ছিন্নপত্র (১৯১২)/১২৯
প্রথম শীতের আরম্ভে সমস্ত দিন ধরে যে একটা উত্তরে বাতাস দিতে থাকে সেইটে আজ সকাল থেকে সুরু হয়েছে। বাতাসটা হীহী করতে করতে আসচে আর আমলকি তরুশ্রেণীর পাতাগুলি হলদে হয়ে উঠে কাঁপতে কাঁপতে ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্চে। এখানকার বনরাজ্যের মধ্যে যেন খাজনা আদায়ের পেয়াদা এসেছে—সমস্ত কাঁপচে, ঝরচে এবং দীর্ঘনিশ্বাসে আকুলিত হয়ে উঠচে। দুপুরবেলাকার রৌদ্রক্লান্ত বিশ্রামপূর্ণ বৈরাগ্যে, ঘন আম্রশাখায় ঘুঘুর অবিশ্রামকূজনে এই ছায়ালোকখচিত স্বপ্নাতুর প্রহরগুলাকে যেন বিরহবিধুর করে তুলচে। আমার টেবিলের উপরকার ঘড়ির শব্দটাও এই মধ্যাহ্ণের সুরের সঙ্গে যেন তাল রেখে চলেছে, ঘরের ভিতরে সমস্ত দুপুরবেলাটা কাঠবিড়ালীর ছুটাছুটি চলছে। ফুলো ল্যাজ, কালো এবং ধূসর রেখায় অঙ্কিত রোমশ নরম গা, ছোট দুটি কালো ফোঁটার মত দুটি চঞ্চল চোখ, নিতান্তই নিরীহ অথচ অত্যন্ত কেজো লোকের মত ব্যস্ত ভাবটা দেখে আমার বেশ মজা লাগে। এই ঘরের কোণে লোহার জাল দেওয়া আলমারিতে ডাল চাল প্রভৃতি আহার্য্য সামগ্রী এই সমস্ত লোভীদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়—ঔৎসুক্যব্যগ্র নাসিকাটি নিয়ে তারা সারাদিন এই আলমারিটার চারিদিকে ছিদ্র খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্চে। দু চারটা কণা যা আলমারির বাইরে বিক্ষিপ্ত থাকে সেইগুলিকে সন্ধান করে নিয়ে সামনের গুটিকয়েক ছোট তীক্ষ্ণ দন্ত দিয়ে কুট্কুট্ করে ভারি তৃপ্তির সঙ্গে তারা আহার করে; মাঝে মাঝে লেজের উপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে বসে’ সামনের দুটি হাত জোড় করে’ সেই শস্যকণাগুলিকে মুখের মধ্যে গুছিয়েগাছিয়ে জুৎ করে নিতে থাকে,—এমন সময় আমি একটুখানি নড়েছি কি অমনি চকিতের মধ্যে লেজটি পিঠের উপর তুলে দিয়ে দে-দৌড়। যেতে যেতে হঠাৎ একবার অর্দ্ধপথে পাপোষটার উপর থেমে একটা পা তুলে ফস্ করে একটা কাণ চুলকে নিয়ে আবার এসে উপস্থিত—এমনি সমস্ত বেলাই কুট্কাট্ দুড্দুড়্ এবং তৈজসপত্রের মধ্যে টুংটাং ঝুন্ঝুন্ চলচেই।