দার্জিলিং ।
১৮৮৭

 এইত দার্জিলিং এসে পড়লুম। পথে বে—খুব ভাল রকম behave করেচে। বড় একটা কাঁদেনি। খুব চেঁচামেচি গোলমালও করেচে–উলুও দিয়েছে—হাতও ঘুরিয়েচে এবং পাখীকে ডেকেচে যদিও পাখী কোথায় দেখতে পাওয়া গেল না। সারাঘাটে ষ্টীমারে ওঠবার সময় মহা হাঙ্গাম। রাত্রি দশটা—জিনিষপত্র সহস্ৰ, কুলি গোটাকতক, মেয়ে মানুষ পাঁচটা এবং পুরুষ মানুষ একটি মাত্র। নদী পেরিয়ে একটী ছোট রেলগাড়িতে ওঠা গেল—তাতে চারটে করে শয্যা, আমরা ছটি মনিষ্যি। মেয়েদের এবং অন্যান্য জিনিষপত্র ladies compartment-এ তোলা গেল, কথাটা শুন্‌তে যত সংক্ষেপ হ’ল কাজে ঠিক তেমনটা হয়নি। ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি ছুটোছুটি নিতান্ত অল্প হয়নি—তবু ন—বলেন আমি কিছুই করিনি—অর্থাৎ একখান আস্ত মানুষ একেবারে আস্ত রকম খেপ্‌লে যে রকমটা হয় সেই প্রকার মূর্ত্তি ধারণ কর্‌লে ঠিক পুরুষ মানুষের উপযুক্ত হত। কিন্তু এই দুদিনে আমি এত বাক্স খুলেছি এবং বন্ধ করেচি এবং বেঞ্চির নীচে ঠেলে গুঁজেছি, এবং উক্ত স্থান থেকে টেনে বের করেচি, এত বাক্স এবং পুঁটুলির পিছনে আমি ফিরেচি এবং এত বাক্স এবং পুঁটুলি আমার পিছনে অভিশাপের মত ফিরেচে, এত হারিয়েচে এবং এত ফের পাওয়া গেছে এবং এত পাওয়া যায়নি এবং পাবার জন্য এত চেষ্টা করা গেছে এবং যাচ্ছে যে, কোন ছাব্বিশ বৎসর বয়সের ভদ্রসন্তানের অদৃষ্টে এমনটা ঘটেনি। আমার ঠিক বাক্স-phobia হয়েচে; বাক্স দেখলে আমার দাঁতে দাঁতে লাগে। যখন চারিদিকে চেয়ে দেখি বাক্স, কেবলি বাক্স, ছোট বড় মাঝারি, হাল্কা এবং ভারি, কাঠের এবং টিনের এবং পশুচর্ম্মের এবং কাপড়ের—নীচে একটা, উপরে একটা, পাশে একটা, পিছনে একটা—তখন আমার ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি এবং ছুটােছুটি করবার স্বাভাবিক শক্তি একেবারে চলে যায় এবং তখন আমার শূন্য দৃষ্টি, শুষ্ক মুখ এবং দীনভাব দেখ্‌লে নিতান্ত কাপুরুষের মত বোধ হয় অতএব আমার সম্বন্ধে ন—র যা মত দাঁড়িয়েচে তা ঠিক। যাক্, তার পরে আমি আর একটা গাড়িতে গিয়ে শুলুম। সে গাড়িতে আর দুটি বাঙালী ছিলেন। তাঁরা ঢাকা থেকে আস্‌চেন—তাঁদের মধ্যে একজনের মাথা টাকে প্রায় পরিপূর্ণ এবং ভাষা অত্যন্ত বাঁকা—তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনার পিতা দারজিলিঙ্গে ছিল?” লক্ষ্মী থাকলে এর যথোচিত উত্তর দিতে পারত—সে হয় ত বলত “তিনি দারজিলিঙ্গে ছিল কিন্তু তখন দারজিলিং বড় ঠাণ্ডা ছিলেন বলে তিনি বাড়ি ফিরে গেছে।” আমার উপস্থিতমত এক রকম বাংলা যোগাল না। * * * * * *

 সিলিগুড়ি থেকে দারজিলিং পর্যন্ত ক্রমাগত স—র উচ্ছ্বাস উক্তি। “ ও মা” “কি চমৎকার” “কি আশ্চর্য্য” “কি সুন্দর”—কেবলি আমাকে ঠেলে আর বলে “র- দেখ দেখ”। কি করি, যা দেখার তা দেখ্‌তেই হয়—কখন বা গাছ, কখন বা মেঘ, কখন বা একটা দুর্জ্জয় খাঁদা নাকওয়ালী পাহাড়ী মেয়ে—কখন বা এমন কত কি, যা দেখ্‌তে না দেখ্‌তেই গাড়ি চলে যাচ্ছে, এবং স— দুঃখ কচ্চে যে র- দেখ্‌তে পেলে না। গাড়ি চল্‌তে লাগল। ক্রমে ঠাণ্ডা, তার পরে মেঘ, তার পরে সর্দ্দি, তার পরে হাঁচি, তার পরে শাল, কম্বল, বালাপোষ, মোটা মোজা, পা কন্ কন্, হাত ঠাণ্ডা, মুখ নীল, গলা ভার-ভার এবং ঠিক তার পরেই দারজিলিং। আবার সেই বাক্স, সেই ব্যাগ, সেই বিছানা, সেই পুঁটুলি, মোটের উপর মোট, মুটের উপর মুটে। ব্রেক থেকে জিনিষ পত্র দেখে নেওয়া, চিনে নেওয়া, মুটের মাথায় চাপান, সাহেবকে রসিদ দেখান, সাহেবের তর্ক বিতর্ক, জিনিষ খুঁজে না পাওয়া এবং সেই হারান জিনিষ পুনরুদ্ধারের জন্য বিবিধ বন্দোবস্ত করা, এতে আমার ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল।