সাহাজাদপুর
১০ই জুলাই ১৮৯৪।

 ভাল করে ভেবে দেখ্‌লে হাসিপায় যে, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা থাক্‌লেও ইহজীবনে দুটো মানুষে কতটুকু অংশ রেখায় রেখায় সংলগ্ন! যাকে দশ বছর জানি তাকে দশটা বছরের কত সুদীর্ঘ অংশই জানিনে; বোধ করি আজীবন সম্পর্কেরও জমাখরচ হিসাব করলেও তেমন বড় অঙ্ক হাতে থাকে না। সে কথা ভেবে দেখ্‌লে সবাইকেই অপরিচিত বলে বোধ হয়; তখন বুঝতে পারি খুব বেশি পরিচয় হবার কথা নেই, কেননা দুদিন পরে বিচ্ছিন্ন হতেই হবে;—আমাদের পূর্ব্বে কোটি কোটি লোক এই সূর্য্যালোকে নীলাকাশের নীচে জীবনের পান্থশালায় মিলেছে এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে বিস্মৃত হয়ে অপসৃত হয়ে গেছে। এ রকম ভেবে দেখ্‌লে কোনো কোনো প্রকৃতিতে বৈরাগ্যের উদয় হয় কিন্তু আমার ঠিক উল্টোই হয়; আমার আরো বেশি করে দেখ্‌তে বেশি করে জান্‌তে ইচ্ছা করে। এই যে আমরা কয়েকজন প্রাণী জড় মহাসমুদ্রের বুদ্বুদের মত ভেসে একজায়গায় এসে ঠেকেছি, এই অপূর্ব্ব সংযোগটুকুর মধ্যে যত বিস্ময় যত আনন্দ তা আবার শত যুগে গড়ে উঠবে কিনা সন্দেহ। তাই কবি বসন্ত রায় লিখচেন:—

নিমিষে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি।

বাস্তবিক, মানুষের এক নিমেষের মধ্যে শত যুগেরই সংযোগ বিয়োগ ত ঘটে। এবারে চলে আসবার আগে যেদিন একদিন দুপুর বেলায় স—পার্কস্ট্রীটে এসেছিলেন, পিয়ানো বাজ্‌ছিল, আমি গান গাবার উদ্যোগ করছিলুম, হঠাৎ একসময়ে সকলের দিকে চেয়ে আমার মনে হল অনন্তকালের অসীম ঘটনাপরম্পরার মধ্যে এই একটুখানি আশ্চর্য্য ব্যাপার। মনে হল এর মধ্যে যেটুকু সৌন্দর্য্য ও আনন্দ আছে এবং এই যে খোলা জানলা দিয়ে মেঘলা আকাশের আলোটুকু আস্‌চে এ একটা অসাধারণ লাভ। প্রাত্যহিক অভ্যাসের জড়ত্ব একদিন কেন যে একটুখানি ছিঁড়ে যায় জানিনে, তখন যেন সদ্যোজাত হৃদয় দিয়ে আপনাকে, সম্মুখবর্ত্তী দৃশ্যকে, এবং বর্ত্তমান ঘটনাকে অনন্তকালের চিত্রপটের উপরে প্রতিফলিত দেখ্‌তে পাই। অভ্যাসের একটা গুণ আছে যে, চারিদিকের অনেক গুলো জিনিষকে কমিয়ে এনে হাল্কা করে দেয়, বর্ম্মের মত আচ্ছন্ন করে বাইরের অতিশয় সংস্পর্শ থেকে মনকে রক্ষা করে—কিন্তু সেই অভ্যাস আমার মনে তেমন করে এঁটে ধরে না—পুরাতনকে বারবার নূতনের মতই দেখি—সেই জন্যে অন্য লোকের সঙ্গে ক্রমশ আমার মনের Perspective আলাদা হয়ে যায়—ভয়ে ভয়ে পরীক্ষা করে দেখ্‌তে হয় কে কোন্‌খানে আছি!