ছিন্নপত্র (১৯১২)/১০

শিলাইদহ।
১৮৮৮

 শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সাম্‌নে আমাদের বোট লাগান আছে। প্রকাণ্ড চর—ধূ ধূ করচে—কোথাও শেষ দেখা যায় না—কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়—আবার অনেক সময়ে বালিকে নদী বলে ভ্রম হয়। গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই—বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটলধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুক্‌নো শাদা বালি। পূর্ব্বদিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে অনন্ত পাণ্ডুরতা। আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা। এমনতর desolation কোথাও দেখা যায় না। হঠাৎ পশ্চিমে মুখ ফেরাবামাত্র দেখা যায় স্রোতহীন ছোট নদীর কোল, ওপারে উঁচু পাড়, গাছপালা, কুটীর, সন্ধ্যাসূর্যালোকে আশ্চর্য্য স্বপ্নের মত। ঠিক যেন এক পারে সৃষ্টি, এবং আর এক পারে প্রলয়। সন্ধ্যাসূর্য্যালোক বলবার তাৎপর্য্য এই—সন্ধ্যার সময়ই আমরা বেড়াতে বেরই এবং সেই ছবিটাই মনে অঙ্কিত হয়ে আছে। পৃথিবী যে বাস্তবিক কি আশ্চর্য্য সুন্দরী তা কল্‌কাতায় থাক্‌লে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোট নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্চে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জ্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতিরাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্চে, জগৎসংসারে এ যে কি একটা আশ্চর্য্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাক্‌লে তবে বোঝা যায়। সূর্য্য আস্তে আস্তে ভোরের বেলা পূর্ব্বদিক থেকে কি এক প্রকাণ্ড গ্রন্থের পাতা খুলে দিচ্চে এবং সন্ধ্যায় পশ্চিম থেকে ধীরে ধীরে আকাশের উপরে যে এক প্রকাণ্ড পাতা উল্‌টে দিচ্চে সেই বা কি আশ্চর্য লিখন—আর, এই ক্ষীণ-পরিসর নদী আর এই দিগন্তবিস্তৃত চর, আর ওই ছবির মতন পরপার, ধরণীর এই উপেক্ষিত একটা প্রান্তভাগ—এই বা কি বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালা! যাক। এ কথাগুলো রাজধানীতে অনেকটা “পৈট্রির” মত শুন্‌তে হবে, কিন্তু এখানকার পক্ষে কথাগুলো কিছুমাত্র বেখাপ নয়।

