শিলাইদা, 
৫ই আগষ্ট, ১৮৯৪।

 কাল সমস্ত রাত্রি খুব অজস্রধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে। আজ ভোরে যখন উঠ্‌লুম তখনো অশ্রান্ত বৃষ্টি। এইমাত্র স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি পশ্চিমদিকে আউষধানের ক্ষেতের উপর খুব সজল শ্যামল অবনত মেঘ স্তূপে স্তূপে স্তরে স্তরে জমে রয়েছে এবং পূর্ব্বদক্ষিণ দিকে মেঘ খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে রৌদ্র ওঠবার চেষ্টা করচে—রৌদ্রে বৃষ্টিতে খানিকক্ষণের জন্যে যেন সন্ধি হয়েছে। যেদিকে ছিন্ন মেঘের ভিতর দিয়ে সকালবেলাকার আলো বিচ্ছুরিত হয়ে বেরিয়ে আস্‌চে সেদিকে অপার পদ্মাদৃশ্যটি বড় চমৎকার হয়েছে। জলের রহস্যগর্ভ থেকে একটি স্নানশুভ্র অলৌকিক জ্যোতিঃপ্রতিমা উদিত হয়ে নীরব মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে; আর ডাঙার উপরে কালো মেঘ স্ফীতকেশর সিংহের মত ভ্রূকুটি করে ধান্যক্ষেত্রের মধ্যে থাবা মেলে দিয়ে চুপ করে বসে আছে—সে যেন একটি সুন্দরী দিব্যশক্তির কাছে হার মেনেছে কিন্তু এখনো পোষমানে নি—দিগন্তের এককোণে আপনার সমস্ত রাগ এবং অভিমান গুটিয়ে নিয়ে বসে আছে। এখনি আবার বৃষ্টি হবে তার লক্ষণ দেখা যাচ্চে; রীতিমত শ্রাবণের বর্ষণের উপক্রম হচ্চে। সুপ্তোত্থিত সহাস্য জ্যোতীরশ্মি যে মুক্তদ্বারের সাম্‌নে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই দ্বারটি আবার আস্তে আস্তে রুদ্ধ হয়ে আস্‌চে; পদ্মার ঘোলা জলরাশি ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে এসেছে; নদীর একতীর থেকে আরএক তীর পর্য্যন্ত মেঘের সঙ্গে মেঘ আবদ্ধ হয়ে সমস্ত আকাশ অধিকার করে নিয়েছে—খুব নিবিড় রকমের আয়োজনটা হয়েছে।

 এতদিনে আউষধান এবং পাটের ক্ষেত শূন্যপ্রায় হয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু এবারে দেবতার গতিকে ক্ষেতের সমস্ত শস্য ক্ষেতেই আন্দোলিত হচ্চে। দেখ্‌তে ভারি সুন্দর হয়েছে। বর্ষার আকাশ সজল মেঘে স্নিগ্ধ এবং পৃথিবী হিল্লোলিত শ্যামশস্যে কোমলা;—উপরে একটি গাঢ় রং এবং নীচেও একটি গাঢ় রঙের প্রলেপ; মাটি কোথাও অনাবৃত নয়; মাটির রংটি কেবল এই ঘোলা নদীর জলের মধ্যেই দেখা যাচ্চে। পদ্মা একএকটি দেশ প্রদেশ বহন করে নিয়ে চলেছে—ওর জলের মধ্যেই কত জমিদারের জমিদারী গুলিয়ে রয়েছে। পদ্মা ভীষণ কৌতুকে একরাজার রাজ্য হরণ করে আপন গেরুয়া আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে অন্য রাজার দরজার রাতারাতি থুয়ে আস্‌চে—শেষে প্রাতঃকালে রাজার রাজার লাঠালাঠি কাটাকাটি।