ছিন্নপত্র (১৯১২)/১২১
দিঘাপতিয়া জল পথে,
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪।
বড় বড় গাছ জলের মধ্যে সমস্ত গুঁড়িটি ডুবিয়ে দিয়ে শাখাপ্রশাখা জলের উপর অবনত করে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আম গাছ বটগাছের অন্ধকার জঙ্গলের ভিতর নৌকা বাঁধা, এবং তারি মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে গ্রামের লোকেরা স্নান করচে। এক একটি কুঁড়েঘর স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে—তার চারপাশের প্রাঙ্গণ জলমগ্ন। ধানের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বোট সরসর শব্দে যেতে যেতে হঠাৎ কোনো জলাশয়ের মধ্যে গিয়ে পড়ে—সেখানে নালবনের মধ্যে শাদা শাদা নালফুল ফুটে আছে—পানকৌড়ি জলের ভিতর ডুব দিয়ে দিয়ে মাছ ধরচে। জল যেখানে সুবিধা পাচ্চে প্রবেশ করছে—স্থলের এমন পরাভব আর কোথাও দেখা যায় না। আর একটু জল বাড়লেই ঘরের ভিতরে জল প্রবেশ করবে, তখন মাচা বেঁধে তার উপরে বাস করতে হবে; গরুগুলো দিনরাত একহাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরবে; রাজ্যের সাপ জলমগ্ন গর্ত্ত ত্যাগ করে ঘরের চালে আশ্রর নেবে এবং যেখানকার যত গৃহহীন কীটপতঙ্গ সরীসৃপ মানুষের সহবাস গ্রহণ করবে। যখন গ্রামের চারিদিকের জঙ্গলগুলো জলে ডুবে পাতালতাগুল্মে পচ্তে থাকে, গোয়ালঘর ও লোকালয়ের বিবিধ আবর্জ্জনা চারিদিকে ভেসে বেড়ায়, পাট পচানির গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত, উলঙ্গ পেটমোটা পা-সরু রুগ্ন ছেলে-মেয়েরা যেখানে সেখানে জলেকাদায় মাখামাখি ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে—মশার ঝাঁক স্থির জলের উপর একটি বাষ্পস্তরের মত ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ায়; গৃহস্থের মেয়েরা ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাদলার ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজ্তে ভিজ্তে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে জল ঠেলে ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মত ঘরকন্নার নিত্যকর্ম্ম করে যায় তখন সে দৃশ্য কোনোমতেই ভাল লাগে না। ঘরে ঘরে বাতে ধরচে, পা ফুল্চে, সর্দি হচ্চে, জ্বরে ধরচে, পিলেওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদচে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারচে না—এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য্য, দারিদ্র্য, মানুষের বাসস্থানে কি এক মুহূর্ত্ত সহ্য হয়? সকল রকম শক্তির কাছেই আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। প্রকৃতি উপদ্রব করে তাও সয়ে থাকি, রাজা উপদ্রব করে তাও সই, শাস্ত্র চিরদিন ধরে যে সকল উপদ্রব করে আস্চে তার বিরুদ্ধেও কথাটি বল্তে সাহস হয় না।