ছিন্নপত্র (১৯১২)/১২০
পতিসর,
১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪।
ভাদ্রমাসের দিন, বাতাস বেশি নেই; বোটের শিথিল পাল ঝুলে ঝুলে পড়চে—নৌকাটি আলস্যমন্থরগমনে অত্যন্ত উদাসীনের মত চলেছে। এই শৈবালবিকীর্ণ সুবিস্তীর্ণ জলরাজ্যের মধ্যে শরতের উজ্জ্বল রৌদ্রে আমি জানালার কাছে এক চৌকিতে বসে আর এক চৌকির উপরে পা দিয়ে সমস্ত বেলা কেবল গুন্ গুন্ করে গান করচি। রামকেলী প্রভৃতি সকালবেলাকার সুরের একটু আভাস লাগাবামাত্র এমন একটি বিশ্বব্যাপী করুণা বিগলিত হয়ে চারিদিককে বাষ্পাকুল করচে যে এই সমস্ত রাগিণীকে সমস্ত আকাশের সমস্ত পৃথিবীর নিজের গান বলে মনে হচ্চে। এ একটা ইন্দ্রজাল, একটা মায়ামন্ত্র। আমার এই গুন্ গুন্ গুঞ্জরিত সুরের সঙ্গে কত টুক্রো টুক্রো কথা যে আমি জুড়ি তার সংখ্যা নেই। এমন একলাইনের গান সমস্তদিন কত জম্চে এবং কত বিসর্জ্জন দিচ্চি। এই চৌকিটাতে বসে আকাশ থেকে সোনালি রোদ্দুরটুকু চোখ দিয়ে চাখ্তে চাখ্তে এবং জলের উপরকার শৈবালের সরস কোমলতার উপর মনটাকে বুলিয়ে চল্তে চল্তে যতটুকু অনায়াস আলস্যভরে আপনি মাথায় এসে পড়ে তার বেশি চেষ্টা করা আপাতত আমার সাধ্যাতীত। আজ সমস্ত সকাল নিতান্ত সাদাসিধা রামকেলীতে যে গোটা দুইতিন ছত্র বারবার আবৃত্তি করেছিলুম সেটুকু মনে আছে—নমুনাস্বরূপ উদ্ধৃত করে দিলুম:—
ওগো তুমি নবনবরূপে এস প্রাণে!—(আমার নিত্যনব)
এস গন্ধে বরণেগানে!
আমি যেদিকে নিরখি তুমি এসহে
আমার মুগ্ধমুদিত নয়ানে।