ছিন্নপত্র (১৯১২)/১১

কলিকাতা 
জুন, ১৮৮৯ 

 গাড়ি ছাড়বার পর বে—চারিদিক চেয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল, ভাবলে এসংসারে কোথা থেকে আগমন, কোথায় গতি, জীবনের উদ্দেশ্য কি—ভাবতে ভাবতে ক্রমে দেখ্‌লুন ঘন ঘন হাই তুলতে লাগ্‌ল, তার পরে খানিক বাদে আমার কোলে মাথা রেখে পা ছড়িয়ে নিদ্রা আরম্ভ করে দিল। আমার মনেও সংসারের সুখদুঃখসম্বন্ধে নানাবিধ চিন্তার উদয় হয়েছিল, কিন্তু ঘুম এল না। সুতরাং আপন মনে ভৈরবী আলাপ করতে লাগলুম। ভৈরবী সুরের মোচড়গুলো কানে এলে জগতের প্রতি এক রকম বিচিত্র ভাবের উদয় হয়। মনে হয় একটা নিয়মের যন্ত্র-হস্ত অবিশ্রাম আর্গিন যন্ত্রের হাতা ঘোরাচ্চে এবং সেই ঘর্ষণ বেদনার সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মর্ম্মস্থল হতে একটা গম্ভীর কাতর করুণ রাগিণী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠচে। সকালবেলাকার সূর্য্যের সমস্ত আলো ম্লান হয়ে এসেচে, গাছপালা নিস্তব্ধ হয়ে কি যেন শুনচে, এবং আকাশ একটা বিশ্বব্যাপী অশ্রুর বাষ্পে যেন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে অর্থাৎ দূর আকাশের দিকে চাইলে মনে হয় যেন একটা অনিমেষ নীল চোখ কেবল ছলছল করে চেয়ে আছে।

