ছিন্নপত্র (১৯১২)/১৫

কালিগ্রাম 
৫ই মাঘ, 
১৮৯১। 

 বেশ কুঁড়েমি করবার মত বেলাটা। কেউ তাড়া দেবার লোক নেই, তা ছাড়া প্রজা এবং কাজের ভিড় এখনো চতুর্দ্দিকে ছেঁকে ধরেনি। সবসুদ্ধ খুব ঢিলে-ঢিলে একলা—একলা কি—একরকম মনে হচ্চে। যেন পৃথিবীতে অত্যাবশ্যক কাজ বলে একটা কিছুই নেই—এমন কি, নাইলেও চলে, না নাইলেও চলে, এবং ঠিক সময়মত খাওয়াটা কল্‌কাতার লোকের মধ্যে প্রচলিত একটা বহুদিনের কুসংস্কার বলে মনে হয়। এখানকার চতুর্দ্দিকের ভাবগতিকও সেই রকম। একটা ছোট্ট নদী আছে বটে কিন্তু তাতে কানাকড়ির স্রোত নেই, সে যেন আপন শৈবালদামের মধ্যে জড়ীভূত হয়ে অঙ্গবিস্তার করে দিয়ে পড়ে পড়ে ভাব্‌চে যে যদি না চল্লেও চলে তবে আর চলবার দরকার কি? জলের মাঝে মাঝে যে লম্বা ঘাস এবং জলজ উদ্ভিদ জন্মেছে, জেলেরা জাল ফেল্‌তে না এলে সেগুলো সমস্ত দিনের মধ্যে একটু নাড়া পায় না। পাঁচটা ছটা বড় বড় নৌকা সারি সারি বাঁধা আছে—তার মধ্যে একটার ছাতের উপর একজন মাঝি আপাদমস্তক কাপড় মুড়ে রোদ্দুরে নিদ্রা দিচ্চে—আর একটার উপর একজন বসে বসে দড়ি পাকাচ্চে এবং রোদ্ পোহাচ্চে, দাঁড়ের কাছে একজন আধ-বৃদ্ধ লোক অনাবৃতগাত্রে বসে অকারণে আমাদের বোটের দিকে চেয়ে আছে; ডাঙার উপরে নানান্‌ রকমের নানান্ লোক অত্যন্ত মৃদুমন্দ অলস চালে কেন যে আস্‌চে, কেন যে যাচ্চে, কেন যে বুকের মধ্যে নিজের দুটো হাঁটুকে আলিঙ্গন করে ধরে উবু হয়ে বসে আছে, কেন যে অবাক হয়ে বিশেষ কোন কিছুর দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কোন অর্থ পাওয়া যায় না। কেবল গোটাকতক পাতি হাঁসের ওরি মধ্যে একটু ব্যস্ত ভাব দেখা যাচ্চে—তারা ভারি কলরব করচে, এবং ক্রমাগতই উৎসাহসহকারে জলের মধ্যে মাথা ডুবোচ্চে, এবং তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে নিয়ে সবলে ঝাড়া দিচ্চে। ঠিক মনে হচ্চে যেন তারা জলের নীচেকার নিগূঢ় রহস্য আবিষ্কার করবার জন্যে প্রতিক্ষণেই গলা বাড়িয়ে দিচ্চে এবং তার পরে সবেগে মাথা নেড়ে বল্‌চে, “কিছুই না—কিছুই না!” এখানকার দিনগুলো এইরকম বারো ঘণ্টা পড়ে পড়ে কেবল রোদ পোহায়, এবং অবশিষ্ট বারো ঘণ্টা খুব গভীর অন্ধকার মুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে নিদ্রা দেয়। এখানে সমস্তক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে চেয়ে কেবল নিজের মনের ভাবগুলোকে বসে বসে দোলা দিতে ইচ্ছে করে, তার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু গুন গুন করে গান গাওয়া যায়, মাঝে মাঝে বা ঘুমে চোখ একটু অলস হয়ে আসে। মা যেমন করে শীতকালের সারা বেলা রোদ্দরে পিঠ দিয়ে ছেলে কোলে করে গুন্‌ গুন্‌ স্বরে দোলা দেয়, সেই রকম।