ছিন্নপত্র (১৯১২)/১৬
পতিসর
৭ই মাঘ,
১৮৯১।
ছোট নদীটি ঈষৎ বেঁকে এইখানে একটুখানি কোণের মত একটু কোলের মত তৈরি করেছে—দুই ধারের উঁচু পাড়ের মধ্যে সেই কোলের কোণটুকুতে বেশ প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকি—একটু দূর থেকে আমাদের আর দেখা যায় না। নৌকাওয়ালারা উত্তর দিক থেকে গুণ টেনে টেনে আসে, হঠাৎ একটা বাঁক ফিরেই এই জনহীন মাঠের ধারে অকারণে একটা মস্ত বোট বাঁধা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে যায়। “হাঁ গাঁ, কাদের বজ্রা গা?” “জমিদার বাবুর।” “এখানে কেন? কাছারির সাম্নে কেন বাঁধনি?” “হাওয়া খেতে এসেছেন।”—এসেছি হাওয়ার চেয়ে আরো ঢের বেশী কঠিন জিনিষের জন্য। যাহোক্ এরকম প্রশ্নোত্তর প্রায় মাঝে মাঝে শুন্তে পাওয়া যায়। এইমাত্র খাওয়া শেষ করে বসেচি—এখন বেলা দেড়টা। বোট খুলে দিয়েছে, আস্তে আস্তে কাছারির দিকে চলেছে। বেশ একটু বাতাস দিচ্চে। তেমন ঠাণ্ডা নয়—দুপুরবেলার তাতে অল্প গরম হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে ঘন শৈবালের মধ্যে দিয়ে যেতে খস্ খস্ শব্দ হচ্চে। সেই শৈবালের উপরে অনেকগুলো ছোট ছোট কচ্ছপ আকাশের দিকে সমস্ত গলা বাড়িয়ে দিয়ে রোদ পোহাচ্চে। অনেক দূরে দূরে একটা একটা ছোট ছোট গ্রাম আসচে। গুটিকতক খোড়ো ঘর—কতকগুলি চালশূন্য মাটির দেয়াল, দুটো একটা খড়ের স্তূপ, কুলগাছ, আমগাছ, বটগাছ এবং বাঁশের ঝাড়, গোটাতিনেক ছাগল চরচে, গোটাকতক উলঙ্গ ছেলেমেয়ে—নদীপর্য্যন্ত একটি গড়ানে কাঁচা ঘাট, সেখানে কেউ কাপড় কাচ্চে, কেউ নাইচে, কেউ বাসন মাজ্চে; কোন কোন লজ্জাশীলা বধূ দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসী কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করচে, তার হাঁটুর কাছে আঁচল ধরে একটি সদ্যস্নাত তৈলচিক্কণ বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টে বর্ত্তমান পত্রলেখকসম্বন্ধে কৌতূহল নিবৃত্তি করচে—তীরে কতকগুলো নৌকো বাঁধা এবং একটা পরিত্যক্ত প্রাচীন জেলেডিঙি অর্দ্ধনিমগ্ন অবস্থায় পুনরুদ্ধারের প্রতীক্ষা করচে। তার পরে আবার অনেকটা দূর শস্যশূন্য মাঠ—মাঝে মাঝে কেবল দুই একজন রাখালশিশুকে দেখ্তে পাওয়া যায়, এবং দুটো একটা গরু নদীর ঢালু তটের শেষ প্রান্ত পর্য্যন্ত এসে সরস তৃণ অন্বেষণ করচে দেখা যায়। এখানকার দুপুরবেলার মত এমন নির্জ্জনতা নিস্তব্ধতা আর কোথাও নেই।