ছিন্নপত্র (১৯১২)/১১২
একটিমাত্র মানুষ কেবলমাত্র সাম্নে উপস্থিত থাকলেই প্রকৃতির অর্দ্ধেক কথা কানে আসে না। আমি দেখেছি থেকে থেকে টুক্রোটুক্রো কথাবার্ত্তা কওয়ার চেয়ে মানসিক শক্তির অপব্যয় আর কিছুতে হতে পারে না। দিনের পর দিন যখন একটি কথা না কয়ে কাটে তখন হঠাৎ টের পাওয়া যায় আমাদের চতুর্দ্দিকই কথা কচ্চে। আজ নদীর কলধ্বনির প্রত্যেক তরলল-কার আমার সর্ব্বাঙ্গে যেন কোমল আদর বর্ষণ করচে—মনটি আমার আজ অত্যন্ত নির্জ্জন এবং সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ; মেঘমুক্ত আলোকে উজ্জ্বল শস্যহিল্লোলিত জলকল্লোলিত চতুর্দ্দিকটার সঙ্গে মুখোমুখি বিশ্রব্ধ প্রীতিসম্মিলনের উপযুক্ত একটি নীরব গোপনতা আমার মধ্যে স্থিরভাবে বিরাজ করচে। আমি জানি আজ সন্ধ্যার সময় যখন কেদারা টেনে বোটের ছাতের উপর একলাটি বসব তখন আমার আকাশে আমার সেই সন্ধ্যাতারাটি ঘরের লোকের মত দেখা দেবে। আমি শীতের সময় যখন এই পদ্মাতীরে আস্তুম—কাছারি থেকে ফিরতে অনেক দেরি হত। বোট ওপারে বালির চরের কাছে বাঁধা থাক্ত—ছোট জেলেডিঙি চড়ে নিস্তব্ধ নদীটি পার হতুম—তখন এই সন্ধ্যাটি সুগম্ভীর অথচ সুপ্রসন্নমুখে আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকত। এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সেই আমার একটি মানসিক ঘরকন্নার সম্পর্ক। জীবনের যে গভীরতম অংশ সর্ব্বদা মৌন এবং সর্ব্বদা গুপ্ত, সেই অংশটি আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে এখানকার অনাবৃত সন্ধ্যা এবং অনাবৃত মধ্যাহ্ণের মধ্যে নীরবে এবং নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে বেড়িয়েছে;—এখানকার দিনগুলো তার সেই অনেক দিনের পদচিহ্ণের দ্বারা যেন অঙ্কিত।