পতিসর 
১৮৯১। 

 আমার বোট কাছারির কাছ থেকে অনেক দূরে এনে একটি নিরিবিলি জায়গায় বেঁধেছি। এ দেশে গোলমাল কোথাও নেই, ইচ্ছে করলেও পাওয়া যায় না, কেবল হয়ত অন্যান্য বিবিধ জিনিসের সঙ্গে হাটে পাওয়া যেতে পারে।—আমি এখন যেখানে এসেছি এ জায়গায় অধিকন্তু মানুষের মুখ দেখা যায় না। চারিদিকে কেবল মাঠ ধূ ধূ করচে—মাঠের শস্য কেটে নিয়ে গেছে, কেবল কাটা ধানের গোড়াগুলিতে সমস্ত মাঠ আচ্ছন্ন। সমস্ত দিনের পর সূর্য্যাস্তের সময় এই মাঠে কাল একবার বেড়াতে বেরিয়েছিলুম। সূর্য্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষরেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। চারিদিক কি যে সুন্দর হয়ে উঠ্‌ল সে আর কি বল্‌ব। বহুদূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটু গাছপালার ঘের দেওয়া ছিল, সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠ্‌ল, নীলেতে লালেতে মিশে এমন আব্‌ছায়া হয়ে এল, —মনে হল ঐখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি, ঐখানে গিয়ে সে আপনার রাঙা আঁচলটি শিথিলভাবে এলিয়ে দেয়, আপনার সন্ধ্যাতারাটি যত্ন করে জ্বালিয়ে তোলে, আপন নিভৃত নির্জ্জনতার মধ্যে সিদুর পরে’ বধূর মত কার প্রতীক্ষায় বসে থাকে, এবং বসে বসে পা দুটি মেলে’ তারার মালা গাঁথে এবং গুন্ গুন্ স্বরে স্বপ্ন রচনা করে। সমস্ত অপার মাঠের উপর একটি ছায়া পড়েছে— একটি কোমল বিষাদ—ঠিক অশ্রুজল নয়—একটি নির্নিমেষ চোখের বড় বড় পল্লবের নীচে গভীর ছল্‌ছলে ভাবের মত। এমন মনে করা যেতে পারে— মা পৃথিবী লোকালয়ের মধ্যে আপন ছেলে-পুলে এবং কোলাহল এবং ঘরকর্‌নার কাজ নিয়ে থাকে, যেখানে একটু ফাঁকা, একটু নিস্তব্ধতা, একটু খোলা আকাশ, সেইখানেই তার বিশাল হৃদয়ের অন্তর্নিহিত বৈরাগ্য এবং বিষাদ ফুটে ওঠে, সেইখানেই তার গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস শোনা যায়। ভারতবর্ষে যেমন বাধাহীন পরিষ্কার আকাশ, বহুদূরবিস্তৃত সমতলভূমি আছে এমন য়ুরোপের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এই জন্যে আমাদের জাতি যেন বৃহৎ পৃথিবীর সেই অসীম বৈরাগ্য আবিষ্কার করতে পেরেছে,—এই জন্যে আমাদের পূরবীতে কিম্বা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের অন্তরের হা হা ধ্বনি যেন ব্যক্ত করচে, কারো ঘরের কথা নয়। পৃথিবীর একটা অংশ আছে, যেটা কর্ম্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ, তার ভাবটা আমাদের মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করবার অবসর পায়নি; পৃথিবীর যে ভাবটা নির্জ্জন বিরল অসীম, সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে। তাই সেতারে যখন ভৈরবীর মীড় টানে আমাদের ভারতবর্ষীয় হৃদয়ে একটা টান পড়ে। কাল সন্ধের সময় নির্জ্জন মাঠের মধ্যে পূরবী বাজ্‌ছিল, পাঁচ ছ ক্রোশের মধ্যে কেবল আমি একটি প্রাণী বেড়াচ্ছিলুম, এবং আর একটি প্রাণী বোটের কাছে পাগড়ি বেঁধে লাঠি হাতে অত্যন্ত সংযতভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার বাঁ পাশে ছোট্ট নদীটি দুই ধারের উঁচু পাড়ের মধ্যে এঁকেবেঁকে খুব অল্প দূরেই দৃষ্টিপথের বার হয়ে গেছে, জ্বলে ঢেউয়ের রেখামাত্র ছিলনা, কেবল সন্ধ্যার আভা অত্যন্ত মুমূর্ষু হাসির মত খানিকক্ষণের জন্যে লেগে ছিল। যেমন প্রকাণ্ড মাঠ, তেমনি প্রকাণ্ড নিস্তব্ধতা; কেবল একরকম পাখী আছে তারা মাটিতে বাসা করে’ থাকে, সেই পাখী, যত অন্ধকার হয়ে আস্‌তে লাগ্‌ল তত আমাকে তার নিরালা বাসার কাছে ক্রমিক আনাগোনা করতে দেখে ব্যাকুল সন্দেহের স্বরে টী টী করে ডাক্‌তে লাগ্‌ল। ক্রমে এখানকার কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো ঈষৎ ফুটে উঠ্‌ল বরাবর নদীর ধারে ধারে মাঠের প্রান্ত দিয়ে একটা সঙ্কীর্ণ পথচিহ্ন চলে গেছে, সেইখানে নতশিরে চল্‌তে চল্‌তে ভাব্‌ছিলুম।