সাজাদপুর। 
জানুয়ারী 
১৮৯০ 

 — কাজেই দুফুর বেলা পাগড়ি পরে কার্ডে নাম লিখে পাল্কী চড়ে জমিদারবারু চল্লেন। সাহেব তাঁবুর বারান্দায় বসে বিচার করচেন, দক্ষিণ পার্শ্বে পুলিসের চর। বিচারপ্রার্থীর দল মাঠে ঘাটে গাছতলায় পড়ে অপেক্ষা করে আছে—একেবারে তার নাকের সামনে পাল্কী নাবালে—সাহেব খাতির করে চৌকিতে বসালেন। ছোক্‌রাহেন, গোঁফের রেখা উঠ্‌ছে— চুল খুব কটা, মাঝে মাঝে এক্‌টু এক্‌টু কালো চুলের তালি দেওয়া—হঠাৎ মনে হয় বুড়ো মানুষ, অথচ মুখ নিতান্ত কাঁচা। সাহেবকে বল্লুম কাল রাত্রে আমার সঙ্গে খেতে এস তিনি বল্লেন আমি আজই আর এক জায়গায় যাচ্চি—Pig-sticking-এর যোগাড় করতে। বাড়ি চলে এলুম। ভয়ানক মেঘ করে এল-ঘোরতর ঝড়—মুষলধারে বৃষ্টি। বই ছুঁতে ইচ্ছে করছে না, কিছু লেখা অসম্ভব—মনের মধ্যে যাকে কবিত্বের ভাষার বলে, কি যেন কি ইত্যাদি। এ ঘর থেকে ও ঘরে পায়চারী করে বেড়াতে লাগ্‌লুম। অন্ধকার হয়ে এসেছে—গড়গড় শব্দে মেঘ ডাক্‌চে, বিদ্যুতের উপর বিদ্যুৎ—হু হু করে এক-একটা বাতাসের দম্‌কা আস্‌চে আর আমাদের বারান্দার সামনের বড় নীচু গাছটার ঘাড় ধরে যেন তার দাড়ি শুদ্ধ মাথাটা নাড়িয়ে দিচ্চে। দেখ্‌তে দেখ্‌তে বৃষ্টির জলে আমাদের শুক্‌নো খালটা প্রায় পূরে এল। এই রকম করে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ আমার মনে হল ম্যাজিষ্ট্রেট্‌কে এই বাদলায় আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে অনুরোধ করা আমার কর্ত্তব্য। চিঠি লিখে দিলুম। চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে ঘর তদারক কর্ত্তে গিয়ে দেখি, সে ঘরে দুটো বাঁশের ঝোলার উপর তাকিয়া গদি ময়লা লেপ টাঙান।— চাকরদের গুল টিকে তামাক, তাদেরই দুটো কাঠের সিন্ধুক—তাদেরই মলিন লেপ, ওয়াড়হীন তৈলাক্ত বালিশ ও মসীবর্ণ মাদুর, এক টুক্‌রো ছেঁড়া চট ও তার উপরে বিচিত্র জাতীর মলিনতা— কতকগুলো প্যাক্ বাক্সর মধ্যে নানাবিধ জিনিষের ভগ্নাবশেষ—যথা মরচেপড়া কাৎলির ঢাক্‌নি, তলাহীন ভাঙা লোহার উনুন, অত্যন্ত ময়লা একটা দস্তার চাদানি, ভাঙা সেজের কাঁচ ও ময়লা শামাদান, দুটো অকর্ম্মণ্য ফিল্‌টার, meatsafe, একটা সুপপ্লেটে খানিকটা পাতলা গুড়—ধুলো পড়ে পড়ে সেট গাঢ় হয়ে এসেছে, গোটা কতক ময়লা কালীবর্ণ ভিজে ঝাড়ন, কোণে বাসন ধোবার গাম্‌লা, গোফুর মিঞার একটা ময়লা কোর্ত্তা এবং পুরোনো মক্‌মলের Skull-cap, জলের দাগ তেলের দাগ দুধের দাগ কালো দাগ brown দাগ, শাদা দাগ এবং নানা মিশ্রিত দাগ বিশিষ্ট আয়নাহীন একটা জীর্ণ পোকাকাটা Dressing table;তার পায়াকটা ভাঙা, আয়নাটা অন্যত্র দেয়ালে ঠেসান্ দেওয়া, তার খোপের মধ্যে ধুলো, খড়্‌কে, ন্যাপকিন, পুরোণো তালা, ভাঙা গেলাসের তলা এবং সোডাওয়াটার বোতলের তার, কতকগুলো খাটের খুরো ভাঙা—ব্যাপার দেখে আমার চক্ষু স্থির—ডাক্‌ লোকজন, নিয়ে আয় নায়েব, ডেকে আন খাজাঞ্চি, যোগাড় কর কুলি, আন্‌ ঝাঁটা, আন জল, মই লাগা, দড়ি খোল্, বাঁশ খোল্, তাকিয়া লেপ কাঁথা টেনে ফেল্, ভাঙা কাঁচের টুক্‌রো গুলো খুঁটে খুঁটে তোল্, দেয়ালের পেরেকগুলো একে একে উপড়ে ফেল্—ওরে তোরা সব হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন, নে না এক্‌টা এক্‌টা করে জিনিষ নে না—ওরে ভাঙলেরে সব ভাঙলে —ঝন ঝন ঝনাৎ—তিনটে সেজ ভেঙে চুরমার্, খুঁটে খুঁটে তোল—ভাঙা চুপড়িগুলো এবং ছেঁড়া চট্‌টা বহুদিনসঞ্চিত ধুলোসমেত নিজের হাতে টেনে ফেলে দিলুম—নিচে থেকে পাঁচ ছটা আর্‌সলা সপরিবারে চতুর্দ্দিকে ছড়িয়ে পড়লেন তাঁরা আমারই সঙ্গে একান্নবর্ত্তী হয়ে বাস করছিলেন, আমার গুড়, আমার পাঁউরুটি এবং আমারই নতুন জুতোর বার্ণিশ তাঁদের উপজীবিকা ছিল। সাহেব লিখ্‌লেন “আমি এখনি যাচ্চি বড় বিপদে পড়েছি।” ওরে এলরে এল—চট্ পট্‌ কর। তার পরে—ঐ এসেছে সাহেব। তাড়াতাড়ি চুল দাড়ি সমস্ত ঝেড়ে ফেলে ভদ্র লোক হয়ে যেন কোন কাজ ছিলনা যেন সমস্ত দিন আরামে বসেছিলুম এই রকম ভাবে হলের ঘরে বসে রইলুম—সাহেবের সঙ্গে ঈষৎ হেসে হাত নাড়ানাড়ি করে অত্যন্ত নিশ্চিন্তভাবে গল্প কর্ত্তে লাগলুম—সাহেবের শোবার ঘরে কি হল এই চিন্তা ক্রমাগত মনের মধ্যে ঠেলে ঠেলে উঠ্‌তে লাগ্‌ল। গিয়ে দেখ্‌লুম এক রকম দাঁড়িয়ে গেছে; রাত্তিরটা ঘুমিয়ে কাট্‌তেও পারে যদি না সেই গৃহহীন আরসুলোগুলো রাত্তিরে তাঁর পায়ের তেলোয় সুড়সুড়ি দেয়।