 খিড়কি ষ্টেসনের কাছাকাছি আমাদের সেই আকের ক্ষেত, গাছের সার, টেনিস ক্ষেত্র, কাঁচের জানালা-মোড়া বাড়ি দেখতে পেলুম, দেখে মনটা ক্ষণকালের জন্য কেমন করে উঠল। এই এক আশ্চর্য্য! যখন এখানে বাস করতুম তখন এ বাড়ির উপরে যে সবিশেষ স্নেহ ছিল তা নয়—যখন এবাড়ি ছেড়ে। গিয়েছিলুম তখনও যে সবিশেষ কাতর হয়েছিলুম তাও বলতে পারিনে অথচ দ্রুতগতি ট্রেনের বাতায়নে বসে যখন কেবল নিমেষের মত দেখলুম সেই একলা বাড়ি তার থেলার জায়গা এবং ফাঁকা ঘরগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তখন সমস্ত হৃদয়টা বিদ্যুৎবেগে সেই বাড়ির উপরে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়ল, অমনি বুকের ভিতরে বাঁদিক থেকে ডান দিক পর্য্যন্ত ধক্‌করে একটা শব্দ হল, হুস্‌ করে গাড়ি চলে গেল, আকের ক্ষেত মিলিয়ে গেল—বাস্‌ সমস্ত ফুরোল—কেবল হঠাৎ ঘা খাওয়ার দরুণ মনের ছোট বড় দু চারটে তার প্রায় দেড় সুর আন্দাজ নেবে গেল। কিন্তু গাড়ির এঞ্জিন এ সকল বিষয়ে বড় একটা চিন্তা করে না, সে লোহার রাস্তার উপর দিয়ে এক রোখে চলে যায়, কোন্ লোক কোথায় কি ভাবে যাচ্চে, সে বিষয়ে তার খেয়াল করবার সময় নেই—সে কেবল গল গল করে জল খায় হুস্ হুস্ করে ধোঁয়া ছাড়ে, গাঁ গাঁ করে চীৎকার করে, এবং গড় গড় করে চলে যায়। সংসারের গতির সঙ্গে এর সুন্দর তুলনা দেওয়া যেতে পারত কিন্তু সেটা এত পুরোণো এবং অনাবশ্যক যে কেবল একবার নির্দ্দেশ করে ক্ষান্ত থাকা গেল। খাণ্ডালার কাছাকাছি এসে মেঘ এবং বৃষ্টি। সেই সব পাহাড়গুলোর উপর মেঘ জমে ঝাপ্‌সা হয়ে গেছে—ঠিক যেন কে পাথর এঁকে তার পরে রবার দিয়ে ঘসে দিয়েছে;খানিক খানিক outline দেখা যাচ্চে এবং খানিকটা পেন্সিলের দাগ চারিদিকে ধেবড়ে গেছে। অবশেষে গাড়ির ঘণ্টা দিলে—দূর থেকে গাড়ির নিদ্রাহীন লাল চক্ষু দেখা গেল, ধরণী থর থর করে কাঁপতে লাগল, ষ্টেষনের কর্তারা চটি জুতো, ঘুণ্টি দেওয়া চাপকান এবং টিকির উপরে তকমা দেওয়া গোল টুপি পরে নানা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল—বিপুল হাতল্যাণ্ঠণ চারিদিকে আলো নিক্ষেপ করতে লাগল—খানসানাবর্গ সচকিত হয়ে যে যার জিনিষপত্র আগলে দাড়াল, বে—ঘুমোতে লাগল। গাড়িতে উঠা গেল। * * * * বে —অকারণে খুঁত খুঁৎ আরম্ভ করলে —-বেলা বাড়তে লাগ্‌ল—যদিও রোদ্দুর নেই তবুও গরম বোধ হতে লাগ্‌ল, কিন্তু সময় আর কাটে না। প্রত্যেক মিনিটকে যেন স্পর্শ করে ঠেলে ঠেলে এগোতে হচ্ছে। সৌভাগ্য ক্রমে খানিক দূর গিয়ে ঘোরতর বৃষ্টি আরম্ভ হল—চারদিক বন্ধ করে কাঁচের জানালার কাছে বসে মেঘবৃষ্টি দেখ্‌তে বেশ লাগ্‌ল। এক জায়গার একটা বর্ষার নদীর কান্ড যে দেখলুম সে আর কি বল্‌ব—সে একেবারে ফুলে ফেঁপে ফেনিয়ে পাকিয়ে ঘুলিয়ে, ছুটে, মাথা খুঁড়ে, পাথর গুলোর উপরে পড়ে আছড়ে বিছড়ে তাদের ডিঙিয়ে, তাদের চারদিকে ঘুরপাক খেয়ে একটা কাণ্ড কর্ত্তে লাগ্‌ল। এরকম উন্মত্ততা আর কোথাও দেখিনি। সোহাগপুরে বিকেলে এসে যখন খেলুম তখন বৃষ্টি থেমেছে—যখন গাড়ি ছাড়লে তখন দেখলুম সূর্য্য অত্যন্ত রাঙা হয়ে মেঘের মধ্যে অস্ত যাচ্ছে। আমি ভাবছিলুম, খাওয়া দাওয়া গল্পস্বল্প খেলাধুলো পড়াশুনোর মধ্যে আর সবার সময় কেবল অলক্ষিতভাবে কেটে যাচ্চে, সময় তাদের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাচ্চে - তার অস্তিত্বই তারা টের পাচ্ছে না—আর আমি সময়ের উপরে সাঁতার কেটে চলেছি, সমস্ত অগাধ সময়টা আমার বুকে মুখে সর্ব্বাঙ্গে লাগ্‌চে। * * * * যথাসময়ে হাওড়ায় গাড়ি গিয়ে পৌঁছল। প্রথমে বাড়ির জমাদার তার পরে যো— তার পরে স— একে একে দৃষ্টিপথে পড়ল। তারপরে সেকেণ্ড ক্লাসের সেক্‌ড়া গাড়ির ছাতের উপরে গুটানো বিছানা, আয়ার দোম্‌ড়ানো টিনের বাক্স এবং নাবার টব (তার মধ্যে দুধের বোতল, লোটা, হাঁড়ি, টিন্‌পট্‌, পুঁটুলি ইত্যাদি) চাপিয়ে বাড়ি পৌছন গেল। একটা কলরব, লোকের ভিড়, দারোয়ানদের সেলাম, চাকরদের প্রণাম, সরকারদের নমস্কার, আমাদের মধ্যে কে মোটা হয়েছি কে রোগা হয়েছি সে সম্বন্ধে সাধারণের সম্পূর্ণ মতভেদ, বে— কে নিয়ে স্ব—এণ্ড কোম্পানির লুটোপুটি, চায়ের টেবিলে লোকসমাগম, স্নান, আহার ইত্যাদি।