 সন্ধ্যাবেলা এই বৃহৎ চরের মধ্যে ছাড়া পেয়ে অনুচরসমেত ছেলেরা একদিকে যায়, বলু একদিকে যায়, আমি একদিকে যাই, দুটি রমণী আর একদিকে যায়। ইতিমধ্যে সূর্য্য সম্পূর্ণ অস্ত যায়, আকাশের সুবর্ণ আভা মিলিয়ে যায়, অন্ধকারে চারিদিক অস্পষ্ট হয়ে আসে, ক্রমে আপনার পাশের ক্ষীণ ছায়া দেখে বুঝতে পারি, বাঁকা কৃশ চাঁদখানির আলো অল্প অল্প ফুটেছে। পাণ্ডুবর্ণ বালির উপরে এই পাণ্ডুবর্ণ জ্যোৎস্নায় চোখে আরো কেমন বিভ্রম জন্মিয়ে দেয়—কোথায় বালি, কোথায় জল, কোথায় পৃথিবী, কোথায় আকাশ নিতান্ত অনুমান করে নিতে হয়। কাজেই সবটা জড়িয়ে ভারি একটা অবাস্তবিক মরীচিকা-জগতের মত বোধ হয়। * * * * গতকল্য এই মায়া উপকূলে অনেকক্ষণ ধরে বিচরণ করে বোটে ফিরে গিয়ে দেখি ছেলেরা ছাড়া আমাদের দলের আর কেউ ফেরেন নি-আমি একখানি কেদারায় স্থির হয়ে বস্‌লুম—Animal Magnetism নামক একখানা অত্যন্ত ঝপ্‌সা subject-এর বই একটা বাতির ঝাপ্‌সা আলোতে বসে পড়তে আরম্ভ করলুম। কিন্তু কেউ আর ফেরেন না। বইখানাকে খাটের উপরে উপুড় করে বেরোলুম—উপরে উঠে চারিদিকে চেয়ে কাল মাথার কোন চিহ্ন দেখ্‌তে পেলুম না। সমস্ত ফেকাশে ধূ ধূ করচে। একবার বলু বলে পুরো জোরে চীৎকার করলুম—কণ্ঠস্বর হু হু কর্‌তে কর্‌তে দশ দিকে ছুটে গেল—কিন্তু কারো সাড়া পেলুম না। তখন বুকটা হঠাৎ চারদিক থেকে দমে গেল, একখানা বড় খোলা ছাতা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যেমনতর হয়। গোফুর আলো নিয়ে বেরোল—প্রসন্ন বেরোল—বোটের মাঝিগুলো বেরোল, সবাই ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন দিকে চল্লুম—আমি একদিকে বলু বলু করে চীৎকার করচি—প্রসন্ন আর একদিকে ডাক দিচ্চে “ছোট মা”——মাঝে মাঝে শোনা যাচ্চে মাঝিরা “বাবু” “বাবু” করে ফুক্‌রে উঠ্‌চে। সেই মরুভূমির মধ্যে নিস্তব্ধ রাত্রে অনেকগুলো আর্তস্বর উঠ্‌তে লাগ্‌ল। কারো সাড়া শব্দ নেই। গোফুর দুই একবার অতি দূর থেকে হেঁকে বল্লে—“দেখতে পেয়েছি” তার পরেই আবার সংশোধন করে বল্লে “না” “না”। আমার মানসিক অবস্থাটা একবার কল্পনা করে দেখ— কল্পনা করতে গেলে নিঃশব্দ রাত্রি, ক্ষীণ চন্দ্রালোক, নির্জ্জন নিস্তব্ধ শূন্য চর, দূরে গোফুরের চলনশীল একটী লণ্ঠনের আলো, মাঝে মাঝে এক এক দিক থেকে কাতর কণ্ঠের আহ্বান এবং চতুর্দ্দিকে তার উদাস প্রতিধ্বনি—মাঝে মাঝে আশার উন্মেষ এবং পর মুহূর্তেই সুগভীর নৈরাশ্য এই সমস্তটা মনে আন্‌তে হবে। অসম্ভব রকমের আশঙ্কাসকল মনে জাগ্‌তে লাগ্‌ল। কখন মনে হল চোরাবালিতে পড়েছে, কখন মনে হল বলুর হয়ত হঠাৎ মূর্চ্ছা কিংবা কিছু একটা হয়েছে—কখন বা নানাবিধ শ্বাপদ জন্তুর বিভীষিকা কল্পনায় উদয় হতে লাগ্‌ল। মনে মনে হতে লাগ্‌ল “আত্মরক্ষাঅসমর্থ যারা, নিশ্চিন্তে ঘটায় তারা পরের বিপদ।” স্ত্রীস্বাধীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠ্‌লুম। এমন সময়ে ঘণ্টাখানেক পরে রব উঠ্‌ল এঁরা চড়া বেয়ে বেয়ে ওপারে গিয়ে পড়েছেন আর ফিরতে পারচেন না। বোট ওপারে গেল—বোটলক্ষ্মী বোটে ফিরলেন—বলু বল্‌তে লাগ্‌ল “তোমাদের নিয়ে আমি আর কখনো বেরোব না”—সকলেই অনুতপ্ত শ্রান্তকাতর, সুতরাং আমার ভাল ভাল উপাদেয় ভর্ৎসনাবাক্য হৃদয়েই রয়ে গেল। পরদিন প্রাতঃকালে উঠেও কোনমতেই রাগ্‌তে পারলুম না।