌ল্‌এর প্রতিশব্দ হিসাবে ‘দল’ ও ‘ধ্বনি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। এ দুটির মধ্যে ‘দল’ শব্দই সুষ্ঠুতর। দ্রষ্টব্য ‘দল’, ‘ধ্বনি’ ও ‘যুগ্মধ্বনি’।

 রবীন্দ্রনাথ কোনো কোনো স্থলে সিলেব্‌ল্‌এর প্রতিশব্দ হিসাবে ‘মাত্রা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেমন— ‘ঐকমাত্রিক’ মানে monosyllabic (পৃ ২৭১)। পক্ষান্তরে তিনি বাংলা মাত্রা অর্থেও ইংরেজি সিলেব্‌ল্ শব্দ ব্যবহার করেছেন (পৃ ২৭৩)। যেমন—‘মনে পড়ে দুই জনে জুঁই তুলে বাল্যে’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তে দুই্, জুঁই্ প্রভৃতি এক-সিলেব্‌ল্-আত্মক শব্দের দুই কলাকেই তিনি ‘দুই সিলেব্‌ল্-এর টিকিট’ দিয়েছেন।

 স্পন্দন (পৃ ৩৩)— পূর্ণ শব্দ ‘ছন্দঃস্পন্দন’ (পৃ ১৪৭)। মানে ছন্দের তরঙ্গভঙ্গি বা রিদ্‌ম্। এই স্পন্দন পদ্যেও থাকে, গদ্যেও থাকে। পদ্যে এই স্পন্দনের বিভাগ থাকে সুনিয়মিত ও সুপরিমিত, গদ্যে এই বিভাগ অনিয়মিত ও অপরিমিত এবং অননুভূত। কিন্তু যে গদ্য কবিতার বাহনরূপে স্বীকৃত, তার স্পন্দনবিভাগ পদ্যের মতো ‘অতিনিরূপিত’ না হলেও অনুভবগম্যতার সীমার মধ্যে আসে। এই স্পন্দনশীল গদ্যকেই বলা হয় ছন্দোময় গদ্য (rhythmic prose)। কেননা, এই স্পন্দনই ছন্দের প্রাণ। দ্রষ্টব্য ‘লয়’।

 হসন্ত-হলন্ত (পৃ ৫২)— পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণের সাংকেতিক পরিভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণকে বলা হয় হল্। আর বোপদেবের মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের মতে ব্যঞ্জনবর্ণের সাংকেতিক নাম হস্। সুতরাং হসন্ত ও হলন্ত অভিন্নার্থক শব্দ, দুএরই মানে ‘ব্যঞ্জনান্ত’। বাংলাদেশে মুগ্ধবোধেরই চল বেশি। তাই হসন্ত শব্দটিই অধিকতর পরিচিত ও প্রচলিত। এই সুযোগে রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত হলন্ত শব্দটিকে স্বরান্ত অর্থে গ্রহণ করেছেন[১১] (পৃ ৪৯)। পাণিনির পরিভাষায় স্বরান্তকে বলা হয় ‘অজন্ত’।

  1. এই অংশটি প্রধানত কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় -কৃত ‘গীতসূত্রসার’ অবলম্বনে রচিত।
  2. এটাই গানের ছন্দের মূলনিয়ম। কিন্তু অনেক তালে তার ব্যতিক্রম দেখা যায় (কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়-কৃত ‘গীতসূত্রসার’, তৃতীয় সং, পৃ ১৫৫)।
  3. এটি রাজনারায়ণ বসু-কে লিখিত পত্ররূপে রচিত হয়। রচনাটির নাম ছিল ‘দীন দ্বিজের রাজ-দর্শন না ঘটিবার কারণ’। দ্রষ্টব্য সাহিত্যসাধক-চরিতমালা ৬৬ (মাঘ ১৩৫৪), পৃ ৩৯ এবং বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১৩৫৯ বৈশাথ-আষাঢ়, পৃ ১৮১।

     সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাল্যস্মৃতি প্রসঙ্গে এই রচনাটি উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর উদ্ধৃতিতে কয়েকটি পরিবর্তন দেখা যায়। (১) শেষ দুই পদ পূর্বে এবং প্রথম দুই পদ পরে স্থাপিত হয়েছে। (২) ‘কর যদি কৃপা’ হয়েছে ‘করে যদি কৃপা’। এই পরিবর্তনটুকু হয়েছে সম্ভবত অর্থসংগতির খাতিরে, যদিও তাতে ছন্দোগত ত্রুটি ঘটে। (৩) ‘তব দরশনে’ রূপ নিয়েছে ‘জগদরশনে’, সম্ভবত সর্বত্র ব্যবহার্যতার খাতিরে। এই পরিবর্তনগুলি রচয়িতারই কৃত বা অভিপ্রেত বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিতে আছে ‘ভ্রমণগমনে’, এটা রচয়িতার অনুমোদিত কিনা বলা কঠিন। দ্রষ্টব্য সত্যেন্দ্রনাথকৃত ‘আমার বাল্যকথা’—ভারতী, ১৩১৯ ভাদ্র, পৃ ৪৫৪ এবং ‘আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস’ গ্রন্থ (১৯১৫), পৃ ২৮।
  4. বর্ণ ও অক্ষর সমার্থক শব্দ। সুতরাং অক্ষরমাত্রা কথাটার পরিবর্তে বর্ণমাত্রা কথাটাও ব্যবহার করা যেতে পারে।
  5. মূলে আছে, ‘বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে’।
  6. “আমি অবশ্য এ লাইনটিকে কান পেতেও পড়েছি, নিয়ম পেতেও পড়েছি। ... কান পেতে ও-লাইনটিতে কিছুমাত্র ত্রুটি পাইনি এবং নিয়ম পেতেও আমার কিছুমাত্র খটকা লাগেনি।... বরং অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একটি নিখুঁত ও সুন্দর নিদর্শন হিসেবেই আমি অগ্রহায়ণের প্রবন্ধে এই লাইনটি গ্রহণ করেছি।”
    —বিচিত্রা, ১৩৩৮ মাঘ: ছন্দ-জিজ্ঞাসা, ১ম পর্ব: পৃ ১১১
  7. চলতি রীতির ভাষায় সাধুছন্দের অনেক দৃষ্টান্ত আছে পরিশেষ ও পুনশ্চ কাব্যে। যথা—প্রাণ (পরিশেষ) এবং খ্যাতি (পুনশ্চ, দ্বিতীয় সংস্করণ)।
  8. দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রহাসিনী কাব্যের ‘ভাইদ্বিতীয়া’ এবং সানাই কাব্যের ‘সম্পূর্ণ’, এই কবিতা-ছুটি উল্লেখযোগ্য।
  9. দেশ, শারদীয় সংখ্যা ১৩৬১: ছন্দের খেলা: পৃ ২২৩-২৪ দ্রষ্টব্য।
  10. স্বপ্নপ্রয়াণ, প্রথম সং (১৮৭৫), দ্বিতীয় সর্গ, ১২৫; তৃতীয় সং (১৯১৪), দ্বিতীয় সর্গ, ১১৫।
  11. দ্রষ্টব্য বিচিত্রা, ১৩৩৯ ভাদ্র, পৃ ১৬১ এবং আশ্বিন, পৃ ৪২৯।