পাবনা পথে,
৯ জুলাই, ১৮৯৫।

 এই আঁকাবাকা ইছামতী নদীর ভিতর দিয়ে চলেছি। এই ছোট খামখেয়ালী বর্ষাকালের নদীটি, এই যে দুইধারে সবুজ ঢালুঘাট, দীর্ঘ ঘন কাশবন, পাটের ক্ষেত, আখের ক্ষেত, আর সারি সারি গ্রাম—এ যেন একই কবিতার কয়েকটা লাইন, আমি বারবার আবৃত্তি করে যাচ্চি এবং বারবারই ভাল লাগ্‌চে। পদ্মার মত বড় নদী এতই বড় যে সে যেন ঠিক মুখস্থ করে নেওয়া যায় না—আর এই কেবল ক’টি বর্ষামাসের দ্বারা অক্ষরগোণা ছোট বাঁকা নদীটি যেন বিশেষ করে আমার হয়ে যাচ্চে।

 পদ্মানদীর কাছে মানুষের লোকালয় তুচ্ছ কিন্তু ইছামতী মানুষ-ঘেঁসা নদী;—তার শান্ত জলপ্রবাহের সঙ্গে মানুষের কর্ম্ম প্রবাহের স্রোত মিশে যাচ্চে। সে ছেলেদের মাছ ধরবার এবং মেয়েদের স্নান করবার নদী। স্নানের সময় মেয়েরা যে সমস্ত গল্পগুজব নিয়ে আসে সেগুলি এই নদীটির হাস্যময় কলধ্বনির সঙ্গে একসুরে মিলে যায়। আশ্বিনমাসে মেনকার ঘরের পার্ব্বতী যেমন কৈলাসশিখর ছেড়ে একবার তাঁর বাপের বাড়ি দেখে শুনে যান ইছামতী তেমনি সম্বৎসর অদর্শন থেকে বর্ষার কয়েকমাস আনন্দহাস্য করতে করতে তার আত্মীয় লোকালয়গুলির তত্ত্ব নিতে আসে। তারপরে ঘাটে ঘাটে মেয়েদের কাছে প্রত্যেক গ্রামের সমস্ত নূতন খবর শুনে নিয়ে, তাদের সঙ্গে মাখামাখি সখীত্ব করে আবার চলে যার।

 সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশ মেঘে অন্ধকার; গুরুগুরু মেঘ ডাকচে, এবং ঝোড়ো হাওয়ায় তীরের বনঝাউগুলো দুলে উঠ্‌ছে। বাঁশঝাড়ের মধ্যে ঘন কালীর মত অন্ধকার এবং জলের উপর গোধূলির একটা বিবর্ণ ধূসর আলো পড়ে একটা অস্বাভাবিক উত্তেজনার মত দেখ্‌তে হয়েছে। আমি ক্ষীণালোকে কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে চিঠি লিখ্‌চি—উচ্ছৃঙ্খল বাতাসে টেবিলের সমস্ত কাগজ পত্র উড়িয়ে ছড়িয়ে ফেলবার উপক্রম করচে। ছোট নদীটির উপরে ঘনবর্ষার সমরোহের মধ্যে একটি চিঠি লিখতে ইচ্ছা করচে—মেঘলা গোধূলিতে নিরালা ঘরে মৃদুমন্দ স্বরে গল্প করে যাবার মত চিঠি। কিন্তু এটা একটা ইচ্ছামাত্র। মনের এইরকম সহজ ইচ্ছাগুলিই বাস্তবিক দুঃসাধ্য। সে গুলি, হয় আপনি পূর্ণ হয়, নয় কিছুতে পূর্ণ হয় না—তাই অনেক সময় যুদ্ধ জমানো সহজ, গল্প জমানো সহজ নয়।