ছিন্নপত্র (১৯১২)/১৩০
ছেলেবেলা থেকে ঐ ফেরিওয়ালার হাঁকগুলো আমাকে কেমন একটু বিচলিত করে, নিস্তব্ধ দুপুর বেলায় চীলের তীক্ষ্ণ ডাকটাও আমাকে যেন উদাস করে দিত। অনেকদিন সেই ডাকটা আমার কানে আসে নি। আজকাল যে চিল ডাকে না তা নয়—আমারই এখন চিন্তা বেশি কাজও ঢের; প্রকৃতির সঙ্গে আর আমার সে রকম ঘনিষ্ঠ যোগ নেই। এখন সময় ফেলে রাখা চলে না; যদি বা মনের গতিকে কোনো বিশেষ কাজ করতে প্রবৃত্তি না হয় তবু একটা কাজের চেষ্টা করতে হয়, নিদেন অন্যমনস্কভাবেও একটা বই পড়বার ভান না করলে মন সুস্থ থাকে না।—এটা কিন্তু কলকাতায়। মফস্বলে গেলে চুপ করে চেয়ে থাকলেও হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, কাজের অন্ধ দাসত্ব করতে হয় না। কর্ত্তব্য কাজের বিরুদ্ধে কিছু বলতেই সাহস করিনে কিন্তু যখন উপস্থিত কোনো কাজ নেই কিম্বা ভাল করে সম্পন্ন করবার শক্তি নেই তখনো কেবল অভ্যাসবশতঃ বা সময়যাপনের তাগিদে যদি কাজ খুঁজে বেড়াতে হয়, তখনো যদি আপনাকে নিয়ে আপনি শান্তি না পাওয়া যায়, তাহলে অবস্থাটা খারাপ হয়েছে বলতে হবে। কাজ একটা উদ্দেশ্যসাধনের উপায়মাত্র; মানুষত কাজের যন্ত্র নয়, পরিপূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে বিরামলাভ করবার শক্তিটা একেবারে হারানো ত কিছু নয়, কেননা তার মধ্যে মনুষ্যত্বের একটা উচ্চ অধিকার আছে। দিন ও রাত্রি কাজ ও বিরামের উপমা। দিনের বেলায় পৃথিবী ছাড়া আর আমাদের কিছুই নেই, রাত্রে পৃথিবীটাই কম, অনন্ত জ্যোতিস্ক-জগৎটাই বেশি। তেমনি কাজের দিনে যুক্তিতর্কের আলোকে পৃথিবীটাকেই খুব স্পষ্ট করে চোখের সামনে রাখা চাই—কিন্তু যখন বিশ্রামের সন্ধ্যা তখন পৃথিবীটাকে হ্রাস করে দেওয়াই দরকার, তখন বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যে বিরাট যোগ আছে সেইটেকেই বড় করে দেখা চাই। সকালবেলায় উঠে জানা চাই আমরা পৃথিবীর মানুষ, দিন অবসান হয়ে এলে অনুভব করা চাই আমরা জগৎবাসী।